তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই হেঁটে চলেছে প্রচেত। সে যে কবে থেকে হাঁটছে, আর কেনই বা হাঁটছে, কোন কিছুই আর তার মনে পড়ছে না। ভারী ব্যাগটা বইতে বইতে কাঁধ টনটন করছে। কী এত ভরেছে ব্যাগের মধ্যে? সেও তো আর মনে নেই।
আবছায়া আলোয় হাতের মুঠোয় ধরা কার্ডটাতে সে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সত্যিই কি এই নির্জন রাস্তা দিয়ে গিয়ে কোথাও শ্রী আম্মার হোমস্টে আছে? থাকলেও দেখা যাচ্ছে না, কারণ বৃষ্টিতে চারদিক ঝাপসা হয়ে আছে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই রাস্তার ধারে একটা গেট দেখতে পেল প্রচেত। পাশে একটা সাইনবোর্ডে কালোর ওপর সোনালী দিয়ে লেখা “শ্রী আম্মাস্”।
যাক্, লোকটা তাহলে বোকা বানায়নি।
দারোয়ান গোছের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ঝড়বৃষ্টির জন্যেই বোধহয় তারা গেট ছেড়ে পালিয়েছে। প্রচেত নিজেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। হোমস্টে যখন, নিশ্চয়ই প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়।
কিন্তু আশ্চর্য তো, ভেতরেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু একটা বড় মাঠ, আর ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে একটা পায়েচলা পথ বেঁকে গেছে। পাশে একটা খাল। সেখানে একটা ছোট্ট নৌকো দাঁড়িয়ে আছে।
আদৌ এই হোমস্টেটা চালু আছে তো?
একটু ইতস্তত করে প্রচেত পথটা ধরে খানিকদূর এগিয়ে গেল। এইবার একটা পুরনো স্টাইলের একতলা বাড়ি চোখে পড়ল। সামনে তুলসীমঞ্চ। তিন চার ধাপ লাল সিঁড়ি উঠে গিয়ে একটা বারান্দা, তার দু'ধারে বসার টানা সীট।
আর এক ঝলক কমলা রং।
প্রচেত কয়েকবার চোখের পাতা ফেলল। সে ঠিক দেখছে তো? হ্যাঁ, ঠিকই দেখছে।
বৃষ্টিতে ধূসর প্রকৃতি আর তার মাঝখানে জ্বলন্ত কমলা।
কী আছে ওখানে?
কোন্ এক অমোঘ মন্ত্রবলে, নিশ্চিত পদক্ষেপে প্রচেত বাড়িটার দিকে এগোতে থাকল। ওই কমলা রং তাকে আলেয়ার মতো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সিঁড়ির নীচে এসে চোখ তুলে তাকাতেই...
আহাঃ!
আগুন রঙের কুর্তা, এলানো চুল, হাতে খোলা বই...
প্রচেত ওর কাঁধের ব্যাগটা আলতো করে নামিয়ে রাখল।
“হ্যালো, আই অ্যাম প্রচেত মজুমদার--”
বইয়ের মালিক একবার অলস চোখে প্রচেতর দিকে তাকিয়ে নিল।
“শ্রী আম্মাকে খুঁজছ তো? জাস্ট আ সেকন্ড।”
যে পাতাটা পড়ছিল সেটাতে একটা আঙুল রেখে বইটা বন্ধ করে নিল। তারপর নূপুরের শব্দ তুলে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য, ক্ষণিকের শূন্যতা...
তারপর ভেতর থেকে একজন ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন। দেখতে আগের জনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। হাইট বেশি না কিন্তু মুখে একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা, পরনে একটা নীল রঙের সুতির শাড়ি।
ইনিই তাহলে শ্রী আম্মা।
প্রচেত কয়েক পা এগিয়ে গেল।
“নমস্কার, আমি প্রচেত মজুমদার। আমার বাইকটা খারাপ হয়ে গেছে...”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, জর্জ বলেছে আমাকে। এসো, তোমার জন্যে পাঁচ নম্বর রুমটা রেডি করে রেখেছি।”
শ্রী আম্মার পেছন পেছন প্রচেতর গৃহপ্রবেশ হল। বারান্দা দিয়ে ঢুকেই একটা বসার ঘর, আর সেটা পেরিয়ে একটা চৌকোনা খোলা উঠোন। শ্রী আম্মা উঠোনের বাঁদিকে ঘুরল। একটা বন্ধ দরজা পেরিয়ে পরের দরজাটার সামনে দাঁড়াল। তারপর তালা খুলে প্রচেতকে ঢুকতে বলল। প্রচেত দেখল দরজায় একটা তামার নেমপ্লেটে লেখা আছে 'তিরুপতি'।
বেশ বড় ঘরটা - দু'দিকে দুটো সিঙ্গল খাট, সাদা চাদর বালিশ আর পায়ের কাছে নীল সবুজ প্যাটার্ন করা কম্বল। দুটো খাটের মাঝখানে একটা পুরনো ডিজাইনের কাঠের ড্রেসিং টেবিল। তাছাড়া ঘরের কোণায় একটা ওয়ার্ডরোব, একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা আছে। বাকিটাও দেখিয়ে দিল শ্রী আম্মা। বাথরুমে বেসিন, গিজার, বাথটব সবই আছে। আরেকটা দরজা খুললে একটা নিজস্ব বারান্দা।
“তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“থ্যাংকস,” বলেই কি খেয়াল হল প্রচেতর। একটু ইতস্তত করে বলল, “বারান্দায় যাকে দেখলাম...”
“মিসেস রায়? তিন নম্বরে আছেন,” বলে শ্রী আম্মা দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মিসেস...
প্রচেতর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এখন এ সব ভাবার সময় নয়। ভিজে জবজবে ব্যাগটা খুলে ক্যামেরাটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। তারপর জামাকাপড় বের করে ওয়ার্ডরোবে টাঙ্গিয়ে ফেলল। শেষে মোবাইল চার্জে লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ফ্রেশ হয়ে নিয়ে প্রচেতর আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। সামনের বারান্দাটা মন টানছে – আরেকবার যদি দেখা পাওয়া যায়...
এই এক ঘন্টায় যেন প্রচেত নতুন জীবন পেয়েছে!
আছে! ওইতো বসে আছে!
প্রচেতর বুকটা দুরুদুরু করছে। একটু সাহস করে এগিয়ে গেল।
“প্রচেত মজুমদার,” হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
'সে' অলসভাবে তাকিয়ে দেখল। তারপর প্রচেতর হাতে আলগা করে আঙুলের ডগা ছোঁয়াল।
“শর্বাণী রায়।”
“নরওয়ে নো মোরি?” হাতের বইটার দিকে ইশারা করল প্রচেত, “তুমি মুরাকামি পড়তে পছন্দ কর?”
“প্লিজ বোল না তুমিও পছন্দ কর।”
“কেন বলব না?”
শর্বাণী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আলাপ করার খুব পুরনো কায়দা এটা।”
প্রচেত শর্বাণীর পাশে বসে পড়ল।
“মুরাকামি আমার ফেভারিট লেখক। কাফকা অন দ্য শোর...উফ্, জাস্ট ভাবা যায় না!”
শর্বাণীর ভুরু একটু উঠে গেল।
“ওই একটা নাম বোধহয় সব বাঙালিই জানে।”
“এই, এরকম বোল না। কাফকা আমি শুধু পড়েছি তাই না গল্পটা নিয়ে আমার নিজের অনেক থিয়োরিও আছে।”
শর্বাণী কথাটা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না। বইটা পাশে নামিয়ে রেখে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে বলল, “তা শুনি কি থিয়োরি আছে।”
প্রচেত চাপে পড়ে গেল। কথাটা সে বলে ফেলেছে বটে, কিন্তু হুট করে কেউ জিজ্ঞাসা করলেই কি কাফকা পড়ে যা যা থিয়োরি ভেবে বের করেছে, সব হড়হড় করে উগরে দেওয়া যায় নাকি? একটু ভেবে মাথার ভেতর খানিকটা গুছিয়ে নিল।
“দেখো, প্রথমতঃ আমার মনে হয় না নাকাতা কাফকার বাবাকে খুন করেছে। ওটা নাকাতা স্বপ্নই দেখছিল। কেন বলছি, টিভি বা খবরের কাগজে যখন কাফকার বাবার খুনের কথাটা বেরিয়েছিল তখন কিন্তু একবারও বেড়ালের কোন উল্লেখ ছিল না। নাকাতা যেটা দেখেছিল সেটা সত্যি হলে কি বেড়াল বা কাফকার বাবার পোশাকআশাকের কথা কেউ উল্লেখ করত না? প্লাস নাকাতা যখন ঘুম থেকে উঠল ওর গায়ে কোন রক্তও লেগে ছিল না।”
“না, আমার মাথায় এটার একটা আলাদা ব্যখ্যা আছে,” শর্বাণী সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সেও আলোচনায় উৎসাহ পেয়ে গেছে। “কাফকা ওর বাবাকে খুন করতে চেয়েছিল তাই ওর হাতে রক্ত লেগেছিল। নাকাতার খুন করার ইচ্ছে ছিল না তাই ওর হাতে রক্ত লাগেনি। মানে শারীরিক ভাবে কে খুন করেছে সেটা বড়ো কথা না, ইন্টেনশনটাই আসল...কিন্তু এটা তুমি ভালো পয়েন্ট বলেছ। কোথাও বেড়ালের উল্লেখ ছিল না কেন?”
“আচ্ছা এটা বল!” উত্তেজনায় প্রচেতর চোখ গোলগোল হয়ে গেছে, “সাএকি কি সত্যিই কাফকার মা ছিল?”
“পাথরের পেছনের জগৎটাকে যদি সত্যি বলি--” বলেই তর্জনী নাড়ল শর্বাণী। “না! এটা নিয়ে তর্ক শুরু করলে সারা রাত কেটে যাবে!”
দু'জনেই হেসে ফেলল।
“ইউ অবভিয়াসলি নো ইয়র মুরাকামি!” একসঙ্গেই বলে উঠল দু'জনে।
“ওঃ তুমি এখানে!” শ্রী আম্মা একটা ট্রে নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। “লক্ষ্মী বলল তুমি ঘরে নেই। নাও, গরম গরম খেয়ে নাও!”
সীটের ওপরে ট্রেটা রাখল শ্রী আম্মা।
“শ্যাল আই গেট এনিথিং ফর ইউ, মিসেস রায়?”
“থ্যাংকস, আই অ্যাম ফাইন।”
প্রচেত ট্রের দিকে তাকিয়ে দেখল। মাখন টোস্ট, ধোঁয়া ওঠা ফিল্টার কফি আর — মুখে দিয়ে বুঝল — কলার আপ্পাম। বৃষ্টির বিকেলে দারুণ ব্যবস্থা।
শর্বাণী আবার বইয়ে মন দিয়েছে। কফির মগ হাতে প্রচেত বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে, দূরে একটা একটা আলো জ্বলছে, একটা মন্দির থেকে বাজনার আওয়াজ আসছে...আর বৃষ্টি...বৃষ্টির বিরাম নেই...
দুপুর আর রাতের খাওয়া ডাইনিং রুমে একসঙ্গেই হয়। প্রচেতর আশংকা ছিল ডিনার করতে গিয়ে নিশ্চয়ই শর্বাণীর স্বামীর সঙ্গে আলাপ করতে হবে। কিন্তু সে বেশ অবাক হয়ে দেখল শর্বাণী একাই এসেছে। বরং মিস্টার আর মিসেস পিল্লাই বলে এক বয়স্ক দম্পতির সঙ্গে আলাপ হল।
শ্রী আম্মাই খাবার বেড়ে দিল। এরিশেরি বলে একটা ডিশ ছিল যা প্রচেত আগে কখনও খায়নি। সঙ্গে ভাত আর চিকেন কারি।
শ্রী আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে প্রচেত জানতে পারল বাড়িটা নাকি প্রায় একশো বছরের পুরনো। পরে অনেক মেরামত হয়েছে, কিন্তু মূল কাঠামোটা একই রাখা হয়েছে। এই ধরনের বাড়িকে বলা হয় নালগেট্ট। বাড়ির প্ল্যানটাও মোটামুটি বুঝিয়ে দিল শ্রী আম্মা।
“শোয়ার ঘর টোটাল ছ'টা। ডানদিক দিয়ে গেলে প্রথমে সহ্যাদ্রি — ওখানে মিস্টার পিল্লাইরা আছেন। তারপর লেপাক্ষী। তারপর বাঁদিক ঘুরলে ভেম্বনাড় — মিসেস রায় ওখানে আছেন। তারপর চার নম্বরে আমি থাকি। আবার বাঁদিক ঘুরলে তিরুপতি আর শেষে তুঙ্গভদ্রা। এছাড়া বসার আর খাওয়ার ঘর তো দেখেইছ।”
“সীজনে এলে ঘর পাওয়াই যায় না,” লক্ষ্মী একগাল হেসে জানাল।
“কাল ব্রেকফাস্টে ঘি রোস্ট দোসা হবে নাকি?” বাটারমিল্কের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মিস্টার পিল্লাই শ্রী আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন।
“ইয়েস, ইয়েস,” শ্রী আম্মা সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল। প্রচেতর দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ মাস্ট ট্রাই আওয়ার ঘি রোস্ট দোসা!”
“পিটারকে একবার পাঠিয়ে দিও না,” মিসেস পিল্লাই অনুরোধের সুরে বললেন, “গিজারটা ঠিক মতো কাজ করছে না।”
ডিনার শেষ করে ঘরে গিয়ে পামুকের 'স্নো' নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল প্রচেত। কোলকাতায় থাকতে কতবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পড়ার সময়ই হয়ে ওঠে নি।
কিন্তু এখানেও আর বইয়ে মন কই? মাথায় তো ঘুরছে শুধু 'মিসেস রায়'। মিসেস...কি বিচ্ছিরি একটা শব্দ। এই একটা শব্দ সবকিছুকে কত জটিল বানিয়ে দিল।
আচ্ছা, মিস্টার রায় কেমন লোক হতে পারে? সে কি শর্বাণীকে ভালোবাসে? অ্যাপ্রিশিয়েট করে? নিশ্চয়ই করে না, নাহলে কি এরকম রোম্যান্টিক বর্ষার রাতে বউকে একা রেখে দেয়? নির্ঘাত খুবই নিরস, বৈষয়িক ধরনের লোক হবে সে। শর্বাণী কিছুতেই তার সঙ্গে সুখে নেই। ভেবে একটু আনন্দ হয় প্রচেতর।
আরো কতরকম কল্পনায় রাত কেটে যায়। ছাতের ওপর বৃষ্টি ঝরতেই থাকে...
সকালে উঠে পর্দাটা সরিয়েই প্রচেত বিরক্ত হয়ে গেল। আজও সবকিছু রুপোলি চাদরে ঢাকা। ব্রেকফাস্টের পর আবার পামুকটা নিয়ে বসবে কি না ভাবছে এমন সময়ে দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখে শর্বাণী দাঁড়িয়ে আছে।
“আরে! এসো ভেতরে এসো!”
“কোথাও বেরতে পারছি না, একা একা আর ভালো লাগছে না,” বলতে বলতে ঘরে ঢুকে এল শর্বাণী।
প্রচেত ফাঁকা খাটটার দিকে ইঙ্গিত করল। তার বুকের ভেতর সেই নার্ভাস দুরদুরুনিটা আবার শুরু হয়ে গেছে।
“বারান্দায় বসা যায় কি?” শর্বাণী নাক কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “সারাদিন ওই এসির হাওয়া আমার একদম পোষায় না।”
প্রচেতর ঠান্ডা ঘর ছেড়ে বেরনোর কোন ইচ্ছেই নেই, কিন্তু উপায় কি? শর্বাণীকে খুশি করার জন্যে বাইরেই বসতে হল।
এসি না থাকলেও বারান্দাটা বেশ ছিমছাম, সুন্দর। দুটো আরামকেদারা আর একটা ছোট টেবিল পাতা আছে। সামনে তাকালে একটা বড় লন দেখা যায়, তার পেছনে নারকেল গাছের সারি, আর তারও পেছনে একটা প্রকাণ্ড ঝিল।
একটা আরামকেদারায় বসে পা মুড়ে নিল শর্বাণী। প্রচেতও পাশে বসল।
“কফি বলি?”
শর্বাণী মাথা নেড়ে না বলল। তারপর চুপচাপ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
এক মিনিট...দু’মিনিট...প্রচেত উসখুস করতে লাগল। শর্বাণীর কথা বলার তাড়া আছে বলে মনে হয় না।
এটা তো নিজের ঘরে বসেই করতে পারত!
প্রচেত দু'একবার একথা-সেকথা শুরু করার চেষ্টা করল কিন্তু বলার কিছু পেল না। না, সেটা ঠিক না। কথা তার মাথায় অনেকই ঘুরছে।
তুমি কি তোমার স্বামীর সঙ্গে সুখী? নাকি অন্য সম্পর্ক খুঁজছ? আমার ব্যপারে কি ধারণা?
নাঃ, এসব ঠিক বলার যোগ্য নয়।
“তুমি ফটোগ্রাফার?”
হঠাৎ শর্বাণীর গলার আওয়াজ পেয়ে প্রচেত চমকে উঠল।
“ঘরে একটা ক্যামেরা দেখলাম মনে হল?”
“ওই একটু শখ আছে,” গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল প্রচেত। “এদিক-ওদিক ছবি তুলি, তারপর এক বন্ধু খবরের কাগজে আছে — ওকে ধরি ছেপে দেওয়ার জন্যে।” একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, “তোমারও কি ইন্টারেস্ট আছে?”
শর্বাণী মাথা নেড়ে না বলল।
“ভালো ছবি দেখলে ভালো লাগে কিন্তু ক্যামেরার টেকনিক্যালিটি আমি বুঝি না।”
“ও...তাহলে তোমার হবি কি? বই পড়া ছাড়া, আই মীন।”
“গানবাজনা ভালো লাগে — ছোটবেলায় তবলা শিখেছিলাম।”
“তবলা!” প্রচেতর ভুরু আকাশে উঠে গেছে।
“অবাক হলে?”
“হ্যাঁ, মানে, মেয়েদের সাধারণত পার্কাশানে ইন্টারেস্ট হয় না তো, তাই...”
শর্বাণী কিছুক্ষণ চুপ করে ঝিলটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
“গাছের পাতার ওপর বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ কি শুধু ছেলেরাই এনজয় করে?”
“না, অ্যাবসলিউটলি নট!”
“পাথরের ওপর ঝরনার শব্দ, মন্দিরের ঘন্টার শব্দ, তিব্বতিদের সিংগিং বোল — এগুলো সবই তো পার্কাশান। কিন্তু নারী পুরুষ সবাই এনজয় করতে পারে।”
“ঠিকই,” প্রচেত লজ্জা পেয়ে বলল, “আমার ওরকম একটা কমেন্ট করা উচিত হয়নি।”
হঠাৎ হেসে ফেলল শর্বাণী।
“এম্বারাসড হয়ে গেলে কেন? তোমার কমেন্টটা খুব স্বাভাবিক ছিল। কম সংখ্যক বাঙালি মেয়েরাই তবলা শেখে। কিন্তু আর পাঁচজন যেটা করে সেটা করতে আমার মোটেই ইচ্ছে করে না। হয়তো খানিকটা শক্ ভ্যালুর জন্যেই। সংস্কৃত অ্যাডিশানাল নিয়েছিলাম জানো? পুরো স্কুলে আমি একা। সংস্কৃতে কবিতাও লিখেছিলাম।”
“বাব্বা তুমি তো অন্য লেভেলে পুরো!”
“এসব অবশ্য বিয়ের আগের কথা।” বলতে বলতে শর্বাণীর চোখের আলো মিইয়ে এল।
প্রচেত একটু সোজা হয়ে বসল। তার মানে সে ঠিকই অনুমান করেছে। শর্বাণী বিয়ে করে খুব সুখী না।
নাহলেই বা তোর কী?, প্রচেতর মাথার ভেতরে আরেকটা প্রচেত তর্ক জুড়ে দিল, বয়ফ্রেন্ড তো নয় যে কাটিয়ে দেবে। ডিভোর্স করা এতো সোজা নাকি? তাও আবার তোর জন্যে!
“বাই দা ওয়ে, ক'টা বাজে এখন?” শর্বাণী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল।
প্রচেত তাকিয়ে দেখল ওর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে।
“অনেক বেলা হয়ে গেছে বোধহয়,” শর্বাণী উঠে দাঁড়াল। “যাই স্নান সেরে নিই। নাহলে আমার জন্যে সবার লাঞ্চে দেরি হয়ে যাবে।”
এখনই যেয়ো না প্লিজ...
“হ্যাঁ, সেই ভালো। আমিও লাঞ্চের জন্যে রেডি হয়ে নিই।”
“তোমার অনেকটা সময় নিয়ে নিলাম,” বলতে বলতে দরজার দিকে পা বাড়াল শর্বাণী।
“এমা, আমি তো ফাঁকাই বসেছিলাম!”
শর্বাণী চলে গেলে প্রচেত সময় দেখার জন্যে মোবাইলটা হাতে নিল। কিন্তু সেটা অজান্তেই কখন যেন চার্জ আউট হয়ে গেছে। ঘরে কোন দেওয়াল ঘড়িও নেই। তাহলে সময় দেখার কী হবে?
সময় না দেখলেই বা কী?
প্রচেতর ঠোঁটে একটা হালকা হাসির ছোঁয়া লাগল। সময়...অদ্ভুত হাঁসজারু বস্তু এটা। খানিকটা প্রাকৃতিক, আবার খানিকটা মনুষ্যসৃষ্ট। দিন-রাতের নাগালের বাইরে যাওয়া হয়তো ইহজগতে সম্ভব নয় কিন্তু ঘণ্টা-মিনিটের শেকল থেকেও কি মুক্তি নেই?
প্রচেত ধীরে ধীরে খাটের ওপর বসে পড়ল। তারপর ঘড়িটা খুলে পাশে রেখে দিল। জীবনে প্রথম মানুষের তৈরি সময়ের বাইরে বেরিয়ে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচছে। শ্রী আম্মার হোমস্টে যেন ঘড়ির কাঁটার বাইরের একটা জগৎ। স্বপ্নের মতো একটা জগৎ...
শেষ অবধি অবশ্য লাঞ্চটা সময় মতোই হয়েছিল।
আগের দিন বৃষ্টিতে ভিজে প্রচেতর হালকা জ্বরজ্বর হয়েছিল। দুপুরে খেয়ে এসেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম যখন ভাঙল তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। বাইরে বেরিয়ে দেখল কখন যেন বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে একটা দু’টো তারাও উঠেছে। দূরের নারকেল গাছগুলোয় কে যেন একটা করে লন্ঠন জ্বেলে দিয়েছে। সবটা মিলিয়ে প্রচেত যেন কোন্ দূর অতীতকালে চলে গেছে।
ইশ্, গিটারটা থাকলে বেশ জমত...
সোহিনী ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে আর গিটারটা ছোঁয়াই হয়নি। ঠিক যেমন আর কখনো লেকের ধারে যাওয়া হয়নি। যেন জীবনের ওই দিকগুলো ছুঁলেই আবার পুরনো ক্ষত থেকে নতুন করে রক্ত ঝরতে শুরু করবে। নিজের সত্তার থেকে টুকরো বাদ দিতে দিতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল যে নিজেকেই আর চিনতে পারত না প্রচেত। সেই প্রচেত আর আজকের প্রচেত কি একই মানুষ? সব কি একটাই জীবনের কথা?
নাকি এক ঝলক কমলা রং সবটা পাল্টে দিল?
শর্বাণী...
মিসেস রায়...
নিজেকে মনে করিয়ে দিল প্রচেত। যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, শর্বাণীর জগতে নিজেকে না জড়ানোই ভালো। কতবার আর ভালোবেসে আঘাত পাবে সে?
ভুরু কুঁচকে ঘরের ভেতর ঢুকে এল প্রচেত। হয়তো এখানে আসাটাই তার ভুল হয়েছিল।
পরদিন সকালে প্রচেতর মাথা থেকে সব ঋণাত্মক চিন্তাই বেরিয়ে গেল। পর্দা সরিয়েই সে দেখতে পেল চারদিক রোদে ঝলমল করছে। ইডিয়াপ্পাম আর ডিমের কারি দিয়ে চমৎকার জলখাবার সেরে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ছবি তুলতে বেরিয়ে পড়ল।
খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরার পর প্রথম দিন দেখা সেই খালটাকে আবার খুঁজে পেল। এক জায়গায় সেটা লনটাকে আড়াআড়ি ভাগ করে চলে গেছে। তার ওপর একটা ছোট্ট সাঁকো বানানো আছে। প্রচেতর ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। সাঁকো পার হয়ে অন্যদিকে যেতেই —
নারকেল গাছের সারি আর ঝিলের ধারে বসে মিসেস রায়।
প্রচেত বুঝতে পারল না সে এগিয়ে যাবে নাকি যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে চলে যাবে। ইতস্তত করছে এমন সময়ে শর্বাণী নিজেই তাকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। প্রচেতর না এগিয়ে উপায় রইল না।
“মিস্টার পিল্লাই বোট রাইডের জন্যে ডাকছিলেন। যাবে?”
প্রচেত এক কথায় রাজি। দু'জনে ঝিলের ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল।
“তুমি কোলকাতায় থাক?” আজ প্রচেতই কথা শুরু করল।
“হায়দ্রাবাদ,” শর্বাণী বলল, “তমাল ওখানে একটা আই টি কম্পানিতে আছে। আমিও এইচ আরে ছিলাম। গত বছর ছেড়ে দিয়েছি।”
“আই সী...” একটু থেমে প্রচেত বলল, “আমি কোলকাতায় থাকি। আইটিতেই ছিলাম কিন্তু বছর দুই আগে বন্ধুদের সঙ্গে একটা কম্পানি খুলেছি।”
“নিজের কম্পানি? বাঃ, ইম্প্রেসিভ!”
শর্বাণীর এই এক দোষ। এমন ভাবে উত্তর দেয় যে কথাটা আর টানা যায় না। হয় অন্য কথায় যেতে হয় নাহলে ওকে পরপর প্রশ্ন করে যেতে হয়... যেন পুলিশ জেরা করছে।
এ যাত্রা অবশ্য আর কিছু বলার আগেই পিল্লাই দম্পতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পাশেই জলে একটা নৌকো দাঁড়িয়ে আছে, আর তার মধ্যে দু'জন মাঝি হাসিমুখে বসে আছে। তারাই হাত ধরে সবাইকে নৌকোয় তুলে নিল। তারপর দাঁড় ঠেলে দিল।
প্রচেতর মনে হল ঝিলের ঠান্ডা হাওয়া ওর মনে প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। জলের মধ্যে কেমন একটা মন শান্ত করা ব্যাপার আছে। তার সঙ্গে ছন্দ করে দাঁড় টানার ছপছপ। একটু আগেই যে লনটা দিয়ে হাঁটছিল সেটা এখন কতদূরে চলে গেছে — যেন অতীত আর বর্তমানের মধ্যের সাঁকোটা ভেঙে গেছে।
টুকটাক গল্প হতে থাকল। মিসেস পিল্লাই জানালেন ওনারা আগে মুম্বাইয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকতেন। কিন্তু এখন নাগারকয়েলে পৈতৃক বাড়িতে আছেন। এক ছেলে আর এক মেয়ে আছে, তাদের দু’জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
মিস্টার পিল্লাইয়ের অনুরোধে শর্বাণী একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইল (মিস্টার পিল্লাই তিন চারবার বললেন, 'সাচ আ সুইট মেলডি')। প্রচেত আবার তার গিটারের অভাবটা অনুভব করল।
মাঝিরা বলল তারা সকালে আর রাতে এই ঝিলে মাছ ধরতে আসে। অতিথিরা চাইলে তখন যোগ দিতে পারে। এখানে ধরা টাটকা মাছ সবার আগে শ্রী আম্মার কিচেনে পৌঁছে যায়। তারপর শহরের বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বেশ খানিকক্ষণ নৌকো বিহারের পর মিস্টার পিল্লাই বললেন, “এবার তাহলে ফেরা যাক? নাহলে লাঞ্চে দেরি হয়ে যাবে।”
“আজ লাঞ্চে স্পেশাল কিছু আছে?” শর্বাণী জিজ্ঞাসা করল।
“সেটা জানি না কিন্তু ডিনারে স্পেশাল আইটেম আছে,” মিস্টার পিল্লাই চোখ টিপে বললেন, “আমি শ্রী আম্মার সঙ্গে কথা বলে রেখেছি।”
“দিনরাত তোমার খালি খাই আর খাই!” মিসেস পিল্লাই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
“আলবাত খাব!” মিস্টার পিল্লাই হঠাৎ রেগে গিয়ে হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে উঠলেন। “সারা জীবন অন্যের বায়না মিটিয়ে তোমার শিক্ষা হল না?” তারপর প্রচেত আর শর্বাণীর দিকে ঘুরে বললেন, “ডু ইউ নো আওয়ার সান থ্রু আস আউট অফ আওয়ার হাউস?”
মুহূর্তে সারা নৌকো নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যেন এক্ষুণি একটা বোমা ফেটেছে। প্রচেত বুঝতে পারল না কী উত্তর দেবে। আড়চোখে একবার শর্বাণীর দিকে তাকাল, কিন্তু সেও চুপ করে বসে আছে। মিসেস পিল্লাই অস্বস্তিতে পড়েছেন এমন ভাবে হেসে উঠলেন।
“হি ইস জোকিং।”
“ওয়াট্ জোকিং?” মিস্টার পিল্লাই ছাড়ার পাত্র নন। “সারা জীবন আমরা বাড়ির কথা, ফ্যামিলির কথা ভেবেছি। নিজেদের কোন নিডকে পাত্তা দিইনি। কিন্তু সেই ফ্যামিলি আমাদের কী প্রতিদান দিল? আমার ছেলে আমাকে ঠকিয়ে আমার ফ্ল্যাটটা নিজের নামে লিখিয়ে নিল। তারপর আমাদেরই বের করে দিল! সারা জীবন তো তাকে নিয়েই কাটিয়ে দিলে সন্ধ্যা, এখন তো অন্তত নিজের খাওয়াদাওয়া, ফুর্তির কথা ভাবো!”
মিসেস পিল্লাইয়ের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। প্রচেত আর শর্বাণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছু মনে করো না, মিস্টার পিল্লাই আপসেট আছেন। আমাদের ছেলে আর ওর ওয়াইফ সারাক্ষণ ভয় পেত আমরা বাড়িটা আমাদের বিধবা মেয়েকে লিখে দেব।”
“সে মেয়েও কি একদিনও খোঁজ নিয়েছে?” মিস্টার পিল্লাই আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, “বাড়িটা থাকতে তো প্রত্যেক রবিবার এসে হাজির হোত। এখন একদিন ফোনেও জিজ্ঞেস করেছে বুড়ো-বুড়ি কেমন আছে?”
মিসেস পিল্লাইয়ের মুখটা দেখে প্রচেতর মায়া হল। কারুর ছেলেমেয়ে প্রতারণা করলে মা-বাবার পক্ষে সেটা কতটা কষ্টকর হতে পারে? কথা ঘোরানোর জন্যেই সে হঠাৎ বলে উঠল, “মাই গার্লফ্রেন্ড লেফট্ মি!”
মিস্টার আর মিসেস পিল্লাই অবাক হয়ে প্রচেতর দিকে তাকালেন।
“সোহিনী বোস,” প্রচেত ওনাদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল। “কলেজে একসঙ্গে পড়তাম আমরা। সেখানেই প্রেম। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম। পাশ করার পর একসঙ্গে চাকরিতে ঢুকে পড়ব, আর তার বছর দুয়েকের মধ্যে বিয়ে। কিন্তু আমাকে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। দু'বছর চাকরি করার পরেই মাথায় বিজনেসের পোকা ঢুকল। কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা সফটওয়্যার কম্পানি খুলে ফেললাম। ব্যাস্, সোহিনীর মা-বাবা বেঁকে বসলেন। চাকরি নেই এরকম ছেলের সঙ্গে নাকি তাঁরা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। আমি বললাম ওনারা না দিলেও তুমি তো রাজি আছ। চলো আমরা রেজিস্ট্রি বিয়ে করে নিই। কিন্তু ও সময় চেয়ে নিল। বাবা-মাকে নাকি বোঝাবে। শেষ একবছর ধরে এটাই শুনেছিলাম। বাড়িতে বোঝাচ্ছে। তারপর একদিন ফোন এল, আর আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। বাড়ি থেকে নাকি অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার মনের অবস্থা তখন কী হয়েছিল শুধু আমিই জানি। অনেকবার বললাম, যাই সমস্যা হোক অন্তত একবার মুখোমুখি কথা বলো, একটা আলোচনায় তো আসা যাক। কিন্তু কিছুতেই রাজি হলো না। এত বছরের সম্পর্ক একটা ফোন কলে শেষ হয়ে গেল।”
“ওঃ ডিয়ার!” মিসেস পিল্লাই বললেন। মিস্টার পিল্লাই দুঃখিত ভাবে মাথা নাড়লেন।
“হয়তো ছেলেমেয়েরা প্রতারণা করলে আঘাতটা বেশি হয়,” মিসেস পিল্লাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল প্রচেত, “কিন্তু প্রতারণার কষ্ট আমিও পেয়েছি। তাই প্লিজ, নিজেকে একা ভেবে লজ্জা বা কষ্ট পাবেন না।”
মিসেস পিল্লাই কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়লেন।
“তারপর কী হল?”
শর্বাণীর গলা শুনে প্রচেত চমকে উঠল। ওর গলায় এত তিক্ততা আগে কখনও খেয়াল করেনি তো!
“তারপর আর কী?” প্রচেত শর্বাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রথম ক'দিন কীভাবে কেটেছে তা বলে সবার মুড নষ্ট করব না। তারপর বন্ধুদের কাছে জানলাম আমাদেরই কলেজের বন্ধু অর্ণবের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। গত একবছর ধরে নাকি অর্ণবের সোহিনীদের বাড়িতে খুব যাতায়াত ছিল। অর্ণব আর সোহিনীকে নাকি অনেক জায়গায় একসঙ্গে দেখাও গেছে। যাক্ গে, কি আর করব...কাউকে জোর করে তো ধরে রাখা যায় না।”
“সেটা অন্যায় বলে মনে হয় না?” শর্বাণী খানিকটা আপন মনেই বলে উঠল। “একটা সম্পর্ক তৈরি হয় দু'জনের সম্মতিতে। কিন্তু সেটা ভাঙার জন্যে একজনের ইচ্ছাই যথেষ্ট।”
মিস্টার পিল্লাই মাথা নেড়ে বললেন, “ইউ আর রাইট।”
নৌকোর মধ্যে অন্তরঙ্গ আবহাওয়া। বোট রাইড যখন শুরু হয়েছিল তখন কে জানত যে যাত্রীরা খানিক পরে যন্ত্রণার এক সূত্রে বেঁধে যাবে?
“তেইশ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে গেছিল,” শর্বাণী শান্তভাবে বলতে থাকল, “তমালদের বাড়ি থেকে দেখতে এসেই আমাকে পছন্দ করে ফেলল, আর আমার মা-বাবাও হইহই করে বিয়ে দিয়ে দিল। তমালের সঙ্গে আমি ভালো থাকব কি না, মতের মিল হবে কি না কিছু বোঝারই সময় পেলাম না। মা বলল সেসব বোঝার জন্যে সারা জীবন পড়ে আছে, আর আমিও মেনে নিলাম। ভাবলাম বিয়েটা হয়তো একটা নতুন এডভেঞ্চার হবে। প্রথম কিছুদিন ভালোই কেটেছিল। কিন্তু তারপর থেকে অশান্তি শুরু হল। আমার কোন কিছুই তমালের পছন্দ হোত না।”
প্রচেত নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। শর্বাণীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরেও কেউ কি করে অসুখী হতে পারে? কল্পনায় তো সে বরাবর শর্বাণীকেই অসুখী বলে ভেবে এসেছে।
“আমারও যে তমালের সবটা পছন্দ হোত তা নয়। কিন্তু সবাই আমাকে বোঝাত যে বিয়ের পর মেয়েদেরই বেশি অ্যাডজাস্ট করতে হয়। আমি সে-কথাও মেনে নিয়েছিলাম। তারপর একদিন... আমাদের ছ'বছরের বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন, তমাল বলল ওর আমার সঙ্গে থেকে দম আটকে আসছে। ক'দিন ও বন্ধুর বাড়িতে থেকে আসতে চায়।”
শর্বাণী গালে হাত দিয়ে বসল। অভিব্যক্তিহীন।
“সব থেকে খারাপ কি লেগেছিল জানো? তমাল এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ার আগে একবার আমার সঙ্গে আলোচনাও করল না। আমারও যে কিছু বলার থাকতে পারে সেটা ওর মাথাতেই ছিল না। যেন আমি ম্যাটারই করি না। খুব আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন।”
“সে কথা ওকে বলেছিলে?” প্রচেত জিজ্ঞাসা করল।
শর্বাণী একটু হাসল। “নাঃ। নিজের মনের কথা বলে, কেঁদেকেটে কোন লাভ হোত কি? ওই যে তুমি বললে, জোর করে কাউকে আটকে রাখা যায় না। যাই হোক, এর পর বেশ কিছুদিন তমাল আর এই নিয়ে উচ্চবাচ্যই করল না - যেন ভুলেই গেল যে এরকম একটা কথা হয়েছিল। সামনে আমার কাজিনের বিয়ে আসছিল। ও বলল ওই সময়ে নাকি আমরা ফ্যামিলি টাইম কাটাব, আবার নিজেদের সম্পর্কটাকে জোড়া লাগাব।”
“তারপর?”
কিন্তু শর্বাণীর গল্পটা শেষ হল না। পাড় থেকে পিটার খবর দিল শ্রী আম্মা লাঞ্চে ডাকছে। তারাতাড়ি নৌকো পাড়ে এনে সবাই নেমে পড়ল। প্রচেত আর শর্বাণীর আপত্তি সত্ত্বেও বোট রাইড মিস্টার পিল্লাইই স্পনসর করলেন।
শর্বাণীর অসমাপ্ত গল্পটা প্রচেতর মন তোলপাড় করতে থাকল।
শর্বাণীর বিয়েটা তাহলে এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়েছে? সম্পর্ক কি জোড়া লেগেছে? যদি তাই হয় তাহলে শর্বাণী একা কেন বেড়াতে এসেছে? নাকি ওরা ঠিক করেছে কিছুদিন একে অপরের থেকে ব্রেক নেবে?
কিন্তু শর্বাণী নিজে থেকে কথা না তুললে প্রচেত কীভাবে এসব কথা জিজ্ঞাসা করবে? সে তো তার অধিকারের সীমানাটাও জানে না। শর্বাণী কি তাকে নিছক বন্ধু বলে মনে করে নাকি সেটুকুও মনে করে না?
আর কেনই বা সে বারবার এরকম জটিল অঙ্কে জড়িয়ে যায়?
ভাবতে ভাবতেই বাকি দিন কেটে গেল প্রচেতর।
মিস্টার পিল্লাইয়ের কথামতো সত্যিই সেরাতে ডিনারের এলাহি ব্যবস্থা হয়েছিল। তার আগে সন্ধেবেলা শ্রী আম্মা লনে কথাকলি নাচের ব্যবস্থা করেছিল। পাশের গ্রাম থেকে শিল্পীরা এসেছিল। তারাই গান গাইল, নাচ করল — নল দময়ন্তীর গল্প আর রাম রাবণের যুদ্ধ। হয়তো পেশাদার শিল্পীদের চাকচিক্য তাদের ছিল না, কিন্তু দক্ষতা বা নাচগানের প্রতি ভক্তিতে তারা কারুর চেয়ে কম ছিল না।
প্রোগ্রাম শেষ হলে ডিনার এল। মিস্টার পিল্লাইয়ের 'স্পেশাল আইটেমের' নাম জানা গেল এলা সাদ্যা। এটা নাকি ওনাম বা অন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে খাওয়া হয়। শ্রী আম্মা, লক্ষ্মী আর পিটারের বউ সুসান মিলে কলাপাতা সাজিয়ে দিল। তাতে কতরকম খাবার — পাচড়ি, কিচাড়ি, পুলিসেরি, ওলান, সাম্বর, থোরান, আভিয়েল, ভাত। সব শেষে এল পায়সম। যদিও শ্রী আম্মা দুধের পায়েসই বানিয়েছিল, প্রচেত অবাক হয়ে শুনল যে মুগ বা ছোলার ডালেরও নাকি পায়েস হয়।
রাতে শুতে গিয়ে প্রচেতর অস্থিরতাটা আবার ফিরে এল। শর্বাণীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা কি গাঢ়তর হতে পারে? কিন্তু শর্বাণী তো তাকে কোন উৎসাহই দিচ্ছে না। আজ রাতের ডিনারে সাধারণ দু’চারটে কথা ছাড়া কিছুই তো বলেনি। প্রচেত একাই কল্পনার সমুদ্রে ভেসে বেরাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে মনে সন্দেহ জাগে। উৎসাহ যে দেয়নি সেটা কি পুরোপুরি সত্যি? শর্বাণী নিজেই তো প্রচেতর ঘরে এসেছিল গল্প করার জন্যে। আর আজ সকালে বোট রাইডে যাওয়ার আগে শর্বাণী প্রচেতর জন্যেই কি অপেক্ষা করছিল না?
প্রচেত ইউ আর প্যাথেটিক, মাথার ভেতরের পাজি প্রচেতটা বলে উঠল। এবার শর্বাণী হাসলেও বল তোরই জন্যে হেসেছে।
বিছানায় ছটফট করতে থাকল প্রচেত। অনেক রাতে শুনতে পেল 'তুঙ্গভদ্রা'য় কারা যেন এসেছে। তালা খোলার শব্দ আর শ্রী আম্মার গলার আওয়াজ পেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
সকালে উঠোনে বেরিয়ে প্রচেত দেখল 'লেপাক্ষী'র দরজায়ও তালা নেই। তার মানে আজ শ্রী আম্মার হোমস্টে পুরো ভর্তি।
সামনের বারান্দাটায় গিয়ে একটু হতাশ হতে হল। যেখানটায় শর্বাণী সাধারণত বসে থাকে সেখানে আজ শ্রী আম্মা বসে হিসেব দেখছে। প্রচেতকে দেখতে পেয়ে বলল,
“আজ সন্ধে ছ'টার থেকে লনে বারবিকিউ হবে। লবস্টার ফ্রাইও থাকবে। ডোন্ট বি লেট।”
লনে নেমে দেখে পিল্লাই দম্পতি দুটো আরামকেদারায় পাশাপাশি বসে আছেন। প্রচেতকে দেখে হাত নাড়লেন। প্রচেতও হাত নাড়ল। শর্বাণীকে কোথাও দেখতে পেল না।
এই মরেছে, শর্বাণী চেক আউট করে যায়নি তো?
কিন্তু যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই একবার বলবে। এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়েছে। আশংকাটা মন থেকে সরিয়ে প্রচেত ঝিলের ধারে গেল। দুটো নারকেল গাছের মাঝখানে একটা হ্যামক টাঙ্গানো আছে। ওতেই আয়েশ করে শুয়ে আবার গল্পের বইটা খুলল। কিন্তু ঝিলের হাওয়াটা এত আরামদায়ক যে এক পাতা পড়তে না পড়তেই ঘুমে ঢুলে পড়ল।
পিটারের ডাকে ঘুম ভাঙল। সবাই ততক্ষণে খেতে বসে গেছে। নতুন অতিথিদের মধ্যে প্রচেত একজন বছর কুড়ির মেয়ে আর এক মাঝবয়সি দম্পতিকে দেখতে পেল। একই ফ্যামিলির কি না সেটা বুঝতে পারল না। শর্বাণীকে দেখতে পেয়ে একটু আশ্বস্ত হল, কিন্তু ও বসেছে টেবিলের একদম অন্যধারে। তাই কোন কথাবার্তা হল না।
লাঞ্চের পর সবাই যে যার ঘরের দিকে রওনা দিচ্ছে এমন সময়ে শর্বাণীকে ধরল প্রচেত।
“আজ বিকেলে বারবিকিউ আছে জানো তো?”
শর্বাণী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“একসঙ্গে যাবে?”
শর্বাণী একটু ভেবে নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। সন্ধে ছ'টায় বসার ঘরে দেখা করি?”
“ওকে!”
হাসিমুখে ঘরে ঢুকল প্রচেত। যাক, 'না' বলে দেয়নি। মানে কিছু চান্স আছে।
বিকেল হতেই প্রচেত দাড়ি কামিয়ে স্নান করে নিল। কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছে। প্রথম প্রথম সোহিনীর সঙ্গে বেরতেও এরকমই লাগত। ইশ্, অন্তত যদি একটা পাঞ্জাবি আনত! কিন্তু না, সবই টিশার্ট। তারই মধ্যে যেটা একটু ভালো সেটা পরে, চুল আঁচড়ে কোলোন ছিটিয়ে নিল। তারপর বসার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই পায়ের শব্দ শোনা গেল। প্রচেতর বুকে যেন হাতুড়ি পড়ছে। তারাতাড়ি বইয়ের তাক থেকে একটা বই নামিয়ে কেত মেরে খুলে বসল।
“অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম?”
প্রচেত বই থেকে চোখ তুলে তাকাল।
শর্বাণী এবেলা পুরো এথনিক্। হালকা সবুজ রঙের তসরের শাড়ি, ঘাড়ের কাছে নামানো খোঁপা, কানে, গলায় হালকা সোনার গয়না...
“দারুণ লাগছে তোমাকে!” প্রচেত আর চোখ ফেরাতে পারছে না।
শর্বাণী মৃদু হাসল।
“থ্যাংকস!”
“শ্যাল উই?” প্রচেত শর্বাণীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
শর্বাণী প্রচেতর হাতে আলতো করে নিজের হাতটা রাখল। দু'জনে লনের দিকে এগিয়ে গেল। “আজ বারবিকিউতে কি হবে জানো? স্পেশাল প্রোগাম কিছু আছে?”
“আছে। আজ আমরা সবাই নিজেদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলব।”
“এই মরেছে!” প্রচেত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। “আমার জীবনে আবার গুরুত্বপূর্ণ কী ঘটেছে? আচ্ছা মুশকিল তো, হঠাৎ এ সব আবার কী...”
“আরে চলো তো,” শর্বাণী হেসে বলল, “ওখানে গিয়ে ঠিক কিছু একটা মাথায় এসে যাবে।”
“তুমি কি বলবে কিছু ঠিক করেছ?”
শর্বাণী ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“আমি এখানে কী করে এলাম সেই গল্পটা বলব।”
প্রচেতর ভুরু ওপরের দিকে উঠে গেল।
“তারও আবার গল্প আছে নাকি?”
“হ্যাঁ, বেশ ইন্টারেস্টিং গল্প আছে।”
“কী গল্প?”
“সেটা ওখানে গিয়েই শুনো।”
প্রচেত কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়েই রইল। হঠাৎ কী এক দুঃসাহসে ভর করে বলেই ফেলেল, “এখানে আলাদা করে বলো না। দেখি গল্পটা শুনে আমার মাথায় কিছু আইডিয়া আসে কি না।”
শর্বাণী বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল। লনে সন্ধে নেমে গেছে। বারবিকিউতে একজন দু'জন করে আসতে শুরু করে দিয়েছে। তারাতাড়ি না গেলে আবার শ্রী আম্মা ডাকাডাকি শুরু করে দেবে।
সেকথা প্রচেতকে বললও। কিন্তু প্রচেত নাছোড়।
“না আমি এখানেই শুনব,” একটু ভেবে যোগ করে দিল, “নৌকোয় যে কথাটা বলছিলে সেটাও তো শেষ হয়নি।”
শর্বাণী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“বেশ। দু'কথায় বলছি।”
বলে একটু থামল। যেন নিজের মাথার মধ্যে সবটা গুছিয়ে নিচ্ছে। তারপর বলতে শুরু করল।
“নৌকোর কথা আর আজকের গল্প একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিশেছে। গত বছর আমার কাজিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে আমি আর তমাল ভুবনেশ্বরে গেছিলাম গাড়ি নিয়ে। বাড়ি ফেরার দিন বেরতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। রাত প্রায় একটা বাজে তখনও হায়দ্রাবাদ থেকে অনেকটাই দূরে ছিলাম আমরা। হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম। শীতের রাত, চারদিক কুয়াশায় ঢাকা।
“হঠাৎ তমাল বলে উঠল ও আর আমার সঙ্গে থাকবে না। হায়দ্রাবাদে ফিরে পাকাপাকি আলাদা থাকবে বলে ঠিক করেছে।”
বারান্দার পরিচিত সীটটায় বসে পড়ল শর্বাণী।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আগের বার যখন তমাল সেপারেশনের কথা বলেছিল তখন তো আমি মেনেই নিয়েছিলাম। তাহলে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর নাটক করে এভাবে আমার সঙ্গে কেন খেলা করল? বহুবার জিজ্ঞাসা করার পর স্বীকার করল, অফিসের একজন মেয়ের সঙ্গে নাকি ওর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মেয়েটা আগে একবার তমালের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও পিছিয়ে এসেছিল। তাই তমাল কোন পাকা ব্যবস্থায় আসতে পারছিল না। ওদিক থেকে গ্রীন সিগনাল ছাড়া আমাকে ছাড়তে পারছিল না। এখন মেয়েটা ওর সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছে।
“আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। তুমুল ঝগড়া শুরু করে দিলাম। তমালও বোধহয় রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে তর্ক করছিল। হঠাৎ হেড লাইটের আলোয় দেখলাম, আমাদের একদম সামনেই একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি বেশ স্পীডে সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু তখন ব্রেক কষারও সময় নেই। গাড়িটা সোজা গিয়ে ট্রাকের গায়ে ধাক্কা মারল।”
“অ্যাঁ! কী সাংঘাতিক!”
“হুঁ...তমাল গুরুতর জখম হয়েছিল। সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল।”
“আর তুমি?”
“স্পট্ ডেড।”
খুব সহজভাবে কথাটা বলল শর্বাণী।
প্রচেত বুঝতে পারল না সে ঠিক শুনেছে কি না। শর্বাণী কি মজা করছে?
“গাড়ি থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়েছিলাম আমি,” শর্বাণী তার স্বাভাবিক শান্ত গলায় বলতে থাকে, “উঠে দেখি গাড়ির ভেতর আরেকটা আমি শেষ হয়ে গেছে।”
প্রচেতর মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শর্বাণী কী বলতে চাইছে? কিছু একটা বলার জন্যে হাঁ করল, তারপর মুখটা বন্ধ করে নিল। কী যেন একটা চেনা ছবি তার মাথায় ভেসে উঠতে চাইছে।
বৃষ্টি ভেজা রাস্তা...উল্টোদিক থেকে টর্চ হাতে কে যেন আসছে...
“এটা দুঃস্বপ্ন না বাস্তব কিছু বুঝতে পারছিলাম না,” বলতে বলতে শর্বাণী একবার শিউরে উঠল। “পুরনো জীবনের টুকরোগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছিল। যতগুলো পারলাম কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু যা অন্ধকার, কুয়াশা, কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ এক ঝলক আলো দেখতে পেলাম। টর্চ হাতে একজন লোক উল্টোদিক থেকে আসছে - জর্জ। আমার হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল--”
“আপনি এখানে চলে যান। আমি শ্রী আম্মার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।” প্রচেত আর শর্বাণী একসঙ্গে বলে উঠল।
শর্বাণী মাথা নাড়ল।
“তাকিয়ে দেখলাম কার্ডে লেখা 'শ্রী আম্মাস্ হোমস্টে'। একবার সন্দেহ হল লোকটা বোকা বানাচ্ছে না তো? কিন্তু যাওয়ার অন্য জায়গাও ছিল না। ঘন কুয়াশার মধ্যে হাঁটছি তো হাঁটছিই। কবে থেকে হাঁটছি, কেনই বা হাঁটছি কিছুই মনে ছিল না। খুঁজে খুঁজে শেষটায় যখন বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। চারদিক নিস্তব্ধ। একা শ্রী আম্মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।”
শর্বাণী বাইরের বাগানটার দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সুদূর অতীতকালের কী একটা দৃশ্য দেখছে।
“স্পট্ ডেড,” প্রচেত ফিসফিস করে বলল। যখন অর্ণবের ফোনটা এল, বলল সামনের মাসে তার আর সোহিনীর বিয়ে, প্রচেতকে আসতে হবে, প্রচেত তখন বাইকে চড়ে ছবি তুলতে বেরিয়েছিল। ফোনটা রেখে, নিজের অজান্তেই বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল সে — যেন বাইকটা এরোপ্লেন হয়ে এক্কেবারে আকাশে উড়ে যাবে। হেলমেটটাও বোধহয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
“আচমকা মৃত্যু কত ভাবে এসে যায়,” শর্বাণী মৃদুস্বরে বলল, “কখনও প্রতারণা, কখনও অপমান, কখনও প্রিয়জনের দেওয়া আঘাত। সেইসব মৃত্যু কেউ দেখতে পায় না।”
“শ্রী আম্মা ছাড়া।”
শর্বাণী ঘাড় নাড়ল।
“শ্রী আম্মার হোমস্টে। পুরনো জীবন শেষ হয়ে নতুন জীবন শুরু করার আগে, সময়ের বাইরে বেরিয়ে কিছুদিন বেঁচে নাও, ঝিলের টাটকা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নাও, নিজেকে সুস্থ করো। তারপর আবার পথ চলতে থাকো। তুমি, আমি, মিস্টার আর মিসেস পিল্লাই – সবাই তো একই চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।”
শর্বাণী প্রচেতর দিকে তাকাল।
“তোমার আর আমার গল্পটা কি খুব আলাদা?”
প্রচেত একটু হাসল। সমব্যথীর হাসি। সহমর্মীর হাসি।
“একি তোমরা এখনো এখানে?” শ্রী আম্মা হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় চলে এসেছে। “বারবিকিউ শুরু হয়ে গেছে তো! এসো, এসো!”
“ইয়েস, জাস্ট আ সেকন্ড।”
জাস্ট আ সেকন্ড...
বৃষ্টির মধ্যের উজ্জ্বল কমলা...
কুয়াশা কেটে হঠাৎ এক লক্ষ তারা আকাশ আলো করে দিল। শর্বাণীর হাতটা টেনে ধরে প্রচেত জিজ্ঞাসা করল,
“একটা কথা বলো...আমাদের পুরনো জীবনগুলো যদি আর নাই থাকে, তাহলে পুরনো সম্পর্কগুলো এখনো কেন ধরে রেখেছ? এখনো কেন মিসেস রায়ই রয়ে গেছ?”
শর্বাণীর ভুরু কুঁচকে গেল। বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং যেন গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে।
“তমাল আর আমার জীবন আলাদা হয়ে গেছে এটা সত্যি। আমরা এখন দুটো সমান্তরাল রেখার মতো। আই গেস্ 'মিসেস রায়' নামটা এখন শুধুই একটা তকমা, আগের জীবনের উদ্বৃত্ত একটা অভ্যেস।”
“তাহলে,” প্রচেতর বুক আবার দুরুদুরু করতে আরম্ভ করেছে, “তাহলে কি আমরা একসঙ্গে পথ হাঁটা শুরু করতে পারি না? জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কি একটা নতুন জীবন শুরু হতে পারে না?”
শর্বাণী একটু ইতস্তত করে বলল,
“সেভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি...”
“ভেবে দেখনি, কিন্তু ভেবে দেখা কি অসম্ভব?”
শর্বাণী এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। খাতা জমা দেওয়া পরীক্ষার্থীর মতো উদ্বেগ নিয়ে প্রচেত শর্বাণীর দিকে তাকিয়ে রইল।
শেষে শর্বাণীর ঠোঁটে হালকা এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল।
“অসম্ভব তো বলিনি।”