-- ফ্যানটা একটু ছেড়ে দেবে?
—পাখাটা গরু না ঘোড়া যে ছেড়ে দেব?
পাখা না ফ্যান, চালানো হবে—না, ছেড়ে দেওয়া হবে তার মধ্যে সূক্ষ ভাবে লুকিয়ে আছে বাঙাল ঘটির ফারাক। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
বাঙাল যেমন জীবনে বুঝবে না সে দরজা দেবে কেন? দরজা কি দেবার জিনিস? তেমনি ঘাসের আগার শিশিরবিন্দু সে যদি ডগায় দেখে তাহলেও তাকে একদম দোষ দেওয়া যায় না।
স্বাধীনতার পরপর এ বঙ্গের একটু ঘাবড়ে থাকা বাঙালরা প্রাণপণে জিভের শত্রুতা চাপা দিতে পারলেও ভাষার খাঁজখোঁজে এভাবেই আটকে গিয়ে ধরা পড়ে যেত। ষাটের দশকে আমার এক দিদি পড়তে গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। বলা বাহুল্য দেশ পরিচয় গোপন রেখে। সেখানে আবার চরম শুদ্ধ ভাষা। পরের বোনটি যখন হাজির হল সেখানে, তখনো তার গায়ে লেগে আছে দেশের মাটির গন্ধ। দিদির কঠিন নিষেধে সে মুখ খোলে না। কিন্তু বাঙাল মন তো শুধু চেয়ে চেয়ে দিন কাটাবার পাত্র নয়। সারাদিনের পর তার মনে হল সে এখন দিব্যি এখানকার ভাষা বলতে পারবে। শুধু একটু সাবধানে বাড়িতে যা বলে সেগুলো একটু বাদ দিতে হবে। ওই তো একদল মেয়ে খেজুরের বিচি দিয়ে বাঘবন্দী খেলছে। তারা বাড়িতে খেজুর শব্দটাই ব্যবহার করে অতএব ওটা নিশ্চয়ই বাঙাল কথা। একটি কথা সে বলল সারাদিন বাদে তাতেই দিদির গুপ্ত পরিচয় ফাঁস হয়ে গেল—আমরাও খাজুরের বিচি দিয়ে খেলি।
আরো অনেক পরে এদেশের নরম হাওয়ায় বাঙাল জিভ যখন অনেক মোলায়েম হয়ে এসেছে একেবারে খেসলুম গেসলুম পার্টি না হলে তফাত করা মুশকিল—যদি না কেউ পেপার পড়তে পড়তে ফ্যানের হাওয়া খায় আর আসো বঅসোর আহ্লাদ দেখাতে না যায়।
সেই সময় ঘটি না বাঙাল বোঝার জন্য একটা সহজ পথ ছিল—জিজ্ঞেস করা হত—কোয়েশ্চেনের বাংলা কি?
উত্তরে প্রsনো বললেই হয়ে গেল। মাল ক্যাচ। এসব পরীক্ষা বাঙালদেরই দিতে হত। উড়ে এসে জুড়ে বসলে এটুকু তো হবেই। ছোটবেলায় রাস্তায় বেরোলে পাড়ার ছেলেরা খ্যাপাত—বাঙাল চিংড়িমাছের কাঙ্গাল। আমরা মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। একবার সঙ্গে ঠাকুমা ছিলেন। সংসারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত তেজস্বিনী মহিলা। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে এই ঘোরতর অন্যায় সংলাপের প্রতিবাদ জানালেন। আমরা সঙ্কুচিত হয়ে হাত ধরে টানাটানি করতে তিনি সগর্জনে বললেন—কা হেতিরা কইব চিঙ্গড়ি মাছের কাঙ্গাল? বাঙালরা যত মাছ দেখছে খাইছে হেতিরা তত চোখে দেখছেনি?
এই যে নিঃসঙ্কোচে আত্মপরিচয় দিয়ে বাঙাল সংলাপ লিখে ফেললাম তার কারণ হচ্ছে বাংলা ভাষার যতই দুরবস্থা ঘটুক না কেন বাঙাল ভাষা কিন্তু সিনেমা থিয়েটার গান সিরিয়ালের কল্যাণে বেশ গ্ল্যামারাস হয়ে উঠেছে। বাঙাল পরিচয়েরও শাপমুক্তি ঘটেছে। বিশুদ্ধ ঘটি বিশুদ্ধ গব্য ঘৃতের থেকেও দুর্লভ। বাঙালদের চাপেই মনে হয় বিস্ময়কর ভাবে তাদের সংখ্যা কমে গিয়েছে। বাগবাজার শ্যাম বাজারে গোটা কয়েক ঘর বোধহয় কোনরকমে বাঙাল ছোঁয়া বাঁচিয়ে টিঁকে আছে।
বাঙাল পরিচয়ের জয়ধ্বজা তুলে সিংহ বিক্রমে এগিয়ে যাবার প্রথম কৃতিত্ব অবশ্যই অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাঙাল ভাষায় একটার পর একটা কমিক পেশ করে ঘটি বাঙাল দুদলকেই তিনি কাবু করে ফেলেছিলেন। বাঙালত্ব নিয়ে ঠাট্টা করা এক ঘটিকে তাঁর বিখ্যাত উক্তি—আমি তো বাঙাল আপনি কি?
—বাঙালি।
—তবেই দ্যাখেন, আমি বাঙাল, পুংলিঙ্গ। আপনি বাঙালি, স্ত্রীলিঙ্গ।
ভানুর দৌলতেই বাঙাল ভাষা ক্রমশ জনপ্রিয় হল। আগে শুধু কমিক চরিত্রের মুখেই শোনা যেত। এখন বিশুদ্ধ ঘটিদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে বিশুদ্ধ বাঙাল বুলি বলতে পারাটা বিশেষ কৃতিত্ব বলে গণ্য হচ্ছে।
তবে বিশুদ্ধ ঘটি ও বাঙাল দুইই হাতে গোনা। যে-কোন শব্দ বিশেষ করে তা যদি ইংরেজি হয় ঘুরিয়ে অন্যরকম করে দিতে খাঁটি বাঙালের বিশেষ সময় লাগে না। আমাদের বাড়িতে এক সুপ্রাচীন ঠাকুমা আসতেন আমাদের ছোটবেলায়। মা জেঠিমারা তখন মিটসেফকে মিসচেফ, কোলাপসিব্ল্ গেটকে কোলাপসুল গেট টম্যাটোকে টমেটু বলেন। সেই ঠাকুমা একান্নবর্তী বাড়ির তরকারি কোটার আসরে একটা টম্যাটো হাতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আপন মনেই বললেন—আগে কইত বাইগুন, তারপর কয় বিলাইতী বাইগুন। এখন কয় মন্টু।
কোন শব্দ কার কানে কি যে বাঁশরী শোনায় বোঝা মুশকিল।
বাঙাল বাড়িতে প্রথম টিভি আসার দিন—ছেলেপিলেরা ঢাকার অনুষ্ঠান দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলে পর মেকানিকটি ছাদের বাঁশে এ্যান্টেনা ফিট করতে করতে কি যেন অচেনা একটা ইংরেজি শব্দ বলল। বাড়িসুদ্ধ ছেলেপিলের দল সেটা শুনে বায়না ধরল “বুচিস্টার” চাই নয়ত ঢাকার অনুষ্ঠান দেখা যাবে না। বোঝা গেল মেকানিকের দেশও পদ্মাপারে। নয়ত এত অনায়াসে বুস্টারকে হজম করে নতুন শব্দ বানাতে পারত না।
সেই কবে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নিয়েছিল একঝাঁক তরুণ শিল্পী। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্বাধীনতার গান গাইতাম আমরা। অস্বীকার করতে বাধা নেই একটু বাঙাল টানে গানগুলো গাইতে পারলে গলার জোরের সঙ্গে মনের জোরটাও যেন আরো ভাল করে টের পেতাম। তারপর মুজিবর রহমানের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা—কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না—অতি বড় বাঙাল-বিদ্বেষীও স্বীকার করবে এর ভাষার জোর।
ভাষার জোর বুঝতে গেলে অবশ্য অত দূর না গেলেও চলে। কারওকে বধ করতে হলে গুলির দরকার নেই বাঙাল ভাষার গালিই যথেষ্ট। লাত্থির যা জোর তা লাথি কল্পনাও করতে পারবে না। থাব্ড়ার কাছে চড় নেহাৎই বাল্যখিল্য। বাবা যখন ছেলেকে “হালার পো হালা” বলে মধুর সম্ভাষণ করে তার মধ্যে সে নিজেরও গুষ্টির তুষ্টি সাধন করে ফেলে।
বহুদিন থেকেই মনে ইচ্ছে ছিল একবার বাংলাদেশ যাব। এবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে সুযোগ হল যাবার। তিন বাঙাল ও এক ঘটি মিলে নির্দিষ্ট দিনের দুদিন আগেই ঢাকা পৌঁছলাম। শহীদ দিবস নিয়ে আজ আর নতুন করে বলার কিছু নেই। আন্তর্জাতিক ভাষাদিবস হিসেবে সে স্বমহিমায় বিশ্বের দরবারে জায়গা করে নিয়েছে। বাঙাল ঘটি দু দলের কাছেই এই দিনটি গর্বের।
এটি আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়। বাংলাদেশের অপূর্ব খাওয়া, অতুলনীয় যানজট সেসব নিয়েও কিছু বলছি না। বহুদিন বাদে প্রাণভরে বাঙাল ভাষা শুনলাম কদিন আর নানা ভাষার বিভিন্ন শব্দকে নিজস্ব ঢংয়ে কাটছাঁট করে নেবার অপূর্ব ক্ষমতাটি বাঙালের একই আছে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম।
আমরা যেখানে উঠেছিলাম সেই অতিথিশালার সেবক একদা প্যারিসে ছিল। আমিও প্যারিসে গেছিলাম শুনে উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল—সঞ্জলি দেখসেন নি? বড় সুন্দর, না?
খুব আপসোস হল । প্যারিস গেলাম অথচ এমন জায়গাটা দেখা হল না। সে আমার দুঃখ দূর করার জন্য বর্ণনা শুরু করতেই বুঝতে পারলাম—সাঁজেলিজে।
স্টীমারে বরিশাল যাবার পথে খাদ্যতালিকায় “পিচ”-প্রতি কতরকম মাছের দাম দেখেছিলাম। ‘ফুসকাও” ছিল কথ্য ভাষার বানানে তার মুচমুচে “চ” বর্ণটিকে হারিয়ে।
রাঙ্গামাটি যাবার সময় অতি চমৎকার সারথি পেয়েছিলাম। সারা রাস্তা গানে গল্পে ভরিয়ে রেখেছিল। এর ‘ভাইডি’ আবার ভয়ানক বলিউডি সঙ্গীতের ভক্ত। মুম্বাইয়ের সিনেমা আর গানের জগত গুলে খেয়েছে। তাদের পারিবারিক জীবন অতীত বর্তমান সব নখদর্পণে। শেফালি খানের আগের পক্ষের মেয়েকে চিনি নাকি জিজ্ঞেস করছিল।
—শারুখ খান?
—না না শেফালি খান।
—ছেলে না মেয়ে?
—কী যে কন—মাইয়া হইব কোন দুঃখে?
ছেলে হবার সুখটা জানি না বলে মাইয়া হবার দুঃখটাও বুঝলাম না। তবে একটু লজ্জা পেলাম এই জন্য—নিজের দেশের এমন বিখ্যাত ব্যক্তিটির সামান্যতম সুতোটাও ধরতে পারছি না বলে।
শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জানি না বলায় সে আশ্চর্য হয়ে তার বিস্তারিত পরিচয় দিতেই চিনতে পারলাম—সইফ আলি খান।
এ ব্যাপারে সর্বোত্তম গল্পটি বলেছেন বরিশালের কৃতী সন্তান শ্রীতপন রায়চৌধুরী। বরিশালের শিবপুর অঞ্চলে পর্তুগিজ পত্তনির কারণে সেখানকার বেশ কিছু নাম হত পর্তুগিজ, যেমন গোমেজ আল্ভারেজ ইত্যাদি। এরা পর্তুগিজ আওতায় যারা রোমান ক্যাথলিক হয়েছিলেন তাদের বংশধর।
তোমরা কী জাত? এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলতেন আইগ্গা মোরা রোমাই কাত্তিক। একদা কার্তিক সম্প্রদায় ঢাক ঢোল বাজিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহে কালীপুজো করছে দেখে জিজ্ঞেস করা হল—এয়া কী? কালীপুজা করতে আছ? তরা না রোমাই কাত্তিক?
আল্ভারেজ কোম্পানি ক্ষোভে ফেটে পড়ে পড়লেন—রোমাই কাত্তিক হইছি দেইখ্যা কি আমাগো জাত গ্যাছে?
ধর্মের সঙ্গে জাতের যে সম্পর্ক নেই সেটা বীর বাঙাল প্রমাণ করে দিয়েছে। সত্যি তো! বরিশালের রোমান ক্যাথলিক চুপচাপ ঠান্ডা চার্চের কোণে বসে ভক্তিরসের প্রদর্শন করছে ভাবা যায় না।
আমাদের ঘটি বন্ধু প্রেম করে বিয়ে করেছে বাঙালকে। কদিন বাদে কোন আত্মীয়া মধুর গলায় জিজ্ঞেস করলেন—কী করে নতুন বউ?
বাঙাল শাশুড়ির চাঁচাছোলা উত্তর—ঘুম মারতাসে।
চল্লিশ বছর আগের বাঙালি সংসারের চালচিত্রে নতুন বউ এখনও উঠে কাজে লাগেনি এই অনিয়মটা শুধু ঘুমোচ্ছে বললে কি বোঝা যেত?
এইবারের কাহিনিটি ঈষৎ বিপজ্জনক। নেহাত সিলেট থেকে আসা একদম মাটির মানুষ আমাদের বন্ধুর মা মাসীমা বলেছেন বলে হজম করা গিয়েছিল। সবাই জানে সিলেটি ভাষার এত জোর যে সমস্ত প-ই ফ হয়ে যায়। তাঁকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হল। উনি তৃপ্ত হয়ে তারিফ করে বললেন—তোমরা কলকাতার মাইয়ারা এত সুন্দর (পা) ক কর—। তোমারে কে শিখাইল (পা) ক করা—মায়ে না শাউড়ি?
তখন মনে পড়ল বন্ধু বলেছিল ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে মাসীমা বলেছিলেন—সবই তো ভাল। মাইয়াও খুবই পছন্দের অখন কথাডা হইল হেতি পাক করতে পারে কি না।
বলাবাহুল্য সমস্ত প-গুলোই ফ শোনাল সিলেটি বিক্রমের জন্য।
শান্তিনিকেতনে উচ্চারণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হত তখন। ক্লাসে বীরপুরুষ মুখস্থ বলছি— এমন সময় হা রে রে রে রে রে / ওইযে কারা আসতেছে--এটুকু বলতেই আমাকে থামিয়ে নলিনীদি বলে উঠলেন—হা ড়ে ড়ে ড়ে ড়ে/ তোমাকে চিনেছি হাড়ে হাড়ে—তুমি বাঙাল।
কোরাস গানের দল থেকেও তীক্ষ্ণ-কান মাস্টারমশাই ধরে ফেলতেন—এই কে বলল—বZর মানিক দিয়ে গাঁথা?
বাঙালের সম্পদ ছিল “পিত্লা শখ” “আজাইরা কাম”-এর মত আরো হাজারো ডিকশনারি বহির্ভূত শব্দ। অভিধানে থাকার মর্যাদা না পেলেও কথাগুলোর লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা নিয়ে কথা বলে কোন আহাম্মক!
হ্যাঁ ভাই, না ভাই, নেবু, নুচি, নঙ্কার মত মিঠে বুলি আজ আর শোনা যায় না। ডেড়টা, বারান্ডা, গেলাস বলা ঘটিও প্রায় অমাবস্যার চাঁদ। সে-সব স্পেশাল বাঙালরাও কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে যারা যে-কোন শব্দকে নিজের ইচ্ছেমত চেহারা দিয়ে বাজারে ছেড়ে দেবার মত বেপরোয়া ও স্মার্ট ছিল।