বাইরে প্রবল বোমা বর্ষণ হচ্ছে। প্রতিপক্ষ জার্মানির ট্রেঞ্চের ধারে একটা তাঁবু। ভিতরে মোমবাতির আলোয় এক প্রৌঢ় পেন্সিল দিয়ে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারীর প্রুফ চেক করছেন। মাঝে মাঝে শত্রুপক্ষের নজর এড়াতে নিভিয়ে ফেলছেন মোমবাতি...
জীবনমরণের সীমান্তে দাঁড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেও নীরবে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছেন অনামী শব্দবিদ জর্জ মার্ ওয়াটসন। ১৮৭৬-এ জন্মানো ওয়াটসন হাউইক আর্কিওলজিক্যাল সোস্যাইটির মেম্বার ছিলেন। সেখানেই সম্ভবত প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক জেমস মারে এবং তাঁর অভিধান সম্পর্কে প্রথম শোনেন। ১৯১৬-এ উইলিয়াম ক্রেইজির সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে অভিধান নির্মাণের কর্মযজ্ঞে যোগদান করেন। আজ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির যে জগৎজোড়া খ্যাতি তার নেপথ্যে আছে জর্জ মার্ ওয়াটসনের মতো অনেক অখ্যাত কর্মবীরের নিরলস পরিশ্রম।
ওয়াটসনের ঘটনা চমকপ্রদ হলেও কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। গোটা পৃথিবীতে অন্যান্য অনেককিছুর মতোই অভিধান রচনার কাজেও ব্যক্তিগত স্তরে ছোঁয়াচ লেগেছে যুদ্ধের। বহু শব্দের ভাঁজে লেগে আছে বারুদের ঘ্রাণ। শব্দের কারবারিদের এ কাজে নেমে মন ভেঙেছে, ঘর পুড়েছে, আত্মীয়স্বজনের কান্নার রোল দিগ্বিদিক কম্পিত করেছে। অভিধান রচনার সময়কার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে ব্যক্তিজীবনের দিকনির্দেশ করেছে।
উইলিয়াম চেষ্টর মাইনর নামের এক খুনী শব্দবিদের প্রসঙ্গে আসার আগে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির সূচনাপর্ব নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। যে সময়ের কথা হচ্ছে, ততদিনে টমাস এলিয়ট, রবার্ট কাড্রে, হেনরি ককর্যাম, নাথানিয়েল বেইলির মতো বেশ কিছু মানুষ অভিধান রচনার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা করেছেন। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই ‘নির্দেশিকা’র পর্যায়ে পড়ে। সংকলক তাঁর ইচ্ছানুসারে ‘ভালো শব্দ’, ‘সঠিক ব্যবহার’ ইত্যাদি ঠিক করে দিতেন। যে শব্দ তাঁর পছন্দের ঠেকত না সেটাকে সটান বাদ দিতেন। কিছু কিছু শব্দের ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ অদ্ভুত উৎকট ব্যাখ্যা পর্যন্ত করতেন। এদের মধ্যে অভিধান হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল স্যামুয়েল জনসনের ‘আ ডিকশনারি অফ দ্য ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’, যা প্রকাশিত হয় ১৭৫৫-এ।
এর প্রায় একশো বছর পর লন্ডনের ফিলোলজিক্যাল সোসাইটি একটা নতুন অভিধান নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ঠিক হয়, ইংরেজি ভাষায় যত ব্যবহৃত শব্দ আছে, সব ভরা থাকবে দুই মলাটের মধ্যে। মনে রাখতে হবে, ‘গ্রেট ভিশন’, ‘গ্রেট মেন’, ‘গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট’ এর স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ড তখন গোটা পৃথিবীতে রাজত্ব কায়েম করার স্বপ্ন দেখছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে রাজভাষার দম্ভকে মর্যাদা দিতে তার এরকমই এক বিশাল অভিধান চাই। লন্ডন লাইব্রেরীতে ফিলোলজিক্যাল সোসাইটির পক্ষ থেকে এই অভূতপূর্ব ডিকশনারী তৈরির প্রস্তাব তোলেন রিচার্ড চেনেভিক্স ট্রেঞ্চ। সমসাময়িক অভিধানগুলোয় কোথায় কী খামতি আছে, তারও এক বিশদ তালিকা পেশ করেন তিনি। এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞের কান্ডারী হিসেবে নির্বাচিত হন দুই বিশিষ্ট শব্দবিদ ফ্রেড্রিখ ফার্নিভাল এবং বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল কোলরিজের নাতি হার্বার্ট কোলরিজ।
ফার্নিভাল দায়িত্ব পেয়েই সোসাইটির তরফে স্বেচ্ছাসেবী পাঠক চেয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন। গোটা ইংরেজি সাহিত্যকে ভাগ করেন তিনটি পর্বে- ১২৫০ থেকে ১৫২৬ (যে বছর নিউ ইংলিশ টেস্টামেন্ট লেখা হয়), ১৫২৬ থেকে ১৬৭৪ (যে বছর মহাকবি মিল্টন মারা যান) আর ১৬৭৪ থেকে তখনকার বর্তমান সময় অব্দি। এই তিনটি কালপর্বের মধ্যে পাঠক তাঁর ইচ্ছামতো একটা সময় নির্বাচন করবেন এবং সেই কালপর্বের মধ্যে প্রকাশিত বইগুলো পড়বেন। বই পড়তে পড়তে যে শব্দগুলো তাঁর উল্লেখযোগ্য মনে হবে সেগুলোকে আলাদা আলাদা করে কাগজে লিখে বইয়ের নাম, খণ্ড, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি উল্লেখ করে, শব্দটি বাক্যে কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে তা দর্শিয়ে একটা বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবেন। মোটামুটি এই ছিল সোসাইটির প্রাথমিক প্ল্যান।
হার্বার্ট কোলরিজ যখন এই প্রজেক্টের সম্পাদক হন, তখন এর পোষাকি নাম ‘আ নিউ ইংলিশ ডিকশনারি অন হিষ্টোরিকাল প্রিন্সিপলস’। তিনি পাশাপাশি নটা এবং উপর নীচে ছটা করে মোট চুয়ান্নটা ওক কাঠের খুপরি তৈরী করেন। পাঠকদের কাছ থেকে আসা অগুন্তি কাগজের স্লিপ বিভিন্ন নির্দেশকের ভিত্তিতে ঐ খুপরিগুলোয় জমা হতে থাকে। কোলরিজ আন্দাজ করেছিলেন, অভিধানের প্রাথমিক কাজ দু বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু হা হতোস্মি! শেষমেষ স্লিপের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ষাট লক্ষের কাছাকাছি! যা তাঁর প্রাথমিক আন্দাজ ছিল, তার প্রায় দশগুণ। ফলে একরকম দিশাহীন অবস্থাতেই থমকে দাঁড়ায় অভিধানের কাজ। এর মধ্যে আবার কাল হয় হার্বার্ট কোলরিজের অকালমৃত্যু। ভদ্রলোক ফিলোলজিক্যাল সোসাইটিতে যাওয়ার পথে একদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন। সামান্য সর্দিকাশিতেই মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। ডায়রিতে তাঁর লেখা শেষ কথা ছিল, ‘আগামীকাল সংস্কৃত শুরু করতে হবে।’
এরপর অনেকদিন কাজে ভাটা পড়ে। কর্মীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ এতদূর অব্দি ধরে নেন, যে এ কাজ কোনোদিন শেষ হতে পারে না। অবশেষে ১৮৭৯-এর ১লা মার্চ এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন ডিকশনারির চতুর্থ সম্পাদক কিংবদন্তী বহুভাষাবিদ জেমস মারে। ইনি মাত্র পনের বছর বয়সেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন ইতালিয়ান, জার্মান, গ্রিক এবং ফরাসী ভাষা। তৎকালীন স্কুলশিক্ষায় অনিবার্য হওয়ায় ল্যাটিন এমনিতেই ছিল তাঁর করায়ত্ত। কিন্তু মজার ব্যাপার, ইনি ছিলেন সেকালের ড্রপ আউট। আর্থিক অসংগতির কারণে স্কুল ছেড়েছিলেন চোদ্দ বছর বয়সে। স্কুলের খাতার উপরে লিখে রেখেছিলেন, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’। প্রথাগত শিক্ষার গণ্ডীর বাইরে পড়াশুনো করে মানুষ কোনমাত্রায় পৌঁছতে পারে, তার অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন তিনি। ত্রিশ বছর বয়সে লাইব্রেরিয়ান পদের জন্য জমা দেওয়া তাঁর আবেদনপত্র দেখে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। তিনি লিখছেন, আরিয়ান (Aryan) ও সাইরো-অ্যারাবিক (Syro-Arabic) ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় সব ভাষাই তাঁর জানা। ইতালিয়ান (Italian), ফ্রেঞ্চ (French), ক্যাটালান (Catalan), স্প্যানিশ (Spanish), ল্যাটিন (Latin) এবং কিছুমাত্রায় পোর্তুগিজ (Portuguese), ভৌডুয়া (Vaudois) ও অন্যান্য আঞ্চলিক ডায়ালেক্ট জানেন। টিউটোনিক শাখার ডাচ (Dutch), জার্মান (German), ফ্লেমিস (Flemish) এবং ড্যানিশ জানেন। অ্যাংলো-স্যাক্সন (Anglo- Saxon) এবং মেসো-গথিকের (Maeso-Gothic) বিভিন্ন শাখার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে, কিছু কাজও করেছেন এর উপর। অল্প কেল্টিক (Celtic) জানেন, বর্তমানে স্লাভোনিক (Slavonic) শেখার চেষ্টায় রয়েছেন। রাশিয়ান (Russian) জানেন বলে সুবিধা হচ্ছে। ফারসি (Persian), আকিমেনিয়ান (Achaemenian), কিউনিফর্ম (Cuneiform) ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে তিনি তুলনামূলক আলোচনা করতে পারেন। হিব্রু (Hebrew) ভাষায় লেখা ওল্ড টেষ্টামেন্টের এবং সিরিয়াকে (Syriac) লেখা পেশিট্টা কারো সাহায্য ছাড়াই পড়তে পারেন। এছাড়াও কাজ চালানোর মতো অল্পবিস্তর অ্যারামিক (Aramaic), আরবি (Arabic), কপ্টিক (Coptic) এবং ফোনিশিয়ানও (Phoenician) জানা আছে তাঁর।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, লাইব্রেরির চাকরিটি তাঁর জোটেনি।
১৮৫৭ থেকে ১৯২৮, এই কালপর্ব নিতান্ত ছোট নয়। ইতিমধ্যে প্রথম সম্পাদক হার্বার্ট কোলরিজ মারা গেছেন, চারবার সম্পাদক বদলেছে, ডিকশনারি সংকলনের জন্য প্রায় ৮০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ হয়েছে এবং পূর্ববর্তী সম্পাদক প্রায় দু টনের কাছাকাছি কোটেশন সম্বলিত স্লিপ হস্তান্তরিত করেছেন পরবর্তী সম্পাদককে। মারের দায়িত্ব গ্রহণের সময়কার চুক্তির শর্ত অনুসারে, ডিকশনারি সম্পূর্ণ করতে সময় লাগার কথা ছিল আরো ১০ বছর। আয়তনের দিক থেকে আন্দাজ সাত হাজার পাতা লাগলে, এই অভিধান প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল মোট চার খণ্ডে। কিন্তু অবশেষে ১৯২৮-এ যখন সত্যিই অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি প্রকাশ পেল, তখন তার আয়তন চার খন্ডে আঁটেনি, মোট বারোটা খণ্ড লেগেছিল চার লক্ষ চোদ্দ হাজার আটশো পঁচিশটা শব্দকে ব্যাখ্যা করতে। শব্দগুলির প্রয়োগ নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়েছিল মোট আঠারো লক্ষ সাতাশ হাজার তিনশো ছ’টা উদাহরণ।
এবার আসি সেই খুনী উইলিয়াম চেষ্টর মাইনরের গল্পে। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২-এ জর্জ মেরেট নামের এক নিরপরাধ ব্রয়লারের শ্রমিককে তিনি গুলি করে হত্যা করেন। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে মাইনর আসলে আমেরিকান আর্মিতে মেডিক্যাল সার্জেনের কাজ করতেন। খুব অল্পদিনই হয়েছে তিনি হত্যার অকুস্থল ল্যাম্বেথ এলাকার কাছে টেনিসন রোডে ঘর নিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ল্যাম্বেথ তৎকালীন লন্ডনের বস্তি এলাকা বলেই পরিচিত ছিল। কয়েকঘর কারখানার শ্রমিক আর তাদের পরিবার বাদ দিলে বাকি পড়ে থাকত পতিতা কলোনি। যে বাড়িতে মাইনর ভাড়ায় থাকতেন, তার বৃদ্ধা মালকিনের বয়ান অনুসারে মাইনর ভাড়াটে হিসেবে এমনিতে খুবই ভালো ছিলেন, কিন্তু সবসময়ে কেমন যেন ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতেন। আসবাবপত্র প্রায়ই অদলবদল করতেন। দরজা জানলা ঠিক করে বন্ধ আছে কিনা সে নিয়ে উদ্বেগে থাকতেন। তাঁর ভয় ছিল, কে বা কারা যেন তাঁকে মেরে ফেলতে পারে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জনৈক উইলিয়ামসন আদালতের জবানবন্দীতে জানান, মাইনর ‘ফেনিয়ান ব্রাদারহুড’ নামে খ্যাত এক আইরিশ সামরিক বাহিনীকে খুব ভয় পেতেন। এমনকি বহুবার এই কাল্পনিক ভয়ের কারণে স্থানীয় থানায় কাল্পনিক আততায়ীদের নামে ডায়রি লেখানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেন।
সম্ভবতঃ এই কারণেই তিনি আর্মির চাকরিটি ছাড়েন। এক সময়ে বেডল্যামের বিখ্যাত পাগলাগারদেও দিন কাটিয়েছেন। সেখানকার এক রক্ষী জানান, ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে মাইনর তাঁকে ফেনিয়ান ব্রাদারহুডের গুপ্তচর বলে গালিগালাজ করতেন। প্রতি রাতে নাকি মাইনর সেলের দেওয়ালে কাদের ছায়া দেখতে পেতেন। টেনিসন রোডের ভাড়া বাড়িতেও আতঙ্কে নিজের বালিশের নিচে বন্দুক লুকিয়ে রাখতেন। তেমনই একদিন একটা ছায়াকে দেখে তাড়া করতে আরম্ভ করেন। অবশেষে ছায়াটা যখন মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে, তখন তাকে গুলি করেন। মারা যান ব্রয়লারের শ্রমিক জর্জ মেরেট।
বিচারের রায়ে ডঃ মাইনরের ঠাঁই হয় ক্রাউথর্নের এক বিশাল ঘেরাটোপ দেওয়া লাল বিল্ডিং এ। তাঁর এই মানসিক রোগের কারণ হিসেবে চিকিৎসকরা ডঃ মাইনরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাকে দায়ী করেন। তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল শ্রীলঙ্কায়। মাত্র বারো বছর বয়সেই সিংহলিজ, হিন্দি, তামিল এবং বেশ কিছু চাইনিজ ভাষা রপ্ত করেছিলেন। চোদ্দ বছর বয়সে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমেরিকায়। ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেন মেডিসিন নিয়ে, স্পেশাল পেপার ছিল কম্প্যারেটিভ অ্যানাটমি। এর পরেই ডাক আসে আর্মি থেকে। আমেরিকায় তখন উত্তাল গৃহযুদ্ধের সময়। মাইনর যে সেনায় যোগ দেন তার নাম ইউনিয়ন আর্মি। এরই আবার অপর নাম ছিল ফেডারেল আর্মি। তিনি যোগ দেওয়ার মাত্র চারদিন পরেই আসে সেই রক্তাক্ত ঐতিহাসিক দিন। ২৯ জুন, ১৮৬৩। গেটিসবার্গের যুদ্ধের নির্ণায়ক মূহূর্ত। মাত্র ছ মাসের মধ্যে তিন লক্ষ ষাট হাজার ফেডারেল সৈন্য এবং অন্য দিকের প্রায় দু লক্ষ আটান্ন হাজার কনফেডারেট সৈন্য প্রাণ হারায়। দিগ্বিদিক কম্পিত হয় সৈন্যদের আর্ত চিৎকারে। গ্যাংগ্রীন, অঙ্গহানি, পুঁজ, রক্তে মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলো নরকে পরিণত হয়।
ডঃ মাইনরের কাছে এর সবকিছুই আনকোরা নতুন ঠেকে। তিনি পন্ডিত মানুষ, বইপত্র নিয়েই থাকতে ভালোবাসেন। এমন বীভৎসতার সম্মুখীন তিনি আগে কখনো হননি। প্রথম প্রথম ইউনিয়ন ফ্রন্টের হয়ে লড়াই করছিল প্রায় দেড় লক্ষ আইরিশ সৈন্য। কিন্তু আইরিশ নেতাদের উস্কানি এবং আমেরিকার মাটিতে লড়াই করার তেমন কোনো প্রত্যক্ষ কারণ না থাকায়, তারা অচিরেই উৎসাহ হারায়। দলে দলে সৈন্য পালাতে থাকে। সেনাদের এই পলায়নবাদী মানসিকতা পাল্টাতে নিজের দলের লোকেরাই নিজেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে। একাধিকবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়া সৈন্যদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বাকিদেরকেও কাউকে নেড়া করে, কাউকে চাবুক পেটা করে, কাউকে উলঙ্গ করে ঘোরানো হত। কখনও নখ উপড়ে নেওয়া হত, কখনও বা লোহার শিকের মাথায় ‘কাওয়ার্ড’ বা ‘D’ লেখা ছাঁচকে জ্বলন্ত অঙ্গারে গনগনে লাল করে গালে, বুকে, পিঠে চেপে ধরে মাংস পুড়িয়ে স্থায়ী ক্ষত তৈরি করা হত। এরপর ক্ষতস্থানে কালো গুঁড়ো ঢেলে দেওয়া হত। একবার এই অমানুষিক অত্যাচার করার দায়িত্ব পড়ে ডঃ মাইনরের উপর। চিকিৎসকদের মতে সেই কাজ থেকে তাঁর মনে যে অপরাধবোধ জন্মায় সেটাই ডঃ মাইনরকে কুরে কুরে খায়।
যাইহোক, কোনোভাবে ডিকশনারির জন্য সেই স্বেচ্ছাসেবী পাঠক চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া কাগজটা এসে পৌঁছয় ডঃ মাইনরের হাতে। তিনি তৎক্ষণাৎ আগ্রহ প্রকাশ করে চিঠি লিখে পাঠান অভিধানের দপ্তরে। এরপর যখনই কোনো উক্তির প্রয়োজন পড়ত, সবার আগে উত্তর আসত ডঃ মাইনরের কাছ থেকে। ইতিমধ্যে হত শ্রমিক জর্জ মেরেটের স্ত্রী ও সন্তানদের দেখভালের খরচ জোগাতেও শুরু করেছেন তিনি। মজার ব্যাপার, জেমস মারে কখনো কোনো সন্দেহই প্রকাশ করেননি ডঃ মাইনর সম্পর্কে। ভেবেছিলেন কোনো রিটায়ার্ড সার্জেন হবেন হয়তো – পন্ডিত মানুষ, হাতে অনেকটা সময় আছে। মাইনরের প্রকৃত পরিচয় মারে জানতে পারেন অনেক পরে। ১৮৯৯ সালে ডঃ মাইনরের অপরিসীম অবদানের কথা স্বীকার করে মারে বলেছিলেন, ‘কেবলমাত্র তাঁর বাছাই করা উক্তির সাহায্যেই আমরা বিগত চার চারটে শতাব্দীকে চিহ্নিত করে ফেলতে পারি।’
লর্ড অফ দ্য রিংসের লেখক টলকিন অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি রচনার কাজে হাত দেন আরো বেশ কিছুদিন পর। ১৯১৬ সালে টলকিনকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর ‘সম’ (Somme)-এর যুদ্ধে ট্রেঞ্চে থাকার অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে ছিল নিদারুণ কষ্টের। এই সময়ে একদিনে প্রায় কুড়ি হাজার সৈন্য মারা যায়। সেই নৃশংস ভয়াবহতা তাঁর মনে এমনভাবে গেঁথে যায়, যে বারে বারে রূপক হিসেবে সে কথা ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়। সামনে থেকে মারা যেতে দেখেন তাঁর দুই বন্ধুকে। ট্রেঞ্চ ফিভারে ভয়ানক আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হন। বারবার এই জ্বরে ভুগতে থাকেন তিনি। ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা হল। এরপর থেকে (লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায়) তাঁর লেখায় প্রকৃত মনোনিবেশ। এর কিছুদিন পর অক্সফোর্ডের মার্টন কলেজে তিনি যোগদান করেন। এখানেই সি এস লুইস সহ অন্যান্য কৃতি ব্যক্তিদের সাথে (যাঁদের ‘Inklings’ বলা হত) পুরোনো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পানশালা ‘দি ঈগল অ্যান্ড দ্য চাইল্ড’-এ ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা চলত তাঁর। ১৯১৯ থেকে ১৯২০, এই দু’বছর টলকিন অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির ‘W’ লেটারের প্রথম দিকের কিছু এন্ট্রি নিয়ে কাজ করেন। মজার ব্যাপার, ১৯৬৯-এ তিনি অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। তবে এবার নতুন ভূমিকায়। দ্বিতীয় খন্ড (‘H’ থেকে ‘N’) প্রকাশের সময়ে নতুন এন্ট্রি হিসেবে উঠে আসে ‘হবিট’ (Hobbit)। তাঁরই অক্সফোর্ডের ছাত্র রবার্ট বার্চফিল্ড এর চিঠির উত্তরে তিনি যে এন্ট্রি পাঠান তা বার্চফিল্ডের লেখা এন্ট্রির চেয়ে বড়। কিন্তু বার্চফিল্ড স্যারের লেখা এন্ট্রিকেই সরাসরি তুলে দেন ডিকশনারিতে:
In the tales of J.R.R Tolkien (1892-1973): one of an imaginary people, a small variety of the human race, that gave themselves this name (meaning ‘hole-dweller’) but were called by other halflings, since they were half the height of normal men.
টলকিন মধ্যপৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্বযুদ্ধের ক্লেদাক্ত অভিজ্ঞতায় জর্জরিত হয়ে। আজ তাঁর বানানো সেইসব শব্দই ঢুকে পড়েছে আমাদের শব্দভান্ডারে নতুন পৃথিবীতে আগামীর প্রত্যয় নিয়ে।
নতুন পৃথিবীর স্বপ্নের কথা উঠল যখন, তাহলে আর্নেষ্ট ডেভিড ক্লেইনকে দিয়েই শেষ করা যাক। ক্লেইনের জন্ম ট্রান্সেলভেনিয়ার এক রাব্বি (Rabbi) পরিবারে। তাঁর জন্মস্থান সাতু মারে (Szatmar) বর্তমানে রোমানিয়ার এক কোণে অবস্থিত। ক্লেইনের জীবৎকালেই এ শহর বহুবার হাতবদল হয়েছে। জন্মের পর থেকে উনিশ বছর বয়স পর্যন্ত এ শহর ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান মালিকানার। ইহুদি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক পাঠের অঙ্গ হিসেবে শেখেন হিব্রু এবং অ্যারামিক। স্কুলে জার্মান ছাড়াও শেখেন ল্যাটিন এবং গ্রীক। ১৯২০ সালে রাব্বি হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পাঁচ বছর পর সেমিটিক এবং রোমান্স ল্যাঙ্গুয়েজে ডক্টরেট করেন ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা থেকে। বলা হত, তিনি কাজ চালানোর মতো করে প্রায় চল্লিশটা ভাষা জানতেন। হিটলারি জার্মানীতে ইহুদি হওয়ার অপরাধে আউসউইৎজ (Auschwitz) এবং দাচাউ (Dachau) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দিন কাটিয়ে যখন তিনি ঘরে ফেরেন, শোনেন তাঁর বাবা, স্ত্রী, একমাত্র সন্তান জোসেফ এবং দুই বোন আউসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অকথ্য অত্যাচারে মারা গেছে। কানাডায় গিয়ে ওঠেন একমাত্র জীবিত বোনের বাড়িতে। তাঁরই অনুপ্রেরণায় হিব্রু ভাষার উৎসভিত্তিক অভিধান সংকলনের কাজ শুরু করেন। অভিধানের কাজ শেষ হলে তিনি মুখবন্ধে লেখেন এক অসামান্য কথা। লেখেন, যেভাবে এই অভিধান দেখায়, বিভিন্ন জাতির পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও আন্তর্সমন্বয়ে কী ভাবে তাদের ভাষাগুলো গড়ে উঠেছে, ঠিক তেমনভাবে বিভিন্নজাতিও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসে, তবে বিশ্বশান্তি আসতে বাধ্য। এই অভিধান রচনায় সেটিই দেখানো আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। (May this dictionary, which plastically shows the affinity and interrelationship of the nations of the world in the way in which their languages developed, contribute to bringing them nearer to one another in the sincere pursuit of peace on earth – which was one of my cardinal aims in writing this dictionary.) বলা বাহুল্য, এ কথা আজও ততখানি সত্য, যতটা ক্লেইনের সময়ে ছিল। কিন্তু যুদ্ধবাজরা সে কথা বুঝলে তবে তো...!
তথ্যসূত্র:
1. The Professor and the Madman. A Tale of Murder, Insanity, and the Making of the Oxford English Dictionary by Simon Winchester
2. Oxford English Dictionary's official blog
3. Dedication, Etymonline website
4. Introduction, A comprehensive etymological dictionary of the Hebrew language for readers of English.
5. 'মধ্যপৃথিবীর রাজা'; টোলকিন, দেশ, বই সংখ্যা, 2 ফেব্রুয়ারি 2017