আমড়া গাছের উঁচু ডালে এখনও কিছু ফল ঝুলে আছে। অঘ্রাণে আমড়া পেকে যায়। এই সময় আমড়ার স্বাদ অতি চমৎকার! পাকা আমড়া হাতে নিয়ে, আঙুলের অল্প চাপে খানিক দলে, একটা ছোট্ট ছিদ্র করে; তার মধ্যে অল্প একটু নুন ঢুকিয়ে, তরল হয়ে যাওয়া সেই শাঁসটুকুকে সুড়ুত করে মুখের ভেতর টেনে নেবার যে অদ্ভুত আবেশ—তার স্বাদ নিয়ে মন ভরেনি এমনি লোক খুব কম আছে। এমনি করে আমড়া খাওয়া তাকে শিখিয়েছিল সোনালি। খুব যে ভাল লাগত তা নয়, কিন্তু খারাপও লাগত না। সোনালি বলত, পাকা আমড়া যদি সারাদিন রোদ পাওয়া হয় তো সেটি সোনায় সোহাগা! পাকা শাঁসে থাকে রোদগন্ধ। আঃ! অপূর্ব আমড়ার ভেতর রোদগন্ধ কোনদিন পায়নি।
বাস যে খুব জোরে চলছিল, তা নয়। আবার ঢিমেও যাচ্ছিল না। যখন থেকে অপূর্ব বাসে উঠে বসেছে, সেই একই গতিতে বাস চলেছে। মোবাইল বের করে টাইম দেখল সে। কুড়ি মিনিট হয়েছে সে বাসে উঠেছে। যখন ওঠে খুব ভীড় ছিল। পরে পরে হালকা হতে শুরু করে। তখনই জানালার দিকটা ফাঁকা হয় ও অপূর্ব সেদিকে সরে আসে। স্বচ্ছ জানালার কাঁচ। ফলে সেটা নামানো থাকলেও বাইরেটা চমৎকার দেখা যাচ্ছিল। তখনই তার চোখে পড়ে একটি আমড়াগাছ। রাস্তার ধারে ধুলো মেখে অতি দীন ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একাকী। গুটিকয় ফল ঝুলছে। দেখে, পাকা আমড়ার স্বাদের কথা মনে পড়ে গেল তার। পাকা আমড়ার ভেতর সে পেত সোনালি-সুবাস। আহা!
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য বয়ে চলেছে বাইরে। অপূর্বর মনে হচ্ছিল, সময় চলে যাচ্ছে। জীবন এভাবেই সরে সরে যায় মানুষের জীবন থেকে। এমনি ঘোর এক লহমায় তাকে আচ্ছন্ন করেছিল যে, কনডাক্টর যখন টিকিট চাইতে এল, যেন সম্বিৎ ফিরল তার। একটা লোক তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে ডাকতে দেখে বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে মুখ উঁচু করে লোকটাকে দেখল। বলল, কি?
ভাড়াটা?
অ্যাঁ—
বাসের ভাড়াটা দিন! এবার জোরের সঙ্গে বলল লোকটা।
ওহ, দিইনি, না?
কনডাক্টর কিছু বলল না। হাত পেতে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
পকেট হাতড়ে অপূর্ব বলল, কত?
কোথা যাবেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটা দিল না অপূর্ব। যেন সে একটু ভেবে নিল জায়গাটার নাম; তারপর বলল, বাহিরগঞ্জ।
বাহিরগঞ্জ-এর কোথায়? নোটটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে কনডাক্টর ।
মানে? এবার যেন একটু হকচকিয়ে গেল সে। কনডাক্টর তেমনই ভাবে বলল, বাহিরগঞ্জ জায়গাটা অনেকটা। তার তিনটি স্টপেজ। তার মধ্যে কোনটা?
একটু ভেবে অপূর্ব বলল, আপনি বেশি ভাড়াটাই নিন।
তার পাশে এসে বসা গোলমুখের মোটাসোটা অল্পবয়সী বউটা বলল, ওমা! বাহিরগঞ্জে তো এই বাস যায় না।
একটু অবাক হল অপূর্ব। বলল, যায় না মানে? কোন বাস যায়?
মানে ঐ, যায় না। কোন বাসই যায় না। এই একটাই বাস, আধঘন্টা অন্তর; বাস আপনাকে যেখানে নামিয়ে দেবে, তারপর হাঁটতে হবে। তবে পাবেন বাহিরগঞ্জ।
তবে যে কনডাক্টর বললে, বাহিরগঞ্জের তিনটি স্টপেজ?
অমনি ওরা বলে। আর লোকেও বলে।
কতটা হাঁটতে হবে?
সে আধঘণ্টা বা কুড়ি মিনিট।
টোটো বা অটো কিছু চলে না?
দুর! এ কি আপনার শহর পেয়েছেন? এখানে যা করবেন তা সব পায়ে হেঁটে। তা ওখানে কার বাড়ি যাবেন?
কনডাকটর টিকিট কেটে খুচরো ফেরত দিয়ে চলে গেছিল। সামনের দিকে একটা ফাঁকা সিটে সে বসে পড়েছে। সামনে কিছু নীল-সাদা পোশাকে ইস্কুল ফেরত বাচ্চা উঠেছিল। তারা হাফ ভাড়া দিয়ে বাড়ি আসতে নেমে গেছে। এখন বাস চলেছে ঢিমে তালে। বেশ কিছু সিট ফাঁকা পড়ে আছে।
বউটি কিন্তু প্রশ্নটি ভোলেনি। আবার বললে, বললেন না যে, কার বাড়ি যাবেন?
আমার এক বন্ধুর বাড়ি। আপনার কি ওখানেই বাড়ি।
হ্যাঁ। সেজন্যিই এত করে জিজ্ঞাসা করছি।
বড় গ্রাম বললেন যে।
হোক না; গ্রাম তো। সেখেনে সবাই সবাইকে চিনবে—গ্রামদেশে এমনি হয়ে এসেছে চিরকাল। শহরে যেমন কেউ কাউকে চেনে না, কারও বাড়ি যাতায়াত নেই—গ্রামে কি আর তেমন? এখানে পাঁচ সাত কিমি দূর অবধি সবাই সবাইকে চেনে। চেনাজানার পরিধি থেকে পালাবার উপায় নেই।
বাসটা একটা পুকুর পেরিয়ে গেল। তাতে কিছু হাঁস সাঁতার কাটছে। আরও কিছু হাঁস পুকুরপাড়ের বাঁশবনের ভেতর নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। রোদ-জল-ছায়া-শীত—সব মিলিয়ে অপূর্বর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ!
অমনি বউটি মুখ ফিরিয়ে হাসল। তার হাসিটি চোখে পড়ে গেল অপূর্বর। সে জানালার বাইরে তাকাল আবার। বাস চলেছে যেন সাইড সিন দেখাতে দেখাতে। বাসটা এবার পেরিয়ে যাচ্ছে একটা টিনের বাড়ি। বাড়ি নয়—ঘর। কিন্তু ঘরটার কোন জানালা চোখে পড়ল না তার। দরজা একটা আছে বটে, নিচু, তাতে ছোট্ট তালা লাগান। এতে মানুষ থাকে না ঘুঁটে-গোবর তা বোঝার কোন উপায় নেই। চারিদিক ফাঁকা সবুজ ঘাসের মাঠ চৌকো মাঠ ও ধারে ধারে গাছপালার ভেতর এই বেখাপ্পা বাড়িটির মাথায় ছেয়ে আছে শীতের নধর লাউগাছ। কিছু কিছু ফুলের গোড়ায় ফলও ধরেছে বৈকি।
অপূর্ব আবার আপন মনে বলে উঠল, খুব সুন্দর।
এবার বউটি শব্দ করে হাসল। বলল, কার বাড়ি যাবেন, বললেন না যে?
অতি নাছোড়বান্দা সে। এবার তার দিকে ভাল করে তাকাল অপূর্ব। বউটি বেশ সুশ্রী। বড় জোর তেইশ কি চব্বিশ বয়স হবে। পরনে হলুদ তাঁত ও লাল ব্লাউস। দুই হাতে মোটা মোটা শাঁখা-পলা। সিঁথিভরা সিঁদুর। গায়ে জড়িয়ে আছে একটা রঙিন চাদর। গোল মুখ, ভরাট গাল ও পুরু ঠোট—সব মিলিয়ে চোখ টানে।
অপূর্ব বলল, পল্টুর বাড়ি যাব।
পল্টু? বলে বউটা খানিক হাঁ করে থাকল। বলল, কোন পাড়ায় বাড়ি?
পুবপাড়ায়।
পুবপাড়া? উত্তর দক্ষিণ দুটি পাড়াই আছে আমাদের গ্রামে। আচ্ছা এই পল্টুর বয়স কত হবে? আপনার বয়েসি?
না না, ছোট। বছর সতের—।
পড়ে?
হ্যাঁ।
কলেজে পড়ে?
হ্যাঁ।
কোথাকার কলেজ?
কলকাতায়।
ও। তা সে আপনার কে হয়?
বন্ধু।
অ্যাঁ! বলে বউটি মুখে আঁচল চাপা দিল। বলল, আপনার বয়স তো ওর চেয়ে বেশি।
ঠিক তাই। অনেকটাই বেশি।
একটা সতের বছরের ছেলে বন্ধু আপনার—বলে সে খি খি হেসে যেতেই থাকল।
**********
বাসটা তাকে যেখানে নামিয়ে দিল, ধূধূ ফাঁকা এক জায়গায়; অপূর্ব দেখল এক ধূলিধূসরিত পথ এঁকেবেঁকে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। কথিত আছে, এই পথ দিয়ে গেলেই সেই গ্রামে পৌঁছনো যাবে।
সে না হয় টুকটুক করে দুই পায়ের ভরসায় পৌঁছে গেল সেখানে; তারপর? কী বলবে সে? কিভাবে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? আবার এমনও হতে পারে, গিয়ে দেখা গেল; গোটা গ্রামটাই তার জন্য অপেক্ষা করছে।
না, একটু বেশি ভেবে ফেলছে সে। গোটা গ্রাম তার জন্য কেন অপেক্ষা করবে? গ্রাম তো তাকে চেনে না। বরং অপেক্ষা করে থাকবে একটি বাড়ি, দুটি গাছ ও তিনটি গরু। গাছ দুটি সে কেটে ফেলেনি তো? বা, ঝড়ে পড়ে গেল কোন একদিন। হয়ত সে গরুগুলিকেও বেচে দিয়েছে। তাই হাতে রইল বাড়িটি কেবল। কিন্তু সে কি চিনতে পারবে?
পথের ধুলোয় পা দেবে গেল অপূর্ব’র। অসাধারণ এই ধুলোর বিস্তার। গোটা রাস্তাটাই ধূলিময়। কিন্তু তার এই বিস্তার এলোমেলো নয়। অপূর্ব এক শিল্প সুষমা আছে। একটা ছন্দ আছে। আলাদা একটা চলন আছে। ধুলোর মোটা স্তর ধরে রেখেছে সাইকেলের টায়ারের দাগ। তার উপর এলোমেলোভাবে পড়েছে অঘ্রাণের শুকনো পাতারা; জন্ম হয়েছে এক দৃশ্যকল্পের। সে হল নয়নলোভী। মোবাইলে ছবি তুলল না অপূর্ব। স্মৃতির কোন ছবি হয় না। পা ফেলতেই সে ডুবে গেল তার সেই অনন্ত স্মৃতির প্রবাহে।
বাসের সেই বউটিও নেমেছে এই স্টপেজে। সে আগে আগে থমকে থমকে হাঁটছে আর পিছু ফিরে বারবার দেখছে। একবার তো বলেই ফেলল, রাস্তার এই ধুলোও সুন্দর—তাই তো?
অপূর্ব আকাশ দেখল। অনেকটা আকাশ পড়ে আছে গাছেদের ওদিকে। পাতা ঝরা, শীতের দাপটে কুঁকড়ে থাকা লম্বা ও রোগা সব গাছেদের ডালে ডালে যে কয়টি পাতা এখনও অবশিষ্ট আছে; তাতেও ধুলোর আস্তরণ। যেন গোটা পৃথিবী ঢেকে যেতে থাকব এইভাবে—ধুলোর ভেতর। ধূলিময় হয়ে উঠবে জীবনযৌবন। সংবাদপত্রে পড়ছিল সে, দিল্লির আকাশবাতাস ঢেকে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ধুলোয়!
বউটি চলে যাচ্ছে। বলে গেল, আমার পিছন পিছন চলে আসুন; ওখানেই যে বাড়ি আমার।
অপূর্ব বলল, আপনি এগোন। আমার সময় লাগবে।
বউটি আবার হাসল। কিন্তু আর কিছু বলল না। তারপর হন হন করে হাঁটা লাগাল।
নিজের বশে একটু একটু করে হাঁটতে লাগল অপূর্ব। আগে তার মনে প্রবল এক উৎকন্ঠা ও উদ্দীপনা ছিল। আহা, কতদিন পর দেখা হবে! না জানি কি দেখবে সে, কেমন দেখবে; আদৌ চিনতে পারবে কিনা। নতুন করে চেনাজানার পর্ব মিটলে কী বলবে সে? আবার সে-ই বা কতটুকু কী বলবে?
সঙ্গে আবার এটাও মনে এল, এইভাবে আসার কি সত্যি দরকার ছিল? কেন এল সে? অনেক ভাবনা চিন্তা করেই এই পথে পা রাখা। তবু, আসা কি ঠিক হল?
রাস্তার দু’ধারে কিছু কিছু বাড়িঘর; গ্রাম নয়, গ্রামের মতন—বাকিটা চাষজমি। লম্বা হয়ে উঠে গেছে সর্ষেগাছ, তাতে হলুদ ফুল। আর আছে মাঠের পর মাঠ আলুগাছ। আলুগাছের পাতারা সব চকচকে। এইসব ক্ষেতজমির ফাঁকে যেসব গাছ বসানো আছে, তাদের পাতারা কিন্তু ধুলোরহিত। পরপর রোপিত ও চুন দিয়ে নাম্বার লেখা—মনে হয় সরকারি গাছ। এই গাছেদের সে চেনে না। আসার সময় রাস্তার ধারে যতগুলি বট ও অশ্বত্থের গাছ দেখেছিল, সব পাতা ধূলির স্তরে চিত্রিত। অপূর্বর জানা নেই, এই সব ধুলোও মধ্যপ্রাচ্যের কিনা।
খানিকক্ষণ হেঁটে চুপ করে রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে গেল অপূর্ব। মুখ তুলে সামনে তাকাল। বউটি অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর পিছু ফিরে তাকাচ্ছেও না। ভুলে যেতে মূহূর্ত লাগে না।
আদিগন্ত মাঠ ও মধ্যে মধ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু বনজঙ্গল, বাড়িঘর—এই পথ দিয়েই সে নিশ্চয় সেই লাল সাইকেলেই চলাচল করে। এই যে ধুলোর উপর আঁকাবাঁকা সাইকেলের টায়ারের দাগ, সে কি তার সেই সাইকেলের? তবে কি কিছুক্ষণ আগেই এই পথ দিয়ে গেছে সে, সময়ের তালমিল হলে দেখা হোত এখানেই!
মাঠের মধ্য দিয়ে কিনকিন করে এক ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। সমগ্র মাঠ জুড়ে তার বিচ্ছুরণ। সে যেন কোমরে হিল্লোল তুলে অপূর্বর গালে এক আঙুলের শিহরিত ঠোনা মেরে বলে, কিহে, ভাল আছ? পাকা আমড়া আনলে না?
আমড়া গাছ কই আমার?
আহা, রাস্তার ধারে দেখলে যে? তবু আনলে না? মনেই পড়ে না, না?
এমন বাতাসে ধুলো যেন প্রাণ পায়, সে উড়তে থাকে না বাতাসে, স্ফীত হয়ে স্থিত হয় মাটিতেই। তখন মাটিতেই তার সুর বাজে; মাটি থেকে মাটিতেই প্রবাহিত হয় সঙ্গীত। সঙ্গীত মূর্ত হয় তার চলায়।
************
একটা সাইকেল এসে থেমে গেল অপূর্বর সামনে। আরোহী সাইকেল থেকে নামল না। সিটে বসেই মাটিতে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ধুলোর উপর সেই স্যান্ডেল-পা। আরোহী বললে, অপূর্ব না?
অপূর্ব তার সাইকেল দেখছিল। কতদিন যে যত্ন হয় না সাইকেলের। ঝাড়পোঁছ হয় না। এক চটক দেখলেই বোঝা যায়, এই সাইকেল বহু পুরানো। অপূর্ব শুনেছে, গ্রামদেশে এখন আর পুরানো সাইকেল কেনার খদ্দের নেই। ইস্কুল থেকে এখন সাইকেল দেওয়া হয় বিনামূল্যে। ফলে ঘরে ঘরে দুটি তিনটি করে সাইকেল। পুরানো জিনিস এখন কেজি দরে বিক্রি হয়।
অপূর্ব তখন আদর মাখছিল। আর কিনকিন বাতাস তাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলছিল। সে আচ্ছন্নের মতন বলল, অ্যাঁ?
চিনতে পার আমায়?
হ্যাঁ। পারছি।
বল দেখি আমি কে?
অসীমদা?
হুম! ঠিক চিনেছ তাহলে।
এবার যেন একটু ধাতস্থ হল অপূর্ব। আদরের রেশ গাল থেকে একটু একটু করে চারিয়ে যাচ্ছিল সারা শরীরে। আর কেঁপেকেঁপে উঠছিল তার অন্তর। অসীমপদ বলল, এদ্দিন পর এদিকে? যাচ্ছ কোথায়?
যাচ্ছি...
হ্যাঁ। কার বাড়ি? এদিকে তোমার তো কোন আত্মীয় নেই যতদূর জানি।
যাচ্ছি পল্টুর বাড়ি।
ও। তা সে থাকে কোথায়?
ঐ যে—
বুঝেছি। কন্তু এতটা পথ যাবে কীসে? আমিও যে সাইকেলে চাপিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব, সে ধ্বক নেই। বয়স চলে গেছে। নইলে এই সাইকেলেই তিনটি করে চালের বস্তা নিয়ে পাঁচ কিমি রাস্তা হেঁটে গেছি। আর এখন তুমি সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভেতরে ভেতরে কাঁপছ!
চারিদিকে টোটো চালু হয়ে গেল। এদিকে নামাতে পারলেন না?
কষের একটা দাঁত ভেঙে গেছে আসীমদার। হাসলে চোখে পড়ে। বললে, অটো নামানোর ক্ষমতা আমার নেই ভাই। পার্টি করা ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে তো আবার তিনমাস জেল খেটে এলুম।
অপূর্ব যেন সচকিত হল। সে খেয়াল করল কনকনে শীতের সেই আদর মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তার গা আবার ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। কে জানত, মাঠের মধ্যে খানিকটা এসেই তাকে এতটা শীতভোগ করতে হবে?
সে সতর্ক হয়ে বলল জেলে? কেন?
আরে ভায়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি আর সব কথা বলা যায়? এই সামনেই আমার বাড়ি; তুমি বাঁহাতি যে মেঠো রাস্তা ফেলে এলে—সেটা দিয়ে গিয়ে একটুখানি। চলো একবার; ঘুরে আসবে। যখন এখানে কাজ করতে আসতে কোনদিন তো এলে না। আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই।
অপূর্ব অনুনয়ের সুরে বলল, আজ একটু তাড়া আছে অসীমদা—অন্য একদিন—
এই রকম অন্য একদিন অনেক কেটে গেছে। দিন গিয়ে বছরও ঘুরে গেছে। দুই বছর এখানে কাজ করেছ, কিন্তু একদিনও আসনি। আজ আর ছাড়ছি না, বন্ধুকে ফোন করে দাও। রাতে না হয় ওর বাড়িতে থেকে যাবে। একটা দিন তো!
ওহ—।
একটু আগেই তোমার কথা হচ্ছিল। তুমি আমাদের খবর নাও না বটে, আমরা কিন্তু আলোচনা করি। আমরা তোমাকে মনে রেখেছি।
একটু অবাক হল অপূর্ব। ভুরু কুঁচকে বলল, আমরা মানে?
কাঁচাপাকা সেই ‘বাংলার বাঘ’ মার্কা গোঁফের ফাঁকে খি খি করে হাসল অসীম। বলল, এই পাঁচ বচ্ছরে তুমি হয়ত তাকে ভুলে গেছ, সে কিন্তু ভোলেনি তোমায়। এই মাঠ পেরিয়ে সোজা যে গ্রামটা পড়বে, সেই গ্রামে ঢুকেই প্রথম তিনটি বাড়ি পরই তার বাড়ি। মনে পড়ছে?
বিস্মিত হয়ে অপূর্ব বলল, কই না!
হুঁ হুঁ বাবা, পড়বে কি করে? কোনদিন গেছিলে তার বাড়ি? নাকি এই পাঁচ বছরে তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রেখেছ।
কার কথা বলছেন বলুন তো?
এই তো, তোমার সঙ্গে এই যে দেখা হল, তার খানিক আগেই তার ছোট জা দেখি এই রাস্তা ধরেই হেঁটে বাড়ি ফিরছে। কোথায় গেছিল, সে কথা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আগের বউটা ক্যান্সারে মারা যেতে বিমল আবার বিয়ে করেছে। না করে কোন উপায় ছিল না। ছেলেপুলে, জমিজমা দেখত কে তাহলে? তবে বয়সে অনেক ছোট। যাইহোক, এই নতুন বউটা বেশ ভাল। হাসিখুশি। দেখা হতে ওর সঙ্গেও কিছুক্ষণ কথা হল। হাসাহাসি হল। খুব হাসে বউটা। কথায় কথায় হাসে। ওদের বাড়ি থেকেই তো এখন আসছি। আর তখনই তোমার কথা উঠল। বলে অসীমপদ থামল। যেন দম নিতে চায়।
ঘেঁটে গেল অপূর্ব। বলল, আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না, অসীমদা। একটু খুলে বলবেন?
একটু চুপ থেকে অসীমপদ বলল, সোনালিকে মনে পড়ে?
সাইকেল থেকে নেমে পড়েছে অসীমপদ। ভারী শরীর তার। বয়সও হয়েছে। কত হবে? সত্তর। যাবতীয় কিছুর সঙ্গে পাঁচ বছর যোগ করতে হচ্ছে। তখন ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে আবার।
অপূর্ব দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। দেখছে এই সামান্য বিকেলেই কীভাবে কুয়াশা নামিয়ে দিচ্ছে শীতের বেলা। মাঠের উপরিস্তরে জমছে কুয়াশা। সেই গোলগাল ছোট জা বউটি হয়ত সেই কুয়াশার ভেতর ঢুকে পড়েছে।
অসীমপদ এই ভাবে যে তাকে সোনালির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে এই ধূধূ শূন্য মাঠের ভেতর ধুলোর ভেতর, তা কি ভেবেছিল অপূর্ব?
প্রবল ঠান্ডার দাপটে ভেতরটা কাঁপছিল তার।
**************
সাইকেল নিয়ে হাঁটতে শুরু করল অসীম। তার পুরো নাম অসীমপদ গোস্বামী। থলথলে চেহারা আছে আগের মতই। তবে আগে যে শাঁসেজলে থাকার ব্যাপার ছিল, এখন তা নেই। চামড়া যেন শুকিয়ে আসছে তার। তার পরনের মাফলার সোয়েটার দেখে অপূর্ব বুঝল, এইগুলি গত দশ বছর ধরে ব্যবহার করছে অসীমদা। বস্তুত, সে অসীমকে চট করে চিনতে পেরেছে চেহারার কারণে নয়, এই পোশাকের জন্য।
ধীর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে অসীম বলল, চলো। বেশীক্ষণ আটকাব না। তুমি এলে আমার ভাল লাগবে; কারণ মনের কথা বলার লোক বিশেষ পাই না। এক ছিল সোনালি; আর তুমি। তুমি বাইরের পাখি; উড়ে যাবেই। গেলেও। সোনালির বাড়ি এখানেই। তাই যখন তার গ্রামে যাই, গিয়ে ওর দুয়ারে খানিক বসি। সুখদুঃখের খবর করি খবর নিই—ও বলে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির কথা। বলে অসীমপদ হাসল।
একটু থেমে আবার বলল, এই ভাবেই কেটে যাচ্ছে ভাই; আর কতদিন! উনসত্তর বছর বাঁচা হয়ে গেল; এখন যতটুকু জীবন বাকি আছে, এইভাবেই কেটে যাক। মধ্যে মধ্যে তোমাদের মত শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মানুষদের সাথে দেখা হবে---একটু কথা হবে; আর কী?
ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির ব্যাপারটা কী?
আরে সেই রূপকথার গল্প—মনে নেই?
না না, সেকথা বলছি না। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির গল্প কে না জানে।
সোনালিই ঐ ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমির গল্প বলে। তারা নাকি রাতবিরেতে ওর আমগাছে এসে বসে। দুঃখ সুখের কথা বলে।
অপূর্ব কিছু বলে না। সে নীরবে ধূলিকণার বহর মাপতে মাপতে সমান্তরাল হাঁটছিল। সাইকেলের টায়ারের চাপে যেখানে উঁচু হয়ে আছে ধুলো, তা কিছু ভাঙছে না। স্থির এবং প্রত্যয়ী ধুলোসকল।
অসীমপদ ধীরস্থির গলায় বলল, এই সেদিন জেল থেকে ছাড়া পেলুম। তিনমাসে আমার বয়স বেড়ে গেল যেন তিনবছর। জীবনটা যেন গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গেল! তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে আমার উপকারই হল। লোকের সঙ্গে তো এখন আর কথাই কওয়া দায়। তোমাদের মত কিছু মানুষের জন্যই দুনিয়াটা চলছে।
তাদের মাথার উপর দিয়ে বাতাস উড়ে যাচ্ছে; সরে যাচ্ছে জমে থাকা ও ভাসমান কুয়াশারা। কিছুকিছু জমি ফসলের মাঝে ফাঁকা পড়ে আছে। খুব দূরে একটা দিঘি, মনে হচ্ছে তার শীতলতা ভেসে আসছে এখানেও।
ধুলোর দিকে তাকিয়ে অসীমপদ বলল, কি ধুলো দেখেছ? পা দেবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গোটা এই মাঠ কেবল ধুলো দিয়ে বানানো! আমাদের এই ধুলো দেখাশোনা করার অব্যেস আছে। কিন্তু তোমার পায়ের অবস্থা দেখেছ? বুট দেখে মনে হচ্ছে না, ভাগাড় থেকে তুলে আনা? উফ! ধুলোয় ধুলোয় একেবারে শেষ করে দেবে। দেশ-গাঁর লোক আমরা—দিন দিন দেখি ধুলো যেন বাড়ছে! এত ধুলো হয় কীকরে?
মাঠেক ঘুরে আলপথে খানিক গিয়েই গাছপালার ধারে অসীমপদর বাড়ি। বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায় না। দূর থেকে মনে হবে, কিছু গাছ ডানা মেলে আছে বুঝি বা।
উঠোনের একধারে জুতো খুলে রেখে অসীমপদর বসার ঘরে ঢুকল সে। চেয়ার একটা আছে বটে কিন্তু সেটাতে অসীমপদ নিজে বসল; অপূর্বকে বসাল খাটে! অফিসের কথা শুরু করল। কিন্তু তার ভেতর সোনালির প্রসঙ্গ এল না একবারও।
অপূর্বরা জানত, অফিসের এই কাজটা অসীমপদর কাছে একটি ছুতো মাত্র। আসলে সে আসে সময় কাটাতে। প্রচুর জায়গাজমি আছে তাদের। পুকুর আছে, বাগান আছে। তার তদারকি ঠিক মত করলে মাসে ত্রিশ হাজার টাকা বাঁধা ইনকাম। কাজ করবে কিষাণ; কিন্তু তাদের উপর সব ছেড়ে দিলে হবে না; কাজ করাতে হবে। ছাতা মাথায় মাঠে বাগানে তাদের কাজের খেয়াল রাখতে হবে, সেটাও পোষাত না হদ্দ কুঁড়ে অসীমপদ’র। সে এই অ্যাকাউন্টস অফিসে খাতা লেখার কাজ বেছে নিল। খাতা যে যত তাড়াতাড়ি সারতে পারবে, সে তত টাকা পাবে। কিন্তু অসীমপদ কাজ করবে কি, সবসময় গুজুরগুজুর করতেই ব্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে অফ নিত। জমিজমা দেখভালের জন্য। এর মধ্যে জেল খাটার কথা আসে কী করে?
অসীমপদ’র স্ত্রী এসে আলাপ করে গেল। তাকে এই প্রথম দেখল অপুর্ব। হাতে চা বিস্কুটের প্লেট ধরিয়ে বলল, জেল খেটে এসে ও আরও কুঁড়ে হয়ে গেছে, জান।
এবার হাসল অপূর্ব। তার মনে হল, জেল ব্যাপারটা খোলসা না হলে সোনালির ব্যাপারটা খুলবে না। আর অসীমপদ তাকে এখানে ডেকে এনেছে জেলজীবনের গল্প শোনাবে বলে।
তাই সে বলল, অনেকক্ষণ থেকেই জেলের কথা শুনছি। ব্যাপারটা কী?
আরে তুমি তো এখানের কাজ ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলে বড় চাটার্ড ফার্মে কাজ পেয়ে; আমরা গ্রামের লোক, গ্রামেই কাজ করে যেতে লাগলাম, ওই খাতা লেখারই কাজ। মাঝে একদিন আমাদের অফিসের মালিক ত্রিদিব আমাকে দিয়ে একটা কাগজে সই করিয়ে নিল। আমিও সরল মনে সই করে দিলুম। কীসের কাগজ জিজ্ঞাসা করতে বলল, সে আমাকে পার্টনার করে নিল। ফলে আমায় কিছু আয় বাড়ল। সকলে আমাকে অফিসের সেকেন্ড ম্যান বলে জানত। অফিস আসা কমিয়ে দিলুম। ঘরে বসেই যখন মাইনে পেয়ে যাচ্ছি তখন আর খাটা কেন? কিন্তু এ থেকে যে আমার বিপদ আসতে পারে, তা আর কে জানত!
তারপর?
বছর দুয়েক পর গোলমাল ধরা পড়ল। আমাকে অংশীদার দেখিয়ে ত্রিদিব করেছিল কী, আমিও ওতে লগ্নী করেছি, সেটা দেখিয়েছিল। তারপর সে কারচুপি করতে থাকে। যারা খাতা সারতে দিতে আসত, তাদেরই কেউ পুলিশে অভিযোগ করে। তদন্তে ত্রিদিব ফেঁসে গেল। আমিও আটকা পড়লুম। শেষে হলফনামা দিয়ে ছাড়া পাই। সোনালিরা আমার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল; সে এক কাণ্ড।
আর ত্রিদিব?
সে এখনও জেলে। খবর রাখি না। ওর পরিবার আর এখানে থাকে না। বাড়িতে তালা মারা।
আর সোনালি?
এই প্রথম সোনালির নামটা তোলার সুযোগ পেল অপূর্ব।
ওকে অনেকে কাজে ডেকেছিল। ও যায়নি। বলে, বাইরে কাজে যাব না। দেশেঘরে কাজ পেলে ঠিক আছে। বড় ভাল মেয়ে ভাই, ওর কোন তুলনা নাই।
এখন তবে কী করে?
কী করবে, বাড়িতেই থাকে। হাইরোডের ধারে জমি ছিল, সেটা চড়া দামে বিক্রি করেছে। সেই টাকায় ছেলেটাকে পড়তে পাঠিয়েছে বাইরে। ওর ছেলেটা যখন ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে অফিসে আসত, তুমি ওর একটা নাম দিয়েছিলে না?
হ্যাঁ।
কি যেন নামটা?
অপূর্ব চুপ করে থাকল। অসীমপদ সেটা খেয়াল না করে বলল, সে ছেলেকে এখন দেখলে আর চিনতে পারবে না— অনেক লম্বা হয়ে গেছে। ভারিক্কি গলা। পাঁচ বছর অনেকটা সময়; সে সময়টা এখন ধুলো হয়ে গেছে। ছেলে মানুষ হয়ে একটা চাকরি পেলে তবেই সোনালির শান্তি।
একটু চুপ থেকে মেঝের দিকে তাকিয়ে অসীমপদ বলল, মাঝে মাঝে হারিয়ে যাওয়া ওই সময়টাকে ছুঁতে চাই, জান; কিন্তু পারি না। তুমি কাজ ছেড়ে চলে যাবার পরই আমাদের যেন তাল কেটে গেল। সোনালিও চুপ করে গেল। ওর মধ্যে আগের সেই উচ্ছ্বাসটা আর দেখতাম না। আমারও আর অফিসে আসতে ভাল লাগত না। আবার না গেলেও নয়। তখনই সইটা করে ফেলি। তুমি থাকলে ভালমন্দ একটা বুদ্ধি দিয়ে সেটা আটকানো যেত।
বলে অসীমপদ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, সোনালির ছেলের নামটা যেন কি দিয়েছিলে?
অপূর্ব একবার অসীমপদ’র মুখের দিকে তাকাল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মনে নেই।
*******
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অপূর্ব দেখল, সেখানে এখন এক মনমরা বিকেল চলে এসেছে পুষি বেড়ালের মত। পিছনের সেই জানালা দিয়ে তাকালে বিকেলের বকের উড়ে যাওয়া চোখে পড়ে। আকাশ ধুলোরং।
অসীমপদ বললে, আমি এখন আসলে গেছিলাম সোনালির বাড়ি।
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল অপূর্বর। স্খলিত গলায় বলল, কেন?
পৌষ সংক্রান্তিতে ওদের গ্রামে একটা পালা নামবে। সোনালির বাড়ির পাশেই একটা ক্লাব আছে, ওরাই বরাত দিয়েছে। পালা তো উঠেই যাচ্ছে গ্রামদেশ থেকে! তাই পালা হলে ক্ষতি কী? মাঝে কেবল তিন মাস জেলে যাওয়া হল, এই যা।
অপূর্ব চুপ করে বসে রইল।
ও হ্যাঁ, তুমি তো বন্ধুর বাড়ি যাবে বললে, কি নাম যেন বন্ধুর?
পল্টু।
ও। তা ওদিকে যখন যাচ্ছ, ঘুরে যেও না সোনালির বাড়ি। ও খুব খুশি হবে।
কোনদিন যাইনি।
কিছু ব্যাপার নয়। পথ বলে দিচ্ছি—। এই মাঠ পেরিয়ে সোজা যাবে। তারপর বাঁ হাতির গলি। হ্যাঁ, তার আগে তিনটি গলি আছে। সেগুলি পেরিয়ে পরেরটা। সেটা দিয়ে সোজা গিয়ে, মাঠের ধারে বাড়ি। খুব সোজা। কাউকে জিজ্ঞাসাও করতে হবে না।
একটু থেমে অসীমপদ আবার বলল, ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। আমি ওসব পারি না, করি না, দরকারও নেই। ছেলে একটা ফোন বাড়িতে রেখে গেছে—বোতামটেপা ফোন; ফোনাফুনি যা করবার ওর মা-ই সব করে। কোন কাজ থাকে, যদি দেখি ওর হাতে সময় আছে—একবার ঢুঁ মারি। থাকলে ভাল, না থাকলে ওর বাড়ির অন্য সব জা’দের সঙ্গে বাচ্চাদের সঙ্গে খানিক গল্পগুজব করে চলে আসি। ওদের অনেক বড় বাড়ি। হাঁড়ি আলাদা হলেও সবাই একসঙ্গে।
কীরকম?
সোনালিদের পুবদিকে তিনটি ঘর। দক্ষিণে ওর মেজ জা’র দুটি ঘর আর পশ্চিমে ওর বড় ভাসুরের দোতলা। মাঝে বড় উঠোন। সেখানে আমগাছ। আমি যখন যাই, ওই গাছের নিচেই সাইকেল রাখি। এবার যেতেই ওর মেজ জা বললে, বসুন, ও বড় রাস্তার দিকে গেছে—এল বলে। বসে যাই। বসলুম, সোনালি এল। সেও সাইকেল রাখে ওই গাছতলায়। সাইকেল রেখে হাত ধুয়ে দু’খানা নাড়ু খেতে দিলে। আর এক গ্লাস জল। কত গল্প হল।
কী গল্প?
পুরানো দিনের গল্পই বেশি হয় কি ছিল সব, কি হয়ে গেল। আমাদের পালা নিয়েও কথা হল। আর তোমাকে নিয়েও কথা হয়। দেখা হলেই তোমার কথা উঠে আসে, রোজ। আমার এখন কী মনে হয় জান অপূর্ব, মানুষের সাজানো সব কিছুই একদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়। এইভাবেই মানুষ একদিন জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তখন সে মারা গেলে তার আর তেমন কষ্ট হয় না। সাজানো বাগান, সাজানো সংসার, সাজানো রাজত্ব-বিরোধীতা-বন্ধুত্ব, ভোট-ছাপ্পা, প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা সব ধুলো হয়ে মিশে যায় ধুলোয়। হয়ত তাই সারা পৃথিবীতে এত ধুলো। হয়ত তাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধুলো উড়ে আসে এইখানে।
***********
অসীমপদ বসে বসে দুলে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ। একটা টিকটিকি সবুজ দেওয়াল বেয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে ডেকে উঠল। অপূর্ব বলল, তারপর কী হল অসীমদা?
কীসের? যেন ধ্যান ভেঙে জেগে উঠল অসীমপদ।
যে কথা বলছিলেন—
কোন কথা?
আপনি একটা গল্প বলছিলেন আমায়।
ও সব গল্প সোনালির কাছে শোনা। নইলে আমি গল্প পাব কোথা? গল্পর বই পড়েছি কোনো দিন? ফাঁকিবাজি করে জীবন কাটিয়ে দিলুম।
কীরকম গল্প?
ও বলে, ওদের আমগাছে ব্যঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি পাখি এসে বসে। হা-হা-হা-।
আচ্ছা!
আরও বলে। অসীমপদর হাসি চলছে তখনও।
কী?
হঠাৎ চুপ করে গেল অসীমপদ। তারপর বলল, স্মৃতি জমে জমে গল্প হয়।
অপূর্ব অনেকটা বাতাস টেনে তা বুকের ভেতর ধরে রেখে বলল, কথাটা কার, অসীমদা?
কার আবার—সোনালির।
অসীমপদর স্ত্রী ঘরে ঢুকল এইসময়। বিছানায় বসল। গায়ে মোটা একখানা চাদর। মাথায় বউটুপি।
অসীমপদ বলে চলল, স্মৃতিরা কি সত্যিই গল্প হয়? নাকি তারা ধুলো হয়ে যায়? পা যেমন ডুবে যায় ধুলোয়, মনও কি তেমনই দেবে যায় স্মৃতিতে? কি জানি! কিন্তু এমনি মনে হয়। আমি কুঁড়ে লোক, তাই মনে হয়। যখন চাষ দেখতে মাঠের ধারে যাই, দেখি আলো উড়ে যাচ্ছে, মেঘ ভেসে যাচ্ছে—যেন সময় চলে যাচ্ছে আর মনটা তখনই হুহু করে ওঠে। এখন তোমার কথা মনে হচ্ছে, ও সব আলো-মেঘ কিছু নয়, সব ছিল ধুলোর ডানামেলা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ধুলো উড়ে আসছে।
আর সোনালি?
সে দিনরাত খেটে যাচ্ছে। সাইকেলে সারাদিন এই ওই করে যাচ্ছে। সকালেই এদিকে এসেছিল—হাইরোডে কী কাজ ছিল—যাবার সময় দেখা করে গেলে এইসব আর তোমাকে দিয়ে বয়াতুম না। ও পাকা আমড়া নুন দিয়ে খেতে ভালবাসে; অনেকবার বলেছে—আমার আর যাওয়া হয়নি। আর যখন আজ গেলুম, হাত ফাঁকা। আরে গেছি পালার বায়না করতে এর মধ্যে আমড়া বা লাউয়ের কথা মনে ছিল না ভাই। ফিরতি পথে মনে পড়ল। এমন মেয়ে, আমড়া চাইবে, কিন্তু জমির কিছু ফসল চাইবেনে। সব ফসল কি আমি বেচি? কত ফেলা ছড়া যায়। বাড়ি এলে যদি গুঁজে দিই, সেই ভয়ে আসবেনে। কি কাণ্ড বল দিকিনি! এখন তোমাকে যখন পেয়েছি, ওর বাড়ি যেতেই হবে তোমায়—সে তোমার বন্ধুর বাড়ি যেতে যতই দেরি হোক—আমার এই কথা রাখতেই হবে।
পাকা আমড়া আপনি কখনও খেয়েছেন?
দূর!
আমি খেয়েছি, জানেন।
বা। খুব ভালো। এই আমড়া খুব মিষ্টি। নিয়ে যাও, নুন মাখিয়ে খেও।
পাকা আমড়ায় থাকে রোদের গন্ধ।
হা-হা। বললে ভাল। এটা সোনালির মত হয়ে গেল।
সোনালি এখন কী করে?
চাকরি চলে যেতে টিউশুনি করে। এখন ছেলে উল্টোডাঙ্গায় মেস করে থেকে সল্টলেকে পড়ে। হাইরোডের ধারে ওদের যে জমি ছিল, সোনালি তা বেচে দিয়েছে। সেই টাকায় ছেলেকে পড়াচ্ছে। আমার ছেলেও কতদূর চলে গেল চাকরি নিয়ে। আসবে বছরে এক আধবার—তার এখানে থাকাটাও কি স্মৃতি হয়ে গেল না?
এবার স্বাভাবিক ভাবেই অপূর্ব প্রশ্ন করল, সোনালির বাড়ি কি মাঝে মধ্যেই যান?
প্রতি হপ্তায় যেতে পারি, তাও নয়। ঐ—যাই। হ্যাঁগো, আমড়া দিয়েছ?
হ্যাঁ।
বেশি করে দিয়েছ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ। আজই তো গাছ ফাঁকা করে সব পেড়ে নিলে। সবই প্রায় দিয়ে দিয়েছি।
আমড়া কি হবে?
কিছু বাড়ি নিয়ে যাবে, বাকি সোনালিকে দেবে।
সেকি! আপনারা কী খাবেন তবে?
দূর দূর! ওসব আমার ভাল লাগে না। চারখানা গাছ আমাদের একটায় এখনও হাত দিইনি। ও নিয়ে যাও, ভাগ করে নিও।
বৌদিও কি পাকা আমড়া খান না?
অসীমপদর স্ত্রী হেসে ফেলে। অপূর্ব একটু হলেও অপ্রস্তুতে পড়ে। প্রশ্নটা বাচ্চাদের মত হয়ে গেল।
অসীমপদর স্ত্রী বললে, পাকা আমড়া ভালবাসে না, এমনি মেয়েমানুষ কম আছে গ্রামে। খেতে বেশ লাগে—টক টক মিষ্টি মিষ্টি—বলতেই আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে।
অসীমপদ বসে বসে গুবগুবিয়ে হাসতে লাগল। তার থলথলে ভূঁড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললে, তুমি যে পাকা আমড়া খাও, তাতে কীসের গন্ধ মেলে?
কীসের আবার—বলে হা হা করে হাসলে অসীমপদর স্ত্রী। বললে, ধুলোর গন্ধ। ধুলো ছাড়া আর কি মিলবে এখানে? আমাদের এখানে ধুলো কেমন দেখলে ঠাকুরপো?
স্মিত হেসে অপূর্ব চুপ করে রইল।
অসীমপদর স্ত্রী বলে যেতে থাকল, তোমরা শহুরে মানুষ, সেখানে ধুলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশি। গ্রামদেশে এমন ধুলো কিন্তু দেখা যায় না। একটা গাড়ি গেল কি না গেল, অমনি ঘর সব ধুলোয় ধুলাক্কার হয়ে যাবে। মাঠের ধারে বাড়ি হওয়ায় সুবিধে অসুবিধে দুই-ই আছে। কিন্তু এই ধুলোর উৎপাত যেন সব হিসেবের বাইরে। ধুলো ঝেড়ে ঝেড়ে আর পারি নে! অন্য সব দিকে ঢালাই রাস্তা হয়ে গেল, এদিকে এত খেয়োখেয়ি যে, এত বড় রাস্তাটাই হল না। সোনালিদের গ্রাম যেতে এই রাস্তাটাই ভরসা। ওদিকে কতগুলি গ্রাম বলত! তারপর এদিকে পাকা রাস্তা। ওদের নিত্যদিন এদিকে আসতে হয়। তোমার দাদা পার্টিতে থাকলে হয়ত হয়ে যেত; কিন্তু ওকে আমিই আর যেতে দিইনে। ছেলেটা বাড়িতে নেই আর ও সর্বক্ষণ পার্টি করে বেড়াবে, ও চলবে নে। আমি কি করে থাকব? এদ্দিন ছেলেটা ছিল, সময় কেটে যেত। আর ও বাবু তো সর্বক্ষণ এদিকে ওদিক টংটং করে ঘুরে যেত—সেও বন্ধ করেছি। কেবল দরকারে অদরকারে সোনালির বাড়ি যায়—ওর গাছে নাকি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি নামে—সে সব গল্প শুনে আসে। এসে আমাকে বলে।
বলে অসীমপদর স্ত্রী আবারও হাসল। বলল, তাছাড়া এদ্দিন তো পার্টির জন্য করল, কী হল? যারা গুছাবার তারা ঠিক নিজেদের আখের গুছিয়ে নিল। ওর চেয়ে জমিজমা দেখলে পেটের ভাত ঠিক ঠিক জোগাড় হবে।
আমি এবার উঠব অসীমদা।
অসীমপদ বললে, আজ থেকে যাও, অসুবিধে কী? দোতলা করেছি—অনেকগুলি ঘর, বাস করি আমরা দুটিতে। সব তো ফাঁকাই পড়ে থাকে।
অসীমপদর স্ত্রী জোর করে হাতে একটা নাইলনের বড় ব্যাগ গুঁজে দিল। বেশ ভারি। উঁকি দিয়ে অপূর্ব দেখে, জমির ফসল। কচি দুই তিনখানা লাউ, মেটুলিওলা পুঁই, সিম—এই সব। আর আমড়া তো আছেই।
সে বলল, এত?
কিছু নয়, নিয়ে যাও। সোনালির বাড়িতে হাফ নামিয়ে দিও, তোমার বোঝা হালকা হয়ে যাবে।
******
অসীমপদর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলিপথ হয়ে মাটির রাস্তা বেয়ে মেঠো পথে এল অপূর্ব। ধুলোরা এখন আর উড়ন্ত নয়। বরং শান্ত হয়ে উঠেছে তাদের উচ্চকিত স্বর। বাতাস নেই; বরং তারা অপেক্ষা করে আছে চন্দ্রালোকের জন্য। এবার তাদের নতুন খেলা শুরু হবে। সূর্যস্মৃতি খেলা।
শান্ত ধুলো ভেদ করে যে সব গাছেরা উঠে গেছে সোজা আকাশের দিকে; তাদের পাতারা আসন পেতে দিয়েছে ধুলোদের জন্য। ধুলোরা সেই পাতায় বসতে পারল তো পারল; নইলে তারা চলে গেল দূরের আশ্রয়ে।
সেই পথ ধরে সে হেঁটে গেল অনেকটা।
কোথায় আকাশ কোথায় বাতাস! চরাচর জুড়ে কেবল ধুলো উড়ে আসে। কোন সে সুদূর মধ্যপ্রাচ্য—সে যদি এত ধুলো পাঠায়, সে দেশের তবে থাকে কি? যেন ঐ এক ফালি চাঁদের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করে মধ্যপ্রাচ্যের সেই ধুলো। ধুলো আসে, ধুলো যায়; একের পর এক মানুষ ধুলো হয়ে যায়। তখন ধুলো হয়ে ওঠে স্মৃতি।
অনন্ত আকাশ তলে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ল অপূর্ব। বেলা শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। আকাশের চোখ ঘোলা হয়ে এসেছে। ক্লান্ত পাখিরা ফিরে চলেছে ঘরে। আর তার সঙ্গে সে দেখল এক অদ্ভুত, অপূর্ব দৃশ্য!
আলোরা ঘরে ফিরে চলেছে। তার পিছনে চলেছে মেঘ—গুচ্ছ মেঘ, একলা মেঘ। আকাশের কোথায় আলো আর মেঘেরা বাস করে, কেই বা তা জানে! কে জানে, হয়ত এমনি করেই জীবন ফিরে চলে, আলো হারিয়ে যায়। তখন জীবন হয়ে ওঠে ধূলিধূসর।
এই মাঠ মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়, ধুলোয়, শীতে, স্মৃতিতে। যদি এই হারিয়ে যাওয়া মাঠ—এই তেপান্তর সে পেরিয়ে যেতে পারে; সে গিয়ে পড়বে এমন একটি বাড়িতে যেখানে আছে অনেকটা উঠোন, একধারে পরপর কয়েকটি কাঁঠালিকলার গাছ, উঠোনমাঝে আমগাছ। সেই গাছে গভীর রাতে এসে বসে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি। তখন চাঁদ ওঠে অনেকটা করে। নারীর মুখের মত চাঁদ। সেই চাঁদ খবর নেয় ধুলোদের কাছে, গাছেদের কাছে।
কী খবর? কার খবর? কার আবার এক রাজপুত্রের। মাটির দুয়োরানির যাবতীয় গোপন কথা ও দুঃখ কথা ওই আমগাছের সঙ্গে। তার ঘরবাড়ি, জীবন-যৌবন, অতীত সব হয়ে ওঠে ধূলিধূসর।
মেঠো রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে অপূর্ব দেখল, আকাশ আর দেখা যাচ্ছে না, চাঁদ স্থির, বাতাস স্তব্ধ। দূরে কোথাও শিয়াল ডেকে উঠল।
সে ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আর করে আনল টুসটুসে একখানা পাকা আমড়া। মুখের সামনে তুলে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। নুন ছাড়া পাকা আমড়ার স্বাদ কেমন? পরখ করে দেখবে নাকি একবার?
তখন কেউ যেন কানের কাছে মুখ এনে বলল, কর না কর, দেখবে দাঁত কেমন টকে যায়।
সকালের সাইকেলের চাকার দাগ কি ধুলো ধরে রাখে সন্ধে অবধি? জানা নেই। আহা, মধ্য প্রাচ্যের ধুলোরা যদি কথা বলতে পারত!
ব্যাগ ধুলোর ধারে রেখে, ধুলোর উপর উবু হয়ে বসে পড়ল অপূর্ব। সাইকেলের চাকার দাগ খুঁজে পেতে তা সে তুলে নিল আমড়ার গায়ে। সন্ধের মেদুর আলোয় আমড়া হয়ে উঠল ধূলিধূসর। হ্যাঁ, এবার এটাকে খাওয়া যেতে পারে। তারপর ঘরে ফিরে যাবে সে।
আর এই ব্যাগ? তার কী হবে? সোনালির বাড়ি পৌছে দেবার কথা ছিল যে?
অপূর্ব পৌঁছবে না। একটু পরেই রাত নামবে। এই তেপান্তরের উপর দিয়ে উড়ে আসবে দুই পাখি। তারাই বয়ে নিয়ে যাবে সেই ব্যাগ। গিয়ে বসবে একটি আমগাছের ডালে। সোনালির হাতে ধুলোমাখা সেই আমড়াখানা দিয়ে বলবে, খুব যে তার কথা বল রোজ রোজ। এবার নাও, ঠ্যালা সামলাও; ধুলো মাখা আমড়া খাও।
সে অবাক হয়ে বলবে, এত কাছে এসে ফিরে গেল? একটা তেপান্তরের মাঠ আর পেরুতে পারল না! সেই ভীতুই রয়ে গেল!
সোনালি সে আমড়া খেল না বুকে জড়িয়ে রাখল, তা জানতে আর কোনদিন এখানে আসবে না অপূর্ব।