• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • প্রান্তিক মানুষের বেদনার আখ্যান : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী


    দেড়শো গজে জীবন— সসীমকুমার বাড়ৈ; প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০১৯; একুশ শতক, কলকাতা; ISBN: 978-93-83521-53-1

    ‘দেশ’ বা ‘রাষ্ট্র’ একটি ধারণা মাত্র, যার অস্তিত্ব কেবল মানুষের মনে। তো এই ধারণাটির বাস্তবসম্মত একটি রূপ দিতে তাকে একটি ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বাঁধতে হয় একটি দৃশ্য বা অদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে। এই প্রাচীরের মধ্যে থাকা তাবৎ পদার্থ এবং তার বায়োস্ফিয়ারের অন্তর্গত জীবকুল মিলিয়ে যে খণ্ডজগৎ, সেটিই একটি দেশ বা রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের (অন্যান্য জীবের কথা ছেড়েই দিলাম) একটি বিচিত্র ও দ্বন্দ্বময় সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষের মধ্যে আবার সমষ্টি ও ব্যষ্টিভেদে সেই সম্পর্কে তারতম্য ঘটে। সমষ্টি যেখানে রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারে, সেখানে তার কপালে জোটে মাত্রাতিরিক্ত আনুকূল্য। অন্যথায় সীমাহীন উপেক্ষা। আর ব্যক্তি তো কেবলই এক ‘আইডেন্টিটি’। রাষ্ট্রের সংবিধানে তার বিভিন্ন অধিকারের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা বহুলাংশেই দুষ্প্রাপ্য, এমনকি তার স্বতঃসিদ্ধ অধিকারগুলিও প্রায়শই লঙ্ঘিত হতে থাকে।

    “আইন আদালত দেড়শো গজের মানুষের কাছে এক ভয়ংকর কুহেলিকার মতো, যে দেশে আইন নেই, সেখানে আইনের কুস্তিপ্যাঁচ বেশি। ঘোড়েল। দেড়শো গজের মানুষরা শুনে আসছে, নো ম্যান্স ল্যান্ডে বসবাস বে-আইনি। বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের জন্মভিটা এখানে, দেশ ভাগের পর এক সাহেব এলেন বাড়ি ঘর রান্নাঘরের উপর দিয়ে লাইন দাগিয়ে বলল — জিরো লাইন, শূন্যরেখা। তখন থেকে শোনা, তারা নো ম্যান্স ল্যান্ডের অধিবাসী। নব্বই-এর দশকের গোড়ায় কাঁটাতারের এপাশে বন্দি করে দায় সেরেছে নিজেদের দেশ। এ বাদে তারা কিছু জানে না। আইন-আদালতে জড়িয়ে গেলে তাদের আরও বেশি জানতে হয়, দরকারটুকু জানাতেই ছিঁড়ে যায় তাদের বুকের পিঞ্জর।”

    উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি সসীম বাড়ৈ-এর ‘দেড়শো গজে জীবন’ উপন্যাস থেকে তুলে দিলাম। ম্যাকমোহন সাহেবের দাগানো শূন্যরেখা এবং কাঁটাতারের মাঝখানে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার-বাংলাদেশ সীমান্তে এই ‘দেড়শো গজ’। একফালি এই ভূখণ্ডে শিকড় রয়ে গেছে কিছু মানুষের। সংখ্যায় তারা মাইক্রোস্কোপিক। রাষ্ট্রের শাসক-সিংহাসনে বসানোর তিলেক ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই রাষ্ট্রের চোখে তারা একটা ‘আইডেন্টিটি’ মাত্র, ভোটার বা আধার কার্ডেই যাদের অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ। ভারতের নাগরিক, কিন্তু পরিচয়পত্র না দেখিয়ে মূল ভূখণ্ডে তারা ঢুকতেই পারে না। সন্ধে ছ’টা বাজলেই সীমান্তের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন কেউ মরণাপন্ন হলে — মাথা খুঁড়লেও দেশের দরজা খোলে না, দেশের ডাক্তার বা হাসপাতালে যাওয়ার উপায় থাকে না তাদের। হয় নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়, নয় অবৈধভাবে বাংলাদেশে গিয়ে চিকিৎসার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। — “দেড়শো গজের কিসেই বা দোষ, যেখানে মানষির জীবন নিয়া বাঁচি থাকাটাই দোষ।” এ এক নৈরাজ্যের জগৎ। এখানে রাজ করে দু-দেশের সীমান্ত-প্রহরী এবং ডাকাতের দল। ধন-প্রাণ-সম্মান তাদেরই জিম্মায়। — “টকা রাখিবে ব্যাংকে, গরু রাখিবে চটিতে, বউ-মাইয়া রাখিবে কোনঠে?”

    সাহিত্য-তাত্ত্বিকরা ‘সীমান্ত সাহিত্য’ (partition literature) নামে সাহিত্যের একটি ধারা সংজ্ঞায়িত করেছেন; যদিও বিশ্বের কোনো এক সীমান্ত-অঞ্চলের সঙ্গে অন্য সব সীমান্ত-অঞ্চলের সমাজ-বাস্তবতায় মিলের চাইতে অমিল অনেক বেশি। ভারতীয় সীমান্ত-অঞ্চলের সমাজ ও সমস্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের সমাজ ও সমস্যা কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না। সেসব অবশ্য বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গন। আমাদের বাংলা ভাষায় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সাহিত্য নিয়েও চর্চার অন্ত নেই। কিন্তু সেখানেও তাকে একটি রঙে ধরা যায় না। ছিটমহলের সাহিত্যকে ‘এনক্লেভ লিটারেচার’ আখ্যায় ভূষিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চর্চা হচ্ছে। ছিটমহলের কয়েকটি অনন্য সমস্যা থাকলেও সীমান্ত সাহিত্য থেকে তাকে আলাদা করে দেখা অর্থহীন। সসীম বাড়ৈ এই যে শূন্যরেখা আর কাঁটাতারের মাঝখানে ‘দেড়শো গজ’-এর ভুবনটিকে প্রথম তুলে আনলেন বাংলা সাহিত্যে, সেটিও তো ছিটমহলের থেকে পৃথক এক অনন্য ভুবন। তবে কি এই উপন্যাসটিকে দিয়ে সীমান্ত সাহিত্যের একটি নতুন ধারার চর্চা শুরু হবে কেতাবি মহলে? যাক গিয়ে ওসব তত্ত্বের কথা। তত্ত্বচর্চায় পি.এইচ.ডি অর্জন হতে পারে, সাহিত্যরসের আস্বাদনে সেটা কতটা কাজে লাগে তাতে আমার সন্দেহ আছে।

    ‘বড় সাহিত্যের প্রেরণার মূলে মানববেদনা’ — বিভূতিভূষণ এই রকম একটা কথা লিখেছিলেন তাঁর ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে। গৃহচ্যুতির মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তেমনই এক মানববেদনা। মূল ধারার সীমান্ত সাহিত্য গড়ে উঠেছে এই বেদনাকে কেন্দ্র করেই। গৃহ মানে তো কেবল বসবাসের বাড়িটি নয়, প্রতিদিনের জীবনযাপনের যাবতীয় উপাদান ছড়িয়ে থাকে যে প্রতিবেশে, যে প্রতিবেশ আধুনিক রাষ্ট্রের মূল ধারার অঙ্গাঙ্গী — সেসবই তার গৃহের অন্তর্গত। সেই হিসেবে ছিটমহল এবং দেড়শো গজের কান্না মিশে যায় ছিন্নমূল তাবৎ মানুষের সঙ্গে।

    এই ‘দেড়শো গজ’-এর ভুবনটিকে আদ্যন্ত জমাট ও নিখুঁত করে একটি স্বল্পায়তন ফ্রেমে নিখাদ মুন্সিয়ানায় ধরেছেন লেখক। তত্ত্বের বিচারে উপন্যাসের গুণাগুণ নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা — কোনোটাই আমার নেই। আমার আলোচনা এগোবে এই উপন্যাস-পাঠের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ার পথ ধরে।

    দুটি কথা প্রথমেই বলতে হয়। প্রথম কথা, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইন এবং কাঁটাতারের মধ্যিখানে ভারতের যে ভূখণ্ডটুকু রাষ্ট্রের কাছে পরিত্যক্ত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ — সেখানেও যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহু মানুষের ঘর-গেরস্থি, তা বাকি বিশ্বের কাছে কেবল অনালোচিত ছিল তাই নয়, ছিল প্রায় অজ্ঞাতও। সেই অজ্ঞাত ভুবনটি সম্পূর্ণ আলোকিত হয়েছে এই উপন্যাসে। দ্বিতীয় কথা, রাষ্ট্রের চোখে এটি বিচ্ছিন্ন হলেও প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ অঞ্চলের জনজীবনের সঙ্গে এই ভুবনের জীবনধারা ওতপ্রোত-বহমান। লেখকের বিশেষ কৃতিত্ব এই যে, উপন্যাসের কেন্দ্রীভূত আলেখ্যটি নির্মাণ করতে গিয়ে সেই ভুবনের মানুষগুলির প্রত্যক্ষ সংকটের সঙ্গে তাদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, তাদের ভাষ্য, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মাচরণ, বিশ্বাস এবং মৌলিক আবেগগুলিকেও গোটাগুটিভাবে ছেঁকে তুলেছেন। অথচ মেদভারে পীড়িত হয়নি উপন্যাসটি, মাত্র আট ফর্মার আয়তনেই ঠাঁই পেয়েছে তার নিটোল গড়ন।

    এই উপন্যাস ধারণ করেছে এক যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন; তারই সঙ্গে সুর মিলিয়ে আখ্যানের বাহনও এক নিরাবেগ গদ্য। আবার যেখানে চরিত্রদের কেউ আবেগমথিত, সেখানে সেই গদ্যে যেন কবিতার ছোঁয়া লেগেছে —

    “সুর ভাসতি ভাসতি কোনঠে যায় মুই জানি না, তেঁও সকালি উঠি দেখি গান শোনা গাছেরা ফুল ফুটাইয়া হাসছে।”

    “তরমুজ লতারা লগ্ন হয়ে রয়েছে সুরের মায়াজালে। কিছুটা সুর ভেসে গেল ভাটির গাঙে। নদীর শরীরে তখন কতো সুরবাহার।”

    “জল ছুঁয়ে তার জল হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। হাতের মুঠোয় যে মনের মানুষের ছোঁয়া।”

    “ভাওয়াইয়া গাইলে বাও বাতাস নিবিড় হয়ে আসে।”

    এই উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণও অনবদ্য। অনবদ্য এই অর্থে যে তারা তাদের সহজাত বিশিষ্টতা নিয়েই উঠে এসেছে উপন্যাসে। খরু এবং মৌলু সাধারণ রাজবংশী হয়েও স্বভাব-গায়ক। খরুর ভাগ্নে দুলাল পুলিশের চাকরি করে। কিন্তু সে কেবল গানপাগল নয়, লোকসংগীত সংগ্রহ করা তার নেশা। কাঁটাতারের ক্ষতবিক্ষত জীবন হেয় পেশায় ধারণ করেও মহত্বের অর্থ না-জানা বিস্তি এবং হাতেমুল হৃদয়ের অভ্যন্তরে লালন করে মহৎ মানবতা।

    উপন্যাসের আখ্যান অংশে ঢোকার আগে তার পটভূমিকার নির্মাণটি একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। শূন্য লাইন ও কাঁটাতারের মাঝখানটি যেন একটি খাঁচা। খরু বর্মনের কথায় — ‘এ খাঁচার একদিকে কাঁটাতার অইন্য দিকে সুইন্য লাইন। পালাইনার আস্তা নাই।’

    দেড়শো গজ পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অংশ, সেখানকার আঞ্চলিক বিশেষত্বগুলি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উপস্থাপিত। নদীতে মাছ ধরা, চর জুড়ে তরমুজের চাষ যেমন আছে, তেমনই আছে সাধারণ মানুষের মনে ভাওয়াইয়া গানের আবেদন। আছে সীমান্তের দৈনন্দিনতা — গরু, নারী আর ড্রাগ পাচার; দুই দেশের সীমান্ত-প্রহরীদের একই রকম অমানবিক আচরণ, অপরাধ ও দুর্নীতির সঙ্গে তাদের গাঁটছড়া। তারা তো রাষ্ট্রেরই যন্ত্রাংশ। রাষ্ট্র যেহেতু এই অধিবাসীদের প্রতি উদাসীন, তাদেরও কোনো দায় নেই এই মানুষগুলির প্রতি। দেড়শো গজের রিক্ত মানুষজন দু-চার টাকা আয়ের জন্য সামান্য কিছু জিনিস এপার-ওপার করলে সীমান্তরক্ষীদের হাতে তাদের হেনস্থার শেষ থাকে না। সিরাজুলের আক্ষেপ, — ‘পোলাপান দুই চাইর প্যাকেট নুন, বিস্কুট, হুপারি বেচলি পাচার হবি?’ অথচ, গরু পাচারের অবৈধতা সেখানে মান্যতা পেয়ে সুচারু দৈনন্দিনতায় রূপান্তরিত। বিশেষ বিশেষ পাচারকারি বা ‘ধুর’ বলে কথিত তাদের দালালদের কাছে সীমান্তরক্ষী-স্বীকৃত আইডেন্টিটি কার্ড থাকে। — ‘কাডের গরু পাচার করলে বিপদ নাই’ — হাতেমুল মিঞা নামে একজন ‘ধুর’ বলে। এই চরিত্রটির কথা পরে আবার আলোচনায় আসবে। আসবে মুকুল নামে একটি বহিরাগত তরুণের কথাও। তার প্রস্তাব — ‘গরু রপ্তানি আইনি হোক’ খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।

    এখানে রক্ষীবাহিনী স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান করে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সেখানে উপস্থিত করা হয়। সেই বাচ্চাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যায়। কারণ দেড়শো গজে কোনো স্কুল নেই। ইন্ডিয়ায় ঢুকতে গেলে কাঁটাতার। ফলে জাতীয় সংগীত গাইতে বললে একটি মেয়ে ‘আমার সোনার বাংলা...’ গেয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ তার পরিবার ‘দেশদ্রোহী’ তকমা পেয়ে যায়। উপন্যাসের রাষ্ট্রীয় প্রতিভূদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমী চরিত্র, এস.ডি.ও. সাহেব উচ্চারণ করতে না পারলেও, ভাবেন — ‘দেশের বাচ্চাকাচ্চা অন্য দেশে পড়াশুনা করাই তো লজ্জার। কেন এখানে স্কুল পৌঁছতে পারল না? চাল তেল নুন এমন কি মোবাইল ফোন পৌঁছতে পারলেও কেন শিক্ষা পৌঁছতে পারল না?’

    উপন্যাসের আখ্যান-কেন্দ্রে খরু বর্মনের পরিবার। তার স্ত্রী মঙ্গলি, মেয়ে ধৌলি এবং ছেলে মংলু। এক রাতে খরুর দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়ল বাংলাদেশের ডাকাতের দল। লুটপাট সেরে “ধৌলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পালের গোদা। পরে এক দুই। দুই তিন চার। পালাক্রমে পাঁচ...ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীর। ছিঁড়ে যাচ্ছে জঙ্ঘাসন্ধি। ...চারজন আধকাটা পাঁঠার মতো চিৎকার করছিল। আশেপাশের বাড়িগুলোও ফেটে পড়ছিল ত্রাহি চিৎকারে। বাঁচাও বাঁচাও। তারা সবাই জানে দেড়শোগজের দূরত্ব অতিক্রম করে চিৎকারের শব্দ কাঁটাতারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীর কারও কানে পৌঁছবে না।”

    পরের দিন সকালে পুলিশ এসেছিল লাশ নিতে। লাশের বদলে জীয়ন্ত ধর্ষিতাকে দেখতে পেয়ে বাধ্য হয়ে তাকে তারা নিয়ে যায় হাসপাতালে। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি দাবি করলে “ইন্সপেক্টর দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠেছিল — বিদেশি ডাকাত তুমি ধরে এনে দিতে পারবা? নো ম্যান্স ল্যান্ডে আছো বাল ছিঁড়তে? ওপারে ভারতে চলে যেতে পার না। শালারা প্রতিবার এক একটা ঝামেলা পাকাবে আর আমাদের ছুটে আসতে হবে।”

    বরাতজোরে বেঁচে যায় ধৌলি। তার জীবনে দেবতার মতো আবির্ভূত হয় রাজস্থান থেকে আগত ধনঞ্জয় নামে ঠিকাদার সংস্থার এক কর্মী। ভালোবেসে ধর্ষিতা মেয়েটিকে গ্রহণ করে সে। পরম মমতায় তাকে দেয় নতুন জীবন।

    বাংলাদেশের জরিনা বেওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সাহিদের বিধবা, যার কবর ইন্ডিয়ার মাটিতে। খরুর কিশোর বয়সের হিরো সাহিদ। জরিনার হয়ে সে-ই শবে বরাতের রাতে তার কবরে চিরাগ জ্বালায়, জিয়ারত করে। সেই সূত্রে বাঁধা দুই পরিবার। জরিনার নাতনি কিশোরী আরা আর মৌলুর হৃদয় নিজেদের অজান্তেই কখন যেন এক সুরে বাঁধা পড়ে। দুই পরিবার সংস্কারের বাধা ডিঙিয়ে দুই হাত এক করে দেয়। আরা সন্তানসম্ভবা হলে এক গভীর রাতে প্রসববেদনায় তার প্রাণসংশয় হয়ে ওঠে। সীমান্তের গেট বন্ধ। ভারতের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সেই মুহূর্তে গরু-পাচারের ‘ধুর’ হাতেমুল যেন মশান দেবতার রূপ ধরে আসে আরা এবং তার গর্ভস্থ সন্তানের পরিত্রাতা হয়ে। হাজারো জটিলতার বেড়া ভেঙে সে বাংলাদেশের হাসপাতালে তার প্রসবের বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হয়। সেই সন্তানের জন্মের শংসাপত্রের আবেদনকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের আখ্যান তার শীর্ষ মুহূর্তে পৌঁছয়।

    এখানে প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে লেখকের আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করি। কোচ রাজবংশের প্রতি রাজবংশীদের অনুরাগ যে তাদের রক্তে সংস্কাররূপে বয়ে চলেছে তা প্রতিভাত হয় এই সন্তানের নামকরণ উপলক্ষে। ‘রুদ্র’-র সঙ্গে ‘প্রতাপ’ যোগ করে মৌলু সেই সংস্কারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। একটি সম্প্রদায়ের সাধারণ চরিত্রের এই দিকটি নির্ভুলভাবে সনাক্ত করা লেখকের সেই বৈশিষ্ট্য।

    এই যে প্রান্তিক জগতটিকে, তার প্রতিবেশ এবং তার অধিবাসীদের যাপনসহ নিপুণ ও নিখুঁত ভাষায় তুলে এনেছেন লেখক, কখনও যা বাস্তবের স্বাভাবিকতা থেকে বিচ্যুত হয়নি — তা যেন এইখান থেকে ইচ্ছাকল্পের দিকে উড়ান-লাফ দেয়। মৌলু-আরার সন্তানের নাগরিক-স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে উত্তর ঔপনিবেশিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংঘাতে মুকুল নামে এক বহিরাগত তরুণের নেতৃত্বে দলতন্ত্রহীন যূথবদ্ধ মানুষের জয়ে আমরা ঔপন্যাসিকের ইচ্ছাকল্পটিকেই মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। এই যৌথ আন্দোলন দেড়শো গজের সীমানা ছাড়িয়ে মানবতার মুক্তির দিশারি হয়ে ওঠে। সেখানে দল নেই কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা আছে; হিংসা নেই কিন্তু সংকল্পের বারুদ-ঠাসা জমাট শক্তি আছে। রাষ্ট্রের দলতন্ত্রের প্রতিভূ (প্রধান) বলেছিল, — ‘কাঁটাতারের হুপারে থাকা তামান চোদনা বে-আইনি মানষি’। আমলাতন্ত্রের প্রতিভূ (বিডিও) বলেছিল, — ‘নো-ম্যানস ল্যান্ডে ওদের থাকার কথা নয়, বে-আইনি বসে থাকলে তার দায়িত্ব কে নেবে?’

    এটাই রাষ্ট্রের স্বর, এটাই চল। এটাই মেনে নিতে হয়। কিন্তু ইচ্ছাকল্পের ভুবনে মানুষের জমাট শক্তি চিড় ধরায় লৌহকঠিন ক্ষমতাতন্ত্রের কোনও এক দুর্বল জায়গায়। যেন দৈববাণীর মতো প্রধানের মোবাইল ফোনে কোনো নির্দেশ আসে। প্রধান বলতে বাধ্য হয়, — ‘হ্যাঁ স্যার...আচ্ছা স্যার...ঠিক আছে দিয়ে দেব।’ এরপর “প্রধানের গলা নেমে গেল ফোঁস-ভাঙা ফণার মতো। নিমিষে শরীর ডুবে গেল পরাজিত হতাশায়।”

    রুদ্রপ্রতাপ বর্মনকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল রাষ্ট্র। তার নামকরণের সময় যেমনটি কল্পচোখে দেখেছিল তার পিতা-মাতা-পিতামহ, তেমনিভাবেই ‘রুদ্রপ্রতাপের ঘোড়া অবলীলায় ডিঙ্গিয়ে’ গেল ‘কাঁটাতারের আঁধার’।

    স্পষ্টতই মানবিকতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে বাস্তবতার বেড়া ভেঙে মহত্তর আশাবাদের উদ্দেশে ইচ্ছাকল্পের উড়ান দিলেন ঔপন্যাসিক এই আখ্যানের শেষ অংশে। একজন কথাকারের এই দায় থাকা উচিত কি না, সেই নিয়ে বিতর্ক ছিল, আছে এবং থাকবেও। তবে এটা স্বীকার করাই ভালো যে, যে-স্বাভাবিকতায় তিনি দুই সম্প্রদায়ের মিলনের প্রতীক হিসাবে রুদ্রপ্রতাপের জন্মগাথা তৈরি করেছেন, তাকে কেন্দ্র করে দলহীন যূথবদ্ধ মানুষের জয়ে সেই স্বাভাবিকতা ব্যাহত হয়েছে।

    মনীষ দেবের যথাযথ প্রচ্ছদে আকর্ষণীয় ‘একুশ শতক’-এর এই কাজটি যথেষ্ট প্রশংসা পাওয়ার উপযুক্ত। তবে মুদ্রণ প্রমাদের ব্যাপারে আরও একটু সতর্ক হলে ভালো হত। বিশেষ করে ভূমিকায় দু-দুবার ‘পাকিস্তান’ হয়েছে ‘পাকিস্থান’। পাঠকের মনে সন্দেহ জাগতেই পারে ভূমিকাকার মূল ফারসি শব্দের সঙ্গে ফারসি প্রত্যয় ‘স্তান’-এর বদলে ইচ্ছে করেই একই অর্থের সংস্কৃত প্রত্যয় ‘স্থান’ যোগ করে একটি সংকর-শব্দ প্রচলিত করার প্রয়াস পেয়েছেন কি না।

    পরিশেষে একটি একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ না করে পারছি না। আমার দেড়শো গজ-কে মনে হয়েছে তাৎমাটুলির ক্ষুদ্র সংস্করণ। ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’-এর মহাকব্যিক ব্যাপ্তি এখানে নেই সত্যি, কিন্তু এই নির্মাণের বাকি প্রকরণ সতীনাথ ভাদুড়ীকে মনে করায়। সসীম বাড়ৈ সতীনাথ ভাদুড়ীর উত্তরসূরি হয়ে উঠবেন কি না, সেটা বলবে সময়; কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিশালী কথাকার হিসাবে নিজেকে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments