কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই ‘যৌবন বাউল’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯-এ। কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি কবিতারসিকদের মুখে মুখে ঘুরত। হয়তো একারণেই অলোকরঞ্জনকে ‘পঞ্চাশের কবি’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। তাঁর বয়স যখন ষোল তখনই (১৯৪৯) তাঁর কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাল্যবয়সে শান্তিনিকেতনে পড়াকালীন সহপাঠী অর্মত্য সনের সঙ্গে ‘স্ফুলিঙ্গ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। লেনিন প্রবর্তিত ‘ইসক্রা’ বা ‘স্ফুলিঙ্গ’ পত্রিকার কথা স্মরণ করে পুলিস স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানায় এবং গ্রন্থাগারিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁদের সতর্ক করে দেন। প্রথম কবিতার বইটির পর আরও অন্তত পঁয়ত্রিশটি কবিতাগ্রন্থ বেরিয়েছে, অনুবাদ কবিতার বই বেরিয়েছে অনেক। আর পর্বে পর্বে তাঁর কবিতার ধাঁচ বদলেছে, যেটা বড়ো কবিদের ক্ষেত্রে, দীর্ঘকাল কবিতা-যাত্রায় একান্ত স্বাভাবিক।
পঞ্চাশে বাংলা কবিতার প্রধান দুটি মুখপত্র—‘শতাভিষা’ এবং ‘কৃত্তিবাস’। ‘শতভিষা’ বছর দেড়েক আগে। ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর হাঁক ডাক ছিল অনেক বেশি। অলোকরঞ্জন উভয় পত্রিকাতেই লিখেছেন তবে মনোধর্মে তিনি শতভিষাপন্থী। অরুণকুমার সরকারের বাড়িতে কবিতাপাঠের আসরে জনৈক শ্রোতা প্রশ্ন করেছিলেন—এখনকার কবিরা disturb করেন না কেন? অলোকরঞ্জন উত্তরে বলেন—disturb করা কবিতার ধর্ম নয়। অল্প পরেই শতভিষার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে ওঠেন অলোকরঞ্জন ও প্রণবেন্দু, প্রথমজন একটি সংখ্যা সম্পাদনাও করেন। সুনীল কবিতাতে তিন লাথিতে রবীন্দ্র রচনাবলী পাপোশে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন আর অলোকরঞ্জন বলেন—রবীবন্দ্রনাথ মৌলি পাহাড় জলপ্রপাত আমি। সুনীল লেখেন—‘কবিতা লিখেছি আমি চাই স্কচ, সাদা ঘোড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ক মুর্গির দু ঠ্যাং শুধু’ বা ‘এবার কবিতা লিখে আমি চাই পনটিয়াক্ গাড়ি’। কৃত্তিবাসগোষ্ঠী চাইল ‘সম্পূর্ণ আমিত্বের বর্বর আবিষ্কার’ এবং ‘সমুদ্যত রোষে শিল্প পদাঘাত করো’। অন্যদিকে অলোকরঞ্জন—‘কে অনন্যা উঠে এলো, দীপ্তি যার অহল্যার চেয়ে/ উর্ত্তীর্ণ হয়েছে আরো দুর্বিষহ ধৈর্যের তমসা/ গৌরীর চেয়েও যার রুচিরাক্ষমালা/ প্রতিজ্ঞার প্রতিভায় জ্বালা’ অথবা, —‘আমি যে সব-কিছুর ভিতরেই/ শাশ্বতের কারুকার্য দেখি।/ জগৎটারে যখনই লাগে ভালো/ তখন আমি নিজেরই মনে খুশি’।
‘বন্ধুরা বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে,/ তোমার চেয়ে তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে/ আমি কি তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো?’
অথবা,
‘মাঝে মাঝে স্পষ্ট করে বলা দরকার/ ঈশ্বর আছেন,/ মগডালে বসে থাকা পাপিয়াকে আর/ পর্যবসিত বস্তু পৃথিবীকে স্নান করাচ্ছেন।’
এসব কথায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। তবে তিনি ঈশ্বরমগ্ন আধ্যাত্মিক কবি নন। মধ্যজীবনে শুনি—‘আজ ঢের পার্টটাইম ঈশ্বর দরকার।’ ১৯৯৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন—‘কোন কবির রচনায় কতোটা ঈশ্বরবিশ্বাস থাকবে কি থাকবে না, এসব বিবেচনা কবিতার অন্ত্য মূল্যাঙ্কনে একতিল প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা কি বিদ্যাপতি বা দান্তেকে তাঁদের ঈশ্বর বিশ্বস্ততার দরুন পড়ি, না তাঁদের অনির্ণেয় শিল্পসৌন্দর্যের জন্য?’ এক সমালোচক যথার্থই বলেছেন—‘তার অন্তর্গত লড়াই পূর্ববর্তী বাংলা কবিতার ধারা ও প্রবাহের সঙ্গে যতখানি ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল নিজের সমকালের কবিদের সঙ্গে’। (জহর সেন মজুমদার) তাঁর আরো অনেকগুলি পর্যবেক্ষণ মান্যতা পাবে। যেমন—‘প্রশ্নে আকীর্ণ কবি প্রেম বিবেক মানবতার ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজেছেন নির্মাণ নিবেশি জীবনের প্রাতিস্বিক শিকড়গুলোকে।’ এবং ‘ক্ষণকালের খণ্ডাংশ নিয়ে পরস্পর জুড়তে জুড়তে ক্ষণকাল থেকে চিরকালে আধুনিক থেকে শাশ্বতে পৌঁছেছেন।’ বা, ‘বাউল দৃষ্টিতে বিচরণ পুরাণ থেকে ইতিহাসে, রূপকথা থেকে সমকালে।’ এবং নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় কথিত ‘বৈপরীত্বের সংহত সমন্বয়’ অলোকরঞ্জনে—সায় দিতে পারি। তাঁর জার্মানী বাস, বিশ্বপরিক্রমা, বৎসরে অন্তত একবার ভারত পরিক্রমা তাঁর মনন মৃত্তিকাকে প্রসারিত করেছে ক্রমশ যাতে প্রতিবাদের মিছিল, শরণার্থী শিবির, শান্তি আন্দোলন, যুদ্ধের ঘাত প্রতিঘাত, আর্তস্বর, ‘হাতে আমার বেউড় বাঁশের বাঁশী/ বাজাতে গিয়ে ঠোঁট ছড়ে যায় সুরের রক্তে বাঁশী ভেজায়’--এখানেই অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর তফাৎ, সমকালীন বাঙালি কবিদের সঙ্গে তফাৎ। লেখকসত্তাকে বন্ধু জানায়—‘ওখানে আরেক বিশ্ব আছে/ এখানে মানুষ মরে বাঁচে/ এখানে তুমি না নেমে এলে/ থেমে থাকবে যেখানে তোমার/ রচিত ব্যাসার্ধ সেইখানে।’ জহরের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে আরো পরিণত অলোকরঞ্জন বারংবার জেগে ওঠেন—আশ্রয়হীনতা এবং নিরাপত্তাহীনতায়। অলোকরঞ্জন ঈশ্বর, মা, ভৌগোলিক বাস্তবতা এ তিনের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন এক ব্যতিক্রমী বিশ্বসত্তা। ক্লোনদের হৃদয়রিক্ততা, অন্ধ আর খঞ্জদের মুরগির লড়াই, সেনানিবাস, বিধবা, সাইরেন, যুদ্ধপ্রবণ দুষ্কৃতি, ভি ডি ও ফিল্ম, অনিচ্ছাকৃত শিশু শবযাত্রা, পেট্রোডলার, পীর ফকির সুফি দরবেশ, নানা দেশী বিদেশী পৌরাণিকতা, কাশ্মীর সমস্যা, গালফযুদ্ধ, পাতাল গ্যারাজ, নিউক্লিয়ার শীতের গোধূলি—সব জড়ো হয়। অলোকরঞ্জনের বন্ধু ও সহকর্মী লোথার লুৎসে ঠিকই বলেছেন—অলোক তাঁর তারটিকে বেঁধেছেন আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মধ্যে, শহুরেপনা আর গ্রামীণ সারল্যের মধ্যে, উন্নত কাব্যরুচি ও সহজ সাদাসিধে অভ্যাসের মধ্যে। আর এক জার্মান অধ্যাপক হান্স হার্ডার বলেন—‘অলোকরঞ্জনের কবিতায় অনেক সময় দেবতা, মানুষ, গাছপালা জাতীয় সাধারণ জৈব ও চিন্ময় বর্গগুলি একাকার হয়ে যায়।’ অতি জীবন্ত পৃথিবী ও নানাশ্রেণীর জীব মিলে যায়। আঙ্গিকের জটিল সঙ্কেত শিল্পে ও জীবনে, উপলব্ধির গভীরতায় কবি হৃদয় মঞ্চ ছেড়ে যাতে পারে জীবনে।
এখানে অলোকরঞ্জনের কাব্যভাষা নিয়ে সংক্ষেপে দু-চার কথা। তাঁর গদ্যভাষার স্বাতন্ত্র নিয়ে অন্যত্র কিছু বলব। অলোকরঞ্জন খুবই সচেতনভাবে পাঠকের মন টেনে রাখার জন্য শব্দ কুশল, তবে বিষ্ণু দের মতো নন। ‘অলোকরঞ্জন যে একজন শিল্পনিবেশি কবি, রূপদক্ষ ভাষাভূষণপ্রিয় কবি সেটা প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না।’ (আলোক সরকার) প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবন বাউল’-এ পাই—মরণমদ মাতাল ডোম, জয়শ্রী জীবন, রুচিরাক্ষমালা, দরিদ্রধূসর ধানখেত, ধ্যান ধবলিমা, কান্না কীর্তনীয়া। অনুপ্রাসের অনিবার্য টান এখানে। পরে, অন্য বইতে—
ভোম্বল গম্ভীর স্বরে (নিজেকে কেউকেটা ভাবলেও আসলে নির্বোধ), জিপসি-চলন্তিকা (নিত্য গতিশীল), খুদকুশী বোমা (আত্মহত্যাপ্রবণ বোমারু), তিলপর্ণ (খুব রোগা) বৌদ্ধধর্ম,
দর্শন প্রসঙ্গঃ নির্বেদ, ত্রিতাপ তৃষ্ণা, বোধিবৃক্ষমূলে, ভূস্পর্শ মুদ্রা;
অন্যান্য ধর্ম: ইন্তেকাল, আজান, ইনশা আল্লা, পঞ্চমুখী জবা, কীর্তন, তুষতুষুলি, বৈতরণী, কুম্ভমেলা
নামশব্দ ব্যবহার—বলাই বনমালী সুবল শ্রীদাস সুদাম শেষে, 'অহংকার ভুলে অরুন্ধতী/ বশিষ্ঠের কোলে মূর্ছা যাবে' ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কয়েকটি চিত্রকল্প:
ক) সমস্ত আকাশ যেন গগনেন্দ্র ঠাকুরের ছবি
খ) আমারি বেদনা যেন চন্দনরাঙানো লালচেলি
গ) বুকের দর্পণে দোলে পুরাতন দ্বাদশমন্দির
ঘ) এই রাত্রি গাঢ় হোক তারপর দুটি শোক / খুঁজে নিক বীতশোক বীণ
ঙ) যেন এক প্রাণবৃক্ষ জীবনে-জীবনে শতঝুরি
চ) সমস্ত নিসর্গ আজ মুখরিত সাজ্জাদ হোসেন
অলোকরঞ্জন কবিতার মতোই গদ্যেও অনায়াস, বিচক্ষণ ও বিস্ময়করভাবে বিশ্বভাবুক। একদা তিনি লিখেছিলেন—‘কেন লিখি আর কেন পড়ি’ এই দুটি প্রশ্নই পরিপূরক। ... অপরাপর রচয়িতারা কী বলছেন সেটা না জানলে একজন লেখকের সৃজন ব্যাপার হয়ে ওঠে আত্মপ্রদক্ষিণ এবং পুনরাবৃত্তির অ্যারীনা।’ (লিখতে চাওয়া) আলোকরঞ্জন তা কখনোই চাননি। এই কথাটি কবি বা গদ্যকার দু দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর অন্তত উনিশ/কুড়িটি গদ্য রচনার বই আছে এবং তার বিষয়বৈচিত্র্যও অনুপম। এই বৈচিত্র্য ও বিস্তারেও তিনি পঞ্চাশের কবি লেখকদের ছাড়িয়ে যান। যা হোক অলোকরঞ্জনীয় প্রবন্ধের যৎকিঞ্চিৎ নিবেদন করা যাক। রবীন্দ্র শতবর্ষে ‘রবীন্দ্রায়ন’ সংকলনে ছিল ‘উপন্যাসের চরিত্র ও রবীন্দ্রনাথ’। এই প্রবন্ধটিই ১৯৮৫তে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বভারতী কোয়াটার্লি’তে Fiction, Character and Tagore নামে। এই নিবন্ধে লেখক দেখান—বঙ্কিমকে উপলক্ষ্য করেই বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম জটিল চরিত্র উন্মোচিত রবীন্দ্রনাথের হাতে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় মানস থেকে দূরে সরে যাননি। তৃতীয়ত: নৈবেদ্য রচনাকালীন মানস ও সৃষ্টির টানাপোড়েন চোখের বালির চরিত্রায়নে যাতে চরিত্র উৎকেন্দ্রিক, বাসনাতীব্রতা থেকে জীবনস্থিরতা অভিমুখী। ‘বাংলা সাহিত্যের রেখালেখ্য’ (১৯৬৯) বইতে দেখান বাঙালি মানসে ছিল পরিগ্রহণ ও প্রত্যাহার, প্রথা অনুগামিতা ও প্রথা অতিক্রমী মন। (বাঙালির মন) ‘মাতৃভাষা ও লিরিকের জন্ম’ নিবন্ধে আসে নিখিল ভারতীয় দৃষ্টি দিগন্ত, ধ্বনিশিল্পী কালিদাস, অন্ত্যমিলের জন্মে ‘ঘত্তা’ নামের তালের অভিঘাত, সংস্কৃত রীতি অতিক্রম, বাংলা লিরিকে মিলনান্তক স্তবক সৃজনে।
চর্যাপদ কবি প্রসঙ্গে আসে ইউরোপীয় ত্রুবাদুর কবিদের কথা। বৈষ্ণব কবিতা আলোচনায় আসে ধর্ম কীভাবে কবিতার কাছে আত্মসমর্পণ করে সে কথা, প্রসঙ্গত ম্যাথু আর্নল্ড-এর যোগ্য এক উদ্ধৃতি। (অন্ত্যমিলের জন্ম) আক্ষরিক অনুবাদের বদলে আসছে স্বকৃত কথন রামায়ণ ও মহাভারত ক্ষেত্রে। তাঁর মতে সুফি মতবাদ নয়, উপনিষদ থেকে কবিতায় প্রেম চেতনা আসছে। ‘শিল্পিত স্বভাব’ (১৯৭০) ১ম পর্যায়ে আলোচ্য—দান্তে, শেক্সপীয়র, ব্লেক, শিলার, ব্রজেন্দ্রশীল, উপেন্দ্রকিশোর, অবনীন্দ্র ও মার্কস। ২য় পর্যায়ে—রবীন্দ্রনাথ, ৩য় পর্যায়ে—ভক্তিরসের কবিতা, যুদ্ধ, যুগমুহূর্ত স্রষ্টা ও পাঠক। দান্তে বিষয়ক আলোচনায় ইটালীয়, ও বাংলা সাহিত্যের আন্তর আত্মীয়তার কথা, বঙ্কিম বর্ণনায় ইনফের্নোর ছাপ, দান্তে ও মধুসূদনের রচনায় পাপের সঙ্গে সৌন্দর্যের রহস্যময় যোগ। বাংলা সাহিত্যে শেক্সপীয়র অভিঘাত নিয়ে চমৎকার বিচার। শেক্সপীয়র রচিত চরিত্রের বিমূর্তায়ন, চরিত্রের মনোলগ, রবীন্দ্রমানসে কীভাবে এবং শেক্সপীয়র সনেট-অনুবাদে বাঙালি কবিদের আগ্রহ এবং জীবনানন্দের মানসে নানা প্রচ্ছায়া কিন্তু নবত্বে উদ্দীপিত। ‘ব্লেকের স্বভাব ও কবিস্বভাব’ বাঙালি পাঠক- ও লেখক- মনে আগ্রহ বিস্তারে সহায়ক। শিলার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রকথা টেনে দেখান দুজনেই স্বদেশে আবিষ্কার করেন বিশ্বজগৎকে। রবীন্দ্র ‘খেলা’-তত্ত্বে শিলার এসে যান। ‘সুন্দর ও কার্ল মার্কস’ নিবন্ধে মার্কসের নন্দন তাত্ত্বিকতায় সুন্দরের প্রসঙ্গ তোলেন যদিও তা অসম্পূর্ণ, অব্যাখ্যাত বলেই তৎকালে বিতর্ক উঠেছিল।
‘বাংলা কবিতা, আধুনিকতা’ নিবন্ধে আসে প্রাচীন ও আধুনিক কবিতার পার্থক্য নির্দেশ। ‘রবীন্দ্র কবিতার চিত্রকল্প’ নিবন্ধে আসে অভিজ্ঞতার সচেতন স্বীকরণ, সঙ্কেতময়তা, পরস্পর বিছিন্ন অংশে প্রাণপ্রতিষ্ঠা, অন্তর্গত আর্তিকে ধরবার চেষ্টা। ‘সুধীন্দ্রনাথের হাইনে’ প্রবন্ধে আসে জার্মান কবির কবিতা অনুবাদে হাইনের ভাবনা ও সুধীন্দ্রর ভাবনার সম্মিলন। ‘দিকে দিগন্তরে’র ১৪টি প্রবন্ধে স্বদেশ ও বিদেশ চেতনা প্রসারিততর। একটি লেখায় বুদ্ধদেব বসুর গদ্যগঠনে গদ্য ও পদ্যের পারস্পরিকতা। ‘ভ্রমণে নয় ভুবনে’ (১৯৮৮) বইতে ভ্রমণসূত্রে ভুবনবীক্ষা। একটিতে আসে পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান ও টেকনোলজি নিয়ন্ত্রিত জীবনে মধ্যযুগীয়তার অনুপ্রবেশ। অপর একটিতে গ্যেয়টের মৃত্যুদিন ও রবীন্দ্র জন্মদিন যৌথ পালনের সূত্রে জন্ম ও মৃত্যুদিন বিষয়ক রবীন্দ্র কবিতাটির কথা, গ্যেয়টের ক্রমবিস্তারী ভারতপ্রীতি, রবীন্দ্রনাথের গ্যেয়েটে প্রীতি ইত্যাদি। ‘জীবনানন্দ’ বিষয়ক বইটিতে (১৯৮৯) একাংশে এই বাঙালি কবির মানসিকতা ও কবিতাকে Semiotic দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ প্রয়াস।
‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’ (১৯৯৭) রবীন্দ্র সৌন্দর্য ভাবনা বিষয়ক যার অভিনবত্ব সোসুরের চিহ্নবিজ্ঞান বা দেরিদার উত্তর আধুনিক ভাবনার প্রয়োগে। নন্দিনীর টানাপোড়েন প্রসঙ্গে হাইডেগার। দেবতোষ বসু বলেন এ আলোচনায় আছে ত্রিআয়তনিক বিন্যাস। এবং সৌন্দর্যবীক্ষা ভাবনা শুরু ‘আরোগ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১১ ও ৩৩ সংখ্যক কবিতা দুটি থেকে। প্রথমে প্রথানুগত সৌন্দর্যভাবনা বিচার যাতে বহিরঙ্গ সামঞ্জস্য।
রবীন্দ্র সৌন্দর্য ভাবনায় অদ্ভুত, বীভৎস, অজ্ঞাতকুলশীলের অবস্থান প্রসঙ্গে অ্যাডোর্নোর ভাবনা কথা। লেখা ছাড়া ও রেখার মধ্যে সুন্দর আবিষ্কার রচনাটিকে বিশিষ্টতা দেয়। ভাষাতাত্ত্বিক রমাপ্রসাদ দে একটি নিবন্ধে অলোকরঞ্জনের ‘জীবনানন্দ’ বইটির আলোচনা প্রসঙ্গে জীবানানন্দ আলোচনায় চিহ্নতত্ত্বের প্রয়োগ চমৎকার ব্যাখ্যা করে বলেন—জীবানানন্দে আছে চিত্র রচনায় সাহসিক অভিনবত্ব, কবি গড়ে নিয়েছেন নিজস্ব চিন্তার সিনট্যাক্স। সৃষ্টিশীল পাঠক নির্মাণ করে নেবেন জীবনানন্দীয় কবিতার অর্থময়তা। সুবক্তব্য কবিতার ৩য় স্তবকে ধ্বনিবিন্যাসে দুরকম স্বরতরঙ্গের স্পন্দমানতা যা অলোকরঞ্জন লক্ষ্য করেছেন। এ কবির রচনায় শব্দ ও ধ্বনির যৌথ সক্রিয়তা। ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে আবিষ্কৃত—রৌদ্রের 'অন্তর্নিহিত অন্ধকার’।
তাঁর কয়েকটি গদ্য সংকলন সময় পেলেই, হাতে পড়লেই, পড়তে থাকি। সেগুলি হল—ভ্রমণে নয়, ভুবনে; শরণার্থীর ঋতু ও শিল্পভাবনা; পুঁথিপট (১ম ও ২য় খণ্ড)। এই চারটি বইয়ের বাড়তি আকর্ষণের কারণ—ভ্রমণরস এবং অবলোকন সূত্রে বিশ্ব জিজ্ঞাসা, তাছাড়া আশির দশক অন্তে পৃথিবী যেমন তার হিংস্র নখ দাঁত বার করছিল তেমনি লেখকের মনও ভ্রমণসূত্রে মানবসংকটের ধাক্কায় বদলে বদলে যাচ্ছিল। তিনি দেখছেন আর লিখছেন, সমন্বয় করতে চাইছেন আত্মার সঙ্গে আত্মার, মূল্যায়ন করতে চাইছেন প্রতি পতন আর উত্থানকে। তদন্ত করছেন, দৃশ্যগুলি বিশ্লেষণ করছেন, পোস্টমর্টেম প্রতিটি সংঘাত, বিষাদ, বিষ ও সংবাদের। এ ভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক কবি বা শিল্পী। ক্রমশ উপলব্ধিতে আসে অকুল বাস্তুবিহীনতা। চরাচরব্যাপী শরণার্থী মানুষের মুখচ্ছবি দেখতে চাওয়াতেই তাঁর নান্দনিকতা। জার্মানির চিঠির পরতে পরতে পীড়িত মানুষের অন্য ধর্মযুদ্ধের ঘোষণা, পৃথিবীকে নতুন করে সাজানো ও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাই বিষয় হয় বার্লিন-প্রাচীরের পতন, উপসাগরীয় যুদ্ধের হাহাকার, শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছে সারা বিশ্ব বিকিয়ে যাওয়া। আন্তর্জাতিক শরণার্থী সমস্যা, ক্ষুধা, ঠান্ডায় মৃত্যু, অনিকেত জীবনপ্রবাহে লাগে মানবিকতার স্পর্শ। এই দৃষ্টান্ত আর কোনো বাঙালি শিল্পীর সঙ্গে তুলনীয় নয়।
অলোকরঞ্জনের ৮টি বই আছে যা ইংরেজিতে লেখা। ‘বুদ্ধদেব বোস’ বইটি প্রকাশ পায় ১৯৭৭-এ। তারিখপঞ্জী এবং তথ্যসূত্র বাদে বইটির ৬টি অধ্যায়। জীবনকথা, কবিতা, সাহিত্য, আলোচক, গদ্যশৈলী, গল্প ও উপন্যাস, নাটক। রোমান্টিক লেখক হিসেবে নন্দিত ও নিন্দিত। স্বোপার্জিত খ্যাতি মৃত্যুর পরেও অব্যাহত। গদ্যকে সাংবাদিকতা ধর্ম থেকে উন্নত করতে সমর্থ হন। নির্বাচিত এক সাহিত্যগোষ্ঠী রচনা করতে সমর্থ হন। কবিতা ক্ষেত্রে প্রথমাবধি দেহাত্মবাদ যার কিছু প্রেরণা মোহিতলাল থেকে। তাঁর কবিতায় মুখ্যত প্রেম। ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ বইতে কবির অতিসচেতন ভাষাদৃষ্টি অনেকক্ষেত্রে কৃত্রিমতাযুক্ত। যাত্রা(??) প্রি-র্যাফেলাইট ভঙ্গি, পরে ইমপ্রেশনিস্টিক পার্সেপসন, কায়া গঠনে নৈপুণ্য। (??) সংবেদনের দিক দিয়ে 'মরচে পড়া পেরেকের গান' বিশিষ্ট। নস্টালজিয়া, একাকীত্ব শেষ পর্যায়ে। নব্য বাবুবিলাস, অবহেলিত চরিত্রে গুরুত্ব হয়তো বোদলেয়র প্রাণিত। বোদলেয়র, রিলকে, হেল্ডার্লিন অনুবাদ বহু প্রশংসিত, মেঘদূত অনুবাদ ও ভূমিকা উল্লেখ্য। কিছু শিশুকবিতা স্মরণীয়। শিল্পের জাদুদণ্ড ছিল তাঁর হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি বক্রোক্তি তারুণ্যে থাকলেও বস্তুত রবীন্দ্র আবিষ্কারে অগ্রণী আলোচক। তাঁর বিচারী অন্তর্দৃষ্টি An Acre of Green Grass এবং অন্যত্র তারিফযোগ্য। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে তুলনামূলক বিচার দানে তাঁর কৃতিত্ব যথেষ্ট। 'শিল্পের জন্য শিল্প' মতবাদ প্রাণিত আলোচনা। ‘মহাভারতের কথা’ বইতে সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের বিচার, কবিতার সাতসিঁড়ি, কবিতার শত্রুমিত্র প্রভৃতি রচনায় তাঁর তীক্ষ্ণধী তারিফযোগ্য। ছোট গল্প রচয়িতা হিসেবে দক্ষতা প্রশংসিত। ভার্জিনিয়া উলফ, জীবনানন্দ, জয়েস প্রভৃতির সঙ্গে তুলনা। বাবুবিলাস সম্পর্কে বক্রোক্তি আছে। স্থাপন করেছেন বিশ্ব কথাসাহিত্য পটে। ‘তিথিডোর’ মধ্যবিত্ত জীবনের পারিবারিকতার intimate miniature হিসেবে, রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্যে অনুপম। নীটসের সাংস্কৃতিক নৈরাশ্যবোধ Spirit ও Life এর বিভাজন বোধ-এ উপন্যাস ভাবনায় ছায়া ফেলেছে। বিশেষত জয়েস। নায়ক চরিত্রের নির্জনতাবোধ অনেক গল্প উপন্যাসে। কিছু গল্পে প্রেম ও মৃত্যু চেতনা যেখানে শিল্পবোধ বড়ো হয়ে ওঠে। অনেক নতুন কথা এ অধ্যায়ে। মহাভারত নির্ভর কাব্যনাট্য, নির্জনবোধ ও অ্যাবসার্ডিটি কতিপয় নাটকে, কখনো ব্রাউনিং এর মোনোলগ স্মরণ করায়। পাতা ঝরে যায় নাট্যে গ্রটেস্ক পৃথিবী এবং শব্দের আদানপ্রদান Guenter Eich এর Traueme মনে করায়। লেখকের সিদ্ধান্ত বুদ্ধদেবের নাটকে আছে এক অন্তর্লোক যাত্রা তবে তা কখনো মিস্টিক নয়। যান্ত্রিকতা মুক্ত এবং বিশ্বসাহিত্যপটে বুদ্ধদেব রচনাকে স্থাপন পরিশ্রমী পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে বলে মনে হয়।
অনুবাদক অলোকরঞ্জনের কথা বলাটা নানা কারণে জরুরি বলেই মনে হয়। অন্তত ২১টি অনুবাদের তালিকা রয়েছে আমার কাছে। এর মধ্যে দুটি করা হয়েছে আলোক সরকার, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অনূদিত রচনার লেখকবৃন্দ সোফোক্লেস, সুমিত্রা নন্দন পন্থ, মহেশ্বর নেওড়া, হ্যেল্ডারলীন, কয়েকজন জার্মান গল্পকার, বীয়ারমান, ব্রেশট, সুরদাস, হাইনে, পেটার ওয়েজ, টিয়াস, বোটোস্ট্রাউস, সারা কির্শ, গ্যোয়েটে, ভিলহেলম বুশ, গুন্টার গ্রাস প্রভৃতি। এই বইগুলির ২/১টি নাটক, কখনো গল্প, কখনো গান, কখনো চিত্রকথা, কখনো কিশোরপাঠ্য, কখনো ভারতীয়, কখনো জার্মান। অন্যদিকে রয়েছে শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সম্পাদিত ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’ যাতে স্বনামে ও সুপর্ণা সেন ছদ্মনামে অনেক অনুবাদ আছে। এই বইটিতে আছে ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়, স্পেনীয়, ইংরেজি, মার্কিন, রুশ, চীনা, জাপানি ও কতিপয় টুকরো কবিতা। পৃথকভাবে একটা দেশের কিম্বা একজন কবির বা নাট্যকারের লেখা কেউ কেউ অনুবাদ করেছেন। কিন্তু অনুবাদ ও অনুবাদ্য বিচারে অলোকরঞ্জন অতুলনীয়। বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর নামোল্লেখ না করাটা অপরাধযোগ্য বলেই মনে হবে। কোনো কোনো অনুবাদ পরখ করে দেখেছি তা একেবারেই মূলানুগ, অনায়াস। ‘আন্তিগোনে’ অনুবাদে (১৯৬৩) তিনি বিষ্ণু দের মতোই মধ্যে মধ্যে ভারতীয়ত্ব সঞ্চার করে সমালোচিত হন। অচিরেই তিনি নিজেকে উৎস পাঠ্যে যথাসম্ভব নিবিষ্ট রাখতে চেষ্টা করেন। যুবকবয়সে কোলরিজ-এর ‘বুড়ো নাবিকের উপকথা’ কবিতাটির অনুবাদ পড়ে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম।
এটি এক দীর্ঘ কবিতা, এতে স্তবকে স্তবকে পঙ্ক্তি বিন্যাসে নানাত্ব আছে, ভাষা ব্যবহারেও (সংলাপ, বর্ণনা) ধরন পালটে পালটে গেছে। সামান্য উদাহরণ দেওয়া যাক্—
হঠাৎ উঠল প্রবল ঝটিকা সে যে বড়ো নিদারুণ পরাক্রান্ত, হানে দিকজোড়া তার ডানায় সে আমাদের আর পিছে-পিছে ধায় দক্ষিণ পানে। ‘বৃদ্ধ নাবিক, বাঁচান্ প্রভু তোমাকে পিশাচের হাত থেকে এ দুর্বিপাকে, একি তুমি কেন অমন তাকাও?’ ‘আমার তীর ধনুক বিঁধে বস্লাম অ্যালবেট্রসটাকে।’শুনেছি এই সাড়ে ২৫ পৃষ্ঠার কবিতাটি অতিদ্রুত অনূদিত হয়েছিল। জানা যাচ্ছে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্তে অলোকরঞ্জনের তর্জমা ছিল ৪৯টি কবিতা, ৭টি দেশের এবং সুপর্ণা সেন ছদ্মনামে আরো ১৫টি। হায়াৎ মামুদ সদ্য উল্লিখিত কবিতাটি সহ, ‘সলিটারি রিপার’ (ওয়ার্ডসওয়ার্থ), ‘রাজনীতি লিডা ও মিথুনহংস’ (দুটোই ইয়েট্স–এর) প্রসঙ্গে মুন্সিয়ানার কথা বলেন। এবং ‘ইংরেজি ও জর্মন ভাষা থেকে অনুবাদ করাতে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ বেশি।’ পশ্চিম জার্মানী প্রবাসী পঙ্কজ চট্যোপাধ্যায় আল্ডোনা গুস্টাস (জার্মান) এর একটি কবিতার অলোকরঞ্জনীয় অনুবাদ প্রসঙ্গে বলেন—‘অনুবাদটির বিশেষত্ব হচ্ছে, মূল কবিতার শব্দ সংখ্যার সাথে অনুবাদের জন্য ব্যবহৃত শব্দসংখ্যা একেবারে এক।’ তিনি আরো বলেন—‘গ্যেয়েটের একাধিক কবিতা ও রচনার অনুবাদ করেছেন। ... গ্যেয়েটের রচনার ভারতীয় উপাদান তথা ভারতীয় প্রভাবের আবিষ্কর্তাও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।’ গ্যেয়েটের ‘অসন্তোষের পুঁথির’ একটি স্তবক—
এবং যখন ফিরে এলো যেন সে এক স্বপ্নে পাওয়া, প্রবাসীর মতো একা, অধিকন্তু সে
শোকাচ্ছন্ন প্রাজ্ঞ আরেকজন যখন জাগল পরদিন প্রত্যুষে||
‘এটা মনে রেখো, অনবিমৃশ্যকারী, সংসার থেকে যাবে না ক্ষমতাখোর তবু বিদগ্ধ এবং স্বৈরাচারী কথোপকথনে হোক-না শরিক তোর।’ক্বচিৎ জার্মান কবিতায় একটু বাঙালি ভাব দেন (হাইনের কবিতা) যেমন—
‘মিষ্টুনি গাল, নরম চক্ষু দুটি কোঁকড়ানো সোনা চুলে অবিকল সন্ত প্রতিকৃতি’
[মিষ্টিগাল (আক্ষরিক) মিষ্টুনি]।
অন্যদিকে রবীন্দ্ররচনা জার্মানভাষায় অনুবাদ করেন জার্মানীতে স্থায়ীভাবে বাসের প্রায় দেড় দশক পরে। জার্মান ভাষায় ভারত ও বাংলার কবিদের বাংলা রচনার প্রথম জার্মান সংকলন করেন (৫০ জন কবির) রবীন্দ্র বিষয়ক অনুবাদে ‘প্রান্তিক’ ও শেষ জীবনের কিছু রচনা। ছবি ও ছড়ায় বাচ্চাদের কবিতার নমুনা—
বোকবন্দর নামের মানুষখানা/ গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের ছিল জানা।
আটপৌরে বা ছুটির দিনের বেশ/ বড়ো পাৎলুন, চোখা ইভনিং ড্রেস।
‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ (২০০০) নামে একটি শীর্ণ বই আছে যার গোড়াতেই বলছেন—‘বস্তুত শান্তিনিকেতনের কথা তেমন সাড়ম্বরে বলিনি’ এবং যদিও এককালে তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন তবু ‘শান্তিনিকেতন এখন আমার কাছে বিশেষ কোনো স্থান মাহাত্ম্যের প্রতিশব্দ নয়, বরং মনোভঙ্গির আরেকটি নাম।’ ‘এখন’ কথাটি ব্যাখ্যাত না হলেও জরুরি। মনে পড়ে আমি যখন শান্তিনিকেতনে চাকরি করছি তখন আমার ও স্বপন কুমার ঘোষের সাধ ছিল অলোকদাকে নিয়ে একটি বেসরকারি অনুষ্ঠান করব, যা করা যায়নি। শান্তিনিকেতন নিয়ে ওর নানা অভিমান ছিল তাই কোনো অনুষ্ঠানে সেখানে যেতে চাইতেন না, যদিও অদূরবর্তী গোয়ালপাড়ায় বন্ধু দেবতোষের বাড়িতে তার কিছু পরেই একবার গিয়ে ২/১টি দিন কাটিয়ে এসেছিলেন। ‘রবীন্দ্ররহিত স্বর্গে যাবার জন্যে আমার তেমন কোনো মাথাব্যথা ছিল না।’ (পৃ. ১৭), কলকাতা রিখিয়া শান্তিনিকেতন টুকরো স্মৃতির কোলাজ যেন বইটি। ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী আমার মনোভঙ্গি যা আজও আমার সত্তার সম্বল।’ (পৃ. ২১) একথার মধ্যে সত্য আছে অসত্য ও আছে। রিখিয়ার ভূখণ্ড, পিতামহ, মায়ের সেবাব্রতী চিত্র, পিতার কলকাতার কাজ এসবের মধ্য দিয়ে পিতারই উদ্যোগে শান্তিনিকেতন স্কুলে একেবারে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়া, মনে পড়ে তাঁর ‘বোলপুর স্টেশনের গায়ে, মন কেড়ে নেওয়া এক রকম রুক্ষতা’। লক্ষ্য করেছেন ‘একটি অদৃশ্য বৃত্ত ঐ ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে পাহারা দিচ্ছে।’ (পৃ. ৩০) সন্তোষ মজুমদারের অনামিক বাৎসল্য, প্রভাকরদার শিশুশ্রমণ স্নেহ, নির্মলচন্দ্র বা সুনীল সরকারের মাঠে ক্লাস নেওয়া, এক অতীন্দ্রিয় ভরসার চিত্রকল্প’ আমরা পাই। ‘শান্তিনিকেতনে জায়গা পাবার প্রধান শর্তই ছিল সুন্দর’ (পৃ. ৩৩) ‘রবীন্দ্র বিভূতি’ এবং ‘সৌন্দর্যের সেই চারণের অধিষ্ঠান’ ‘অসুন্দরের বিরুদ্ধে তাঁর ক্লান্তিহীন লড়াইয়ের পর্ব’ কথাগুলি পরে বিকশিত হয়, কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি রবীন্দ্র বক্তৃতামালায় ‘সুন্দরের অভ্যর্থনা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন ও যথাসময়ে বই হয়ে যায় সেই ভাষণ। সহপাঠী হিসেবে প্রেমেন্দ্র পুত্র হিরন্ময় বা প্রবোধ বাগচী কন্যা গোপা, বা ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কাছে গান শেখা বা ভাস্কর দুর্গাশংকর, বা অমর্ত্য সেন, শান্তিদেব ঘোষ কিম্বা প্রভাতকুমার অথবা ভূগোল শিক্ষক প্রমোদরঞ্জন, সহপাঠী তান লী, মধুসূদন কিংবা শিক্ষক নন্দলাল বা পুলিনবিহারী, সুবিনয় রায়, হীরেন্দ্র দত্ত অথবা রমেশ দা—টুকরো টুকরো প্রসঙ্গ জুড়ে খচিত হয় এক ফ্রেস্কো। এরই ফাঁকে ফাঁকে ঘুরেফিরে আসে ‘সুন্দরের সম্মোহনের’ দিকটা বা ‘সুন্দর কি কখনো জগৎ ও জীবনের দুর্বার সংগ্রাম থেকে নিজেকে আলগা করে রাখতে পারে?’ (পৃ. ৩৪-৩৫), ‘সেই সুন্দরই শিল্পীর কবচকুণ্ডল’ (পৃ. ৩৬) বা ‘রবীন্দ্রনাথের রক্ত দিয়ে তৈরি আয়তনে সুন্দর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুতি চলবে না’। (পৃ. ৩৭) ‘প্রতিদিন তাঁকে তৈরি করে নিতে হত সুন্দরের পাকাপোক্ত বনিয়াদ।’ (পৃ. ৩৭) এইসবের বিপ্রতীপ্রতায় আছে ‘শান্তিনিকেতনের সুডৌল উল্লাসের ঘরানা’, 'টুরিস্টদের রন্ধ্রসন্ধানের মতলব’, শিক্ষাদীক্ষার আদিখ্যেতা বিষয়ে আর্যা-তর্জা’ (পৃ. ৪২), নানাবিধ ঔদার্যের অন্তরালে চির উদ্যত নিষেধাজ্ঞা, দুরপনেয় বুরোক্রেসি, কোনো ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রায়নে ‘বিশ্বভারতীর প্রতিকূলতা’ কিংবা ‘অসিত কপট’ বা ‘পরশ্রীকাতরতা’-র কথা চকিতে উল্লেখিত। ছাত্রছাত্রীরা বরং আশ্রমভক্ত যদিও বিদ্রোহ বেমানান। এক ফাঁকে তিনি বলে নেন—‘চারপাশের গাঁয়ের মানুষজন কিংবা বোলপুরের কলমজুরদের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের কথা (পৃ. ৬৩) হয়তো পরিণত মনস্কতায় বুঝতে শিখলেন—‘আমাদের বরণীয় আধুনিক কবিদের নিয়তি রবীন্দ্রনাথ’ কিন্তু পাঁচমিশেলি রিচুয়ালে অধ্যুষিত শান্তিনিকেতন অলোকদাদের কাছে ‘অচলায়তন’ গণ্য হওয়া, জানালার বাইরেই ‘বিশ্বলোক’, (পৃ. ৬৭) ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে আছে পিয়ার্সন, আমিয়েলের দিনপঞ্জী। আমিয়েলের মূল্যায়ন (অন্তর্মুখী ভাবুক সমাজের পথিকৃৎ) (জ্ঞান, কর্ম, ভক্তির, ত্রিস্রোত অঙ্গীকৃত) এবং ‘আজ আমাদের জীবনের পরিপার্শ্বে কোনো বিখ্যাত আলোকবর্তিকা নেই বলে আর্তনাদ করে উঠবার দরকার নেই।’ (পৃ. ৭৩) ‘রবীন্দ্রনাথ যে স্বয়ম্ভু নন, শান্তিনিকেতনও যে তাঁর অস্তিত্বের সমস্তটাই নয়’—এ বোধ গ্রাস করে নিচ্ছিল। প্রসঙ্গ ফিরে যায় রিখিয়ায়, দুর্গাপুজোর সমারোহ, বরাবরই ভাজাভুজি ঝালঝোলের নিদারুণ পক্ষপাত’, সেখানে পূর্ণিমা সম্মেলনী, কথার ফাঁকে বলে নেন ‘নান্দনিক নাস্তিকের এই গোপন উপাসনাই বোধহয় সবচেয়ে বড়ো পূজা’ (পৃ. ৮০) একটি পল্লীই বিশ্বজগতের মেরুদণ্ড হয়ে ওঠার বোধ তাঁর অর্থাৎ লেখকের রবীন্দ্র প্রতীতির নিদর্শন। আস্তে আস্তে শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে এক আর্কেটাইপ, বেদনার্ত বোধে, শুধু বোধেই প্রত্যাবর্তন ভুবনডাঙার মাঠে। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় সূত্রে বলেন সবাইকে দীক্ষিত করার চেষ্টা নিজের শর্তে। কৈশোর শান্তিনিকেতনে ছিল পড়াশোনার নামে খেলাধুলো, ইউটোপিয়ার উৎসভূমি, স্বপ্নাভিরাম পল্লীতে বিনোদনের অন্য ধাঁচের প্রাচুর্য। কিন্তু বেদনার্ত চিত্তে কবুল করেন—‘আজ যখন জায়গাটার কোরক দীর্ণ হয়ে গেছে, সেখানে গিয়ে ছুটির বসতি বাঁধার কথা ভাবতেও পারি না।’ (পৃ. ৮৬) ছিল প্রাণের রসদ যথাসাধ্য সংগ্রহের চেষ্টা, প্রাক সভ্যতার আর্কেটাইপগুলো শনাক্ত করার বেদনা। আজ লেখকের কাছে কলকাতার মধ্যে মিশে রয়েছে শান্তিনিকেতন। এ ভাবেই ইউটোপিয়ার অনিবার্য স্থিতি, একজন আধুনিক প্রথাভাঙা কবির চোখে তাঁর বাল্যস্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়ার অনবদ্য দৃষ্টান্ত।
অলোকরঞ্জনের জীবন বিপুল, বৈচিত্র্যময় ও ব্যতিক্রমী। শান্তিনিকেতনে বাল্যে গান্ধীজী, সরোজিনী নাইডু, বিজয় লক্ষ্মী পণ্ডিতের সান্নিধ্য পেয়েছেন। আশ্রমিকদের সঙ্গে খেলা করার সময় গান্ধীজী সবরমতী আশ্রমের জন্য সাহায্য চান, অটোগ্রাফের বিনিময়ে। বালক অলোকরঞ্জন প্রতিবাদ করেন। ঠিক তেমনি জরুরি অবস্থার সময় রাজভবনে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে ধিক্কার দেন। ইন্দিরাকে বলেছিলেন এই জরুরি অবস্থা ও সেন্সর অরাজনৈতিক কবিকেও রাজনৈতিক করে দিল। জীবানানন্দকে একদা বলেছিলেন আপনার কবিতা বড়ো অ্যাবস্ট্রাক্ট লাগছে। জীবনানন্দ ক্ষুব্ধতায় তাঁর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেন, কিন্তু কিছু পরে নতুন কবিতা শোনান। অলোকরঞ্জনের জীবনানন্দ বইটি এবং আরও প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ জীবনানন্দ আবিষ্কারে অভিনব প্রেরণা দেয়। গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে একদা ছিল যথেষ্ট বন্ধুত্ব (মনে পড়ে টিন ড্রাম পড়তে আমাকে প্রবুদ্ধ করেন) কিন্তু একদা দেখা গেল গ্রাস ভুল ভারতীয়দের খপ্পরে পড়েছেন, কলকাতাকে ভুল বুঝছেন, রবীন্দ্র বিশ্লেষণে ভুল করছেন, তখন ধীরে ধীরে সম্পর্ক শিথিল হয়ে যায়। বাবা বিভূতি দাশগুপ্ত ছিলেন অনিল ও লীলা রায়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের সহযাত্রী। (মনে পড়ে এক দূর আত্মীয়ের জন্য বাসা সংগ্রহের জন্যে আমাদের কসবার বাসায় আসেন।) মা নীহারিকা দাশগুপ্ত ছিলেন সংগীতপ্রেমী, মানব দরদী, যাঁর বন্ধুত্ব ছিল ইন্দিরা দেবী ও মীরা দেবীর সঙ্গে। অলোকদা গান ও এস্রাজ বাজানোর তালিম নেন মায়ের কাছে। একটু অন্যভাবেই মার্কসকে দেখতে চেয়েছেন, একারণে 'মার্কস ও সুন্দর' প্রবন্ধটি লেখার পরই তিনি বাঙালি মার্কসবাদীদের কাছে পর হয়ে যান। অনেক পরে (১৯৯৩) এক সাক্ষাৎকারে বলেন—‘মার্কসকে ছাড়া এ শতাব্দী কল্পনাও করতে পারি না।’ গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তুলনামূলকতায় কাজ শুরু করেন জার্মানিতে। সমগ্রতার সন্ধান ছিল অন্বিষ্ট। সমকালীন ভারতীয় কবিতা জরিপের কাজ শুরু করেন ৮৬তে, বিভিন্ন কবির সঙ্গে কথা বলে। যেমন—বিষ্ণু দে, বাৎস্যায়ন প্রভৃতি। আকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্তির পর এক সম্বর্ধনা সভায় বলেন—‘শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতির সমুজ্জ্বল ভারতবর্ষ আজ নব্য হিন্দুয়ানির উগ্রতায় যে ভাবে ভেঙে যাচ্ছে, সময়ের এই সংকটে কবি কোথায় দাঁড়াবেন?’ চোরের ওপর বাটপাড়ি করে কি আমরা মাটিতে ভাত খাবো! বরং মাটির বাসনকে তুলে নেবো আমাদের নিত্য ব্যবহারিকতায়।’ অন্যদিকে নব্য নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা যুবকদের প্রতি সহানুভূতি দেখান অলোকরঞ্জন ও তাঁর স্ত্রী ট্রুডবার্টা। এক ভিন্ন ধাঁচের বিশ্বমানসিকতার শিল্পী ছিলেন সন্দেহ নেই।
সেটা ১৯৬৩ বা ১৯৬৪ হবে। এম. এ. পরীক্ষা দেবার প্রাক্কালে অলোকদার বাড়িতে গিয়েছিলাম ২/১টি রচনা বিষয়ে কিছু টিপস নেবার জন্যে। আমার বন্ধু নন্দলাল সিং তখন আলোকদার ভাই দীপঙ্করকে পড়াত। হয়তো সেই সূত্রে আলাপ হয়। দীপঙ্করের বোন কিটিও একই স্কুলের ছাত্রী, যে পরে দিল্লীতে একটি কলেজে অধ্যাপিকা হয়। অলোকদা জার্মানীতে যাবার আগে কিংবা ফেরার আগে দিনকয়েক ওদের সঙ্গে কাটাতেন। ওর মেজ ভাইও দিল্লীতে। একদিন অফিস যাবার মুখে বাসস্ট্যান্ডে দুর্ঘটনায় ওর আকস্মিক মৃত্যু। প্রথম আলাপেই মানুষটি আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন তাঁর সহৃদয় ব্যবহারে এবং মনস্বিতার প্রাচুর্যে। ওঁর মা গেট খুলে দিতেন, সাত সকালেই কয়েকজন দূরাগত মানুষ তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। মাসীমা একদিন বললেন অলোক শেষরাত্রে কাজ শেষে ঘুমোতে গিয়েছে, তোমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। সহমানুষেরা কেউ কবিতাপ্রার্থী, সম্পাদক বা অন্য কিছু। এর পর থেকে দীর্ঘকাল দেখেছি ওঁকে একা পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। কথা ছিল ওর কাছে পি.এইচ.ডি. করার। বিষয় ঠিক করে দিয়েছিলেন—বাংলা নীতিকবিতা। কবিতামনস্ক ছিলাম না, বিষয়টাও পছন্দ হয়নি, কিন্তু কাজে নেমেছিলাম। তারপর গ্যেটে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চর্চার কাজে উনি জার্মানী চলে যান। তিনি আমাকে পাঠান উজ্জ্বলকুমার মজুমদারের কাছে। এবার পছন্দসই বিষয় ঠিক হল—রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা ছোটগল্প—১৯২৩ - ১৯৪৭। প্রতিবছরই পরিযায়ী পাখিদের মতো অলোকদা এদেশে আসতেন আর আমরা উন্মুখ আগ্রহে শুনতাম ওর আশ্চর্য বাক্ভঙ্গি, অনায়াস অসাধারণ শব্দবন্ধ আর বিশ্বভাবুকতা। তাঁর হার্দ্য ভঙ্গিমা অতি দ্রুত মানুষের মন জয় করে নিত। প্রাক্-জার্মানী পর্বে তিনি ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক কিম্বা বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। ‘কিম্বা’ ব্যবহৃত, কারণ অধ্যাপনার বিস্ময়কর কৃতিত্বে তিনি দুটি বিভাগেই পড়িয়েছেন এবং তাতে নিয়ম বাধা হয়নি। অলোকরঞ্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শশিভূষণ দাশগুপ্তের কাছে ভারতীয় কবিতায় লিরিকের জন্মকথা নিয়ে ইংরেজিতে গবেষণাপত্র দাখিল করলেও যাদবপুরে পেয়েছিলেন স্বাগত সম্ভাষণ। অচিরেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে, ভারতবর্ষে। দেখেছি দূর গ্রামের যুবক এসেছে কবিতাপ্রেমে, এমনকী জেলের কারাধ্যক্ষ—কবিতা প্রেমে। বাঙালি, অবাঙালি অতিদ্রুত আপনজন হয়ে উঠত তারা। সামান্য কর্ম সহায়ক কিম্বা বস্তু বহনকারী কেউই তাঁর সুস্মিত সম্ভাষণ ও আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত হত না। পরবর্তীকালে সুযোগসন্ধানী যোগ্য, অযোগ্য কতো না মানুষ আসত, অলোকদার ফর্মালিটি ছিল অসামান্য। এক গ্রীষ্মের দুপুরে এসেছিল সুদূর বেলঘরিয়া থেকে এক গাছ-ওয়ালা, ওঁকে একটা ফুলগাছ উপহার দিতে, পূর্বপরিচয়হীন, কিন্তু সম্ভাষণে কোনো তুচ্ছতা ছিল না। ছোট্ট প্রকাশকের কর্মচারির জন্য চাকরির চেষ্টা করতে দেখেছি, তার বায়োডাটা পৌঁছে দিয়েছি। তুচ্ছকে সরিয়ে না দেবার এই অভ্যাস আমাদের মধ্যে বিরল। আমার মলিন জীবন নিয়ে গিয়েছি বারংবার আর ফেরার পথে শুচিস্নিগ্ধ মন নিয়ে বাসে উঠেছি। একবার সুযোগ পেয়েছিলাম ওঁর গলা খারাপ থাকায় অনেকক্ষণ ধরে স্বরচিত কবিতা শুনিয়ে ওঁকে বিরক্ত করার। আমার একটি প্রবন্ধের বই তাঁকে উৎসর্গ করে লিখি—‘শ্রদ্ধেয় অলোকদাকে—যাঁর অলোকসামান্য বিভায় আমরা রঞ্জিত বহুকাল।’ হয়তো এটি অনেকেরই মনের কথা। মোৎসার্ট আমার প্রিয়। একথা জেনে মোৎসার্টের একটি লং প্লে রেকর্ড আমার জন্য উপহার নিয়ে আসেন। চিলির কবি ভিক্টর হারার ওপর একটি ছোট্ট কাজ করছিলাম। চাইছিলাম—ভিক্টরের স্বকন্ঠে গীত কিছু গান। একবার ফেরার পথে ওঁর স্ত্রী ট্রডবার্টা-বৌদি জার্মান এক যুবগোষ্ঠীর কাছ থেকে এই গায়কের কিছু গান ক্যাসেট করে নিয়ে আসেন আমার জন্য। বাড়িতে গেলেই এর ওর তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন আর যে কোনো একটি স্বরচিত বই উপহার দিতেন। আমার সামান্য লেখাপত্র নিবেদন করতাম। মাঝে মাঝে বলতেন এই/ওই বইটা আমি নিয়ে যাব। প্রতিদিন কত না বই/পত্রপত্রিকা উপহার আসত, প্রায়ই নানা রেকর্ডিং বা ওয়ার্কশপে যেতেন, কখনো নাট্য অনুষ্ঠানে, কবিতা পাঠের আসরে অথবা সভা চালনায়। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল তাঁর। ক্কচিৎ কোনো বিরল মুহূর্তে উঠত কিছু সম্পর্ক ফাটলের কথা। পরিহাস আর শীলিত সংলাপ ছিল অফুরান, আদর করে লোক সমক্ষে আমাকে বলতেন—‘বৌদ্ধ শ্রমণ’। যদিও বৌদ্ধ শাস্ত্রের কিছুই জানি না আমি। ওঁর কাছ থেকে শিখেছি—অফুরান প্রাণশক্তির ব্যবহার, সংযত বাগ্মিতা আর বিশ্বপ্রজ্ঞাপ্রবাহে স্নাত হবার প্রবণতা। গল্প শুনতাম নানা বিদেশী সম্মেলনের, পাণ্ডিত্য সান্নিধ্যের, কিছু পেয়েছি ‘পুঁথিপট’ বা ‘ভ্রমণে নয় ভুবনে’ প্রভৃতি বই থেকে। যখন বার্লিন যাই, ইচ্ছে ছিল ওঁর বাড়ি যাব যা নানা ভারতীয় পুঁথি প্রতিকৃতি ফ্রেস্কো সজ্জিত, সেইখানে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তখন তিনি যাচ্ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মে অন্য দেশে। ভক্ত পঙ্কজ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে দায়িত্ব দিয়ে যান। পঙ্কজবাবু আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন, বিমানবন্দরে রিসিভ করেন, একদিন ডিনারে নিমন্ত্রণ করেন, আমার বক্তৃতা শুনতে যান, বার্লিন রেডিওর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেন। আমার পেনশনের বিলম্বের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, ভোলেননি কখনও। একবার পি.এইচ.ডি.-র পর পোস্ট ডক্টরাল কাজের আশা নিয়ে যাই শান্তিনিকেতনে ওর কাছে। উনি উৎসাহভরে বেশ কয়েকজন গণ্যমান্যের কাছে চিঠি লিখে দিলেন। একটি মূল্যবান মৌখিক উপদেশ ছিল সঙ্গে। আপনি যে বাড়িতে যাবেন তা আগে অন্যকে জানাবেন না আর যে বাড়ির পর অন্য বাড়িতে যাবেন সেটাও ব্যক্ত করবেন না। এতে শান্তিনিকেতন কাঠামোর ভেতরকার চেহারাটা বোঝা যায়। পুলিনবিহারী সেনের বাড়িতে যেমন বিব্রত হয়েছিলাম। উনি অসম্ভব রুষ্ট হয়ে ওঠায় বিস্মিত হই। আমি তাঁর অপরিচিত। ফিরে এসে কথাটা অলোকদাকে জানাই। উনি টেলিফোনে পুলিনবাবুর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পুলিনবাবু উত্তরে বলেন—কী করব, শঙ্খ হাজির ছিল যে। অলোকদা এটাও বলেছিলেন—‘ছেলেটি তো আপনার কাছে চাকরি চাইতে যায়নি।’ পরে চাকরি করতে গিয়ে শান্তিনিকেতন কালচারের সান্নিধ্য বেশ ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছিলাম। চিঠি লিখতেন, সবাইকেই লিখতেন, অজস্র। ছোট ছোট হরফে ২/৪ পঙ্ক্তির চিঠি, তাতে প্রয়োজনীয় কথা আর হার্দ্য সম্ভাষণ। আজ এধারে-ওধারে ছড়িয়ে আছে ওর উপহার আর চিঠি। অলোকদা একদা কবিতায় লিখেছিলেন—‘যেটকু সময় বাকি আছে তবে সেটাও কাটুক/ অক্ষরে অক্ষরে।’
বেলা পড়ে এল। আমার-ও এই একই কথা।
পুনশ্চ:
ক) অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বহুমুখী নান্দনিকতা, বিপ্রপট অধ্যয়ন ও জিজ্ঞাসা বিরল। তাঁর ভদ্রতাবোধ ব্যতিক্রমী। অথচ কেন জানি না আমার কাছে মান্য দুজন প্রাবন্ধিকের বইতে তাঁর জন্য একটি পঙ্ক্তিও নেই। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা কবিতার কালান্তর’ এবং অশ্রুকুমার সিকদারের ‘কবির কথা কবিতার কথা’ এবং ‘আধুনিক কবিতার দিগবলয়’ বই তিনটির কথা বলছি।