পাখিটা উড়ে গিয়ে উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির ভাঙাচোরা টালির নীচে ফেলে রাখা একটা পচাকাঠের ওপর বসে তার মেঘের মত ডানা মেলে ধরে। নিজেকে লেপে দেয় নোনাধরা দেয়ালের বুকে।
“দাদা, কত?”
“হুম? কী?” গতরাতের বৃষ্টি যেখানে স্তব্ধ হয়ে আছে সেই টইটুম্বুর গর্তের ওপর স্কুটারের একটা চাকা পড়ে। তারপর নোংরা, পাতাপড়া জলটুকুও প্রায় নিঃশেষ করে চলে যায়। কিছুটা লেগে থাকে চাকায়। কিছুটা বা বাইরে, অগোছালো, ছড়িয়েছিটিয়ে। সম্বিৎ ফিরলে বলে, “সাত।” হঠাত্ স্পিড বেড়ে যায় বাসের। পিছনেরটাকে কিছুতেই এগোতে দেবে না সামনে। তারপরই প্রবল ঝাঁকুনি। ব্রেক কষেছে খুব জোরে। পিছনের ৪৭বি ডজ করে বেরিয়ে গেল। যাত্রীদের খিস্তি আর বাসের ঝাঁকুনি সামলে কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করে, “একটা?” পাখিটা এবার উড়ে গিয়ে বসে পাশেরই একটা বহুতলের কাচ লাগানো জানলার শার্সিতে। তারপর ভরসা না পেয়ে উড়ে যায় দৃষ্টিসীমা তুচ্ছ করে আরো উপরে। বাসের জানলা দিয়ে যতটা দেখা যায় ততটুকু দেখে সে বলে, “একটা।”
“খুচরো দিন। ভাঙাতে পারব না।” পাশ দিয়ে ট্রাম চলে যাচ্ছে। এবার বাস ছাড়বে। ট্রামের ঘন্টির একটানা ছন্দ আর বেসুরো ঘড়ঘড়ানিতে অস্পষ্ট হয়ে আসে অতীনের শব্দ, “এই নিন।”
প্রথম চুমুকেই সরটা ঠোঁটে বিশ্রীভাবে আটকে গেল। কোনরকমে ওটার বিদায় দিয়ে ভাঁড়ের মধ্যেই আছড়ে ফেলল বহুক্ষণ জমে থাকা একটা নিঃশ্বাসের ঢেউ। তাতে চায়ের ওপর খেলে বেড়ানো বুদবুদগুলো বেশ একটা নাড়া খেল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল ওরা। চায়ের দোকানটার লাগোয়া একটা বড় অফিস থেকে দলে দলে লোক বেরিয়ে আসছে। এখানেই আজকের দ্বিতীয় ইন্টারভিউটা দিয়ে এল অতীন। ব্যর্থতার সারি সারি দীর্ঘশ্বাস ভিড় বাড়াচ্ছে চায়ের দোকানে। এসি মেশিনটা ভেতরের সমস্ত আগুনকে টেনে আনছে আর গরম হাওয়া ঢেলে দিচ্ছে দোকানটার মাথার ওপর। মেশিনটার প্রতিবিম্ব পড়েছে হলদে-সাদা চায়ে। আর একটা চুমুকে ছবিটা ঘেঁটে দেয় অতীন। সামনের ফুটপাতে একটা ফাটল। তাতে পিলপিল করে আশ্রয় নিতে ঢুকে পড়ছে পিঁপড়ের দল। খুঁজে খুঁজেও বিড়ালটা আশ্রয় পেল না। বৃষ্টিতে ভিজেই যাচ্ছে। অদূরে একটা বড় বাড়ির ব্যালকনিতে রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে তার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে একটা আলসেশিয়ান। আজ প্রথম ইন্টারভিউটাতে গিয়েই বুঝেছিল ওটা আগে থেকেই ম্যানেজ করা আছে। ইন্টারভিউটা করা হয়েছে শুধুমাত্র ফর্ম্যালিটির জন্য। দ্বিতীয়টাতে ভ্যাকেন্সি দুটো। আর অ্যাপ্লিক্যান্ট প্রায় সাড়ে চারশো। তাদের মধ্যে পিএইচডি হোল্ডাররাও রয়েছে। অথচ বিজ্ঞাপনে যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ লিখেছিল। সত্যি আশ্চর্য! আজকের দিনটাও বৃথা গেল। শ্রীলাকে একটা ফোন করল। আউট অফ রিচ। তারপর মুস্তাকদাকে। সাড়ে ছটায় রিহার্সাল। এখন প্রায় আড়াইটে। শিয়ালদহ থেকে একটাই ট্রেন যায় মশালবাড়িতে। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা। মশালবাড়ির নাম আগে ছিল রূপচাঁদনির হাট। কতশত বছর আগে, রূপ আর চাঁদনি-দুই ভিনরাজ্যের মানুষ এখানে এসে আস্তানা গাড়ে। তখন এখানে প্রায় জঙ্গল। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের বাস। রূপ কোনো এক রাতে খাবার খেয়ে হাত ধুতে বাইরে বেরোয়। আর ফেরেনি। পরের রাতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। লোকে বলে, বাঘে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। চাঁদনি বড় অদ্ভুত মানুষ ছিল। একটুও ভেঙে পড়েনি। বরং লোকজন জড়ো করে এই আদ্যিকালের জঙ্গল সাফ করায়। তারপর এখানেই প্রতি কার্তিক মাসে হাট বসতে শুরু করে। কতসব বণিক, কতসব মজার মজার লোক--কেউ জাদুকর, কেউ বা ভাগ্যগণক এখানে আসত সেই কার্তিকে; থেকেও যেত কেউ কেউ। তারপর এলো ব্রিটিশরা, কখন আবার চলেও গেল। নিজের খেয়ালে বেশ রইল এ চত্বর। স্বাধীনতার পরও বেশ কিছুদিন বহাল তবিয়তে থাকার পরই হঠাৎ ছন্দপতন। দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি বেড়ে গেল। প্রতি রাতে টাটকা লাশ পড়ত। আজ এ ধর্মের, কাল ওই। এ যেন রূপেরই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি--প্রতিরাতে; শুধু তখন বাঘে খেত, আর এখন মানুষই। এরপর এল সেই রাত। রূপচাঁদনির মানুষ রাস্তা ছেয়ে ফেলল। প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল। অনেক হয়েছে। আজ রাতে আর একটাও খুন নয়। এই ঘটনার পর ধীরে ধীরে শান্ত হলো মশালবাড়ি। এসব কথা মুস্তাকদার কাছে শোনা অতীনের। মুস্তাকদার বাবা ছিল মশালবাড়ি আন্দোলনের নেতা। কী একটা যেন আছে মুস্তাকদার মধ্যে। ওঁর সাথে কথা বললে অতীনের মনে হয় নিজের সাথেই কথা বলছে কিংবা মাটি অথবা সেই পুরনো জটাধারী গাছটার শিকড়ের সঙ্গে। মুস্তাকদা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। একা থাকে। পুরনো পৈতৃক বাড়িতেই। আর একটা ছোটোখাটো নাটকের দল চালায়। না, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত নয়। এর পিছনেও অনেক ইতিহাস। আজ থেকে বিশ-বাইশ বছর আগে অতীন যখন খুব ছোটো, ঠিক সেইসময় মশালবাড়ি ছেয়ে গিয়েছিল লুম্পেন, বখাটে ছেলেতে। রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরতে গেলে বেশি সময় লাগলেও সবাই বড় রাস্তাই ধরতে বাধ্য হতো। কেননা রাজারানী সুইটসের পাশের অন্ধকার শর্টকাট রাস্তাটায় দিশির গন্ধ আর বাঙলা গালাগালে ঠাসা রিমেড হিন্দিগানেই ব্যাপারটা থেমে থাকেনি। ক্লাবটা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলো দেহব্যবসা আর সাট্টার ঠেক। এদের নিয়ে মুস্তাকদাই প্রথম দল খুলেছিল--নাটকের দল। নাম দিয়েছিল ‘স্বপ্নফেরি’। বেকার, চরম হতাশা আর নেশায় ডুবে থাকা ছেলেগুলোর সন্ধ্যেটা ধীরে ধীরে অন্যরকম হতে শুরু করল। প্রথম নাটক নামল--অযাচিত। অচিন্ত্যকুমারের “ছন্নছাড়া” কবিতার অনুপ্রেরণায়। একেবারে পাল্টে যেতে থাকল ওরা। রাজারানী সুইটসের পাশটা গমগম করত। প্রতিদিন স্থানীয়রা ভিড় করত ক্লাবে--রিহার্সাল দেখতে। মশালবাড়ি অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো। বন্যায় কিংবা বর্ডার পেরনো হতদরিদ্র মানুষের আশ্রয় হয়ে উঠল স্বপ্নফেরি। সাতচল্লিশ কেটে গেছে, কেটে গেছে একাত্তর। তবুও ভিড় কমেনি অনাহূতদের। আগন্তুকের দরজায় এখনও তারা কড়া নেড়ে চলেছে একটু মাটির আশায়। রাজারানী সুইটসের সামনের ঢিপিতে বসে কানুখ্যাপা মাঝেমধ্যে চেঁচিয়ে ওঠে, “দ্যাশটা গ্যাছেরে, এক্কেবারে কাইট্যাকুইট্যা মইর্যা গ্যাছে।” তারপর যেমন হয়। ভিড় বাড়ে স্বপ্নফেরির 'প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধুদের’। সবাই চলে গেল। কেউ চাকরি করত কলকাতা। কেউ বা আরো দূরে, থেকেও গেল কেউ কেউ। তাদের নিয়েই মুস্তাকদা ঘরে ঘরে ফিরি করতে লাগল বিনিপয়সার স্বপ্ন।
অতীন সবে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। রোজগারের জটিল অঙ্ক ওকে এমএসসির দিকে আর যেতে দিল না। তার উপর পার্মানেন্ট চাকরি পেয়ে গেল হাতেনাতে। ভবিষ্যৎ ভীষণ উজ্জ্বল এ প্রজেক্টে। তারপরই সেই কালো রাত। খবর পেল, কোম্পানি তুলে দিয়ে কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে মানি মার্কেটিং এজেন্সির কর্তা। সে রাতেই মশালবাড়ি ফিরে আসে ও। একমাস আত্মগোপন। বহু এজেন্ট সুইসাইড করেছিল। ও পারেনি। ওকে পারতে দেয়নি মুস্তাকদা আর শ্রীলা। শ্রীলার হাত ধরে বহুক্ষণ বসেছিল ও। সামনে বয়ে যাচ্ছিল রূপচাঁদনির রাত-কালো নদী। মাথা নীচু করে ও যেন দেখতে পাচ্ছিল সামনে একটা বিরাট স্বপ্নের দিন গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছে আর ঝরে পড়া টুকরোগুলো নিয়ে বয়ে যাচ্ছে পুরনো নদী সময়ের ঘাটে পৌঁছে দেবে বলে। হ্যালুসিনেশন নাকি ম্যাজিক রিয়েলিটি? ও জানে না। শ্রীলা জানতে পারে। ও তো ইংরিজি সাহিত্য পড়ছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকক্ষণ চুপ করেছিল দুজনেই। শ্রীলা জানে কখনো কখনো নৈঃশব্দকে ভাঙতে নেই।
রাত বাড়ছিল। ঢেউয়ের শব্দ আর ফুলেফেঁপে ওঠা দীর্ঘ নীলচে কালো রাত ওর ভিতরে গুমরে উঠছিল। এইসময়ই মুস্তাকদা ওর পিঠে হাত রাখে। উষ্ণতায় বোধহয় আশ্রয়ের স্বাদ পেয়েছিল ও। হঠাৎই কান্না আর দমকে দমকে কাশির সাথে ভাব জমিয়েছিল ওর চেপে রাখা কষ্টগুলো। নদীতে কেউ আধলা ইঁট ফেলছিল। রূপচাঁদনির গভীর মোচড়ে ছলকে ছলকে জল ছড়িয়ে পড়ছিল। মুস্তাকদার বুকে মাথা গুঁজে এক হাতে ধরে রেখেছিল শ্রীলাকে। শ্রীলা একটুও কাঁদেনি। সেই প্রথম ওর স্বপ্নফেরিতে যাওয়া। তারপর নিয়মিত। শ্রীলাও যেত। ধীরে ধীরে নেশার মতন হয়ে গেল অভিনয় করা। শ্রীলাও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। একা হাতে অতীন টেনে নিয়ে না গেলে নাটকটা নামতই না। শ্রীলা নিজেই বলেছিল মুস্তাকদাকে ও পারবে না। কিন্তু সেই এক জেদ মুস্তাকদার। মুস্তাকদা কোনো পার্ট যাকে দিয়েছে শত ব্যর্থতাতেও তাকে রিপ্লেস করবে না। ওয়ার্কশপ করবে, নিজে করে দেখাবে, বোঝাবে। তারপরও যদি না হয় তাহলে নাটক খারাপ নামুক ক্ষতি নেই কাউকে বাদ দেবে না মুস্তাকদা। রিপ্লেস করাতে বিশ্বাস করে না মুস্তাকদা--অতীন জানে।
স্টেশনে প্রায় পৌঁছে গেছে অতীন। ভিড়ের এগলি-ওগলি করে কোনোমতে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ায়। আটটা কাউন্টারেই অক্টোপাসের লম্বা দাঁড়া। মানিব্যাগ সামলে দশটাকার বিনিময়ে গতি কেনার লটারি প্রতিযোগিতার একটা টিকিট জোটে অবশেষে।
কুয়াশা এসে ঝাপটা দিচ্ছে। অনেক দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্য। তবুও শেষ আভাটা রেখে গেছে আকাশ লাল করে। এর মাঝেই পেরিয়ে যাচ্ছে অনেককিছু। লাইন চেঞ্জ করে অন্য লাইনে ঢুকছে ট্রেনটা, তারপর আরেক লাইনে। শুধুই রিপ্লেস করতে করতে নিজেকে নিয়ে পালাতে চাইছে। সূর্য ডুবে যেতে যেতেও একবার থমকে দাঁড়াল। বেশ একটু হেসে নিল। পালাতে গেলেও তো দৌড়তে হয়। তারপর টুক করে ডুবে গেল কোনো অচিনপুরে। ট্রেন থেকে নামার পর ভ্যানে বেশ খানিকটা। তারপর স্বপ্নফেরি। রিহার্সাল শেষ করে মুস্তাকদা ডাকল অতীনকে।
“বুঝলি, আর টানতে পারছি না।”
“কেন গো?”
“একটা অদ্ভুত ক্রাইসিস হচ্ছে। ধর, কোনো লেখা শুরু করলাম। নতুন কোনো স্ক্রিপ্ট বা জাস্ট এমনিই কোনো লেখা। যেটা নিয়েই ভাবছি দেখছি এটা জানা, এটা পুরনো, এটা নিয়ে আগে কাজ হয়েছে।”
“সে তো হতেই পারে। স্টাইলটাই তো ইম্পর্ট্যান্ট। ওইখানেই তো অভিনবত্ব।”
“তুই শুধু বাইরেটাই দেখছিস। আসলে বিষয়গুলো এ ওর ঘাড়ে চেপে ইতিহাসটাকে পাকস্থলী বানিয়ে ফেলেছে। রিক্রিয়েশন, অ্যাডাপ্টেশন...। কিন্তু, তবুও একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। আশপাশটা এত তাড়াতাড়ি বদলাচ্ছে বুঝতে পারছি না, জানিস। যারা ভাবছে বুঝে যাচ্ছে সেই সাধারণ বা অসাধারণেরাও কিন্তু বুঝছে না। একটা বড় ধরনের ফাঁক থেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব তো একই আছে, একইরকম। কিন্তু না, আসলে বোধহয় দ্রুত পাল্টাচ্ছে। দেখবি ফ্যান যখন জোরে ঘোরে পুরোটাকে এক মনে হয়। কিন্তু আসলে ঘুরছে তো মোটে তিনটে বা চারটে ব্লেড। একটা খেলা চলছে ভিতরে ভিতরে। রাজনীতিতে, দেশে এমনকী আমাদের মশালবাড়িতেও। সেগুলো খারাপ, ভীষণ নোংরা। কিন্তু রোখা যাচ্ছে না। আর এটাকেই আমি ধরতে পারছি না আমার লেখাতে। তাহলে বল, ক্রাইসিস না?”
“হ্যাঁ, এটা আমিও ভেবেছি। এই যে তুমি জায়গাটাকে পাল্টে দিয়েছিলে, সেটা পেরেছিলে কেননা প্রবলেমটা ধরতে পেরেছিলে। তখন সবকিছু অনেক ডাইরেক্ট হত। মালটাও খেত রাস্তায়, মেয়েগুলোকে নিয়ে ক্লাবে ঢুকতও চোখেরই সামনে। তাই ওদের বোঝা গেছে। পাল্টানোও গেছে খুব ইজিলি।”
“এইখানেই পয়েন্টটা। আগে ক্লাবে যা যা হতো, সেটা এখন এক্সিকিউট করার জন্য পলিসি মেকাররাই হাত বাড়িয়ে রেখেছে। এই যে নতুন শপিং মলটা হলো সেখানে সব্বাই যাচ্ছে। মাতাল হয়ে সারারাত বারেই পড়ে থাকছে। কেউ কিছু বলছে না। অথবা, নামভাঁড়ানো রুমগুলোর কথাই ভাব না। খুব ইজি অ্যাক্সেস। কিন্তু ওইখানে ঢুকলে কেউ কিচ্ছু মনে করবে না। আসলে এসি, ঝাঁ চকচকে দেখনদারি, ইংরিজি গান, এককথায় মার্কেটিং আরকি--এইসব দিয়ে দেশের হর্তাকর্তারাই চেষ্টা করছে যাতে ওরা ভুলে থাকে, ভাববার সময় না পায়। আর পাশে পাচ্ছে কর্পোরেট এজেন্সিগুলোকে। মানুষের কাছে ওগুলো হয়ে উঠেছে স্ট্যাটাস। এটাকে কীভাবে আটকাতে হয় আমি জানি না। বরং সামিল না হলেই সবাই বলবে অর্থোডক্স।”
দূর থেকে রিক্সটা আসছে। ওটাতেই ফিরবে ভাবছে অতীন। খুব ক্লান্ত আজ। হঠাৎই ওটাকে ক্রস করে একটা টোটো চলে এল। যাক, আগেও পৌঁছনো যাবে, আর বেঁচেও যাবে পাঁচটা টাকা। খুচরো পয়সা দিতে হবে না।
বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়ল অতীন। কাল আবার দুটো ইন্টারভিউ। দেখা যাক, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’-র মধ্যে বিবর্তিত সিদ্ধার্থরা বেঁচে থাকে কিনা। গা-টা এলিয়ে দিতেই শ্রীলার ফোন এল। বোম্বের চাকরিটা ছেড়ে ফিরবে শ্রীলা। বোকার মতন একটা প্রশ্ন করে অতীন। “কোথায়? মশালবাড়ি?”
“না। রূপচাঁদনির হাট।” হেসে ফেলে শ্রীলা। অতীন বলে, “কলকাতার কোথায়?”
“বালিগঞ্জ।” ভোরের অ্যালার্ম দিয়ে চোখ বুজল অতীন। তীব্র হর্নে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল। জানলাটা বন্ধ করবে। শুকনো গর্তটাকে পাশ কাটিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। কোন এক নিশাচর পাখি বিশ্রীভাবে ডাক ছাড়ে উল্টোদিকের বাড়ির দেওয়ালের একটা ভাঙা ফাটল থেকে। অতীনের মনে হল, পাখিটা কান পেতে আছে। জানলাটা বন্ধ করে দিল। মা পাশের ঘরে খাচ্ছে। দরজার কাছে মুখটা এনে অতীন বলল, “মা, ভাঁড়টা রাতে ভেঙো তো। কাল কিছু খুচরো পয়সা লাগবে।”