আমি তখন কলেজের শেষ ধাপে আর আমাদের পাশের বাড়ির প্রত্যয় সবে চাকরিতে ঢুকেছে। দু-বাড়ির ছাদ প্রায় গায়ে লাগানো। প্রত্যয়ের দিদির চার বছরের ছেলেটা মাঝেমধ্যে মামার বাড়ি আসত, এক নম্বরের বিচ্ছু একটা। হোলি হয়ে গেছে দু-তিন হবে...ছেলেটা একটা বালতিতে রং গুলে পিচকারি দিয়ে আমাদের ছাদে ছড়িয়ে দিল। আমার কিছু সালোয়ার-কুর্তি শুকোচ্ছিল, সব গেল। জানাজানি হতেই প্রত্যয় আর ওর দিদি আমাদের বাড়িতে এসে ক্ষমাটমা চাইল। আমরা বললাম – তাতে কী হয়েছে, ছেলেমানুষ। ছেলেমানুষ কী বুঝল সে-ই জানে, বলল “রং ভালো হয়নি? আচ্ছা, কাল আরও অনেক ভালোভালো রং দিয়ে দেব।”
প্রত্যয়কে তো অনেক দিন চিনতাম কিন্তু সেদিন কী যে হল, আমাদের দুজনের মনেই নতুন কোনো রং লেগে গেল। মানে যাকে বলে ভালোবাসা।
প্রত্যয় কাজ করত হায়দ্রাবাদে, আমিও হায়দ্রাবাদে চাকরি জোগাড় করলাম। বিয়েতে তখনই আমাদের সায় ছিল না তবু আমরা একসঙ্গেই থাকতাম। যাকে ‘লিভ টুগেদার’ বলে। বছর দুয়েকের মাথায় প্রত্যয় বদলি হল পুণেতে। এদিকে আমার সামনে তখন চাকরিতে ওপরে ওঠার একটা ভালো সুযোগ এসেছে। তাই প্রত্যয়ের সঙ্গে গেলাম না। ভাবলাম কতই বা বয়স আমাদের, কদিন পরে আবার এক জায়গায় চলে আসা যাবে।
কিন্তু প্রত্যয় চলে যেতেই আমার কেন-কে-জানে ঠিক ভালো লাগছিল না। নিজেকে কীরকম একলা মনে হতে লাগল। একে তো বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকায় বাড়ির কেউ সম্পর্ক রাখে না, তারপর এই ছাড়াছাড়ি। আমার সবকিছু কেমন খালি হয়ে গেল হঠাৎ।
যেখানে কাজ করি সেখানকার চেনাশোনা কয়েকজন দূরদেশে বেড়াতে যাচ্ছিল, আমি প্রত্যয়কে ফোনে জিগেস করলাম – যাব? ও দায়সারা উত্তর দিল “হ্যাঁ, ঘুরে এসো”। মনে মনে আশা করেছিলাম ও বলবে – “কবে? চলো আমিও যাব।” অন্ততপক্ষে আমার যাওয়া নিয়ে কিছু জানতে চাইবে। কে কে যাচ্ছে, কতদিনের সফর এইসব। তেমন কোনো কথা তো বলল না প্রত্যয়। আমাদের দুবছরের সম্পর্ক কি শেষ হতে চলেছে? কী জানি। খুব মনমরা হয়ে পড়েছিলাম কয়েকটা দিন, তবু ভাবলাম ঘুরেই আসি।
গ্রীস দেশটা ভারী সুন্দর। পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র, দ্বীপ। চারিদিকে প্রাচীন ইতিহাসের নমুনা ছড়ানো। আমাদের দেশের মতো এদেরও অনেক দেবদেবী। আর তাদের নিয়ে কত যে গল্প। সময় সময় আমার বেশ লাগছিল আবার তারপরেই মনে হচ্ছিল এতগুলো মানুষের ভিড়ের মধ্যে আমি তো আসলে একা। প্রত্যয়কে মনে পড়ছিল থেকে থেকে।
একটা মিউজিয়মে গেছি, দারুণ সব পাথরের মূর্তি – দু-আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। সুন্দর করে রাখা। এককোণে রাখা ছিল একটা শিশুর মূর্তি, সে ঘুমিয়ে আছে। ভারী মিষ্টি মুখখানা। আমাদের রসিক মহিলা গাইডটি বলল “শ্ শ্ শ্ ... কেউ শব্দ কোরো না যেন। এর নাম কিউপিড, এর ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভারী মুশকিল হবে কিন্তু--”
আমরা ঘিরে দাঁড়ালাম। গাইড বলতে লাগল, “জানো, এর কাছে ধনুক আর কিছু সোনার তীর আছে। ছেলেটা না বড় দুষ্টু – যখন যেদিকে ইচ্ছে এলোমেলো তীর ছোঁড়ে। উপকথায় বলে এর তীর যাদের গায়ে লাগে তারা ... হিঃ হিঃ... তারা ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। আর ছাড়া পায় না ....”
হলঘরে আরও অনেক সুন্দর সুন্দর দেখার জিনিস, সকলে অন্যদিকে চলে গেল। শুধু আমি ঘুমন্ত কিউপিডের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে বলছিলাম “জানিস, ঠিক তোরই মতো একটা দুষ্টুছেলে একদিন আমার জামা-কাপড়ে রং ছিটিয়ে দিয়েছিল। কীকরে যেন সে রং ভেতরেও লেগে গিয়েছিল রে। এই দুষ্টু, ওঠ না রে একবার...তোর সেই মন্তর দেওয়া দুটো সোনার তীর ছুঁড়ে দে দুদিকে। একটা লাগুক প্রত্যয়ের গায়ে, একটা বিঁধুক আমার বুকে। ও আমাকে আবার ভালবাসুক, আর আমিও ওকে ... এই ছেলে, কতদিন তো ঘুমিয়ে রয়েছিস, একবাট্টি ওঠ না রে ...”
(এই সংখ্যায় অচিন্ত্য দাসের আরো একটি গল্পঃ 'মাছের দিন')