আমাকে দেখে কি মনে হয় তোমার? মনে হয় না, আমি কত ভালো আছি। হ্যাঁ-হ্যাঁ, ভালো আছি। সত্যিই ভালো আছি। আসলে ভালো থাকতে হয় বলে ভালো আছি। নাও গো, চলো এবার। বাইকে স্টার্ট দাও। নইলে দেরি হয়ে যাবে যে। কথাগুলো অনিকেতকে শুনিয়েই যেন হাওয়ায় মিশে মিশে নদীর পাড় ঘেঁষে ভেতরের দিকে চলে গেল। বাইকে বসল শুচিস্মিতা। সুকোমল নন্দিত হাত এসে ছুঁয়ে দিল অনিকেতের বলিষ্ঠ কাঁধ। খানাখন্দে পড়ে নাড়া দিতে লাগল, কখনো কখনো। পিছনের দু-একটা শব্দ হাওয়ার আঘাতেই খসে খসে পড়ে গেল বোধ হয়। বদনা আজও চুল্লু খেয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে আছে এখনও, ঠিক আগের মতন। এসে পৌঁছলো একটি বি.এড. কলেজে।
পুষ্পস্তবকে বরণ আর দু-চারটা ছোড়া ছোড়া কথায় অভ্যর্থনা সারা হলো। ম্যাডাম শুচিস্মিতা এলেন শ্রেণিকক্ষে। শৈলীতে ভর করে বিষয় সহজ সরল হয়ে মুক্তো ছড়াতে থাকলো শ্রেণিকক্ষ জুড়ে। অসংখ্য ভালো লাগা আর প্রশংসার ছোট ছোট কথা শুনে ফুর্তি এল মনে। আরও দু-একটা ক্লাসের অনুরোধও এসে পড়ল। যেতে হবে। মেঘের অবস্থাও ভালো নয়। যখন-তখন নেমে না আসে। চলো গো। স্টার্ট দাও। আসছি, ভালো থেকো সবাই। আবার যদি সময়সুযোগ হয়, আসব। পুনশ্চ সেই নদীটির কাছে। তারপর ভেসেলে রায়চক। পরে বাস ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে যাবে কোলকাতা শহরে। চলো না গো, দুজনে একসঙ্গেই নদী পেরোই। তুমি নাহয় কিছুক্ষণ থেকে চলে আসবে। তুমি সঙ্গে থাকলে নিশ্চিন্তে আমিও একটু নদীর পাড়ে বসে যেতে পারি।
দুর্বল সেতু বেয়ে নেমে এল দুজনেই। জলের উপরে ভেসে থাকা জেটি ঢেউ-এর তালে তালে দুলিয়ে দিল অকস্মাৎ। আচ্ছা, ওই নীল আকাশ আর জলকে নিয়ে আমার একটা ছবি তোল না। মাঝনদীতে জেলের ডিঙিটাকে ধরবে কিন্তু। জল আর আকাশের মিলনরেখায় দিব্যি মিলে গেল শুচিস্মিতার কমনীয় মুখ। এবার তো আমাদের দুজনের একটা সেল্ফিও নিতে পারি, না কি? জেটিকে ছেড়ে ভেসেল নদীর বুকে ভাসতে ভাসতে এগোতে লাগল। সামনে দিয়ে মালয়েশিয়ার একটা প্রকাণ্ড জাহাজ জল ঠেলে ঠেলে চলে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। উচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়ল ভেসেলেও। সিঙ্গাপুর, চীন প্রভৃতি প্রায় ষোলোটি দেশ থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এই পথ ধরেই আসে ও চলে যায়।
পশ্চিমের সূর্য অস্তগামী। রক্তিম আলোয় ঝিলমিল করছে নদীর পুণ্য সলিল। শাবক শুশুকের ঝাঁক খেলায় মেতেছে। মুহূর্তের জন্য মাথা তুলেই ডুবে যাচ্ছে নদীর গভীরে। সারাদিনের ক্লান্তি মেখে ডিঙি পাড়ে এসে, শুধু রাতের জন্য বিদায় জানাচ্ছে তার আজীবনের পুরুষকে। শুরু হলো এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি। রঙিন ছাতার নীচে অনিকেত ও শুচিস্মিতা। ইচ্ছে করছিল আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে। আরও কিছু প্রকৃতির রূপ মেখে নিতে। কিন্তু সময় অন্তরায় হয়ে উঠলো। আগামী সপ্তাহে যদি আসো, জানিও। ভালো থেকো গো। আসছি। আর হ্যাঁ, তোমার ছোটগল্পের বইটি মনে করে নিয়ে আসবে।
পরের সপ্তাহের কাজ পিছিয়ে চলে গেল পরের মাসে। সেদিনও চারদিকে রিমঝিম বৃষ্টি। সকালের আধভেজা পোশাক গায়েই শুকিয়েছে কখন, বুঝতেই পারেনি অনিকেত। কলেজ স্ট্রিট থেকে লেকটাউন অনেকটা পথ। ফিরে এসে আবার ধর্মতলার বাস। একটা ট্যাক্সিকে ডাকল। আদ্যিকালের ছাইরঙা একটা মস্ত বাড়ি। ছোটবড় গাছ আগলে রেখেছে সামনের ভূমিকে। শুচিস্মিতা হাসতে হাসতে বাড়ির ভেতরে আসতে বলল। যা অবস্থা, ঘাম আর বৃষ্টি মিলে এক অদ্ভুত গন্ধ তখন সারা শরীর জুড়ে। আজ থাক, পরে নাহয় কোনদিন, বলেই গল্পের বই হাতে দিতে চাইল অনিকেত। তুমি না ভারি দুষ্টু হয়েছ এখন। বাড়িতে এসে চলে যাবে, তাই কখনো হয়!
স্নান সেরে এখন সোফায় অনিকেত। ততক্ষণে কফির ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে বাতাসেই মিশে যেতে চাইছে। জলরঙা হাউসকোট জড়িয়ে শুচিস্মিতাও চুমুক দিতে দিতে সোফাতেই বসে পড়ল। ছেলে রিবন খাতা নিয়ে এল মায়ের কাছে। বাবা, এই তোমার অনিকেতকাকাই। এই কাকাই-এর কথাই তুমি বলেছিলে মা। কাকাই, তুমি খুব সুন্দর। তোমার মুখটা খুব মিষ্টি। তুমি কি ক্যারাম খেলতে পার? খেলবে আমার সাথে? বাবাই এসব কি হচ্ছে। কাকাই আজ খুব ক্লান্ত। কালকে খেলবে বাবু। রিবন এক দৌড়ে ভিতরের দিকে চলে গেল। অনিকেত পিছনে পিছনে গিয়ে দুজনে মিলে ক্যারাম খেলতে শুরু করল। কাকাই তুমি আমাদের বাড়িতেই থেকে যাও। আমার কোন বন্ধু নেই জানো। আমি একটুও খেলা করতে পাই না। তুমি থাকলে তোমার সাথে খেলব।
সারা বাড়িতে আট-দশটা রুমে মাত্র আড়াই জন। বার্ধক্যজনিত কারণে মাসিমাও অসুস্থা এখন। শুচিস্মিতার বাবা ছিলেন বিনে পয়সার ডাক্তার। গত পাঁচ বছর আগে তিনিও সকলকে রেখে দিয়ে চলে গেছেন। এখন সংসারের সমস্ত কাজ শুচিস্মিতাকেই সামলাতে হয়। চলো গো, খেয়ে নিই। বর্ষা নেমে এল মনে হয়। কখন শুরু হয়েছে, একবারও থামেনি। কোলকাতাকে ডুবিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, রিবনকে আগে খাইয়ে দিই। ওর আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে। ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি শুচিস্মিতা আর অনিকেত। পূর্ণিমার চাঁদের মতো টিপ সখ করে বসে আছে চওড়া কপালে। চশমায় বাঁধা সোনালি নেকলেস সামঞ্জস্য রেখেই এদিক-ওদিক করে যাচ্ছে। চোখের মায়ায় পড়ে চোখদুটোও আটকে যেতে লাগল বার বার।
রিবন সিরাপ না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। কদিন ধরেই খুক খুক করছে ছেলেটা। চলো গো, তোমার শোয়ার ঘরটা দেখিয়ে দিই। দেখছ তো সারাদিন কাজ নিয়েই পড়ে থাকি। তার উপরে কাজের দিদি ডুব মারলে খাটুনিটা আরও বেড়ে যায়। এই যদি ভালো থাকা হয়। তাহলে বেশ ভালো আছি। ধরতে পারো, ভালো থাকতে হয় বলে ভালো আছি। হাসতে হাসতে এক এক করে কথাগুলো ঝরে পড়তে লাগল মুখ থেকে। তোমার নিশ্চয় একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে মাথায়। সব পুরুষেরই আসে। মেয়েদেরও আসে। এমনকি আমারও আসে। বিছানার এক কোণে বসে পড়ল শুচিস্মিতা। আর তখনই মধ্যরাত্রির সময়ের কথা মনে করিয়ে দিল দেওয়ালের ঘড়ি।
আমি তখন বিশ্বভারতীর ছাত্রী। লাবণ্যে ভরপুর আস্ত একটা আষাঢ়ী নদীর মতো। অসংখ্য বক্রচাহুনি এসে ঠেকতে লাগল এখানে-সেখানে। কোন কোন চোখ আবার নদীর স্রোতের মতো উপর থেকে নীচের দিকে গিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছিল বার বার। সবে সেকেন্ড ইয়ার শেষ হয়েছে। আলাপ হলো অঙ্কন বিভাগের স্যারের সাথে। অসাধারণ শিল্পী মানুষ। সুবিখ্যাত আঁকা ছবিগুলো এখনো চোখেই ভেসে ভেসে থাকে। বেশ কয়েকটি নামী পুরস্কার প্রাপ্তির পর থেকে নামডাক বেশ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বুদ্ধিদীপ্ত প্রখর চোখ। কোঁকড়ানো বাঁধা চুল আর মুখ-ভরতি দাড়ি। খদ্দরের ধূসর পাঞ্জাবির ভেতরে নেতাজীর ঘোড়ার মতো অশ্বশক্তিমান একটা সুপুরুষ। মিষ্টভাষী মানুষটি ইশারায় কাছে ডেকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন আমার দিকে। চোখের ভাষায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু কথাগুলো আমি অল্প অল্প করে পড়ে ফেলতে চাইছি। ঠিক তখনই, যদি কিছু মনে না করো, কাল একবার কোয়ার্টারে এসো। তোমাকে নিয়ে কিছু ভাবনা আছে।
প্রথম দর্শনেই আমি কেমন দুর্বল হয়ে গেলাম। বলতে পারো, কোথাও একটা ভালো লাগা অথবা ভালোবাসার ধাঁধায় আটকে গেলাম। দরজা ঠেলে ঢুকতেই একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ এল নাকে। চতুর্দিকে অগোছানো আঁকাআঁকির সরঞ্জাম সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। জানালাগুলো কখনো খোলা হয়েছিল বলে মনে হয় না। মেঝেতে ধুলোর স্তূপ। এককোণে জমে আছে অসংখ্য ছোটবড় ফরেন বোতল। একটা তিন-বাই-ছয়ের চৌকিই শুধু বিছানা জড়ানো। বসো। এক ঘন্টা বসে আছি, কোন কথা নেই। আপন মনে রঙতুলির হাত এঁকেই চলেছে শুধু। দেখো তো, কেমন হলো। অবিকল আমাকেই এঁকে দিলেন স্যার। আমি যেন আয়নায় নিজেকে মেলাতে বসেছি। বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। ব্যালকনির সিগারেটের ধোঁয়া ঘুরেফিরে রুমেই এসে ঢুকে পড়ছে, তখন।
আচ্ছা, আমরা যদি একসাথেই থাকি, তোমার কি কিছু আপত্তি আছে? ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না সেদিন। দুম করে এমন প্রস্তাব আসতে পারে, কল্পনাও করিনি কখনো। পরে একদিন প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে দিলাম। সামাজিকভাবে না হলেও আইন মেনে বিয়ে করলেন আমাকে। বছর যেতে না যেতেই জন্ম হলো রিবনের। আনন্দে কিনা দুঃখে জানি না তবে নেশা বেড়ে বেড়েই যাচ্ছিল ওনার। দু-একবার চেষ্টা করে, ওর মধ্যেই নিজের সুখ খুঁজে বেড়াতে থাকলাম। একদিন গভীর রাতে উনি ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। জলের গ্লাস ধরে বসলাম, মুখের সামনে। জানো, শুচিস্মিতা। আমি না, তোমাকে নিয়ে বেশ তৃপ্ত নই। কোথাও একটা অসন্তুষ্টি যেন আমাকে হা-হুতাশ করে তোলে। সত্য কথা অবলীলায় এত সহজ করে কেউ বলতে পারে এর আগে কখনো শুনিনি। ও, এই কথা। হাসতে হাসতে পরের দিনই দুবছরের রিবনকে নিয়ে কোলকাতা শহরে চলে এলাম। ভালো থাকবেন স্যার। শরীরের কথাটা একটু ভাববেন। মানুষটাকে নিয়ে অনেকদিন ছিলাম তো। বিশ্বাস করো, একবারের জন্য কোন দুঃখ, কোন অভিমান মনে জায়গা নিতে পারেনি। বরঞ্চ একটা অকপট সত্য স্বীকার করার সৎসাহসকে স্যালুট জানিয়েছি বারবার। এখনো মানুষটাকে আমি খুব ভালোবাসি। বিয়ের আগেও উনি স্যার ছিলেন, পরেও স্যার, এখনও উনি আমার স্যার। তবে এখন আর জানি না, মানুষটা ঠিক কেমন আছে।
এবার গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠল শুচিস্মিতার। পরে পরেই শুরু হলো সংগ্রামী জীবন। একদিন কলেজে জয়েন করলাম। সেখানেও ডিভোর্সীর কাঁধে হাত রাখতে চাইল আনাচকানাচের অসংখ্য পুরুষ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু ভালো থাকার টিপস আসতে থাকল দিনে দিনে। সংশয়, সন্দেহ, কত কিছু। পুনশ্চ বিবাহের প্রস্তাবও রাখলেন এক তরুণ প্রফেসর। সমাজকে চোখ খুলে দেখতে শিখলাম। এখন আমার সামনে শুধুই রিবন। মায়ের কাজটা তো ভালো করে করি। আবারও হাসতে হাসতে, শুয়ে পড়ো গো। অনেক রাত হয়ে গেল। দরজাটা লাগিয়ে দিও।
বেশ কাটছিল, বলো? রিবনেরও খুব পছন্দ হয়েছে তোমাকে। মাঝে মাঝে এসো। এমন কোরো না বাবু। চার দিন তো হলো। কাকাই আবার আসবে। কাজ আছে সোনা। অনিকেত রিবনের দিকে আজ আর তাকাতে পারছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চার দিন নয়, চার দিন নয়, যেন চার যুগ আগের কোন এক গভীর সম্পর্ক। শিশুর কোমল হাতের স্পর্শমাখা অনিকেতের শরীর আজ বড় অসহায়। শুচিস্মিতার সুদৃঢ় মনও বড় আবেগে ভিজে যাচ্ছে আজ। তবুও, ভালো থেকো গো। সাবধানে যেও। দরজায়, মায়ের হাত ছেড়ে চলে যেতে চাইছে অবোধ কিশোর। অনিকেত আর একবারের জন্যও মাথা তুলে চাইতে পারল না কারও দিকে।