• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গল্প
    Share
  • জাহিরের কাহিনি : হর্হে লুইস বোর্হেস, স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ: অ্যান্ড্রু হার্লি
    translated from English to Bengali by অংকুর সাহা


    বুয়েনোস আইরেস শহরে জাহির হ’ল কুড়ি সেন্তাভোর এক সাধারণ মুদ্রা যার গায়ে কেউ ক্ষুর অথবা ছুরি দিয়ে খোদাই করেছে দুটি বর্ণ — ‘এন’ এবং ‘টি’, আর তার পাশে ‘২’ সংখ্যাটি। (গুজরাতে অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাপ্তি কাল নাগাদ ছিল জাহির নামের এক বাঘ; জাভা দ্বীপে সে ছিল সুরকর্তা মসজিদের এক বেচারা অন্ধ, ধার্মিকেরা পাথর ছুঁড়ে তাকে হত্যা করে; পারস্যে সে ছিল এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর প্রিয় উপকরণ, নাদির শাহের আদেশে তাকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়; ১৮৯২ সালে মাহদির জেলখানায় সে ছিল নাবিকের ক্ষুদ্র কমপাস, পাগড়ি থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একচিলতে কাপড়ে যত্ন করে মোড়া, রুডলফ কার্ল ভন স্লাটেন যা স্পর্শ করেছিলেন; কর্ডোবার সিনাগগে, জোটেনবার্গের বিবরণ অনুযায়ী, বারোশ’ স্তম্ভের মধ্যে একটির মার্বেল পাথরের শিরা; তেতুয়ানের বস্তিতে এক কুয়োর তলদেশ।) আজ নভেম্বর মাসের তের তারিখ, গত সাতই জুনের ভোরবেলায় জাহির এসেছিল আমার হাতে, আমি এখন যে মানুষ, তখন তা অবশ্যই ছিলাম না, কিন্তু এখনও মনে আছে এবং চেষ্টা করলে হয়ত বলতেও পারব কী ঘটেছিল। আমি এখনও, অন্তত অংশত হলেও, বোর্হেস।

    জুন মাসের ছ’ তারিখে তেওডেলিনা ভিয়ারের মৃত্যু ঘটে। সেই ১৯৩০ সালে তাঁর ছবি ছড়ানো থাকত পৃথিবীর নানা পত্রপত্রিকার পাতায়; সেই সর্বচারীতার একটা বড় কারণ ছিল তাঁর অপার সৌন্দর্য, যদিও প্রতিটি ছবিতেই তার শর্তহীন প্রমাণ রয়েছে, এমন কথা বললে ভুল হবে। কিন্তু সে কথা যাক — সৌন্দর্যের চেয়েও তেওডেলিনার বেশি চিন্তা ছিল পরিপূর্ণতা নিয়ে। চিনে এবং ইহুদিরা যে কোন মানব পরিস্থিতিকেই আইনগতভাবে বিধিবদ্ধ করেছেন। ইহুদি ধর্মপুস্তক মিশনাতে বলা হয়েছে যে পবিত্র বিশ্রাম দিবস স্যাবাথের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে কোন দর্জির ছুঁচ হাতে রাস্তায় বেরুনো নিষেধ; কনফুসিয়াসের নিয়ম-পুস্তক আমাদের জানায় যে অতিথি যখন প্রথম পানীয়ের গেলাস হাতে নেবেন, তার মুখ থাকবে গম্ভীর, কিন্তু দ্বিতীয়বার তাঁকে হতে হবে সম্ভ্রমময়, অথচ হাসিখুশি। যে কঠোর নিয়মাবলীর বাঁধনে তেওডেলিনা নিজের জীবনকে বেঁধেছিলেন, তাও ছিল অনুরূপ, কিন্তু আরও বেশি সযত্ন এবং বিশদ। তালমুদপন্থী এবং কনফুসিয়াসবাদীদের মতনই তিনি চেষ্টা করে যেতেন যাতে তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মই হয় ত্রুটিশূন্যভাবে নীতিসম্মত; কিন্তু তাঁর কর্তব্যকর্ম ছিল অন্য দুই গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি প্রশংসনীয় এবং কঠিন, কারণ তাঁর জীবনযাত্রার নিয়মকানুন চিরন্তন নয়, বরং প্যারিস এবং হলিউডের খামখেয়ালের ওপরে নির্ভরশীল। তেওডেলিনা ভিয়ারকে প্রথাসম্মত স্থানে, প্রথাসম্মত সময়ে, প্রথাসম্মত সাজপোষাকে হাজির হতে হবে প্রথাসম্মত জীবন-বিতৃষ্ণার ভাবভঙ্গি সমেত; কিন্তু সেই জীবন-বিতৃষ্ণা, সেই সাজপোষাক, সেই সময় এবং সেই স্থানগুলি প্রায় সেই মুহূর্তেই আর ফ্যাশনসম্মত থাকবে না, এবং হয়ে দাঁড়াবে (এমনকী তেওডেলিনা ভিয়ারের নিজের মুখেই) ক্যাটক্যাটে অতিসজ্জার উদাহরণ। ফ্লবের-এর মতনই তিনি সর্বাঙ্গসুন্দর পরমের সন্ধান করতেন, কিন্তু সে পরম স্বল্পজীবী। তাঁর জীবন অবশ্যই অনুকরণযোগ্য, অথচ এক অন্তঃস্থ মরিয়া আশাহীনতা ভেতর থেকে সর্বদা কুরে কুরে খেত তাঁকে। অন্তহীন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তাঁর যাত্রা, যেন নিজের কাছ থেকেই ভয়ে পালিয়ে যাওয়া; তাঁর খোঁপা এবং চুলের রঙ-এর ছিল বিখ্যাত ক্ষণস্থায়ীত্ব, তাঁর হাসি, তাঁর ত্বক, তাঁর তীর্যক দৃষ্টিরও তাই। ১৯৩২ সালের পরে তিনি অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন রোগা হওয়ার জন্যে... যুদ্ধের সময় নানা চিন্তা ভাবনাও এসে হাজির তাঁর মনে। প্যারিস যখন জার্মানদের অধিকারে, তখন তার ফ্যাশন বজায় রাখার উপায় কী? একজন বিদেশি ব্যবসায়ী, যার বিষয়ে তাঁর প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল — সে তাঁর ভালমানুষির সুযোগ নিয়ে তাঁকে গছায় বেশ কয়েকটি স্টোভপাইপের আকারে নির্মিত টুপি। এক বছর না পেরোতেই জানা যায় যে প্যারিসে কস্মিনকালেও কেউ অমন হাস্যকর আকারের পোষাক ছোঁবেও না এবং সেই কারণে সেগুলো কোন ফ্যাশনসম্মত টুপিও না, সেগুলো অস্বীকৃত খামখেয়াল। সেখানে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না। ডঃ ভিয়ার বাধ্য হলেন বাসা বদল করে কাইয়ে আরাওস অঞ্চলে উঠে যেতে এবং তাঁর কন্যার ছবি বেরুতে থাকে মুখে মাখার ক্রিম এবং মোটরগাড়ির বিজ্ঞাপনে — যে ক্রিম তিনি কোনদিন ভুলেও ব্যবহার করবেন না আর যে গাড়ি কেনার পয়সা তাঁদের নেই। তেওডেলিনা ভাল করেই জানতেন যে তাঁর শিল্পকর্মের যথার্থ অনুশীলনের জন্যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, তাই তিনি পিছু হঠলেন, কিন্তু পরাজয় স্বীকার করলেন না। এ ছাড়া — নিছক অলীক নারীদের সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নই ওঠে না। আরাওসের অশুভ অ্যাপার্টমেন্ট তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না; জুন মাসের ছ’তারিখে তিনি স্বভাবসিদ্ধ শিষ্টাচার ভঙ্গ করে বারিও সুরের রাস্তায় মৃত্যুবরণ করলেন। আর্হেন্তিনার সবচেয়ে আন্তরিকতাময় উদ্দীপন অর্থাৎ চালিয়াতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমি স্বীকার করতে চাই, আমি তাঁর প্রেমে মুগ্ধ ছিলাম এবং আমার দু চোখ জলে ভরেছিল তাঁর মৃত্যুসংবাদে! খুব সম্ভবত: পাঠকেরা একথা বুঝতে পেরে গেছেন অনেক আগেই।

    শেষকৃত্যের সমসময়ে, ক্রমাগত পচনের ফলে মৃতদেহ ফিরে পায় তার পূর্বের মুখচ্ছবি। ৬ জুন রাত্তিরের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে কোন এক মুহূর্তে তেওডেলিনা ভিয়ার অলৌকিকভাবে ফিরে পান তাঁর কুড়ি বছর আগের অস্তিত্ব; তাঁর অবয়ব পুনরুদ্ধার করে সেই কর্ত্বত্ব, যা ঔদ্ধত্য, ধনসম্পদ, যৌবন, সমাজের উপরিভাগে অবস্থান বিষয়ে অবগত করা বিধিনিষেধ, কল্পনাশক্তির খরা এবং ভাবলেশহীনতার থেকেই পাওয়া সম্ভব। আমার মনের ভাবনাগুলো ছিল অনেকটা এইরকম: ওই মুখমণ্ডলের অন্য কোন সংস্করণই আজকের মত আমাকে বিভ্রান্ত করবে না অথবা এমন চিরস্মরণীয় হয়ে উঠবে না। সত্যি কথা বলতে কী, এটাই প্রথম এবং একই সঙ্গে অন্তিম মোলাকাত। আমি তাঁর ক্রমাগত কঠিন হতে থাকা মৃতদেহকে রেখে এলাম পুষ্পস্তবকের রাশির মধ্যে — পৃথিবীর প্রতি তাঁর যে ঘৃণা বেড়েই চলেছিল দিনের পর দিন, মৃত্যুর মধ্যে তা পেয়েছে পরিপূর্ণতা। যখন আমি রাস্তায় পা রাখলাম, রাত তখন হবে প্রায় দুটো। বাইরে পূর্বনির্ধারিত একতলা আর দোতলা বাড়িঘরের সারি নৈর্ব্যক্তিক দাঁড়িয়ে, সাধারণত রাতের বেলার অন্ধকার এবং নির্জনতার সরলতায় যেমন হয়। এক ব্যক্তিসম্পর্কহীন করুণায় নেশাগ্রস্ত, আমি রাস্তা ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকি। চিলে এবং তাকুয়ারি — এই দুই রাস্তার মোড়ে এক পানশালা এবং মুদির দোকান। আমার দুর্ভাগ্য যে সেখানে বসে তিনজন লোক তাস খেলায় মত্ত।

    অলংকারবিদ্যার একটি মানসরূপের নাম বিরোধালংকার অথবা অক্সিমোরন — বিশেষ্যর সঙ্গে এমন একটি বিশেষণ জুড়ে দেওয়া যা মূল বিশেষ্যর সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমন অধ্যাত্মরহস্যবাদীরা বলেন “অন্ধকার আলো”-র কথা এবং অপরসায়ণবিদেরা বলেন “কালো সূর্যের” কথা। তেওডেলিনা ভিয়ারের থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেওয়া এবং রাস্তার মোড়ে পানশালা ও মুদির দোকানে বসে এক গেলাস কড়া ব্র্যান্ডি সেবনও এক ধরনের বিরোধালংকার: ঘটনাটির মধ্যে একই সঙ্গে স্থূলতা ও সাবলীলতা দেখেই আমার লোভ হয়েছিল। (এবং একই জায়গায় লোকগুলোর তাস খেলা চলছিল বলে ঘটনাটির বৈসাদৃশ্য বাড়ে।) আমি দোকানদারকে বলি এক গেলাস ব্র্যান্ডি আর কমলালেবুর রস দিতে; ফেরত খুচরো পয়সার মধ্যে ছিল সেই জাহির; আমি তার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই রাস্তায় নামি এবং মনে হয় জ্বর আসছে আমার। পৃথিবীতে এমন কোন মুদ্রা নেই যা ইতিহাস এবং লোকগাথার অন্তহীন স্রোতকে আলোকিত করে যে মুদ্রারাশি, তার অন্যতম প্রতীক নয়! আমি ভাবতে বসি অনেক বিচিত্র কথা — গ্রিক পুরানের শেষ পারানির খেয়ার মাঝি কারণের জন্য ওবোলাস মুদ্রা: বাইজ্যানটাইন সম্রাট ফ্লাভিয়াস বেলিসারিয়াস (খ্রীঃ ৫০০ - ৫৬৫) অন্ধ হবার পর যে রৌপ্য মুদ্রার জন্যে ভিক্ষে করতেন; জুদাসের তিরিশ টুকরো রূপো; করিন্থের রূপসী রাজনর্তকী লাইসের জন্য অজস্র দ্রাখ্‌মা মুদ্রা; ইভেসিয়ার সাতজন মূর্তিপূজাবিরোধী সন্ত তিনশো ষাট বছরের নিদ্রার পরে ঘুম ভেঙ্গে রুটি কিনতে যান প্রাচীন মুদ্রার বিনিময়ে; এক সহস্র এক আরব্য রজনীর যাদুকরের ঝকঝকে মুদ্রাগুলি রূপান্তরিত হয় কাগজের চাকতিতে; ভ্রাম্যমান ইহুদি পথিক আইজ্যাক লাকেডেমের অজস্র রোমান মুদ্রা দেনারিয়াস; পারস্যের কবি ফিরদৌসিকে সম্রাট দিয়েছিলেন ষাট সহস্র মুদ্রা — মহাকাব্যের প্রতিটি পংক্তির জন্যে একটি করে মুদ্রা — কিন্তু কবি সেগুলি ফিরিয়ে দেন কারণ মুদ্রাগুলি সোনার নয় রূপোর; আহাব তাঁর জাহাজের মাস্তুলে পেরেক মেরে রোমান স্বর্ণমুদ্রা ডাবলুনকে আটকে দিয়েছিলেন; লেওপোল্ড ব্লুমের আর-ফিরে-না-আসা ফ্লোরিন মুদ্রা; পলাতক সম্রাট চতুর্দশ লুইকে ধরিয়ে দিয়েছিল যে বিশ্বাসঘাতক স্বর্ণমুদ্রা। ঠিক যেমন কোন স্বপ্নের ভিতরে প্রবেশ করার পর মনে হবে — যে কোন একটি মুদ্রার মধ্যে মানুষ দেখতে পায় এই সব সুখ্যাত অনুষঙ্গগুলিকে — পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে বিশাল এবং ব্যাখ্যার অতীত জরুরি। আমি হেঁটে চলি, পদচারণার বেগ বাড়ে ক্রমশ জনমনুষ্যহীন রাস্তা এবং হাটবাজারের মধ্যে দিয়ে। আমার চোখ গিয়ে থামে দুর্দশাগ্রস্ত, লৌহনির্মিত বেষ্টনীতে; তার ওপারে লা কনসেপসিওন গির্জার শাদা কালো টাইল বসানো চত্বর। অর্থাৎ আমি গোল হয়ে এক চক্কর ঘুরে এসেছি — যে কোণের দোকানে আমি জাহির পেয়েছিলাম, এখন আবার পৌঁছে গেছি তার মাত্র এক ব্লক দূরে।

    আমি চকের মাথায় পৌঁছে দেখি দূরে সেই পথের প্রান্তে তীর্যক ঢালু ফুট-পাথ জুড়ে অন্ধকার — অর্থাৎ দোকানটি বন্ধ হয়েছে আজকের মত। বেলগ্রানোতে পৌঁছে আমি ট্যাক্সি ধরি। নিশি পাওয়া মানুষের মতন, চোখে এক বিন্দু ঘুম নেই, প্রায়-সুখী, আমি ভেবে দেখি যে টাকা পয়সার চেয়ে কম বৈষয়িক আর কিছু নেই, কারণ যে কোন মুদ্রাই (ধরা যাক কুড়ি সেন্তাভোর মুদ্রাকেই) সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ঝলমলে সাজ পরে থাকে। ‘অর্থ এক বিমূর্ত বিষয়’, আমি বার বার বলি, ‘অর্থ হ’ল ভবিষ্যৎ সময়ের মূল্য’। হয়ত শহর থেকে দূরে অতিবাহিত একটা সন্ধে, অথবা ব্রাম্‌স্‌ এর এক সঙ্গীত, তাস অথবা দাবা খেলা, কফি পান, অথবা এপিকটেটাসের বাণী, যা আমাদের ঘৃণা করতে শেখায় স্বর্ণমুদ্রাকে। ফারস দ্বীপের গ্রিক দেবতা প্রোটিয়াসের চেয়েও আরও ঘন ঘন পরিবর্তনশীল কোন বহু-রূপী এই মুদ্রা। এটা ভবিষ্যতের অজানা কোন সময়, বার্গসঁ-এর সময়কাল, ইসলাম ধর্মের শক্ত, কঠিন, কঠোর সময় অথবা গাড়িবারান্দা নয়। পৃথিবীতে কোন সম্ভাব্য ঘটনা ঘটতে পারে অর্থাৎ ঘটলেও ঘটা সম্ভব; যে কোন মুদ্রা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতীক। (তখনও আমার মনে কোন সন্দেহ আসেনি যে চিন্তাভাবনা গুলো আসলে জাহিরের বিরুদ্ধে চতুর প্রতারণা এবং তার শয়তানী প্রভাবের উদাহরণস্বরূপ।) দীর্ঘ এবং নাছোড়বান্দা আনমনা ভাবনার পরে ঘুম এসে যায়, কিন্তু স্বপ্নে দেখি আমি এক মুদ্রার স্তূপ, যাকে পাহারা দেয় এক গ্রিফন।

    পরের দিন আমি সিদ্ধান্ত করি যে মাতাল হওয়া প্রয়োজন। আরও সিদ্ধান্ত করি যে মুদ্রাটির জন্যে আমার এত দুর্গতি, তার হাত থেকে মুক্তি পেতে হবে। তাকিয়ে দেখি মুদ্রাটির দিকে — গায়ের আঁচড়গুলি ছাড়া তার আর কোন বিশেষত্ব চোখে পড়ে না। হয়তো মাটিতে পুঁতে ফেলা বা লাইব্রেরির এক কোণে লুকিয়ে রাখাই ছিল সমীচীন, কিন্তু আমি চাই কক্ষপথ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি অর্থাৎ পছন্দ করি তাকে হারিয়ে ফেলা। কিন্তু আমি না গেলাম পিলারের ব্যাসিলিকায়, না গেলাম সমাধিক্ষেত্রে; সাবওয়ে ধরে রওনা দিলাম কনসটিটিউসিওনের দিকে এবং সেখান থেকে সান হুয়ান হয়ে বোয়েদা। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে নামি উরকুইসা স্টেশানে; প্রথমে হাঁটি পশ্চিমে, তারপর দক্ষিণে, একবার বাঁদিকে ঘুরি, একবার ডানদিকে — যখনই কোন পথের বাঁক আসে — যাকে বলে উদ্দেশ্যমূলক লক্ষ্যহীনতা এবং এমন একটা রাস্তায় পৌঁছে — যে রাস্তা আমার চোখে অন্য যে কোন রাস্তার মতনই — আমি একটা পানশালায় ঢুকি, ব্র্যান্ডির অর্ডার দিই আর জাহির দিয়ে দাম মেটাই। আধবোজা চোখে, এমনকী কালো চশমার পেছন থেকেও আমি দেখার চেষ্টা করি না কোন কোন বাড়ির নম্বর অথবা রাস্তার নাম। সেই রাতে আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে গভীর নিদ্রায়।

    জুন মাসের শেষ পর্যন্ত নিজেকে ব্যস্ত রাখি উদ্ভট, আজগুবি এক গল্প লিখে। গল্পের মধ্যে দু-তিনটে জায়গায় থাকে হেঁয়ালিভরা বাগাড়ম্বর — “রক্ত” না লিখে লিখি “তরবারি-তরল” এবং “সোনা’-র বদলে “ড্রাগন-শয্যা” — দুটো উদাহরণ; গল্পটি রচিত হয় উত্তম পুরুষে। গল্পের কথক এক সংসারত্যাগী তাপস, মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনরকম আদানপ্রদান নেই, তিনি বাস করেন, বলতে গেলে, এক নির্জন জলাভূমির ধারে (স্থানটির নাম গ্নিটাহাইড্‌র্‌।) তাঁর সরল এবং আপাপবিদ্ধ জীবনযাপনের জন্যে সবাই তাঁকে ভাবে দেবদূত; এক ধরনের দয়ালু অতিরঞ্জন, কারণ কেউই প্রকৃত প্রস্তাবে পাপমুক্ত নন — তিনি নিজেই (উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে) তাঁর বাবার গলা কেটেছেন, যদিও এ কথাটাও সত্যি যে তাঁর পিতা ছিলেন এক খ্যাতনামা যাদুকর এবং যাদুর সাহায্য অন্যায়ভাবে অসীম ধনরত্ন সংগ্রহ করেছিলেন। কাহিনির কথক তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের সর্বভূক লোভের হাত থেকে সেই ধনরত্নের রক্ষায়; দিন রাত্তির তিনি থাকেন তার পাহারায়। শিগ্‌গির, হয়ত: ভীষণ শিগ্‌গির অবসান ঘটতে চলেছে সেই অতন্দ্র পর্যবেক্ষণের: নক্ষত্রদের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছেন যে তরবারি ছিন্ন করবে তাকে, তা বানানো হয়ে গেছে কামারশালা (তরবারির নাম ‘গ্রাম’)। ক্রমবর্ধমান বিকৃত শৈলীর অবলম্বনে, কথক প্রশংসা করে যান তাঁর শরীরের উজ্জ্বল দ্যুতি এবং নমনীয়তার; কোন একটি অনুচ্ছেদে চটজলদি উল্লেখ করা হয় ‘দাঁড়িপাল্লার' কথা; অন্য এক অনুচ্ছেদে বলে পাহারা দেওয়া ধনরত্নের মধ্যে রয়েছে লাল পাথরের আংটিগুলি এবং অনেক ঝকমকে স্বর্ণালংকার। অন্তিমে এসে বোঝা যায় যে যোগী তাপস আসলে ফাফ্‌নির নামক সরীসৃপ এবং যে ধনরত্নের ওপরে সে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোয়, তাও সেই একই আইসল্যান্ডের রূপকথার নিবেলুংগেনের স্বর্ণসম্ভার। শেষ পর্যন্ত সিগার্ড নামক বীর যোদ্ধার আবির্ভাবে হঠাৎই শেষ হয়ে যায় কাহিনি।

    আগেই বলেছি যে এই অকিঞ্চিৎকর, আজগুবি কাহিনিটি রচনা করে (লেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি অনায়াসে, ছদ্মপাণ্ডিত্যের ভান করে ঢুকিয়ে দিয়েছি ‘ফাফনিসমাল’ লোকগাথা থেকে কয়েকটি পংক্তি) আমি সক্ষম হয়েছি ওই জাহির মুদ্রার ভাবনা আমার মন থেকে মুছে ফেলতে। অনেক রাত্রে এমনও হয়েছে যে বিষয়টি ভুলে যাবার ব্যাপারে আমি এতটাই নিশ্চিত, যে আবার তা ইচ্ছাকৃতভাবে স্মরণে এসেছে আমার। সত্যি কথাটা হলো যে ওই মুহূর্তগুলির অপব্যবহার করেছি আমি; ঘটনাগুলো মনে পড়তে শুরু করা অনেক সহজ তাকে বন্ধ করার প্রচেষ্টার থেকে। নিজেকে একই কথা বার বার বলা নিরর্থক যে ওই হতচ্ছাড়া নিকেল ধাতুর চাকতিটির সঙ্গে ওই রকম আরও অসংখ্য, অবিকল, নির্দোষ চাকতির কোন তফাৎই নেই — তার মানুষজনের হাত থেকে হাতে ফেরে প্রতিদিন। কথাটা বিবেচনা করে আমি অন্য কোন একটি মুদ্রার বিষয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। মনে পড়ে আরও একটি (হতাশাব্যঞ্জক) পরীক্ষার কথা — চিলের পাঁচ এবং দশ সেন্তাভোর মুদ্রা সমেত একবার এবং উরুগুয়ের দু সেন্তাভো মুদ্রা নিয়ে আরও একবার। জুলাই মাসের ষোল তারিখে সংগ্রহ করি এক পাউন্ড স্টার্লিং মুদ্রা; সারাদিন তার দিকে আমি তাকাইনি, বলতে গেলে, কিন্তু রাতে কড়া বৈদ্যুতিক আলোর নীচে আতসকাচ ব্যবহার করে আমি মুদ্রাটির পর্যবেক্ষণে মাতি। তারপর মুদ্রার গায়ে বার বার ঘষে ঘষে দেখি। সরলরেখার আলো, ড্রাগন এবং সেন্ট জর্জ কোন নতুন তথ্যই দেয় না আমাকে, মুক্তি পেতে পারি না নিজের বদ্ধমূল ধারণার হাত থেকে।

    আগস্ট মাসে সিদ্ধান্ত নিই এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার। এই আজগুবি গল্পের পুরোটা অবশ্য তাঁকে বলতে পারিনি; তাঁকে জানাই যে আমি নিয়মিত অনিদ্রায় ভুগছি এবং একটি বিশেষ বস্তুর প্রতিচ্ছবি থেকে মুক্ত করতে পারছি না আমার মনকে — যে কোন এক এলোমেলো বস্তু, ধরুন একটা মুদ্রা... অল্প কিছুদিন পরে কাইয়ে সারমিয়েন্তো অঞ্চলের এক পুস্তকালয়ে আমি উদ্ধার করি এক প্রাচীন গ্রন্থের কপি — “দস্তাবেজ ও কাহিনি — জাহিরের ইতিহাস” (ব্রেসলো থেকে প্রকাশিত, ১৮৯৯) — লেখক জুলিয়াস বারলাখ।

    সেই গ্রন্থের দুই মলাটের ভেতর আমার অসুখের হুবহু বর্ণনা। মুখবন্ধে লেখকের প্রস্তাব — “একটি সহজে সামলানো যায় এমন এক অক্টেভো সংকলনে জাহির-সংক্রান্ত কুসংস্কার বিষয়ে যত অথ্য ও দলিলপত্র রয়েছে — তাদের গ্রন্থভুক্ত করা — তার মধ্যে হাবিখ্‌টের অভিলেখাগার থেকে চারটি প্রবন্ধ এবং ফিলিপ মেডোজ টেইলারের এই বিষয়ে আদি রিপোর্ট।” জাহির নিয়ে মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং ইসলামী সভ্যতায়। (বারলাখ তাঁর রচনায় স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন যে জোটেনবার্গের মতে আবুল-ফেদাহ্‌-এর রচনায় বিষয়টির প্রথম উল্লেখ।) আরবি ভাষায় “জাহির” শব্দটির অর্থ যা প্রত্যক্ষ, চাক্ষুষ, দৃষ্টিগ্রাহ্য, স্পষ্ট প্রতীয়মান এবং সেই অর্থে আল্লার নিরানব্বই নামের মধ্যে অন্যতম। ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশের সাধারণ মানুষের মুখে শব্দটির ব্যবহার এইরকম — “বস্তু অথবা সত্তা, যার এমন ভয়ংকর ক্ষমতা যে তাকে ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব এবং তার প্রতিচ্ছবি মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে তাকে পাগল বানায়।” তার প্রথম সন্দেহাতীত প্রমাণ পারস্যের বহুবিদ্যাবিশারদ দরবেশ লুত্‌ফ আলি আজুর; আলি আজুর লিখেছেন যে শিরাজ শহরের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রক্ষিত ছিল তাম্রনির্মিত এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর উপকরণ — “সেটা এমন ভাবে তৈরি যে তার দিকে এক ঝলক মাত্র তাকালেই মানুষের মনে সেই বস্তুটি ছাড়া অন্য কোন ভাবনার উদয় হওয়াই অসম্ভব — তাই সম্রাট নির্দেশ দেন বস্তুটিকে গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করার, যাতে মানুষ তার আপন বিশ্বকে ভুলে না যায়।” মেডোজ টেইলারের বৃত্তান্ত আরও সুদূরপ্রসারী; লেখক হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের রাজসভায় কাজ করেছেন কিছুদিন এবং লিখেছেন “ঠগীর স্বীকারোক্তি” নামে এক বিখ্যাত উপন্যাস। ১৮৩২ সালে ভূজ শহরের প্রান্তদেশে টেইলার শুনেছিলেন এক অসামান্য উক্তি মানুষের পাগলামি অথবা ঋষিত্ব বোঝাতে: “যথার্থই সে এক বিশেষ দৃষ্টিতে বাঘটিকে দেখেছে।” তিনি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন এক যাদুমন্ত্রের বাঘের কথা, যার দিকে একবার তাকালেই আসন্ন সর্বনাশ, কারণ তারপরে আর কোনদিনই তাকে নিয়ে চিন্তাভাবনা বন্ধ করা সম্ভব নয়, এমনকী বহুদূর থেকে তাকে এক ঝলক দেখলেও। কেউ একজন বললে যে এমনই এক পীড়িত মানুষ ভয়ে পালিয়েছিলেন মহীশূর পর্যন্ত, কিন্তু সেখানেও তাঁর প্রাসাদের দেয়ালে এঁকেছিলেন সেই বাঘের ছবি। টেইলার সেই জেলার অনেকগুলি কারাগার পরিদর্শন করেছিলেন; নিঘুর শহরের জেলখানায় রাজ্যপাল তাঁকে একটি সেল দেখিয়েছিলেন যার মেঝে, দেয়াল এবং গম্বুজাকৃতি ছাদ জুড়ে এক অন্তহীন বাঘের ছবি আঁকা (প্রথমে রঙগুলো ছিল পুরোপুরি বন্য, তবে ঘষে ঘষে তুলে ফেলার আগে তার পরিমার্জনা হয়েছিল)। ছবিটা ছিল একটা বাঘের ভেতরে আরও অনেক গুলো বাঘ, এমনভাবে জড়ো করা হয়েছে তাদের — দেখলে হতবুদ্ধি হয়ে যেতে হয়; আড়াআড়ি রেখার ভেতরে বাঘ, বাঘের ডোরাকাটার মধ্যে অন্য বাঘ, এবং তার মধ্যে রয়েছে সমুদ্র, হিমালয় পর্বতমালা এবং সেনানীর দল যাদের প্রত্যেকের সঙ্গে কোন না কোন বাঘের মিল। ছবিটা এঁকেছিলেন এক ফকির, এই জেলকক্ষেই অনেক বছর আগে তার মৃত্যু; তিনি এসেছিলেন সিন্ধুপ্রদেশ অথবা হয়ত গুজরাতেরই কোন অঞ্চল থেকে; প্রথমে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর জেলকক্ষে পৃথিবীর এক মানচিত্র আঁকা। তাঁর আদি উদ্দেশ্যর কিছু কিছু চিহ্ন রয়ে গিয়েছে সেই বীভৎস, ভয়ংকর ছবিতে। টেইলার এই কাহিনি বলেছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের মহম্মদ আল-ইয়েমেনিকে; আল-ইয়েমেনি তার উত্তরে বলেন যে পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণী নেই, যার মধ্যে জাহির হয়ে যাবার প্রবণতা নেই; কিন্তু পরম করুণাময় কখনই দুটি বস্তুকে একই সময়ে জাহির হবার অনুমতি দেন না, কারণ একটি জাহিরের পক্ষেই আমজনতাকে অনায়াসে বশীভূত করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সর্বদাই পৃথিবীতে একটা না একটা জাহিরের অস্তিত্ব থাকে — প্রাচীন অজ্ঞানতার যুগে এক দেবতা ছিলেন ইয়াহুক নামে এবং তার পরে খোরাশান শহর থেকে আগত পয়গম্বর, যিনি মূল্যবান পাথরে খচিত বোরখা অথবা স্বর্ণনির্মিত মুখোশ পরে থাকতেন। তিনি আরও মন্তব্য করেন, আল্লা অজ্ঞেয় এবং রহস্যময়।

    বার বার পড়তে থাকি বারলাখ-এর নিবন্ধগুলি। সঠিক বেছে নিতে পারি না নিজের অনুভূতিগুলি; মনে পড়ে আমার সেই বেপরোয়া অবস্থা, যখন জানতে পারি যে আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় নিজেকে উদ্ধার করা; এই কথা জেনেও ভেতরে ভেতরে নিশ্চিন্তি, যে আমার দুর্ভাগ্যের জন্যে আমাকে দায়ী করা যাবে না; যারা জাহিরকে মুদ্রা বলে না ভেবে হয় মার্বেল পাথরের চাঙড় অথবা বাঘ বলে ভাবে, তাদের প্রতি আমার তুমুল ঈর্ষা। মনে পড়ে তখন আপন মনে ভাবতাম, বাঘের কথা চিন্তা না করা কতোটাই সোজা। আরও মনে পড়ে এই অনুচ্ছেদটি পড়ার পরে আমার চমকপ্রদ অস্বস্তি — “গুলশান-ই-রাজ" এর একজন প্রতিবেদক লিখেছিলেন, ‘যিনি একবার জাহিরকে দেখেছেন, তিনি খুব শীঘ্রই দেখতে পাবেন মন্ত্র:পূত গোলাপকে’ এবং উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন আত্তার রচিত ‘আসরার নামা’ (‘অজানা বস্তসমূহ বিষয়ক পুস্তক’) পুস্তক থেকে:

    “জাহির হ’ল গোলাপের ছায়া
    এবং বোরখার উন্মোচন”।
    তেওডেলিনার শেষকৃত্যের রাতে আমি অবাক হয়েছিলাম উপস্থিত অভ্যাগতদের মধ্যে তাঁর ছোটবোন সেনোরা আবাস্‌কালকে না দেখতে পেয়ে। অক্টোবর মাসে হঠাৎ দেখা তাঁর এক বান্ধবীর সঙ্গে।

    “বেচারা জুলিয়া,” ভদ্রমহিলা বলেন আমায়, “তার হাবভাব কেমনতর উদ্ভট। শেষ পর্যন্ত তাকে বশ-এর ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়েছে। এখন নার্সেরা চামচে করে তাকে খাওয়ায় বলে তার মনোবেদনার অন্ত নেই। সে গড়গড় করে বলে যায় সেই মুদ্রাটির কথা, যেমন বলে মোরেনা স্যাকম্যানের ড্রাইভার”।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ হয়ে আসে স্মরণশক্তি, কিন্তু জাহিরের স্মৃতি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হতে থাকে। প্রথমে আমি তার একদিকটাই দেখতে পেতাম, তার পরে অন্যদিক; কিন্তু এখন আমি দুটো দিকই দেখতে পাই একই সঙ্গে। এমন নয় যে আমার দৃষ্টির সামনে জাহির মুদ্রাটি কাচের তৈরি, কারণ একটা দিকের ছবি অন্য দিকের ছবির ওপরে আরোপিত হয় না — বরং আমার দৃষ্টি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তুলাকার এবং জাহির হইচই ফেলেছে তার কেন্দ্রে। জাহির ছাড়া অন্য সব বস্তু যেন আমার সামনে এসে উপস্থিত হয় এক অদৃশ্য ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে এবং অনেক দূরত্ব থেকে — তেওডেলিনার তাচ্ছিল্যে ভরা মুখচ্ছবি এবং তাঁর শারীরিক যন্ত্রণা। টেনিসন বলেছিলেন, আমরা যদি একটা ফুলকে তার সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারি, তাহ’লে আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব আপনাকে এবং বাইরের পৃথিবীকে। তিনি হয়ত বলতে চেয়েছেন যে পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, আর ওপরে নির্ভর করে না পৃথিবীর ইতিহাস এবং তার কারণ ও কার্যের অন্তহীন জোড়া লাগার একত্রীকরণ। হয়ত তিনি বলতে চেষ্টা করেছেন যে দৃশ্যজগতকে পুরোপুরি দর্শন করা সম্ভব তার প্রতিটি প্রতিচ্ছবির মধ্যেই ঠিক যেমন শ্যোপেনহাওয়ার আমাদের জানিয়েছেন যে মানব সমাজের ইচ্ছার প্রকাশ তার অন্তর্গত প্রতিটি নরনারীর মধ্যে দিয়ে। ইহুদি কাবালাপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে প্রতিটি মানুষ এক অণুবিশ্ব, তার মধ্যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীকী প্রতিফলন; অর্থাৎ টেনিসনের কথা বিশ্বাস করলে, “সবকিছু থেকে হতে পারে — সবকিছু,” এমনকী অসহ্য জাহিরও।

    ১৯৪৮ সালের আগে জুলিয়ার ভবিতব্য পেরিয়ে যায় আমাকে। আমাকে খাইয়ে দিতে হয়, পরিয়ে দিতে হয় পোষাক, আমি জানি না এখন দিন অথবা রাত্তির — বোর্হেস মানুষটা কেমন ছিল তাও স্মরণে নেই। এমন এক ভবিষ্যতকে ভয়ংকর বলাটাও এক ভ্রান্ত বিশ্বাস, কারণ ভবিষ্যতের কোন পরিস্থিতিই আর আমার ওপরে প্রভাব ফেলতে সমর্থ নয়। যে অচেতন রোগীর মাথার খুলিতে যন্ত্র দিয়ে ছ্যাঁদা করা হচ্ছে, তার যন্ত্রণাকেও অনেকে বলতে পারেন ভয়ংকর। কিন্তু আমি আর বিশ্বজগতকে অনুভব করি না, অনুভব করি কেবল জাহিরকে। আদর্শবাদী ইস্তাহারে ঘোষণা করা হয় যে ‘বেঁচে থাকা’ এবং ‘স্বপ্ন দেখা’ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সমার্থক। আমার কাছে তার হাজার বারের পর হাজার বার আবির্ভাব মিলে মিশে একাকার: প্রথমে তা এক জটিল স্বপ্ন সেখান থেকে এক শাদামাটা স্বপ্ন। অন্যেরা স্বপ্নে আমাকে পাগল ঠাওরায়, কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখি জাহিরকে। যখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ রাতদিন চিন্তা করবে জাহিরের কথা, তখন কে হবে স্বপ্ন আর কে বাস্তব— পৃথিবী অথবা জাহির?

    রাতের ক্ষয়ে যাওয়া এক রিক্ত যামে আমি এখনও ঘুরে বেড়াতে পারি পথে পথে। প্লাজা গারায়-এর বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে ভোর এসে বিস্মিত করে আমায় — চিন্তা করি (বা চিন্তার চেষ্টা করি) ‘আসরার নামার’ সেই অংশটুকু, যেখানে বলা হয়েছে:

    “জাহির হ’ল গোলাপের ছায়া
    এবং বোরখার উন্মোচন”।
    আমি সেই বিবৃতিকে যুক্ত করি এই স্বীকৃত তথ্যের সঙ্গে ঈশ্বরচিন্তায় নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্যে সুফিসন্তেরা বার বার উচ্চারণ করে যান হয় নিজের নাম অথবা ঈশ্বরের নিরানব্বইটি নাম — শেষ পর্যন্ত আর খেয়ালই থাকে না কোনটা কার নাম। আমার গভীর ইচ্ছে সেই পথে পা দেবার। হয়ত অবিশ্রান্তভাবে জাহিরের কথা চিন্তা করতে করতেই আমি তাকে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হব মন থেকে — হয়ত এই মুদ্রার পিছনেই উপস্থিত রয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর।

    উৎসর্গ — ওয়ালি জেনার এর জন্যে।



    বাংলা অনুবাদের টীকা: — বোর্হেস গল্পটি লেখেন ১৯৪৭ সালে, প্রকাশিত হয় ‘লস আনালেস দে বুয়োনোস আইরেস’ কাগজের জুলাই ১৯৪৭ সংখ্যায়। গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে “এল আলেফ” গল্প সংকলনে।

    — ১৯৭০সালে নর্মান টমাস দি জিওভান্নির অনুবাদে গ্রন্থটির নির্বাচিত গল্পের ইংরেজি ভষায় প্রকাশ “আলেফ ও অন্যান্য গল্প” নামে। কিন্ত বোর্হেস “জাহির” গল্পটির ইংরেজি অনুবাদের অনুমতি দেননি — গল্পটির পরিমার্জনা করেন ১৯৭৪ সালে।

    — লেখকের বান্ধবী, কবি ও আবৃত্তিকার ওয়ালি জেনারকে উৎসর্গ করা হয়েছে গল্পটি।

    — গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন পুয়ের্তো রিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক অ্যানড্রু হার্লি।

    — গ্রিফন — সিংহের দেহ, ঈগলের মাথা — ডানাওয়ালা এক কাল্পনিক প্রাণী।

    — দস্তাবেজ ও কাহিনী — “Urkundenzur Geschichte der zahirsage”। কাল্পনিক জর্মন লেখক উলিয়াস বারলাখের কাল্পনিক পুস্তক।

    — ইয়াহুক — বারলাখের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী — কোরানে ইয়াহুকের উল্লেখ রয়েছে (৭১:২৩) এবং বোরখা পরিহিত পয়গম্বরের নাম আল মোকান্না--কিন্তু ফিলিপ মেডোজ টেইলার ছাড়া অন্য কোন লেখক জাহিরের সঙ্গে এই দুজনের কোন সম্পর্কের উল্লেখ করেননি।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ ইন্টারনেট থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments