ইন্টারভ্যালে হলের আবছা আলোয় অরুণিমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল অহনা। নাহ্, ঠিক চমকায়নি—ওর মনটা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল বলা যেতে পারে। আচ্ছা বেশ সাদা-ই নাহয় সই তা বলে এত সাদা পরতে হয়? মৌটাও যেন কি—কোন প্রাণে মাকে এমন সাদায় মুড়ে সিনেমায় নিয়ে এল?
অহনার মনে পড়ে গেল হাল্কা মেক আপেই অরুণিমার গালে বেশ একটা লালচে আভা সব সময়েই থাকত। যেন ও সবেমাত্র জগিং করে ফিরল বা ঘরে অনেক কাজ সেরে এসেছে। স্বাভাবিক ঝলমলে ত্বক ওকে কোনোদিনই মেক আপে ফুটিয়ে তুলতে হয়নি। উঁচু করে বাঁধা ঝুঁটি, গোলগাল চেহারা—সব মিলিয়ে ওকে বেশ লাগত। এখন কি আর ও এসব ভালবাসে না? নাকি জামাই বাড়ি এসেছে, নিন্দে হতে পারে তাই এত নিয়মানুবর্তিতা!
দিন কুড়ি হ’ল সীতেশদা মারা গ্যাছেন,—আচ্ছা অরুণিমা গেলে সীতেশদার জন্য এক সেট অতি সাদা পোশাক কিছু থাকত কি? কোনো ভদ্রলোককে তো অহনা স্ত্রীবিয়োগে কোনো বিশেষ ইউনিফর্ম পরতে দেখেনি। তাতে কি ওঁদের ভিতরের হু হু টা কম হয়? কে জানে—মনে তো হয় না।
সিনেমা দেখা তো মাথায় উঠল। ‘বেলা শেষে’র জমাটি নাটকের সাথে জুড়ে গেল অরুণিমার সাদা ম্রিয়মাণ মূর্তি। খানিক দেখে তো মন চলে যায় একটু দূরে বসা ওর দিকে।
গাঢ় রং, বিশেষ করে সবুজ অহনার ভারি পছন্দের। তার ওপর আজকাল ও নিজে থেকেই সালোয়ার কুর্তা ধরেছে। বেড়াতে গেলে জিনস, ঝোলা দুল তো আছেই সব সময়ের সঙ্গী। শর্ট কুর্তিও পরে দেখেছে, ভালোই মানায়, ওর তো বেশ ফুরফুরে লাগে। অন্তত শাড়ির বাধ্যবাধকতা থেকে তো নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছে। মাথার সাদা চুলগুলো না লুকিয়েই ও এসব পরে বেড়ায়। আবার আদ্যিকালের দিদার মত ভাত চটকে গল্প বলে বুবাইকে খাওয়াতেও অহনা ভারি ওস্তাদ,—এই ফুরফুরে বোহেমিয়ন জীবনটাই বোধহয় অরুণিমাকে দেখে ধাক্কা খেল। সেই সাদা মূর্তি যেন বললে, ‘পরে নাও, পরে নাও, দুদিন বই তো
নয়!’ কিন্তু কেন নয়? পাশের মানুষটি না থাকলে যে তলহীন গহ্বর সৃষ্টি হয় তা কি রঙে চাপা পড়ে না সাদায় প্রকট হয়? বয়স বাড়ার সাথে সাথে আলাপচারিতা কিছু বাঁধা শব্দখুঁটির চারপাশে ঘোরাফেরা করে,—-‘বাজার কি আসবে?—’, ‘মাছটা কম আছে, নিয়ে এলে ভালো', ‘খানা খাজানা দেখে এসব নতূন রান্না কেন? আমাদের বয়স হয়েছে, পটেটো প্যানকেক চলবে না, কোলেস্ট্রল বাড়বে’, ‘কমপিউটর দেখে ট্যাক্স দিতে আজও শিখল না—ডুববে, সব ডুববে’, ‘সারাদিন টি ভি,—গান শোনা যায় না?’, ‘বাজে সময় নষ্ট ভাল লাগে না—বাইরের দুনিয়ায় কি ঘটছে জানতে হবে না?—শুধু স্বপ্নে থাকলেই হবে?’, 'কেন? গাছের গুঁড়ি বেয়ে খুড় খুড় করে কাঠবিড়ালির উঠে যাওয়া, পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফিঙে, দেওয়ালের পিছনে ওঁত পেতে বসে থাকা বিড়ালের একটু লেজ উঁকি মারা, এও তো সত্যি।’—এমনি সব কথা, আর তার পিঠের কথায় দৈনন্দিন ভরা। কখনো যে যার দুনিয়ায় দূরে থাকা, আবার দীর্ঘ কথাহীনতার পর ফিরে আসাও। একটু শরীরের এদিক ওদিক হলে কপালে ভাঁজ—‘পরপর দুবার কাশল না?—ঠান্ডা লাগার তো কথা নয়!’—যুগ্ম জীবনের সংসারে হাতা খুন্তি মিক্সি আভেনের মতই এরা অপরিহার্য। এমন কি পাউডার না মাখা, মানুষ মানুষ গন্ধে অভ্যস্ত হওয়া,—তিন দিন ধরে ওয়াশিং মেশিনে শার্ট-প্যান্ট না দেখে সুযোগ বুঝে খামচে ধরে জামা কাপড় পালটা করানো—সবই জানান দেয় আছি, আমরা দুজনে পাশাপাশি আছি। এই এত সব গুচ্ছ গুচ্ছ অনুভূতির হঠাৎ অনুপস্থিতি কি সাদা শাড়ির ইউনিফর্মে হাইলাইটেড হয়, না তার প্রয়োজন আছে? সবুজ সালোয়ার কুর্তি দিয়েই কি সে ব্যথা টোন্ড ডাউন হয়! থাকা না থাকায় যে দুস্তর ভেদ। কিন্তু মাত্র কুড়িদিন যে স্বামীহারা তাকে তো সময় দিতেই হয় সাদা রঙ্গিনের তত্ত্ব বুঝতে।
এত ভাব সত্ত্বেও অহনা এ নির্মম সত্য বান্ধবীকে বোঝাতে পারেনি। নিরন্তর সামাজিক ব্র্যান্ডিং—কুমারী-সধবা-বিধবা আর তার আচার-বিচারের মধ্য দিয়ে অহনা অরুণিমাকে কিছু পথ তো চলতেই হবে তারপর তো উত্তরণ—। তাই হতাশ হাসি হেসে অহনা চিন্তায় ইতি টানলে।
মনটা কিন্তু মানছিল না। মৌকে ফোন করে ‘হ্যালো, কি করছিস রে মা মেয়েতে, চা খেয়েছিস? বেরোবি নাকি কোথাও?’ বলেই ফেলল অহনা। ওরা রাজি হতেই, পাফটা হাল্কা বুলিয়ে, হ্যাংগারে যে পাটিয়ালাটা ঝুলছিল সেটাই চাপিয়ে নিল অহনা।
কাছেই ওদের প্রিয় টিক্কা। চা চটচটে, ফ্যাকটা লাল টেবিলে আলগোছে কনুই রেখে, অহনা অরুণিমার মুখের দিকে তাকাল। কেমন যেন অসহায় ভাব—পাত্তা না দিয়ে ও বল্লে ‘কি রে মেয়ের বাড়ি ছুটি কাটিয়ে কি করবি কিছু ভেবেছিস? একটা প্লে স্কুল খুলবি নাকি—সারাদিন কুচোদের কিচমিচে ভরা থাকবি—তোর বাড়ি তো সফট টয়এ ভরা—মিসেস দাশের কাছে শিখেছিলি; কেবল ধুলো জমছে—কিছু তো কাজে আসবে।’ চোখ যেন অল্প, খুব অল্পই, ঝিকমিকিয়ে উঠল। ভরসা পেয়ে অহনা আর একটু এগোল—‘চল কলেজ স্ট্রীট থেকে কটা এ.বি.সি., বডি পার্টস আর ভেজিটেবল চার্ট কিনে আনা যাক। যদি আরো অন্য কিছু চোখে পড়ে তাও নেওয়া যাবে। একটা রকিং হর্সও বেশ মানাবে, আর কিছু রঙিন কুশন। প্লে স্কুলে বেশি ক্যাপিটল লাগবে মনে হয় না। বলিস তো আমিও তোর সাথে লাগতে পারি। ফাঁকাই আছি। রুনু তো ওয়াশিংটনে—তবে করোনার জেরে যদি ফিরেও আসে নিশ্চয়ই নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। সব তো বড় হয়ে গেছে।
অহনা লক্ষ্য করল অরুর গালের লাল যেন ছিটি-বিটি ফিরে এল—চোখের ফাঁকা ভাবটা একটু কাটল যেন—স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ও। জল পাতলা টোমাটো সস আর তেঁতুল গোলার মাঝামাঝি মিশ্রণটাতে সামোসা ডুবিয়ে কামড় দিয়ে ওরা চিনি বেশি পাতা কম চায়ের গ্লাস তুলে নিল। পাশের টেবিলে তখন একদল ছাত্র সমস্বরে ফোর জি মোবাইলের গুণগান করছে।
****
বছর খানেক পরের কথা—টিক্কায় সেদিন ইউনিফর্মের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের বীজ বপন করা হয়েছিল তা ধীরে অতি ধীরে এক সুদৃঢ় মহীরুহে পরিণত। অরুণিমা ওর রাজারহাটের ফ্ল্যাটে লিটল ফ্লাওয়ার প্লে স্কুলের ঝুঁটি বাঁধা বাঁধনি স্কার্ট ব্লাউজ পরিহিতা গোলগাল অরু ম্যাম। আর অহনা? সে তো দস্তুর মতো ব্যাটিং করেই চলেছে।
(এই সংখ্যায় নিবেদিতা দত্ত-র আরো একটি গল্পঃ 'হলুদ পাতা')