• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৩ | জুলাই ২০২১ | প্রবন্ধ
    Share
  • কলম্বাস রমানাথ রায় : নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


    লম্বাস কী করেছিলেন? এক বিশাল ভূখন্ড, এক মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন। আর “রবীন্দ্র-পরবর্তী” বাংলা গল্পে — নতুন আঙ্গিক, নতুন ভাষা, নতুন কথন-রীতি, অনির্বচনীয় গল্পের উদ্ভাবনী-প্রতিভার সম্মান আমি দিতে চাই রমানাথ রায়-কে।

    বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠতম বাচাল-মহারাজ হলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। তিনি যৌনতাকে নিয়ে সারাজীবন রগড় করেছেন, নারীদেহকে ভাষায় বহুত রগ্‌ড়ে নিজস্ব আনন্দ পেয়েছেন খুব; হয়তো মানসিক রমন-প্রক্রিয়ার সূত্রে — দু-পাঁচটা চমকিত করার মতো গল্পও লিখেছেন। কিন্তু অজস্র বাজে-বকা সত্ত্বেও দুটো কথা ঠিক বলেছিলেন; হয়তো দুটো সত্যও উচ্চারণ করেছিলেন:

    (১) ‘বাংলা গদ্যসাহিত্যকে যা নষ্ট করেছে তা হ’ল, এর ন্যারেটিভ টেকনিক’;

    (২) ‘ভাষা মানে ডিকশান; — বুড়ো আঙুলের ছাপ’।

    আর এই দুটো সত্যভাষ রমানাথ রায়-এর কানে পৌঁছাক আর না পৌঁছাক; নিজের তীব্র-তীক্ষ্ণ বৈদগ্ধ ও মৌলিক বিবেচনার ওপর আস্থা রেখে রমানাথ গল্প রচনার প্রথম প্রয়াস থেকেই সর্বতোভাবে প্রয়াস করেছিলেন প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো কথত্র — ভঙ্গির ট্রামলাইন থেকে সতর্ক হয়ে অনেক দূরে সরে আসতে এবং একইসঙ্গে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ভাষা, নিজস্ব ডিকশান, ‘বুড়ো আঙুলের ছাপ’।

    একটু স্থির হয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে অনেক রথী-মহারথীকে গ্রাহ্য করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত মানস-অভিযান করলেই, অনুধাবিত হবে আমাদের যে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন কৃতি গাল্পিকের বিশিষ্টতা, শুধু বিষয়-বৈচিত্র্যে, কাহিনি নির্মাণ করা ও তাকে নিজের নিজের দৃষ্টিভঙ্গী, জীবনবীক্ষণ ও কলমের মসৃণ কুশলতায় নান্দনিক সফলতার চূড়া-বিন্দুতে পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত ছিল।

    আমি পেশাদার সমালোচক নই। গাঁয়ে মানে না আপনি এরকম এক অনিশ্চিত মানের কলমচি মাত্র। নান্দনিক তত্ত্ব বিস্তার ও বিশ্লেষণ করা অর্থাৎ ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া আমার একেবারেই অপছন্দ। আমি বিশ্বাসী Text-এ। এক মাষ্টারমশাই আমাকে দিব্যাস্ত্র শিখিয়েছিলেন যে, কোনো কথকের প্রসঙ্গে সন্দর্ভ রচনার ক্ষেত্রে বেশি জটিল তত্ত্ব ও তথ্যের অন্তর্জাল বিস্তার না করে সরাসরি চলে যাবে Text-এ। Text, text and text; — এটাই ছিল তাঁর সংক্ষিপ্ত পরামর্শ।

    তাই আমি রমানাথ রায়-এর কয়েকটি গল্পের করে প্রমাণ করতে চাইব, তাঁর কথন কেন বাংলা গল্পের প্রবহমান ইতিহাসে — সম্পূর্ণ অন্য এক ধারাস্রোত বা ব-দ্বীপ; হয়তো বা সম্পূর্ণ নতুন এক মহাদেশ।

    প্রথমেই জানানো উচিত প্রবহমান আখ্যান-রীতি অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আখ্যান-বলয়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রমানাথ তাঁর গল্পে, — এক Repititive Cyclic Order অনুসরণ করেন। তাঁর যে কোনো গল্পেই এলানো, দীর্ঘ আখ্যানরীতি সম্পূর্ণ বর্জিত। দুই, তিন বা চারটি বাক্যে তাঁর গল্পের প্রাক্‌কথন। তার পরই তিনি আশ্রয় নেন ছোট-ছোট সংলাপের। সংলাপের পর সংলাপ যুক্ত হয়ে নির্মিত হয় যে বৈঠা; তার সাহায্যেই তিনি জীবনের জটিলতার আপাত-মসৃণ জলের উপর দিয়ে তাঁর গল্পের নৌকো সাবলীলভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যান। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি গল্পই নীতিদীর্ঘ; তিন-চার বা পাঁচ পৃষ্ঠার। দশ-বারো পৃষ্ঠার দীর্ঘ গল্প তিনি রচনা করেছেন কম। বস্তুত তাঁর বেশির ভাগ গল্পই, আক্ষরিক অর্থেই ‘ছোটগল্প’।

    এবার কয়েকটি গল্পের আলোচনাতে আসা যাক। ধরা যাক, ‘৩৬-২৪-৩৬’ গল্পটি। গল্পের কথক — ‘আমি’। আমি দীপাকে ভালবাসত। এখন রুমিকে ভালবাসে। কারণ দীপার থেকে ‘এখন’ অনেক সুন্দর দেখতে। এখন রুমির বুক ছত্রিশ ইঞ্চি। আগে ছিল তেত্রিশ।

    ‘—কোমর?
    —চব্বিশ।
    —আগে কত ছিল?
    —ছাব্বিশ।
    —পাছা?
    —ছত্রিশ।
    —আগে কত ছিল?
    —চৌত্রিশ।
    —তুমি তাহলে এখন?
    —এখন আমি ৩৬-২৪-৩৬।’
    তারপর দুজনে এ. সি. মার্কেটে ঘুরতে লাগল। দুজনে শো-কেস থেকে শো-কেসে ঘুরতে লাগল।
    ‘রুমি শো-কেস থেকে শোকেসে ঘুরতে লাগল। মাঝে মাঝে দোকানেও ঢুকতে লাগল। শাড়ি দেখতে লাগল। ব্রা দেখতে লাগল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে শোকেস থেকে শোকেসে ঘুরতে লাগলাম।’

    ‘এক সময় রুমি হারিয়ে গেল। রুমিকে আর দেখতে পেলাম না। কোথায় গেল রুমি? রুমিকে খুঁজতে লাগলাম।’

    খুঁজতে খুঁজতে অবশ্য রুমিকে পাওয়া গেল।

    ‘ঐ তো রুমি! রুমি শোকেসের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ব্লাউজ নেই, শাড়ি নেই। শুধু ব্রা আর প্যান্টিজ...।’

    এই আপাতসরল, সৃজন-কঠিন গল্পের কোনো ব্যাখ্যা দরকার? বরং মনে পড়ে যাবে শঙ্খ ঘোষ-এর বহু-উদ্ধৃত কবিতাটি। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’— ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি / তোমার জন্য গলির কোণে / ভাবি আমার মুখ দেখাব / মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’

    পরের পছন্দ — ‘টাইপিস্ট রমলা’। ..... বিনোদের বাবা উকিল। বিনোদ উকিল। টাইপিস্ট রমলার — ইংরেজির স্পিড — সত্তর। বাংলার — চল্লিশ। বিনোদের বাবা পুত্রবধূ হিসেবে রমলাকে নিয়ে গেলেন। শ্বশুরবাড়িতে রমলার টাইপ করা ছাড়া দ্বিতীয় কাজ নেই। বিনোদের বাবার মামলার নথিপত্র সে টাইপ করে। বিনোদের মামলার নথিপত্র সে টাইপ করে। সারাদিন। রাতেও। একদিন সমস্যা হ’ল। বিনোদ একদিন স্ত্রীকে বলল — ‘তোমার স্পিড আরো বাড়াতে হবে। ইংরেজি টাইপের স্পিড নব্বই করতে হবে, বাংলায় করতে হবে আশি।’ কিন্তু রমলা স্পিড বাড়াতে পারল না। তখন রমলাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নতুন টাইপিস্টকে আনা হ’ল।

    ‘ইংরেজিতে তার স্পিড একশ, বাংলায় নব্বই।’ এবার রমলা টাইপিস্ট হ’ল, ‘সাত শতাধিক গল্প-উপন্যাসের লেখক গোপাল চক্রবর্তীর...।’

    সেবারের পুজো উপলক্ষে দশটা শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখতে হবে লেখককে। সুতরাং — লেখক গোপাল — ‘রাতদিন রমলাকে ডিকটেশন দিয়ে চলেছেন। রমলাও সব কাজ ফেলে কেবল টাইপ করে চলেছে। করতে করতে এক সময় রমলার স্পিড বেড়ে গেল। ষাট থেকে সত্তর হল, সত্তর থেকে আশি হল, নব্বই হল, একশ হল। তাতে ভীষণ খুশি হয়ে লেখক রমলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। রমলা জানাল, সে বিবাহিতা। তখন লেখক গোপাল বললেন — ‘তাতে কি হয়েছে? তুমি বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা কর। সব খরচ আমার। .... তোমার এত স্পিড যে ভাবা যায় না। তোমাকে হারালে আমার উপন্যাস লেখা কমে যাবে, আমার আর্থিক ক্ষতি হবে, আমার খ্যাতি কমে যাবে। ....’ লেখকের নির্দেশ মতো রমলা — স্বামী বিনোদকে ফোন করে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রস্তাব দিল। যখন বিনোদ জানল, রমলার স্পিড একশ; তখন বিনোদ বলল — ‘তোমাকে ওখানে কাজ করতে হবে না। তুমি আবার ফিরে এসো। আমরা তোমাকে আবার সাদরে গ্রহণ করে নেব।’ ইতিমধ্যে গল্প নানাভাবে এগিয়ে গেছে। সেসব পাঠক পড়ে নেবেন আমি গল্পের শেষটুকু উদ্ধৃত করব:

    ‘কাজের লোক জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?

    — রমলাকে।

    — উনি এখন ভীষণ ব্যস্ত। দেখা হবে না।

    — দেখা হবে না মানে! আমি ওর স্বামী। — বলে বিনোদ একরকম জোর করেই ভেতরে ঢুকে গেল। গিয়ে রমলার সামনে এসে দাঁড়াল।

    গোপাল চক্রবর্তী ক্রুব্ধ হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিনোদকে জিজ্ঞেস করলেন, — কে আপনি? এখানে আপনার কি চাই?

    ‘...... বিনোদ এবার বলল, আমি রমলার স্বামী। আমি রমলাকে নিতে এসেছি।

    গোপাল চক্রবর্তী বললেন, অসম্ভব।

    বিনোদ বলল, আমি উকিল। আমার কাজে বাধা দিলে আপনাকে জেলে পাঠাব।

    গোপাল চক্রবর্তী বললেন, আমি লেখক। আপনার মতো অনেক উকিল আমি দেখেছি। আপনি এখনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। নইলে আমি থানায় ফোন করতে বাধ্য হব। বিনোদ এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে রমলাকে লক্ষ্য করে বলল, রমলা, পতি পরমগুরু। পরপুরুষের ঘর করা পাপ। তুমি আমার সঙ্গে ঘরে ফিরে চলো।

    রমলা কোনো উত্তর না দিয়ে টাইপ করে চলল, খটাখট.... খটাখট.... খটাখট...

    গোপাল চক্রবর্তী বললে, রমলা তুমি এখন টাইপ করা থামাও। তোমার স্বামীকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।

    রমলা এবারেও কোনো উত্তর না দিয়ে টাইপ করে চলল, খটাখট... খটাখট... খটাখট....’

    এরকম গল্প আপনারা বাংলা বা ইংরেজি ভাষায় পড়েছেন নাকি? আমি, খুব মুখ্যু, পড়িনি।

    শেষ উদাহরণ, আন্তর্জাতিক মানের গল্প — ‘শত্রুপক্ষ’। গল্প শুরু হয় এইভাবে।

    ‘বাবা-মা-ভাই-বোন সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে কাল্টু যুদ্ধযাত্রা করল।’
    সেনাদলে যোগদান করে কাল্টুর ডিউটি হল — গাছের ডালে। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, গাছের ডালে দূরবিন চোখে লাগিয়ে বসে থাকার পরও কাল্টু একজন শত্রুকেও দেখতে পেল না। একদিন সে ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করল —

    ‘— আমি এতদিনেও বুঝতে পারছি না স্যার, আমাদের শত্রু কারা? কাদের সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে? এই প্রশ্নে ক্যাপ্টেন ভীষণ রেগে গেল। বলল, এই ধরণের কৌতূহল খুব খারাপ। আজ তোমাকে আমি ছেড়ে দিলাম। এরপর তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। তোমার কোর্টমার্শাল হবে। এখানে তুমি যুদ্ধ করতে এসেছ, যুদ্ধ করে যাও। কার সঙ্গে যুদ্ধ, কেন যুদ্ধ তা জানার দরকার নেই? বুঝতে পেরেছ?’

    একদিন ক্যাপ্টেন কাল্টুকে জিজ্ঞেস করল, সে এ যাবৎ কটা শত্রু মেরেছে। কাল্টু জানাল, সে একটা শত্রুও মারতে পারেনি। ক্যাপ্টেন ভীষণ রেগে জিজ্ঞেস করল —

    ‘—তা হলে কি করেছ? একটা মশাও মারতে পারনি?

    —মশা মেরেছি স্যার।

    —কটা?

    —গুনিনি। তবে এক লাখ হবে স্যার।

    তা শুনে ক্যাপ্টেন উৎফুল্ল হয়ে বলল, সাবাস! তোমার জন্যেই তাহলে মশার উৎপাত একটু কমেছে। নইলে মশার উৎপাতে আগে ঘুমোতে পারতাম না।’

    একদিন গুজব রটল, শত্রুরা আসছে। নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা গুলি ছুঁড়তে লাগল। বোমারু বিমান থেকে বোমা পড়তে লাগল। কাল্টুও গুলি ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু শত্রুরা এগিয়ে আসতেই লাগল। তারা সংখ্যায় — কোটি কোটি।

    গল্পের শেষ — ‘শত্রুরা বোমা, গুলি উপেক্ষা করে আস্তে আস্তে যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। কাল্টু চোখে দূরবিন লাগিয়ে তাদের চিনতে পারল। তারা এই দেশের মানুষ। তাদের মধ্যে কাল্টু তার বাবা-মা-ভাই-বোনকে দেখতে পেল। তাদের কারো হাতে মেশিনগান নেই, রাইফেল নেই। তাদের প্রত্যেকের হাতে ভিক্ষাপাত্র।’

    এই গল্পটি পড়ে, আপাতদৃষ্টিতে বিষয়গত কোনো মিল না থাকা সত্ত্বেও আমার মনে পড়ে গিয়েছিল শঙ্খ ঘোষ-এর এই বিশেষ কবিতাটি — ‘জঙ্গলের মাঝখানে কাটা হাত আর্তনাদ করে / গারো পাহাড়ের গায়ে কাটা হাত আর্তনাদ করে / সিন্ধুর স্রোতের দিকে কাটা হাত আর্তনাদ করে / কে কাকে বোঝাবে কিছু আর / ... অর্থহীন শব্দগুলি আর্তনাদ করে আর তুমি তাই স্তব্ধ হয়ে শোনো / দেশ আমাদের আজও কোনো / দেশ আমাদের আজও কোনো / দেশ আমাদের আজও কোনো / দেশ আমাদের কোনো মাতৃভাষা দেয়নি এখনও।’

    যেহেতু এই আলোচনা ‘শাস্ত্রবিরোধী’, তাই এখানেই শেষ হল।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ এখান থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments