• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • লোথালের বাজুবন্ধ : অচিন্ত্য দাস


    মেদাবাদ থেকে মাত্র শ-খানেক কিলোমিটারের মধ্যে হলেও লোথাল দেখতে লোকজন তেমন আসে না। নামটাও কেমন যেন – ‘লোথাল’। মানে ‘মরা মানুষের ঢিপি’। শুনতে বিচ্ছিরি লাগে বলে অনেকে বলে ‘মৃতনগরী’। সেই পাঁচ হাজার বছর আগে, হরপ্পা-মহেঞ্জোদরোর সময় এখানে লোকবসতি ছিল। সে বসতির চাক্ষুষ প্রমাণ এ অঞ্চলে এখনো ছড়িয়ে রয়েছে। জায়গাটা মানে এই শহরটা নাকি বেশ সমৃদ্ধ ছিল। লোকে যাক না যাক আমার কিন্তু এসব পুরাতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক জায়গায় যেতে ভীষণ ভাল লাগে। মনে হয় এককালে কত মানুষের আনাগোনা ছিল, কত ঘটনা ঘটেছে। এখন তারা আর কেউ নেই – শুধু কিছু ভাঙ্গাচোরা বাড়িঘর অতীতের সাক্ষী হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আপিস থেকে ছুটি নিয়ে মাঝোসাঝে আমি একলাই বেরিয়ে পড়ি।

    আরেকটাও ব্যাপার আছে। সেটা নিজেকে নিয়ে হলেও, আমি আজও ঠিক করে সমস্যাটা বুঝে উঠতে পারিনি। এসব পুরোনো জায়গায় কিছুক্ষণ কাটালেই আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে, আমি কোথাও একটা গিয়ে বসে পড়ি। মনে হয় অনেক লোক যেন আমার চারপাশে। তারা অবাক চোখে আমাকে দেখছে – এ আবার কে এসেছে? আর দু-একজন কৌতূহলী হয়ে অদ্ভুত সব অজানা ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।

    কোলকাতায় ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। কিছুই পাওয়া যায়নি। আমি নাকি শতকরা একশো ভাগ সুস্থ। শেষে বন্ধুর কথায় একজনের কাছে গিয়েছিলাম। ইনি ডাক্তার নন, শুনলাম ইনি জীবনের ওপারের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে অনেক পড়াশুনো এমনকী হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। ভদ্রলোক আমাকে দু-একটা কথা জিগেস করলেন তারপর ‘তীক্ষ্ণ’ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার তো একটু একটু ভয় করছিল। উনি বললেন – তুমি পুরোনো দিনের কথা ভাবতে ভালবাসো আর তা থেকে তোমার মনের মধ্যে একটা ঘোর আসে। তুমি কল্পনায় অনেক কিছু অনুভব কর। আর একটা কথা। ভূত-প্রেত কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। তবে কী জানো, অনেকদিনের মরে যাওয়া মানুষজনের মনের কথা, মানে তাদের আাশা-নিরাশা সুখ-দুঃখ ইচ্ছে-অনিচ্ছে বাতাসে সূক্ষ্ম তরঙ্গ হয়ে ভেসে বেড়ায়। হতে পারে তুমি একজন ভাল ‘মিডিয়াম’ – সেইসব কথা তুমি শুনতে পাও, বুঝতে পারো।

    আমি একটা বোকার মত প্রশ্ন করে বসলাম ওনাকে। “আচ্ছা, এরকম হলে আমি কী করব?” উনি বললেন – “কী করবে? কিছু করবে না। ওরকম হলে চুপ করে শুয়ে বা বসে থাকবে। যখন বুঝবে ওরা চলে গেছে তখনই চলাফেরা করতে পারো, তার আগে নয়।”

    সে যাক গে। লোথালের কথা হচ্ছিল। সেবার এসেছিলাম আমেদাবাদের দিকে বেড়াতে। আমেদাবাদ বড় শহর, অনেক কিছু দেখার আছে – অনেক মন্দির, মসজিদ। পুরোনো দিনের জলতোলার কুয়োর চারপাশে রাজপ্রাসাদের মত সাজানো ঘরবাড়ি, সিঁড়ি। আর সাবরমতী নদী তো আছেই। খুব সুন্দর করে ঘাট বাঁধিয়ে বাগান করে দিয়েছে। সেখানেই সন্ধ্যেবেলা বসেছিলাম। অন্ধকার নেমে আসছে। দেখছিলাম জল বয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, এ যেন সময়ের নদী। ‘সময়’ কথাটা মাথায় আসতেই মনে হল, শহর তো পরেও দেখা যেতে পারে, কাল বরং লোথাল থেকে ঘুরে আসা যাক। সে কতযুগ আগেকার জনবসতি! এখন অবশ্যি সেখানে কেউ থাকে না।

    হোটেল থেকেই গাড়ি ভাড়া করলাম। ড্রাইভারের নাম কল্পেশ। অল্পবয়েসি গুজরাটি ছেলে, ভারী চটপটে আর হাসিখুশি। আমার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ধীরেসুস্থে একটু বেলা করে বেরিয়ে দুপুর বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম লোথাল। প্রথমে মিউজিয়মটা দেখলাম। এই অঞ্চল থেকে যত প্রাচীন নমুনা পাওয়া গেছে সব সেখানে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। নিচে বুঝিয়ে লেখা আছে কোন জিনিস কী কাজে ব্যবহার হত, কতদিন আগেকার জিনিস এইসব খবরাখবর। মিউজিয়ম দেখা হয়ে গেলে সেখান থেকে গেলাম একটা কাঁটাতার ঘেরা মাঠে। অনেকটা জমি। এখানেই পাঁচ-সাড়েপাঁচ হাজার বছর আগে একটা শহর ছিল। জায়গাটি হরপ্পা সভ্যতার অংশ বলে মনে করা হয়। আগেই বলেছি, লোথালে লোকজন বড় একটা আসে না। আর এই ভরদুপুরে চারিদিক ফাঁকা, কাউকেই দেখছি না। মিউজিয়ম থেকে আনা একটা ম্যাপ দেখে দেখে একাই হাঁটছি। কল্পেশ আসেনি, গাছের ছায়ায় গাড়ি রেখে তার ভেতরে ঘুমোচ্ছে বোধহয়।

    ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। পাগলের মত শোনালেও আমার মনে হয় নির্জন দুপুর আর গভীর রাত্তিরের মধ্যে কোথায় যেন মিল আছে। যাই হোক, যত দেখছি তত তাক লেগে যাচ্ছে। জাহাজ নোঙর করার ব্যবস্থাও ছিল এখানে! নদী অবশ্য এখন অনেক দূরে সরে গেছে। যেখানে বাজার বসত, সে জায়গাটা দেখলেই ঠাহর করা যায়। তখন লোহা জিনিসটা আবিষ্কার হয় নি – তবে তামা, সোনা, পেতল, কাঁসা এসব চলত। ধাতু গলাবার সরঞ্জাম এখনো কিছু কিছু রয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে বাড়ি, প্রত্যেকটা বাড়ির ছাদে পোড়ামাটির তৈরি কলসির মত জলের ট্যাংক। নোংরা জল নিষ্কাশনের জন্য নালি ... উফ্, ভাবাই যায় না। অবাক হয়ে দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম সেই কতদিন আগে লোকে বুদ্ধি আর পরিশ্রম দিয়ে একটা শহর গড়ে তুলেছিল! এমন সময় একটু চমকে উঠলাম। টেরই পাইনি কখন একটা লোক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল – “একটা জিনিস আছে, দেখবেন?”

    সাদা কুর্তা-পাজামা, মাথায় সাদা পাগড়ি। লোকটা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পকেট থেকে একটা পোড়ামাটির গয়না ধরনের জিনিস বার করল।

    হাতে নিয়ে দেখলাম – মেয়েদের হাতে পরার গয়নার ভাঙা টুকরো। এ জিনিসের চল এখনো আছে, তবে সোনা কিংবা রুপোর হয়। বাজুবন্ধ বলে – কনুই থেকে ওপরে পরতে হয়। জিনিসটা পোড়ামাটির হলেও দেখলাম এর ভেতর পেতল বা তামার তার দিয়ে করা কিছু নকশা গাঁথা রয়েছে। নকল নয় তো? মনে তো হচ্ছে পুরোনো দিনের জিনিসই হবে। সারা শরীরে একটা রোমাঞ্চের ভাব খেলে গেল – সেই হরপ্পার যুগের নিদর্শন আমার হাতে! লোকটি বলল খুব সস্তায়, মানে পাঁচ হাজার টাকায় দিয়ে দেবে। এরা স্থানীয় লোক, পয়সা রোজগার করতে চাইছে। অবশ্য নিয়ম হল এরকম কিছু পেলে, মিউজিয়মে জমা দিতে হয়। নমুনা বাইরে নিয়ে যাওয়া নিষেধ।

    মনে একটু দ্বিধার ভাব এল। নেব কি নেব না। যদিও জিনিসটাকে এক ধরনের চোরাই মাল বলা যেতে পারে তবু সেই কতদিন আগেকার হরপ্পা সভ্যতার নমুনা আমার আলমারিতে থাকবে! লোভ সামলাতে না পেরে দর করা শুরু করলাম – শেষে দু-হাজারে রফা হল।

    যখন ফিরছিলাম তখন নিজেকে বেশ কেউকেটা বলে মনে হচ্ছিল। আমার হাতব্যাগের ভেতরে এক অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কাঁচের শো-কেসে রাখব, বন্ধুবান্ধবরা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।

    হোটেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল পার হয়ে গেল। চা-টা খেলাম, পায়ে হেঁটে হোটেলের চারপাশটা একটু ঘুরলাম। সারাদিন ধকল গেছে, রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে শুয়ে পড়লাম। আর শোয়া মাত্র ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এল।

    জানালা বন্ধ করে শুতে পারি না, তাই খুলেই শুয়েছিলাম। গভীর রাত্তিরে কোনো কারণে ঘুমটা ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছের ডালপালা আর আকাশ। শুক্লপক্ষের রাত্রি, চাঁদের আলোয় ভাসছে নিঝুম পৃথিবী। ঘুমটা কেন ভেঙেছে তা এবার বুঝলাম। কাদের যেন কথার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ভয়ের কথা হল, এই ঘরের মধ্যেই কারা যেন নিচু গলায় কিছু বলছে। ভাষা অন্য, কিন্তু কী বলছে তা আমি যেন বেশ বুঝতে পারছিলাম। একটা ছোট মেয়ের গলা পেলাম --“মা, মা, দেখ আমি বলেছিলাম না এই লোকটাই ওটা নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস পেছনে পেছনে এসেছিলাম।”

    মা বলল – “হ্যাঁ রে, তুই ঠিকই দেখেছিলি। ওই দ্যাখ, ওই তাকের ওপর রেখেছে।”

    মেয়েটি বলল –“চলো, ওটা নিয়ে যাই, ওটা তো আমাদের জিনিস। তুমিই তো আমাকে কিনে দিয়েছিলে।”

    মেয়েটির মা যে কী বলল তা ঠিক বুঝতে পারলাম না তবে কেমন একটা দীর্ঘশ্বাসের আভাস পেলাম।

    কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। আমি কাঠের মত হয়ে গিয়েছি, শুয়ে শুয়ে কান খাড়া করে শুনছি। বাইরের চাঁদের আলো ঘরেও কিছুটা আছে, তাতে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। যারা কথা বলছে তারা নিশ্চয় অদৃশ্য।

    হঠাৎ একটা তীব্র বুকফাটা কান্নার আওয়াজ শুনলাম। মেয়েটি কেঁদে উঠেছে। --“মা মা আমি ওটা পরব কী করে, আমার তো হাত-পা কিছু নেই – ও মা আমরা কেন এরকম হয়ে গেছি, মা আমাকে বলো আমরা কেন এরকম হয়ে গেছি….”

    বাইরে একটা নিশাচর পাখি ঠিক একই রকম তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে কোথায় যেন উড়ে গেল।

    তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। আমি ঘেমে নেয়ে কোনো রকমে বিছানায় উঠে বসলাম। আর ঘুম হল না। শেষরাতে নিচে গিয়ে কল্পেশ, মানে ড্রাইভারকে জোরজার করে ঘুম থেকে ওঠালাম। এত রাতে কেন, কী জন্য এসব প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে বললাম – “লোথাল। এখনি যেতে হবে।”

    ******

    খালি রাস্তা, যেতে বেশিক্ষণ লাগল না। অত ভোরে কেউ কোথাও নেই, গেটও খোলেনি। কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। কাঁটাতারের বেড়া টপকে ঢুকে পড়লাম মৃতনগরীতে। হাত-চারেক উঁচু একটা পাঁচিল দেখলাম, কোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। পাঁচিলটায় একটা বেশ গভীর ফাটল ছিল, তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বাজুবন্ধটা রেখে দিলাম।

    চোখ বুঁজে বললাম –“লোভে পড়ে তোমাদের জিনিস নিয়ে গিয়েছিলাম, খুব ভুল হয়ে গেছে। এই ফেরৎ দিয়ে গেলাম। যদি পারো আমাকে তোমরা মাফ করে দিও...”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments