• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৪ | মার্চ ২০১৯ | গল্প
    Share
  • পিকনিকের দিন : অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী


    মোচাটা যে উচ্চতায় ঝুলছে, মাটি থেকে লাফ দিয়ে তা ধরা অসম্ভব। বেশ চকচকে, নধর ও লোভনীয় একটি মোচা তার সমস্ত কচি কলাদের ছেড়ে এসে সূঁচালো মুখ চাগিয়ে রেখে যেন বলছে, দ্যাখো, আমি কত সুন্দর! নেবে আমায়?

    গ্রামের মূল রাস্তা থেকে আরও আরও ভেতরে এই পাড়াটা। সরু পায়ে চলা পথ। কিছুদূর হাঁটলেই একাকি দাঁড়িয়ে থাকা কলাগাছটি খুব সহজেই নজরে এসে যায়। সঙ্গে একটি ভাঙাচোরা মাটির বাড়ি। ঝুঁকে পড়া টালির চাল, তার উপর ডালপালা মেলে আছে শীতের লাউগাছ। নিচু ঘর, কিন্তু উঁচু দাওয়া। তাই মাথা উঁচু করে হাঁটা যায় না। সেখানে সোজা হয়ে হাঁটলেই মাথা ঠুকে যাবার সমূহ সম্ভাবনা।

    মোচাটা প্রথম চোখে পড়েছিল বেসরকারি একটি ব্যাংকে মোটামুটি এক পদে কাজ করা বছর আটাশের রক্তিমের। সে দাঁড়িয়ে গেল। বলা ভাল মোচাটার মধ্যে যে শিল্প সুষমা ছিল, সেটাই তাকে দাঁড় করাতে বাধ্য করল। সে একটা চিত্রকল খুঁজে পেল এক চটকায়। রাস্তার ধারে একটু কলাগাছ, তার ফ্যাঁকড়া বেরিয়েছে তিনটি। পাশেই ধূলিময় এক উঠোন, মাটির বাড়ি। সেই উঠোনের পাশ দিয়ে চার পাঁচটা পৃথুলা হাঁস প্যাঁকপ্যাঁক করতে করতে নেমে গেল ঘরের ঠিক পিছনেই অবস্থিত পুকুরটায়। রক্তিমের মনে হল, এই শীতেও তাদের ঠান্ডা লাগে না।

    তার পিছনে থাকা চারজনের দলটার পাও থেমে গেল। পৃথুলা কল্পনা রক্তিমের দৃষ্টি অনুসরণ করে, চশমাটা তর্জনী দিয়ে ঠেলে ভুরু অবধি তুলে মুখ উঁচু করে মোচাটা দেখলেন। তড়বড় করে বললেন, ‘এটা আমি নেব।’

    রক্তিম বলল, ‘মোচাটা কিন্তু কাঁচকলার।‘

    কল্পনা ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তাতে কী?’

    ‘কাঁঠালিকলার মোচার মত স্বাদু নয়, একটু কষা।’

    ‘হোক কষা! এমন সুন্দর ভাবে গাছে ঝুলে আছে, একে ছেড়ে যাওয়া যায় নাকি? এটাকে আমি পেড়ে নেব। মোচাটা আমার চাই-ই চাই!’

    ‘সে পাড়ুন। কিন্তু বলে পাড়বেন। মনে হচ্ছে এই সামনের নিচু বাড়িটাই এই কলাগাছের মালিক। আপনার তো আবার পিকনিকে এসে পরের দ্রব্য না বলে চেয়ে নেওয়া অব্যেস!’

    ছদ্ম হেসে কল্পনা বললেন, ‘এই রক্তিম, মজা কোরো না তো। গ্রামে পিকনিক করতে এসে এইসব গাছপাকা জিনিস নেব না তো কি নেব?’

    রক্তিম বলল, ‘মোচা যে গাছপাকা হয়, কোনদিন শুনিনি!’

    একজন পাশ থেকে টিপ্পনী কাটল, ‘তা মোচার কোনখানটা আগে পাকে?’

    কথাটা শুনে বাকি সকলে হো হো করে হেসে উঠল। কল্পনা একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘সে যাই বল না কেন, পিকনিকে এসে চুরি করে নেবার মজাই আলাদা।’

    রক্তিমরা প্রতি বছর দলবেঁধে ডিসেম্বরের একটা রবিবার দেখে পিকনিক করতে যায়। বাচ্চা-বড়ো মিলিয়ে জনা পঞ্চাশ লোক হয়। সবাই যে প্রতিবছর আসতে পারে বা আসে, তা নয়। অনেকেই বাদ যায়, সেখানে নতুন মুখ আসে। তবে তারা তথাকথিত কোন পিকনিক স্পট ভাড়া করে না। কারও বাগানে, মাঠে বা কোন বৃদ্ধাশ্রমের খোলা জমিতে পিকনিক হয়।

    এবারে তারা এসেছে এক গ্রামে। গ্রামের নাম রঘুপতিগড়। হুগলি জেলার একটি অতি সাধারণ গ্রাম। থানা পড়ছে চণ্ডীতলায়। এই গ্রামের বিশেষত্ব হল, যেখানে একটা মন্দির আছে। সেটা অবশ্য কোন কাজের কথা নয়। মন্দির, সে শতাব্দী প্রাচীন—অনেক গ্রামেই আছে। এই গ্রামের মন্দিরের উল্লেখ্য বিষয় হল, মন্দিরের শূন্যতার সেবা হয়। ধ্যানও হয় শূন্যতার।

    মন্দির থেকে কিছুটা দূরত্বে একজনদের পরিত্যক্ত বাড়ির ঢালাই উঠোনে, তেঁতুলগাছের ছায়ার নিচে ওদের রান্নার আসর বসেছে। বাড়িটিকে দেখভালের জন্য একজন বৃদ্ধা আছেন। শহুরে ভাষায় যার মানে দাঁড়ায়, কেয়ারটেকার। তার ছেলেপুলেরা কেউ তাকে দেখে না। এই বাড়িটি থেকে একটু দূরে তার ঘর। একটেরে, মাটির ঘর। সে এই বাড়িটিকে নিয়েই পড়ে থাকে। ঝাঁটপাট দেয়। পরিষ্কার রাখে। তার জন্য কিছু মাসোহারা পায় সে। তবে মূল দরজার চাবি তার হাতে থাকলেও ঘরগুলি সব তালাবন্ধ। কলকাতাবাসী বাড়ির মালিকেরা পালা-পাব্বণে এক আধবার আসে, দুই চারদিন থেকে যায়।

    বেড়ালের পায়ে চলা বুড়িটি বিনবিন করে বলে চলছিল, ‘মন্দির ঐ দিকে বাবারা, যাও না সব, যাও। মন্দির দেখে এস।’

    কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিচ্ছিল না। পিকনিক স্পট ভাল কি মন্দ সেই নিয়েই সকলে কাটাছেঁড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    এই বছর পিকনিকের তদারকির দায়িত্বে আছেন রামকৃষ্ণ মণ্ডল। তাঁর মেয়ে-জামাই হাউসিং এ ভাড়া এসেছে এই এক বছর হল। ওরা দুইজনেই ইস্কুল মাস্টার। পিকনিক করার কথা শুনে রামকৃষ্ণ মণ্ডল এই জায়গাটি বেছে দিয়েছেন। যারা আগে দেখে গেছে, তাদেরও পছন্দ হয়েছে। পরিত্যক্ত বাড়িটি নাকি ‘বিভূতিভূষণের গল্পে’র মত। সেখানের ঢালু ঘাস জমিতে বসলে ইটরঙ শূন্যতার মন্দিরটির কিছুটা অংশ গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়।


    ******

    দেখতে দেখতে আট বছর বয়স হল এই পিকনিকের। আশি পেরুনো, পাজামা-পাঞ্জাবি-শাল শোভিত, ক্লিন সেভড, একমাথা সাদা চুলের প্রবুদ্ধ শতপথী প্রতিবার এই পিকনিকে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘যেই নামটি দিয়ে থাকুক, খারাপ দেয়নি। চারিদিকে গ্রাম, ছায়াচ্ছন্ন এলাকা। মেঠো শীতের ফুলও দেখলাম আসার পথে। মোবাইল-নেট-আমাদের ভার্চুয়াল পৃথিবী যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। বিভূতিভূষণের বাড়িই বটে!’

    রান্নার লোক লুচি আর নতুন আলুরদম বসানোর আগে এক দফা চা করে দিয়েছে। নোনতা বিস্কুট সহ চা পান করে প্রায় সকলেই চলল মন্দির দর্শনে। মাত্র দুই একজন চেয়ারে বসে রইল। বাতের ব্যথায় তাঁরা নড়তে চড়তে পারেন না। পিকনিকের বাসে উঠেছেন সবচেয়ে নিচু সিঁড়ির নিচে প্লাস্টিকের পিঁড়ে রেখে। নেমেছেনও সেই ভাবে। বাস একেবারে স্পট অবধি আসেনি। গ্রামের ভিতরের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেখান থেকে এই সুঁড়ি পথে আসা।

    তাঁরা এইটুকু পথও কষ্ট করে হেঁটে এই ‘বিভূতিভূষণের বাড়ি’তে এসেছেন। এরপর আর তাঁদের নড়ার ক্ষমতা নেই। আবার হাঁটাচলা করবেন একেবারে ফেরার সময়। কষ্ট হলেও প্রতিবছরের এই পিকনিকে আসা চাই তাঁদের।

    ছোট ছোট গ্রুপে রক্তিমরা আরও অনেকের মত মন্দির দর্শনে চলল। গরানে(?? গড়ানে?) সেই সরু পায়েচলা পথের ধারে একটা বাঁক খাওয়ানো ছোট পুকুর। সেখানের টলটলে কালো জলে রাজহাঁস চলে। দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে খালি গায়ে উঠোনের কাঁচাকাঁচা কুলগাছের নিচে লাফায় আর তাদের উঠোনের ধারের কলাগাছে বলশালী মোচা ঝুলে থাকে। রক্তিমরা ভেবেছিল, হয়ত বাড়ির মালিকেরাই এসে বলবে, ‘আপনারা শহুরে মানুষ। আমাদের গাঁয়ে ফিস্টি করতে এলেন, নিয়ে যান না মোচাটা—ও আর এমন কি!’

    কিন্তু এমন কিছু ঘটল না। এখন দিনকাল পালটেছে। গ্রামের মানুষও এখন সমস্ত কিছুতে নির্বিকার থাকার শহুরে দক্ষতা ক্রমে অর্জন করে ফেলেছে। ওদের বাড়ির বউটা যেমন কাঠের জ্বালের উনুনে রান্না করছিল, করতে লাগল। আর একটা লম্বা চেহারার বিধবা বুড়ি মানুষটা কেবলমাত্র একটা মলিন শাড়িতে নিজের শরীর কোনক্রমে ঢেকে সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ওদের দিকে দেখার কোন প্রয়োজন আছে বলে কেউ মনে করছে না।

    তাই একটু দাঁড়িয়ে থেকে ওরা নীরবে মন্দিরটির দিকে হাঁটা লাগাল। কল্পনা চুপিচুপি সমবয়সী শ্যামলীর কানে বললেন, ‘পরে মওকা বুঝে মোচাটার সদগতি করা যাবে!’

    মন্দিরে একজন সেবায়েত আছেন। আন্দাজ বছর আটচল্লিশ বয়স হবে। দোহারা চেহারা। তাঁর পরনে না গেরুয়া না সাদা—এমনি রঙের একটি ধুতি ও গায়ে একটি ফতুয়া। তিনি নিজের নাম বললেন না, পূর্বাশ্রমের কথা কিছু বললেন না। কেবল জানালেন, বাড়ি বাঁকুড়ায়। আর এখানে তিনি একাই থাকেন। বছরে দু’বার মন্দিরে ভক্ত সমাগম হয়।

    সেবায়েতের সবসময় হাসি মুখ আর কথা বলছেন ধীরে। রক্তিম মন্দিরের চাতালে বসে গেল। অদ্ভুত এক আমেজ আছে এখানে। সে গোটা এলাকাটা দেখতে থাকল মন দিয়ে।

    তার পুবদিকে মুখ। সেখানে বিশাল এক সর্ষে খেত। তারপর তাল-নারকেল-নিম-বট-তেঁতুলের সারি। ফলে আকাশের অনেকটাই তারা আড়াল করে রেখেছে। সর্ষে গাছে ফুল এসে গেছে। ফুলেরা মৃদু উত্তরে বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। সেদিকে একটা গেট আছে। মন্দিরের খিড়কি পথ। তারা ঢুকেছে মেন গেট দিয়ে। তার বাঁ পাশে গোলাপ ফুলের বাগান। শীতের ফুল গাছও আছে দুই একটি। তারপর এক প্রাচীন আমগাছ। খরা মারা উঠোনে সেই গাছের দুই একটি হলুদ পাতা খসে পড়ছে মাঝে মধ্যে। তার ডানদিকে ধ্যানঘর। সেগুলি ঢালাই নয়। ইঁটের পাঁচ ইঞ্চির দেওয়াল। মাথায় টালি চাপান। পাশেই মোটর পাম্প বসানো। ট্যাপকল, বেসিন। পাশে বাথরুম ও পায়খানা। ‘বিভুতিভূষণের বাড়ি’তে বাথরুম থাকলেও তালা চাবির কারণে তা ব্যবহার করার উপায় নেই। তাই রামকৃষ্ণবাবু এখানে বাথরুমের ব্যবস্থার কথা বলে রেখেছেন।

    পিকনিক পার্টির যারা ঢুকেছিল, বাথরুম সেরে একটু আধটু ঘুরে নিয়ে এক এক করে বেরিয়ে যেতে থাকলেন। তারা না ভাল করে দেখল কিছু, না কোন প্রণামী দিল, না কথা বলল সেবায়েতের সঙ্গে।

    কল্পনা এসে বললেন, ‘রক্তিম, চলো, ফেরা যাক। এতক্ষণে লুচি আলুরদম নেমে গেছে।’

    মিত্রবাবুও বললেন, ‘শীতের বেলা, কড়াই থেকে লুচি নামতে নামতেই জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে। এখানে বেশি সময় নিলে ফিরে গিয়ে সেই ঠান্ডা লুচিই খেতে হবে। চলো, যাওয়া যাক।’

    শ্যামলী বটব্যাল বললেন, ‘সেই ভাল। মাঝে তো আবার আসতে হবে, তখন একটু বসে যাব।’

    রক্তিমের এখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। সে কখনও শুন্যতার সেবায়েত, শূন্যতার মন্দির দেখেনি। এই হইচইয়ের দলে সেটা হবে না। তাই বলল, ‘আপনারা চলুন। আমি একটু পরে যাচ্ছি।’


    ******

    ক্রমে ক্রমে গোটা মন্দিরটিই ফাঁকা হয়ে গেল। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এল মন্দিরে। আমগাছে উড়ে এসে বসল দুটি টিয়া। দু’ চারিটি শুকনো পাতা খসে পড়লে মাটিতে শব্দ উঠল। সেখানে বসেই মুখটা অনেকটা উঁচু করে বাকি আকাশটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল রক্তিম। সেবায়েত চলাফেরা করছেন বেড়ালের পায়ে। রক্তিম নিচু গলায় বলল, ‘একটু শুনবেন?’

    সেবায়েত স্মিত মুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘বলুন।’

    ‘আপনার হাতে যদি খানিকটা সময় থাকে তাহলে একটু বসবেন? আমি এই মন্দির নিয়ে জানতে চাই।’

    শ্বেত পাথরের চাতালে সেবায়েত রক্তিমের মুখোমুখি বসল। পরনের কাপড়ে ভিজে হাত মুছে বললেন, ‘বলুন, কী জানতে চান?’

    ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের পুরো এই মন্দিরটি দেখছি। আমি শুনেছি আপনারা শূন্যতার ধ্যান করেন। এই মন্দিরে কোন মূর্তিই বা নেই কেন!’

    ‘আমরা মূর্তিপূজা করি না। আমরা নিরাকার।’

    একটু অবাক হয়ে রক্তিম বলল, ‘মানে?’

    ‘এটাকে অনেকে শূন্যতা বলে কিন্তু আমরা বলি নিরাকার। শূন্যতা আর নিরাকার এক নয়।’

    ‘আচ্ছা!’

    এই চাতালের শেষদিকে, পুবদিকে যে তিনটি শ্বেতপাথরের বেদি আছে, সেখানে তিনজনের নাম পাথরে খোদাই করে লেখা। সেখানে আছে আবির্ভাব ও তিরোধান সন। সেবায়েত জানালেন, ‘একদম ডানদিকের সমাধি মন্দির হল শ্রী শ্রীমৎ ভগবত স্বামী সত্যানন্দের। তাঁর পুত দধভস্ম নিয়ে এই সমাধি বেদি গঠিত। পাশেরটি তাঁর স্ত্রীর। এই আশ্রমটি তাঁদেরই সৃষ্টি। আর বাঁদিকেরটি তাঁর প্রধান শিষ্য শ্রীশ্রী শ্রদ্ধানন্দজীর। উনি বিবাহ করেননি।’

    ‘আর আপনার গুরু?’

    ‘আমার গুরু গৃহী। তিনি সত্যানন্দজীর কনিষ্ঠ সন্তান। এই গ্রামেই তাঁর গৃহ। বাইরে ওই যে দোতলা বাড়ি দেখছে, ওখানেই উনি পরিবার নিয়ে বাস করেন।’

    ‘আর আপনার পরিবার?’

    সেবায়েত নীরব রইলেন।

    ‘নিরাকারের সেবক বিষয়টি যদি বুঝিয়ে বলেন।’

    ‘আমরা ওঁ-এর ধান করি।’

    ‘ব্রাহ্মরাও তাই করতেন। আপনারা কি তবে ব্রাহ্ম?’

    সেবায়েত আবার চুপ।

    রক্তিম বুঝল, এই কথাটা বলে সে ভাল করেনি। সে বিষয়টি হালকা করার জন্য বলল, ‘এই বিষয়ে আপনাদের কোন পুস্তিকা আছে?’

    তিনি দোতলায় উঠে গেলেন। তখনই রক্তিমের চোখে পড়ল, ধ্যানঘরে কে যেন বসে আছে। একটু ঝুঁকে পড়ে সে দেখল, একজন ভদ্রমহিলা অত্যন্ত উদাস হয়ে একটা সাধারণ শাড়ি পরে বসে রয়েছেন কাঁচাপাকা এক ঢাল এলোচুলে। তাঁকে চিনতে পারল রক্তিম। পিকনিকের বাসেই এসেছেন। কিন্তু হাউসিং-এ তাঁকে সে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। হতে পারে নতুন এসেছেন। তাছাড়া তাদের কমপ্লেক্স-এ হাজারটা ফ্ল্যাট। সবেতেই যে লোক থাকে, তা নয়। কিন্তু যারা বাইরে একদমই বেরোয় না, তাদের মুখ চেনা বা নাম জানা সম্ভব হয় না সবসময়। সেই হিসেবেই এই মধ্যবয়স্কা মহিলা তার অচেনা হতে পারে। তাদের এই পিকনিকে বুড়োবুড়ি ও মধ্যবয়স্কদের ভিড়ই বেশি। কারও থেকে খবর পেয়ে পিকনিক দলের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু যেখানে সবাই মন্দির ঘুরে-টুরে চলে গেল, এই একা ধ্যানঘরের দরজার আড়ালে বসে কী করছেন? নিরাকারের ধ্যান?

    সেবায়েত গোলাপি, সাদা ও সবুজ এই তিন রঙের তিনটি ছোট ছোট পুস্তিকা নিয়ে নিচে নামলেন। মোট দাম পড়ল পঁচানব্বই টাকা। পার্স থেকে একশ টাকা বের করে দিল রক্তিম। বলল, ‘বাড়ি ফিরে পড়ব।’

    তিনি স্মিত মুখে হাসলেন।

    ‘ধ্যানঘরে কী হয়?’

    ‘আমরা শূন্যতার ধ্যান করি।’

    ‘শূন্যতা? এই যে বললেন, নিরাকার?’

    ‘শূন্যতা তো নিরাকারই। গোটা পৃথিবী শূন্যই। তাই এই পৃথিবী, মায়া-মমতা-ভালবাসা, মানুষের যাবতীয় সম্পর্ক—সবই তো সেই নিরাকার—শূন্য। ঈশ্বরের মূর্তি এক কল্পনামাত্র। আর কল্পনা মানেই শূন্য, নিরাকার।’

    ‘দাঁড়ান দাঁড়ান, আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে! আপনি একবার বলছেন শূন্যতা আর নিরাকার এক নয়, আলাদা—‘আবার বলছেন এক—এর মানেটা কী?’

    ‘আপনি তখন ব্রাহ্মদের কথা বলছিলেন না? ওঁনারা ‘ওঁ’ এর ধ্যান করেন। সেটাও কিন্তু মূর্তির এক রূপ। পাথরও তাই, ক্যালেন্ডারের ছবিও তাই। আমাদের ধ্যানের সামনে, পূজার সামনে কোন কিছুই থাকে না।’

    ‘তার অর্থ?’

    ‘নিরাকার তো প্রথম থেকেই আছে। আর শূন্যতা হল আজ যেখানে যা আছে কালকে সেখানে আজ মুছে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া। এ অতি জটিল বিষয়। আপনি যে তিনটি পুস্তিকা সংগ্রহ করলেন, তা একটু একটু করে পড়েন, সব ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর যদি পারেন পৌষের পূর্ণিমায় তিনদিন অনুষ্ঠান চলে, আসবেন তখন। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের।’

    ইত্যাদি নানা কথা আলোচনার পর সে বেরিয়ে এল মন্দির থেকে। সেখান থেকে পিকনিক স্পট ‘বিভূতিভূষণের বাড়ি’ হেঁটে পাঁচ মিনিট। টিনের চালা মন্দিরকে পাক দিয়ে ঘুরেই ছোট পুকুর পাড় থেকেই দেখা যায়। পুকুরে একটি বৌ বাসন ধুচ্ছিল। রক্তিমকে আসতে দেখে বুকের আঁচল টানল।


    ******

    স্পটে পৌঁছতেই গোস্বামী বলল, ‘কি ভায়া রক্তিম, মোচার খবর কি হল?’

    রক্তিম হেসে বলল, ‘সে খবর কল্পনাদির কাছে। মোচার মালিক উনিই।’

    বলে সে পেতে রাখা প্লাসটিকের সবুজ চেয়ারে বসে পড়ল। এখানে রোদ নেই। গাছপালার ছায়া আছে। রোদ পড়ে আছে একটু দূরে, যেখানে সাদা গরুটা বাঁধা আছে। সে উঠে পড়ল। ভিতরে গিয়ে শালপাতায় লুচি ও আলুরদম নিয়ে বসে পড়ল। এখানকার জমির নতুন আলু। দারুণ স্বাদ। গপাগপ কয়েকটি লুচি ও অনেকখানি আলুরদম খেয়ে ফেলল সে। কল্পনারা আগেই চলে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে সামনের মাঠ ঘুরে এসেছে। চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, চন্দ্রমুখী আলু এখন পাঁচ টাকা কেজিতে বিকোচ্ছে। তবে নিতে হলে বস্তা নিতে হবে, খুচরো নয়।

    লুচি পর্ব সমাধা করে রক্তিম বেরুল। কল্পনা বসে বসেই বললেন, ‘আমি ভেবেছি, মোচাটা তুমি আমার জন্য পেড়ে আনবে। তাই মন্দিরে রয়ে গেলে। ফাঁকা সময়ের সদ্‌ব্যবহার করবে।’

    রক্তিম বলল, ‘ওটাকে ঠিক মন্দির বলা যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ ওরা নিরাকারের সেবক। মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নয়।’

    গোস্বামী চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললেন, ‘মোচাটা কি তবে নিরাকার?’

    তাঁর কথা শুনে উপস্থিত সকলে হেসে ফেলল। পঞ্চাশ জনের দলটা এখন বেশ হালকা। কিছু লোক বাড়ির ভিতরে আছে, রান্নার কাজে সাহায্য করছে বা রান্না হওয়া দেখছে। বাকিরা গেছে জমিতে, চাষিদের বাড়ি বাড়ি। গ্রামের ‘টাটকা শাক-সব্জি নিয়ে ফিরব’—এই আশায়। তাঁদের সবাই যে কল্পনার মত না বলে চেয়ে নেওয়ায় বিশ্বাসী, তা নন। অনেকে রীতিমত পয়সা দিয়ে বাস বোঝাই করে নিয়ে যায়।

    মণ্ডলগিন্নি বললেন, ‘বাড়িটার নাম ‘বিভূতিভূষণের বাড়ি’ কে দিল বলতো, কল্পনা?’

    কল্পনা বললেন, ‘কে জানে!’

    সে সময় কোট-প্যান্ট-টাই ও হ্যাট শোভিত মিঃ গাঙ্গুলি এসে বললেন, ‘আমার মিসেসকে আপনারা কেউ দেখেছেন? অনেকক্ষণ হল, দেখতে পাচ্ছি না। টিফিনও করেনি!’

    ‘এই রে!’ কল্পনা বলে উঠলেন, ‘বৌদি আবার ওরকম, মন্দিরে গেছিলেন? আমরা সবাই ওখানেই ছিলাম। তারপর ওখান থেকে ফিরে এসে কিছু জন মাঠে ঘুরতে গেছে, বাকিরা এদিক ওদিক আছে। বাস থেকে নামার পর আমি আর খেয়াল করিনি বৌদিকে।’

    ‘মন্দিরে এই তো ঘুরে এলাম, কই—।’

    রক্তিম বলল, ‘মন্দিরের সাইডে ধ্যানঘর বলে লম্বা একটা হল ঘর আছে। সেখানে একজনকে আমি বসে থাকতে দেখেছি।’

    কল্পনা বললেন, ‘গাঙ্গুলিদা, আপনি আর একবার মন্দিরে যান। রক্তিম যেখানে বলছে, সেই ঘরের ভেতর ঢুকে দেখুন। রক্তিম তো বৌদিকে আগে দেখেইনি। আপনাকেই বা হাউসিং এর কতজন চেনে? এই তো সেদিন এলেন মুম্বাই থেকে।’

    গাঙ্গুলি বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা তো ঠিকই। ওঁনার সঙ্গেই তো আমার এই আলাপ, বাসে বসে। আর আমার মিসেস তো বাইরেই আসে না। যাক, দেখি গিয়ে—।’

    তিনি চলে গেলে কল্পনা বললেন, ‘গাঙ্গুলিবাবুর গল্প জান?’

    ‘না। কী গল্প?’

    ‘ওঁনার লাইফ খুব প্যাথেটিক, জান। উনি চাকরি করতেন মুম্বইতে। সেখানের প্রবাসী বাঙালি হয়ে গেছিলেন। একমাত্র ছেলের অষ্ট্রেলিয়ায় চাকরি হয়েছিল। সেটা সেলিব্রেট করতে বাইক নিয়ে গোয়া যাচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। যাবার পথেই রাস্তায় সেই ছেলে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে সে মারা যায়। তারপর তিনি চাকরি ছেড়ে বৌদিকে নিয়ে এখানে চলে আসেন। হাউসিং-এর এই ফ্ল্যাটটা দশবছর আগে কিনে রেখেছিলেন। ওঁনার আসল বাড়ি বাঁকুড়ায়।’

    ‘আপনার পাশের ফ্ল্যাটটাতেই উনি থাকেন বোধহয়।’

    ‘পাশের নয়, আমার তিনতলায়। বলতে গেলে আমিই ওঁনাকে জোর করে পিকনিকে এনেছি। বৌদি প্রচণ্ড ডিপ্রেসড। কারও সঙ্গেই কথা বলেন না। দাদা সামলে নিয়েছেন। কিন্তু বৌদি এই এক বছরেও সেই ধাক্কা সামলাতে পারেননি। যদি বৌদিকে আবার স্বাভাবিক করা যায়, তাই পিকনিকে আনা।’

    মাংস রান্নার গন্ধে চার পাঁচটা কুকুর জমা হয়ে গেছে। হাউসি-এ যার কারণে পথ-কুকুরদের বাড়-বাড়ন্ত, সেই আনম্যারেড, সরকারি চাকুরিজীবি, পঞ্চাশেও চড়া মেকআপে যিনি নিজেকে সুন্দরী দেখতে ভালবাসেন, হাউসিং-এর দুই কামরা ফ্ল্যাটে একাকি বাস করা সেই প্রতিমা পাল অন্যান্য বছরের মত এই বছরও পিকনিকে উপস্থিত। আর তাঁর প্রশ্রয়ে উপস্থিত এখানের নেড়ি কুত্তারাও। ইতিমধ্যে তারা একটি করে লুচি প্রতিমার থেকে ‘প্রসাদ’ হিসেবে পেয়েছে। এবং তারা খাবারের সন্ধানে গ্রামান্তরে যাওয়া শ্রেয় বলে মনে করছে না। থাবা গেড়ে বসে আছে প্রতিমার সামনে।

    কল্পনা বললেন, ‘তুমি কি এদের বাসে তুলে নিয়ে যাবে বলে ভাবছ নাকি?’

    প্রতিমা একগাল হেসে বললেন, ‘না না, কি যে বল!’

    বটব্যাল একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘হাউসিং এর কুকুর আর বাড়িও না, বাপু। যারা আছে, তাদের নিয়েই জ্বলছি! খাওয়া নিয়ে ওদের চিন্তা নেই। তোমার ঘর থেকে ওরা ভাতমাছ পায়, খায়; আর দিনেরবেলা পড়ে পড়ে ঘুমায়। রাত্রে এত বিকট চিৎকার করে যে শান্তিতে ঘুমুতে পারি না। বারান্দার সামনে কয়েকটি ফুলগাছ লাগিয়েছিলাম। হারামজাদাগুলো সেই গাছের উপর পড়ে কাল রাতে এমন কামড়াকামড়ি করেছে যে অত টাকার গাছ আজ আর একটাও আস্ত নেই!’

    প্রতিমা পাল কিছু বলার জন্য টুকটুকে লাল ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, সরকারবাবু তখন পাশ থেকে বিরক্তি মুখে বললেন, ‘আঃ, এখানে এসেও এসব কথা না তুললেই নয়?’

    তখন তারা বাইরে থেকেই শুনতে পেল, রাঁধুনিরা কাকে যেন ধমকাচ্ছে। রক্তিম বাড়ির ভিতরে গেল। দেখল, ধমক খাচ্ছে সেই বুড়িটা। হাতে এক বাটি আলুরদম। রাঁধুনি রক্তিমকে দেখতে পেয়েই বলল, ‘এই দেখুন, এই বুড়ি কতবার এই বাটিটা করে আলুরদম নিয়ে গেল। বুড়ি মানুষ বলে কিছু বলিনি। কিন্তু যা দেখছি, একবালতি আলুরদম ও একাই ঘরে নিয়ে যাবে! এদিকে তো বারবার বলছে, ছেলেবউ থেকেও নাই, ভাত দেয় না; নিজেরটা নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হয়---তবে কার জন্য এত, ঠাকুমা?’


    ******

    যারা এদিক-ওদিক গিয়েছিল, একজন দু’জন করে ফিরে আসছেন সব। মণ্ডলের ছেলে-বউমা-নাতি, এই প্রথমবার আসা অল্পবয়স্ক পাহাড়ি দম্পতি। কারও হাতে দুই এক ডাল করে লাউশাক, কারও হাতে একটি দুটি করে বেগুন। এসেই জল খেয়ে রান্নার খোঁজ। এরা হঠাৎ ফিরে আসাতেই অস্বস্তিকর কুকুর প্রসঙ্গে থেকে সকলেই রেহাই পেয়ে গেলেন। কল্পনা স্বগতোক্তির মতন বললেন, ‘আমাদের যৌবনে বয়স্করা বলতেন, একটা ফল আবার ফল! এখন সবারই তো একটা করে বাচ্চা। তখন যদি বড়দের কথা শুনে দুটি বাচ্চা নিতাম, একজন হয়ত কাছে থাকত। এখন তো আর কোন উপায় নেই!’

    প্রবুদ্ধ বললেন, ‘তোমার ছেলে তো গ্রীন কার্ড পেয়ে গেছে শুনলাম, কল্পনা।’

    ‘না, মেশোমশাই, এখনও পায়নি। পাবে পাবে হচ্ছে—এই সময় ট্রাম্প কি সব নিয়ম বার করে দিল, ফলে এখন আর এত সহজে হবে না। এই তো, সাত আট মাস আগেই আমি ঘুরে এলাম ওখান থেকে। গ্রীন কার্ড পাবে, বাড়ি কিনবে—এই আনন্দেই ছেলে-বউমা মশগুল ছিল তখন। এখন ওদের ওদেশে রাখবে কিনা, কে জানে!’

    গাঙ্গুলি তাঁর স্ত্রীকে ধরে ধরে নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। রোদ এখন অনেকটা ঘুরে গেছে। যেখানে দুটি ছাগল লাফায়; একটি কাটা তালগাছ পড়ে থেকে থেকে মলিন হয়ে গেছে সেখানে। তাতে ঘুঁটে দেওয়া। সে সব বাঁচিয়ে মাঠ ঘোরা কিছু পিকনিক পার্টির লোক তালগাছের উপর বসে পড়ল। তাদের হাত খালি।

    লুচি আলুরদম গাঙ্গুলিগিন্নির মুখে রুচল না। একটি খেয়ে বাকি তিনটি ফেলে দিলেন। কুকুরেরা রোদ ছেড়ে এসে তা কুড়িয়ে নিয়ে আবার রোদেই ফিরে গিয়ে গা এলিয়ে দিল।

    কল্পনা উঁচু গলায় বললেন, ‘বৌদি, মন্দিরে ছিলেন, বলে যাবেন তো। গাঙ্গুলিদা অস্থির হচ্ছিলেন। ওখানে কি করছিলেন আপনি এতক্ষণ?’

    ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে বললেন, ‘ওখানে নিরাকারের পূজা হয়।’

    ‘যাকে দেখা যায় না, তার আবার পুজো কি? ও সব ভাঁওতা!’

    ‘সে জন্য ধ্যান করতে হয়। শূন্যতার ধ্যান।’

    ‘আপনাকে কতবার বলেছি বৌদি, দু’জনে মিলে বেলুড় মঠে গিয়ে দীক্ষা নিয়ে আসুন। এবার আর দেরি করবেন না। দীক্ষা নিয়েই হাউসিং-এর ‘শ্রীরামকৃষ্ণমণ্ডলী’র মেম্বার হয়ে যাবেন। প্রতি শনিবার সন্ধেতে সেখানে ধর্মালোচনা হয়। আমার তো ওসব নিয়েই কেটে যায়। সিরিয়াল-টিরিয়াল আমার ভাল লাগে না।’

    এবার থেমে থেমে কেটে কেটে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি দীক্ষা নেব। তবে ওখানে নয়। আমি এই মন্দিরে নিরাকারের দীক্ষা নেব। নিরাকারের সাধনা করব। মূর্তিপূজাতে আর আমার বিশ্বাস নেই।’

    রক্তিম দেখল, বুড়ি তাদের সকলের কাছে আসছে, কানে কানে কি সব বলে চুপ করে মুখ পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। তার কথা সকলেই মন দিয়ে শুনছে। শুনে কেউ ঘাড় নাড়ছে, কেউ চুপ থাকছে, কেউ তেমনি ফিসফিস করে করে কিছু বলছে। অবশেষে সে রক্তিমের কাছেও এল।

    দুপুরে যখন সকলে খেতে বসল, রক্তিম দেখল বুড়িটি আগের মতই মাঝে মাঝে বাটি নিয়ে আসছে, আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘আহা, মানুষ খাবে গা, মানুষ খাবে!’

    তাকে পাশে বসাল রক্তিম। বাড়ির সে লম্বা দুয়ার; সেখানেই সকলে বসে পড়েছে, খাওয়া-দাওয়া চলছে। রক্তিম বলল, ‘তা এইসব যে নিয়ে যাচ্ছ, কে খাবে তোমার? তোমার তো কেউ নেই বললে।’

    ‘আমি শুধু একখান লুচি আর দুটি আলু খেয়েছি, বাবা।’

    ‘তাহলে?’

    ‘আমার এক লাতিন আছে না, গোপাল; আমার বড্ড ন্যাওটা। ওর বাপ আমারে ভাত দেয় নাতো কি, ভালমন্দ রান্না হচ্ছে, লাতিনটারে কিছু প্রাণে ধরে দিতে পারবুনি, তা হয়? তুমিই বল না কেন!’


    ******

    সুঁড়িপথ আড়াল করে হালকা অন্ধকার নেমেছে। সেই অন্ধকার পথের সঙ্গে মানিয়ে বেঁটেখাট শরীর নিয়ে হেলেদুলে যেতে যেতে কল্পনা চিৎকার করে আগে থাকা চারজনের দলটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘পিকনিক স্পটটাকে ‘বিভূতিভূষণের বাড়ি’ কে প্রথম বলেছে, জানা গেল?’

    পিছনদিকে মুখ ফিরিয়ে মিত্রবাবু বললেন, ‘যেই দিয়ে থাকুক, নামখানা সত্যিই সার্থক। কি সুন্দর বাতাস, জলঘেরা পুকুর, পাড়ে কতকত ছায়ামেলা গ্রাম! মনে হচ্ছে ছেলেবেলার সেই গ্রামে ফিরে এলাম যেন। ফিরে গিয়ে বিভূতিবাবুর গল্প আবার পড়তে হবে। তালের ফুলুরি, দ্রব্যময়ীর কাশীবাস—আহা!’

    পাশ থেকে কে যেন মিত্রবাবুকে বলল, ‘ইছামতী পড়েছেন? পড়ে নিন।’

    ‘নাঃ, কতকাল পড়া হয় না। পড়ার অব্যেসই চলে গেছে। সময় পেলে এখন কেবল টিভি খুলে বসে থাকি। পড়ার কথা মনেই থাকে না।’

    ‘তাহলে শুরু করুন ‘দেবযান’ দিয়ে।’

    একটা আলো। রাস্তার ধারের ডুম জ্বলছে ল্যাম্পপোস্টে। সকলে দেখল, মিত্রবাবুর সঙ্গে যিনি কথা বলছেন তিনি আর কেউ নন, গাঙ্গুলীগিন্নি।

    সকলে খুশি হল। হাজার হোক, ফেরার সময় হলেও গাঙ্গুলীগিন্নি কিছুটা স্বাভাবিকের সুরে কথা বলছেন। সকলে অলক্ষ্যে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

    মণ্ডলগিন্নি আগের কথার খেই ধরে বললে, ‘সত্যি, শুধু ঐ বাড়িটাই নয়, এই গোটা গ্রামটিই যেন বিভূতিভূষণের গল্প থেকে উঠে এসেছে।’

    কল্পনা বললেন, ‘শুধু বাড়ি কেন গো, আমরাও।’

    গাঙ্গুলীগিন্নি বললেন,‘না, আমরা নই।’

    ‘কেন আমরা নই? আমরা কি বাঙালি না?’

    ‘সেটা কোন কথা নয়। এই গ্রামে আসল হল ওই বুড়িটা। বিভূতিবাবু বেঁচে থাকলে ওকে নিয়ে আবার একটা গল্প লিখতেন, ‘ও মোর গোপাল—!’

    ‘ওমা! ও! সকলের কাছে চোখ কাটাবে বলে দু’শ, একশ’ করে হাতিয়ে নিয়েছে। গাঙ্গুলিদা তো একেবারে পাঁচশ টাকার নোট হাতে তুলে দিলে। বারণ করলুম, শুনলে না। বললে, আমার আর টাকা নিয়ে কী হবে? তোর কত গেল রে, রক্তিম?’

    ‘কিছু নয়, শুধু মোচাটা। বুড়ি তো মাংস খায় না। কিন্তু মোচা খেতে ভালবাসে। মোচাটাকে মাংসর মত করে রেঁধে খাবে। আসার সময় তাই পেড়ে দিয়ে এলুম। সবজি, মশলা-পাতি যা বেঁচেছিল, সব দিয়ে এসেছি।’

    কল্পনা বললে, ‘ওরে শয়তান ছেলে! তাই ফেরার সময় দেখি মোচাটা নেই। আমি ভাবলুম, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। এখন তো দেখছি মণ্ডলগিন্নিই ঠিক বলেছিল, কল্পনাদি, তোমার মোচা হাওয়া হয়ে গেছে। আমাদের গ্যাঁটের কড়ি খসল একশ টাকা করে আর উনি কিছু না করেই মহৎ সেজে নিলেন—বা, বলিহারি!’

    মণ্ডলগিন্নি বললে, ‘বুড়িটা মোচাটা খাবে না হাতি, ও কাল গ্রামের কাউকে না কাউকে বেচে দেবে ঠিক, দেখিস।’

    কল্পনা বললেন, ‘আর চোখ কাটানোর ব্যাপারটা? সেটাও যে কতটা সত্যি কে জানে! এখানে যারা পিকনিকে আসে, তাদের থেকেই বুড়ি হয়ত এমনি করে টাকা তুলে খায়। ছেলেরা তো ভাত দেয় না শুনলুম।’

    সুঁড়িপথটা তারা সকলে একটু একটু করে পেরিয়ে এসেছিল। পিছন ফিরে তাকাল রক্তিম। পথটা পুরোপুরি ঢেকে গেছে অন্ধকারে। পিছনে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। না সেই বাড়ি, না নিরাকার মন্দির। রক্তিম মনে মনে বলল, ভাল থেক আমাদের বিভূতিভূষণের গ্রাম। ভাল থেক, বুড়িমা। হাজার টাকা দিয়ে এসেছি তোমায়—চোখটা যেন কাটিয়ে নিও, ভুল কোর না। আর তোমার গোপালকে ভাল রেখ।

    রাস্তার একটা ইঁটে পড়ে ঘুরে যাচ্ছিলেন গাঙ্গুলীগিন্নি। রক্তিম ধরে ফেলল। তার কেন জানি মনে হল, নিরাকারেরও প্রতিমা হয়। অন্তত মনে মনে।

    পিকনিকের বাসটা যেন রাস্তার নিরাকার মেদুর আলো মেখে তাদের সাকার পৃথিবীতে পৌঁছে দেবে বলে অপেক্ষা করছে।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments