১
জানালার রাবার প্ল্যান্টে জল দিতে দিতেই মিলি বলল, আঃ, কি যে বিশ্রী শব্দ করে ব্রাশ করো? এখনো গেঁয়োভাব গেল না। শুভেন একটু সামলে গেল। আজ কি মিলির রেওয়াজ ঠিকঠাক হয় নি?
এখনো রোজ ভোর চারটেয় উঠে মিলি রেওয়াজে বসে। রেওয়াজ সেরে উঠতে উঠতে সাতটা সাড়ে সাতটা। তারপর সে চা বানায়, শুভেনের জন্য এক কাপ কালো চা টেবলে রেখে, নিজের এক কাপ ঢেলে নিয়ে, বাকিটা ফ্লাস্কে রেখে সে চান করতে চলে যায়। চান হয়ে গেলে রান্নাঘরের এককোনে দেওয়ালে চৌখুপী বাক্সে চিনেমাটির মা সরস্বতীর সামনে একটি ধূপ জ্বেলে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকবে কিছুক্ষণ। তারপর জানালার গ্রিলে ঝুলে থাকা টবের গাছের দেখভাল...ততক্ষণে শুভেন উঠে পড়ে। ব্রাশ করে, চা খায়, মিলির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, তার আর মিলির বাইরে বের হবার পোষাক বের করে রাখে। মিলি প্রথম প্রথম একটু অপছন্দ করতো, কিন্তু শুভেনের রুচির ওপর এখন সে ভরসা করে বলেই মনে হয়।
অনেকদিন অব্দি শুভেন বিশ্বাস করতো যে মিলির প্রভাতী রেওয়াজে যেদিন ভৈরবের রে -র শ্রুতি ঠিকঠিক লাগে সেদিনটা অন্যরকম কাটে পৃথিবীর। সেদিন খর গ্রীষ্মেও আকাশে মেঘসঞ্চার হয়। সূর্যের রক্তচক্ষু ঢাকা পড়ে যায়, ভরদুপুরে রাস্তায় বেরোলেও ঘামে জামা পিঠে সেঁটে যায় না, বরং ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়, আবার তাদের মাখন বড়ালের গলিতে জল জমে একতলার বাসিন্দাদের ঘর ভাসিয়ে দিয়ে যায় না।
শুভেন তখন মামাদের ভাড়াবাড়ির আশ্রয়ে থেকে বি কম পাস করেছে সবে। মিলি ক্লাস নাইন, বাড়ন্ত গড়ন হলেও বাড়িতে ফ্রক পরে, মাখনের মত মসৃণ পায়ের গোছ দেখা যায়... চোখ যেন জ্বলে যেত শুভেনের... কিন্তু ইসকুলে যাবার সময় বাধ্যতামূলক সালোয়ার কামিজ।
তখনো এত সারেগামাপা আর টিভি হয় নি, কিন্ত কেমন করে যেন মিলির একটু নামডাক হয়েছে। আশপাশের পাড়ার জলসায় ছোটখাটো মিলি মঞ্চে উঠলে শুভেনের যেন কেমন পেটের মধ্যে গুরগুর করে। বাগবাজার, গিরিশ পার্ক… ছিদাম মুদী লেন...। প্রোগ্রামের দিন শুভেন আগ বাড়িয়ে তার হারমোনিয়ম তবলা বয়ে দেয়, মিলির সিড়িঙ্গে চেহারার গানের মাস্টারটাকেও খাতির করে ফিলটার উইলস কিনে খাওয়ায়, টিউশনির টাকায়। অন্যদিনে আধময়লা টেরিলিনের প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরলেও, অনুষ্ঠানের দিন মাষ্টারের ধোপদুরস্ত পাজামা আর গিলে করা পাঞ্জাবির বাহার দেখবার মত। মেজাজখানাও।
একবার পাড়ার জলসা ভাঙলে মিলিকে বাড়িতে ছেড়ে দিতে গিয়ে সেই ভৈরবের শ্রুতির কথাটা শুভেন সাহস করে বলে ফেলেছিল। মিলি ফিক করে হেসে বলেছিল, তাই বুঝি!
শুভেন দেখলো মিলির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোটাও একদম ক্লাসিক। তখনই সে মনে মনে আজীবন মিলির দাসত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু কথাটা আর বলে উঠতে পারে নি। আটাশের বি মাখন বড়ালের পাশাপাশি ভাড়াটেদের একের আশ্রিতজনের সাথে অন্যের মেয়ে জড়িয়ে গেলে বড্ড জট পাকিয়ে যায়। মানে, যেতে পারতো । তাদের বয়সের ফারাকটাও নেহাত কম নয়। তবুও দ্যাখো, একদিন মিলিই ঝড়ের হাওয়ার মত পর্দা উড়িয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল তার জীবনে। এখনো সে কথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যায় শুভেন।
মোদ্দা কথা মিলির গলার প্রতি এই অমোঘ আকর্ষণের বীজ যে কখন জীবনে বপন হয়ে গেছিল... সেটা ঠিক মনে করে উঠতে পারে না শুভেন! কিন্তু সে আকর্ষণ দিনে দিনে বেড়ে উঠে এক মহিরুহের মত সারা জীবনে ছায়া বিস্তার করছে ...যত দিন যাচ্ছে এক অন্ধ করা ভালবাসায় তলিয়ে যাচ্ছে সে....কি হবে যদি একদিন জেগে উঠে মিলিকে আর না দেখে সে! মিলির গলা শুনতে না পায়...
২
আজও দরজার ঘন্টি বেজে উঠলে সেই অস্বস্তিটা ফিরে আসে শুভেনের। আগের মত অত তীব্র নয়, তবু এক অকালের শীতবোধের মত, হেলায় জড়িয়ে রাখা মাফলারের কুটকুট করার মত… কোনো অজানা আততায়ী এসে পৌঁছোলো কি গন্ধে গন্ধে? এই ভয়েই না টানা তেরো চোদ্দ বছর তাদের কলকাতার কারো সাথে সম্পর্ক ছিলনা?
বঙ্কুর ভাড়া করা বাসায় তারা যেদিন এসে উঠেছিল সেদিন থেকেই...অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠলেই তার মনে হত, দরজা খুললেই যে মানুষটা দাঁড়িয়ে থাকবে, সে জিজ্ঞেস করবে, আপন কৌন? চটর্জীবাবুকা সগে ভাই, রহতে কাঁহা, আ-চ্ছা, আপহিকা নঈ নঈ শাদি হুয়া হ্যায়...
আদতে কোনদিন এরকম ঘটনা ঘটে নি। মুম্বাই শহরতলীর প্রতিবেশীদের মত নিরুৎসুক অথচ সজ্জন প্রতিবেশী বেশি দেখা যায় না। পাশের বাড়ির যোশীরা কখনো সখনো লিফটে দেখা হলে এক চিলতে হাসি বিনিময় করে ফের নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে।
যেদিন মিলি আর সে এক কাপড়ে বম্বে মেলে চড়ে বসেছিল, সেদিনও তার মনে হয়েছিল, এ সুখ তার সইবে তো! ছেলেবেলায় বাপ-মরা ছেলে শুভেন দিদিমার হাতে মানুষ, দিদিমা কলেজে পড়ার সময় চলে গেসল। মামাদের আশ্রয়ে সেও হাঁফিয়ে উঠছিল। ইস্কুলের বন্ধু বঙ্কু তখন বম্বেতে--যা তার কাছে মায়া নগরী ...রাস্তায় বেরোলেই ছায়াছবির হিরো-হিরোইনদের দেখা পাওয়া যায়...কলকাতার কাজের বাজার শুকনো, বঙ্কু টুকটাক খবর দিত, সাহস যোগাতো। আর মিলির মত একটা আস্ত গোটা মেয়ে তার পাশে...নাঃ জাস্ট অবিশ্বাস্য।
অবশ্য মিলিরও স্বপ্ন...একদিন ছবিতে গান গাইবে। এদিকে বাড়িতে তার পরে দুটো ছোটো ছোটো ভাই...বাবার সামান্য চাকরি। রিটায়ারমেন্টের আগে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়ির লোক উঠে পড়ে লেগেছে তখনই। বাগবাজারের মল্লিকবাড়ির থেকে তার সম্মন্ধ এসেছে...চৌরঙ্গীতে বড় দোকান ওদের। শর্ত একটাই...গান গাওয়া ছাড়তে হবে মিলির।
বঙ্কু আশ্বাস দিয়েছিল, এখানে এলে কিছু একটা হয়েই যাবে, তবুও, এ তো প্রায় ফুসলিয়ে নাবালিকা অপহরণ। কোনো একটা নিরাপদ চাকরি ছাড়াই। দুদিন পরেই কষ্ট করতে করতে মিলির ধৈর্য্যচ্যুতি হবে, কলকাতার জন্য হয়তো মন কেঁদে উঠবে তার। তখন কী করবে সে...
বঙ্কুর ভরসায় তারা এসে বঙ্কুর ব্যাচেলর প্যাডে এসে উঠেছে। সকালে স্নান করে মিলি তার শাড়ি মেলে দিয়েছে জানালায়, ব্যাচেলর এসটাবলিশমেন্টের রান্নাঘর গুছিয়ে তুলেছে গৃহিণীর নৈপুণ্যে...বঙ্কু লাঞ্চের ডাব্বা নিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়েছে, আর তার উপদেশ মত বায়োডাটা হাতে শুভেন এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানি কাজ খুঁজে বেরিয়েছে মিলিকে একলা ঘরে রেখে। তার মধ্যেই এক এক দিন দুপুরবেলা কথা নেই বার্তা নেই, সব ছেড়েছুড়ে দুপুরে তৃষ্ণার্তের মত ফিরেছে মিলির কাছে...দরজা খুলে মিলির অবাক দৃষ্টি, অস্ফুট প্রশ্ন থামিয়ে দিয়েছে দু-জোড়া ঠোঁট এক করে দিয়ে, জ্বরতপ্ত দুটি শরীরও তারপর কখন মিলে এক হয়ে গিয়েছে... বিকেল বেলা বঙ্কু ফিরে এসে জিজ্ঞেস করেছে, রিচার্ডসনে গিয়েছিলিস তো, কি আর কোন একটা কোম্পানিতে, শুভেন বঙ্কুর চোখে চোখ না রেখে দায়সারা হ্যাঁ বলে দিয়েছে...
সেই বাসাটার সামনে দিয়ে গেলে এখনো বুকের মধ্যে কেমন একটা বাতাস খেলে যায়। বাসার রান্নাঘরটা রাস্তা থেকে চোখে পড়ে। একলা বাড়িতে মিলিকে প্রথম নিজের করে পাওয়ার সেই দিনগুলি মনে পড়ে। আগের সেই বাসার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এখন তাদের বসবাস।
বঙ্কু সে বাসা ছেড়ে উঠে গিয়েছে অনেকদিন। কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকরিতেও উঠতে উঠতে সে অনেক দূরে এখন। কালেভদ্রে কথা হয় এখন, দেখা হয় নি প্রায় এক যুগ।
অবশ্য সে বম্বেও তো এখন আর বম্বে নেই...মুম্বাই হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু এখনো বাসাটার সাথে আসতে যেতে চোখাচুখি হয়ে যায়, তাকিয়ে থাকলে দোতলার রান্নাঘরে মেয়েলি হাতের নড়াচড়া টের পাওয়া যায়, যদিও বাইরের আলোর প্রাচুর্যে ভিতরের অবয়ব বুঝে ওঠা যায় না ভালো। তবু শুভেনের পা আটকে যায়... ওই কি তবে মিলি? ঘরে যাকে ছেড়ে এল, সে কি মিলি নয়?
অবশ্য মিলি তাকে সকালেই হাত নেড়ে বিদায় জানিয়েছে বলে সারাটা দিন যে ঘরেই থাকবে এমনটাও কথা নেই। আজকাল প্রায়ই মিলির রেকর্ডিং থাকে, স্টুডিওগুলো সব লোখন্ডওয়ালার দিকে, জ্যাম এড়িয়ে পৌঁছতেই হয়, তাই মিলিকেও বেরোতে হয় চটপটই। যদিও বিরাট ব্যানারে প্লে ব্যাকের স্বপ্ন এখনো তার অধরাই থেকে গেছে, মিলি ভয়েস ওভার করে, নানা বিজ্ঞাপনের জিংগল গায়....বিশেষ করে হিন্দি থেকে যেগুলো বাংলায় তর্জমা করা হয়....তাছাড়া শনি রবিবারে সে গানও শেখায়। সামনাসামনি, কিছু স্কাইপ করেও। মাঝেসাঝে শো। মোটের উপর মিলি আজকাল ব্যস্ত, খুবই ব্যস্ত।
পুরনো দোতলার রান্নাঘরে নড়াচড়া থেমে যায়। একজোড়া চোখ গভীর অভিনিবেশে তাকে দেখছে, সেই দৃষ্টির তরঙ্গ যেন তাকে এসে স্পর্শ করে। সম্বিৎ ফেরে শুভেনের। অন্যমনস্ক হয়ে সে এইদিকে চলে এসেছে। এটাই তার হোটেলের রাস্তা, নিত্যদিনের কাজে যাওয়ার পথ। অভ্যাসের বশে।
৩
আশ্চর্যের কথা, মিলি না জানুক, সে তো জানে, হোটেলের দরজা তার জন্য আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া হোটেলও যে কোনোদিন বন্ধ হয়ে যাবে। বারবার পুলিশের হুজ্জুতিতে কাপুররা নাকি আর হোটেল চালাবে না বলে স্থির করেছে, সব কর্মচারীদের একমাসের মাইনে দিয়ে রাস্তা মাপতে বলে দেবে বলে খবর আছে মার্কেটে। পঁচিশ বছর বয়েসের মত আজকাল আবার পকেটে বায়োডাটা নিয়ে পথে পথে ঘুরতে বেরিয়েছে মাঝবয়েসী শুভেন চৌধুরী।
পনেরো বছর আগে কাপুরদের হোটেলের একাউন্টস বিভাগে ঢুকেছিল। কমার্স ডিগ্রির দৌলতে। তারপর সাতঘাটের জল খেয়ে ফ্রন্ট অফিসে এসে বসেছিল। এখন তাই বিভিন্ন হোটেলেই চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পঁচিশে যে প্রতিযোগিতার উত্তাল তরঙ্গে ভর করে সে গন্তব্যে পৌঁছেছিল, মধ্য চল্লিশের শুভেন সেদিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছে। একঝাঁক ঝকঝকে তরুণ প্রফেশনালের ভিড়ে কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসে... জব এজেন্সীর মি. কাটিয়াল তো সেদিন বলেই দিয়েছে, আপকে এজমে থোড়া এগ্রেসিভ বননা পড়েগা মি. চৌধুরী। শুভেনের আশাহত, হতভম্ব দৃষ্টি দেখে আবার বলে, নহি, নহি, আই মীন থোড়া এসার্টিভ। ওয়সেই সী মারমেড কি করমচারী কা থোড়া বদনাম হো গয়া মার্কিটমে।
শুভেন পা ঘষটাতে ঘষটাতে বেরিয়ে আসে। পালিয়ে বেড়ানো মানুষ এগ্রেসিভ হয় কিভাবে, ফাইট যার নসীব নেই, তার তো ফ্লাইটই সার। সবাই তো কাপুর না। কাপুররা ভাল করেই জানতো তাদের হোটেলে মধুচক্র বসছে। ...ব্যবসায়ী, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সরকারী দফতরের অফিসার...সবার জন্য বুকিং, সবার জন্য মার্জিত ভ্রমণসঙ্গী। বুকিং সব বেনামে। এয়ারপোর্টের কাছেই, তাই আসা-যাওয়ার পথে ঘন্টাদুই মৌজমস্তির জন্য প্রশস্ত।
বড় কাপুর পুলিশকে বললেই হল, তারা দুইভাই কিচ্ছু জানতো না? তাহলে যখন শুভেন একজন গেস্টকে জেনুইন আই ডি ছাড়া রুম দিতে অস্বীকার করে দিয়েছিল, ছোট কাপুর ফোন করে কেন বলেছিল, মাদা্€¥দ, মালিককা হুকম বড়া ইয়া তেরা হুকুম! যো বোলা গয়া বহি করনা। আসলে ভি আই পির সঙ্গের মেয়েটাকে কেন যেন খুব চেনা লাগছিল শুভেনের...এক দূরসম্পর্কের এক বোনের মত। যদিও সে নাম বলেছিল পুরো অবাঙালি কেতার উচ্চারণে, অকষতা।
সেদিন মালিকের কাঁচা খিস্তি শুনে বিবেককে ব্লেজারের ছোট পকেটে পুরে ফেলতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু তাতেই কি আরো জট পাকিয়ে গেল? তার চোখেমুখে বিদ্রোহের রেখা দেখা গিয়েছিল। সে আবার একাউন্টস, তার পুরনো বিভাগেই ফিরে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। তার বদলে ছোট কাপুর তাকে একদম বার-দুয়ার দেখিয়ে দিল, কিন্তু সেদিনও বড় কাপুর তার দিকে তাকিয়ে ছিল, অদ্ভুত একজোড়া শীতল চোখের দৃষ্টি নিয়ে। শুভেনের তখনও ব্যপারটা ঠিক সিঙ্ক ইন করে নি।
তবে এসব তো এই লাইনে লেগেই আছে। মধুর সাপ্লাই কমে আসলেই পুলিশের নজর পাল্টে যায়। একসময় কাপুররা ধরা পড়তই, টাকার জোরে জামিনও হয়ে যেত, কিন্তু সেসব কিছুই হল না, তার আগেই বন্ধ হয়ে গেল সী মারমেড। ছুটি হয়ে গেল কর্মচারীদের! পরের প্রজন্মের কাপুরদের সাম্প্রতিক স্বপ্ন বহুতল বাড়ি, মল। কিন্তু বাড়ি তৈরীর শুভেন কিচ্ছু জানে না যে! তাছাড়া জানলেই বা কী, তাকে তো আর বিশ্বাস করবে না কাপুররা।
মিলি এখনো জানে না। প্রতিদিন সকালে উঠে মিলির বানানো চা খেয়ে, দুজনের লাঞ্চের ডাব্বা ভরে শুভেন। চান করে। সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ে কাজে যাবার নাম করে। মাঝে মাঝে একটা করে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙে। আর কতদিন, কে জানে।
৪
মিলি গাছে জল দিতে দিতে একটু নরম স্বরে বললো, আজ একটু তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। আজ সঙ্গীতসুধার লঞ্চ পার্টি আছে। কল টাইম সাড়ে সাতটা। তোমার আজকাল আবার শিফট নেই তো?
--চ্যানেল লঞ্চ তো তোমার কি!
--বাঃ, প্লে-ব্যাক, ভয়েস ওভার আর্টিস্ট ছাড়া এফ এম চ্যানেল লঞ্চ কি জমে? তাছাড়া ভুলে গেলে? কিশোর বলেছিল না, ইনভিটে এলে নিয়ে নিতে? তোমার সামনেই তো কথা হল!
কিশোরের গালভরা নাম সেক্রেটারি। আসলে টুকটাক ইন্ডাস্ট্রির কাজের খবর রাখে। যোগাযোগ করিয়ে দেয়...দক্ষিণার বিনিময়ে অবশ্য, সেটাই তার পেশা। খুব নিষ্পাপ মুখশ্রী, কিশোরের মতই বলা চলে, ব্যবহারও খুব ভাল, শুভেনকে আবার শুভদাদা বলে ডাকে...কিন্ত কেন জানি শুভেনের তাকে বড় তৈলাক্ত মনে হয়, তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, দালাল!
--কে দালাল!
শুভেন সামলে নেয়, না এই যে, খবরে লিখেছে, আর্মি কী সব অস্ত্রশস্ত্র কিনবে, তা দালাল এপয়েন্ট করেছে। তাই নিয়ে পার্লিয়ামেন্টে হুলুস্থুল। কাগজের দিকে তাকিয়েই বলে যায় শুভেন।
মিলি আর কথা বাড়ায় না। তারও মনে আছে একদিন কিশোরকে নিয়ে কী তুলকালাম হয়েছিল। অথচ ছেলেটা দিদি ডাকে তাকে। শেষে বাড়ি ছেড়ে পাশের দক্ষিণী ধর্মশালার লাগোয়া রাম-মন্দিরের সিঁড়িতে গিয়ে বসেছিল। শুভেন গিয়ে অনেক সাধ্যসাধনা করে তার মান ভাঙায়। তার মধ্যে একটা কাজ ছিল একছড়া যূঁইয়ের মালা কিনে দেওয়া। সেটা মনে করে নিজের মনেই একটু হাসলো সে। যূঁইফুল তার এখনো বড় প্রিয়।
--যাক, তুমি কিন্ত তাড়াতাড়ি ফিরে এস জানু। আমাকে সওয়া সাতটার মধ্যে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
বলা যাবে না, মিলিকে কিছুই বলা যাবে না। কিন্তু কাজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা আজকাল খুব হচ্ছে, শুভেনের একদম না-পসন্দ। হপ্তায় গড়ে দুটো করে পার্টি... মিডিয়ার পার্টিতে দুজনের আমন্ত্রণ থাকলে পার্টিতে যায়, বুফে থেকে মিলিকে বার-বার পকোড়া, জল, আইস্ক্রীম এনে দেয়...বিনোদন দুনিয়ার লোকজনদের হেঁয়ালি মার্কা কথা শুনে বুঝবার চেষ্টা করে, মুখে একটা চিলতে হাসি ধরে রেখে। উল্টোপাল্টা কিছু নামলো কি না, মিলির ভ্রু-যুগলের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। নিজে কোন ড্রিঙ্ক পারতপক্ষে নেয় না। নিলেও গ্লাস হাতে ধরা থাকে মাত্র। ড্রাইভ করতে হবে তো। কিন্তু সেটাও বোধহয় সব না, এইসব পার্টিতে যুগলে নেমন্তন্ন থাকলেও, না এলে এমন কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না । বরং না এসে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ঘ্যাম নেওয়াও চলে।
কিন্তু মিলির একলার আমন্ত্রণ থাকলে সে বাড়িতে টিভির সামনে একা টেবিলে বসে, সামনে বরফ, গ্লাসে পানীয়...আর রক্তে কুরুর কুরুর করে সংশয়ের বুদ্বুদগুলির ভেসে ওঠার শব্দ শোনে। ঘড়িটা যত এগোয়, তার ইচ্ছে হয় বেরিয়ে পড়ে, গেটক্র্যাশ করে ..., শেষে একসময় কলিং বেল বেজে উঠলে লাফ দিয়ে ওঠে।
বদলে যাচ্ছে কি মিলিও। তার আলমারিতে শাড়ি, সলওয়ার সুটের সংখ্যা কমে আসছে, জীনস আর নানা রকম কুর্তি... চুল কেটে ফেলেছে... বাংলা মিডিয়ামের ইস্কুলে পড়া মিলির মুখে ঢুকে পড়ছে ভাঙা ভাঙা ইংরাজি, মুম্বাইয়ের টপোরি হিন্দি, কায়কো রে, আর খালিপিলি। ওগো’র বদলে জানু। আই লাইনার আর ডিপ লিপস্টিক ছাড়া আজকাল বাড়ি থেকে বের হয় না মিলি।
আর এক আশ্চর্য কনফিডেন্স। আসলে অনেকগুলো মিলিকে সে গুলিয়ে ফেলে আজকাল। যখন মিলিকে আদর করে, মনে হয় মিলি একান্ত ভাবে তার, কিন্তু যখন মঞ্চে উঠে তার ঈষৎ ভারি আওয়াজের জোয়ারি খুলে দেয়...তখন সে যেন শুধু মুগ্ধ জনতার, আর কারো না। যখন স্কাইপের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের বকাবকি করে, শুভেনের বুক গুরগুর করে, আবার সেই মিলিই যখন কোনো অমায়িক মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ে, তার আপাদমস্তক জ্বলে যায় ...একটু কম হাসো মিলি, দুটো কাজ কম করলেও পেটের ভাত জুটে যাবে ঠিক...চালিয়ে নেবো ঠিক।
কিন্তু আজ আর ততটা জোরের সঙ্গে কখাটা বলতে পারলো না শুভেন। মনে মনেও না। বিরসবদনে বললো, ও ঠিক আছে। এসে যাবো ঠিক। তুমি কিন্ত রেডি থেকো।
৫
একটা পুরনো স্কচের অর্ধেকটা, প্লেটে বাদামভাজা আর আইস পট তেমনি পড়ে আছে। রাত সাড়ে এগারোটা। উঠে খেয়ে নিলেই হয়...মিলি তো ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসবে বলেছে, তাকে যেতে একদম মানা করে গিয়েছে। হবি তো হ, আজকেই কাটিয়াল তাকে যেতে বলেছিল, সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু আপিসে গিয়ে দেখা কাটিয়াল লাঞ্চ করতে সেই যে বেরিয়েছে, তখনো আপিসে আসে নি। সাড়ে ছটা অব্দি তার জন্য অপেক্ষা করে উর্ধ্বশ্বাসে বাড়িমুখো হল শুভেন।
মিলি ততক্ষণে উদ্বেগে পাগলের মত হয়ে গিয়েছে। ওয়াচম্যানকে একটা চলতি ট্যাক্সি ধরতে বলে দিয়েছে। ভাগ্যিস ঠিক তক্ষুনি শুভেন পৌঁছে গেছিল। গাড়িতে উঠেও মিলি হিসহিসিয়ে বলছিল, তুমি এটা ইচ্ছা করেই করলে, তাই না? যখনই আমার কোনো একটা প্রজেক্ট আসে, তোমার এইসব চালাকি শুরু হয়ে যায়।
শুভেন জবাব দেয় নি। গন্তব্যে পৌঁছে শুধু জিজ্ঞেস করেছে, কটায় আসবো?
মিলি পাথরের মত মুখে বলেছে, থাক, আমি ম্যানেজ করে নেব। স্টুডিও থেকে পৌঁছে দিতেও পারে, না হলে ট্যাক্সি তো আছেই। তোমার আসতে হবে না।
খোঁচাটা হজম করেছিল। নিরুপায়। এদিকে রাত দশটার সময় কাটিয়াল ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করলো। যে কাজটার কথা এগোচ্ছিল, সেটা নাকি সুরাটের প্রজেক্ট। মুম্বাইতে না। শুভেনের চলবে কিনা না জেনে আর এগোয়নি কাটিয়াল।
শুভেন চুপ করে থাকে। সুরাট এমন কিছু দূর না। সপ্তাহের মাঝখানে একবার চলে আসাও যায়। তবু...
--কনফার্ম কর দুঁ শুভেন দাদা? ওয়েজ ডিসকাশন কর লেঙ্গে?
শুভেন গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, মুঝে দো দিন টাইম দোগে কাটিয়াল, শোচনে কে লিয়ে?
কাটিয়াল রাজি হয়। হয় তো তার সত্যিই আপত্তি নেই। অথবা হয়তো পুরোটাই ঢপ, কাটিয়াল তাকে গাজরের মরীচিকা দেখিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শুভেনের তাতে কি! সে একটা আবছা ছবি দেখে, উদ্বেল জনতার সামনে গান গাইছে মিলি, হাওয়ার চুল উড়ছে তার! চারিপাশে করতালিতে উদ্বেল জনতা! ক্রমাগত মঞ্চের দিকে ধেয়ে যাওয়া জনতার চাপে দূরে সরে যাচ্ছে শুভেন। আজকাল একটা পনেরো সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়, তারপর সে ছবির মানুষটার ব্যক্তিগত জীবনে জনতার বার্থরাইট জন্মে যায়। আরেকটা ছবিতে সে বুক সমান উঁচু চোরাবালির মধ্যে বন্দী হয়ে ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে।
চটকা ভেঙে শুভেন ধড়মড় করে উঠে বসে। ফোনটা হাতে নিয়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে। মিলিকে ফোন করতে গিয়ে দেখে মোবাইল রীচ করা যাচ্ছে না। শুভেন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। ফোন করবে? কিশোরকে? না কি সঙ্গীতসুধার ওয়েবসাইটে দেওয়া কোনো নাম্বারে? নিচে তাদের বিল্ডিংএর গেট খোলার আওয়াজে শুভেন জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। একটা গাঢ় রঙের সেডান গেট দিয়ে বেরোচ্ছে। কেন জানি তার গাড়িটা খুব চেনা চেনা লাগে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি ঘুরনোর শব্দ করে মিলি ঘরের মধ্যে ঢোকে। হাতে জড়ানো একটা যূঁই ফুলের মালা। শুভেনের সপ্রশ্ন দৃষ্টি অনুসরণ করে মিলি, তারপর বলে, ওঃ, এটা? একটা বড় উরলিতে অনেক মালা আর ফুল জল দিয়ে রাখা ছিল, এইটা তুলে নিয়ে এলাম। সুন্দর না?
শুভেন চুপ করে থাকে। মিলি হাতের ক্লাচটা ডিভানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়, মালাটা একবার শুঁকে একটা সুদৃশ্য বৌলে জল দিয়ে রাখে বিছানার পাশে। জাগ থেকে জল খায়, শুভেনের পাশে বসে পা টানটান করে তুলে দেয় সেন্টার টেবলে। তার কালো ট্রেগিংসের প্রান্তসীমায় আইভরি-শাদা পায়ের পাতার দিকে, মাঝের আঙুলের চুটকার দিকে তাকিয়ে থাকে শুভেনের দুর্জয় মান। মিলি তাকে আড়চোখে দেখে। বলে, গোঁসা হয়েছে বাবুর? বোর হয়ে গেছো একলা একলা?
শুভেনের কোনো উত্তর না পেয়ে কোল ঘেঁষে গুটিসুটি হয়ে আসে মিলি। একটা হাতে শুভেনের চুলে বিলি কেটে যায়। বরফ গলার মত শুভেন আবার একটু একটু করে গলতে থাকে। কেন যে তার মেজাজ খারাপ হয়েছিল ঠিক মনে পড়ে না আর। মিলিকে আবার একটা ছোট্ট বাচ্চার মত লাগে তার। সহজ, উচ্ছল, কিন্তু ভারি অবুঝ, ভারি জেদি।
একটা ছোট বাচ্চা যদি থাকতো তাদের মধ্যিখানে? মিলির মাথার পিছনদিকের চুলের গোড়ায় ঘাম জমেছে। চুলে বিলি কাটতে গিয়ে ভিজে ওঠে শুভেনের আঙুল।
মিলির চোখদুটো বন্ধ। চোখ বন্ধ রেখেই মিলি বললো, জানো, আজকের পার্টিটা খুব কাজের হল। এইজন্যেই এইসব জায়গায় গেলে ভাল নেট-ওয়ার্কিং হয়। শুভেন একদৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে।
--কিশোর অজিত ভাইয়ের সাথে আবার কথা বলিয়ে দিল। উনি আমার গান শুনেছেন বললেন।
শুভেনের কোনো হেলদোল নেই। অজিত বলিউড ছবির বি গ্রেড সঙ্গীত পরিচালক। প্রধান কাজ বিদেশী ট্র্যাক তুলে এনে বাঁশী আর ঢোলক জুড়ে দেওয়া। অজিতভাইয়ের সঙ্গে আগে একবার আলাপ হয়েছে তাদের।
--অজিতভাই একটু অপেক্ষা করে যেতে বললেন। ওনার ছবির ডিরেক্টর আর প্রোডিউসারেরও আসার কথা কিনা! সেইজন্যই তো এত দেরী হল। তবে ভদ্রলোক খুব ভাল, জানো! খোঁজখবরও রাখেন দেখলাম। আমার গান অজিতভাইয়ের কাছে শুনেছেন। শুভেনের সেই একটু আগের স্বপ্নটা মনে পড়লো--সেই উন্মত্ত জনতা, সেই মুহুর্মুহু করতালি, গানের তালে তালে মিলির অনাবৃত বাহুতে আছড়ে পড়ছে তার উন্মুক্ত কেশদাম।
--আমাকে আর অজিতভাইকে ওনার অফিসে দেখা করতে বললেন সামনের সপ্তাহেই। কয়েকটা সিটিং ওঁর অপিসে করতে বললেন, যাতে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়... হিরোইনও নাকি আসবে। ওঁর অফিস নাকি তোমাদের হোটেলের ঠিক পিছনেই।
এবারে উৎকর্ণ হয়ে ওঠে শুভেন, তার অফিসের পিছনে প্রোডিউসারের অফিস! কোনদিন নাম শোনেনি তো! পুরো এস্টেটটাই তো কাপুরদের। প্রপার্টি ট্যাক্স ইত্যাদি তো তাকেই দেখতে হত, যখন একাউন্টসে ছিল।
মিলি তখনো ঘুমজড়ানো গলায় বলে যাচ্ছে--আর খুব ভাল মানুষ, জানো। আমাকে ট্যাক্সির এপ হাতড়াতে দেখে তখুনি ড্রাইভারকে ডেকে বললেন পৌঁছে দিতে।
শুভেনের হাত একদম বাজপড়া গাছের মত স্থির হয়ে গেল এক লহমার জন্য। মনে পড়েছে-- গাড়িটার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার সেভেন থ্রি জিরো থ্রি। কাপুরদের লাকি নাম্বার তিনশো তিন...ওদের সব প্রাইভেট গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বারে তিনশো তিন পাওয়ার জন্য প্রচুর খর্চা করে দুই ভাই!
মাথার মধ্যে একটা বিস্ফোরণ। ব্যস।
৬
রাত বাড়ছে। সাইড টেবলে যূঁই ফুলের মালার তীব্র সুগন্ধ। ধূপের গন্ধও কি? পাশে সেই দক্ষিণী ধর্মশালা-মন্দিরের লাগোয়া কল্যাণমণ্ডপ থেকে লোকজনের টুকটাক কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ক্যাটারারের লোক, কাল নিশ্চয় সকালে ঝমঝম করে নাদস্বরম বাজিয়ে বিয়ে হয়ে যাবে দুটি মানব-মানবীর।
পাশ ফিরে শুয়ে আছে মিলি। অভিমানের নোনা দাগ গালের ধার দিয়ে শুকিয়ে এসেছে । শেষ বর্ষার দুঃখী বৃষ্টির ফোঁটাগুলি যেন বড় বেশি সময় নিয়ে ঝরে পড়ছে, প্রতিটা টুপ টুপ আলাদা করে শোনা যাচ্ছে জানালার বাইরে।
একটা ছোট বাচ্চা যদি থাকতো তাদের মাঝখানে! অবশ্য নিজেরাই তো সে পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। এখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে।
নিজের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে শুভেন। আন্ধেরী স্টেশন এখান থেকে খুব দূরে নয়। রাত একটায় লোকাল ট্রেনের যাতায়াত বন্ধ হয়েছিল, আর ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে আবার চালু হয়ে যাবে। মাঝের সময়টুকু অপেক্ষা, শুধুই অপেক্ষা। মিলির গলার পাশ বরাবর লাল-কালো কালসিটে মতন দাগের উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছিল শুভেন। ভোরের প্রথম ট্রেনটা যখন আসবে, সাহস করে তাকমতো এগিয়ে পড়তে পারলেই... ততক্ষণ মিলি ঘুমিয়ে নিক।