অর্পিতার ফেসবুক প্রোফাইলটা খুলে ইতস্তত নাড়াচাড়া করছিল আর্শাদুল। একসময় গোটা ২৫০ ফ্রেন্ড ছিল তার। এখন কমতে কমতে ১৫০তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই একটা অদ্ভুত স্বভাব আর্শাদুলের। ফেসবুকে এলে কাকে কাকে আনফ্রেন্ড করবে, চলতে থাকে মাথায়। অনেক সময়ই আগে থেকে ভেবে নিয়ে আসে সে। হয়তো কাউকে হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকে শেষ ৩-৪ বার পিং করেছে, উত্তর পাওয়া যায়নি বা সেরকম উৎসাহ পাওয়া যায়নি---তো আর্শাদুলের মনে হয় এরকম নাম কা ওয়াস্তে ফ্রেন্ড রেখে লাভ কি? সে তো জানতেও পারবে না কিছু এই ব্যাপারে। অনেকসময় এরকমও হয়, এর সাথে কোনোদিন কথাও হয়নি বা ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তো কেবল বন্ধুসংখ্যা প্রদর্শনের জন্য রেখে লাভ কি? মোট কথা, আর্শাদুলের মতে রিয়েল লাইফ যারা ফ্রেন্ড তার এই মুহূর্তে অথবা ভার্চুয়াল হলেও কথা বললে উত্তর পাওয়া যায়, তারা বাদে বাকিদের বন্ধু রাখতে নারাজ সে।
আনফ্রেন্ড কাকে কাকে করবে মোটামুটি ঠিক করাই থাকে অনলাইন হওয়ার আগে আর্শাদুলের--আগেই বলা হয়েছে। গতকাল থেকে অর্পিতাকে আনফ্রেন্ড করার চিন্তা মাথায় তার। ব্যাটা ওকে হোয়াটসঅ্যাপে গল্প পাঠালাম শেষ দু'টো; কোনো উত্তর নেই। আগেও পাঠিয়েছিল। তখন উত্তর এসেছিল--'এই গল্পটা এরকম প্যাথেটিক কেন করলি? বাচ্চাটার কি হবে বলতো যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সখ্যতা না থাকে?' কখনও এরকম--'আমি বিশ্বাস করি না এরকম কঠোরহৃদয় কেন তুই?' সমালোচনা তো ভালো যদি তাতে কিভাবে আরো ভালো হয় তার কথা থাকে। কিন্তু এরকম নির্বোধ ও যুক্তিহীন উক্তিতে মাথা গরম হয় আর্শাদুলের। 'আরে আমি তো আর ওই ছেলের দায় নিয়ে ব'সে নেই যার মা চলে গেল,' অথবা 'আমি কি করব যদি সখ্যতা না থাকে স্বামী-স্ত্রীর। আমার এরকম ভালো লাগলো তাই লিখলাম।'--বলেছে সে। আর বুঝেছে অর্পিতাকে কিছু পাঠিয়ে লাভ নেই। তবুও কোনো দুর্বল জায়গা থেকে ওর নামটা যখন হোয়াটসঅ্যাপ কনট্যাক্ট লিস্ট স্ক্রল করার সময় দেখিয়েছে, পাঠিয়ে দিয়েছে শেষ দুটো। এবারে আর কোনো উত্তর আসেনি। ২-৪ বার ফোনও করেছিল আর্শাদুল। ব্যস্ত আছি, পরে করিস ধরনের কিছু শোনা গিয়েছিল অন্য প্রান্তে গাড়ির আওয়াজের অন্তরালে শেষবার করা ফোনে। কাল থেকে অর্পিতাকে আনফ্রেন্ড করার সিদ্ধান্তটা পাকাপাকিভাবে নিয়েছে সে।
অর্পিতার প্রোফাইলটা খুলে ফ্রেন্ড বাটনটায় ক্লিক ক'রে আনফলো, আনফ্রেন্ড...এইসব অপশনগুলো দেখছে আবার বাইরে ক্লিক ক'রে ওগুলোকে সরিয়েও দিচ্ছে।
প্রোফাইলের সামনে ব'সে ওর মনটা চলে যায় কয়েক মাস আগের কোনো এক রাতে। কলেজের সেকেন্ড সেমিস্টার শেষ। পরেরদিন থেকে শুরু কলেজ ফাংশন। অর্পিতা আর মুকুলিকা তখন হার্টথ্রব অনেকেরই। গোটা কয়েক প্রপোজবাক্য ইতিমধ্যেই প্রেরিত হয়েছে দু'জনের উদ্দেশ্যেই এবং সেই ব্যর্থ প্রেমিকদের কেউ কেউ আজ সেমিস্টার শেষের আনন্দ উদযাপন হেতু বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সেই বিষাদঘন, হৃদয়বিদারক মুহূর্তগুলো রোমন্থন করছে ঈষৎ ভারি গলায়। আর্শাদুল শুনছে সেগুলো চুপচাপ। এক স্ট্রিম হওয়ার জন্য মুকুলিকাকে ও একটু বেশী চেনে। অর্পিতাকে দু-একবার দেখেছে বটে কিন্তু সেভাবে পরিচিত নয় এখনো। তার উপর অর্পিতা ছিল কলকাতার হাইকোর্টের জাজের মেয়ে আর ঠাটবাটই আলাদা। সকলকে কাছে ঘেঁষতে দেয়না এরকম একটা খবর অনেকের মুখে শুনেছিল আর্শাদুল। ফাংশনের শেষ দিনটা থাকে স্টুডেন্টদের নিজেদের প্রোগ্রাম। তাতে আর্শাদুলের ছিল একটা আবৃত্তি এবং অর্পিতা ও মুকুলিকা ছিল দুটো কোরাস গানের দলে। শেষদিনের বিশেষ বিশেষ ক্ষণের অপেক্ষায় থাকে অনেকেই। আর্শাদুল যে একেবারে উদাসীন সেটা বললে সত্যের অপলাপ হবে। তবে সে নিজে এতটাই আবৃত্তি-অন্ত প্রাণ যে অন্য ভাবনা মনে খুব একটা ঠাঁই পাচ্ছেনা। হ্যাঁ, এই আবৃত্তির ব্যাপারে আর্শাদুল খুব একাগ্রচিত্ত। এটাকে আত্মপ্রচারের মাধ্যম হিসাবে দেখে না সে। শেষদিন এলো। হয়েও গেল আবৃত্তি। বিশেষ নজর অবশ্যই সকলের ছিল মুকুলিকা আর অর্পিতার দুটো কোরাস গানের দিকে। সেটাও বেশ ভালো হলো। দলের সুমন্ত, সুবীর, অমিতদের মধ্যে তো হুড়োহুড়ি পড়ে গেল অভিনন্দনের আড়ালে নিজেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। আর্শাদুল সেই সুযোগে সরে পড়ে ঘটনাস্থল থেকে।
পরেরদিন ক্যান্টিনে চা-সিগারেট খেতে ঢুকেছে আর্শাদুল। এখন ছুটি। ক্লাসের তাড়া নেই। অনেকে বাড়িও চ'লে গেছে। তাই ক্যান্টিনেও ভিড় কম। আর্শাদুল দেখলো অর্পিতাকে ঘিরে কিছু ভক্তমণ্ডলের ভিড়। সাথে আরও একটা মেয়ে আছে যার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে তার। সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে আলাদা বসে সে। সিগারেটটা ধরিয়ে কাউন্টার থেকে কাপটা নিয়ে আজও তাই করলো। অকস্মাৎ দেখে অর্পিতা হাত নেড়ে ডাকছে তাকে। চা-টা বড়ো বড়ো চুমুকে শেষ ক'রে অর্ধসমাপ্ত সিগারেটেটা হাতে নিয়ে একটু সঙ্কুচিতভাবেই দলে গিয়ে বসে সে। মেয়েরা সাথে থাকলে একটু বাধো-বাধো লাগে তার এখনও কোনো অজ্ঞাত কারণে। যদিও নিজেও এটা জানার কারণে সচেতনভাবে সেটাকে গোপন রাখার চেষ্টা করে আর্শাদুল। খুব ভালো ক'রেই জানে এরকম দুর্লভ, ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তে ওর বন্ধুমহল তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয় খুব সঙ্গত কারণেই। প্রায় মিনিট পনেরো চললো গল্পগুজব। আর্শাদুল চলে আসার একটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। অর্পিতাই হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে। কাজেই নীরব শ্রোতা হয়েই অপেক্ষা করতে হয় তাকে। পনেরো মিনিট পর আসর ভাঙলে সকলকে বাই জানিয়ে অর্পিতা আর্শাদুলকে বলে--'খুব সুন্দর আবৃত্তি তোর। আমারও আবৃত্তির সখ। কোনোদিন সুযোগ আসলে ডুয়েট করা যাবে।' তার সপ্রতিভতায় একটু সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে আর্শাদুলের সদ্য প্রশংসাপ্রাপ্ত স্ফীত হৃদয়। এতক্ষণের আলোচনায় যেটুকু কথাবার্তা সে শুনেছে তাতে অর্পিতাকে তার প্রচণ্ড উপরচালাক, কথার ফুলঝুরি ছোটানো একটা মেয়ে বলেই মনে হয়েছে। এবং কথাবার্তায় একটা আভিজাত্যের ছাপও নজরে পড়েছে। কিন্তু সেই মেয়ের আবার আবৃত্তিরও সখও কি ক'রে থাকতে পারে? আর আবৃত্তি হলো এমন একটা জিনিস যেটার নাম আর্শাদুলের সামনে করলে সেটাকে সহজে অবহেলা ক'রে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না সে। মুখ থেকে তার বেরিয়েই যায়--'তাই নাকি? বাহ্ খুব ভালো। ...একটা পছন্দের কবিতা কয়ের লাইন কর দেখি।' মনে হলো অর্পিতা যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। সে করলো--"বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎচঞ্চুবিদ্ধ ... অকস্মাৎ কল্লোলোচ্ছ্বাসে।" পৃথিবী কবিতার মাঝের দুটো স্তবক। প্রথম স্তবকে গলার চড়াই আর পরেরটায় খাদে নামাটা শোনার মতো সত্যি। অবাক হয়ে গেল আর্শাদুল। একজন ফটফটে বাচাল মেয়ের গলায় এরকম গভীর ভাবের কবিতা এতো মানানসইভাবে ফুটে উঠতে পারে, আশা করেনি সে। বলতেই হয় তাকে--'বাহ্, সুন্দর করিস তো তুই।' অর্পিতা 'থ্যাক্স ইউ' বলে, আর বলে 'আমাকে চিনিস তো তুই। আমার নাম অর্পিতা।' আর্শাদুলের মুখে অস্বস্তির ভাবটা যেন ধরা পড়ে যায়। 'জানতাম না'--এতোবড়ো মিথ্যাটা কি ক'রে বলবে এই চিন্তার অবসরেই অর্পিতা হেসে ওঠে--'বস্, এতো গোমড়া মুখে থাকলে কি ক'রে ভাব করবি মেয়েদের সাথে?' আর্শাদুল হয়তো আরও অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মেয়ে সান্নিধ্যে অনভ্যস্ত ছোটো শহরের, বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করা, মুসলিম পরিবারের ছেলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়--'না না, চিনি তো তোকে।' অর্পিতা অবশ্য আর কিছু বলে না। 'পরে কথা হবে, চললাম'-- বলে সত্যিই চলে যায় ।
আর্শাদুলের মাথাটা কেমন যেন ঘুরে যায়। নারী মানে একটা স্বর্গলোকের জীব, যাদের মাঝেমধ্যে হয়তো দেখা যায় এবং দেখা গেলে দেবীর মতো সাবধানে একটা দূরত্ব বজায় রেখে যথাসম্ভব সম্মান জানিয়ে জায়গাটা অতিক্রম ক'রে যেতে হয়--এরকম একটা ধারণা তার উনিশ বছরের অনভিজ্ঞ জীবনে ছিল। কিন্তু সেই কল্পলোকের দেবী যে হাতছানি দিয়ে ডাকতে পারে, কবিতা বলতে পারে আবার ছদ্ম শাসনও করতে পারে--এরকম অভিজ্ঞতা তার নতুন। একা একা হোস্টেলের রুমে ব'সে অর্পিতার চিন্তাটা সে ভুলতে পারে না। আর্শাদুলের মন অগভীর নয়। সমস্ত কিছুকেই গভীরভাবে চিন্তা করতে এবং গুণের ঈর্ষা নয়, কদর করতে অভ্যস্ত সে। অর্পিতার অমায়িক কথাবার্তা এবং আবৃত্তির নমুনা তাকে আর্শাদুলের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে। তার মনে এতকাল নারী মানে আবছায়াভাবে যে নিষ্প্রাণ দেবীমূর্তি স্থাপিত ছিল, সেই মূর্তি যেন মানবীরূপে প্রাণ পায় কোনো একজনের। নিজের প্যাশনের সাথে অর্পিতার মিল পেয়ে আর্শাদুল ভাবতে থাকে আর কোনো সম্পর্ক না থাক, আমরা তো একই কাব্যদেবতার পূজারী। দেবতার এই চিন্তাটা তার মনে এমন একটা নিশ্চিন্ততা আনে যে সে ভুলে যায় মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কয়েক মিনিটের পরিচিতি ছিল সেটা মাত্র।
রাতে হোস্টেলের একটা রুমে আবার সেই পরিচিত আড্ডা, পরিচিত বিষয়ের পুনরাবৃত্তিতে বসতে হয় আর্শাদুলকে। বিষয়টি হলো অলকার প্রতি সুবীরের মাস দুয়েক আগের প্রেম নিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে চলা ঘটনাবলীর বিবরণ। সুবীর মদ খেতো স্কুল লাইফ থেকেই, গাঁজাও নেয় মাঝেমধ্যে। নেশার ঘোরে কেঁদে ফেলে যখন তখন। তবে লুকায় না কারুর কাছেই ওর এইসব ব্যাপার, এমনকি মেয়েদের কাছেও না। অলরাউন্ডার টাইপের ছেলে। টুকটাক অনেক কিছুই পারে। ওর আরেকটা পরিচয় ও প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রিন্সিপালের ছেলে এবং জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মেয়েজগৎ-এর প্রতি ওর ভিক্ষুকসুলভ মনোবৃত্তি। অলকা ওকে খুব পরিষ্কারভাবে নাকচ ক'রে দিয়েছে সেটা আর্শাদুল জানে। তবুও তার পরে সে আরও কয়েকবার ঘ্যানঘ্যান করেছে অলকার কাছে। এবং আরও আশ্চর্য ঘটনাগুলো সে বর্ণনাও করে বন্ধুদের উৎসাহের সঙ্গে। আর্শাদুলেরও অবাক লাগে যে-ভঙ্গিতে ও অলকার কাছে বারবার নিজেকে জাহির করতে চায়। তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে একটা অনুকম্পার দৃষ্টিতে তাকে শুনতে হয় সুবীরের ঘ্যানঘ্যানানি এবং কিছু উপদেশও দিতে হয় তাকে নিজের মনোযোগের প্রমাণস্বরূপ। এই ঘটনা নতুন নয়। বেশ কয়েকবারের পুনরাবৃত্তি দোষে দুষ্ট ও একঘেয়ে। হস্টেল প্রায় পুরো খালি হয়ে যায় পরেরদিন। আবার মাসখানেক পরে দেখা হওয়ার কথা সকলের সাথে।
বাড়ি ফিরে আর্শাদুলের একটা সম্পূর্ণ নতুন অনুভূতি হয়। অর্পিতার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হলে কিভাবে কথা বলবে সেটা নিয়ে ভাবতে প্রতিদিনই কিছুটা সময় চ'লে যায় তার। এমনিতেই বড়লোকের ঘরের মেয়ে, তার উপর দেখতেও ভালোই এবং সপ্রতিভ। আর্শাদুলের সামান্যতম ত্রুটিও তার কাছে হাস্যাস্পদ হতে পারে, এরকম একটা চিন্তা তার মনে আসে। এর আগে তো কোনোদিন এরকম হয়নি। কোনোদিন তো এরকম চিন্তা করতে হয়নি তাকে। প্রকৃতি বরাবরই সে ভালোবাসত। কবিতার মধ্যে অর্ণব, অরণ্য, অন্তরীক্ষ--এতোদিন একটা বিচ্ছিন্ন বস্তুর মতো তার কাছে প্রতীয়মান হতো। আজ একটা মানবীর ভাবনা তাকে যেন সেই সমস্ত কিছু এক ক'রে ভাবতে শেখায় এবং জড়বস্তুর উপরে প্রাণের প্রলেপ ফেলে। জগৎ যেন আজ নির্বাক নয় তার কাছে; তার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সবাক ভালোবাসার ধ্বনিমাধুর্য পায় সে। ভালো লাগে নিজের সাথেই নিজে কথা বলতে। একটু যেন আফশোস হয় যদি অর্পিতার মোবাইল নম্বরটা একটু সাহস ক'রে চাওয়া যেত।
কালস্রোতে ভেসে গেছে কতশত শতাব্দী তো এই একমাস কোন্ ছার। ক্লাস শুরু হয় থার্ড সেমিস্টারের। অর্পিতার সাথে এখনও দেখা হয়নি দ্বিতীয়বার। আলাদা স্ট্রিম ছিল ওদের। হস্টেলের পরিবেশে ঢুকে অর্পিতার কথা মনে পড়ে না তার এরকম নয়--তবে গত একমাসে মনের মধ্যে যে উথালপাথাল চলছিল সে তরঙ্গস্রোত এখন যেন অনেকটাই পরিণত ও শান্ত। তরণী সমুদ্রে যাওয়ার সময় সামনের ঢেউয়ের সংঘাতে প্রচণ্ড আলোড়িত হয়। কিন্তু সেটা যখন অতিক্রান্ত হয় তখন তরী প্রবেশ করে সমুদ্রের গভীরে; যেখানে ব্যাপ্তি বেশী, প্রশান্তি বেশী কিন্তু লহরীর আনাগোনা সীমিত। সেরকমই একটা অনুভূতি যেন আর্শাদুলের মনে; অর্পিতারূপ চিন্তাসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া কাণ্ডারীর মতো।
আর্শাদুলের মনের অবস্থা যখন এরকম ঠিক তখনই একটা ঘটনা ঘটলো। সুবীর দু’-তিন দিন দেরী ক'রে হস্টেলে ঢুকছে, যদিও সেটা আর্শাদুলের নজরে পড়েনি। আজ নিজের মুখে বলাতে খেয়াল হলো তার। ছাদে নিয়ে গেল একা আর্শাদুলকে। এমনিতে সুবীর তার ভালো বন্ধু, তবে সেটা একটা অনুগ্রহের ভালোবাসা। একটা স্নেহও বলা যায় গভীরতাহীন, নারী অঞ্চলপ্রেমী বন্ধুর প্রতি।
সেই তারিখটা আজও মনে করতে পারে আর্শাদুল। হয়তো সেই রাতে আকাশে কতগুলো তারা ছিল এবং কোন তারা মিটমিট ক'রে হেসে তাকে ব্যঙ্গ করেছিল বা কোনগুলো ড্যাবড্যাব ক'রে তাকিয়ে তার বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টির সঙ্গী হয়েছিল, সেটাও হয়তো সে মনে করতে পারবে। ছুটির মধ্যে কলকাতায় অর্পিতার সাথে দেখা করেছিল সুবীর। সুবীর যে ব্যারাকপুরে থাকতো এটা জানে আর্শাদুল। দেখা ক'রে অর্পিতাকে তার মনের ইচ্ছাও বলে। অর্পিতা নাকি আজ সম্মতি জানিয়েছে সুবীরের সেদিনের প্রস্তাবের। আরও কিছু ঘটনা হয়তো বলেছিল সুবীর গত একমাসের; আর্শাদুলের ঠিক কানে ঢোকেনি। তবে ও যে সত্যি বলছিল এবং ওর আনন্দ সরল ও অকৃত্রিম এটা বোঝা যাচ্ছিল সহজেই। কথা শেষ হলে দু'জনে নেমে আসে ছাদ থেকে এবং ক্রমে চলে যায় যে যার ঘরে। পাঁচতলার ঘরের জানালা থেকে বাইরের অন্ধকার, আকাশের ভগ্নাংশ এবং নীচের জঙ্গলের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকায় আর্শাদুল। নীচের সবুজ ঝোপঝাড়গুলো এত নিকষকালো লাগে রাত্রিতে কোনোদিন খেয়াল করেনি সে। শোনা যায় জলে ডুবে মরার আগে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অতীতের সমস্ত ঘটনা চলচ্চিত্রের মতো চোখের সামনে দেখা যায়। সেরকমই খুব দ্রুত কয়েকটা কথা আর্শাদুলের মনে আসে। অর্পিতার কয়েকটা কথার খুঁটিনাটি হিসাব করে। না, কোথাও তো কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। শুধু ছিল ডুয়েট আবৃত্তির ইচ্ছা, সাথে কিছু নর্মাল হবি নিয়ে কথাবার্তা আর কিছু লেগ-পুলিং আর্শাদুলের বাধো-বাধো কথার পরিপ্রেক্ষিতে। তাহলে তার মন এত যন্ত্রণা পাচ্ছে কি কারণে? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। হাতে কাঁটা ফুটে আছে, জায়গাটাও বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কাঁটাটাকে দেখা না গেলে ঠিক যেরকম অস্বস্তি হয়, ঠিক সেরকমই মনে হয় তার। ছোট্ট ঘরের মধ্যে বড়ো যন্ত্রণার ঠিক উপশম হয় না। আর্শাদুল তাই আবার উঠে আসে ছাদে রাতের অন্ধকারে। মুক্ত কৃষ্ণবর্ণ গগনতলে হয়তো কোটি কোটি মানুষ নিজেদের দুঃখকষ্টের কারণ বিধাতার কাছে জানতে চেয়ে এসেছে এতোদিন। আজ আর্শাদুলেরও নিজেকে তাদেরই দলভুক্ত মনে হয়। মনের অস্থিরতা বেরিয়ে আসে তার পদচারণার মধ্যে নির্জন ছাদে। অর্পিতার কথাবার্তা, সহজাত আভিজাত্য, হবি, আবৃত্তি সব মিলিয়ে আর্শাদুল তাকে নিজের খুব কাছাকাছি এনে ফেলেছিল এবং হয়তো ভেবেছিল এসবের ঘেরাটোপে সে নিরাপদ অন্য প্রতিযোগীর থেকে। কিন্তু পার্থিব কোনো প্রলোভনের কাছে সেই বেড়াজাল যে কতোটা ক্ষণভঙ্গুর--এটা প্রথম উপলব্ধি করে সে। দূরের অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে যায়। সেটা বেদনা নয়, ক্ষোভ নয়, ঈর্ষাও নয়। নিজেকে অতি নগণ্য মনে হয় অকস্মাৎ। মনে হয় বাতাস যেরকম মানুষের চারপাশে থেকেও মানুষের কোনো ভাষা বোঝেনা ব'লে সবসময় তার নিজস্ব ছন্দে হুহু আওয়াজে বিলাপ করে, সেরকমই সেও নারীমনের চাওয়া-পাওয়া, তার রহস্য সম্পর্কে সত্যিই অবিদিত এখনো।
ছাদের কোণের একটা অংশ নতুন সিমেন্টিং হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে এবং অন্যমনস্ক পদচারণাকালীন আর্শাদুল পড়ে যায় পাঁচতলার ছাদ থেকে। নিজেকে আবিষ্কার করে সে হসপিটালের বেডে। মাথায় ব্যান্ডেজ, দু'পায়েই প্লাস্টার। জানতে পারে ক্রমশ, দীর্ঘ ১৬ ঘন্টা জ্ঞানহীন ছিল সে। হস্টেলের নীচের চৌকিদাররা তাকে তুলে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হসপিটালে ভর্তি করে। এরপর ওয়ার্ডের কাছ থেকে পরিচয় জোগাড় ক'রে বাড়িতে ফোন করা হয় আর্শাদুলের। ডাক্তার বলে তিনমাসের আগে কিছু বলা সম্ভব নয় কতোটা রিকভার করবে পা।
হসপিটালের বেডে একা একা শুয়ে অর্পিতা আর সুবীরের কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। সাতদিন হয়ে গেছে। দু’-তিন বার এসেছেও ওরা দু'জনে দেখতে। অর্পিতাকে নিয়ে আর্শাদুলের মনোভাব কেউই তো জানতো না--তাই ওর এই ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াটা দুর্ঘটনা ব'লে ভাবতে অসুবিধা হয়নি কারুর আর সেদিক দিয়ে ভাবলে একটা লজ্জার হাত থেকে বেঁচেছে আর্শাদুল। সে স্থানীয়, তার উপর বাবার পরিচিতিও কম নেই, তবুও অর্পিতা-সুবীর দু'জনেই বলেছে যেকোনো প্রয়োজনে ফোন করতে। সুবীরের কন্ট্যাক্ট তো ছিলই, অর্পিতাও নিজের নম্বর ও সাথে ফেসবুকের লিঙ্ক দিয়েছে। অন্যান্য কয়েকজন বন্ধুও আসে মাঝেমধ্যে। ফোনও করে আর্শাদুল কখনো কখনো। কেবিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে সে কয়েকটা গল্পের বই, লেখালেখির খাতা আনিয়েছিল। এখন অবসর তো অন্তহীন। তাই এইসব চর্চার কাজটা একটু বেশীই হয়।
মাস দুয়েক হয়ে গেছে। কাল ডাক্তাররা প্লাস্টারটা কেটেছে একটা পায়ের। কিন্তু যেভাবে হাড় ভেঙেছে, তাতে আর্শাদুলকে ক্রাচ বা নকল পা নিয়েই চলতে হবে এরকম একটা আশঙ্কা আছেই ডাক্তারদের। কমপ্যাসোনেট গ্রাউন্ডে কলেজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরের বছর সেকেন্ড ইয়ারে আবার ভর্তি হতে পারবে কারণ বছরের মাঝে তো জয়েন করা যায় না। বাড়ি থেকে কিছুটা স্বস্তি সেই কারণে। এখন প্লাস্টার কাটার পর ক্রাচ নিয়ে নিজের রুম বা রুমের বাইরে অল্পসল্প হাঁটতে পারে আর্শাদুল। একদিন কি মনে ক'রে ফোন করে অর্পিতাকে সন্ধ্যাবেলা। একটানা রিং হয়ে কেটে যায়। একঘন্টা পরে অর্পিতাই ফোন ব্যাক করে। জানা যায় বেরিয়েছিল। ফর্মাল শারীরিক এবং কলেজের কথা হওয়ার পর আর্শাদুল হঠাৎ বলে--'এই তোর আবৃত্তি অনেকদিন শুনিনি। একদিন রেকর্ড ক'রে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবি?' অর্পিতা হয়তো এই ধরনের আবদার আশা করেনি একটা হসপিটালের রোগীর কাছ থেকে। 'রেকর্ডিং তো করিনি কোনোদিন। হ্যাঁ, করলে পাঠাবো তোকে,' ধরনের উত্তর পাওয়া যায় ও প্রান্ত থেকে। ব্যাপারটা একটু ভারি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই হোক বা অর্পিতার সাথে আরেকটু কথা বলার ইচ্ছাবশতই হোক, আর্শাদুল বলে--'আমি শেষ কয়েকদিনে দু-তিনটে লেখা লিখেছি। তোকে পাঠাবো।' কথার মধ্যে আর্শাদুলের কিছুটা উচ্ছ্বাস হয়তো ধরা পড়ে যায়। ওদিক থেকে নিরুত্তপ্ত কন্ঠে উত্তর আসে--'নিশ্চয় পাঠাবি। পড়বো।' আবৃত্তি পাওয়া যায়নি তবে আর্শাদুলের লেখা পাঠানোর গল্প আগেই বলা হয়েছে।
একটা পা রিকভার করেছে কিন্ত আরেকটা পা ঠিক হবে না। ডাক্তাররা নকল পা লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে। আপাতত আর্শাদুল ক্রাচে ভর দিয়ে চলছে। হসপিটাল থেকে তিনদিন আগে ছেড়েছে তাকে। অর্পিতার কথা ভাবতে ভাবতেই কখন মোবাইলে ওর প্রোফাইল ছেড়ে ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির জানালায় উঠে এসেছিল খেয়াল ছিল না। সম্বিৎ ফিরলো ঠোঁটে লবণাক্ত কিছুর স্পর্শে। না, আজ আর কোনো কিছুতেই দুর্বল হবে না সে। আনফ্রেন্ড করবেই অর্পিতাকে। হয়তো ঠিকই করে সে। কারণ দ্রুতগামী, দ্রুত পরিবর্তনশীল মানুষ এবং জগতের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে আজ আর্শাদুল ধীরে চলা একজন মানুষ। তার লেখা 'পৃথিবী' নিয়ে নিজের মতো ক'রে বাঁচুক সে।