রক্তিমের পিঠে আলতো করে হাত রাখলাম। ও হয়ত একটু ঠান্ডা ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে তাকাল, নির্জন গরম ঘরে কাউকে না দেখে আবার ডুব দিল চাঁদপুরের শেষ বিকেলে দেখা ঘোড়ানিম গাছের ছায়ায় মাকড়া পাথর বসানো একলা পুকুরঘাটে। ওর কাছে রং তুলির পেশাদারি আভিজাত্য নেই। যেমনই হোক তার স্মৃতি অথবা কল্পনা, জায়গায় জায়গায় পুকুরের গভীর সবুজ আর আকাশের ফ্যাকাশে নীল মিশে যাচ্ছে ওপারে জল না ছুঁয়ে এলিয়ে পড়া দুষ্টু খেজুর গাছের কমলারঙা ফলের গোছায়। পুকুরের উঁচু-নীচু জলে ছেঁড়া ছবি আর শুকনো ডাঙার পাটভাঙা গন্ধ হাতে হাত রেখে গুনগুন করে যায় ছেলেটির কানে।
অনেক সময় নিয়ে পট স্থির হয়, খুঁটিনাটি বোঝা যায়। পাথরে বসে রক্তিম দেখে শেষ বিকেলের রঙে ছোপানো কাপড় গায়ে ধূলামাটির পথে শান্ত ধীর পায়ে ভেসে চলেন কোনও আনন্দময়। খানিক পরে মিলিয়ে যান দিকচক্রবালে। মিলিয়ে যায় পুকুর, খেজুর গাছ, পাকা বাঁশের বেড়া, বেতের ঝোপ, রঙ্গন ফলের লাল সবুজ থোকা, মচমচে পাতা বিছানো শরীরী নরম ধূলা। সামনে পড়ে থাকে গোধূলি বেলার নির্লিপ্ত সঙ্গম। ওর মনে পড়ে টুকরো কিছু দৃশ্য, মলিন কাষায় ঢাকা উজ্জ্বল শরীর কোনো নগরপ্রান্তে বুড়ো বটের ঝুরি ঘেরা চৌখুপিতে আসন পাতা, পাশে একটি ঝোলায় ভিক্ষাপাত্র, তার সামান্য গর্ভে মিলেমিশে একাকার কয়েক মুঠো ভাত, ডাল, পায়েস, তরকারি। প্রেষমন্ত্র স্মরণ করে মাধুকরীর অন্ন মুখে তোলার আগেই তড়িঘড়ি মেঘ ছেয়ে আসে, উদ্দাম বাতাসে ঘোলা ঝড় ওঠে। ঠিক তখনই কোথা থেকে ভীতু একটি রোগা কুকুর খুব সাবধানে এসে জুলজুল করে তাকায় সেই খাদ্যপিণ্ডের দিকে। বাজ পড়ে কাছেই। চমকে উঠে কুকুর আরও কাছে ঘেঁষে একটু সাহচর্য খোঁজে, খাবারের গন্ধে তার নির্জলা জিভেও দু-ফোঁটা জল আসে। তাঁর হাত মুখে ওঠে না। অভুক্ত সারমেয় সমস্তটাই পায় অনায়াসে। তিনি মিষ্টি হেসে ছলছলে চোখে ভিক্ষাপাত্র মাটিতে উপুড় করে দেন, তারপর দেখেন ভেতরে লেগে আছে অল্প মণ্ড। তাই আঙুলে বার করে মুখে দেন। প্রবল বৃষ্টি নামে। আবার বাজ পড়ে।
চমকে উঠে রক্তিম দেখে মেঘের ছায়া পড়েছে পাশের বাড়ির নারকেল গাছ আর ডুমুর গাছে। বাদুড় দুটো নেই। ইটের ঘরে এক ঝলক শীতল হাওয়া হুস করে ডাকাতের মত ঢোকে। আমি ওর কাঁধ থেকে হাত তুলে নিই। রক্তিম ঘুরে কিছু খোঁজে, এদিকে ওদিকে তাকায়, কিছু পায় না। কে জানে তার চাওয়া-পাওয়ার খেরোর খাতায় কবে শেষ কালির ফোঁটা পড়ছে।