• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • ভুবনডাঙার মানুষজন : অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়



    ।। ১ ।।

    বারান্দার ইজিচেয়ারে সুরেশ সান্টাবুড়োর মতো একটা লাল কোট পরে কাত হয়ে শুয়ে আছে। গ্রীলের লতাপাতা-নকশার ফাঁকফোকর দিয়ে শীতের মিঠে রোদ্দুর তার পরনের লাল কোটের উপর এসে পড়াতেই বোধহয়, তার চোখদুটিও আরামে চকচক করছিল। বড়দিন চলে গেছে।

    লাল কোটখানা অবশ্য ছিঁড়ে গিয়েছে, সেলাই খুলে গিয়েছে জায়গায় জায়গায়, এবছর মেরামত করে দিতেই হবে, উৎসবের দিনশেষে ট্রাঙ্কে ফিরে যাওয়ার আগে। নীলিমা টু ডু লিস্টে লিখে রাখলেন আপাতত।

    পাশে টিপয়ের উপর একটা বেতের ডালায় কিছু চকোলেট রাখা। ঘরেই বানানো। ঠান্ডার দিন বলেই বোধহয় গলে নরম হয়ে যায়নি এখনও। নীলিমা একবার ভাবলেন, এবার ওসব তুলে ফেললেও হয়, তারপর মনে পড়ল টুকাইরা বড়দিনের সময় ছিল না, এখানে ফিরে একটু ফুরসত পেলেই হাঁপাতে হাঁপাতে আসবে ছেলেটা, "নীলি, ওগোমা?" বলে হাত বাড়িয়ে দেবে। ওগুলো থাক তবে আরো কটা দিন।

    অবশ্য টুকাইরা যে ফিরেছে সে বুঝেছেন আজ সকালে উঠোনে মেলা ভেজা কাপড় দেখে। তাছাড়া ওদের কুকুরটা বার বার ছাদের পাঁচিল সামনের পা দুটো তুলে দিয়ে, জিভ বার করে হ্যাঃ হ্যাঃ করে হাঁপাচ্ছে, আবার নেমে পড়ে দৌড়চ্ছে সিঁড়ির দিকে। নিশ্চয়ই টুকাইয়ের বাবা ফিরতি পথেই কুকুরটাকেও নিয়ে এসেছে, কোথাও বেড়াতে গেলে সেই যেখানে রেখে আসতে হয়, সেখান থেকে। ওর নাম জিমি। টুকাই তাঁকে দেখিয়েছিল, মোবাইলে একরকম চলন্ত ছবি আসে, যাতে ক্লিক করলে একনাগাড়ে অন্তত বার পাঁচেক দেখিয়ে তবে থামে। আবার চালালে আবার বার পাঁচেক। ঠিক সেরকম জিমিরও বার পাঁচেক হ্যাঃ হ্যাঃ করা হয়ে গেল বেশ ক’বার।

    জিমির সেই হ্যাঃ হ্যাঃ করা দেখতে দেখতে নীলিমার মনে পড়লো, কিছুদিন আগেই এদিকের গেরস্তালিতেও একটা কুকুর নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কাগজে একটা খসড়া মতো এঁকে ধরেছিলেন টুকাইয়ের সামনে।

    —টুকাই, আমাদের একটা ডগি চাই, কি বলিস?

    —না, বেবি চায়।

    —বেবি? সে কি! কার জন্য?

    —সুব্বো।

    —ও, সুব্বো আর ইতা?

    —না, ছুদু সুব্বো।

    একতলার বসার ঘরের একপাশে একজোড়া অর্ধসমাপ্ত মানব মানবী পড়ে আছে, যাদের টুকাই চটজলদি নাম দিয়েছে, ইতা আর সুব্বো। একজোড়া তরুণ-তরুণী আবার মা-বাবা হতে চাইলে তাতে আপাতদৃষ্টিতে কিছু অস্বাভাবিকতা তো নেই। কিন্তু সুব্বোর একলার জন্যই বেবি চাওয়াটার মধ্যে টুকাইয়ের কী অন্তর্বেদনা লুকিয়ে আছে কে জানে।

    —ছিঃ টুকাই, ইতা আর সুব্বো তো ফ্রেন্ড!

    —না, কুউব ঝগা।

    নীলিমা আর কথা বাড়াননি।

    টুকাইটা ফাঁক পেলেই চলে আসে, শনি–রবি তো বটেই, ওর সে দুদিন ছুটি থাকে ইস্কুল। তাছাড়া হপ্তার মধ্যেও, কখনো সখনো, যদি ইস্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফেরে। ওর মা কাজ থেকে ফেরার পথে রোজ একবার উঁকি দিয়ে যায়, যদি টুকাইকে দেখে, ঠিক বলবে, টুকাই, চলে এসো। দিদার অনেক কাজ এখন। টুকাই অবিশ্বাসীর চোখে তাকায়, ভাবখানা এই যে বুড়ো মানুষের আবার কাজ কি!

    আসলে নীলিমার নিজেরও তো তাই মনে হয়, কত যে কাজের ছল দিয়ে জাগ্রত দৈনিক জীবনের পনেরো ষোলো ঘন্টা ভরে রাখতে লাগে, তা যদি টুকাইয়ের মা জানতো......হয়তো আপত্তিও করা যেত, কিন্তু সেই সময়টা ঠিক ঝর্ণার টিভির সামনে বসে সাস-বহু গেলার সময়। টুকাই থাকলে অনর্গল ঘুরঘুর করে, শব্দ করে, আর ঝর্ণার তাতে নাকি টিভি দেখতে "ডিস্টাপ" হয়। ধাঁ-ধাঁ করে হাতের কাজ সেরে একঘন্টা সিরিয়াল না দেখতে পেলে ঝর্ণার চলবে না।

    আর কাজের লোক ছাড়া তাঁর চলবে কী করে? এই বড় বাড়ি, লাগোয়া বাগান....পুরোনো গাছপালা, শাল গাছ, আম গাছ....গঞ্জ শহরের কোলাহল থেকেও দূরে এই নির্জনতার কোলে তাঁর বসবাস। পুবের বারান্দায় দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায়, রাঙা মাটির ঢেউ খেলানো কার্পেটে মাঝেসাঝে এক-আধটা হাতপাখার গোছার মতো তালগাছ। এদিকটায় এই দুটো-একটা ছাড়া বাড়ি নেই। মানুষজনও কম, অন্তত এখনো।

    সপ্তাহে দুটো দিন সাড়ে আটটা বাজলে ঝর্ণা দোকানপাট সেরে আসতে বের হয়। দিনের বাজার। আগের দিন লিস্ট করে ছোটো ছোটো চিরকুটে লিখে পাঠিয়ে দেওয়া থাকে, গোয়ালা রাজেন, ডিম-পাঁউরুটিওয়ালা আফরোজ, মুদি শ্যামাপদর জন্য, নামে নামে। এসেই বাইরের কাপড় ছেড়ে, ধোওয়া কাপড় পরে সে রান্নাঘরে ঢোকে। এক থেকে দেড় ঘন্টা। বাস্। দুটো মানুষের তিনবেলার রান্না করতে আর কতক্ষণ লাগে!

    বাকি সময়টা তাঁর খেয়ালের সঙ্গী। ফরমাশমতো। টুল এনে এঘরে-ওঘরে রাখবে, এটা-ওটা সরাবে, কাপড় দিয়ে মুছবে, আর বিড়বিড় করে বকবে, পারিনে বাপু। এ কি বুড়ো মানুষের মতোন ব্যাভার। এট্টা কেমনধারা সোমসার সাজিয়ে বসে আচে।

    ঝর্ণা দুপুরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে চলে গেলে মাটির তাল নিয়ে, কি ছুঁচসুতো, কাপড় আর উল নিয়ে বসা। যখন যেমন মন চায়। টুকাই এই সময়টায় একদম লক্ষ্মী ছেলেটি। পাশে বসে মাটির তাল নিয়ে সেও হাতের চাপে আকার দিতে থাকে। সেইসব না-দেখা জন্তু জানোয়ার, আর সব অজানা আকার দেখতে দেখতেই একদিন বলেছিলেন, এটা কি রে টুকাই?

    — কপি, ডাইনো খায়।

    —যাঃ, ডাইনোসর আবার শাকসব্জিও খায় নাকি?

    —খাও ফুই গেই, মাউচ খায়।

    নীলিমা ঠিক বুঝে যান, খাবার ফুরিয়ে গেলে তবেই তারা মানুষ খায়। নইলে শাকসব্জিই তাদের খাদ্য। কথা স্পষ্ট ফুটুক আর না ফুটুক, ওর এই গুছিয়ে কথা বলা দেখলে মনে হবে যেন বিরাট বিজ্ঞ।

    ইস্কুলে যেমন খুশি সাজো অনুষ্ঠানের জন্য হলুদ ফতুয়া, ধুতি, বাঁশি আর ময়ূরপাখায় সাজিয়ে ইসকুলে দিয়ে এসেছিল রীতা। অথচ মঞ্চে উঠে বাঁশিটা কোমরে গুঁজে, ঘাড় বেঁকিয়ে, নখ কামড়ে কাটিয়ে দিল। বাড়ি ফিরে রীতা খোলা উঠোন দাঁড়িয়ে চড়-চাপড় দিচ্ছিল, উনি ঝর্ণাকে দিয়ে ছাড়িয়ে আনিয়ে ঘুঘনি খেতে দিলেন। বাস্, মনখারাপ পগার পার।

    —হ্যাঁরে, কি সেজেছিলি আজ?

    —কিন্নো।

    —আমাকেও সাজতে নিবি? ঘাড় হেলিয়ে জানালো রাজি আছে।

    —কী সাজবো আমি?

    —আদা।

    —উঁহু, তুই কৃষ্ণ হলে আমি হব যোগমায়া, বুঝেছিস?

    —ওগোমা?

    —হ্যাঁ, তুই কিন্নো আর আমি ওগোমা।


    ।। ২ ।।

    রিটায়ারমেন্টের পর নির্জনতা উপভোগ করবেন বলে সুরেশ ভুবনডাঙায় এই বাড়িটা অনেক যত্নে বানিয়েছিলেন। স্বাস্হ্যকর জায়গা, সুন্দর বনস্থলী, ছোটো হলেও একটি সত্যিকারের স্রোতস্বিনী...হলই বা নির্জন শহরতলী। আর্কিটেক্টের শিল্পবোধ, দেশী-বিদেশী লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন থেকে আইডিয়া, মিলিয়ে মিশিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির ওপর দু কাঠার দোতলা তুললেন। কাজের লোকের জন্য আউট-হাউস, বাড়ির সীমানা বরাবর ফলবান গাছের সারি, কিছু দেওদার, কাঠচাঁপা। পোর্টিকো থেকে গেট অব্দি মোরাম বিছানো রাস্তা। ছিমছাম, রুচিসম্মত। বড় শহর নদীর ওপারে, অবশ্য বর্ষার সময় বাদে তার নদীত্ব সম্মন্ধে কিছুই জোর দিয়ে বলা যায় না, বালুচর দেখে নদী জানা যায়, ধোঁয়া দেখে যেমন আগুন।

    কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। চেনা মানুষটার ব্যক্তিত্ব, স্মৃতি, কবিতা-প্রেম সব যেন কোন জাদুবলে আস্তে আস্তে হারাতে লাগল। অমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্মার্ট মানুষ হঠাৎই নিজের চারপাশ বোঝেন না, উঠে দাঁড়াতে গেলে টলমল করতে থাকেন, কেউ না থাকলে পড়ে যান। হাত পা কেটে রক্তারক্তি। পার্কিনসন এবং মানসিক ক্ষয়ের সাঁড়াশি আক্রমণ কাবু করে দিল এককালের ডা়কসাইটে সরকারী আমলাকে।

    এখানে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল, তাছাড়া এমন রোগিকে সবাই হাসপাতালেই দিতে চায়.....কিন্তু নীলিমা জানতেন, যেসব রোগি নিজের পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধেই হতচেতন, হাসপাতাল তাঁর শুধুই অবলুপ্তিই ত্বরান্বিত করবে। নিজেই সেবার ভার নিয়েছিলেন। সাত-আট বছর আর অন্য কোনোদিকে তাকানো হয়নি। পরের দিকে বার বার পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে যেতে লাগলো, শেষ দেড় বছর তো বিছানাই সম্বল। গোটা দশটা বছরও তাঁদের এ বাড়িতে একসাথে থাকা হল না, এক বর্ষার দুপুরে সুরেশকে ওরা ফুলে ঢাকা গাড়িতে করে বিদায় দিয়ে এল।

    সুরেশ যতদিন ছিলেন, নীলিমার নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। সেই রাতের পর রাত বার বার উঠে দেখে আসা, মানুষটার গোঙানির কারণ বুঝে জল খাওয়ানো, পাশ ফিরিয়ে দেওয়া, আবার সকাল হতে না হতেই চান করে, কাপড় ছেড়ে তৈরী হওয়া আরেকটি দিনের জন্য। তার মধ্যেই বাজার দোকান, ওষুধপত্র কেনা... কিন্তু সুরেশ চলে যাওয়ার পর কোথায় যে গেল সেই ব্যস্ততা! আচমকা সারাদিনটা নিয়ে যে কী করা যায় তাই যেন বুঝে উঠতে পারেন না!

    একমাত্র ভাই ছোটু দেশছাড়া আজ বহু বছর, কি একটা বিদেশী ভ্রমণ-চ্যানেলের হয়ে বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ায় দেশে বিদেশে। আশ্চর্যের কথা, খবরটা পেয়ে একমাত্র সেই এসেছিল। কাজকর্ম মিটে যেতে সেও চলে গেল।

    বর্ষা এলে যখন আমগাছ আর চালতা গাছের শিরাকাটা পাতা থেকে জল চুঁইয়ে পড়তো, চোখ সরিয়ে নিতেন নীলিমা...হেমন্তে সারা রাত পাতায় টুপটাপ শব্দ শোনা যায়। শিশির জমে, তারপর একসময় তার ভার সইতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায় কাঠবাদামের শুকনো লাল পাতাগুলি। মনে পড়ে, এই বাড়িতে প্রথম রাত্রিবাসের সময় সুরেশ কী উত্তেজিতই না হয়ে উঠেছিল পাতা ঝরে যাবার আওয়াজ শুনতে পেয়ে — কার যেন কবিতা শুনিয়েছিল, কেবল পাতার শব্দে আমি আজ জেগেছি সন্ত্রাসে....নৈঃশব্দের সন্ত্রাস তো আজ আমার সুরেশ, তুমি কেন জেগেছিলে তবে? নাকি একটু একটু করে আমাকে তৈরি করছিলে একলা থাকার জন্য?

    ততদিনে আউটহাউসে ভাড়াটে বসিয়েছেন, রাতে একলা ঠিক ভয় না করলেও, অসোয়াস্তি তো হয়ই। তাই। টুকাইরা তিনজন।

    আগে তো ধরে ধরে শীতের রোদে বারান্দায় ইজিচেয়ারে সুরেশকে বসিয়ে দিতেন আলোয়ান গায়ে। সে বছর প্রথম শীতের রোদ যেদিন শূন্য চেয়ার ছুঁয়ে পোষা বেড়ালের মতো এসে বসলো, নীলিমার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। খাঁ খাঁ করা বাড়িতে সেই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছিলেন না।

    এক শীতের দুপুরেই পুরোনো শাড়ির মধ্যে তুলো ভরে ভরে সেলাই করে একটি আকার দিলেন। পীচ রঙের শাড়ির খোলে, মেয়েদের জামায় বসানোর বড় বড় কাচের বোতাম দিয়ে চোখ, কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে সেলাই দিয়ে ঠোঁটদুটি। সুরেশেরই কোট আর টুপি লাগিয়ে সেই মানুষের ঠাঁই হল বারান্দার ইজিচেয়ারে....আচমকা সমস্ত বারান্দাটা রোদ্দুরে হেসে উঠলো যেন। ঝর্ণা কাজে এসে প্রথমেই চেয়ার দেখে চমকে উঠেছিল, গালে হাত দিয়ে বলে উঠেছিল, হাঁ ভাল্।

    শুধু চমকায়নি টুকাই। সাড়ে তিন বছরের টুকাই, যার কথা ফোটেনি বলে বাপের আফশোষের, মায়ের চিন্তার শেষ ছিল না, সেই বাচ্চা এক ঝলক দেখলো চেয়ারখানি,......

    তারপর তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,দাউ?(দাদু)। আচ্ছা! উনি হলেন দাউ আর আমার বেলায় কেবল নীলি! হেসে উঠলেন সশব্দে আর মনের সবকটা জানালা খুলে যেন উড়ে গেল পাখির ঝাঁক।

    সেই শুরু। ওগোমা তো তারও পরে।

    সাইকেলে করে চিঠি বিলি করতে আসত তরুণ টুডু। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, পাথরে কোঁদা কেষ্টঠাকুরটির মতো চেহারা। কিন্তু তরুণ কী যেন পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে দিল্লী চলে গেল একদিন। নতুন পিওন, দশরথ প্রৌঢ়, একটু কাঠখোট্টা গোছের মানুষ। তার সাথে আর যাই হোক, আলাপচারি জমে না, টুকাই দশরথকে দেখলে লুকিয়ে পড়ে।

    পুরোনো ধূসর রঙের শাড়ি, ঝর্ণার ভাইপোর বাতিল বয়স্কাউটের খাকি ইউনিফর্ম, সুরেশের শখ করে কেনা সাইকেল ...এসব তো বাড়িতেই ছিল। অতএব, একদিন সকালে, পোর্টিকোতে এসেই টুকাইয়ের মুখে হাজার ওয়াটের আলো, তঁউ আঙ্কেল!

    ক্রমশ তাঁর নির্জন বনবাস এরকম ফিরে আসা লোকে ভরে যেতে লাগলো। কে বলে ভুবনডাঙা থেকে মানুষ সমানে দূরের শহরে চলে যায়! এত মানুষও ফিরেও তো আসে! গোয়ালা রাজেন, ডিম-পাঁউরুটিওয়ালা আফরোজ, মুদি শ্যামাপদ, একটা পাঠশালা, গুটি চার-পাঁচ ছাত্রছাত্রী, সালোয়ার কামিজ পরা দিদিমণি, টুকাই সবাইকে চেনে। তাদের সাথে ওর কী যে এত কথা থাকে, কে বলবে এই ছেলেই ইস্কুলে গেলে গোঁজ হয়ে বসে থাকে।

    সকালে এসেই বলবে, লিত্? নীলিমা মুদির দোকানের জন্য ফর্দ লিখে দিলে, সেই লিস্ট নিয়ে গম্ভীরমুখে বাজার করতে যাবে টুকাই। কিম্বা ভাঁজ করা কাগজ ভরে খালি লেফাফা এনে বলবে, চিতি, তঁউ আঙ্কল দিতে। সে চিঠি পড়ে জবাব মুসাবিদা করতে বসবেন। সে উত্তর খামে ভরে আবার বাক্সে ফেলে আসবে।

    নীলিমা বলবেন, বাঃ, ভারি কাজের ছেলে তো তুই!

    ঝর্ণা কি এইসব আদিখ্যেতা পছন্দ করে না? কে জানে কেন সুযোগ পেলেই টুকাইকে কোন চান্স না দিয়ে বাজার থেকে আনা জিনিষপত্তর সোজা ভাঁড়ার ঘরে রেখে দেয়। চিঠি থাকলে এনে টেবিলে রেখে দেয়। বকা দিলে গম্ভীর হয়ে থাকে।

    তাতে অবশ্য বয়েই গেছে দুই অসম বয়সের বন্ধুর...নাঃ, একটু ভুল হল, দুই নয়, তিনজন। সামনে না থাকলেও আরো একজন আছে তাদের খেলার সাথী...ফোনে ছবি তুলে ছোটুকে মাঝে মাঝে ছবি পাঠানো শিখে নিয়েছেন নীলিমা... ছোটুও তার দেখা নানা আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা লেখে।


    ।। ৩ ।।

    স্বপ্নটা অচেনা নয়। এই ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও না কোথাও এই রকম কিছু ঘটে চলেছে।

    এক আশ্চর্য নীল কুয়াশার মধ্যে একজোড়া মানব মানবী পরস্পরকে কাছে টানছে। মেয়েটির চুল বালিশে ছড়িয়ে পড়ে ছিল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বেষ্টনকারী জলরেখার মতো। সঙ্কোচ নয়, কোন কল্পিত সুখের আবেশে তার চোখদুটি মুদিত। অস্থির পুরুষের ওষ্ঠাধর সেই আরাধ্যা নারীশরীরের ওপর ঝুঁকে পড়েছে।

    ক্রমশ তাদের শ্বাস দ্রুততর হতে থাকে, পুরুষটির ব্যাকুলতা লক্ষ্য করে মেয়েটি তাকে একটু সরিয়ে দিতে দিতে বললো, তোমার ওই কী যেন বলে, নেই?

    পুরুষটি বললো, কী হবে! আরেকজন যদি আসে তো আসুক।

    মেয়েটি আদরে জড়ানো কাতরতার সঙ্গে বলে, না, ও এখনো ছোটো, ওকে সামলে রাখতে হয়, দেখতে হয়। পুরুষটি নাছোড়বান্দার মতো তবু বলে, ও বড় হয়ে গেছে, একটু কম দেখো।

    স্বপ্নটা এতদূর এসে এখানে কেমন জড়িয়ে-মড়িয়ে যেতে থাকে। কোনোদিন পুরুষটির গলায় হাহাকার ঝরে পড়ে...ও বড় হয়ে গেছে, একটু কম দেখো, আমাদের একটা নর্মাল বাচ্চা.....মেয়েটি দপ করে জ্বলে ওঠে, কী বললে? কী বললে তুমি? ও নর্মাল নয়? ও জড়ভরত?

    কোনোদিন মেয়েটির গলা থেকেই আক্ষেপ ভেসে আসে...আচ্ছা, ওকে পেটে ধরার সময়টা কী কষ্ট পেয়েছি তোমার মনে পড়ে? না তোমার, না আমার, কারো বাড়িতে কেউ নেই একটু পাশে দাঁড়ায়, দুবেলা খাওয়া জোটেনি সব সময়... ও যে একটু একটু পিছিয়ে, সেটা কি ওর দোষ!

    এইভাবে দৃশ্যের অন্তর্গত আলো আর ধ্বনির মধ্যে ঝাঁজ-করতালের ধ্বনির মতো কর্কশ, অপ্রাসঙ্গিক আওয়াজ এসে পড়ে, আজকেও রীতা স্বপ্ন ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে।

    বাঁ কাতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে টুকাই। রীতা দেখলো ডান গালে শুকনো জলের দাগ।

    পরের হপ্তা থেকে সুব্রত চলে যাবে শালবনীর প্রজেক্টে। তাতে টাকাটা একটু বাড়বে, কিন্তু থাকতে হবে একলা। রীতা থাকবে মিশনের কাছেই ঘর ভাড়া করে, যাতে অবরে-সবরে সে ছেলেকে দেখে আসতে পারে। খালি সময়টায় যদি রীতা কটা টিউশন করতে পারে, তাদের কষ্টেসৃষ্টে চলে যাবে, সুব্রত বুঝিয়েছে।

    তাছাড়া এখানে বাঁধের কাজ প্রায় হয়েও এসেছিল, ঠিকাদার লোক সরিয়ে নিচ্ছে।

    চলে যাবে, তারা বরাবরের মতো চলে যাবে এই ভুবনডাঙা ছেড়ে। যেমন আর সবাই যায়। প্রথমে নদী পেরিয়ে বড় শহরে, তারপর সেখান থেকে আরো দূরে, যতদূর মানুষ যায়।

    সুব্রতর ভাবনার আজকাল তল পায় না সে। তারা দুই বাড়িরই অমতে বিয়ে করায়, শ্বশুরবাড়িতে তাকে অনেক সহ্য করে চলতে হয়। ঠিক অপমান বা অত্যাচার না, বরং একধরনের শীতল উপেক্ষা।

    অথচ, সেখানেও সুব্রত আশ্চর্যজনক ভাবে নিরুত্তাপ। মাঝে মাঝে মেয়েটি ভাবে এ কি সত্যিই সেই মানুষ, যার টানে সে বাবা-মার নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসেছিল এক কাপড়ে?

    সন্ধ্যায় টুকাইকে বলা হয়েছে তাদের সিদ্ধান্তের কথা। নতুন জামা, জুতো নিয়ে খেলছিল টুকাই। খেলা থামিয়ে জানতে চাইল:

    — মা, তুমিও যাবে?

    — না সোনা। আমাকে তো ওখানে থাকতে দেবে না।

    — ছুদু টুকাই? আল ওগোমা?

    — নাঃ, ওগোমাকেও না।

    টুকাই আর কথা বাড়ায়নি। শুধু রাত্রে খাওয়ার পরে উঠোনে মুখ ধুতে গিয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ।

    রীতা একবার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো দোতলার কোণের ঘরে আলো জ্বলছে এখনো। নিজের মনেই বিড়বিড় করে, ভালোর জন্য, টুকাই তোর ভালোর জন্য।


    ।। ৪ ।।

    সেলাই করতে করতে কখন যে চোখ জড়িয়ে এসেছিল, টেরই পাননি নীলিমা। একটা অদম্য আবেগের তেজে যেন শরীর না চলতে চাইলেও তাকে চাবকে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। যেন এই কাজটি আজ সেরে না রাখলেই নয়। কিন্তু কখন যেন ছুঁচ-সুতো আর কাপড় ধরা দুটি হাত অবশ হয়ে এল। হাতের কুশলী মোচড়ে যে আদলটা ফুটে উঠছিলো সেটা হাত থেকে পড়ে মাটিতে গড়াতে থাকলো।

    আজ সকালে শেষ পর্যন্ত রীতা একলাই এসেছিল। টুকাই আসেনি। বাপের সাথে বড় বাজারে কাপড়জামার দোকানে গিয়েছে, তার নাকি কয়েক জোড়া পোশাকের দরকার। পড়াশুনায় তুখোড় হবার জন্য হরিশ্চন্দ্রপুরের মিশনের স্পেশাল ইস্কুলে পাঠিয়ে দিতে হবে টুকাইকে। শরীরটা কেমন যেন আনচান করে উঠলো নীলিমার। যেন তার বুকের একটা পাঁজরই ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চাইছে কেউ।

    নীলিমা জানেন, টুকাইয়ের পরিষ্কার কথা বলতে না পারার জন্য, বাকি ছেলেদের মতো ক্লাসে ফটাফট উত্তর দিতে না পারার জন্য, ইসকুলে ভাল না করতে পারার জন্যই না ওর মার এত মনোকষ্ট। আসলে ওর বাবা যে খোঁটা দেয় সারাক্ষণ সেটা তো জেনে গিয়েছেন কিছুদিন আগেই — একদিন কি একটা কথায় রীতার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, সারাক্ষণ তোমার ছেলে, তোমার ছেলে করে, আচ্ছা নীলি দিদিমণি, তুমিই বলো, ছেলেটা কি আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম? কথা হচ্ছিল টুকাইয়ের কান এড়িয়ে, কিন্ত ছোটোরা ঠিক শুনে ফেলে, বিড়বিড় করে টুকাই বলে উঠেছিল, বাও খাপ, ... রীতা অস্বস্তিতে পড়ে প্রসঙ্গ পাল্টেছিল।

    আজ আর সেসব রাখ-ঢাকের প্রশ্ন এল না, দুটি রক্তাক্ত হৃদয় একদম মুখোমুখি। নীলিমা বললেন, টুকাইকে হোস্টেলে দিবি? সে কি পারবে? রীতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল, বলেছিল, আমার কথা তো আর শুনবে না সুব্রত। ওর বাড়ির লোকও যে তাই চায়। আবার বলছে, ওর ভালোর জন্যই।

    কার ভালোর জন্য, সেটা অবশ্য একটা রহস্য। রীতা নাকি আগেও এই রকম কথাবার্তা শুনেছে, সুব্রত টুকাইকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছে, পড়াশুনা না করলে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেব। তারা মা-বেটায় পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এবার দেশের বাড়িতে গিয়ে সুব্রত যেন মনস্থির করেই ফিরেছে। ভাসুরের ছেলে পুরুলিয়াতে পড়ে, ভাসুর-জার মুখে সেই তৃপ্তির আলো দিব্যি দেখা যায়। তারও সেই আলোর দখল চাই।

    খুব অসহায় লাগছিল নীলিমার। অব্যক্ত সেই কষ্ট, গলায় দলা পাকানো একটা মন খারাপ নিয়ে সারা দিন কাটিয়ে দিয়ে, শেষে সেলাই নিয়ে বসেছিলেন। কালো উলের ছোট ছোট ঘূর্ণি দিয়ে মাথাটা ঢাকা হয়ে এল প্রায়। আর একটুই বাকি। একটু ঘামের বিন্দু জমা হয় রূপোলি ঝিলিক দেওয়া কপালে। সময় নেই, আর বেশি সময় নেই।


    ।। ৫ ।।

    নীলিমা ধড়মড় করে উঠে বসলেন, টেবিল বাতির আলোয় টেবিলে রাখা ফেবার লুবা ঘড়িতে সময় দেখলেন, রাত আড়াইটে। সুরেশের প্রিয় যন্ত্রটা। নিয়মিত সার্ভিস করিয়ে, দম দিয়ে চালু রেখেছিল সুরেশ। হয়তো সেই কৃতজ্ঞতা-বোধেই একইরকমভাবে সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে সে, নইলে আলাদা করে তার কোন যত্ন তো তিনি আর করেন না, নিয়মিত দম দিয়ে যাওয়া ছাড়া!

    কিন্তু এ কী! তাঁর বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তরুণ টুডু, তাঁদের চিরদিনের সহাস্য জীবন্ত চিঠিওয়ালা। তরুণ যেন তাঁকে আশ্বস্ত করে নীরবে হাত বাড়িয়ে দিল, নীলিমা কোন ভারবোধ ছাড়াই উঠে বসলেন।

    শুধু একটু জল পেলে বেশ হত, গলাটা যেন শুকিয়ে এসেছে। যেই ভাবা, অমনি সেই গম্ভীর মুখের মাস্টারনী এসে এক গেলাস জল ধরলো তাঁর মুখের সামনে। নীলিমা মাস্টারনীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কই গম্ভীরমুখো মাস্টারনী, এ তো সেই ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, টুলু।

    তারপরেই দেখলেন একে একে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে তাঁকে ঘিরে....সহাস্য সুরেশ! সেই শ্যামল, আফরোজ ..মাষ্টারনীর কটি খুদে ছাত্র...তাঁর জগতের সবাই! ব্যতিক্রম শুধু ইতা আর সুব্বো। এক অনির্দিষ্ট, অনির্দেশ্য অন্ধকারে প্রায় মিশিয়ে যাওয়া অবয়ব। সবার পিছনে, নত দৃষ্টি।

    রাত্রির বাতাসের মতো এই সমস্ত মানব-মানবীর আনন্দ-বেদনার তপ্তনিঃশ্বাস যেন একজোড়া শিরাজাগা চামড়া কুঁচকানো হাতকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল, নদীর জলে যেমন দুরের পাহাড়ের ভূকম্পনের তিরতিরে কাঁপন এসে লাগে। এক আশ্চর্য ভাষাহীন তরঙ্গে তাঁকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নির্বাক কিন্তু প্রত্যক্ষ, বাটিকের কাজে যেরকম হাল্কা রঙের ওপর গাঢ় রঙের পরত চড়ে যেতে যেতে নকশা ক্রমশঃ জোরালো হয়ে ফুটে উঠতে থাকে।

    শুধু একটি ছায়ার পিছুটান যেন থেকে যায় কোথাও। ইজিচেয়ারে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে কে ও! লাল চেক হাফশার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট পরে...কোথায় যেন সেই মিশনের ইশকুল, এ তো তারই ইউনিফর্ম।

    পাশে গিয়ে আস্তে করে ডাকলেন, টুকাই!

    দু-একবার ডাক দেবার পর সাড়া দিল। মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।

    নীলিমার মনে পড়ে গেল, ছোটু গত সপ্তাহেই লিখেছিল তার দেখা জাপানের শিকোকু দ্বীপের একটা পাহাড়ি গ্রামের কথা, নাম তার নাগোরো না কী যেন...সে গ্রামে গেলে দেখা যায়, চাষীরা খেতের আগাছা তুলছে। বুড়োবুড়িরা জমা হচ্ছে টগবগ করে চায়ের জল ফোটা কেটলির পাশে। ছাত্ররা ইশকুলে, ক্লাসঘরে মাস্টারনীর কথা শুনছে মন দিয়ে। কেবল দুটো দুষ্টু ছেলে ক্লাস পালিয়ে সিঁড়ির বালুস্ত্রাদে হেলান দিয়ে কোন ফন্দি আঁটছে। সবাই সব দেখছে শুনছে মোষের শিঙের বোতাম দিয়ে তৈরী চকচকে চোখ, কাপড়ের ভাঁজে সেলাই করা কান দিয়ে। আস্ত, জ্যান্ত একটা গ্রাম জীবনের স্পন্দনে দবদব করছে।


    ।। ৬ ।।

    সাতসকালেই টুনটুনি পাখির টুইট-টুইট ডাকে ভোর হচ্ছে ভুবনডাঙায়।

    নিচের ঘরে বিছানায় উশখুশ করছে ঝর্ণা। স্বপ্ন দেখছে তার পাগলি বুড়ি মালকিন সমস্ত ভুবনডাঙার গাছ পাথরদের ছুঁয়ে দিচ্ছে আর তারা জ্যান্ত মানুষ হয়ে যে যার কাজে চলেছে গঞ্জের দিকে, সঙ্গে ওই কালো কোঁকড়াচুল ছেলেটা.. খলখল করে হাসছে। যেকালে মানুষেরাই পাথর হয়ে যাচ্ছে, সেকালে পাথরদের মানুষ করে তোলা যেন খুব একটা মজার খেলা হিসেবে পেয়েছে ওরা। আর ঝর্ণা একলাই, কর কী, কর কী বলে দুজনকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে চলেছে। এত মানুষের জায়গা আছে নাকি সংসারে। শেষে দাঁড়াবে কোথা! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমের চটকা ভেঙে গেল তার। মনে পড়লো ছেলেটা থাকবে না আজ থেকে আর....কেন আসিস আর মায়া বাড়াস, বিছানা গুটিয়ে রাখতে রাখতে সে নিজের মনে বিড়বিড় করে।

    এবার সে হাতমুখ ধোবে, কাপড় ছাড়বে, তৈরী হবে সারাদিনের জন্য। চায়ের জল বসাবে। চা ছাঁকা হয়ে এলে ট্রেতে চায়ের কাপ-ডিশ বসিয়ে দোতলায় যাবে, যেখানে তার পাগলি বুড়ি মালকিনের ঘর। কোনোদিন মালকিন বাইরের আরামকেদারায় বসে থাকেন, কোনোদিন ঘরে, বিছানায়।

    — কই গো, তোমার হল? এই মৃদু ডাকেই সাধারণত সাড়া দেয় তার মালকিন। আজ অবশ্য সেরকম কিছু হবেই, জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। হয়তো ঝর্ণা গিয়ে প্রথমে কাউকে দেখতেই পাবে না। সারা বাড়ি খুঁজতে থাকবে, না পেয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করতে যাবে, এমন সময় ওধারের বারান্দা থেকে হাওয়াই চটির শব্দ তুলে কারো বেরিয়ে আসায় আশ্বস্ত হয়ে উঠবে।

    কিম্বা হয়তো দেখবে কেউ নেই, শুধু ছাপা নীল শাড়ি পরা এক মাথা কাঁচা-পাকা চুল এক পুতুল পড়ে আছে, যেমন সেই লালকোটপরা বড়দাদাবাবুকে রাখা থাকতো বারান্দায়। ততক্ষণে আউটহাউসের সামনে এসে দাঁড়ানো ট্রাকে মালপত্র তোলা সারা, একই ট্রাকে চড়ে রওনা দেবার জন্য তৈরী তিনজন।

    ঝর্ণা মুখে যেমনই রাগ দেখাক, পুতুলটা তুলে নিয়ে একছুট্টে গিয়ে বাচ্ছাটার হাতে দিয়ে আসতে নিশ্চয়ই ভুল করবে না। ভুবনডাঙা কি একটা! মায়া ছাড়া ভরবে কী দিয়ে!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments