গত ১৫ এপ্রিল, ২০১৯ পারি শহরের নোত্র দাম গির্জার কেন্দ্রীয় চূড়াটি বিধ্বংসী আগুনে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতির পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব-নিকেশ সম্পূর্ণ না হলেও, ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল মাকরঁ পারি-র এই ঐতিহাসিক সৌধটির ক্ষতিগ্রস্ত অংশের পুনর্নিমাণের আশ্বাস দিয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি সাহিত্যের একটি যুগান্তকারী উপন্যাস ফরাসি জাতিকে নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের পুনরাবিষ্কারে অনুপ্রাণিত করেছিল। ওই উপন্যাসটি কি আরেকবার সেই অসাধ্যসাধন করতে পারে?
মনে এই প্রশ্ন নিয়ে বহু পাঠক ভিক্তর উগো-র প্রসিদ্ধ উপন্যাস নোত্র দাম দ্য পারি, যা ইংরেজি অনুবাদে দ্য হাঞ্চব্যাক অব নোত্র দাম নামে বহুল পরিচিত, পুনরায় পড়তে শুরু করেছেন। এই উপন্যাসটি ঊনবিংশ শতকে ফরাসি জনগণ, বিশেষ করে পারি-র অধিবাসীদের নজর গথিক শৈলীর এই গির্জার দিকে ফেরায় এবং ক্যাথিড্রালটিকে জাতীয় সংহতির প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলে। ওই উপন্যাসে নোত্র দাম একটি শীতল, প্রাণহীন প্রেক্ষাপট নয়। উপন্যাসের দু’টি অধ্যায় শুধু গির্জার বর্ণনায় ব্যয় করা হয়েছে। উগো মনে করেছিলেন যে সৌধটি যুগ যুগ ধরে যে-ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেগুলি শুধু আঘাতের কারণেই নয়, বরং সেই সব সংস্কারের প্রচেষ্টার পরিণামে, যার ফলে গির্জার ক্ষতিই হয়েছে অধিক, সংরক্ষণ কম। কারণ পাথরে তৈরি হলেও গির্জার শরীরে অসার প্লাস্টারের প্রলেপ লাগানোর অর্থ তাকে আরও আঘাত দেওয়া।
মজার ব্যাপার হল ২৭ বছর বয়সী, তখনও দাড়িহীন কবি ভিক্তর উগো যেদিন তাঁর উপন্যাস নোত্র দাম দ্য পারি-র পাণ্ডুলিপি প্রকাশক গোসল্যাঁ-র কাছে জমা দেন, সেদিনটিও ছিল ১৮২৯ সালের ১৫ এপ্রিল। বইটি শেষমেশ ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয়ে চূড়ান্ত সাফল্য পেয়ে ফরাসি সাহিত্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে নজির কাড়ে। সে সাফল্য এমনই, নোত্র দাম গির্জার সঙ্গে তা এতই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যে বঁজাম্যাঁ রুবো-র প্রখ্যাত ব্যঙ্গচিত্রে দৈত্যাকৃতি উগো-কে গির্জায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় আর কবির বন্ধু অগুস্ত ভাকেরি তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন যে ‘নোত্র দাম গির্জার টাওয়ারগুলো দেখতে উগো-র নামের H অক্ষরটির মতো।’
ভিক্তর উগো-র উপন্যাসের কাহিনী বহুশ্রুত: ১৪৮২-এর পারি শহরে কুঁজো এবং অতিশয় কুৎসিত কোয়াসিমোদো, নোত্র দাম গির্জার ঘণ্টাবাদক, জিপসি নর্তকী সুন্দরি এসমেরাল্ডার প্রেমে পড়েছে। এসমেরাল্ডার প্রণয়প্রার্থী আরও অনেকে, ক্যাপ্টেন ফিবাস দ্য শাতুপের এবং কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ঊর্ধ্বতন যাজক ক্লোদ ফ্রোলো। এসমেরাল্ডার প্রতি কোয়াসিমোদোর প্রেম প্রতিদানহীন। এসমেরাল্ডা যখন লম্পট যাজকের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে এবং ক্যাপ্টেন ফিবাস-এর প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলে, তখন ফ্রোলো ক্যাপ্টেনকে ছুরিকাঘাত করে। কিন্তু এসমেরাল্ডা এই অপরাধের জন্য দায়ী হয়। দুঃখে, হতাশায় সে আত্মহত্যা করে। কোয়াসিমোদো ফ্রোলোকে ক্যাথিড্রালের টাওয়ার থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। উপন্যাসের শেষে এসমেরাল্ডার সমাধিতে দুটি কঙ্কাল পাওয়া যায়। দেখা যায় একটি কুঁজো লোক এসমেরাল্ডাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভিক্তর উগো-র উত্তেজক, সাড়া-জাগানো উপন্যাস, যা ইংরেজি ঔপন্যাসিক ওয়াল্টার স্কট-এর আইভ্যানহো উপন্যাসের মত ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক আখ্যানের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, মধ্যযুগীয় পারিকে একদিকে যেমন জীবন্ত করে তোলে, তেমনই তার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে।
নোত্র দাম দ্য পারি উপন্যাসে গির্জাটি একটি কেন্দ্রীয় পটভূমি। ফ্রোলো এবং কোয়াসিমোদো সেখানে বাস করে, গরিব ভবঘুরেরা সেখানে ঢুকে পড়ে, এসমেরাল্ডা সেখানে আশ্রয় নেয়। কোয়াসিমোদো যখন ভবঘুরে মানুষদের উপর ফুটন্ত সিসে ঢেলে দেয়, তখন সেই প্রজ্বলিত শিখার মধ্যে আমরা যেন গির্জায় অগ্নিকাণ্ডের মর্মান্তিক পূর্বাভাস অবলোকন করি। ভিক্তর উগো-র বর্ণনায়: “সকলের দৃষ্টি গির্জার শিখরের দিকে নিবিষ্ট। তাঁরা দেখলেন এক অসাধারণ দৃশ্য। সবচেয়ে উপরের গ্যালারির চূড়ায়… সর্বগ্রাসী অগ্নিশিখা দু’টি টাওয়ারের মধ্যে দিয়ে উপরের দিকে ধাবমান, ফুলকির ঝাপটা আর বিশাল, বিশৃঙ্খল, আগ্রাসী আগুন যার শিখাটি হাওয়ায় ভেসে এসে জিভের মত ধোঁয়ার ওপরে কখনও বা আবির্ভূত হচ্ছে।”
বলা হয় গির্জাই হল ভিক্তর উগো-র উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। বস্তুত, রূপকের ব্যবহারের মাধ্যমে উগো বারবার গির্জাটিকে মনুষ্যরূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। গির্জার পাথরের তৈরি শরীরটি যেন রক্তমাংসের অবয়ব আর গির্জা কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা যেন মানুষের শরীরের ক্ষত। উগো লিখছেন, “বলতে দ্বিধা নেই পারি-র নোত্র দাম গির্জাটি এখনও একটি সৌম্যকান্তি, মহিমান্বিত সৌধ। কিন্তু বার্ধক্যে যদিও সংরক্ষণের মাধ্যমে একে সুন্দর রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কাল এবং মানুষ এই নমস্য সৌধের যে অসংখ্য মর্যাদাহানির জন্য দায়ী তাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা অথবা বিরক্ত হওয়া কঠিন নয়। ...আজ এই গথিক স্থাপত্যটিতে তিন ধরনের ধ্বংসক্রিয়া লক্ষ করা যায়। এর ত্বক কুঁচকে গেছে, তার উপরে আছে বড় বড় আঁচিল; এগুলি সময়ের দান। হিংসা এবং নৃশংস আক্রমণের ফলে পড়েছে কালশিটে, ভেঙেছে হাড়; লুথার থেকে মিরাবো, যতগুলো বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এগুলো তার দান। এছাড়াও আছে অঙ্গবিকৃতি, অঙ্গহানি, অস্থিসন্ধির স্থানচ্যুতি যা গ্রিক, রোমান, বর্বরদের ‘সংস্কারের’ পরিণাম…”
এমন নয় যে ভিক্তর উগো সংস্কারবিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে কখনও সখনও জীর্ণোদ্ধারের প্রচেষ্টায় লাভের থেকে ক্ষতিই হয় বেশি। তাঁর মতে সৌধকে বাঁচাতে হলে সেটির পুনর্নিমাণ করলেই চলবে না, তার গঠনের মূল নীতি, তার প্রাণসত্তা এবং আত্মার প্রতি হতে হবে শ্রদ্ধাশীল। নোত্র দাম-এর আত্মার নাম কোয়াসিমোদো, উগো বারবার এটা বলতে চেয়েছেন। গির্জার ঘণ্টাবাদকের মধ্যে রয়েছে গির্জার মতই একই সঙ্গে দৈত্যাকৃতি আর মহিমার মেলবন্ধন।
এই উপন্যাসে নামভূমিকায় অবতীর্ণ যে নায়িকা, তার প্রাণসত্তাটি কেমন? বহুকালের অবহেলা এবং বিকৃতি, সৌন্দর্যহানির অসংখ্য প্রচেষ্টাকে জয় করেও তিনি কেন সুন্দরী? পরবর্তী বহু পরিবর্তন, পরিমার্জনের পরেও তার অন্তরাত্মা কেন এত মহিমান্বিত? উগো-র অসাধারণ বর্ণনায় এর উত্তর হল: “অসাধারণ সৌধগুলো, খুব বড় পর্বতের মতই বহু শত বছরের তৈরি। শিল্পকর্ম যখন সাময়িক স্থগিত থাকে, তখন প্রায়শই তার রূপান্তর ঘটে… নতুন শিল্প তাকে যেখানে পায়, সেখান থেকে পুনরায় নির্মাণ শুরু করে, নিজের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেয়, তাকে নিজের মনের মত করে গড়ে, সম্ভব হলে তাকে সম্পূর্ণ করে। এই কাজটি হয় কোনও সমস্যা ছাড়াই, কোনও প্রচেষ্টা অথবা প্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকে, স্বাভাবিক, শান্ত নিয়মে। এই বিশাল নির্মাণে যে মানুষ, শিল্পী, ব্যক্তি অংশ নেন, তাঁদের নাম মুছে যায়, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে মানুষের সমুদয় বুদ্ধিবৃত্তি। এখানে কাল হল স্থপতি, রাষ্ট্র হল নির্মাতা।”
সুতরাং নোত্র দাম গির্জা একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল সত্তা যা তাকে ক্রমশই করে তোলে আরও শক্তিশালী অথচ আরও ভঙ্গুর, ক্ষণস্থায়ী। বাইরের পরিবর্তন যাই হোক না কেন, স্থাপত্যের প্রাথমিক গঠন, তার মূল নীতি কখনই বদলায় না। উগোর অনবদ্য বর্ণনায়: “এই সব বর্ণের সূক্ষ্ম মাত্রা, এই সব খুঁটিনাটি পার্থক্য, এগুলি সৌধের শুধু উপরিভাগের পরিবর্তন ঘটায় না। এখানে শিল্পই রূপ পরিবর্তন করে। খ্রিস্টীয় চার্চ-এর মূল নীতি কখনই আক্রান্ত হয় না। কারণ এর অভ্যন্তরে আছে সেই কাঠের কাজ, বিভিন্ন অংশের মধ্যে যুক্তিনিষ্ঠ পারস্পরিক পরিকল্পনা...গাছের গুঁড়িটি অনড়, তার শাখা-পল্লব যতই খামখেয়ালি হোক না কেন।”
উপন্যাসের ‘এতেই হবে তার মরণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে বেজেছে সাহিত্যের বিজয়ডঙ্কা। এই অধ্যায়ে উগো-র ভবিষ্যদ্বাণী হল যে কোনও সৌধ, তা যতই শক্তপোক্ত পাথরে তৈরি হোক না কেন, কাগজের বই হবে তার চেয়েও অধিক টেঁকসই। উগো জানতেন না যে গির্জা আগুনে পুড়বে, কিন্তু সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতেও পারেননি। তিনি বলেছিলেন যে বন্যা পর্বতকেও ভাসিয়ে দিতে পারে। অথচ আজকে আমরা জানি যে আগুন নোত্র দাম গির্জাকেও গ্রাস করতে পারে। কিন্তু গির্জা তো পাথরে তৈরি বই, আর বই হল কাগজে তৈরি গির্জা। ইতিহাস প্রমাণ করল যে গির্জা পুড়লেও পাঠকেরা ছুটছেন বইয়ের দোকানে, উগো-র উপন্যাসের সন্ধানে। এই সংকটের সময়েও তাই আমরা দেখি যে আগুন লাগলেও নোত্র দামের বহিরঙ্গের রূপ আর টাওয়ারগুলি অক্ষত আছে। উগো-র নামের H অক্ষরটিও এখনও খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। উগো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ‘বই সৌধকে হত্যা করবে’। কিন্তু তাঁর উপন্যাস নিয়ে পাঠকের কাড়াকাড়ি দেখতে দেখতে আমরা অনুভব করি যে আসলে বই মানুষের মনে সৌধের পুনর্নিমাণে সাহায্যই করেছে।