• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | গল্প
    Share
  • দুধেল গাই : অতনু দে


    কদা স্বীয় ইস্পাত বেলন কারখানার গদিতে বসিয়া একটি প্রমাণ সাইজের লস্যির গেলাসে চুমুক দিয়া অকস্মাৎ আকাশবাবুর একটি দুধেল গাই কিনিবার সাধ হইলো।

    সামনেই বসে ছিলেন তাঁর ‘খাস আদমি’ — প্রোডাকশন ম্যানেজার ভক্তিবাবু — ভক্তিনারায়ন রাই। অনেকদিন ধরে আছেন — প্রায় বছর পনেরো হয়ে গেল। আকাশবাবুর থেকে বেশ কিছুটা বড় হলেও দুজনের মধ্যে বেশ একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে। এঁকে আকাশবাবু বেশ মন খুলে নিজের কথা বলতে পারেন। এক্ষেত্রেও আকাশবাবু তাঁর কাছেই এই নতুন প্রস্তাবটি রাখলেন।

    “কেন, লস্যিটা পছন্দ হল না? মানে খাঁটি দুধ হলে বেশি ভালো হবে...।” জিগ্যেস করলেন ভক্তিবাবু।

    “আহা — সে জন্যে বলছি নাকি? গরু রাখা যেকোন ব্যবসাদার পরিবারের কালচার, ভাই! গোমাতা ব্যবসার লক্ষ্মী, জানেন না?”

    ভক্তিবাবু মন দিয়ে খানিকক্ষণ গলা চুলকোলেন। সদ্য গদিতে বসা তরুণ মালিকটিকে উনি বিলক্ষণ চেনেন। কারখানা চালানোর ব্যাপারটা ভালোই জানলেও ব্যয়-সংকোচ ব্যাপারটি উনি এখনো শিখে উঠতে পারেন নি। সবে গদিতে বসেছেন কিনা।

    জায়গাটার নাম জঙ্গলগড়। কলকাতা থেকে বেরিয়ে বম্বেরোড ধরে পঁচিশ-তিরিশ মাইল গেলেই পড়ে। হাইওয়ের ধারের মফঃস্বলি জায়গাগুলো যেমন হয়, তেমনি — আলাদা কিছু নয়। গোটা তিনেক ছোট ছোট ইস্পাত কারখানা আছে — কোনটাতে করোগেটেড গ্যালভানাইজড শিট তৈরি হয় (যাকে চলতি ভাষায় ‘ঢেউপাত’ বলে), কোনটাতে টি-এম-টি বার বা সরিয়া তৈরি হয়, কোনটাতে বা পাইপ। মন্দ চলে না কারখানাগুলো। সাধরণমানের জিনিস — রাস্তাঘাট, টিনের চালার বাড়ি, বেড়া — এসব বানাতে কাজে লাগে।

    বম্বে রোডের ধারের দুনম্বর কারখানাটার নাম গোয়েঙ্কা স্টিল। শ্যামলাল গোয়েঙ্কার নামে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন শ্যামলালবাবু। তখন একটা ছোট্ট ইউনিট — তাতে শুধু পাইপ তৈরি হতো। পরে ধীরে ধীরে এর বাড়বৃদ্ধি হয়ে বেশ একটা মাঝারি মাপের ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে এখন। ঢেউপাত, পাইপ, গ্যাল্ভানাইজড পাইপ — সবই তৈরি হয় এখানে। সেই ইন্ডাস্ট্রিরই তরুণ মালিকটি হলেন আকাশ গোয়েঙ্কা - স্বর্গত পুনিত গোয়েঙ্কার কনিষ্ঠ পুত্র। দুবছর হলো এটার হাল ধরেছেন। তার আগে এটা চালাতেন ওঁর ছোটমা। সম্পর্কে আকাশবাবুর কাকিমা, কিন্তু সর্ব অর্থেই ওঁর মা।

    ছোটমা এই কারখানার হাল ধরেন — বলা উচিৎ ধরতে বাধ্য হন — কুড়ি বছর আগে। শ্যামলালবাবু মারা যাবার পর এই কারখানার মালিকানা পান শ্যামবাবুর মেজ ছেলে পুনিত। বড় ছেলে সুমিত অনেকদিন থেকেই শ্যামবাবুর লুধিয়ানার ব্যবসাটা দেখাশোনা করেন, তাই এ কারখানায় তাঁকে কোন অংশ দিয়ে যান নি শ্যামবাবু। পুনিতবাবুর দক্ষ হাতে ব্যবসাটা যখন বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, সেই সময় অকস্মাৎ একটি গাড়ির এক্সিডেন্টে তিনি, তাঁর স্ত্রী এবং দুই পুত্র মারা যান। বেঁচে যায় ছোট ছেলে আকাশ, যে তার কাকিমা — অর্থাৎ ছোটমার কাছেই ছিল। নিরুপায় হয়ে সেই ঘোর দুঃসময়ে ছোটমা ব্যবসার হাল ধরেন। ভাসুর সুমিতবাবু কিছুটা সাহায্য করেছিলেন — দূর থেকে যতটা করা সম্ভব আর কি। আকাশের ছোটকাকা বরাবর ধর্মকর্ম নিয়েই থাকতেন — তাকে দিয়ে ব্যবসার কাজ বিশেষ কিছু হতো না।

    সেই সময় থেকে কঠোর অধ্যবসায় এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরে ছোটমা আরতিদেবী এই ব্যবসা সামলেছেন। অত্যন্ত কড়া হাতে চালিয়েছেন ব্যবসা — অতি সাবধানে, পাই-পাই হিসেব করে। বিচক্ষণভাবে ব্যবসা বাড়িয়েছেন, কিন্তু বাজে খরচ একেবারেই করেন নি। এই দুবছর হলো উনি আকাশকে ব্যবসা সামলাতে দিয়েছেন, কিন্তু সতর্ক নজর রাখেন সবদিকে। ভুলভ্রান্তি হলে আকাশবাবুকে আজও ওঁর ভৎসনা শুনতে হয় মাথা নিচু করে।

    ভক্তিবাবু আরতিদেবীর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁকে বিলক্ষণ জানেন। তাই এও জানেন যে এই গরু কিনে পয়সা নষ্ট করাটা ছোটমা একদম ভালো চোখে দেখবেন না। ছোটমার দেবদ্বিজে ভক্তি আছে ঠিকই কিন্তু তার পেছনে একরাশ টাকা নষ্ট করাটা উনি পছন্দ করেন না। তাই একটু কিন্তু কিন্তু গলায় বললেন “ছোটমার সঙ্গে কথা বলে নিয়েছেন তো?”

    “আরে, মা রাজি হয়ে যাবেন। দুধেল গরু নেবো — তিন লিটার দুধ দেবে। মাকে বলে দেবো শুধু ওই দুধ দিয়েই আমার জন্যে দই পাততে। ব্যাস, মা আর না বলতে পারবেন না”। বলে একগাল হাসলেন আকাশবাবু।

    ভক্তিবাবুও হাসলেন। “তাহলে খোঁজ করি দুধেল গরুর?”

    “তুরন্ত”


    ***


    ভক্তিবাবু করিৎকর্মা লোক — গরুর সন্ধান পেতে বেশী সময় লাগলো না। জানা গেল একটু দুরেই একটা গো-হাট আছে — সেখানে নিয়মিত গরু কেনাবেচা হয়। সেখানে সবসেরা গরু বিক্রেতার নাম গোস্বামী — যার সব গরু হচ্ছে দেশী গরু, ভাগলপুর থেকে আসে। তার কাছে একটা — যাকে বলে ‘সবৎস দুগ্ধবতী গাভি’ আছে, সে নাকি সাড়ে তিন লিটার দুধ দেয়, এবেলা-ওবেলা। শুনেটুনে ভক্তিবাবু নিজেই চলে গেলেন একদিন — সঙ্গে নিয়ে গেলেন কারখানার এক সুপারভাইজারকে — নাম অনাদি। অনাদি গ্রামের ছেলে, তার বাপ গোয়ালা ছিলো — গরুর ব্যাপারস্যাপার সে ভালো বোঝে। সে গরুকে হাঁ করিয়ে তার জিভ-দাঁত সব খুব মন দিয়ে দেখলো, তারপর ল্যাজ তুলে দেখলো, গায়ে পিঠে হাতও বোলালো। তারপর ভক্তিবাবুকে আলাদা করে বলে গেল এ গরু অতি “সুলক্ষণযুক্ত”। ছাড়া উচিৎ হবে না।

    পরদিন সকালে গোস্বামী ভক্তিবাবু এবং আকাশবাবুর সামনে গরুটাকে দুইয়ে দেখিয়ে দিলো যে দুধ সাড়ে তিন লিটার বা তার চেয়ে বেশিই বই কম নয়।

    তারপর শুরু হলো দর। এ বলে কুড়ি, ও বলে বারো — অনেক টানাহ্যাচড়ার পর আঠেরোতে রফা হলো। গোস্বামী নিজে তার নিজস্ব টেম্পোতে করে পৌঁছে দিয়ে গেল ‘লক্ষ্মী’কে আর তার বাছুরটাকে। ছোটমা নিজের হাতে তাদের মাথায় ও শিংএ সিঁদুর মাখিয়ে ঘরে তুললেন। এর মধ্যে রাতারাতি তাদের জন্যে আলাদা করে গোয়ালঘর তৈরি করিয়ে নিয়েছেন ভক্তিবাবু। আকাশবাবুদের বাড়ির লাগোয়া জমিতে, কারখানার কাছেই।

    কিন্তু পরদিন সকালে লক্ষ্মী শুধুমাত্র একলিটার দুধ দিলো। বিকেলে সেটুকুও না।

    বোঝা গেলো পচা শঙ্খে পা কেটেছে। অনাদি গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল “ইনজেকশন দিয়েছিল বাবুজি। আমাদের ঠকিয়ে দিয়েছে”। আকাশবাবুর আর ভক্তিবাবুর মুখ চুন। আরতিদেবীর মুখ থমথমে।

    ঠিক হলো ওই গোস্বামীকে ধরতে হবে। ভক্তিবাবু আবার নেমে পড়লেন কাজে।

    ঠিক পাঁচদিনের মাথায় গোস্বামী ধরা পড়লো ভক্তিবাবুর হাতে। গো-হাটার পেছনের চায়ের দোকানে তৃপ্তি করে চা-টা খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই গোস্বামী দেখলো তাকে ঘিরে ধরেছে জনা দশেক লোক; তাদের হাতে লোহার রড।

    প্রবল তর্ক-গালাগালের পর রফা হলো যে গোস্বামী গরুটা ফেরত নিয়ে নেবে। এবং তিনদিনের মধ্যে সে আরেকটা দুধেল গরু এনে দেবে। সেটার দাম অবশ্য হাজার টাকা বেশী কিন্তু সেটা চাইতে আর গোস্বামীর সাহস হলো না। শুধু বললো “মেহেরবানি করে যদি লক্ষ্মীকে একটু আমার হাটে পৌঁছে দেন...”।


    ***


    পরদিন সকালে ব্যবস্থা করা আছে। ছোট টেম্পো পৌঁছে গেছে সময়মত। লক্ষ্মীর যাবার সময় হয়ে এলো।

    ভক্তিবাবু আর যান নি। এভাবে ঠকে যাবার পর থেকেই মেজাজ খুব খারাপ। ছোটমার সামনে ওঁর মাথা হেঁট হয়ে গেছে। ওই অনাদিকেও সেদিন খুব কড়কেছেন উনি।

    আকাশবাবুর সিকিউরিটি গার্ডের ফোন এলো। “ভক্তিবাবু, আপকো আনা পড়েগা। ইয়ে গাই তো যানে সে রহা”।

    তার মানে? ভক্তিবাবু তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে পৌঁছলেন গোয়ালঘরের সামনে। গিয়ে দেখলেন আকাশবাবুও নিচে নেমে এসেছেন। তারও মুখে হতবুদ্ধি।

    ভক্তিবাবু দেখলেন টেম্পোতে বাছুরটা তোলা হয়ে গেছে। কিন্তু লক্ষ্মীকে নড়ানো যাচ্ছে না। সে কিছুতেই যাবে না। রীতিমত হৃষ্টপুষ্ট প্রমাণ সাইজের গরু, তাকে টেনে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে নড়ানো সহজ নয়। তবু সাতআটজন মিলে টান লাগালে হয়তো টেম্পোতে তোলা যেত, কিন্তু কেউ তার গায়ে হাত দিতে চাইছে না। মায় অনাদিও নয়।

    কারণ লক্ষ্মীর চোখ দিয়ে একটানা টপটপ করে বড় বড় ফোঁটায় জল ঝরছে। একটা গরু যে এরকম অঝোরে কাঁদতে পারে, তা কারুর ধারনার বাইরে। ভক্তিবাবুও কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।

    “উসে রেহনে দে ছোটু”। ওপরের বারান্দা থেকে ছোটমার গলা ভেসে এলো।

    “লেকিন মা, গোস্বামী হামে ঠকা দিয়ে। ইয়ে তো দুধ দেতা নেহি হ্যায়...”

    “কোই বাত নেহি ছোটু। রেহনে দে”।

    আরতিদেবী আর কথা বাড়ালেন না। পেছন ফিরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলেন। রান্নাঘরে গিয়ে ছেলের খাবারের ব্যবস্থা করতে থাকলেন। রোজকার মতন।

    না, ঠিক রোজকার মতন নয়। আজ কাজ করতে করতে হঠাৎ দিদির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দিদি মানে নিজের দিদি নয় — ওঁর মেজ জা, আকাশের মা। আর মনে পড়ে যাচ্ছে আরেকটা দিনের কথা।

    সেদিনও সব তৈরি ছিল। গাড়ি দাঁড়িয়েছিল দরজায়। জিনিসপত্র সব গাড়িতে তোলা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাত-চড়ে-রা-না-কাড়া খুব শান্ত ভালোমানুষ মেজ-জা সেদিন হঠাৎ তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। সরাসরি তাঁদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিলেন। শান্ত কিন্তু ইস্পাতকঠোর কণ্ঠে। ওই একদিনই।

    বলেছিলেন “আরতি ইয়ে ঘর ছোড়কে নেহি জায়েগি মা-জি। আজ সে মেরা ছোটা বেটা আকাশ উসকা বেটা হ্যায়”।

    বাঁজা বউ বলে আরতিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় নি সেদিন।


    ***

    কুড়ি বছর কেটে গেছে তারপর। এখন ওই গোয়াল একটা বিশাল খামার। একশোর ওপর গরু থাকে সেখানে। আটজন লোক আছে তাদের দেখাশোনা করার জন্যে। সেই দুধ বাড়িতে আসে, কারখানার উঁচু পদের লোকেদের বাড়ি বাড়ি ঘটিতে করে দিয়ে আসা হয়। কারখানার ক্যান্টিনে ওই দুধের দই হয়, পনির হয়, কখনো-সখনো পায়েস বা ক্ষীরও হয়।

    বাজারে বিক্রি হয় না।

    ছোটমার বারণ।

    ***


    (এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'ইন্টারভিউয়ের পরে')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments