• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • অধন্যা : দিবাকর ভট্টাচার্য


    ইবার শান্তা যেন দেখতে পেলো এক অপূর্ব মিথ্যামূর্তিকে।

    যাকে মাথায় করে নিয়ে চলেছে ওই অধন্যা নারীটি।

    নির্জন একান্তপথে।


    সেদিকে তাকিয়ে ঘোর লেগে যায় শান্তার। আর ওই বিস্তীর্ণ ঘোরের গহনে দুলতে থাকে সেই বহুবর্ণিল মিথ্যাকুসুমগুলি।

    এভাবেই ভেসে ওঠে বহু বছর আগের সেই ঘটনাটি।


    সরস্বতী পুজোর দিন, বিকেলবেলা। শান্তা বসেছিলো রবীন্দ্রসদনের গেটের সামনে এক আর্টিস্ট বন্ধুর অপেক্ষায়। কিন্তু তার আসার সময়টা পার হয়ে গিয়েছিলো বলে চলে যাবে কি যাবে না এই দোনামনায় সামনের ফোয়ারাটার কাছে এসে বসেছিলো শান্তা।

    চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো বেশ কিছু লোকজন। বেশিরভাগই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা, উচ্ছল, ঝলমলে। সরস্বতী পুজোর সন্ধেয় খুশির জোয়ারে যেন ভাসছিলো তারা।

    তখনই একপাল ঝকমকে ছেলেমেয়েদের মাঝে বড্ড বেমানান ভাবে এসে দাঁড়ালো সে শান্তার সামনে।

    — "আরে তুমি এখানে? আজকের দিনে এমন সন্ধেবেলায় এখানে একা একা বসে বসে কি করছো? নাকি কেউ সঙ্গে আছে এদিক-সেদিক? আর থাকলেও তুমি বলবে নাকি সে কথা? ঠিক বলেছি কিনা?" নিজে থেকেই বলতে শুরু করেছিলো সে। শান্তা কিছু না বলে সামান্য হেসে তাকিয়েছিলো তার দিকে।

    — "চকলেট খাবে? অস্ট্রেলিয়া থেকে এনেছে আমার ভাইঝি। খাওনা একটা? ডায়েটিং করছো? নাকি নেবে না আমার থেকে?" কাধেঁর ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিলো সে। শান্তা কোনো উত্তর না দিয়ে মুখে হাসিটা রেখেই মাথাটা সামান্য নীচু করেছিলো।

    — "আচ্ছা শান্তা তুমি আমায় দেখলে এমন আড়ষ্ট হয়ে থাকো কেন বলো তো? আমরা তো এককালে খুব কাছের মানুষ ছিলাম তাই না?" শান্তার মুখের দিকে একটু ত্যারছা ভাবে তাকিয়ে বলেছিলো সে। শান্তা কোনো উত্তর না দিয়ে দূরের আকাশের দিকে চোখ রেখেছিলো।

    —"দিল্লির সেই এগজিবিশনটার পর থেকেই তুমি এভাবে বিহেভ করতে শুরু করলে কেন বলোতো? তোমার কি ধারণা আমিই তোমায় সিলেক্টেড হতে দিইনি? তাহলে তো সেদিনই সামনাসামনিই বলতে পারতে কথাটা, কিন্তু আমি যে সবার কাছেই তোমার কাজ সিলেক্ট করার জন্যে বলেছিলাম সেটা কি জানো? মিনিস্ট্রি অফ কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের মিহিরবাবুকে, সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান শঙ্খবাবুকে, আর্ট ফোরামের পরিতোষদাকে এমনকি সুব্রতকেও? হ্যাঁ হ্যাঁ সুব্রতকেও — শুনে তোমার অবাক লাগছে তাই না?" পাশে রাখা ব্যাগটায় কিছু যেন খুঁজতে খুঁজতে বেশ ধীরেসুস্থে কথাগুলো বললো সে। কোনো উত্তর না দিয়েই শান্তা ‌একই ভাবে মুখ তুলে তাকিয়েছিলো সামনের বিরাট আকাশটার দিকে।


    —"তুমি কি ভাবছো দিল্লির হোটেলে সেই রাতের ব্যাপারটায় আমি কিছু জানতাম না? সেদিন সকাল থেকেই তো তুমি আমার সঙ্গে ছিলে, কিন্তু বিকেল হতেই কোথায় উধাও হলে। তুমি কি ভাবলে অত লোকের ভিড়ে আমি টের পাবো না? তখন তুমি সুব্রতকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে আমি কি জানতাম না নাকি? কিন্তু মনে করে দ্যাখো এরপরেও সন্ধেবেলায় যখন তুমি এলে আমি তোমার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছিলাম কিনা?" এবার শান্তার মুখের দিকে তাকিয়েই খুব আস্তে আস্তে কথাগুলো বলেছিলো সে। শান্তা মাথা নামিয়ে হাতের নখগুলোকে দেখছিলো আনমনে।

    —"এর পরেও কাশ্মীরের ঘটনাটা ভাবো তো? তোমার পছন্দের জায়গা, তোমার পছন্দের হোটেল, তোমার পছন্দের রুম, সবকিছুর একটা মাত্রা থাকা উচিত ছিলো কিনা বলো? তাও আমি কিছুই কি বলেছিলাম তোমায়? কারণ আমিই শুধু তোমায় বন্ধুত্বের জায়গাটা দিয়েছিলাম — সুব্রতর চেয়েও বেশি করে। কখনো ফিল করোনি সেটা?" কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলো সে। শান্তা এবার বলে ‌উঠতে যাচ্ছিলো পাল্টা কয়েকটি কথা, কিন্তু কি মনে করে সেই কথা গুলো যেন অতিকষ্টে গিলে ফেললো তখনই।

    —"সুব্রত বরাবরের ভালো মানুষ, কারো মুখের উপর কোনো কথা বলতে পারে না। তাই তোমার উপরেও পারেনি, আর সেটাকেই তুমি খুব বুদ্ধি করে ব্যবহার করতে শুরু করলে। সুব্রত সব জানতো কিন্তু কিচ্ছু বুঝতেই দেয়নি তোমাকে, যাতে তুমি মনে কষ্ট না পাও। কিন্তু তুমি তার বিনিময়ে কি করলে? আর এই করে কি পেলে জীবনে?" এইবার সে গলাটা সামান্য তুলে খুব কেটে কেটে বলেছিলো এই কথাগুলো। শান্তা হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো তার মুখের দিকে।

    "মানুষ তো নেহাত কম আসেনি তোমার জীবনে। যদিও ছোটবেলা থেকেই বাপ-মা মরা মেয়ে ছিলে, শুনেছি তোমার ডাক্তারমামা ছিলেন দেবতুল্য মানুষ। যে মামার বাড়িতে খেয়ে-পরে বড়ো হলে; সেই মামাবাড়ি ছেড়ে চলে গেলে। তারপর তোমাদের কলেজের সিনিয়র সুরজিৎ; তোমায় যথেষ্ট কেয়ার করতো। তার সঙ্গে কি যে হোলো তোমার। এছাড়া ওই সমীর, অচিন্ত্য, দেবতোষ এরা সবাই এসেছিলো তোমার কাছে, কিন্তু কাউকে কি ধরে রাখতে পারলে? অথচ তোমার রূপ ছিলো, গুণ ছিলো, প্রথম সারির পেন্টার হতে পারতে, কিন্তু জীবনটাকে কেন যে বেহিসেবি রাস্তায় নিয়ে গেলে। তোমার বন্ধুরা তোমাকে আড়ালে এখনকার অমৃতা শেরগিল বলতো জানো নিশ্চয়ই?" শান্তার চোখে চোখ রেখে একনাগাড়ে বলে যেতে লাগলো সে। শান্তা একটি কথার‌ও জবাব না দিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তার গাঢ় বাদামি চোখ দুটির দিকে।

    —"আমাদের বিয়েতে তুমি আসবে না ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি এসেছিলে। আমায় কেমন লাগছে দেখতে? না সুব্রতকে দেখতে?"

    —"আমার মেয়ে হওয়ার পর দেখতে এসে বলেছিলে, 'বাবার মতন সুন্দর হয়েছে'। কথাটা কি আমায় ইনসাল্ট করার জন্যে বলোনি?"

    —"লেক রোডের বাড়িতে গৃহপ্রবেশের দিন তুমি তোমার আঁকা একটা ছবি প্রেজেন্ট করেছিলে, সুব্রতদের পুরোনো বাড়িটার ছবি। কেন? তোমার সঙ্গের পুরোনো স্মৃতিগুলোকে উসকে দেওয়ার জন্যে?" যেন আগে থেকেই তৈরি করা কিছু প্রশ্ন ঝড়ের মতো এক ঝাপটায় বলে গেলো সে।

    এইসব কথাগুলোর কোনোটারই কোনো উত্তর দেয়নি শান্তা। ওকে নিরুত্তর থাকতে দেখে হঠাৎ যেন একেবারে অন্য মূর্তিতে সে আবার বলতে শুরু করেছিলো —

    —"খুব মজা লাজছে? খুব মজা লাগছে তাই না?

    —"এই ভাবে এখানে বসে থাকতে? যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না?

    —"যতো নষ্টের গোড়া। পিছন থেকে কেমন কলকাঠি নাড়তে লজ্জা করে না?

    —"দূর থেকে বিষাক্ত মাকড়সার মতো জাল বিছোচ্ছো, ভাবছো আমি টের পাচ্ছি না?

    —"তোমার জন্যে — হ্যাঁ হ্যাঁ — তোমার জন্যে ও আমার মেয়ের নাম রাখলো বিভাবতী। একটা যাচ্ছেতাই সেকেলে নাম। পরে জেনেছিলাম ওটা নাকি তোমারই আসল নাম।

    —"ইন্ডোর প্ল্যান্ট আমার দুচক্ষের বিষ, তাও ঘর জুড়ে ওই গাছপালাগুলো রাখতে হয়, কারণ তোমার পছন্দের জিনিস।

    —"পাহাড়ে উঠলেই আমার ভয়ভয় করে, শীত আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। বিয়ের পর সুব্রত আমায় ওই পাহাড়েই নিয়ে গেলো, নিয়ে গেলো সেই কাশ্মীরেই, আর উঠলো সেই হোটেলটাতেই। কারণ তোমার যে পাহাড় পছন্দ, তোমার যে প্রিয় জায়গা ছিলো কাশ্মীর — আর ওই হোটেলটাতেই তোমরা উঠেছিলে।

    —"তোমার যে পেন্টিংটা আমাদের ড্রয়িং রুমে ও আজও টাঙিয়ে রেখেছে সেটাও ওই কাশ্মীরের হোটেলের বাইরের ল্যান্ডস্কেপ —তা কি বুঝিনি আমি? এই ভাবে তুমি আমার জীবনের প্রতিটি ব্যাপারে দূর থেকে বিষ ছুঁড়ে যাচ্ছো —ভাবছো আমি কিছুই বুঝছি না, তাই না? দূরে গিয়েও নিশ্চুপে সাপের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছো তা কি আমি দেখছি না ভেবেছো?"

    শান্তা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো ওর পরের এই কথাগুলোতে। তারপর শান্তার দিকে তাকিয়ে কেমন অচেনা ফ্যাসফ্যাসে গলায় সে বলেছিলো —

    — "কিন্তু এতো করেও কি হোলো শেষ পর্যন্ত জানো?

    — "ঠিক এখনই — এই সময় ও কি করছে জানো?

    —"ও এখন আমার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করে আছে।

    — "আমি না আসা অবধি চা টা খাবে না।

    — "সেই প্রথমদিনটার মতোই আজও বসে থাকে।

    —"কতোটা পাগলের মতো ও আমাকে ভালোবাসে ভাবতে পারো?"

    তারপর একটু থেমে বলে উঠলো —

    —"তাহলে?

    —"তাহলে শেষটায় কি দাঁড়ালো বলোতো?

    —"কে জিতলো সবশেষে?"— বলেই কেমন একটা অদ্ভুতদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো শান্তার মুখের দিকে। তারপর হঠাৎই উঠে পড়েছিলো। তারপর শান্তার অস্তিত্বটাকেই যেন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছিলো সামনের লোকজনের মধ্য দিয়ে।

    সমস্ত ঘটনাটায় শান্তা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময় শান্তার মাথায় পাক খাচ্ছিলো সুব্রত এবং সুব্রতর আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার মুহূর্তগুলো। মনে পড়ছিলো বিগত কয়েকটি বছরের সমস্ত ঘটনাগুলো —

    সুব্রত... সুব্রত সেন... বিখ্যাত ডাক্তার সুশীল সেনের ছেলে... রীতিমতো সুদর্শন ও সম্ভ্রান্ত ... আর্ট কলেজে কৃষ্ণার তিন বছরের সিনিয়র... ট্যালেন্টেড আর্টিস্ট... কিন্তু অত্যন্ত বোহেমিয়ান টাইপের... অথচ মনটা ছিলো শিশুর মতো... বন্ধুদের খুব প্রিয়... শান্তার সঙ্গে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলো... কিন্তু পুলিশের বড়কর্তার এই মেয়েটির সঙ্গে একটা ঘটনায় জড়িয়ে গিয়েছিলো... যার সুযোগ নিয়ে মেয়েটি বাধ্য করেছিলো তাকে বিয়ে করতে...

    এরপর মেয়েটির মারাত্মক সন্দেহপ্রবণতা আর বদমেজাজের জন্য সব বন্ধুরা একে একে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সুব্রতকে। শুধু শান্তা ছাড়া। কিন্তু তাকেও একদিন চলে যেতে হয়েছিলো সুব্রতর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে, ওই মেয়েটির দেওয়া একটি সম্পূর্ণ মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে্‌ নিশ্চুপে। শুধুমাত্র সুব্রতর শরীরস্বাস্থ্যের কথা ভেবে, কারণ ততদিনে সাংঘাতিক ডিপ্রেশনে পড়ে সুব্রত পুরোপুরি অ্যালকোহলিক আর হাই প্রেশারের রুগী...

    এই মেয়েটির উৎকট ব্যবহারের জন্যে অ্যাড এজেন্সির ভালো চাকরিটা যাওয়ার পর পুরোপুরি বাড়িতে আইসোলেটেড হয়ে গেলো সুব্রত...

    মাসছয়েক আগে একবার ফোন করে বলেছিলো, "শান্তা — কয়েকটা ছবি বিক্রির বন্দোবস্ত করে দেবে? ওই গণেশ আর বিষ্ণুর ছবি দুটো ভাবছি..."

    শান্তা জানতো তেলরঙে আঁকা ওই অসাধারণ ছবিদুটো ছিলো সুব্রতর প্রাণের চেয়ে প্রিয়... তাই কাউকে না জানিয়ে নিজের মামাতো দাদাকে পাঠিয়ে ছবি দুটো নিজেই কিনে নিয়ে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে একা ঘরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো শান্তা।

    এই রকম হাজারো কথা, অনেক ছবি একের পর এক ঢেউয়ের মতো ভেসে আসছিলো শান্তার সামনে।

    এরপরই শান্তার মনে হোলো এতো অজস্র মিথ্যের জাল বুনে কি লাভ হোলো এই মহিলাটির? এইভাবে সমস্ত মনগড়া কথা সাজিয়ে গুজিয়ে বলে কি দেখাতে চাইছে ও? ওর প্রতিটি কথাকে চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা কথাগুলো শোনালে ওর আর মুখ থাকবে? পুরোনো ঘটনাগুলো আর ঘাঁটতে চায় না বলেই চুপ করেছিলো সে।

    তারপর দূরের ঝলমলে আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে শান্তার মনে হয়েছিলো এমন সুন্দর সন্ধেটায় হঠাৎ করে একটা মিথ্যের নোংরা বোঝা কেন যে সামনে এসে হাজির হয়েছিলো কে জানে।


    * * *


    সময় অলক্ষ্যেই দ্রুতগামী।

    তাই শান্তা রায়ের জীবনের আরো বছর দশেক যেন সহজেই স্বল্পকালে পার হয়ে যায়।

    এখন এই আর্ট কলেজের অধ্যাপিকা শান্তা আবার এসে বসে আছে ওই রবীন্দ্রসদনের কাছেই।

    অ্যাকাডেমী অফ ফাইন আর্টসের গেটের সামনে।

    দোলের পরদিন — এক বিস্তীর্ণ বিকেল।

    এক উঠতি চিত্রকরের চিত্রপ্রদর্শনী সাউথ গ্যালারিতে। শান্তা সেখানেই আমন্ত্রিত। ক্যানভাস জুড়ে অসংখ্য চড়া রঙের দাপাদাপি। চোখ দুটোকে ঠান্ডা করার জন্য বাইরে এসেছে শান্তা। এসে বসেছে গেটের মুখের ফোয়ারাটার পাশে। সামনে অল্পবয়সী কিছু ছেলেমেয়েদের জটলা। তার‌ই মাঝে শান্তার হঠাৎ চোখ আটকে গেছে একজনের দিকে। মনে হচ্ছে যা দেখছে তা সত্যি না চোখের ভুল!

    —"আরে! শান্তা! তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো? এমন চমৎকার বিকেলে? আমার মতো বেরিয়ে পড়তে পারো না?" — অর্থাৎ নির্ভুলভাবে সে-ই।

    পরনে গাঢ় হলুদ শাড়ি, চুলটা আগের মতোই মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধা। চোখের কোলে কালি, গালদুটো তুবড়ে গেছে, গায়ের ফরসা রঙটা যেন ক্যানভাসের মতো ফ্যাটফ্যাটে সাদা। ঠিক দশবছর আগের মতোই শুরু হোলো তার কথার স্রোত।

    — "আমি এখনো কিভাবে ঘুরে বেড়াই দেখছো তো?

    — "অভ্যেসটা অবশ্য সুব্রতই করিয়ে দিয়েছিলো।

    —”ও তো প্রচণ্ড ঘুরতে ভালোবাসতো।

    — "বিয়ের পর আমরা বছরে দুবার তো বেরোতামই।

    —"আর সেই বিদেশে গিয়েই — জানতে পেরেছিলে নিশ্চয়ই খবরটা।

    —"কিন্তু জানো তো সুব্রত কোনো কষ্ট পায়নি। ঘুমের মধ্যেই ম্যাসিভ অ্যাটাক, দশটা মিনিটও সময় দেয়নি।

    — "এটা তো আমি মনে করি ভগবানের বিরাট আশীর্বাদ।

    —"লাইফটা রাজার মতো কাটিয়ে ছিলো, আর রাজার মতোই চলে গেলো।

    —”তাই আমার কোনো দুঃখ নেই; বরং ‌‌‌একটু স্বস্তি‌ই আছে। শুনে অবাক হচ্ছো। তাই না?

    —”মনে করো তো আমি যদি ওর আগে চলে যেতাম তো কি হোতো ওর? কে দেখতো ওকে?"

    .....সেই একই কথা বলার ভঙ্গি — এক‌ই ভাবে কথা বলতে বলতে তেরছে তাকানো — এক‌ই ভাবে সামনের মানুষটির অস্তিত্বটাকেই যেন অগ্রাহ্য করে নিজের মনে বলে যাওয়া ....শান্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলো তার দিকে।

    —"আসলে সুব্রতর সঙ্গে আমার বন্ডিংটা যে লেভেলে ছিলো তা তুমি বুঝবে কি করে? মনে আছে দিল্লিতে — ডক্টর রাঘবন, আমাদের পাশের ঘরটায় উঠেছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন — 'ইউ আর মেড ফর ইচ আদার অন আর্থ অ্যান্ড হেভেন'। সেই ব্যাঙ্কোয়েট হলের সামনে — মনে পড়ছে তোমার? তারপর‌ই তুমি কোথায় উধাও হয়ে গেলে বলোতো? সুব্রত পরে খুব রিগ্রেট করতো এই ঘটনায়...

    — "বেসিক্যালি সুব্রত খুব খোলা মনের মানুষ ছিলো তো, সেই জন্যে অনেকেই ওকে ভুল বুঝতো। এই ভুলটা তো তুমিই সবচাইতে বেশি করেছিলে, তাই না? সুব্রত‌ই কিন্তু পরে আমায় বলেছিলো সব ঘটনা...

    —"বাদ দাও। সব পুরোনো কথা। আমার হাতের এই বালাটা দ্যাখো, কি রকম দেখতে বলো তো? এই রকম প্যাটার্ন আগে কখনো দ্যাখোনি তো? দেখবে কোত্থেকে? এটাতো সুব্রত বানিয়ে দিয়েছিলো ইটালিয়ান ফ্যাশন ম্যাগাজিনের ছবি থেকে। সাহা জুয়েলারির সেরা কারিগরকে দিয়ে....

    —”এই সন্ধের মুখটায় আমি খুব মিস করি সুব্রতকে, এইসময়টাতেই নিজে হাতে চা তৈরি করে বারান্দায় বসে থাকতো...

    — “আসলে সুব্রতর ভেতর যে ছেলেমানুষিটা ছিলো, আমার জন্যে সেটা...

    — "একনম্বর অ্যাড এজেন্সির টপমোস্ট পার্সন হয়েও সুব্রত...

    — "মিস করছি এখন — কেয়ারিং হ্যান্ডস, সুব্রতর।

    — "যে ইন্টেলেকচুয়াল লেভেলে সুব্রত..."

    কথাগুলো ক্রমশ অর্থহীন আকারহীন হয়ে ভেসে যাচ্ছে শান্তার উপর দিয়ে।

    শান্তা নির্বাক হয়ে বসে রয়েছে যেন একটা সাদা ক্যানভাসের সামনে।

    কারণ ওই মুখর মহিলাটি যেভাবে হঠাৎ এসেছে সেভাবেই হঠাৎ উঠে চলে যাচ্ছে, কিংবা মিলিয়ে যাচ্ছে সামনের মানুষজনের মাঝে...

    আর ঠিক তখনই শান্তা দেখতে পাচ্ছে —

    এক মিথ্যার চলন্ত বোঝাকে।

    হ্যাঁ একটা আস্ত বোঝা।

    যার ভিতর ঠাসা আছে গাদাগাদা বানানো ঘটনা —

    কোনো এক প্রয়াত সুব্রত সেনের জীবনকে নিয়ে সোনায় মোড়া সব কথাবার্তা।

    যার সঙ্গে বাস্তবের সুব্রত সেনের কোনো মিল নেই ।


    * * *


    একজন বোহেমিয়ান অ্যালকোহলিক সাসপেন্ডেড আর্ট ডিরেক্টর মারা যাবার পর তার ভস্মশেষ কোন নালায় ভেসে যায় —

    কিংবা বছর ঘুরলে তার ছয় বাই আট ফ্রেমবন্দী চন্দনচাপানো মুখখানা কোথায় কোন জঞ্জালে কাৎ হয়ে থাকে। তার খোঁজ কে নিতে যায়?

    অথচ এই তার এই মলিন জীবনসঙ্গিনীটি কি নিষ্ঠার সঙ্গে বয়ে চলেছেন তার পরমযত্নে তৈরি করা একঝুড়ি মিথ্যের বোঝা —

    যেখানে সময়কে তুচ্ছ করে বড়ো উজ্জ্বল হয়ে আছে সুব্রত সেন নামের একজনের অস্তিত্ব — এটা শিবসত্য।

    এইবার শান্তা দেখতে পাচ্ছে সেই সত্যশিব কিংবা অপূর্ব মিথ্যামূর্তিটিকে — যাকে পরমযত্নে ওই অধন্যা নারীটি....


    (বিখ্যাত সুইডিশ নাট্যকার অগস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের একাঙ্ক নাটিকা : 'দ্য স্ট্রঙ্গার' এর দ্বারা প্রাণিত।)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ : অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments