শার্ট আর তার সঙ্গে মানানসই টাই পছন্দ করতে আজকে অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই সময় লাগলো অনিরুদ্ধ মিত্রের। শেষমেশ হেরিংবন সাদা ট্যুইডের সঙ্গে পরলেন চওড়া ঘননীল টাই আর সিংগল প্লিটের কালো ট্রাউজার। আর চকচকে কালো জুতো। লিফটে নামতে নামতে ভেবে নিলেন যে কলেজে যাবার জন্যে রাস্তাটুকু আজ একটু দ্রুত হাঁটবেন। পোশাক পরতে যে দেরিটুকু হলো, সেটা মেকআপ করতে হবে তো!
আজকের দিনটা অ্যান্ডি—মানে অনিরুদ্ধ মিত্রের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আজ টেক্সাস টেকনোলজি আসছে ওঁর কলেজে।
এই আমেরিকান কোম্পানিটি এই প্রথম যাদবপুর ইউনিভারসিটিতে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টে এলো। নতুন কোম্পানি, কিন্তু আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে এঁরা একেবারে যাকে বলে “কাটিং এজ” কাজ করছেন। ওঁদের সাম্প্রতিকতম রিসার্চ হলো সামাজিক জীবনে মানুষের আচরণকে সংখ্যায় পরিবর্তিত করে সেগুলোকে একটা ডাটা ক্লাউডে রাখা। একে বলা হয় বিগ ডাটা মাইনিং। এর পরের ধাপ হলো এই ডাটার ওপর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং প্যাটার্ন রেকগনিশন টেকনিক ব্যবহার করে আজকের সমাজের একটা সাঙ্কেতিক প্রতিবিম্ব বা ডিজিটাল টুইন তৈরি করা। এবং সর্বশেষে এই ডিজিটাল টুইন মডেলটির ওপর আবার আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং গেম থিয়োরি ব্যবহার করে কতগুলো ‘সোশ্যাল হ্যান্ডেল’ তৈরি করা। এই হ্যান্ডেলগুলো আর কিছুই নয়, মানুষের মনে বা চিন্তায় সামান্য কিছু পরিবর্তন করার রাস্তা, যাতে আজকের সমাজ পাল্টে গিয়ে সুস্থ সুন্দর একটা সমাজ গড়ে ওঠে। যে সমাজ শুধু সাফল্যের পিছনে ইঁদুর-দৌড় করে বেড়াবে না। যে সমাজে মানুষ সত্যিই স্বাধীন হবে, সবাই সমান সুযোগ পাবে, স্বীকৃতি পাবে। এই বৈপ্লবিক সফটওয়ার মডেল (যার নাম “ট্রান্সফরমেটার”) নিয়ে বিজ্ঞানমহলে তোলপাড় চলছে এখন।
এই দরের একটি কোম্পানিকে যাদবপুরের ক্যাম্পাসে আনতে পারাটা অ্যান্ডির একটা বিরাট সাফল্য। এবং সাফল্যের সঙ্গেই আছে এই পুরো প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার বাড়তি দায়িত্ব।
দ্রুত হেঁটে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় অ্যান্ডি নিজের অফিসে ঢুকে পড়লেন। টেক্সাস টেকনোলজির রিক্র্যুটমেন্ট টিমের আসতে এখনো আধঘণ্টা দেরী আছে, সেই ফাঁকে তিনজন শর্টলিস্টেড ক্যান্ডিডেটের প্রোফাইল, রিসার্চ অ্যাবস্ত্র্যাক্ট, রিভিউ সামারিতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন অ্যান্ডি। ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরায় তোলা ভিডিওগুলোও চালিয়ে দেখে নিলেন। অল ওকে—অ্যাজ এক্সপেকটেড। প্লেসমেন্ট অফিসার অনিরুদ্ধ মিত্রের প্রস্তুতি নিখুঁতই হয়। সবসময়।
সাড়ে নটার কম-বেশি এক মিনিটের তফাতে ওঁরা তিনজনই এসে পড়লেন। ক্লিনশেভেন ধারালো মুখ আর আলো ঠিকরোনো সাদা শার্ট পরা ডঃ রাতুল মুখার্জি; ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি, শেভ করা মাথা আর ঝকমকে টি-শার্টে মিঃ স্টার্ক চৌধুরী; এবং স্লিট-স্কার্ট এবং স্লিভলেস টপ পরিহিতা গ্ল্যামার-উজ্জ্বল মিস ঐন্দ্রিলা দাশগুপ্ত। থুড়ি “মিজ”—অর্থাৎ বিবাহিতা না অবিবাহিতা, সেটা স্পষ্ট নয়। এঁদের মধ্যে রাতুলবাবু এবং স্টার্কবাবু কাজ করেন টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্টে, আর ঐন্দ্রিলাদেবী আছেন হিউম্যান রিসোর্সে। না না—বাবু বা দেবী নয়—রাতুল, টনি এবং ডেলা। রুলস-অফ-দ্য-গেম হিসেবে প্রথমেই সেটা জানিয়ে দিলেন ঐন্দ্রিলা—অর্থাৎ ডেলা।
রাতুল এবং টনি সরাসরি ইভ্যালুয়েশন শেয়ার শুরু করলেন।
এখন ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ আর আগেকার মতন নেই। ক্যান্ডিডেটকে ডাকার আগেই অনেক কাজ এগিয়ে থাকে। প্রার্থীর পি-এইচ-ডি থিসিসটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যাচাই করা হয়। শুধু পি-এইচ-ডির কাজ নয়, তার সঙ্গে যেসব ছোট রিসার্চ বা প্রজেক্ট সে করেছে (অন্তত তিনটি হতেই হবে), সেগুলোও সব বাজিয়ে দেখা হয়। প্রথমে কুড়িটি প্রথম শ্রেণির আন্তর্জাতিক আর্কাইভগুলোর সঙ্গে প্ল্যাজিয়ারিজম চেক করে দেখে নেওয়া হয় কাজটা সত্যিই স্বকীয় নাকি “কারুর দ্বারা অনুপ্রাণিত।” এই গণ্ডি পার হলে কোম্পানির মেনফ্রেম ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমে কাজগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। বলা বাহুল্য এই পরীক্ষা করেন এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এবং এক বা একাধিক উচ্চ শ্রেণির আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইঞ্জিন। এতে পাস করলে তারপর ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরায় রেকর্ড করা থিসিসের ডিফেন্স এবং তার দৈনন্দিন গাইডদের সঙ্গে কথোপকথন পর্যবেক্ষণ—সেখানে প্রার্থীর প্রশ্নোত্তরের যুক্তি-তথ্য ছাড়াও তার কণ্ঠস্বর-মুখ-চোখের মনি এগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। বুঝে নেওয়া হয় সে কতটা কাজ সত্যিই বুঝে করেছে আর কতটাই বা বই পড়া মুখস্ত বিদ্যে। এরপরের কয়েকটা ডায়নামিক অনলাইন টেস্ট—অর্থাৎ পরীক্ষার্থী কি ধরনের উত্তর দিচ্ছে সেই অনুযায়ী পরের প্রশ্নের প্যাটার্ন এবং মাত্রা পরিবর্তন হয়, এমন পরীক্ষা। এই স-ব কটা গণ্ডি পেরোতে পারলে ক্যান্ডিডেটের সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্ট। সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্ট করা হয় একটি অতি জটিল অ্যালগরিদমকে দ্বারা—যাতে তার স্কুল-কলেজ জীবনের তুচ্ছ-গুরুতর সব ঘটনাকে ম্যাপ করা হয়—এমনকি সে কি ধরনের বই পড়ে, কি কি ছবি দেখে, তার সোশ্যাল মিডিয়ার কার্যকলাপ—সব।
যে তিনটি ছেলে-মেয়েকে শর্টলিস্ট করা হয়েছে, তারা এগুলো সবকটাই পাশ করে গেছে। এর পরের ধাপ হলো প্লেসমেন্ট অফিসারকে তাদের রেটিংগুলো দেখানো। ভারত সরকারের নিয়ম হলো এই অ্যাসেসমেন্ট স্বচ্ছভাবে কলেজকে জানাতে হবে, যাতে এই প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে পালিত হয়েছে সেটার প্রমাণ থাকে। এইটাকেই বলা হয় ইভ্যালুয়েশন শেয়ার।
সেই কাজটাই করছিলেন রাতুল এবং টনি। প্রথমে অ্যান্ডিকে তিনজন ক্যান্ডিডেটের টেকনিক্যাল রেটিং দেখানো হলো। সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্টের রেজাল্ট প্রেজেন্ট করলো ডেলা, যদিও সেটাকে অনুধাবন করা একটু শক্ত। এই একটি ব্যাপারে রেটিং অতো নিখুঁতভাবে আসে না, এটা অনেকটাই অনুভব বা জাজমেন্ট নির্ভর। তবুও, আলোচনা করা আবশ্যক। এগুলো নিয়ে অ্যান্ডির সঙ্গে আলোচনার পর সর্বসম্মতভাবে স্থির হলো যে প্রথমে আলফা এক এবং দুইকে ডাকা হবে। আলফা তিন থাকবে স্ট্যান্ড-বাই হিসেবে।
অ্যান্ডি সবে নিজের কানে টোকা মেরে বিল্ট-ইন ফোনটা চালু করতে চলেছে, এমন সময় ডেলা হাত তুললেন। তারপর বললেন “এঁদের ডাকার আগে আমরা ইউনিভার্সিটিটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। একটা ক্যুইকট্যুর যাকে বলে।”
“নিশ্চয়ই! থ্রি-ডি গ্লাস আছে না দেবো?” বললেন অ্যান্ডি।
“না, আমি পায়ে হেঁটেই দেখতে ভালোবাসি,” বললেন ডেলা।
আজকাল কেউ এভাবে পায়ে হেঁটে ঘোরে না (অ্যান্ডি বাদে; তিনি এখনো সাবেকি কায়দায় কলেজে হেঁটে আসেন)। সময় লাগে অনেকটা। তাছাড়া পায়ে হেঁটে ঘোরার চল নেই এমনিতেও। সকলেই থ্রি-ডি গ্লাস পরে নিয়ে ক্যাম্পাসের ক্যামেরা নেটওয়ার্ক এক্সেস করে নেয়। তাই এই প্রস্তাবে অ্যান্ডি একটু অবাকই হলেন শুনে।
“ইউ মিন—মানে পুরো ইউনিভার্সিটি পায়ে হেঁটে ঘুরবেন?” প্রশ্ন করলেন অ্যান্ডি। মনে মনে হিসেব করে নিলেন যে তাতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লেগে যাবে। তাছাড়া বাড়তি ফ্যাচাং হলো এইরকম আকর্ষণীয়া সুন্দরীকে পাশে নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটা। আজকাল অবশ্য রাস্তায়-ঘাটে বিশেষ কেউ থাকে না, তবু যে কজন থাকবে, তারা অপাঙ্গে, ঘাড় ঘুরিয়ে, সরাসরি—অনেকরকম ভাবেই দেখবে। তারপর শুরু হবে টিটকিরির স্রোত—প্রথমে চোরা, তারপর একটু বেশি—শেষে একদম ক্যাওড়ামির বানভাসি।
“ডেলা—আমার সকালের ৪৫ মিনিটের ওয়ার্কআউট হয়ে গেছে। এই বাড়তি এক্সারসাইজটা কি খুব জরুরী?” ফাজিল গলায় প্রশ্ন করলেন টনি।
“অত্যন্ত জরুরি। আমাদের ট্রান্সফরমেটার সল্যুশনটা যারা তৈরি করবে, আমরা তাদের চিন্তায় বৈজ্ঞানিক বিশুদ্ধতা আশা করি। সেটা বুঝতে গেলে তারা কি পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে, সেটা জানা দরকার। কারণ প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, তার বেড়ে ওঠার দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তার কনফার্মেশন বায়াসগুলো। সেগুলো আমাদের জানা দরকার। টেকনিক্যাল মানুষ হলেও তোমার এটুকু অন্তত বোঝা উচিত!” বিরক্ত কন্ঠে বললেন ডেলা।
“অ। তা তার জন্যে মাঠে ঘাটে ঘুরতে হবে আমাদের?” বিদ্রুপের স্বরে জিগ্যেস করলেন টনি।
“দরকার হলে ঘুরতে হবে। তোমার কি বিশ্বাস ক্লাউডে ডাটা আর থিসিস অ্যানাল্যসিস করেই মানুষ চেনা যায়?”
“ডেলা—আমরা, যারা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং বিগ ডাটা নিয়ে কাজ করছি, আমাদের কাছে সেটাই সত্যি নয় কি?”
“সত্যি নয়, সেটা তুমিও জানো টনি। সত্যি হলে এই ইন্টারভিউ বস্তুটির আর প্রয়োজন থাকতো না।”
হাত তুললেন রাতুল। “একটা মাঝামাঝি সলিউশন ভাবা যাক। পুরো ক্যাম্পাস ঘোরার দরকার নেই। ওঁদের ডিপার্টমেন্টটা দেখে আসি। সেই সঙ্গে ওই তিনজনের গাইডদের সঙ্গেও দেখা করে নেবো নাহয়। বিশেষত ডঃ ঘোষাল তো আমাদের কোম্পানির জন্যে নিয়মিত কনসালটেন্সি করেন—ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারলে আমার অন্তত খুবই ভালো লাগবে। কি ডেলা, চলবে?”
“চলবে।” বলল ডেলা।
“ফাইন উইথ মি অ্যাজ ওয়েল” বললেন টনি, যদিও তাকে জিগ্যেস করা হয় নি। তার দিকে একটা বিরক্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল ডেলা।
ইউনিভার্সিটি অফিস থেকে বেরিয়ে একটু এগোলেই সামনে বিশাল মাঠ। তবে সেটা প্রায় ফাঁকা—অল্প কিছু ছেলেমেয়ে তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই এখন ইউনিভার্সিটি কমন রুমে। বিরাট হলটাতে আধুনিক আর্টিফিসিয়াল এম্বিয়েন্স কন্ট্রোল টেকনোলজি আছে—অর্থাৎ তার ভিতরে থ্রি-ডি প্রজেকশন, স্ক্রিন প্রজেকশন দেওয়া থাকে। তাছাড়া ছাত্ররা নিজেদের থ্রি-গ্লাসটা ওয়ারলেস নেটওয়ার্কে কানেক্ট করে নিতে পারে। অ্যান্ডি বাকিদের নিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন আজকের থিম হচ্ছে রেট্রো কলকাতা—সেই ১৯৯০র রাস্তাঘাট—সেযুগের বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি। নিজস্ব থ্রি-গ্লাস পরলে ভিউটা নিজের মতো করে নেওয়া যায়—অর্থাৎ জানলা দিয়ে দেখা হচ্ছে, না ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, নাকি দোতলা বাসে চেপে—যেমন পছন্দ। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা এখনকার।
ওঁরা চারজন কাউন্টারে এসে পৌঁছলেন। মেনুটা পেছনে ডিসপ্লেতে রয়েছে, সেটা অবশ্য রেট্রো নয়—সাধারণ মেনু। কেউ চাইলে এখান থেকে অনলাইন অন্য জায়গা থেকে অর্ডার দিতে পারে। ড্রোন ডেলিভারির সুবিধে আছে ক্যান্টিনে। ম্যানেজার লাল্টুবাবু হাসি হাসি মুখে ওঁদের দিকে এগিয়ে এলেন।
“কি খাবেন বলুন।”
“কফি চলবে?” জিগ্যেস করলেন অ্যান্ডি। রাতুল আর টনি নিলেন—৮০ শতাংশ ইথিওপিয়া আর আরাবিয়াকা সমান-সমান মিক্স, সঙ্গে ২০% চিকোরি। ডেলা কিছু নিলেন না, শুধু কাউন্টারে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে মেনুটা স্টাডি করতে থাকলেন। অ্যান্ডি চা-কফি খায় না—সে এদের সঙ্গে সাধারণ দুচার কথা বলতে থাকলো।
হঠাৎ ডেলা মেনুর একটা আইটেমের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিগ্যেস করলেন “ওই আ-চপটা কি জিনিস?”
লাল্টুবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন “ওটা, ম্যাডাম, আমাদের এখানকার বহু পুরনো আইটেম। ভেজিটেবল ক্রখে গোছের।”
“ডিপ ফ্রায়েড? এখনো এসব চলে?”
“হ্যাঁ, চলে কিছুটা। এটা সেই ১৯৯০ বা তার আগে থেকে আছে। এটার নাকি পুরো নাম ‘আন্ত্রিক চপ’। কেন তা জানা নেই।”
“এটা কি আজ ৯০’স এর রেট্রো লুক বলে রেখেছেন?” জিগ্যেস করলেন টনি।
“না স্যার। এটা রোজই থাকে।”
“স্ট্রেঞ্জ!” বললেন ডেলা।
সেখান থেকে ডিপার্টমেন্ট। এ-আই অ্যান্ড ডাটা-সায়েন্সের বিল্ডিঙের একেবারে ওপরতলায় ডক্টরেট স্টুডেন্টরা কাজ করে—যাবার জন্যে ম্যাগলেভ টেকনোলজির ক্যাপসুল লিফট আছে। যে তিনটি ক্যান্ডিডেটকে শর্টলিস্ট করা হয়েছে, তারাও ওখানেই আছে। তাদের সঙ্গে অবশ্য এঁরা এখন দেখা করলেন না—ইন্টারভিউয়ের সময় দেখা তো হবেই। অ্যান্ডি এঁদের নিয়ে গেলেন ডঃ ঘোষালের কাছে।
ডঃ ঘোষাল এ-আইয়ের জগতের একজন কিংবদন্তী-–প্রায় তিরিশটা পেটেন্ট আছে। এর সঙ্গেই ভারী আমুদে ও সহৃদয় মানুষ--রাশভারী মোটেই নন। রাতুল, টনি আর ডেলাকে দেখে বেশ খুশিই হলেন। এঁদের না-না-না কে একেবারে পাত্তা না দিয়ে ওঁর সংগ্রহে যে দেশ-বিদেশের সতেরোটা সিংগল টি-এস্টেটের টপক্লাস চা আছে, তার মধ্যে থেকে সবসেরা দার্জিলিং ফার্স্টফ্লাশ বেছে নিলেন। তারপর একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম শৌখিন কাজ করা চায়ের পটে সময় নিয়ে ধৈর্য ধরে চা বানালেন--আর তারপর তার স্বচ্ছ হাল্কা ব্রাউন রং আর মৃদু-আভাসি-গন্ধমাখা চায়ে চুমুক দিতে দিতে শুরু করলেন আড্ডা। ডঃ ঘোষালের গল্পের স্টক দেখা গেল অফুরন্ত--ইউনিভার্সিটির গল্প, নানান জায়গায় বেড়াতে যাবার গল্প--সেসব গল্পে রাতুল তো একেবারে মজে গেলেন। এর ফাঁকে কিছু টেকনিক্যাল কথাও উঠলো--ডঃ ঘোষাল সেগুলোর ব্যাপারে ওঁর মতামত এবং পরামর্শ দিলেন অতি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায়। কিছুক্ষণ বাদে টনি আর ডেলা উসখুস করছেন দেখে অ্যান্ডি বলল “রাতুল, আপনি গল্প করুন। আমি এঁদের ডিপার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনি।"
ইতিমধ্যে এসে পড়েছেন ডঃ রায়—ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রোফেসার, ডঃ ঘোষালের সতীর্থ এবং দ্বিতীয় ক্যান্ডিডেটের গাইড। যত্ন করে ঘুরিয়ে দেখালেন ডিপার্টমেন্টটি এবং তার লাইব্রেরিটা। ইন্টারএকটিভ ক্যাটালগ করা অজস্র অডিও বই এবং ডিজিট্যাল বই। পড়বার কিয়স্ক আছে যারা এখানেই পড়তে চায়। একপাশে টেবিল চেয়ার, সোফা—বসে আলোচনা করার জন্যে। একপাশে বেশ কিছু কাগজের বই। ডেলা সেই দিকটাতে এগিয়ে গেলেন।
“কাগজের বই পড়ে ছাত্ররা?”
“অল্পই—কিন্তু পড়ে। বেশ কিছু ক্লাসিক বই আছে, সেগুলো ডিজিটাইজ করা হয় নি।” বললেন ডঃ রায়। “যেমন এই দেখুন না—শার্ঙ্গদেবের সঙ্গীত রত্নাকর বইটা কাগজের বই হিসেবেই আছে।”
“এসব বই আপনাদের লাইব্রেরিতে কেন?” জিগ্যেস করলেন ডেলা।
“আমরা কিছু নন-ডিপ বই রাখি। ছাত্রদের পূর্ণবিকাশের জন্যে। আমারই তো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যাপারে খুবই উৎসাহ। আর ডঃ ঘোষাল তো বাংলাভাষার উৎপত্তি, চর্যাপদ এসব নিয়ে একজন অথরিটি। দেখুন না—সুনীতি চট্টোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় এইসব বহু প্রাচীন লেখকদের বই রয়েছে। এগুলো সব উনিই পড়েন।”
“ইন্টারেস্টিং--”
অ্যান্ডির অফিসে ফেরার সময় রাতুল অ্যান্ডির দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনাদের ফ্যাকাল্টি সত্যিই খুব ভালো, অ্যান্ডি। ইম্প্রেসড।” ডেলা কিছু বললেন না—সারা রাস্তা সে চুপ—কিছু একটা নিয়ে সে চিন্তা করছে। টনির সঙ্গে কি একটা আলোচনা করলেন, তাতে টনি নিজের ই-ফাইলটা খুলে দুয়েকটা জিনিস একটু আপডেট করে নিলেন।
অ্যান্ডির অফিসে পৌঁছে ডেলা বললেন “শ্যাল উই স্টার্ট?”
অ্যান্ডি বলেই রেখেছিলেন। আলফা ১—মানে প্রকাশ চৌধুরী বাইরেই বসে ছিলো। ডাকা হলো তাকে।
শুরু হলো ইন্টারভিউ।
আলফা ১-এর ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে লাঞ্চটাইম হয়ে গেল। লাঞ্চের পর আলফা ২—অর্থাৎ সুমনা লাহার ইন্টারভিউ হলো।
দুটি ক্যান্ডিডেটই অত্যন্ত ভালো। টনি—যে টেকনিক্যালি ভীষণ খুঁতখুঁতে, সে অব্দি সন্তুষ্ট। রাতুল এবং ডেলা কিছু বললেন না তবে মুখ দেখে মনে হলো সন্তুষ্ট।
“এবার আমি কফি নেব,” বললেন ডেলা। “আর একটা আলাদা ঘরে আমরা তিনজন একটু আলোচনা করতে চাই। আপত্তি নেই নিশ্চয়ই?”
“এই ঘরটাই ব্যবহার করুন। আমি কফি আর কুকিজ পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বললেন অ্যান্ডি।
ঘণ্টাদেড়েক বাদে অ্যান্ডির ডাক পড়লো।
“আপনার ক্যান্ডিডেটরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত ভালো, অ্যান্ডি। আমরা এতোটা আশা করি নি।” বললেন ডেলা।
অ্যান্ডি একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।
“কিন্তু একটা ব্যাপারে এসে একটু আটকে যাচ্ছি অ্যান্ডি--” বললেন ডেলা।
“বলুন কি ব্যাপার। আমি চেষ্টা করবো ক্ল্যারিফাই করে দিতে।”
“একটা কথা বলুন অ্যান্ডি—আপনারা একাডেমিক্সে হিউম্যানয়েড—অর্থাৎ হিউম্যান-লাইক রোবট ব্যবহার করেন না?” জিগ্যেস করলেন ডেলা।
“করি—তবে সাপোর্ট ফাংশনে। লাইব্রেরিয়ান ইত্যাদি।”
“টিচিংএ কেন করেন না?” এবার প্রশ্নটা এলো টনির দিক থেকে।
“আমরা মনে করি যে এই বয়েসে ক্রিয়েটিভিটি থাকাটা বেশি জরুরি। সে ব্যাপারে মানুষ রোবটের থেকে বেশি ভালো শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে।”
“এটা কি আপনাদের পলিসি? কারণ ওয়েবসাইটে তো কিছু লেখা নেই?” ডেলা প্রশ্ন করলেন।
“না, ঠিক সেইভাবে পলিসি নয়। নিতে কোন আপত্তি নেই। ফান্ডও আছে। কিন্তু আমরা মনে করি রোবটের চিন্তাভাবনার একটা লিমিট আছে। তাই তার দ্বারা শিক্ষাদান করলে ছাত্রদের চিন্তায় একটা সীমাবদ্ধতা আসবে।”
“তাই কি, অ্যান্ডি? ডাটা-এনালিটিক্স বা গেম থিয়োরি, দুটোই তো দাঁড়িয়ে আছে প্রখর যুক্তিবাদের ওপর! আর এই নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিবাদ ঠিকমতো শেখানোর ব্যাপারে অ্যান্ড্রোফর্ম ব্রেন সেলস—অর্থাৎ হিউম্যানয়েডের থেকে ভালো শিক্ষক কেই বা হতে পারে?” বললেন টনি।
পাশ থেকে রাতুল বলে উঠলেন, “ভুল বুঝবেন না অ্যান্ডি। আপনাদের ফ্যাকাল্টির কোয়ালিটি নিয়ে আমার কিছু বলবার নেই। আরে ডঃ ঘোষালকে নিয়ে কারোরই কিছু বলবার থাকতে পারে না। কিন্তু ইন্ডিভিজ্যুয়াল ব্রিলিয়ান্স আর সিস্টেমের তফাৎ আছে অ্যান্ডি।”
“এটা খুব যুক্তিপূর্ণ কথা হলো কি, রাতুল?” অ্যান্ডি বললেন।
“অযৌক্তিকও নয় কিন্তু, অ্যান্ডি। ভেবে দেখুন। মানুষ যতই ব্রিলিয়ান্ট হোক না কেন, তার বয়েস বাড়বে, ব্রেনসেল ডিজেনারেট করবে। টেমপেরামেন্ট পালটাবে, পড়াবার কনসিসটেন্সি একরকম থাকবে না। এমনকি কোন বায়াস, কোন বিশেষ ছাত্র বা ছাত্রীর প্রতি পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা থাকে। এই সমস্যাগুলো হিউম্যানয়েড প্রফেসরের ক্ষেত্রে একেবারেই নেই।” বলে উঠলেন ডেলা।
“তাছাড়া রেকর্ডিংয়ে দেখলাম মাঝে মাঝে আপনার ক্যান্ডিডেটরা তাদের গাইডদের সঙ্গে ওঁদের ইন্টারেস্ট এরিয়া – মানে ওই ডঃ ঘোষালের বাংলা ভাষার রিসার্চ আর ডঃ রায়ের সঙ্গীত নিয়েও আলোচনা করেছে। এমনকি সিনেমা বা গল্পের বই নিয়েও গল্প করেছে। হিউম্যানয়েড প্রফেসর হলে এই ধরনের ডিসট্র্যাকশন হতোই না!” বললো টনি।
অ্যান্ডি মাথা নাড়লেন “এটা কিন্তু..." তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে ডেলা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন--
“আপনি যে কারণটা বললেন হিউম্যানয়েড না ইউজ করার—সেটাই কি একমাত্র কারণ?”
“তাছাড়া আর কি কারণ হতে পারে?”
“আপনাদের ইউনিভার্সিটির কি একটা স্পষ্ট অতীতমুখী প্রবণতা নেই বলতে চান? ওই লাইব্রেরিতে কাগজের বই, প্রোফেসরদের প্রাচীনতার প্রতি মোহ এগুলো কি তার নিদর্শন নয়? কমনরুমে রেট্রো-এফেক্ট অপশন রাখার মানে কি? আর ওই ‘শতাব্দী প্রাচীন আন্ত্রিক-চপ’? হোয়াট ননসেন্স!” বললেন ডেলা।
“আমার কিন্তু মনে হয় এটাই প্রধান কারণ, অ্যান্ডি” রাতুলের অতিভদ্র আওয়াজ ভেসে এলো। “আপনি ভেবে দেখুন না—ডঃ ঘোষালের ওই টি-ব্যাগ না ব্যবহার করে টি-পট, ওই চর্যাপদ নিয়ে পড়ে থাকা, ডঃ রায়ের ক্লাসিক্যাল গান—এগুলোর একটা ইম্প্যাক্ট আছে ছাত্রদের মানসিক বিকাশের ওপর।
অ্যান্ডি শান্ত কণ্ঠে বললো “ইউ-এন গাইডলাইন অনুযায়ী তো শুধু স্টুডেন্টের যোগ্যতাই দেখা উচিত, তাই না?”
“তাই তো দেখছি, অ্যান্ডি। যোগ্যতা মানে সে আমাদের কোম্পানিতে ফিট করবে কিনা। মানিয়ে নিতে পারবে কিনা। ভেবে দেখুন—আমাদের কোম্পানিতে তো ওদের কলিগ হবে হিউম্যানয়েড, ট্রেনার হয়তো হবে হিউম্যানয়েড—সেগুলো কি ওরা মেনে নিতে পারবে এতো সহজে?” রাতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“রাতুল, হিউম্যানয়েড ওরা কলেজে দেখছে রোজ। ব্যাঙ্কে দেখে, ইলেক্ট্রিশিয়ান-প্লাম্বার এরা বেশিরভাগই তাই। তবে অসুবিধেটা কোথায়?” আবার অ্যান্ডির চিরাচরিত শান্ত আওয়াজের উত্তর এলো।
“কিন্তু সেগুলো সামাজিক স্ট্যাটাস হিসেবে একধাপ নীচের কাজ। কাজেই ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে একটা বায়াস থাকবে যে হিউম্যানয়েডরা মানুষের সমান নয়। কাজেই ট্রেনার হিসেবে, কলিগ হিসেবে এরা কতটা মেনে নেবে হিউম্যানয়েডদের?” ডেলা প্রশ্ন করলো। “শুধু তাই নয়, ভেবে দেখুন—আপনার ক্যান্ডিডেটদের বাড়িতেও তো হিউম্যানয়েড নেই। যা বুঝলাম, এরা তো সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ে—হিউম্যানয়েড অ্যাফোর্ড করা সম্ভব হয় নি। অতএব সেদিক থেকেও একটা অ্যাকসেপ্টেন্সের অভাব থাকবেই।”
“ডেলা—এটা কি যুক্তিপূর্ণ? এতো ভালো ক্যান্ডিডেটরা এই কারণে আটকে যাবে?”
“কারণটা খুব জোরালো, অ্যান্ডি। যদি তাদের মধ্যে ইমোশনাল অ্যাকসেপ্টেন্স অফ ফিউচারিস্টিক টেকনলজি না থাকে—অর্থাৎ এই ধরনের অত্যাধুনিক টেকনোলজি, যা আমাদের সমাজকে পাল্টে দিতে চলেছে—তাকে মানসিকভাবে মেনে নেবার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে আমাদের কি লাভ বলুন?”
অ্যান্ডি স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন ডেলার দিকে। তারপর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শান্ত কণ্ঠে বললেন “তাহলে আপনারা কনভিন্সড নন যে মানুষ তার কনফরমেশন বায়াস ভেঙে বেরোতে পারে?”
“অ্যান্ডি, এটা তত্ত্বকথা। এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে কফির আড্ডায়—কাজ চলে না।”
“ডেলা—কিছু মনে করবেন না, সেক্ষেত্রে আপনারা ইন্টারভিউ নিতেও হিউম্যানয়েড পাঠালেই পারতেন। এতোটাই যখন তাদের ওপর ভরসা আপনাদের।” অ্যান্ডির কণ্ঠ এখনো শান্ত, যদিও বিদ্রুপের একটা হাল্কা ধার এসেছে তাতে।
“হয়তো হবে একদিন, অ্যান্ডি। হয়তো বেশিদূরে নেই সে দিন।”
বিকেল হয়ে এসেছে। ঘরের আলো জ্বালা হয় নি। যদিও হাতের সামান্য নাড়াতেই মোশান সেন্সার আলো জ্বেলে দেবে। কিন্তু অ্যান্ডির ইচ্ছে করছে না। অন্ধকারই ভালো।
চোখ বুজে চিন্তা করছিলেন অ্যান্ডি। মানবসভ্যতার কথা। যে সভ্যতা ইতিহাসের সিঁড়ি ভেঙে ধাপে ধাপে উঠে এসেছে আজ এইখানে। নিষাদ, ক্রীতদাস, শুদ্র, হরিজন—এসব ভেদাভেদ পেরিয়ে। ভাষা-পোশাক-লিঙ্গ-সামাজিক ভেদাভেদ পেরিয়ে। টেকনোলজি, যাকে আমরা বলি “দ্য গ্রেট লেভেলার”, তার হাত ধরে।
তার পরেও মানুষের চিন্তাধারাটা একেক সময় বুঝতেই পারেন না অ্যান্ডি। যা যুক্তিপূর্ণ, দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, তাকে মেনে নিতে এতো অসুবিধে? নিরপেক্ষভাবে যোগ্যকে স্বীকৃতি দিতে এতো দ্বিধা?
ঘরে আলো জ্বলে উঠলো দপ করে। কারণ মোশন সেন্সররা দেখে ফেলেছে যে ভাবতে ভাবতে সামনের টেবিলে আচমকা একটা সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিয়েছেন এন্ড্রোফরম-রিলিজ নাইন সিরিজের হিউম্যানয়েড রোবট অনিরুদ্ধ মিত্র।
(এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'দুধেল গাই')