• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৮ | এপ্রিল ২০২০ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • নিদ্রাচর মানুষের আখ্যান : শুভময় রায়

    The Day the Sun Died; —Yan Lianke; Translated into English by Carlos Rojas; Chatto & Windus; Published in USA: 2018; Page: 320; ISBN: 978-0802128539

    ক গ্রীষ্মরাতের কাহিনী। রাত্রি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে সমাপ্তির দিকে এগোয়। কিন্তু প্রত্যুষ আসে না, সূর্য ওঠে না। সরকারি সংবাদ চ্যানেলগুলো অস্বাভাবিক সৃষ্টিছাড়া আবহাওয়ার দিকে আঙুল তোলে। কর্তৃপক্ষ যখন দায়িত্বজ্ঞানহীন, তখন একজন মানুষের পক্ষে কীই বা করা সম্ভব।

    গ্রামে মৃতদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েছে। গোড়ায় শুধু কতিপয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু ক্রমে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটল, সংক্রমণ ছড়াল মহামারির মত। রোগের লক্ষণ? ঘুমন্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো। চারিদিকে নিদ্রাচর মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। লেখক রচনা করছেন নিদ্রাহারা রাতের এ গান।

    গ্রামের মানুষ যদিও এখনও মন শক্ত করে চোখ খোলা রেখে রাস্তায় হাঁটছে, দেখে বোঝা যায় তারা থেকেও নেই। তারা কথা ছুঁড়ে দেয় শূন্যে। অচিরেই রাস্তা ভরে যায় বিভ্রান্তচিত্ত জনগণে যাঁরা সকলেই মৃত্যুচিন্তায় আচ্ছন্ন। এই বিকারগ্রস্ত, প্রলাপী মানুষেরা সকলে চলেছে কাজে, হয়ত আসন্ন ঝড়ঝঞ্ঝার ভবিষ্যৎবাণী শুনে চাষের ক্ষেতে ছুটছে ফসল তুলতে অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও নাপিতের চুল কাটার সেলুনে ডাকাতি করতে। জীবনের দৈনিক ঘটনা প্রবাহ এখনও তাঁদের উদ্বিগ্ন করলেও বোঝা যায় যে “জাগ্রত অবস্থায় তাঁরা যা করতে পারতেন না, তাই যেন স্বপ্নের বশে সম্ভব হচ্ছে”।

    মহামারির প্রথম লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে তাৎক্ষণিক তাড়নায়: তুচ্ছ কারণবশত প্রতিশোধের প্রবৃত্তি, ছোটখাট চুরিচামারি, হঠাৎ আবেগতাড়িত যৌন সংগম। রাত যত বাড়ে, নিদ্রাচরেরা ততই লিপ্ত হয় ব্যাপক লুঠপাট আর হত্যায়। প্রাপ্তবয়স্করা শুধু লুঠতরাজই করছে না, শুরু করেছে এক মর্মান্তিক ধ্বংসলীলা। চোদ্দ বছরের এক কিশোর সেখানে দর্শক। গ্রামের লোকে তাকে বোকা বলে জানে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটি দোকান চালায় তার পরিবার। তার মা অতি সক্রিয়, জানা যায়নি তাঁর কর্মক্ষমতা বেড়েছে স্বপ্নচর হওয়ার কারণে নাকি চরম হতাশায়। বালকের পিতা শুধু যে তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তাই নয়, গোটা গ্রাম উদ্ধারের সংকল্প তিনি নিয়েছেন। গ্রামবাসীকে চা খাওয়াচ্ছেন, তাঁদের মুখে জলের ছিটে দিচ্ছেন, এখনও ঘুম তাড়ানোর, জেগে থাকার উপায়গুলো কী ভাগ্য আছে! আরও আশ্চর্য, এই নিদ্রাচর মানুষেরা এখনও টেলিভিশন আর প্রেশার কুকার সংগ্রহে অবিচল, তারা চায় আরও গয়না, আরও টাকা।

    অবস্থার অবনতি হতে হতে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল, সরকারি কর্মকর্তারা কয়েক শতাব্দী প্রাচীন আইন বলবৎ করে বিদেশীদের হত্যা করার নিদান দিলেন, তখনও সেই বালকের পিতা কেন নিজেকেই দোষী মনে করছেন? সেই সব সময়ের কথা ভেবে যখন তিনি প্রতিবেশীদের গালমন্দ করতেন। মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে মৃতদেহ দাহ করা বাধ্যতামূলক হওয়ায় মৃতকে কবর দেওয়া এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বালকের মামা মড়া পোড়ানোর চুল্লির ম্যানেজার। একে মহামারি, তায় আবার সদ্য কবর দেওয়া দেহগুলোও মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে। শ্মশানে তিল ধারণের স্থান নেই। পিতার শ্যালক দাহ করা শব থেকে নির্গত তেল সংগ্রহ করে রাখেন লাভের আশায়। একের পর এক টিনের পাত্র সেই তেলে ভরে ওঠে। কারখানায় সে তেলের খুব চাহিদা — সাবান, রবার, গ্রিজ্ তৈরিতে কাজে লাগে। শিল্পে ব্যবহারের জন্য এই তেল অসাধারণ। “হতে পারে এটি একটি দারুণ ভোজ্য তেল। মহামারির এই তিন বছর তো আমরা মানুষের মাংস থেকে তেমন লাভ করিনি!”

    শ্যালকের ক্যানেস্তারাগুলোয় সংরক্ষিত তেল বেচে পরিবারটির ধনী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। “কিন্তু আমার বাবা-মা সেই তেল বিক্রি করতে চাননি। কখনও না। ওটা মানুষের মাংসের তেল। বলাই বাহুল্য আমরা ওই তেল বিক্রি করতে পারব না।” তাই খুঁজে পেতে একটি গুহায় ক্যানেস্তারাগুলো রাখা হল। এমন গুহা যা রাতের মত অন্ধকার, যেখানে সূর্য প্রবেশ করে না।

    এতক্ষণ বলছিলাম চিনা ঔপন্যাসিক ইয়াং লিয়াংকে-র (Yan Lianke) সাম্প্রতিক অনূদিত উপন্যাস ‘যেদিন সূর্য গেল অস্তাচলে’-র গল্প। এই ব্যঙ্গাত্মক কাহিনীতে লেখকের অভিপ্রায় বর্ণনা করার ভার পড়েছে এমন একজনের কাঁধে অদৃশ্য অস্তিত্ব যার সহজাত। “আমাকে সকলেই শা নিয়ানিয়ান বলে ডাকে, যার আক্ষরিক অর্থ হল বোকা নিয়ানিয়ান।” উপন্যাসে কাহিনীকার নিজেকে এমন এক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনুপ্রেরণা যাঁকে ছেড়ে পালিয়েছে। গল্পের কিশোর কথক তাঁর ভক্ত, লেখকের সব বই বালকের মুখস্থ, যদিও কিশোরের বর্ণনায় সে বইগুলো মাটির ঢিপির মত, যেখানে অনেক মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে। অথবা সেগুলো গুহায় সঞ্চিত শবদেহের তেলের মতো — যা অন্তহীন, অশেষ। ঠান্ডা, মৃতদের মতই নিঃশব্দ।

    করোনা ভাইরাস আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে ইয়াং লিয়াংকে-র উপন্যাসটি পাঠ করা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। চিন রাষ্ট্রের সার্বিক নবজাগরণের যে স্বপ্ন রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিং দেখিয়েছেন, লিয়াংকে-র উপন্যাস তার বিপরীতে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে একটি দুঃস্বপ্নের মতো। মহামারি যত ছড়ায়, মানুষও ততই নীতিভ্রষ্ট হতে থাকে। জাগ্রত অবস্থায় যা ভাবাও যেত না, নিদ্রাচ্ছন্ন থেকে তাই সম্ভব হল। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই বিশৃঙ্খলার রাত্রিকে পরের দিন সকালেই আবার করে তোলা হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় সংঘটিত অদ্ভুত, অকল্পনীয় নৃশংস ঘটনাবলী তখন অনুল্লেখ্য, অনুচ্চার্য এক বিস্মৃত অতীত। শুধু স্মৃতিই নয়, প্রতিবাদের ইচ্ছাও তাই অবদমিত। পরিস্থিতি মুখ বুজে মেনে নিলে পাওয়া যাবে দ্রুত উত্থানরত অর্থনৈতিক বিকাশের পুরস্কার।

    কাহিনীর আচ্ছাদন এক দুর্বোধ্য অস্পষ্টতা যা মানুষকে হুমকি দেয়, ভয় দেখায়। সত্যকে সামনে আসতে, সত্যকে গ্রহণ করতে বাধা দেয়। আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় কখন অজান্তেই অস্তাচলের সূর্যরশ্মির আড়ালে সমগ্র উপত্যকাটি রক্তের মতো লালবর্ণ ধারণ করেছে। বই পড়া শেষ হলে মনে প্রশ্ন জাগে যে ইয়াং লিয়াংকে-র আখ্যানের প্রেক্ষাপট কি শুধুই চিন? রাষ্ট্রের চাপে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক প্রথানুসারী আচরণ এবং তার পরিণামে উদ্ভূত ভিতরে ভিতরে ফুটতে থাকা বিক্ষোভের আঁচ। অথবা হয়তো আজকের টালমাটাল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি সমগ্র মানব জাতিকে বাঁধতে চেয়েছেন এক বিশ্বজনীন কল্পচিত্রে — স্বপ্নে অথবা দুঃস্বপ্নে।


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments