বিজয়নগরের নাম আমি প্রথম জেনেছিলাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়ে। যদিও, সেটা ঠিক ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়বার বয়স কিনা, সেবিষয়ে সন্দেহ আছে! ওইসময়ই আমাদের ক্লাস সেভেনের বইতে পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজের বিবরণীর একটু অংশ তুলে দেওয়া ছিল। তখন আমায় মধ্যযুগের এই বিশাল শহরটিকে ভারী আশ্চর্যের মনে হত। তারপর এখন বড় হয়ে, আরেকটু বেশি পড়াশোনা করে দেখলাম—সত্যিই দাক্ষিণাত্যে চতুর্দশ শতকে গড়ে ওঠা এই বিশাল সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্যের মধ্যমণি—অতুল বৈভব ও ঐশ্বর্যে মোড়া এই শহর; আড়াইশো বছরের মধ্যে তার মৃত্যু আর আজকের হাম্পিতে ছড়িয়ে থাকা সেদিনের বিজয়নগরের স্মৃতি—সবমিলিয়ে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বিজয়নগরের কাহিনী যতটা রোম্যান্টিক, ততটাই ভাববার।
পরম্পরা অনুযায়ী, হাম্পি প্রাচীন যুগ থেকেই ধর্মক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পম্পা-ক্ষেত্র, কিষ্কিন্ধ্যা-ক্ষেত্র বা ভাস্কর-ক্ষেত্র নামেও এটি পরিচিত। তুঙ্গভদ্রা নদীরই প্রাচীন নাম পম্পা। ‘হাম্পি’ হল ‘পম্পা’ শব্দেরই কানাড়া রূপ। কথিত আছে, রাম এখানে এসে বালি বধ করেন এবং কাম্পিলার পথে মাল্যবন্ত পাহাড়ে বাস করেছিলেন। তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ দিকের পাহাড়কে বলা হয় মাতঙ্গ পর্বত, যেখানে সুগ্রীব আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই মাতঙ্গ পর্বতের ওপর থেকে হাম্পি ও তার চারপাশের খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়, হাম্পি বেড়াতে গেলে অনেকেই তা দেখে আসেন।
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতবাদ প্রচলিত আছে। রবার্ট সিওয়েল তাঁর ‘এ ফরগট্ন এম্পায়ার’ বইতে বিজয়নগরের উৎপত্তি সম্পর্কে সাতটি কিংবদন্তির উল্লেখ করেছেন। অনেকেই বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠাকে মুসলমান একাধিপত্যের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসাবে দেখেছেন। তবে স্থানীয় শক্তির স্বাধীনতা প্রকাশের মধ্য দিয়েও এই উত্থানকে ব্যাখ্যা করা যায়, একই সময় যা বাংলা ও বাহমনিতে দেখা গিয়েছিল।
যাই হোক, প্রবাদ আছে যে ১৩২৬–২৭ খ্রিস্টাব্দে কাম্পিলা মহম্মদ বিন তুঘলকের সাম্রজ্যভুক্ত হওয়ার পর তিনি কাম্পিলার খাজাঞ্চিখানা থেকে হরিহর ও বুক্ককে দিল্লী নিয়ে যান। কিছুদিন পরে বিদ্রোহ দেখা দিলে এদের কাম্পিলাতে ফেরত পাঠানো হয়। এঁরা আনেগুন্ডিতে জনসমর্থন লাভে সমর্থ হলে কিছুদিনের মধ্যে দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগর শহরের প্রতিষ্ঠা করা হয়। একাজে তাদের প্রধান সহায়ক ছিলেন শৃঙ্গেরী মঠের বিখ্যাত সাধু মাধব বিদ্যারণ্য। তাঁর নামানুসারে এই শহর ‘বিদ্যানগর’ নামেও পরিচিত ছিল। বিজয়নগর শহরটি ছিল তুঙ্গভদ্রা নদীর দক্ষিণ পারে। উত্তর পারে ছিল পুরনো কেল্লা আনেগুন্ডি। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে শহরটি তৈরি হয়ে যায়।
বিজয়নগরে মোট চারটি রাজবংশ রাজত্ব করেছিল। বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্ক-র পিতা সঙ্গমের নামানুসারে এই রাজবংশ ‘সঙ্গমবংশ’ নামে পরিচিত। এদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন ভগবান বিরূপাক্ষ। হরিহর বিরূপাক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যশাসন শুরু করেছিলেন। ১৩৫৭ সালে হরিহর মারা গেলে বুক্ক ১৩৭৭ সাল অবধি রাজত্ব করেন, যার মধ্যে তিনি চীনদেশে দূত পাঠিয়েছিলেন। তিনি মাদুরা জয় করে রাজ্যসীমা বাড়ান। এঁর ছেলে দ্বিতীয় হরিহরের সময় (১৩৭৭–১৪০৪) সিংহলের কিছু অংশ জয় করা হয়েছিল। এঁর ছেলে প্রথম দেবরায়ের সময় ইতালীয় পর্যটক নিকোলো কন্টি ভারতে আসেন। এঁর ছেলে দ্বিতীয় দেবরায়ের সময়ে (১৪২২–১৪৪৬) পারস্যের রাজদূত আব্দুর রজ্জাক বিজয়নগরে আসেন। ১৪৪৩ সালে তিনি বিজয়নগরের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা রেখে গিয়েছেন। দ্বিতীয় দেবরায়ের পর সঙ্গম বংশের পতন শুরু হয় এবং যথাক্রমে সালুভা বংশ ও তুলুভা বংশের রাজারা রাজত্ব করেন। তুলুভা বংশের সবথেকে বিখ্যাত রাজা হলেন কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯–১৫২৯)—যাঁকে অনেকে বিজয়নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে মনে করেন। এঁর সময়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য উন্নতি ও সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছিল—যার বর্ণনা পর্তুগিজ পর্যটক দুয়ার্ত বারবোসা, ডোমিনগো পায়েজ, ফারনাও নুনিজ দিয়ে গেছেন। তাঁর সমকালীন দেশীয় গ্রন্থগুলিও একই সাক্ষ্য দেয়। কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর পর বিজয়নগরের পতন শুরু হয় এবং অরভিদু বংশের রাজা সদাশিবের সময়ে কৃষ্ণা নদীর পারে তালিকোটার যুদ্ধে (১৫৬৫ খ্রিঃ) বিজয়নগর পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হয়। মোগলরা পরবর্তীকালে কালে বিজয়নগর দখল করে ও পরে তা নিজামের রাজত্বের মধ্যে চলে যায়।
সেকালের বিজয়নগর ও তাতে বসবাসরত মানুষের জীবনকে বুঝতে হলে বিদেশী পর্যটকদের দেওয়া বিবরণীর গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অসীম। পারস্যের রাজদূত আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন যে, বিজয়নগর শহরটি এতটাই সুন্দর যে এমন স্থান তিনি কখনও চোখেও দেখেননি এবং কানেও শোনেননি। পর্তুগিজ পর্যটক পায়েজ বিজয়নগরে প্রবেশের এক সুন্দর বর্ণনা দিয়ে গেছেন—“শহরে ঢোকার প্রথম ফটকে পৌঁছানোর আগে একটি ছোট নদী পেরোতে হয়। ফটকটি সম্পূর্ণ পাথরে নির্মিত। ফটকের দুদিকে দুটি মিনার বা দুর্গ, যা একে আরো শক্তিশালী করেছে। এগুলি বেশ বড় ও সুন্দর দেখতে। ফটকের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে দুটো ছোট মন্দির দেখা যায়, যার মধ্যে একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রথম ফটকের সংলগ্ন এই প্রাচীরটি পুরো শহরকে বেষ্টন করে আছে। সামনে এগোলে আরো একটি ফটক এবং তাকে ঘেরা প্রাচীর পাওয়া যায়। এই প্রাচীরটিও আগের প্রাচীরের সমান্তরালে শহরটিকে বেষ্টন করে আছে। এই ফটকের পর থেকে রাস্তাগুলো রাজার প্রাসাদের দিকে গেছে, সারি সারি বাড়ি আর রাস্তা, যেখানে ‘নায়ক’ ও বিভিন্ন ধনী ও সম্মানীয় মানুষদের বাড়ি। বাড়িগুলি মূর্তি, ভাস্কর্য ও নকশা দিয়ে সুসজ্জিত। যদি প্রধান রাস্তাটি ধরে যাওয়া যায়, আরেকটি প্রধান দরজা পড়বে যা রাজপ্রাসাদের সামনে বিশাল ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়ে। এর বিপরীতে আরেকটি রাস্তা শহরের অন্যদিকে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। এটি শহরের একদম কেন্দ্রের অংশ। এখানে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকানপাট দেখা যায়।…” পর্যটকেরা প্রথম থেকে দ্বিতীয় প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে চাষের জমি, বাড়ি, বাগান ইত্যাদি দেখেছেন। তাঁরা এখানে ধান, শিম জাতীয় ফসল, গম, ভুট্টা ও প্রচুর পরিমাণে কার্পাসের চাষ হতে দেখেছেন। বর্তমানে শহর ঘিরে সাতটি প্রাচীরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যদিও সব জায়গায় এটি সমান অবস্থায় নেই। সপ্তম প্রাচীরটির অবস্থাই সব থেকে ভালো, যা আসল শহরটিকে প্রদক্ষিণ করে রেখেছে।
অসংখ্য মন্দির ও প্রাসাদে ভরা বিজয়নগর শহরের বিশালত্বের কথা সমকালীন সব পর্যটকই উল্লেখ করে গেছেন। ভ্রমণকারী পায়েজ এক পাহাড়ে উঠে শহরের সম্পূর্ণ চেহারাটা দেখবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শহরটি অসংখ্য পাহাড়ের মধ্যে ছড়িয়ে থাকায় সম্পূর্ণ চেহারাটি তিনি দেখতে পাননি। চমৎকার এই শহরটিকে তাঁকে রোম শহরের মতো মনে হয়েছিল। নগরের মধ্যে প্রচুর গাছ আছে—প্রায় জঙ্গলের মতো, বাগিচা ও হ্রদ রয়েছে স্থানে স্থানে। কয়েকটি হ্রদ ছাড়াও বহু নালার সাহায্যে জল সরবরাহ হয়। মুসলমানদের আলাদা এলাকা আছে যার একটু নিচু দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে, এর পাশেই আম, কাঁঠাল, সুপারি, সাদা আঙুর প্রভৃতি ফলের খেত দেখা যায়।
বিজয়নগরের বিপুল জনসংখ্যার উল্লেখ সব ভ্রমণকারীই করেছেন। পায়েজ বলেছেন, বিজয়নগর শহরে এক লক্ষ বাড়ি ছিল। আরেক ভ্রমণকারী নুনিজ কৃষ্ণদেব রায়ের নাগল্পুর (বর্তমান হসপেট) শহর তৈরির কথা বলেছেন। যাইহোক, পায়েজের বসতবাড়ির সংখ্যানুযায়ী কুঁড়েঘরের লোকজনকে বাদ দিয়েও, পরিবারপিছু গড়ে পাঁচজন ধরলে নগরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষ। অন্যদিকে, আব্দুর রজ্জাক ও নুনিজ সৈন্যসংখ্যা জানিয়েছেন পাঁচ/ ছয় লক্ষ। যেহেতু সব সৈন্য রাজধানীতে ছিল না, তাই এই হিসেবেও শহরের জনসংখ্যা পাঁচ লক্ষ আসে। এই জনসংখ্যা সঠিক হলে বিজয়নগরকে সমকালীন বিশ্বের সবথেকে জনবহুল শহর বলে ধরা যায়।
পায়েজ জানিয়েছেন, পৃথিবীর মধ্যে এই শহরেই দুনিয়ার সমস্ত ভালো জিনিস পাওয়া যায়। চাল, গম, ভুট্টা, বার্লি, মুগ ও অন্যান্য ডাল, ছোলা ইত্যাদি খুব সস্তায় পাওয়া যায়। নানাধরনের পাখির মাংস, ইটালির পায়রা, খরগোশও পাওয়া যায় সস্তা দরে। এগুলো সবই বাজারে জীবিত অবস্থায় বিক্রি হয়। যে পরিমাণ মাখন, তেল আর দুধ এখানে প্রতিদিন বিক্রি হয়, তেমনটা খুব অল্প জায়গাতেই হয়। রজ্জাক লিখেছেন, বিজয়নগরের মানুষ গোলাপ ছাড়া বাঁচতে পারে না, গোলাপকে তারা খাদ্যের মতই প্রয়োজনীয় মনে করে। এখানের বাজারে উচ্চমানের মুক্তো, হীরে, পান্না, চুনি পাওয়া যেত। স্বাভাবিকভাবেই, বিজয়নগরের এই অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির পেছনে ছিল উন্নত বাণিজ্য। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের পাশাপাশি পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ, চিন, আরব, পারস্য ও পর্তুগালের সঙ্গে বিজয়নগরের বহির্বাণিজ্য চলত। বহু বিদেশী বণিক বিজয়নগরে ঘোড়া কেনাবেচার জন্য আসত। বিঠল মন্দিরের বাইরের গ্রামটিতে ঘোড়ার বাজার বসার নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়। শিল্প-বাণিজ্য দেখাশোনার জন্য গিল্ড বা বণিকসংঘ বিশেষ ভুমিকা নিয়েছিল। সোনা ও তামার মুদ্রার পাশাপাশি সামান্য পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রাও প্রচলিত ছিল। রজ্জাক এই সমৃদ্ধির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, রাজার কোষাগারে একাধিক প্রকোষ্ঠ আছে যার প্রতিটি তরল সোনায় পরিপূর্ণ। রাজ্যের সমস্ত উচ্চ–নীচ ব্যক্তি নানান অলংকার পরত।
এখানকার ব্রাহ্মণ বাদে বেশিরভাগ মানুষ, এমনকি রাজাও ছিলেন আমিষভোজী। তবে গোরু–বলদের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। নগরের প্রত্যেকেই প্রচুর পরিমাণে পান খেতেন, সঙ্গে সুপুরিও। সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল, পায়েজ ও বারবোসার কথাতেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। তবে প্রজাদের ধর্মাচরণে কোন বিধিনিষেধ ছিল না। কৃষ্ণদেব রায়ের ধর্মীয় উদারতার বর্ণনা দিয়ে বারবোসা লিখেছেন, রাজা সবাইকে এতটাই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে যে কেউ আসতে পারত, এখানে থাকতে পারত এবং নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারত। বিজয়নগরের সৈন্যবাহিনীতে অনেক মুসলমান সৈন্যও ছিল।
বিজয়নগরের উৎসব অনুষ্ঠান ছিল জাঁকজমকে পূর্ণ। এর মধ্যে কানাড়া নববর্ষ, দীপাবলি, মহানবমী উৎসব ও হোলি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। কণ্টি দেখেছিলেন, হোলির দিনে রাস্তায় সবাই একে অপরকে রঙ মাখাচ্ছে। রাজা ও রানির গায়েও গেরুয়া রঙের জল ঢালতে দেখেছেন তিনি। নবরাত্রি উপলক্ষ্যে যে মহানবমী উৎসব হত, তার জমকালো বর্ণনা দিয়েছেন রজ্জাক ও পায়েজ। নর্তকী, মল্লযোদ্ধারা নানা ধরনের খেলা দেখাত, সারা রাজ্য থেকে নায়ক ও অভিজাতরা উপঢৌকন নিয়ে আসতেন। লোকে সারাদিন উপবাস করে রাত্রে খেত। শেষদিনে পশুবলি হত। হাম্পিতে এখন যেখানে মহানবমী ডিব্বা বা দশেরা-ডিব্বা, সেখানেই এই অনুষ্ঠান হত।
এখানে বিজয়নগরের ‘নায়ক’ বা ‘নায়ঙ্কারা’ প্রথার কথা একটু বলে নেওয়া যেতে পারে। পর্তুগিজ পর্যটকেরা এদের ‘ক্যাপ্টেন’ বলেছেন। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা রাজপরিবারের সদস্য বা অভিজাতদের অধিকারে থাকত, এদের উপাধি ছিল নায়ক। স্থানীয়স্তরে এরা সামরিক, অসামরিক ও বিচারব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তবে প্রাদেশিক আয়ব্যয়ের হিসাব, যুদ্ধের সময় রাজাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করা প্রভৃতি এদের কর্তব্য ছিল। স্বাভাবিকভাবেই, প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা। এক্ষেত্রে রজ্জাক দ্বিতীয় দেবরায়ের বা পায়েজ কৃষ্ণদেব রায়ের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে রাজার চূড়ান্ত ক্ষমতার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। তবে, রাজশক্তি দুর্বল হলে নায়করা অনেকক্ষেত্রেই স্বাধীনতা ঘোষণা করত।
মধ্যযুগের নিরিখে বিজয়নগর নারীস্বাধীনতায় ছিল যথেষ্টই এগিয়ে। বিজয়নগরের প্রশাসনের যেকোনো ক্ষেত্রেই নারীরা চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারতেন। সমাজে নর্তকীদেরও বিশেষ সম্মানের স্থান ছিল। পায়েজ নগরের সবথেকে ভালো রাস্তায় তাদের প্রাসাদোপম বাড়ি, অসংখ্য দাসী ও বিপুল ঐশ্বর্যের কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা, পুরুষদের বহুবিবাহে আসক্তি—নারীসমাজের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছিল সন্দেহ নেই।
সাহিত্যচর্চায় বিজয়নগর এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিল। কৃষ্ণদেব রায় নিজে ‘আমুক্তমাল্যদা’ ও ‘জাম্ববতীকল্যাণম’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। ‘অষ্টদিগগজ’ নামে পরিচিত আটজন জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত তাঁর সভা অলংকৃত করতেন। বিজয়নগরের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃত ছাড়াও কন্নড়, তেলেগু, তামিলের মতো আঞ্চলিক ভাষার বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। এছাড়া, প্রথম বুক্ক রায়ের পুত্রবধূ গঙ্গাদেবী ‘মাদুরা-বিজয়’ নামে কাব্য লেখেন, যেখানে তিনি তাঁর স্বামী ও বুক্ক রায়ের ছেলে কুমার কম্পনের মাদুরা বিজয়ে সাফল্যের বর্ণনা দিয়েছেন।
বিজয়নগরের আরেক কৌতূহলোদ্দীপক দিক হল নগরের জলসরবরাহ ব্যবস্থা। সমকালীন পর্যটকেরা এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নুনিজ জানিয়েছেন যে কৃষ্ণদেব রায় দুটি পাহাড়ের মাঝে একটি ছোট হ্রদ তৈরি করেছিলেন। ধনুকের মতো একটি বড় বাঁধ তৈরি করা হয়, যার মুখে বড় দরজা বসানো ছিল, এর নিচে ছিল পাথরের নালি। দরজা খুলে দিলে এই নালি দিয়ে প্রাসাদে ও শহরে জল যেত, এমনকি কিছু চাষ-আবাদের জমিতেও জল দেওয়া হত। এর কিছুকাল আগে পায়েজ প্রায় পনেরো–কুড়ি হাজার মানুষকে এই হ্রদের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য পরিশ্রম করতে দেখেছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই, বিজয়নগরের এই উজ্জ্বল ঐশ্বর্যের এক উলটো দিকও ছিল। সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। এছাড়াও বিভিন্ন বৃত্তিকর, সামাজিক করও উচ্চহারে প্রচলিত ছিল। ফলে দেখা যায়, বিজয়নগরে রাজারা যেমন সেচের সুব্যবস্থা করতেন তেমনি এর ফলে খাজনাও বেশ বৃদ্ধি পেত। এছাড়া এই বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায় চিরাচরিত করগুলি ছাড়াও স্থানীয় শাসকেরা অন্যান্য কর বসাতেন—যা সাধারণ মানুষের দুর্দশার কারণ হয়েছিল। এই জনবহুল বিশাল শহরটি খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জন্য গ্রামাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। সমকালীন ভ্রমণকারীরা জানিয়েছেন, বাইরের তুলনায় শহরের ভেতরে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। আবার, মাল শহরের মধ্যে আনার জন্য করও দিতে হত। ফলে বিক্রেতা ও উৎপাদক তাদের সঠিক মজুরি পেতে ব্যর্থ হতেন। শহরে যত ঐশ্বর্য কেন্দ্রীভূত হয়েছিল, বাইরের জগতের সঙ্গে তার প্রভেদ ততই বেড়েছিল। ষোড়শ শতকে পর্যটক নিকিতিন লিখেছেন, পল্লী অঞ্চলের লোকদের অবস্থা ছিল শোচনীয়, কিন্তু অভিজাতরা ছিলেন অতি সমৃদ্ধশালী ও বিলাসব্যসনে মত্ত। ফলে দেখা যায় শহরটি সাম্রাজ্যকে শুষে নিচ্ছে কিন্তু বিনিময়ে প্রায় কিছুই দিচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই, এর পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর, বিদর, আহম্মদনগর ও গোলকোন্ডার মুসলিম সুলতানদের মিলিত জোটের কাছে বিজয়নগর তালিকোটার যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। বিজয়ী বাহিনী বিজয়নগরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। আশপাশের গ্রামীণ উপজাতিরা শহরটি লুঠ করে, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে অভিজাতরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাই দেখা যায়, শুধুমাত্র তালিকোটার যুদ্ধ নয়, ভ্রান্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ছবির মতো এই শহরের মৃত্যু ডেকে এনেছিল।
সেদিনের বিজয়নগরের বহু নিদর্শন, বহু স্মৃতি তুঙ্গভদ্রার তীরে আজকের হাম্পি–কমলাপুরম অঞ্চলে প্রায় ২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ১৯৮৯ সালে ইউনেস্কো হাম্পিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে। বিজয়নগরের স্থাপত্যকে ধর্মীয়, অসামরিক ও সামরিক—এই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলি তৈরিতে কঠিন গ্রানাইট পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। বিজয়নগরের স্থাপত্যশৈলীতে পাণ্ড্য, চালুক্য ও হয়সল শৈলী ছাড়াও ইন্দো-সারাসেনিক রীতির গভীর প্রভাব দেখা যায়। মন্দিরের স্তম্ভগুলিতে জটিল ও বিচিত্র অলংকরণ এই শিল্পরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। দক্ষিণ ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যে বিজয়নগরের স্থান বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
কমলাপুরম থেকে এগোলে যে স্থাপত্যটি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হল রানির স্নানাগার। বাড়িটির মাঝখানে একটি ছোট পুকুর বা সাঁতার কাটার জায়গা, যার পাশে ঝুল-বারান্দা দিয়ে ঘেরা। এর দেওয়াল ও খিলান ইটের কারুকার্যে শোভিত। এর উত্তরপশ্চিমে রাজপ্রাসাদের ঘেরা জায়গা। এখানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মহানবমী-ডিব্বা বা দশেরা-ডিব্বা, যার কথা আগেও বলা হয়েছে। উড়িষ্যা বিজয়ের পর কৃষ্ণদেব রায় এটি তৈরি করেন। এর পাথরের ধাপগুলিতে হাতি, ঘোড়া, যোদ্ধা ইত্যাদি খোদাই করা আছে। এর পূর্বদিকে একটি ঘর বেরিয়ে আছে, যার দেওয়ালে খোদাই করা মূর্তিগুলি সম্ভবত বিজয়নগরে আগত চিনা দূতদের অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল।
রাজপ্রাসাদের এই ঘেরা জায়গাটি থেকে উত্তরপশ্চিমে রয়েছে হাজারা-রাম মন্দির। রামচন্দ্রের মূর্তি ধরলেও এটি আসলে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে তৈরি। মন্দিরটিকে চিত্রপ্রদর্শনীর প্রধান ক্ষেত্র বলা যায়। এখানে রামায়ণের বিভিন্ন কাহিনী, গণেশ, মহিষমর্দিণী, হনুমান, বিষ্ণুর দশাবতার এমনকি কল্কিরও ভাস্কর্য রয়েছে। প্রাসাদ এলাকার পশ্চিমে একটি বড় প্রাচীর ঘেরা জায়গা আছে, যাকে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী টাঁকশাল এলাকা বলা হয়। এখান থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের ব্রাহ্মী শিলালেখের ভগ্নাংশ পাওয়া গেছে। এর উত্তরে এক ঘেরা জায়গাকে বলা হয় দানায়ক-এর জায়গা (দণ্ডনায়ক বা প্রধান সেনাপতির অপভ্রংশ), মনে হয় জায়গাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দক্ষিণপূর্ব দিকে একটি সৌধের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে, যাকে মসজিদ বলা হয়ে থাকে।
এর উত্তরপশ্চিমে বড়, উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা একটি স্থান আছে, যা জেনানা মহল নামে পরিচিত। এর উত্তরপশ্চিমে মহিলা রক্ষীদের আবাস এবং মাঝখানে একটি বড় প্রাসাদের ভিত দেখা যায় (৪৫.৭মি.x২৮.৬মি.) যা রানির প্রাসাদ নামে বিখ্যাত। তবে জেনানা মহলের সব থেকে সুন্দর বাড়ি হল পদ্ম-মহল। এটির চারপাশ খোলা এবং অনেকগুলি স্তম্ভ উপরের ছাদকে ধরে রেখেছে। দোতলায় কাঠের খড়খড়ি লাগানো কয়েকটি ছোট ছোট জানালা আছে, যা বিজয়নগরের অন্য কোন বাড়িতে দেখা যায় না। এর ঠিক বাইরে সুন্দর, লম্বা, বড়, পশ্চিমমুখী বাড়ি আছে, যা হাতিশালা নামে পরিচিত। অনেক কারুকার্য নষ্ট হয়ে গেলেও বাড়িটি যে খুব কারুকার্যশোভিত ছিল তা বোঝা যায়।
দানায়কের ঘেরা জায়গা ছেড়ে হাম্পির পথে এগোলে মাটির নীচের মন্দির পাওয়া যায়। পশ্চিম দিকে আরও এগোলে মনোলিথিক বা একটিই বড় পাথর থেকে কাটা নরসিংহের মূর্তি দেখা যায়। পাশে লক্ষ্মী মূর্তিও ছিল, যদিও এখন কেবল তার একটি মাত্র হাত অবশিষ্ট আছে। এটি ২২ ফুট উঁচু। এর উত্তরে একটু উঁচু জায়গায় রয়েছে বড় এক কৃষ্ণ মন্দির। এই মন্দিরটি কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যা বিজয়ের পর উড়িষ্যা থেকে বিষ্ণুমূর্তি নিয়ে এসে তৈরি করেছিলেন। পূর্বদিকে আরও নেমে গেলে পড়ে বিখ্যাত হাম্পি বাজার, যার সামনে রয়েছে বিজয়নগরের সবথেকে পুরনো মন্দির—পম্পাপতি বা বিরুপাক্ষের মন্দির। এর গর্ভগৃহে যাবার দরজা চালুক্যশৈলীতে তৈরি, দরজা থেকে গর্ভগৃহ পর্যন্ত সবই তামার পাতে ঢাকা ও গিল্টি করা। ১৫১০ সাল নাগাদ কৃষ্ণদেব রায় এই মন্দিরের রঙ্গমণ্ডপটি তৈরি করান, যার ছাদের ভেতরদিকে বিজয়নগর চিত্রকলার বহু নিদর্শন রয়েছে—বিদ্যারণ্যের শোভাযাত্রা করে যাওয়া, দ্রৌপদী লাভের জন্য অর্জুনের ধনুর্বেদ পরীক্ষা প্রভৃতি চিত্রের বিষয়। ১৫১৩ সালে তেতলা উঁচু গোপুরটিও তিনিই তৈরি করেছিলেন।
বিজয়নগরের অপর এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হল তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে বিঠল মন্দির। বিজয়নগর শৈলীর সর্বোচ্চ উৎকর্ষ দেখা যায় এই মন্দিরের স্থাপত্যে–ভাস্কর্যে। মন্দিরটি ১৬৪মি.x৯৪.৫মিটারের এক বিশাল বড় ভিতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটির পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণে তিনটি গোপুর রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণেরটিতে কারুকার্য সবচেয়ে বেশি। বিঠল বলতে এখানে বিষ্ণুকে বোঝানো হয়েছে। মন্দিরের রঙ্গমণ্ডপটিতে ছাপান্নটি স্তম্ভ রয়েছে, প্রতিটি ৩.৬ মিটার উঁচু। এই স্তম্ভগুলিতে নারী, নর্তকী, বাদক প্রভৃতির মূর্তি খোদিত আছে। এই স্তম্ভগুলি থেকে সাত সুর বের হয়, যা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। মণ্ডপের ছাদে পদ্মফুলের নকশা দেখা যায়। বিঠল মন্দিরের আরেক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল পাথরের রথটি। এটি গরুড়ের উদ্দেশ্যে নির্মিত। কাঠের রথে যেসব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ থাকে, বিজয়নগরের ভাস্কর এই পাথরের রথে তা সযত্নে খোদাই করেছেন। এছাড়াও, আরো বহু মন্দির, প্রাসাদ ও বাজারের নিদর্শন পাওয়া যায় হাম্পি–কমলাপুরম–হসপেট অঞ্চলে।
বিজয়নগর নিয়ে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। আলোচনা ও গবেষণা চলতে থাকবে, বিজয়নগরের নানা দিক সম্পর্কে নানান তথ্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তবে আজকের নগরসভ্যতার মানুষ হিসেবে বিজয়নগরের কাহিনী নিশ্চিতভাবে আমাদের অর্থনীতিতে ভারসাম্য আর স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
তথ্যসূত্র —
এ ফরগট্ন এম্পায়ার – রবার্ট সিওয়েল
হাম্পি – ডি. দেবাকুঞ্জারি, আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া
মধ্যযুগের ভারতীয় শহর – অনিরুদ্ধ রায়
ইন্টারনেট