• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | গল্প
    Share
  • ঘুষ : অতনু দে


    খেয়াল করে দেখেছেন, ঘুষ দেবার পর শিরদাঁড়াটা আর সোজা থাকে না? কেমন কোলকুঁজো করে দেয় মানুষকে? দেখেছেন?

    বাড়ির পেছনের বাজারে চা খেতে গেছি। সেখানে একটা “রাজস্থানী” চায়ের দোকান আছে – খুব নাম। সবসময়ই বেশ ভিড়, মাঝেমাঝে লাইনও পড়ে যায়। দামও অন্য চায়ের দোকানের চেয়ে বেশি – ১৫ টাকা। মাটির ভাঁড়ে চা দেয় – বেশ বড়ো ডিজাইন-করা ভাঁড়। চায়ে নানান মশলা মেশানো থাকে, এলাচ তার মধ্যে অন্যতম। বাকিগুলো আলাদা করে বুঝতে পারি না। লোকটাও বলে না – হাজার হোক, ট্রেড সিক্রেট বলে কথা।

    দিল্লির শীতের শনশন হাওয়া চলছে একেবারে খাপখোলা তলোয়ার। একেক কোপে সব কুপোকাত। হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে দলুই জড়িয়ে লোকেরা সব ওই রাজস্থানী চায়ের দোকানে ভিড় করছে। জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বের করে দুহাত ঘষতে ঘষতে আমিও যাচ্ছি সেখানেই। আজকে বেজায় শীত।

    “বাবু, জারা চায় পিলাওগে?”

    কনুইয়ের কাছ থেকে এলো রিনরিনে গলার আওয়াজটা। একটা বাচ্চা ছেলে – এই বছর দশেকের মতো বয়েস। কালো, ঝাঁকড়া চুল, নোংরা, নাক থেকে সিকনি গড়াচ্ছে। হাফপ্যান্ট, রবারের চটি। গায়ের পাতলা বোতামছেঁড়া জামাটা শেষ কবে সাবানের মুখ দেখেছে তা বলা শক্ত। মুখ তুলে আমার দিকে স্পষ্ট সোজা চোখে তাকিয়ে আছে।

    “চায় পিলাওগে, বাবু?”

    আবার প্রশ্ন করে বাচ্চাটা।

    আমি বড়ো একটা এদের ভিক্ষে দেওয়াটা পছন্দ করি না। খেটে খাস নে কেন? তবে এ নেহাতই বাচ্চা, আর শীতটাও জব্বর আজকে। কিনে দেওয়াই যাক এক কাপ। শীত আছে বটে আজকে।

    তা গেলুম দুজনে। চা-ওয়ালাকে বললাম এক কাপ আমার জন্যে, এক কাপ –“উহ উসকে লিয়ে।" দেখিয়ে দিলাম ছেলেটাকে।

    “থোড়া টাইম লাগেগা। বন রাহা হ্যায়।” গম্ভীর গলায় বললো লোকটা। মাথায় পাগড়ি বাঁধা। গম্ভীর মুখ।

    তা হোক। চা পেলেই হলো।

    হয়েও গেলো একটু বাদেই।

    দেখলাম আমার চা-টা ওদের সেই ডিজাইন-করা ভাঁড়ে। বাচ্চাটারটা একটা কাগজের কাপে। একটু কম যেন মনে হলো।

    “লিজিয়ে। আউর আপ উনকো দিজিয়ে। হম উন লোগোকো নেহি দেতে।" গম্ভীর গলা বললো।

    আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। হাতের গুলি ফুলে উঠলো। সটান লোকটার কলার চেপে ধরে বললাম “মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে পারো না? লজ্জা করে না তোমার?”

    লোকটা ঘাবড়ে গেল আমার রক্তচক্ষু দেখে। তাড়াতাড়ি একটা বড়ো কাপে নিজের হাতে ছেলেটাকে চা-টা তুলে দিলো। সঙ্গে একপ্যাকেট বিস্কুটও।

    আমরা দুজনেই হাসলাম। না না – তিনজনেই।

    ***

    মিথ্যে কথা। এসব কিছুই হয় নি।

    অচেনা লোকেদের সামনে সিন ক্রিয়েট করতে আমার বড্ডো অস্বস্তি হয়। তার ওপরে আবার লোকটার ব্যক্তিত্ব বেশ প্রবল। যদি কিছু বলে দেয় মুখের ওপর? তার চেয়ে... ছেলেটার হাতে ওই কাগজের কাপটাই তুলে দিলাম। সঙ্গে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে দিলাম। দশ টাকা দাম।

    সামান্যই টাকা। দশ টাকা।

    কিন্তু পিঠটা কেমন কুঁজো হয়ে রইলো কটা দিন। ঘুষ দেবার পর যেমন হয় আর কি!

    ***


    (এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো দুটি গল্পঃ 'দুই বুড়োর আখ্যান''অন্ধকারে')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments