আমার অজস্র অনুবাদের মধ্যে “নি:সঙ্গতার শতবর্ষ” এবং “এক্কা-দোক্কা”১ বইদুটোর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় নতুন সংস্করণ এবং পুনর্মুদ্রণ ঘটেছে। যে সময়ে আমি এই লেখাটি লিখতে বসেছি, ঠিক সেই সময়েই ন্যু ইয়র্ক টাইমস এবং লস এঞ্জেলিস টাইমস সংবাদপত্রের পেপারব্যাক বেস্টসেলারের তালিকায় স্থান পেয়েছে “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ”, যেটা কিন্তু মূল গ্রন্থের প্রকাশের সময় ঘটেনি। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের সমঝদার হিসেবে খবরটা আমার কাছে অতীব সুখের, কিন্তু অনুবাদক হিসেবে আমি শোকাহত। কারণ আগেকার দিনে অনুবাদ ছিলো অনেকটাই ঠিকের কাজ, শহরতলির কোনো প্রাসাদের বাগানের ঘাসে সার ছড়ানোর মতন — কাজ করলে আর অল্প কিছু পয়সা পেলে। যদি না মূল গ্রন্থের লেখক হন হোমার অথবা ভার্জিলের মতন অতিপ্রাচীন কেউ, অনুবাদককে রয়্যালটি দেবার প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমার পক্ষে কষ্টকর বসে বসে দেখা যে আমার ১৯৬৯ সালে করা অনুবাদগ্রন্থ বাজারে বিক্রি হয় ঝড়ের গতিতে আর আমি হিসেব কষে যাই কাজটা গত বছর করা হ’লে কতো হাজার-লক্ষ টাকা আসতো ঘরে। প্রথম পেপারব্যাক সংস্করণ প্রকাশের সময় ক্যাস ক্যানফিল্ড জুনিয়র২ আমায় অল্প কিছু রয়্যালটি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সংস্করণের সব কপি ফুরিয়ে যায় অনেক দিন আগেই। তারপরে একবারই বুক-অফ-দ্য মানথ ক্লাব থেকে জুটেছিল সামান্য সম্মানী, তা না হ’লে ধরে নেওয়া যায় ইংরেজিতে বইটির স্বত্ব যে সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত। সে যাই হোক, এবার বন্ধ করি আমার একঘেয়ে ঘ্যান ঘ্যান। দুর্ভিক্ষপীড়িত পঙ্গপালের মতনই আমরা অনুবাদকেরাও সাহিত্য-সম্পর্কিত মুখরোচক খাবার দেখলেই সাগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এই তথ্যটা জেনেই আমাদের অল্প কিছু সান্ত্বনা যে এমন এক ঠগ, প্রবঞ্চক এবং বুর্জোয়া ব্যবসাদারে ভরা ভুবনে আমরা অন্তত মহান এক কর্মে রত, যেমন সেই পুরানো আমলের প্রিন্স ফ্রাঁসোয়া করেছিলেন তাঁর “মৃত চড়ুই” গ্রন্থে।
আমি আগেই কোথায় যেন লিখেছি, মার্কেস যখন তাঁর গ্রন্থটির জন্যে নতুন এক অনুবাদক খুঁজছেন, আমি তখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম — কিন্তু হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪ - ১৯৮৪) তাঁকে বলেন আমার হাতের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই সম্পন্ন হয় সেই সংক্রান্ত সকলের সন্তুষ্টিতে, এমনকী সমালোচকদেরও, তবে মাঝেমধ্যে ইঁট-পাটকেল ছুঁড়েছেন অধ্যাপক ওরেন্দো।৩ আরও একটা বিরল ঘটনা — ক্লারিস লিসপেকতোর৪ এর উপন্যাসটির মতন “নি:সঙ্গতার শতবর্ষ”-ও আমি আগেই পড়েছি, তখন কোনো ধারণাই ছিলো না যে পরে এটার ইংরেজি অনুবাদ করবো। দুটি গ্রন্থের ক্ষেত্রেই আমি অনুবাদকর্ম শুরু করার আগেই জানতাম তাদের উৎকৃষ্ট গুণাবলীর কথা। উপন্যাসটি যারা মূল স্পেনিয় ভাষায় পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করেছেন তার সম্পর্কে, কারও কারও মন্তব্যে হয়ত বুদ্ধিমত্তার ছাপ নেই, কিন্তু সকলের বক্তব্যেই মেশানো ছিলো বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা। এসব শুনেই আমার হয়ত ভয় পেয়ে যাওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে আমি সহজে ভয় পেয়ে পিছু হঠিনা — অনুবাদকর্ম তাদের মধ্যে একটা, অতএব আমি ছিলাম প্রস্তুত। আগেই বলেছি যে আমি অনুবাদের কথা চিন্তা করার আগেই গ্রন্থটি পড়েছিলাম নির্ভেজাল পাঠক হিসেবে, এবং বুঝতে পারি যে আমার নিয়মিত অনুবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করলে হয়ত তার ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো। আমি অবাক হয়ে ভাবি কোন পদ্ধতিতে কাজটার ফল হতে পারতো সবচেয়ে ভালো; এবং এতবছর ছাত্রছাত্রীদের বইটা পড়ানোর পরে এখন যদি তার অনুবাদে হাত দিতাম, যে গ্রন্থের বিষয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন পড়ার সুযোগ ঘটেছে আমার, তা’হলে শেষ পর্যন্ত অনুবাদটা আরো ভালো হতো অথবা আরো খারাপ। এসব কথা তোলার অর্থই হ’ল যে আমরা একটা বই যখন ফিরে ফিরে পড়ি, প্রতিবারেই উন্মোচিত হয় নতুন দিগন্ত। একই কারণে আমরা বছরের পর বছর দান্তের নতুন নতুন ইংরেজি অনুবাদ হাতে তুলে নিয়ে ওজন দেখি, বিচার-বিবেচনা ও সহ্য করি সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি ছাড়াই, কিন্তু তবু পড়ে যাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, কারণ সেই ইংরেজি শব্দগুচ্ছের ফাঁকে বার বার উঁকি মারেন টাসকানির৫ অভিজাত ভদ্রলোক।
কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রথম সমস্যা হল কী নাম দেওয়া যায় গ্রন্থটির। যে কোনো গ্রন্থের অনুবাদকই আশা করেন যে গ্রন্থের শিরোনামটি সহজে অনুবাদযোগ্য হবে অথবা গ্রন্থের নাম হবে তার প্রধান চরিত্রের নামে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন হতে পারে যে অন্য ভাষায় মূল গ্রন্থের নামটি গ্রহণযোগ্যই নয় এবং সতর্ক থাকতে হবে যাতে নতুন ভাষায় গ্রন্থের নামটি মূলগ্রন্থের ভাববস্তু থেকে দূরে সরে না যায়। যদি সুধী পাঠক আমাকে অনুমতি দেন চলিত অপকৃষ্ট ভাষা এবং সামরিক ইতর বুলির মিশ্রণে এক উপমার ব্যবহার করতে, তা’হলে বলবো যে অনুবাদক গ্রন্থের সঠিক নামকরণে বিফল হ’লে সমালোচকেরা অনায়াসেই ঝান্ডার মতন ওড়াতে পারেন “ম্যাগির জাঙিয়া”।৬ “সিয়েন আনিওস দে সোলেদাদ” এর মতন সরল বিবৃতিমূলক শিরোনামের অনুবাদে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু আবার ভেবে দেখুন। “দে” অথবা “আনিওস” নিয়ে অসুবিধে থাকার কথা নয়, কিন্তু “একশো বছর” না লিখে যদি “শতাব্দী” লিখি তা’হলে “আনিওস” (“বছর”) হয়ে যায় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু একটু ভেবেচিন্তেই আমি সে পথে না যাবার সিদ্ধান্ত করি। “সিয়েন” অর্থাৎ “একশো” নিয়েই প্রথম সমস্যা কারণ স্পেনিয় ভাষায় এই বিশেষ্যের পূর্বে কোনো আর্টিকল থাকে না অর্থাৎ ইংরেজিতে তা হতে পারে “ওয়ান হানড্রেড” অথবা “এ হানড্রেড”। নামটি পড়ে বোঝা সম্ভব নয় কোন পথে যাওয়া উচিত। মহাকবি ভার্জিলের “ঈনীড” মহাকাব্যের অনুবাদকের মতন আমাদেরও পড়তে হয় ভাষ্য-সংক্রান্ত উভয়সংকটে — শুরু করবো কীভাবে?৭ “আমি গুণগান করি অস্ত্রের এবং...” তারপরে কী? “মানবের” অথবা “এক মানবের”? মূল লাতিন ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী দুটোই হওয়া সম্ভব। ভার্জিলকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি, কিন্তু তাঁর অনুবাদককে নিতে হবে। আমার ক্ষেত্রে আমি এই সময়ের গণ্ডীটাকে খুব নির্দিষ্ট করে দেখেছি, অর্থাৎ ভবিষ্যৎবাণীর মতন — যেটা যথার্থ ও নিরূপিত, প্রতিগণনার মতন — কেবল যে কোনো একটা একশো বছরের সময়সীমাতে নয়। কিন্তু গণ্ডগোলটা লাগে এই জন্যে যে স্পেনিয় ভাষার পাঠকদের জন্যে এই দুটো ব্যাখাই তাঁদের মনের অন্তর্জগতে বুনে দেওয়া হয়েছে, যেমন ওই ওপরের লাতিন উদাহরণে এবং যেমন ছিল রোম সাম্রাজ্যে। কিন্তু একজন ইংরেজিভাষী পাঠক যখন মূল স্পেনিয় ভাষ্যটা পড়বেন, তাকে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে — কোন ব্যাখার অনুসরণ করবেন। সেটা আগে থেকে তাঁর মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া যাবে না। আমার তখন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল (এবং এখনও রয়েছে) যে গাবো৮ এখানে বলতে চেয়েছেন “এক শতবর্ষ” এবং সেই অর্থটাই উপন্যাসের মূল সুরের সঙ্গে বেশি মেলে। এবং তা ছাড়াও তাঁর নিজের সামান্যতম আপত্তিও নেই আমার দেওয়া ইংরেজি শিরোনাম নিয়ে।
কিন্তু তার পরে এলো “সোলেদাদ” — সেখানেও একই রকমের দ্ব্যর্থবোধ, যদিও সেটা এম্পসনের৯ বর্ণিত কোনো প্রতীক বা আলাদা কিছু, সে রহস্যের আজও সমধান হয়নি। স্পেনিয় ভাষায় শব্দটি অবশ্যই তার ইংরেজি জ্ঞাতিভাই অর্থাৎ “সলিচিউড” এর ঘনিষ্ঠ, কিন্তু তার আরো একটি অর্থ রয়েছে অর্থাৎ “একাকিত্ব”, যার মধ্যে একলা থাকার ভালো এবং মন্দ, দুটো দিকেরই অনুভূতি বর্তমান। আমি “সলিচিউড”-এর দিকেই ঝুঁকলাম কারণ সেটা একাকিত্বের খানিকটা অর্থও বহন করে — যেমন বিলি হলিডের১০ গাওয়া গান শুনলে পাঠক বুঝতে পারবেন যে নি:সঙ্গতার মধ্যেই রয়েছে একাকিত্বের বীজ। গাবোরও নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল আমার নামকরণ, কারণ তিনি সেই অদ্ভুত ও অসম্ভব মন্তব্য করেছিলেন (যা আমার কানে অবশ্য মধু ঢেলেছিল) যে আমার ইংরেজি ভাষ্য তাঁর মূল স্পেনিয় রচনার থেকে তাঁর ভালো লেগেছে বেশি। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে একটা জোরালো উক্তি অথবা ব্যাখ্যা রয়েছে যেটা আমাকে বাধ্য করে নতুন করে ভাবতে বিষয়টি নিয়ে। কোথায় যেন গাবো লিখেছিলেন যে তাঁর মতে আমার অনুবাদের পদ্ধতি হ’ল — আমি প্রথমে তাঁর বইটি মন দিয়ে পড়েছি এবং তার পরে ইংরেজি ভাষায় তাকে নতুন করে লিখেছি। এটা হতে পারতো এক মহান কীর্তি এবং সাহিত্যের ইতিহাসে এমন অনেকবারই হয়েছে যে এক মহান সাহিত্যের অথবা পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে সম্পূর্ণ অভিনব নতুন সাহিত্যকর্ম। আমার তরুণী নাতনি জেনিফার সম্প্রতি হানসেল আর গ্রেটেলের রূপকথা অবলম্বনে গ্রিক পুরাণের শৈলীতে রচনা করেছে নতুন কাহিনি, যাতে বজ্জাত ডাইনি ফিরে এসেছে সৎ পথে। এটা কেমন করে সম্ভব হ’ল যে আমি অনুবাদ করলাম শব্দের পর শব্দ, আর বাক্যের পর বাক্য, কিন্তু গাবো ভাবলেন ঠিক তার উল্টো। অবশ্য আমি যেটা সচরাচর করি না — অনুবাদের আগে পুরো বইটা আগাগোড়া পড়েছি, সুতরাং তাঁর কথায় খানিকটা হলেও সত্যি রয়েছে। আমি নিজে এখনও পর্যন্ত কোনো উপন্যাস লিখিনি, আমি জানি না তার লেখার পদ্ধতি, কিন্তু অনুমান করতে পারি যে কাহিনিসূত্র, বিষয়বস্তু, মূল ভাব, চরিত্র আর পুরো পরিবেশটাই জন্ম নেয় ঔপন্যাসিকের মননে এবং তার পরে কেবল চাই কাগজ, কলম, আর সময়। আর সত্যি কথা বলতে কী, গার্সিয়া মার্কেস নিজেই বলেছেন তাঁর রচনাপদ্ধতি অনেকটাই এই রকম — পুরো ব্যাপারটা দানা বাঁধে তাঁর মনের মধ্যে এবং তিনি লিখতে বসে শব্দের সুতো টেনে টেনে তিনি সেই ভাবনাগুলোকে প্রকাশ করেন। হয়তো এমনটাই হতে পারে যে আমার অনুবাদ পদ্ধতির সঙ্গে তাঁর রচনা পদ্ধতির হুবহু মিল।
অনেক সময়েই কোনো কাহিনির প্রথম পঙ্ক্তিটাই সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় এবং অধিক উদ্ধৃত; ভেবে দেখুন, প্রুস্তের —
“অনেকদিন ধরেই আমি তাড়াতাড়ি শুতে যাই।” (“হারানো সময়ের খোঁজে”)
সেরভান্তেসের — “লা মান্চা অঞ্চলের কোথাও, যে গ্রামের নামটা আমি মনে রাখার চেষ্টাও করিনি,” (“দন কিহোতে”)
কাফকার — “একদিন সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর স্বপ্নের থেকে ঘুম ভেঙে দেখলো যে সে ঘুমন্ত অবস্থায় এক দৈত্যাকার পোকার মতন প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।” — (“রূপান্তর”)
ডিকেন্সের — “সেটা ছিলো খুব ভালো সময়, সেটা ছিলো খুব খারাপ সময়।” (“দুই শহরের কাহিনি”)
এই বইটির ক্ষেত্রেও: “মুচোস আনিওস দেসপুয়েস, ফ্রেন্তে আল পেলোতোন দে ফুসিলামিয়েনতো, এল কোরোনেল আউরেলিয়ানো বুয়েনদিয়া আবিয়া দে রেকোর্দার আকেলা তার্দে রেমোতা এন কে সু পাদ্রে লে ইয়েভো আ কোনোসের এল ইয়েলো।” বাক্যটি লোকের মুখে মুখে ফেরে, এমনকী ইংরেজিতেও, আমি কেবল জোড়হাতে প্রার্থনা করতে পারি যে তারা যা বলছে তাতে মূলের নির্ভুল ব্যঞ্জনা রয়েছে।
আমি লিখেছিলাম, “Many years later, as he faced the firing squad, colonel Aureliano Buendia was to remember that distant afternoon when his father took him to discover ice.” অনেক সম্ভাব্য অনুবাদ হতে পারে এই বাক্যটির। ব্রিটিশ সেবাবাহিনীর ক্ষেত্রে “ফায়ারিং স্কোয়াডের” বদলে বলা যেত “ফায়ারিং পার্টি” — সেটা আমার ভালোও লাগে, কিন্তু আমি লিখছি মার্কিন পাঠকদের জন্যে। “আবিয়া দে” ইংরেজিতে হতে পারে “উড (Would) — কতোটা কাঠ কাটতে পারে কাঠঠোকরা — কিন্তু আমার মনে হয়েছে এখানে “ওয়াজ (Was)” করাই সমীচীন। এছাড়া আমি “রিকল (recall)” না লিখে “রিমেমবার (remember)” লিখতে চেয়েছি, যার থেকে স্মৃতির গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। সময়ের ক্ষেত্রে “ডিসট্যান্ট (distant)” শব্দটির ব্যবহার আমার পছন্দের। তার বদলে “রিমোট (remote)” লিখলে রিমোট কন্ট্রোল বা রোবটের অবাঞ্ছিত অনুষঙ্গ এসে পড়তে পারে। আশা করি ড: আইনস্টাইন আমার শব্দ নির্বাচন অনুমোদন করবেন। সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা হয়েছিল “কোনোসের”-কে নিয়ে এবং আমি পরে জেনেছি যে এই শব্দটির অনুবাদ নিয়ে অধ্যাপক ওরেন্দো প্রচুর পরিমাণে হৈ চৈ করেছেন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আমার স্ত্রী ক্লেম এক অভিজাত সেমিনারে আমার নির্বাচিত শব্দের পক্ষ নিয়ে তর্ক করতে বাধ্য হয়। শব্দটির সোজা অর্থ হ’ল কাউকে প্রথমবার জানা, অথবা কারুর সঙ্গে পরিচয় হওয়া অথবা কারুর সঙ্গে প্রথমবার দেখা হওয়া। কিন্তু বরফের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মানে কী? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কাউকে বা কিছু জানার যে ক্রিয়াপদ “সেবার”, তার চেয়ে এই শব্দের অর্থ অনেকটা গভীর। গার্সিয়া মার্কেস অনেক ভেবেচিন্তেই শব্দটি ব্যবহার করেছেন স্পেনিয় ভাষায়। ইংরেজি রূপান্তরে বরফের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের অর্থ কী? “কী হে বরফবাবু, কেমন চলছে দিনকাল?” অথবা হতে পারে “বরফের প্রথম অভিজ্ঞতা”। প্রথমটা কেমন যেন বোকা বোকা, দ্বিতীয়টা প্রায় অর্থহীন। যখন আপনি কোনো বিষয় নিয়ে প্রথমবার জ্ঞাত হন, তখন আপনি তাকে “আবিষ্কার” করেন। তার পরেই বিষয়টি সম্পর্কে আপনার জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে। আমি লিখতে পারতাম “বরফের সঙ্গে প্রথম জানাশোনা” — কিন্তু সেটাও পাগলামি, বরফের সঙ্গে করমর্দন অথবা টুপি নেড়ে সম্ভাষণ। আমি লিখেছি “বরফ আবিষ্কার (discover)” এবং আমার বিশ্বাস উপন্যাসের এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বাক্যে আমার শব্দ নির্বাচন সঠিক।
এছাড়া গ্রন্থটির ধ্বনির পরিমাপের কথাও ভাবতে হবে। স্পেনিয় ভাষায় গার্সিয়া মার্কেসের বাক্যগুলিতে অনেক সময়েই গদ্যকবিতার অনুরণন থেকে যায়। তাঁর শব্দের নির্বাচন সঠিক কারণ তাদের অর্থের সঙ্গে তাদের কানে শোনা ধ্বনি মিলে সৃষ্টি করে নতুন ব্যঞ্জনা এবং তাদের যুক্ত করা হয় ছন্দোময় সমতায়। যেমন কোনো সঙ্গীতের স্বরলিপির রূপান্তর করা যেতে পারে এক যন্ত্র থেকে অন্য যন্ত্রে, সেইভাবে কোনো শব্দসমষ্টিকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করার সম্ভব হতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আমি আমার অনুবাদকর্মে মোটামুটি সন্তুষ্ট এবং আমার মতে তা অনুবাদের বদলে স্থান পরিবর্তন। যদিও আমি অন্য ভাষায় “শতবর্ষের” ভাষ্য নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি, একবার ব্রাসিলে গিয়ে আমার সুযোগ ঘটেছিল পর্তুগিজ ভাষার গ্রন্থটি সযত্নে পর্যবেক্ষণ করার। স্পেনিয় ভাষা যেমন অভিজাত, পর্তুগিজ ভাষা তেমনি সঙ্গীতময় — সেখানে ধ্বনির ব্যবহার অন্যরকম, উপন্যাসটি যেন আপন মনে গান গেয়ে ওঠে। স্পেনিয় ভাষাকে এইভাবে বর্ণনার মাধ্যমে আমি বলতে চাই যে ভাষার দক্ষ ব্যবহারে গাবো হলেন সেরভান্তেসের যোগ্য উত্তরসূরী। তাঁর ওস্তাদের ক্ষেত্রে যেমন, গাবোর ক্ষেত্রেও তেমনি তাঁর ভাষা কখনো বাসি হবে না, আমার কেবল গভীর আশা যে তার দীর্ঘজীবনের খানিকটা অংশ আমিও হয়তো পাবো।
পাঠকের মুখ চেয়ে আমি এই গ্রন্থের চরিত্রদের নামগুলো নাড়াচাড়া করেছি খুব সতর্কভাবে। কে বাবা আর কে ছেলে সে ব্যাপারে যাতে কোনো বিভ্রান্তি না হয় (যদিও লেখক নিজেই সন্তর্পণে উৎসাহ দিয়েছেন সেই বিভ্রান্তিতে) সে জন্যে আমি বৃদ্ধ গোষ্ঠীপতিকে সব সময়েই হোসে আর্কাডিও বুয়েন্দিয়া নামে বর্ণনা করেছি, কখনও সংক্ষেপ করে নয় — ঠিক যে রকম “পিনাট” কমিকের পাতায় “চার্লি ব্রাউনকে” সব সময় ডাকা হয় “চার্লি ব্রাউন” নামে। প্রতিটি নামেরই একটা ব্যক্তিগত সারাৎসার থাকে যেটাকে অক্ষত রাখা প্রয়োজন এবং উপন্যাস যত সামনে এগোয় সেই সারাৎসার স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে — নামগুলো পালটায় না, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাভ করে নতুন উপকরণ। আমি যখন বড়ো হচ্ছি, তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন ফ্র্যাংকলিন ডিলানো রুজেভেল্ট, তাঁর নাম উল্লেখ করা হত ফ্র্যাংকলিন ডি. রুজেভেল্ট অথবা এফ. ডি. আর নামে। বর্তমানে যখন কাউকে তাঁর নাম ফ্র্যাংকলিন রুজেভেল্ট বলতে শুনি, আমার মাথায় রাগ চড়ে যায়। নামের সারাৎসারটাই হয় বিলুপ্ত, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন, ফ্র্যাংকলিন পিয়ার্সের১১ সঙ্গে তাঁর আর কোনো তফাৎই থাকে না! এর পরে তাহ’লে কী হবে — জন হুইটিয়ার, হেনরি লংফেলো, অলিভার হোমস?১২ জ্ঞানী গাবোর অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণই ছিলো হোসে আর্কাডিও বুয়েন্দিয়া নামটি অক্ষত রাখার — কেবলমাত্র তাঁকে তার ছেলের সঙ্গে না গুলিয়ে ফেলার জন্যেই নয়; তাঁর পুত্রের নাম হোসে আর্কাডিও, কোনো পদবীর উল্লেখই নেই; তাঁর প্রপৌত্র হোসে আর্কাডিও সেগুন্দো। শেষ নামটিতে স্পেনিয় শব্দটির অর্থ “দ্বিতীয়”, কিন্তু সমধর্মী শব্দ বলে আমি তার ইংরেজি করিনি — ভেবেছিলাম হোসে আর্কাডিও দুই অথবা দ্বিতীয় হোসে আর্কাডিওকে মনে হবে রাজকীয় অথবা উন্নাসিক।
সম্পাদকেরাও ওই গ্রন্থে একটা বংশবৃক্ষ জুড়ে দিয়েছিলেন, অনুবাদের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও বানিয়েছিলাম আমি, প্রথমে মনে হয়েছিল ভালো অভিপ্রায় — পাঠককে সাহায্য করবে চরিত্রগুলোকে বুঝতে এবং আলো ফেলবে তাদের জটিল আন্ত:সম্পর্কগুলোর ওপরে। কিন্তু পরে বইটা বাজারে আসার পর আমার মত পালটে যায়। যদি গার্সিয়া মার্কেস এমন একটি সারণী চাইতেন, খুব সহজেই তিনি তা দিতে পারতেন প্রথম স্পেনিয় ভাষার সংস্করণে, কিন্তু দেন নি। ক্রমশ: আমার মনে হয়েছে যে হয়তো অল্প কিছু নামের বিভ্রান্তি একেবারে খারাপ জিনিস নয় — আমরা যেভাবে বানর অথবা ঘোড়াদের দেখি, বুঝতে পারি না তাদের অন্ত:সম্পর্ক, তারাও সেভাবে আমাদের প্রজাতির নরপশুদের দ্যাখে। যদি কোনো পরিবারে বংশপরম্পরায় সন্তানদের ঘুরে ফিরে একই নাম দেওয়া হয়, তাহ’লে ছয় সাত প্রজন্মের পরে অথবা শতবর্ষ পার হয়ে গেলে, পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে অন্য সদস্যের তফাৎ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। দ্রবীভূত হয়ে মিলিয়ে যায় স্মৃতি এবং আগে পরে কেবলমাত্র এমন লোকজনের মিছিল তুর্গেনেভ যাদের নাম দিয়েছেন “ধূসর মানুষ”। ব্যাপারটা গোলমেলে এবং যখন একদল পলিতকেশ অধ্যাপক কাতেদ্রা১৩ সিরিজে প্রকাশ করলেন উপন্যাসটির সঠিক সংস্করণ — গ্রন্থের শুরুতেই এক বংশলতিকা, পুরো পরিবারটির কুলুজিনামা।
“নি:সঙ্গতার শতবর্ষ” যখন পাঠক ও সমালোচকদের কাছে তার যোগ্য সমাদর পেল, প্রকাশকরাও আর এক বিন্দু সময় নষ্ট না করে ইংরেজিতে গাবোর অন্যান্য গ্রন্থ প্রকাশে মাঠে নামলেন। আমাকে বায়না দেওয়া হ’ল তাঁর প্রথম প্রকাশিত নভেলা এবং কয়েকটি ছোটোগল্প অনুবাদের। স্পেনিয় ভাষায় বইটির নাম “লা ওহারাস্কা” যার এক অর্থ “মৃত, ঝরা পাতা”, কিন্তু আবার অন্য অর্থ রাবিশ, জঞ্জাল, মূল্যহীন সামগ্রী। আবার আমি তুমুল বিক্রমে লাগলাম উপযুক্ত ইংরেজি শব্দের খোঁজে, যার মধ্যে ওই সমস্ত গুণাবলী ধরা পড়বে; অনেকদিন ধরে ভাবলাম এই নিয়ে। শেষ অব্দি খানিকটা উদ্ভাবনের সুযোগ নিয়ে নাম দিলাম “পাতার ঝড়” অথবা “লিফ স্টর্ম” — যে ঝড়ে “নি:সঙ্গতার শতবর্ষ” উপন্যাসের অন্তিম পর্বে ধ্বংস হয়েছিল মাকোন্দো গ্রাম এবং একই রকম প্রলয়ের পূর্বাভাস এখানেও যার ফলে পুরো শহরটাই পরিণত হবে জঞ্জালে। গাবোর সাহিত্যে মাকোন্দোর সেই প্রথম আবির্ভাব। এই নামকরণ আমার নিজের যে পুরো মনোমত হয়েছিল তা নয়, কিন্তু আলেকজান্ডার কোলম্যান যখন নামটা সোৎসাহে অনুমোদন করে বললেন, “চমৎকার হয়েছে”, আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তার পরে আর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবিনি।
মাঝে মধ্যেই এ ব্যাপারে আমার আত্মপ্রত্যয়ে ভাঁটা পড়তো — ভাবতাম, আমি কোনোভাবে নষ্ট করে ফেলেছি তাঁর আবেদন, গাবোর কালজয়ী উপন্যাসের পর তার প্রথম লেখা নভেলার অনুবাদ করে। ক্রমটা পালটে নিয়ে এখন যদি “নি:সঙ্গতার শতবর্ষের” নিখুঁত শৈলীর খানিকটা যদি অজান্তে অনুপ্রবেশ করে “পাতার ঝড়"-এর মধ্যে এবং তাকে তার যা প্রাপ্য তার থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাহলে কী হবে? পুরো ব্যাপারটা ঘটে যেতে পারে আমড়া গাছে ল্যাংড়া আম ফলানোর মতই বিভ্রান্তিকর, যদিও “পাতার ঝড়"-কে আমড়ার সঙ্গে তুলনা করা অন্যায় হবে, সেটা খুবই ভালো লেখা। শেষ পর্যন্ত আমাকে বাঁচালেন গাবো — তিনি স্পেনিয় ভাষায় যেমনটি লিখেছেন, আমি তার অনুসরণ করে গেলাম নির্দ্বিধায় এবং তার ফলাফল হ’ল আর একটি অনবদ্য অনুবাদ।
গল্পগুলি বিভিন্ন স্বাদের, কিন্তু পুরানো ক্লিশে ব্যবহার করে বলতে হয় — সবগুলিতেই গাবোর খানদানী ছাপ রয়েছে। গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছিল “এসকোয়ার” থেকে “প্লেবয়” এর মতো নানা বিচিত্র পত্রিকায়, যার থেকে প্রতীয়মান হবে যে উত্তর আমেরিকায় গাবো মোটেই অপরিচিত নন। তাঁর পরবর্তী দীর্ঘ উপন্যাস “কুলপতির হেমন্ত” এর খানিকটা অংশ প্রকাশিত হ’ল “দ্য ন্যু ইয়র্কার” পত্রিকায় এবং সেখানে প্রকাশ পেল সম্পাদকীয় ভীরুতা এবং ধ্যানধারণার গোঁড়ামি। উপন্যাসে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী শাসক এবং তাদের কদর্য, বিকৃত মানসিকতার বহি:প্রকাশ ও কীর্তিকলাপকে সোজা ভাষায় খোলাখুলি তুলে ধরা — তিনি লেখাটিকে অনুচ্ছেদে ভাগ করেননি এবং যতি চিহ্নের ব্যবহারও অত্যন্ত কম। এইভাবে গার্সিয়া মার্কেস চেয়েছেন ঘটনার গতি বজায় রাখতে এবং অপ্রতিহত গতিতে কাহিনিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সময়টা এমনভাবে কাটবে যেন কেউ বসে আছেন চলন্ত ট্রেনে নিজের আসনে, জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধাবমান জলাভূমি এবং বস্তি। আমি ইংরেজিতেও সেই অবাধগতি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়েছি। কাজটা বেশ কঠিন, কারণ দীর্ঘ বাক্যগুলো একে অন্যের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রুদ্ধনিঃশ্বাসে; যখন হোসে লেসামা লিমার১৪ “পারাদিসো” অনুবাদ করেছিলাম, তখন যেমন অতি উচ্ছ্বসিত ও জটিল সব বাক্য নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল, তেমন অবশ্য একেবারেই নয়। কিন্তু “দ্য ন্যু ইয়র্কার” এর ঠিক সহ্য হ’ল না আমার অনুবাদ, তাঁরা আবদার ধরলেন লেখাটিকে অনুচ্ছেদে ভাঙতে হবে আর তার মধ্যে ছড়াতে হবে যতিচিহ্ন। যেহেতু পুরো গ্রন্থটিই প্রকাশিত হবে অল্প সময় পরে এবং পত্রিকায় তার একটা অংশ আগেভাগে পড়লে পাঠকের আগ্রহ বাড়বে, সেই কারণে ক্যাস ক্যানফিল্ড এবং আমি রাজী হলাম তাঁদের প্রস্তাবিত পরিবর্তনে। তবে গাবোর কথা ভেবে — একটিও সেমিকোলন নয়।
যা বললাম সেটা অবশ্য পুরো কিস্সার অংশবিশেষ। গাবো তাঁর রচনায় একটি শব্দ সানন্দে বারংবার ব্যবহার করেন অনেক সময় গালাগাল অথবা আবেগোক্তি হিসেবে, কিন্তু অন্য সময় বর্ণনামূলক শব্দ হিসেবে — শব্দটি হল “মিয়ের্দা” যার অর্থ হল “বিষ্ঠা”। শব্দটির ভাবানুবাদ করলাম কেন তা একটু পরেই বলছি। আমার অনুবাদে আমি স্বভাবত:ই সঠিক ইংরেজিতে একমাত্রার জোরদার১৫ শব্দটি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছি — যেখানে যেখানে, নানান বৈচিত্রময় পরিবেশে মূল স্পেনিয় শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছে। কাহিনির নামহীন কুলপতির এটি একটি প্রিয় শব্দ এবং ইংরেজিতে সেটা তার স্থূল, জাগতিক, অনমনীয় অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করা আমার কাছে ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কাজটি আন্তরিকভাবে করি, যার ফলে দ্য ন্যু ইয়র্কারের দপ্তরের লোকেরা সংকটে পড়ে যান। আমি জানতে পেরেছি যে পত্রিকার উচ্চপদস্থ সম্পাদকমণ্ডলী ও কর্মীরা বার বার মিটিং ডেকে আলাপ-আলোচনা ও সলা-পরামর্শ করেছেন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ঠিক করতে, কারণ শব্দটি কখনও এর আগে ওই পত্রিকার পাতায় অবতীর্ণ হয় নি। কিন্তু সম্পাদকেরা বুদ্ধিমান — তাঁরা অনুধাবন করেন যে গল্পটিকে সফল করে তুলতে হ’লে, শব্দটির জোরালো অনুবাদ প্রয়োজন। গাবো সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু আমি জোর গলায় বলবো যে তাঁর সবচেয়ে বড়ো জয় হ’ল “দ্য ন্যু ইয়র্কারে” এই শিট্-প্রতিবন্ধককে চিরকালের জন্যে ভেঙে দেওয়া।
তাঁর পরের যে গ্রন্থটি আমার হাতে এলো তাতে কয়েকটি গল্প আর দুটি নভেলা — একটি পুরানো আর অন্যটি নতুন। গ্রন্থের সূচনা একটি নভেলা দিয়ে, যার নামটি দীর্ঘ — “লা ইনেক্রেইবল ই ত্রিস্তে ইস্তোরিয়া এরেন্দিরা ই দে সু আবুয়েলা দেসালমাদা” অর্থাৎ “সরল এরেন্দিরা ও তাঁর হৃদয়হীনা ঠাকুমার বিষাদময় ও অবিশ্বাস্য কাহিনি”। নামটি প্রথমে সংক্ষেপ করে লেখা হ’ল “সরল এরেন্দিরা ও হৃদয়হীনা ঠাকুমা” কিন্তু সেটাও দেখা গেল বই-এর প্রচ্ছদের পক্ষে ভীষণ লম্বা এবং কেটেছেঁটে কেবল “সরল এরেন্দিরা”। গার্সিয়া মার্কেসের প্রতিটি সাহিত্যকর্মের সুতো দিয়ে বুনে দেওয়া যায় এক কাঠামো, যাকে শক্ত করে ধরে রাখে বিষয়বস্তুর আর ছন্দসুরের বৈচিত্র্য এবং অনুবাদকের সৌভাগ্য, তাঁর অনবদ্য শৈলী। যখন আমি তাঁর রচনাসমগ্র উল্টেপাল্টে দেখি, স্পেনিয় ভাষাতে তাঁকে একবাক্যে চিনতে পারি প্রতিটি রচনায় এবং যদিও জানি যে এতে আমার স্বার্থ জড়িত, তাঁকে আমি খুঁজে পাই ইংরেজিতেও। সবখানে ছড়ানো তাঁর অননুকরণীয় গতিময় শৈলী এবং কাহিনির বৈচিত্র্যময় পরিবেশে তাকে প্রয়োগ করে অপরিসীম দক্ষতার সঙ্গে — এমন কী “নি:সঙ্গতার শতবর্ষ” এবং “কুলপতির হেমন্ত” এর মতন দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে। সেই শৈলীকে আমি বহন করে আনতে পেরেছি আমার ইংরেজি অনুবাদে — একথা ভেবে আমার সুখের শেষ নেই; যদিও আমি অন্যদের অনূদিত তাঁর সাহিত্যপাঠের সুযোগ বিশেষ পাইনি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে গাবোর শৈলীর নির্যাস সেখানেও পাওয়া যাবে।
“দ্য ন্যু ইয়র্কার” কথিত সমস্যা আবার দেখা দেয় অপ্রত্যক্ষভাবে গাবোর প্রথম দিকের একটি উপন্যাসের অনুবাদে। স্পেনিয় ভাষায় উপন্যাসটির নাম “লা মালা ওরা” (“দু:সময়”), কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস যখন উপন্যাসটি লিখছিলেন, তিনি তার নাম দিতে চেয়েছিলেন “এস্তে পুয়েব্লো দে মিয়ের্দা” (“এই গুএর শহর”)১৬। কোনো মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশক এই নামের একটি গ্রন্থের প্রকাশে সম্মত হবেন না, সে কথা বলাই বাহুল্য। অনেকে এই মত পোষণ করতেন যে এই উপন্যাসের শহরটির সঙ্গে মাকোন্দোর প্রচুর মিল, কিন্তু আমার সন্দেহ আছে গাবো তাঁর যাদুকরী, মোহিনী সৃষ্টির বিষয়ে এমন বিরূপ বিশেষণ প্রয়োগ করবেন। ওই বিশেষ “শব্দটি” ছাড়াই তিনি যে নতুন নাম দিয়েছিলন, তার অনুবাদেও প্রথমেই বিপত্তি। “দ্য ব্যাড টাইম” — চলবে না — বাসি রুটির মতন নীরস, একঘেয়ে। তারপরে আমার মনে হ’ল “ব্যাড” না লিখে “ইভ্ল (EVIL)” লিখলে কেমন হয়? বেশ ভালোই লেগে গেল শব্দটা। এবং “টাইম” এর বদলে স্পেনীয় “ওরা” শব্দের আক্ষরিক অনুবাদ করে “আওয়ার (Hour)” লিখি না কেন? শেষ পর্যন্ত আমাকে বাঁচালেন মহাকবি মিলটন — মনে পড়লো “হারানো স্বর্গ” মহাকাব্যের কথা এবং নন্দনকাননে শয়তানের প্রবেশ। শেষ পর্যন্ত “দ্য ইভ্ল আওয়ার” নামটিই গৃহীত হ’ল এবং তার ফলে শয়তান এবং পাপকর্মের অশুভ ছায়াও হয়তো পড়লো তার গায়ে।
এর পরে গার্সিয়া মার্কেসের আরো একটি উপন্যাসের আমি ইংরেজি অনুবাদ করেছিলাম — তার পরে আবার যখন সুযোগ আসে, আমি অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে তিনি অন্যত্র যান — সেটা হল “ক্রনিকল অফ অ্যা ডেথ ফোরটোল্ড”। স্পেনিয় ভাষায় তার নাম “ক্রনিকা দে উনা মুয়ের্তে আনুসিয়াদা” এবং আমার করা ইংরেজি অনুবাদে নামটি প্রথমেই পেলো অতিপ্রত্যয়ী প্রতিবেদকদের পুঁথিগত, পণ্ডিতি ঠোক্কর। অনেকেই আমাকে বললেন, নামটি হওয়া উচিত ছিল “ক্রনিকল অফ অ্যান অ্যানাউন্স্ড ডেথ”। আমি এমন বিদঘুটে নাম বহুকাল শুনি নি। আমি কেবল ভাবতে পারি যে ন্যু ইয়র্কের পেন স্টেশানে ট্রেন ধরতে গেছি আর গমগমে গলায় ঘোষণা চলছে কোনো বেচারি আত্মার পরজগতে যাত্রার। এই চরম অর্থহীন ও হাস্যকর সমালোচনার পরে আমার নিজের দেওয়া শিরোনামে আমি সন্তুষ্ট হই এবং এই ভেবেও আমি আনন্দিত যে ভবিষ্যতে এই আকর্ষণীয় বাক্যবন্ধটি একটি ক্লিশেতেও পরিণত হতে পারে। কারণ গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরে আমি বিভিন্ন স্থানে দেখেছি এই একই রকম “ক্রনিকল অফ অ্যা-----------ফোরটোল্ড” বাক্যাংশের ব্যবহার। আমার মনে হয় না যে তার বদলে “অ্যানাউন্স্ড” লিখলে তার একই রকম অভিঘাত সম্ভব হ’ত।
আমার মনে হয় যে ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্য এবং রহস্যময় —গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে আমার কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবার পরে আমি হর্হে আমাদো (১৯১২ - ২০০১)১৭ এর সঙ্গে কাজ শুরু করি এবং তাঁর বেশ কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদের কাজে নামি। হঠাৎ আমার মনে এই অদ্ভুত চিন্তা আসে যে মাকোন্দো শহরটি বাহিয়া রাজ্যের মধ্যে কোথাও অবস্থিত, হয়তো তার দক্ষিণ প্রান্তের কাকাও অঞ্চলে অথবা উপসাগরীয় উপকূলে যে অঞ্চলটাকে রিকনকাভো বলা হয় তার কোথাও। এ এক অনির্বচনীয় স্থান বদল, এমনকী আমি মানসচক্ষে দেখতে পাই সানিয়া ব্রাগা১৯ (১৯৫০- ) মাকোন্দোর পথ আলো করে হেঁটে যাচ্ছেন এবং চেষ্টা করছেন বুয়েন্দিয়া পরিবারে তাঁর যথাযোগ্য স্থানটি খুঁজে নিতে।
লেখক পরিচিতিঃ ইয়োরোপ ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রথিতযশা অনুবাদক গ্রেগোরি রাবাসার জন্ম ১৯২২ সালে আমেরিকার ন্যু ইয়র্ক শহরে। ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যু। তিনি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ৬টি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন —
১। “One Hundred Years of Solitude” (মূল গ্রন্থ “Cien anos de Soledad”) প্রকাশ ১৯৭০।
২। “Leaf Storm and other Stories” (মূল গ্রন্থ “La hojarasca”), প্রকাশ ১৯৭২।
৩। The Autumn of the Patriarch “(মূল গ্রন্থ “El otono del patriarca”), প্রকাশ ১৯৭৬।
৪। “Innocent Erendira and other stories” (মূল গ্রন্থ “La increible y triste historia de la candida Erendira y de su abnela desalmada”) প্রকাশ ১৯৭৮।
৫। “In Evil Hours” (মূল গ্রন্থ “La mala hora”), প্রকাশ ১৯৭৯।
৬। “Chronicle of a Death Foretold” (মূল গ্রন্থ “Cronica de una muerte anunciada”), প্রকাশ ১৯৮৩।
অনূদিত নিবন্ধটি লেখকের ২০০৫ সালে প্রকাশিত “একে যদি বিশ্বাসঘাতকতা বলে” (“If This be Treason”) গ্রন্থে সংকলিত।
Copyright © 2005 by Gregory Rabassa. Used by permission of New Directions Publishing corporation.
টীকা:
১) হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪ - ১৯৮৪) এর বিখ্যাত উপন্যাস “হপস্কচ” (প্রকাশ ১৯৬৬)
২) হার্পার কলিন্স প্রকাশনা সংস্থার প্রধান সম্পাদক ও অন্যতম স্বত্বাধিকারী; জন্ম ১৯২৩, মৃত্যু ২০১৩।
৩) ছিদ্রান্বেষী সমালোচকদের কাল্পনিক নাম; রাবাসার অনেক লেখায় এঁর ব্যবহার রয়েছে।
৪) ব্রাসিলের কথাসাহিত্যিক; জন্ম ১৯২০, মৃত্যু ১৯৭৭। উপন্যাসটির নাম “আ মাসা নো এসকুরো” (“অন্ধকারের আপেল”), প্রকাশ ১৯৬৩।
৫) মধ্য ইতালির একটি প্রদেশ যার অন্তর্গত ফ্লোরেন্স শহরে দান্তে আলিঘিয়েরি (১২৬৫-১৩২১) এর জন্ম।
৬) সামরিক বাহিনীতে যখন বন্দুক ছোঁড়ার পরীক্ষা হয়, তখন কোনো সৈন্যের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সেখানে একটি লাল পতাকা উঠে যায়; ইতর ভাষায় তার নাম “ম্যাগির জাঙিয়া”। পরে সেই সৈন্যের ভাগ্যে জোটে পরিহাস ও কৌতুক।
৭) মহাকবি ভার্জিলের “ঈনীড” মহাকাব্যের প্রথম পংক্তি। “Arma Virumque cano” অনেক যুগ যুগ ধরে অনুবাদকদের বিতর্ক ও বিভ্রান্তির কারণ।
৮) লাতিন আমেরিকার অনুরাগীদের কাছে মার্কেসের আদরের ডাকনাম।
৯) ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল উইলিয়াম এম্পসনের (১৯০৬-১৯৮৪) মহতী প্রবন্ধগ্রন্থ “সাত রকমের দ্ব্যর্থবোধ” — কবিতার আলোচনার এক নতুন দিগন্ত।
১০) মার্কিন জ্যাজ সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী বিলি হলিডে (১৯১৫-১৯৫৯) এর ১৯৫৬ সালে প্রথম গাওয়া একটি বিখ্যাত গানের নাম “সলিচিউড”।
১১) ফ্র্যাংকলিন পিয়ার্স (১৮০৪-১৮৬৯) এবং ফ্র্যাংকলিন ডিলানো রুজেভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫), উভয়েই বিভিন্ন সময়ে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পিয়ার্স ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৭ — তাঁর শাসনকালে দেশটি অনিবার্য গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। রুজেভেল্ট ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ — তিনি বিশ্বজোড়া মন্দার প্রকোপের সময় দেশের মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করেন।
১২) এঁদের পুরোনাম যথাক্রমে — কবি জন গ্রিনলিফ হুইটিয়ার (১৮০৭-১৮১২), কবি হেনরি ওয়াডসওয়ার্থ লংফেলো (১৮০৭-১৮৮২) এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস (১৮৪১-১৯৩৫)।
১৩) স্পেনের একটি অভিজাত প্রকাশনা সংস্থা যাঁরা মূলত অ্যাকাডেমিক বইপত্র প্রকাশ করেন।
১৪) কুবার শীর্ষস্থানীয় কবি ও সাহিত্যিক; জন্ম ১৯১০, মৃত্যু ১৯৭৬।
১৫) শিট্ (shit) শব্দটি এখনো অভিজাত সমাজে ও পত্রপত্রিকায় অপাংক্তেয়।
১৬) রাবাসা লিখেছিলেন (“This Shitty Town”).
১৭) ব্রাসিলের এক বিখ্যাত লেখক। রাবাসা তাঁর চারটি গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন।
১৮) মাকোন্দো কাল্পনিক শহর, কিন্তু “বাহিয়া”, “কাকাও” এবং “রিকনকাভো” খুঁজে পাওয়া যাবে ব্রাসিলের ম্যাপে। আমাদোর জন্ম ও মৃত্যু বাহিয়া রাজ্যে।
১৯) ব্রাসিল ও হলিউডের নামকরা অভিনেত্রী। আমাদোর লেখা উপন্যাস অবলম্বনে তোলা বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন; তাদের মধ্যে “ডনা ফ্লোর ও তার দুই স্বামী” (১৯৭৬) এবং “গাব্রিয়েলা” উল্লেখযোগ্য — দুটি ছবিরই পটভূমি ব্রাসিলের বাহিয়া অঞ্চল।