• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | গল্প
    Share
  • জয়তী ও তিন প্রেমিক : বিশ্বদীপ সেনশর্মা


    সুবিমলকে সে বারবার বলেছিল, তুমি কিন্তু দেড়টার মধ্যে চলে আসবে, আমি ওখানে দাঁড়াতে পারব না। কিন্তু এইচএসবিসি'র সামনে গিয়ে দেখল সুবিমলের পাত্তা নেই। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে ভিআইপি সুইটসের দিকে হাঁটতে থাকল। দোকানে ঢুকে সন্তু আর মুন্টির জন্য সন্দেশ কিনল। দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এসে সামনে ফুটপাথের দোকানের ম্যাগাজিন নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করল। তারপর ফিরে গিয়ে দেখল সুবিমল উল্টোদিক থেকে দ্রুতপায়ে আসছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতে দুইহাতে কানমলার ভঙ্গি করল। সে রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল। সুবিমল প্রতিবারই এই কাণ্ড করে। তাকে হাসতে দেখে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে কাছে এসে বলল, ট্যাক্সি ডাকি? সে ঘাড় নেড়ে বলল, কোথায় যাবে? সুবিমল বলল, ট্যাংরায় যাবে? দুপুরে ফাঁকা থাকে। সে আবার ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। তার মনে পড়ছিল গতবার পার্কস্ট্রীটে গিয়ে তার ননদের ছেলের প্রায় মুখোমুখি হয়ে গেছিল।

    সুবিমল ছোটাছুটি করে একটা ট্যাক্সি পেয়েও গেছে। দরজা খুলে তাকে উঠিয়ে নিজে পাশে বসে সুবিমল দরজা বন্ধ করল। ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। সুবিমল এখন একদৃষ্টে তাকে দেখছে। আজকে সে পরেছে হলুদ তাঁতের শাড়ি আর কালো জামা। কপালে ছোট কালো টিপ। হাল্কা প্রসাধন আর ঘামে তার মুখ চকচক করছে। জামাটা ছোট, নাভির অনেক উপরে শেষ হয়েছে। সুবিমলের দিকে না তাকিয়ে সে আঁচল ঠিক করল। সুবিমল তার বুকের দিকে লোভীর মত তাকিয়ে আছে। গাড়ি হাডকোর মোড় ছাড়িয়ে বাইপাসে পড়ল। সে সুবিমলের দিকে ফিরে চাপাগলায় বলল, ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকো না। সুবিমল হেসে উঠল।

    একটু পরে ট্যাংরার একটি অখ্যাত রেস্টুরেন্টে তারা বসেছিল। মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি। সুবিমল একটা হাত তার উরুর উপর রেখেছে। আশপাশে দেখার মত কেউ নেই তবু তার অস্বস্তি হচ্ছিল। যে লোকটা অর্ডার নিচ্ছে সে তো দেখছে। সে জোর করে হাতটা সরিয়ে দিল। সুবিমল আবার হাসল।

    ওয়েটার সুবিমলের জন্য বীয়ার আর তার জন্য কোক নিয়ে এল। সুবিমলের গ্লাসের কানায় বোতল ঠেকিয়ে সন্তর্পণে ফেনা না করে বীয়ার ঢালল। তাকেও কোক ঢেলে দিল। লোকটি চলে গেলে সুবিমল বীয়ারের গ্লাস তুলে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বলল, "আহ।" তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলল, "বলো আর কী খবর? " তার ভাবে-ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল তার সঙ্গে দুপুরটা কাটানোর সম্ভাবনায় সে খুশি ও তৃপ্ত।

    সে ঠোঁটে হাসি টেনে আনল। বলল, চলছে। তারপর কিছু বলতে গিয়ে সে থেমে গেল। সুবিমল লক্ষ করল না। সে তার ডান হাত আবার তার উরুর উপর রেখে বলল, কালকে আমাদের এবারের প্রোমোশনের লিস্ট বেরোবে।

    সে মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে বলল, কি মনে হচ্ছে, হবে এবারে?

    সুবিমল মুখ কুঁচকে বলল, দেখা যাক। গতবারেও তো হবে শুনেছিলাম। না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

    সুবিমল এরপরে তার বসের কথা বলতে লাগল। ভদ্রলোক মানুষ ভাল, কিন্তু ভীতু প্রকৃতির, অধস্তনদের জন্য মিটিংএ সেভাবে লড়ে যেতে পারেন না।

    এইসব কথা সে আগেও শুনেছে। তবু একটু পরে কিছু বলতে হয় বলেই সে হেসে বলবে, এবারে চাকরিটা পাল্টাও। তোমার তো যোগ্যতা আছে। সুবিমল খুশি হয়ে বলবে, খালি কাজ জানলেই হয় না গো, ঠিকমত যোগাযোগটাও হওয়া চাই। এইভাবে কথায় কথায় দুপুর গড়াবে। সুবিমল আরেক বোতল বীয়ার অর্ডার করবে। টেবিলের তলায় তার হাত ক্রমশ: সাহসী হয়ে উঠবে। একটু পরে চারিদিক দেখে নিয়ে সে জয়তীকে কাছে টেনে নিয়ে চুমু খাবে। চুমুপর্ব শেষ হলে জয়তী রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছবে। তারপর, বেয়ারা খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেছে, সুবিমল তৃপ্তির সঙ্গে খেতে ব্যস্ত, সে নিজের প্লেটে সামান্য একটু চিলি চিকেন নিতে নিতে সন্তর্পণে বলবে, তোমাদের বাড়িতে আমাকে একদিন নিয়ে যাবে? সুবিমলের মুখে সামান্য ছায়া সরে যাবে, সে হয়ত বলবে, "মার শরীরটা ভাল নেই জয়ি, একটু দাঁড়াও।" সে লজ্জিত হয়ে ভাববে ঠিকই তো, দুটি বাচ্চা সমেত একটি বিধবা মেয়ের সঙ্গে ছেলে মেলামেশা করছে জানলে কোন মা-ই বা খুশি হবেন?

    দুজনেই অফিসে হাফ ডে করে এসেছে সুতরাং তাদের প্রেমপর্ব অনেকক্ষণ চলল। দুটো বীয়ার খেয়ে সুবিমল অনেক কথা বলছিল। একসময় যথারীতি সে দীঘা বা মন্দারমণিতে যাবার কথা আবার তুলল। সে চুপ করে রইল কিন্তু তার মন বলছিল সুবিমলের প্রস্তাব বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সামনে মাংসখণ্ড দেখা কুকুরের মতই ক্রমশ: লোভী হয়ে উঠছে সুবিমল।

    তার কথায় হুঁ হাঁ করতে করতে ক্রমশ: সে পিছিয়ে যাচ্ছিল চার বছর আগের দিনগুলিতে। পাঁচ বছরের সন্তু আর কয়েক মাসের মুন্টিকে নিয়ে সে তখন বাপের বাড়িতে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে প্রাণপণে আঘাতটা সামলে উঠবার চেষ্টা করছে। দাদা একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেছিল, তাঁর দেওয়া ওষুধও নিয়মিত চলছে। একই সঙ্গে অভিরূপের অফিসে একটা চাকরির জন্যও চেষ্টা চালাচ্ছে।

    এইসময় তার স্কুলের বান্ধবী সুপ্রিয়া তাকে বলে, জয়ি, যা হবার হয়েছে এবার তুই বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যা। মাথার উপর ছাদটা খুব দরকার।

    সবদিক ভেবেচিন্তে সে ফিরে যাওয়াই ঠিক করে। শাশুড়ি ছেলেকে হারিয়ে শোকে উন্মাদ, তার উপর প্রাচীনপন্থী। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ছেলে চলে যাওয়ার জন্য তিনি জয়তীকেই দায়ি করেছিলেন। সুতরাং ফিরে যাওয়ার পর জয়তীর অভ্যর্থনা মধুর হয়নি। উঠতে বসতে জয়তীকে কথা শুনতে হয়েছে। নাতি নাতনির উপর টান ছাপিয়ে উঠেছিল সেই আক্রোশ। কিন্তু দাঁতে দাঁত চিপে পড়ে থাকা ছাড়া জয়তীর উপায় ছিল না। বাচ্চাদের নিয়ে দাদা বৌদির আশ্রয়ে পাকাপাকি ভাবে থাকার প্রশ্নই ছিল না। কী ভাগ্যি, এই সময়ে অভিরূপের অফিসে তার চাকরিটা হয়ে যায়। মাইনে খুব বেশি না হলেও মাস গেলে কয়েক হাজার টাকা শাশুড়ির হাতে তুলে দিয়ে সে যেন পায়ের তলায় কিছুটা জমি ফিরে পায়।

    এই ভাবে ঠেকা দিয়ে কোনরকমে চলছে। শাশুড়ি এখনও কথা শোনান। বাড়িটা ওঁর নামে, হয়ত উনি মেয়েকেই লিখে দিয়ে যাবেন। সে যা মাইনে পায় তাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকা যায় না। এই সব কথা ভাবতে বসলে রাত্রিবেলা তার বুকের মধ্যে ধকধক করে ওঠে, উঠে আলো জ্বালিয়ে সে ড্রয়ার থেকে ঘুমের ওষুধ বার করে খেয়ে নেয়।

    সুবিমল হাত তুলে ওয়েটারকে বিল আনতে বলল। তারপর জয়তীর দিকে তাকিয়ে বলল, "আজ কিছু হয়েছে?”

    সে মৃদু হেসে বলল, "নতুন কিছু নয়। রোজকার ঝামেলা।"

    সুবিমল তাকে কয়েক মুহূর্ত দেখল, তারপর তার হাত ছুঁয়ে শান্ত গলায় বলল, "আমার উপর ভরসা নেই তোমার?"

    সে আবার হাসল, বলল, "না থাকলে কি অফিস ছুটি নিয়ে প্রেম করতে আসি?"

    সে যাবে সিঁথিতে। সুবিমলের উল্টো দিকে। সুবিমল তাকে ছেড়ে আসতে চাইলেও সে রাজি হল না। অতটা পথ পাশাপাশি বসে গেলে কেউ দেখেও ফেলতে পারে। অগত্যা সুবিমল তাকে বাইপাসেই নামিয়ে দিল। বাসে উঠে সে লেডিজ সিটে জায়গাও পেয়ে গেল।

    সাতটা নাগাদ বাড়িতে ঢুকে সে দেখল তার ননদ ইরা ননদাইকে নিয়ে এসেছে। শাশুড়ি ময়দা মাখছিলেন, তাকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সে চট করে হাত-মুখ ধুয়ে ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। একেবারে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে বেরোবে। ওর মধ্যেই সন্তু মুন্টির পড়া দেখানো। আজকে বাড়তির মধ্যে বসার ঘরে গিয়ে ইরা আর সুজনদার সঙ্গে হাসিমুখে দুটো কথা বলে নেওয়া। এটা না করলে শাশুড়ি রাগ করেন।

    রাত্রে সব কাজ সেরে সে কম্পিউটার খুলে মেল চেক করতে বসল। এটা অভিরূপ থাকতেই কিনেছিল, সে কোনরকমে মেইনটেন করে যাচ্ছে। মেল চেক করা ছাড়াও অফিসেরও কিছু কাজে লাগে। প্রথমেই সে ম্যারেজ-পোর্টালে তার ইনবক্সে গেল। এক বান্ধবীর পরামর্শে এটা সে কয়েকমাস হল শুরু করেছে যদিও তার পক্ষে প্রায় বিলাসিতা, মাসে প্রায় হাজার টাকা করে দিতে হয়। অবশ্য রেসপন্স প্রচুর আসে। বেশিরভাগই বিবাহিত বা ব্যাচেলরদের কাছ থেকে। এগুলো সে এড়িয়ে যায়। দু- একটি আসে বিপত্নীক বা ডিভোর্সিদের কাছ থেকে, তবে দুই সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে শুনে শেষ পর্যন্ত আর কেউ আগ্রহ দেখায় না। শুধু এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কয়েকবার চ্যাটে ও স্কাইপে কথা হয়েছে।

    আজ সেরকম কিছু নেই। পোর্টাল বন্ধ করে নিজের মেল খুলে সে চমকে উঠল। বহুদিন পর অস্ট্রেলিয়া থেকে সুগত মেল করেছে। সে একনি:শ্বাসে পড়ে ফেলল। খুব একটা কাজের কথা নেই। কাজের চাপে অনেকদিন মেল করা হয়নি, ইত্যাদি। তার খবর জানতে চেয়েছে। সবশেষে লিখেছে মাস দুয়েক পরে সে দেশে আসছে, তখন নিশ্চয়ই দেখা হবে। সে নিজের মনেই হাসল, সুগত কি কলকাতায় থাকাকালীন ঘোরাঘুরি এবং সেক্সের জন্য একজন গার্লফ্রেন্ডের ব্যবস্থা করে রাখতে চাইছে?

    সুগতর সঙ্গে এক বিয়েবাড়িতে তার আলাপ হয়েছিল শশাঙ্ক চলে যাবার বছরখানেক পরে। সুগত সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, জয়তীর থেকে বয়সে বছর দুয়েক ছোটই হবে। তবু দুই সন্তানের মা জয়তীর সঙ্গে প্রায় বছর খানেক সে চুটিয়ে প্রেম করেছিল। জয়তী বিয়ের কথা তুললে সে খালি বলত আর কটা দিন দাঁড়াও, একটু সেটল করে নি। সেটল করতে গিয়ে সুগত শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। তার লাইনে নাকি ওখানে প্রচুর সুযোগ।

    শেষদিকে তারা শোয়াশুয়িও করত। ভিআইপি রোডের উপর বিভিন্ন হোটেলে দুপুরবেলা সুগত তার নগ্ন শরীরের স্বাদ নিয়েছে। সেও প্রাণপণে সাড়া দিয়েছে।

    কম্পিউটার শাট ডাউন করতে করতে সে ভাবল তবু সুগত এলে সে দেখা করবে। আর এক বার।

    পরের দিনটা ভাল গেল না। সকাল থেকে মুন্টির জ্বর। স্কুলে পাঠানোর প্রশ্ন নেই। অগত্যা শাশুড়িকেই বলতে হল একটু দেখতে। শাশুড়ির নাতি নাতনিদের উপর টান নেই এমন নয় তবু তাকে হেনস্থা করার সুযোগ পেলে ছাড়েন না। মুখ গম্ভীর করে বললেন, তুমি বরং ছুটি নিয়ে নাও বাপু আমি বুড়ো মানুষ, জ্বরটর বাড়লে কোথায় কী করব।

    সে কাতর গলায় বলল, সে রকম হলে ফোন করে দেবেন। আমিও দেখছি অফিসে দরকারি কাজ সেরে কত তাড়াতাড়ি বেরতে পারি।

    কিন্ত অফিসে গিয়ে ম্যানেজারকে বলতে গিয়ে বিশ্রীভাবে ধমক খেল। বললেন, আপনার রোজই কিছু না কিছু বাহানা। এত সমস্যা তো বাড়িতেই থাকুন, অফিসে আসেন কেন?

    এই সব শুনলে আগে তার কান লাল হয়ে উঠত, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। বরং সে চট করে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ঠিক আছে স্যার, আমি ম্যানেজ করে নিচ্ছি।

    সিটে ফিরে আসতে না আসতেই মেল এসে গেল, জিএম কাল একটা প্রেজেন্টেশন দিতে দিল্লী যাবেন, তার স্লাইডগুলি সবার কাছ থেকে নিয়ে কমপাইল করে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হবে। সাধারণত এই ব্যাপারটা বেশ কয়েক রাউন্ড হয়। ফাইনাল হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওরই মাঝে সে শাশুড়িকে বারবার ফোন করল, প্রথমবার উনি বোধহয় ইচ্ছে করেই তুললেন না, দ্বিতীয়বার তুলে বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোমার মেয়ের আবার জ্বর এসেছে, সঙ্গে কাশি, তুমি বাপু তাড়াতাড়ি এসে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।

    অফিস থেকে সে ছাড়া পেল সাতটা নাগাদ। ট্যাক্সি নিয়েও বাড়ি পৌঁছতে আরও আধা ঘন্টা। শাশুড়ির বাক্যবাণ শুনতে শুনতেই সে মুন্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পাড়ার একটি ছেলে ডাক্তারি পাস করে কাছেই চেম্বার খুলেছে, তাদের ভাল করেই চেনে। তার কাছ থেকে ফিজ-ও কিছুটা কম নেয়, ওষুধপত্রও বুঝেসুঝে লেখে। তবু সব মিলিয়ে ছশো টাকার মত লাগল। জ্বর না কমলে পরে ডেঙ্গুর টেস্টও করাতে হবে।

    সব পর্ব শেষ করে শুতে শুতে রাত প্রায় এগারোটা। সন্তু মুন্টি ঘুমিয়ে পড়েছে, শাশুড়ির ঘরে আলো জ্বলছে, উনি অনেক রাত অবধি বই পড়েন।

    মোবাইলে টুং করে মেসেজ ঢুকল। তুলে দেখল পোর্টালে আলাপ হওয়া সেই ভদ্রলোক। লিখেছেন, কথা বলতে পারি?

    সে শ্বাস ফেলল। এখন প্রেম বা প্রেমের অভিনয় কোনটাই করার অবস্থায় নেই। তবু কিছু লিখতেই হয়। সে লিখল, হ্যাঁ, তবে শুধু হোয়াটসঅ্যাপ।

    ভদ্রলোক লিখলেন, অগত্যা।

    সে একটা স্মাইলি পাঠাল। ভদ্রলোক লিখলেন, আমি ভাবছিলাম...

    - বলুন..

    - আমরা কি একবার দেখা করতে পারি?

    সে প্রথমে লিখল, আপনি চাইলে হতেই পারে। তারপর বেশি একপেশে হয়ে যাবে ভেবে ডিলিট করে দিয়ে লিখল, আমার আপত্তি নেই।

    - কালকে সন্ধ্যাবেলা?

    সে এবার নিজের মনেই হেসে ফেলল। তারপর লিখল, আগামী কয়েক দিনে হবে না। ভীষণ কাজের চাপ। লিখে আর একটা স্মাইলি যোগ করে দিল।

    - তা হলে রবিবার?

    মুন্টির শরীর ভাল থাকলে অসুবিধা নেই। সে লিখল, কাল-পরশু কনফার্ম করছি।

    ভদ্রলোক লিখলেন, ঠিক আছে। অনেক রাত হল, আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। গুড নাইট।

    সে গুড নাইট বলে ফোনটা সরিয়ে রাখল। তার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। ভদ্রলোক খুবই ভদ্র, হয়ত লাজুকও। অন্য কেউ হলে রাত জেগে ন্যাকান্যাকা যৌনগন্ধী কথা বলে যেত।

    এই ভদ্রলোক বিপত্নীক, বাবা-মা কেউ নেই। বিডন স্ট্রীটে দোতলা বাড়ি, একতলাটা ভাড়া দেওয়া। প্রেসের ব্যবসা। ইনি দুই পুত্র কন্যা সমেত তার দায়িত্ব নিতে রাজি হবেন? না কি আসলে সেই দীঘা-মন্দারমণির গল্প? কথাটা মনে হওয়ায় সে আবার নিজের মনে একচোট হাসল।

    বিয়ের পর কয়েকটা বছর ছাড়া সে কোনওদিনই খুব সচ্ছলতা বা নিরাপত্তার মধ্যে থাকেনি। বাবা কর্পোরেশনে সামান্য চাকরি করতেন, তারা মধ্য কলকাতার গলিতে দুই কামরার ভাড়া বাড়িতে থাকত। মা বেশ কষ্ট করেই লেখাপড়া শিখিয়ে তাদের দুই ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংএর প্রশ্ন ছিল না। তাছাড়া, তারা কেউই বিশেষ মেধাবী ছিল না, ফলে স্কুলের শিক্ষকরাও বিশেষ মনোযোগ দিতেন না। দুজনেই টায়েটুয়ে পাসকোর্সে গ্রাজুয়েট হয়েছিল। দাদা ওরই মধ্যে একটু উদ্যোগী ও যোগাড়ে ছিল, চট করে একটা ছোট প্রাইভেট ফার্মে চাকরি জুটিয়ে নেয় এবং ধাপে ধাপে কিছুটা উপরে উঠে যায়। ওই সময় কিছুদিন যেন সংসারের হাল একটু ফিরেছিল। তারপর বাবা রিটায়ার করলেন এবং হঠাৎ একদিন সামান্য জ্বরে ভুগে চলেও গেলেন। তারপর যে কে সেই। দাদা কিছুদিন পরেই নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে এবং বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝে যায় এ সংসারে সে অনভিপ্রেত। তখন সে পাগলের মত একটা চাকরি খুঁজেছে। মা অবশ্য কিছুদিন থেকেই তার বিয়ের চেষ্টা করছিলেন। শেষপর্যন্ত অভিরূপের মা এবং পরে অভিরূপ নিজে তাকে দেখে পছন্দ করে।

    তার পক্ষে অভিরূপ পাত্র হিসাবে যথেষ্টই ভাল ছিল। কলকাতার বুকে নিজেদের

    বাড়ি, মোটামুটি ভাল চাকরি, ছেলের সুন্দর স্বাস্থ্য ও চেহারা - এসবই তখন তার কাছে স্বপ্নের মত ছিল। বিয়ের আগে ঘোরাঘুরি করার সময়ে সে মাঝেমাঝেই অভিরূপের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকত, এই রূপবান ও গুণবান ছেলেটি কিছুদিন পরে তার বর হতে চলেছে একথা যেন তার বিশ্বাস হত না।

    বিয়ের পর সে চট করে অভিরূপদের সংসারে মানিয়ে নিয়েছিল। শাশুড়িকে সর্বদা তোয়াজ করে চলা কিম্বা ইরা বাড়িতে এলে একটু খাতিরযত্ন করা এসব কাজে তার ভুল হত না। তখন তাদের রান্নার লোক ছিল তবু প্রায়দিনই সে রান্নাঘরে ঢুকে একটা না একটা পদ রান্না করে সবাইকে খাওয়াত। অভিরূপও তাকে নিয়ে খুশি ছিল। যেদিন অফিস থেকে আগে ফিরতে পারত, তাকে নিয়ে বাইকে করে দিল্লী রোড ধরে বেরিয়ে পড়ত। রাত্রে কোন ধাবায় রুটি-মাংস খেয়ে ফিরত। ফেরার সময় বাইকের পিছনে অভিরূপের চওড়া পিঠে নিজের বুক ঠেকিয়ে বসে তার মনে হত সে কোনদিন এই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠবে না তো?

    তো তার জীবনে এই স্বপ্নের মেয়াদ ছিল ঠিক পাঁচবছর। তার মধ্যে দুবছরের মাথায় সন্তু চলে এল। নাতির মুখ দেখে শাশুড়ি খুশি হয়ে হার দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। আরও তিন বছর পরে মুন্টি। অভিরূপেরও এবার মেয়েরই শখ ছিল। ততদিনে সে অফিসে প্রোমোশন পেয়ে ম্যানেজার হয়ে গেছে, চুপিচুপি তারা একটা ছোট গাড়ি কেনার কথা ভাবছে। সন্তু সল্টলেকের নামকরা স্কুলে চান্স পেয়ে গেছে।

    এরপরই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। একদিন সন্ধ্যাবেলা, তারা যখন অভিরূপের বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে তখন থানা থেকে ফোনটা আসে। কিছুদিনের মধ্যে সে বুঝতে পারে ফোনটা শুধু তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়নি, তার ভাঙ্গা টুকরোগুলিও যেন ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তার হাত একেবারেই খালি।

    পরের দিন দুপুরে অফিসে পারমিতা এল। পারমিতা তার অনেকদিনের বন্ধু, সেলসের চাকরি করে, একটা স্কুটার নিয়ে সারা কলকাতা দাপিয়ে বেড়ায়। কাছাকাছি এলেই দেখা করে যায়। হাতে সময় থাকলে নীচে ফুড-কর্নারে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজনে দুপুরের খাওয়াটাও সেরে নেয়। দুজনের স্বভাবে খুব মিল নেই। পারমিতা স্বাধীনচেতা ও একরোখা। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করত। চাকরিতে ঢুকেও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মাঝেমাঝেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটা চাকরি ছেড়েছে। অবশ্য ওদের বাড়ির অবস্থা ভাল, কাঁকুড়গাছিতে বড় ফ্ল্যাট।

    সে বাবা-মার একমাত্র সন্তান। বিয়েটিয়ে এখনও করেনি, জিগ্যেস করলে মুচকি হেসে বলে একটা ছেলের জীবন নষ্ট করে কী লাভ? তবে ওর কাছেই শোনা, প্রাক্তন সহকর্মী এবং বয়সে ছোট একটি ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং শারীরিক সম্পর্ক আছে।

    নীচে নেমে এগ-রোল খেতে খেতে পারমিতা তার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করল। এই বন্ধুটির কাছে তার কিছু গোপন নেই। সে বলল, সুবিমল, সুগত আর নতুন ভদ্রলোকটির কথা। পারমিতা বলল, যদিও এই কথা তাদের মধ্যে আগে হয়েছে, আবার বলল, তুই এরকম বিয়ে পাগলা হয়ে উঠেছিস কেন?

    সে মৃদু হেসে বলল, ধরে নে বিয়েটা একটা বেশ ভাল নতুন চাকরি।

    পারমিতা ধমক দিয়ে বলল, তোর এই ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সটা আর গেল না। তুই আমার লাইনে চলে আয়, কিছুদিনের মধ্যে ডবল রোজগার করতে পারবি। খালি একটু ঘোরাঘুরি করতে হবে।

    সে বলল, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না রে।

    পারমিতার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই পরে কথা হবে বলে সে বিদায় নিল। বলে গেল কোনরকম দরকার হলেই তাকে জানাতে।

    আজ অফিসে চাপ ছিল না। পাঁচটা নাগাদ বাড়িতে ফোন করতে শাশুড়ি বললেন, মুন্টির আর জ্বর আসেনি। সে ঠিক করল যাবার পথে একবার ক্রীক রোতে গিয়ে মাকে দেখে যাবে। কিছু হাতখরচের টাকাও দিয়ে আসবে। বাবা যাবার পর মা পিএফ-এর যে কটা টাকা পেয়েছিলেন তাদের দুই ভাই বোনের বিয়ে দিতে প্রায় সবই বেরিয়ে গেছিল। সে এখন নিজের মাইনে থেকে যখন যেমন পারে মাকে কিছু দিয়ে আসে।

    দরজা খুলে তাকে দেখে বৌদি খুশি। টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। গতকাল গড়িয়াহাটে গিয়ে কী কী কেনাকাটা করেছে তাকে দেখাল। ছেলে সার্থক যে কত ভাল রেজাল্ট করেছে গর্বিত গলায় সেই খবর দিল। সবশেষে তারা যে শীগগিরই সন্তোষপুরে নতুন ফ্ল্যাট কিনে উঠে যাচ্ছে সেই খবরটা দিল। তার প্রথমেই মনে হল এরপর মাকে দেখতে গেলে বাস ও রিকশাভাড়া বাবদ কত টাকা বাড়তি খরচা হবে কে জানে।

    ছাড়া পেয়ে মায়ের ঘরে পৌঁছতে সন্ধ্যা। মার চেহারা আরও খারাপ হয়েছে। আসলে স্বামী চলে যাবার পর ছেলের সংসারে একরকম মানিয়ে নিয়েছিলেন, তারপর সুস্থ সবল জামাইয়ের এত অল্প বয়সে চলে যাবার আঘাতটা তিনি সহ্য করতে পারেননি। এখন সারাদিন ঘরের মধ্যেই শুয়ে-বসে থাকেন, সংসারের কাজেকর্মে বিশেষ থাকেন না, কখনও সার্থক খেলতে খেলতে চলে এলে দুটো কথা বলেন, ওই অবধি। মানুষটা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। কেমন আছ জিগ্যেস করলে মুখে একটা মলিন হাসি ফুটে ওঠে।

    মার হাতে টাকাটা দিয়ে আর পরে একদিন সন্তু মুন্টিকে নিয়ে আসবে বলে কথা দিয়ে সে উঠে পড়ল। রাতে ভদ্রলোককে পিং করে রবিবার কখন কোথায় দেখা করবে জেনে নিল। শাশুড়িকে কিছু একটা বলে যেতে হবে।

    তিনদিন পরে রবিবার দুপুরে সে পার্কস্ট্রীটে একটা রেস্ট্যুরেন্টে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসেছিল। শাশুড়িকে অফিস কলিগের বাড়ি নেমন্তন্ন বলে বেরিয়েছে। ফলত: দুপুরে খেয়ে আসতে পারেনি। ভদ্রলোক অবশ্য লাঞ্চের প্রস্তাব করেছিলেন, সে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। আপাতত দুজনে দুটো মকটেল নিয়ে বসেছে। ভদ্রলোক ছবির থেকে সুপুরুষ। লম্বা, পেটানো চেহারা। মুখশ্রীও মন্দ নয়। সব মিলিয়ে বেশ হ্যান্ডসাম।

    হোয়াটসঅ্যাপে আর মেলে প্রাথমিক আলাপ পরিচয় হয়েই আছে। তবু প্রথমে দু-চারটে সাধারণ কথাবার্তা চলল। কথা বলতে বলতে সে দেখল ভদ্রলোক আলাপচারিতায় বেশ স্বচ্ছন্দ। ব্যবহার ও কথাবার্তায় এমন একটা সহজ ভাব আছে যে কথা শুনতে ও বলতে ইচ্ছে করে। বস্তুত কিছুক্ষণ পরে সেই অনেক কথা বলছিল, ভদ্রলোক, নাম শুভময়, হাসি মুখে শুনছিলেন। দুটো মকটেল নিয়ে এক ঘন্টা বসে থাকা যায় না তাই তার অনুমতি নিয়ে ভদ্রলোক একটু পরে এক প্লেট কাবাব অর্ডার করলেন।

    আরও বেশ কিছুক্ষণ পর, যদিও তার নিজের ওঠার তাড়া ছিল না, ভদ্রতার খাতিরে সে বলল এবারে উঠতে হবে, আপনার নিশ্চয়ই দেরি হয়ে যাচ্ছে।

    শুভময় মৃদু হেসে বললেন, একেবারেই নয়, এখন বাড়ি ফিরে একা একা বোর হব। তবে আপনি বোর হলে অবশ্য উঠতেই হয়।

    সে হেসে ফেলে বলল, তা নয়, তবে আর বেশি দেরি হলে শাশুড়ি জেরা করবেন।

    শুভময় হাত উল্টে বললেন, অগত্যা। তা হলে আবার কবে দেখা হচ্ছে?

    সে এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিল। হাসি মুখেই বলল, আপনি কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব?

    - করুন।

    সে বলল, আপনি সুপুরুষ, নিজের বাড়ি-ব্যবসা আছে, নির্ঝঞ্ঝাট সংসার - আপনার পিছনে তো সুন্দরী মেয়েদের লাইন লেগে যাবার কথা। আপনি হঠাৎ আমার মত একজনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চাইছেন কেন?

    শুভময় মৃদু হেসে বললেন, ধরুন আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। প্রেম তো অত ভেবেচিন্তে হয় না।

    সে হাসল। শুভময় এবার মুখ থেকে হাসি মুছে ফেলে বললেন, আপনি সংশয়ে আছেন বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও সঠিক জানি না। তবে - শুভময় হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর রাখা তার হাত স্পর্শ করলেন - আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

    সে হাত উল্টে বলল, অগত্যা। এবার দুজনেই হেসে উঠল। সে ঘড়ি দেখে বলল, এবারে উঠি। দেখা করতে হলে আপনি একদিন সন্ধ্যাবেলা অফিসের কাছে কোথাও আসতে পারলে ভাল হয়।

    ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, আমি ফোন করে নেব।

    সেদিন রাত্রে সবাই ঘুমোলে সে সন্তর্পণে হোয়াটসঅ্যাপ খুলল। খুলে অবাক হয়ে দেখল শুভময়ের সঙ্গে তার আগের চ্যাটের কোন রেকর্ড নেই। এমনকী তার কনট্যাক্ট লিস্ট থেকেও শুভময়ের নাম কে যেন যত্ন করে মুছে দিয়েছে। যেন শুভময়ের মত কারও সঙ্গে তার আদৌ আলাপ হয়নি; সবটাই তার কল্পনা।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)