'একটা কোনো মৃত্যু অনেক পুরোনো মৃত্যুর ছায়া সঙ্গে বয়ে আনে, আনতে পারে'— লিখছেন শঙ্খ ঘোষ। (পুরোনো চিঠির ঝাঁপি, পৃ.২৫) অশ্রুবাবুর মৃত্যু আমার মনে তেমনি অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। মনে পড়ছে একদা লিখেছিলাম— 'মৃত্যুর সঙ্গে কথোপকথন' শিরোনামাঙ্কিত কয়েকটি কবিতা। সেই অর্থে আমি তাঁর ছাত্র নই, স্নেহ সান্নিধ্য ব্যক্তিগত স্তরেও আসেনি। কিন্তু প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য যেমন লিখছেন শঙ্খ ঘোষকে, বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যু সম্পর্কে, আমিও তাই বলতে পারি, হয়ত। 'হঠাৎ বুদ্ধদেবের মৃত্যু ছিঁড়ে দিলো, পালটে দিলো সমস্ত কিছু... পাঠক হিসেবে বরং মতান্তর — মৌলিক মতভেদ হোত বহুক্ষেত্রেই, কিন্তু তবু ব্যক্তিগত, নিরেট শূন্যতা বোধ করছি আমি।' (পূর্বোক্ত, পৃ.২৩) 'শিশুতীর্থের পরিপ্রেক্ষিত' 'পরিচয়ে' অশ্রুবাবুর এই লেখা পড়ে আবাক হয়ে গিয়েছিলাম ছাত্রজীবনে। তারপর — লেখার পর লেখা তাঁর আগ্রহের আগ্রাসনে আমাকে আবিষ্ট করেছে বহুকাল। 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকায় যখন লেখার জন্য বেছে নিই 'আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস' তখন তাঁর প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে আমার আনন্দকে ব্যক্ত করতে করতে বলেছিলাম দুটি অপ্রিয় কথা (ক. প্রবন্ধগুলি যেন প্রাবন্ধিকের সংকলন মাত্র, খ. বইটার যা নাম তাতে প্রত্যাশিত ছিল বাংলা উপন্যাসে, সাধারণভাবে উপন্যাসে আধুনিকতা নিয়ে কিছু কথা, যা নেই) তাতে উনি কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, দেখা হলেও কথা বলেননি বেশ কিছুকাল। তারপর 'আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়'-- যাতে আমার প্রত্যাশা পূরণ হল বহুগুণে। কখন যেন স্থানিক দূরত্বের সম্পর্ক কেটে গেল এবং পাঠক হিসেবে আমাদের মতান্তর এবং সামীপ্য ঘটেছে বহুক্ষেত্রে। দেবেশ রায়ের কথাসাহিত্যে তাঁর প্রবল আস্থা ছিল কিন্তু দেবেশদা তখন বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী ও খ্যাত দৈনিকের প্রতি আস্থার অতিরেক দেখাচ্ছিলেন বলেই এ বিষয়ে মতানৈক্য দেখিয়েছি। অন্যদিকে পোর্তুগীজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগোর উপন্যাস-প্রিয়তায় আমাদের মিল অবাক করেছে আমাকে। একবার কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ফেরার পথে সারামাগোর 'লাইফ ইন পোর্তুগাল' নামের বিপুল বইটি কিনে নিয়ে যান এবং কথা চলে। ফরাসি কথাসাহিত্যিক এমিল জোলার 'জারমিনাল' নিয়ে কথার মুগ্ধতা বিনিময়-কালে বিক্ষুব্ধ মজুরদের হাতে কারখানা মালিকের লিঙ্গচ্ছেদন ও পতাকায় তার স্থাপন — কতকাল আগে পড়া বলছিলেন — আমি 'থ' হয়ে গিয়েছি। ইতালীয় সাহিত্যিক ইগনাজিয়ো সিলোনের উপন্যাস ও তার উল্লেখ আমাকে বেশ অবাক করে। প্রবন্ধে প্রবন্ধে অব্যর্থ রেফারেন্স ও টুকরো বাক্যাংশকে গ্রথিত করে দেওয়ার স্টাইল ছিল অদ্বিতীয়। হাসতে হাসতে বলতেন — আপনারা শহরে থাকেন তাই বই যাচাই করে কিনতে পারেন। কিন্তু আমাদের, যারা দূরস্থ, তাদের ছোটোখাটো পাঠ্যের জন্য পুরো বইটিই কিনে নিতে হয়। কয়েকবছর আগে ভীষ্ম সাহানীর স্মৃতিকথা নিয়ে একটা ছোট্ট লেখা লিখি। তখন ওঁর চোখ প্রায় গেছে, কানে শুনেছেন লেখাটি। আগ্রহের কথা জেনে বইটা ওঁকে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলি। আক্ষেপ করে বলেন — দৃষ্টি গেছে একেবারে, পড়া যাবে না। একথা শুনে চোখে জল এসেছিল আমার। ওঁর পঁচিশটা কবিতা, কিংবা স্মৃতিকথা পড়ার কথা জেনে আনন্দ পেয়েছেন। 'পুরোনো পথের রেখা' বাড়ির এ ঘরে ও ঘরে ঘুরতে ঘুরতে হাতে এসে গেলেই সব কিছু সরিয়ে আবার পড়ি। কখন যেন বইটির একাধিক কপি জমে ওঠে। একবার লিখতে চাইছিলেন সম্ভবত: বন্ধন মুক্তি নিয়ে গল্প কথার কথা। অন্য কিছু একটাও হতে পারে। আনন্দে খোঁজাখুঁজি করে তালিকা বানাই, জানিয়ে দিই, খুশী হন। উত্তরবঙ্গে গেলে ফোনে কথা হত, কিন্তু দেখা হত কম। কারণ আমার ফেরার তাড়া। কিন্তু চাইতেন যাই ওখানে, গাড়ি পাঠিয়ে দেবার কথাও বলতেন, লজ্জা হত। কলকাতায় অনেকবারই ওঁর বক্তৃতা শুনতে গেছি। গোর্কি বিষয়ে একবার বলেছিলেন যাদবপুরে ইন্দুমতী সভাগৃহে। কিন্তু উনি পরিচিত পরিবৃত হয়ে পড়ায় ওঁকে আর আলাদা করে পাইনি। পরের দিন সকালেই ফোন — কেমন লাগল? একটু আধটু বললাম। ফোনে কি আর সব কথা বলা যায়? 'কিল মারার গোঁসাই' লিখে অন্ধ প্রগতিবাদীদের চটিয়েছিলেন। তারা যে খেপে যাবে এটাই স্বাভাবিক। বড়ো একটা চিঠিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণে কিছু কথা বলি। বঙ্গীয় মার্কস ধ্বজাধারীদের প্রতি বিরক্তি থেকে মার্কসবাদেই তিনি অনাস্থা ব্যক্ত করেছিলেন এ বইতে। এ প্রসঙ্গে মৃদু সমালোচনা করেছিলাম। উনি দু:খ করে জানান একদা বামপন্থী কর্মপ্রয়াসে কিভাবে যুক্ত ছিলেন। কলকাতার এক খ্যাত পত্রিকায় ওঁর অনেকগুলি বই নিয়ে বেশ বড়ো একটা প্রবন্ধ লিখি। খুশী হয়ে জানান — এটাই তাঁর লেখা সম্পর্কে একমাত্র বড়ো লেখা। এই কথা জেনে মন খুশী হয়। কতো কথা হতো আর আমি অবাক হতাম ওঁর পাঠের পরিধি, ব্যাখ্যার প্রাঞ্জলতা, দেশ ও বিদেশের পাঠ সঞ্চয়কে মিলিয়ে দেখায়। মাঝে মাঝে উৎসাহভরে বলতেন এখন কি বই পড়ছেন সে-সব কথা। একবার বললেন শোভনলাল দত্তগুপ্তের কমিনটার্ন বিষয়ক বড় বইটির কথা, যত্ন করে পড়ার কথা। ঐতিহাসিক কার-এর ডস্টয়েভস্কি বিষয়ক বইটির কথা জানি ওঁর লেখা পড়ে। ম্যান্ডেলস্টামের স্ত্রীর লেখা অসামান্য স্মৃতিকথার ২য় খণ্ডের খবর পেয়েছিলাম ওঁর কাছ থেকেই। সঙ্কোচের সঙ্গে জেরক্স চেয়েছিলাম। কিন্তু বইটির বাঁধাই ছিল এমন যে জেরক্স হয়ত সম্ভব হয় নি। পরে এ বই পড়ি আমেরিকাবাসী বন্ধু সমীর ভট্টাচার্যের মারফৎ। কতো বইয়ের, প্রসঙ্গের কথা ভিড় করে আসে মনে। প্রথাসিদ্ধ পঠন-পাঠনে অভ্যস্ত অধ্যাপক ছিলেন না বলেই ভালো লাগত। আজ ভাবি, এমন সাহায্য আর কে আমাকে করবে? মতভেদ ও মতসামীপ্যের টানাপোড়েনেই সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা। কখনো কোনো এক পক্ষের তীব্রতায় ছিঁড়ে যায় তা। সৌভাগ্য আমার, এক্ষেত্রে সম্পর্ক ছেঁড়েনি। রবীন্দ্রনাথের 'চার অধ্যায়'কে জাস্টিফাই করে প্রবন্ধ লেখেন। আমার তা অপছন্দ ছিল। জয়দেব বসু বা ভাস্কর চক্রবর্তীকে উনি যতটা স্থান দেন আমি তা দিতে নারাজ। 'চার অধ্যায়' প্রসঙ্গ অবশ্য বলিনি। অন্যদিকে লাতিন আমেরিকান ডিক্টেটর নভেল নিয়ে তাঁর ভারী চমৎকার প্রবন্ধটি থেকে কতো কি যে শিখেছি, এ-সব কথা হয়েছে আমাদের একাধিকবার। উপন্যাসে দেশজরীতির সরবতা দেবেশ রায় ঘরানার ব্যাপার, সবচেয়ে চমৎকার লেখাটি কিন্তু অশ্রুবাবুর। তাঁর দেশভাগের গল্প উপন্যাস নিয়ে অতি তথ্যপূর্ণ লেখাটির কথা নানাস্থানে বক্তৃতায় বলেছি, এজন্য অবশ্য সমালোচিতও হয়েছি। রবীন্দ্র অনুবাদ নিয়ে তাঁর ছোট্ট বইটি পড়ি আর ভাবি এসব যদি লিখতে পারতাম। হায় সে যোগ্যতা আজও রয়ে গেল অনর্জিত। ছোট ছোট রঙ্গ, দু:খ, ছোট ছোট চিন্তার সোপান বেয়ে আমরা চলি নতুন পুরোনো পথে, বিপথে। তার কি শেষ আছে? উনি প্রত্যক্ষ না হলেও আমার শিক্ষক। কতো কি যে শিখেছি, আগ্রহ বিস্তার করতে সাহায্য করেছেন তার শেষ নেই।
'এই মাত্র চলে গিয়েছে সে(দু পৃষ্ঠা — জয় গোস্বামী)
শেষ দেখা দেখবে বলে দিগন্তে অর্ধেক চাঁদ এসে
যখনি দাঁড়াল, দেখল, পূর্বে ও পশ্চিমে
দু-পৃষ্ঠা ঝলমল করছে মৃত্যুর কবিতা।'
আজ আমার 'নিরেট শূন্যতা' — বড়ো একা হয়ে গেলাম। একাকীত্ব পূর্বেও ছিল, আজ তা গুরুভার হয়ে উঠেছে।
'আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস' বইটি নিয়েই শুরু করি। প্রথমেই বলে নেন — 'আধুনিকতা ব্যাপারটি শুধু আঙ্গিক বা রূপকল্পের ব্যাপার নয়', এবং 'আঙ্গিকগত উদ্ভাবনার নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে জীবন সচেতনতাই মূর্ত হয়।' তাছাড়া — 'আধুনিকতার মূল কথা স্থিতিবস্থা সম্পর্কে উদ্যত প্রশ্নশীলতা।' ১৭টি প্রবন্ধ আছে — রবীন্দ্র উপন্যাস থেকে সমরেশ বসুর উপন্যাস পর্যন্ত। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা — (চোখের বালি-তে) স্পষ্টতা এবং চরিত্রের অন্তর্জগতের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। সমাজনীতির বিরুদ্ধে নারীর বিদ্রোহ অবশ্যই আধুনিক। অশ্রুবাবু বলেন — বিষয়ের মৌলিক কথা যে হাঁ এবং না এর ডায়ালেকটিক, তা অত্যন্ত সচেতন নৈপুণ্যে — ভাষায়, উপমায়, নিসর্গ বর্ণনায় স্পষ্ট। কালের মাত্রা বজায় রাখার দায়িত্ব ত্যাগ করলেন ঘরে বাইরে-তে। তত্ত্বতাড়িত হওয়া যে আধুনিকতার একটা বড়ো লক্ষণ, 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে তা স্পষ্ট। যোগাযোগের আধুনিকতা আয়রনির ব্যবহারে। আধুনিক মননের তির্যকতাও লক্ষ্য করার মতো। 'বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতার বিবর্তনে শরৎচন্দ্রের ভূমিকা সামান্য।' রবীন্দ্র প্রবর্তিত আধুনিকতা বিস্তারের দায়িত্ব ছিল কল্লোলের লেখকদের যা তাঁরা পালন করতে পারেন নি। মানুষের মহিমা নয়, মানুষের মহিমাহীনতাই জগদীশ গুপ্তের বিষয়। এক ভয়ঙ্কর হতাশাময় রেনেসাঁস-পরবর্তী আধুনিক দৃষ্টি দিয়ে জগদীশচন্দ্র জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী অপরাজিত প্রসঙ্গে তিনি প্রুস্ত, রোলাঁ প্রভৃতির উপন্যাসের কথা তুলেছেন। বিভূতির এই দুটি উপন্যাস লেখার উপন্যাস (??), এখানে তাঁর আধুনিকতা — কথাটা ইতিপূর্বে আর কেউ বলেন নি। তবে আত্মসচেতনতার যে আতিশয্য আধুনিক উপন্যাসে তা এখানে নেই। তারাশঙ্কর প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হল — 'ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে তিনি সামাজিক বাস্তবতার মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এখানেই তাঁর মহিমা' এবং বাস্তবের প্রতি দায়বদ্ধতার সীমাবদ্ধতা প্রকট তাঁর সাতচল্লিশ-পরবর্তী রচনায়। অশ্রুবাবু বলেন অন্নদাশঙ্করের 'সত্যাসত্য' আধুনিক এপিক। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল সমাজে উজ্জয়িনী চরিত্রটির 'স্বাধীন আত্ম-আবিষ্কারের আধুনিকতা' অন্যতম প্রসঙ্গ। তবে কি অর্থে 'আধুনিক এপিক' — অনালোচিত, আছে তিনটি চরিত্রের আত্মঅন্বেষণের বিস্তৃত আলোচনা।
ধূর্জটি প্রসাদের উপন্যাসচিন্তার আধুনিকতা, আলোচ্য লেখকের মতে উপন্যাসের রীতিই হয়ে উঠেছে এক্ষেত্রে উপন্যাসের বিষয়। গোপাল হালদারের 'ত্রিদিবা'-কে বলা চলে 'বাস্তবতার অন্বেষণের উপন্যাস'। এই ত্রয়ী উপন্যাস উনিশ শতকী বাস্তবতা অর্জনের পদ্ধতির বদলে ভিন্নভাবে বাস্তবতা অর্জন যা আধুনিকতার লক্ষণাক্রান্ত। এ উপন্যাস কাহিনীপ্রধান নয়, আত্মসমীক্ষা আশ্রয়ী। সাবজেকটিভ হয়ে ওঠার পথ সচেতন ভাবে বর্জনে উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে আধুনিক। উপন্যাসের গঠন ও উপজীব্য নিয়ে আধুনিক যুগে যে বিচিত্র পরীক্ষা চলেছে মানিকের 'দিবারাত্রির কাব্য' সেই পরীক্ষাকার্যের অন্যতম উল্লেখ্য প্রচেষ্টা। প্লটের চাহিদাকে উপেক্ষা করে প্রধান হয়েছে থীম। কবিত্ব ও বাস্তবতার দ্বন্দ্ব এখানে। নি:সঙ্গতা আধুনিক মানুষ মাত্রের নিয়তি। এক 'অভিনব আধুনিক উপন্যাস' এটি। বহিরঙ্গে সরাসরি অনাধুনিক, ভিতরে আধুনিকতার সংক্রমণ। গল্প ছাড়িয়ে দার্শনিক উপলব্ধির প্রকাশে পদ্মানদীর মাঝি হয়ে ওঠে আধুনিক। পুতলনাচের ইতিকথার নায়ক শশী নিয়তি-তাড়িত, নানা সংযোগহীনতা করে তোলে এ উপন্যাসকে আধুনিক। জীবনানন্দের উপন্যাসে আধুনিক সংসারের অদ্ভুত আঁধার রূপায়িত, গদ্য প্রতিমাতেও তাই শকুন আর শিয়ালের অন্ধকারত্ব। মূল্যবোধের ভয়ংকর বিপর্যয়, ভয়ংকর বিবমিষা, দাম্পত্য সম্পর্কের বিরূপতা, সভ্যতার অসুখের কারণ নির্ণয়, আত্মমগ্নতা, একাকীত্ব, যন্ত্রণাবোধ — সব মিলিয়ে নরক চিত্রণের আধুনিকতা। সতীনাথ পুরোনো মহাকাব্যের ছাঁচে আধুনিক এপিক লেখার প্রেরণা পান জয়েস থেকে। পরিবেশ-প্রধান বস্তুনিষ্ঠ আধুনিক মহাকাব্য 'ঢোঁড়াই চরিত্র মানস' উপন্যাস। বস্তুজগতের সমগ্রতা ও তার সঙ্গে ঢোঁড়াই চরিত্রের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া গড়ে তোলে এপিকের আধুনিকতা। গড়ে ওঠে এক আধুনিক রামকথা। অমিয়ভূষণের 'গড় শ্রীখণ্ড' উপন্যাসে চারটি কাহিনীবৃত্ত পরস্পর সম্পর্কিত। তবে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য প্রাবন্ধিকের লেখায় স্পষ্ট নয়। কমলকুমারের 'অন্তর্জলীযাত্রা' এক antique epic হলেও তাঁর রচনাশৈলী একেবারেই আধুনিক। বারে বারে নির্মম ব্যঙ্গ পরিহাস বিদ্রূপ স্পষ্ট করে আধুনিক লেখকের সমালোচনাবুদ্ধি। সমরেশ বসুর কিছু উপন্যাসে আছে বিশ্বাসের সংকট। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য খুঁজে নিয়েছেন অন্য কোনো বিকল্প বিশ্বাস। যেমন দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে মানবতার আলোকে আত্মজীবন দর্শন। আধুনিক বুর্জোয়াসমাজের যে নেতিময় শূন্যতাময় দেউলে অস্তিত্বের অকপট আপোষহীন ছবি তা তুলনারহিত। আধুনিকতা কিভাবে তা স্পষ্ট নয়। এই বইটি আমার প্রিয় বই, মাঝে মাঝে পড়ি। চোখে পড়ে ক) অনেক নতুন বিশ্লেষণ আছে, যা পূর্বে বা পরে পাইনি; খ) সব কটি অধ্যায়েই কথাসাহিত্যিক, আলোচক, সাহিত্য ব্যতিরিক্ত পাশ্চাত্ত্য লেখকের ব্যবহার আছে যাতে আলোচনার প্রসারণা ঘটিয়ে দেয়।
তাঁর প্রবন্ধের বই প্রচুর, অগ্রন্থিত লেখাও বিস্তর। আপাতত: 'এক কুড়ি পছন্দের প্রবন্ধ' বইটির কয়েকটি বেছে নিচ্ছি, যা আগে পড়িনি। 'বাংলা সাহিত্যে ভবিষ্যতের ভাবনা' প্রবন্ধে লেখক বলেন পূর্বে স্বাদেশিকতার প্রেরণাতেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয়, বাঙালিত্বের প্রধান উপাদান ছিল বাংলা ভাষা। কিন্তু বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের পাঠক কমছে। এর কয়েকটি কারণ — স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের কোচিং গমন, ক্লান্ত মন টিভি আর মিউজিক সিস্টেমে সমর্পণ, ক্ষমতার ভাষা বলে ইংরেজি অনুশীলন বৃদ্ধি, উন্নয়নের ঢক্কা নিনাদে বাঙালিত্ব ভুলে যাওয়া, গবেষণার উন্নতমানের অভাব, প্রভৃতি। 'বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও ভাষাদ্বন্দ্ব' প্রবন্ধে লেখক দেখান একদা মুসলমান শাসকরা বাংলা চর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন কিন্তু পরে বাংলা রচনার (হিন্দু লেখকদের) প্রতি অনাগ্রহের বীজ বুনে দেওয়া হয়। একসময় মুসলমান কবিরা বাংলার সঙ্গে আরবি ফারসি মেশাতেন। (কবিকঙ্কন, ভারতচন্দ্র) কিন্তু পরে লেখাতেই হিন্দু শব্দ বদলানো হয়। বাংলার ওপর উর্দু চাপানোর প্রয়াস ঘটেছে। পারস্পরিক ঘৃণা গড়ে উঠতে থাকে। ভাষার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয়ের আন্দোলন ঘটেছে পূর্ব পাকিস্তানে। 'মুদ্রণ ও বাংলা কবিতার জন্মান্তর' খুবই আকর্ষণীয় প্রবন্ধ। লেখক দেখান মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত আবহমান বাংলা কবিতাই সুরাশ্রিত। মুদ্রণযন্ত্র এল, ঈশ্বর গুপ্তের সময় থেকে 'অগেয়' কবিতা আসতে লাগল। এল ছন্দোমুক্তির পথ। অমিত্রাক্ষরের অগ্রগতি, মিশ্রবৃত্তের ব্যবহার, গদ্যছন্দের অসামান্যতা, স্তবক বিন্যাসের অভিনবত্ব এল, তেমনি এল স্তবক বিন্যাসের দৃশ্যমান অভিনবত্ব, (অমিয় চক্রবর্তী) কংক্রিট পোয়েট্রির পূর্বাভাস, মিলের বিচিত্রবিন্যাস, অলংকরণের অভিনবত্ব, দুর্বোধ্যতা, জটিলতা, কবি ব্যক্তিত্বের আত্মপ্রকাশ, ইত্যাদি। কিন্তু মুদ্রণ প্রসঙ্গের অভিঘাত এসেছে গাদ্যিক শব্দ বা বাক্যবন্ধের ব্যবহারে, পত্রকবিতায়, মার্জিত অমার্জিত সংমিশ্রণে, কবিতাগ্রন্থে ম্যানিফেস্টো ব্যবহারে (দময়ন্তী-- বুদ্ধদেব) ইত্যাদি। পরের প্রবন্ধে (কবিতার শরীর)-এ ভাবনার অনুসরণ, যেমন-- আপোশেনেয়ারের (??) উদাহরণ (যার কিছু নিরীক্ষা ষাটের কিছু কবিতায়) স্তবক নির্মাণের অভিনবত্বে, কবিতা পাঠের নানা ভিন্নতায়।
উপন্যাসে দেশজ রীতি চাই, ইউরোপীয় মডেল বাংলা উপন্যাসের সর্বনাশ করে দিয়েছে এমন একটা হুজুগ উঠেছিল। কিন্তু কাকে বলে উপন্যাসে দেশজ রীতি তার স্পষ্ট উদাহরণ ও ব্যাখ্যা দিতে পারেননি হুজুগকর্তারা। এ বিষয়ে আমি যেকটি প্রবন্ধ পড়েছি তার মধ্যে অশ্রুবাবুর 'না পড়িয়া উপন্যাস কন্টিনান্টাল' প্রবন্ধটি সবচেয়ে ভালো বলে মনে হয়েছে। শীর্ষনামটি যে যুবনাশ্বর একটি কবিতা থেকে সেটা বলে দেওয়া উচিত ছিল। দেবেশ রায়কে খণ্ডন করে অশ্রুবাবু বলেন 'বঙ্কিমচন্দ্রের আমলে কোনো অতিনিরূপিত একটাই মাত্র ছক ছিল না। এবং তারাশঙ্কর যখন গল্প উপন্যাস লেখা শুরু করেন তখন ইউরোপীয় আদর্শ অনুসরণের আর এক প্রস্থ আধুনিকবাদী উদ্যোগ দেখা দিয়েছিল।' তারাশঙ্করের কথাসাহিত্যের মৌল বৈশিষ্ট্য উল্লেখ ক'রে প্রাবন্ধিক রাইকমল থেকে অরণ্যবহ্নি আলোচনা করে দেশজ উপাদান ব্যবহারের উদাহরণ দিয়ে যান। তারাশঙ্কর 'কাহিনী বলেন চিরাগত দেশজ কথনরীতিতে, বর্ণনা পদ্ধতিতে,' গড়ে তোলেন 'বিকল্প আধুনিকতা।' মিথও হয়ে যায় উপন্যাসের কথনবিশ্বের অঙ্গ। রাইকমল যেন বৈষ্ণবপদাবলীর আখ্যানরূপ। 'কবি' উপন্যাসে আসে কবির লড়াই, স্বরচিত গান, পাঁচালি। গণদেবতা, পঞ্চগ্রামে দেখা যায় রামায়ণ মহাভারত ধরনের একাধিক কাহিনী, উপকাহিনী। এবং কাহিনী একরৈখিক নয়, উপন্যাসের কালও এক নয়। গান, ব্রত, কথকতা উপন্যাসের বাস্তবতার সঙ্গে। আবিষ্কৃত হয় কথকতা উপকথার কথনরীতির ছন্দের স্পন্দন। নাগিনী কন্যার কাহিনীতে পুরাণ লোককথা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। সম্পূর্ণ এক অপ্রত্যাশিত স্বতন্ত্র দেশজ কথনরীতির ব্যবহার 'অরণ্যবহ্নি' উপন্যাসে। তাঁর মহিমা প্রবহমান উত্তরাধিকারকে পুনরুদ্ধার করে তাকে আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন।
'বিষ্ণুদের স্বধর্ম অন্বেষা' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দেখাতে চান স্বধর্ম সন্ধানের ইতিবৃত্ত। ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক হলেন এলিয়টভক্ত; অনুবাদক — এলিয়টের মতই তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, পশ্চিমী পুরাণের উল্লেখ, পূর্বসূরীর ভাঙা পঙ্ক্তির ব্যঙ্গাত্মক ব্যবহার, ভাঙা শহুরে সংলাপ, বৈয়াকরণিক বিপর্যয়। এরপর অবক্ষয়ী আধুনিকতা থেকে বিকল্প আধুনিকতার দিকে — লোরকা, এলুয়ার, আরাগঁ, নেরুদার সংসর্গে। কিন্তু মার্কসবাদী চর্চায় তিনি উর্দিহীন শিল্পী। তারপর রবীন্দ্রনাথকে পথনির্দেশক মেনেই শুরু আত্মানুসন্ধান, স্বদেশানুসন্ধান। এল দেশজ পুরাণের উল্লেখ, লোকসাহিত্য, রূপকথা, ছড়ার দ্বারস্থ হওয়া। দাম্পত্য হয়ে উঠল চূড়ান্ত প্রতিমা। প্রেমে প্রাণিত এই তাঁর স্বধর্ম অন্বেষা। 'ব্রাত্য কবি, ব্রাত্যের কবি' সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও বাঙালি বামপন্থী পার্টি নিয়ে তীব্র এক প্রবন্ধ। সুভাষের মৃত্যুর পর অনেক নিন্দে-মন্দ হয়েছে তাঁকে নিয়ে কিন্তু বামপন্থী নেতারা একসময় দেখিয়েছেন ঔদাসীন্য, উপেক্ষা; রেখেছেন ব্রাত্য করে। বাংলা একাদেমি, বিশ্ববিদ্যালয় কেউই তাঁকে সম্মান দেয় নি, সরকার পেনশন বা চিকিৎসার উদ্যোগ নেয় নি। বরং রটানো হয়েছে নানা অপবাদ। সোলঝিনিৎসনের বই বা কবিতা অনুবাদ করায় নিন্দে হয়েছে কিন্তু কবি সুভাষ তাঁর ধ্রুবতা থেকে কখনো বিচ্যুত হন নি। 'ভূতের বেগার' লেখার জন্য নিন্দিত হন। কবি কিন্তু অবিচল বাস্তবতায়, মনুষ্যকেন্দ্রিকতায়। তত্ত্বের কঠোর দুর্গে, নেতাদের নির্দেশনায় না থেকে মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসায়, দিনানুদিত জীবনের তুচ্ছতা ও মমত্বে তাঁর কবিতা উৎসারিত। এ এক দুঃখের আখ্যান। বহুবছর আগে 'এক্ষণ' পত্রিকায় পড়েছিলাম — 'বোর্হেসের গোলকধাঁধা'। বোর্হেসের জীবনতথ্য, কয়েকটি কবিতার অনুবাদ, তাঁর গল্পের ধরন, সের্ভান্তেস-এর কথা — মূলত: পরিচিতিমূলক প্রবন্ধ। বোর্হেসের উপলব্ধির জগৎ নিয়ে কিছু বিরূপ কথাও চলিত আছে। সে সব অবশ্য এ লেখায় নেই।
আমার আর একটি প্রিয় বই- 'নবীন যদুর বংশ'। শুনেছি ওঁর প্রিয় সহপাঠী বন্ধু শঙ্খবাবুরও প্রিয় বই এটি। আমার প্রিয়তার কারণ — তৃতীয় বিশ্বের বিপন্নতার বিদেশী প্রসঙ্গায়ন এবং সংকটের ভাবনা, যা ঐকসূত্রে বেঁধেছে এই লেখাগুলিকে। যেমন চলচ্চিত্রমুগ্ধতায় আমরা ভাবি আচ্ছা অমুক ভূমিকায় তমুকের বদলে আর কাকে বিকল্প ভাবা যেত। এখানেও ভেবে গেছি কে লিখতে পারতেন এই লেখাগুলি। নিজের মনের কাছে উত্তর আসে নি। ভারতীয় এমার্জেন্সির অন্ধকার সময়ে লেখা হয় 'নবীন যদুর বংশ' প্রবন্ধটি। মৌষল পর্ব নিয়ে রোমান্টিক নভেল পড়েছি সমরেশ মজুমদারের। কিন্তু এ প্রবন্ধের অ্যাপ্রোচ মোটেই রোমান্টিক নয়। জীবনানন্দের 'আমিষাশী তরবার' কবিতাটি থেকে এই ধ্বংস চিহ্নিত পঙ্ক্তি নিয়ে উপন্যাস-ও লেখেন কার্ত্তিক লাহিড়ী, যা আমাদের মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়। প্রথমে আছে ভয়ঙ্কর তমিস্রার জীবনানন্দকালীন পটভূমি, তারপর বিষ্ণু দে'র 'পদধ্বনি', বিমল করের 'যদুবংশ'। প্রসঙ্গত: বলেন 'আধুনিক সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য নায়কেরা সবাই প্রায় পরাজিক নায়ক।' বলেন কি কৌশলে পুরাণকে করে তোলা যায় আধুনিক, আসে অরওয়েল বা হাক্সলির কথা। নীরেন্দ্রনাথের কবিতাংশ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, বুদ্ধদেবের 'কালসন্ধ্যা' নাটকের কথা। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনার কথাও এসে পড়ে। ষাট ও সত্তরের লেখায় যদুবংশীয় অভিঘাতের কথা থাকলে ভাল হত। তবে এখন মনে হয় এমার্জেন্সির সময়ে এ লেখা নিরামিষ মাত্র। ভারতীয় উপন্যাস এবং গোপীনাথ মহান্তির উপন্যাস, তারাশঙ্করের হাঁসুলি বাঁকের উপকথা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনার পটভূমি নির্মাণ করে চলে যান আঞ্চলিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে, এর পর গোপীনাথের দুটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা যা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। হাসান আজিজুল হকের গল্প বিষয়ক আলোচনাসূত্রে বলেন হাসান জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গোত্রের গল্পকার। মনুষ্যত্বহীন ক্লিন্ন পরিবেশে অস্তিত্ব রক্ষার, খাঁচায় বন্দীত্বের 'ব্যক্তিগত মুক্তি আর মুক্তিহীনতা'র গল্প, তুলে ধরেন একে একে, নিষ্ঠুর বাস্তববাদিতা লক্ষ্য করেন তাঁর লেখায়। 'বোর্হেসের গোলকধাঁধা' প্রবন্ধের সীমাবদ্ধতার কথা আগেই বলেছি। 'মৃত্যুপুরীর দুই বাসিন্দা' ডস্টয়েভস্কি ও সোলঝোনিৎসিনের দুটি উপন্যাস নিয়ে লেখা। দুই কালের দুই কথাকার সদৃশ ভাবনায়, আঙ্গিক ভাবনায় জীবনের নির্মমতা যা দুই কালের তুলে ধরেছেন লেখক। 'আধা আত্মজৈবনিক' ও 'স্বৈরতান্ত্রিক উৎপীড়নের দিক' দুটি উপন্যাসের আর দুটি মিলের কথা। '১,৭৪,৫১৭ নম্বরের জবানবন্দী' প্রিমো লেভির লেখা উপন্যাস নিয়ে। মৃত্যুশিবিরের আতঙ্ক আর ক্বচিৎ ক্ষীণমানবতার শিখাকে ধরেছেন চমৎকার। বাঙালি পাঠকের কাছে লেভিকে পরিচিত করিয়ে দিলেন তিনি। 'পিতৃভূমির পিতৃপুরুষেরা' ডিক্টেটর নভেল নিয়ে আলোচনা। লাতিন আমেরিকান ঐতিহ্য ও কতিপয় নির্বাচিত রচনা নিয়ে আলোচনা আমাকে অন্তত: বিস্মিত করেছে, পেয়েছি অনেক আলোককণা। আছে বিষয়ের ও আঙ্গিকের বাক্রীতির, রূপকল্পের অভিনবত্বের কথা। 'ক্ষমতার উৎস উৎপীড়ন এবং সন্ত্রাস' শনাক্ত করে দেন প্রাবন্ধিক। যাঁরা লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যের স্বরূপ বিষয়ে আগ্রহী, তারা বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, সমাজতত্ত্বের ছাত্রছাত্রী অধ্যাপক সব্বাইকে কিছু না কিছু শেখায় লেখাটি। আজ মনে পড়ছে এ প্রবন্ধের বইপত্র জোগাড়ের কিছু কথা বলেছিলেন। সামান্য কথা কিন্তু বাংলার শিক্ষকদের আর কেউ এমন অনুসন্ধানে তৎপর? মনে তো পড়ে না। 'হেরমান হেসে ও তাঁর ভারতীয়তা' লেখাটি চমৎকার, কিন্তু বইটির সুরের সঙ্গে ঠিক যেন মেলে না।
'সাহিত্যের সমাজ' বইটির ভূমিকায় অশ্রুবাবু লিখেছিলেন — 'সাহিত্য আর সমাজ-ইতিহাস আমার প্রধান আগ্রহের বিষয়। সাহিত্যকে আমি সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পড়তে ভালোবাসি।' তাঁর দু একটি বই বাদ দিলে, কিছু লেখা সরিয়ে রাখলে পাঠক বুঝতে পারবেন এই প্রবন্ধকারের তাঁকে অনুধাবনের, একাত্ম হবার এই চাবিকাঠি, যদিও টেকনিক সচেতনতা সর্বত্র। (??)
টেলিফোনে প্রায়ই হাসতে হাসতে বলতেন — আপনারা ভাগ্যবান। বই দেখে, পাতা উলটে, যাচাই করে কিনতে পারেন, কোথাও একটি মাত্র অধ্যায় সংগ্রহ করতে পারলেই কার্যসিদ্ধি হয়। কিন্তু আমরা, যারা দূরে থাকি তাদের সে সুযোগ নেই। পুরো বইটাই হাতে নিতে হয়। তাঁর অধিকাংশ বইয়ের পাতা উলটোতে উলটোতে বুঝতে পারি কতো কি পড়েছেন, কোন কোনো লেখককে বুঝতে চেয়ে অনেক কিছু দেখে নিয়েছেন আর কোথাও দুর্বোধ্যতা, পাণ্ডিত্য কন্টক নেই। তিনি তো বাংলার অধ্যাপক, কিন্তু বিশ্বসাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাসের, দর্শনের এমন স্থিতধী অধ্যয়ন তাঁকে উজ্জ্বল, বিকল্পহীন করেছে। নতমস্তকে ভাবতে বসি এবার তবে কার কাছে যাব। অতীত স্মৃতি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন — 'কাল যায়, সেই ছবি যেন উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে'। তাঁর বইগুলি পড়তে পড়তে পাঠের পুনর্ণব স্মৃতি যেন উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে। শিশির কুমার দাশ মাঝে মধ্যেই আক্ষেপ করতেন, যেহেতু দিল্লীতে আছেন তাই ঈপ্সিত চরিতার্থতা পাচ্ছেন না। দিল্লীর জে.এন.ইউ-এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে টয়লেটের আড়ালে আমার কাছ থেকে তড়িঘড়ি সিগারেট চেয়ে নিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত করার প্রাক্কালে এইসব কথা শুনে বলেছিলাম — ভাগ্যিস দিল্লীতে, তাই এতো বড়ো বড়ো কাজগুলো করতে পেরেছেন। কলকাতা, তার পোকামাকড়ময় বুদ্ধিজীবিতা এখানে থাকলে আপনাকে শেষ করে দিত। শিলিগুড়ির বাসিন্দা অশ্রুকুমার, দিল্লীর বাসিন্দা শিশিরকুমার দুজনকে হারিয়েছি, এঁরা কেউই সরাসরি আমার শিক্ষক নন, কিন্তু আমি তাঁদের একলব্য ছাত্র। নিজের পড়ার ঘরে বসে এঁদের সান্নিধ্য অনুভব করি আর জেগে উঠি, জেগে উঠতে নিরন্তর চেষ্টা করি। হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতিক — যুদ্ধযাত্রার এই ছিল চতুরঙ্গ সামগ্রিকতা। সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা — এর সমন্বয় আনে রুচির সমগ্রতা — অশ্রুবাবুর সংস্কৃতিযুদ্ধে এই ছিল চতুর্মাত্রা — আমি এটাই পছন্দ করি। এবার আমি কোথায় যাব, কার কাছে যাব? অশ্রুবাবু রচিত একটি পঙ্ক্তি দিয়ে অশ্রুসজল সমাপ্তিতে যাই — 'এক একজন বন্ধু চলে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় যেন আমারই জীবনের এক একটা অংশ।' (পুরোনো পথের রেখা, পৃ.৫২)