বিরাট আমগাছ দুটোর জায়গায় একটা কুৎসিত ফ্ল্যাটবাড়ি দাঁড়িয়ে। লখার বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে। এদিক ওদিক একটু হেঁটে খুঁজতে থাকে আর কী কী হারিয়েছে—-মাঠটা ঘিরে দিয়েছে উঁচু পাচিল দিয়ে, গদু মল্লিকদের জমি ছিল ওটা, কত দুপুর বিকেল হইহই করে কেটেছে ওই মাঠে, পুরোনো মেসবাড়িটা দেখা যাচ্ছে না পাঁচিলের জন্য, আছে নাকি ভেঙে ফেলেছে? একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে নিজের অজান্তে, ভাবে—কীসের টানে এলাম? স্কুলবাড়ি লাগোয়া কোয়ার্টারটা আছে, সেরকমই। নিশ্চই তার বাবার মতো কোন দারোয়ানের সংসার, দড়িতে গামছা ঝুলছে, ঝুড়িতে শুকনো কুল রোদে রাখা, ঝলকে মায়ের মুখটা অতীত ফুঁড়ে উঠে আসছিল, লখা জোর করে সরিয়ে দিতে হনহন হাঁটা লাগায়। পাঁচিলের পাশ ধরে পুকুরের দিকটায় যেতে যেতে বেশ বুকটা ধুক ধুক করে ভয়ে, যদি পুকুরটাও…। নাঃ! আছে, বিরাট কুয়ো পুকুর টলটলেই আছে একরকম, তার পিছনের বস্তিতে ঘর বেড়েছে অনেক মনে হল। পুকুরধারে গোটাকতক খেজুরগাছ আগের মতোই দাঁড়িয়ে। সেই পুরোনো গাছগুলোই কি? খেজুর গাছ কদ্দিন বাঁচে? বড় নালাটার ওপর কংক্রিটের স্ল্যাব, মৃত খেজুরগাছের ওপর দিয়ে আগে পার হত; দুহাত ডানার মত ছড়িয়ে দৌড়ে গাছের ব্রীজ পারাপার, পড়লে নীচের পাঁকে হাবুডুবু, আজ সেই স্মৃতিটাও এত আনন্দের ঠেকবে সে কি জানত? ভাবতে ভাবতে লখা গাছের ছায়ায় বসে পড়ে, ব্যাকপ্যাক মাটিতে রেখে সিগারেট ধরায়, দুপুরে প্রভাস-মাস্টারের বাড়ি দেখা করতে যাবে, ফোনে কথা হয়েছে। প্রভাস-স্যর এখন স্কুলের হেডমাস্টার। পরিদির কি বিয়ে হয়ে গেছে? তাই হওয়ার কথা। চোখ লেগে আসছে, রাতের ট্রেনে ঘুম হয়নি তার।
লছমন সিং ওরফে লখার পরিবার ছিল ভোজপুরি ছোট জাত। হাইস্কুলের দারোয়ানের কাজ নিয়ে তার বাবা বাংলার এই মফস্বলে বাস শুরু করে। স্কুলের ঘর ও বাগান পরিষ্কারের কাজও করত তাদের পরিবার। তাদের বাসস্থানকে দারোয়ান কোয়ার্টারই বলত পাড়ার সকলে। কোয়ার্টারের পাশেই বিরাট মাঠ। মাঠের অপরপ্রান্তে পুরোনো মেসবাড়ি, উঁচু সিলিং, খড়খড়ির ইয়া বড় জানালা। লখার যখন ক্লাস ফোর তখন রামদাস মেসে রাঁধুনীর হেল্পার হয়ে এল। তাকে দেখাত দশ বছরের বাচ্চা, অপুষ্টির তলে বয়স হয়ত আরো বছর দুয়েক এগিয়েই ছিল। রামদাস বিহারের প্রত্যন্ত রুখাশুখা গরীব গাঁওয়ের ছেলে, যেসব গাঁয়ের বাপ-মা কাজে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়—একটা পেট তো কমল। তা বাঙ্গালী কথা বুঝতে হিমসিম খেতে খেতে রামদাস দিন দুয়েকের মধ্যেই সাঁঝে শুনতে পেয়েছিল ভোজপুরবা গীত, আনন্দে সে দড়িছেঁড়া বাছুরের মত লখার বাবার গানের আসরে হাজির হয়েছিল। মা-বাপ ছেড়ে আসা বাচ্চাটাকে লখার পরিবারের সকলে আপন করে নিতে দেরি হয়নি। রামু লখার দোস্তি জমে উঠতেও বেশি সময় লাগেনি। এই বন্ধুত্ব লখার স্কুলের বন্ধুদের মস্করার বিষয় ছিল। অশ্লীল ভঙ্গি সহ অতি জনপ্রিয় ‘রাম-লখন’ সিনেমার ‘ওয়ান টু কা ফোর’ গেয়ে লখাকে প্রায়শই খেপানো হোত।
মেসবাড়িতে উড়িয়া বামুন উপেনঠাকুরের সঙ্গে রামদাস ঠাঁই পেয়েছিল রান্নাঘর লাগোয়া ঘরে। উপেনঠাকুরের ঘর ভাগাভাগির আপত্তিজনিত ওড়িয়া চেল্লামেল্লিতে অতিষ্ঠ হয়ে রামদাস প্রথমদিকে দাওয়ায় শুতো। মেসবাড়িটি প্রাচীর ঘেরা ছিল না, ফলে মনে হত মাঠের মধ্যেই বাড়িটা আছে, চারপাশে বিশাল কাঠচাঁপা গাছ, রক্তকরবী, টগর, আমগাছ, কুলগাছেদের ভিড়। রামদাস এই সজল শ্যামল পরিবেশে এক্কেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, রাঁধুনীর কানমলা, মেসের বাবুদের তিরষ্কার কিছুই তার গায়ে লাগত না।
মেসবাড়ি ভদ্রপাড়ার শেষ সীমানা নির্দেশ করত, এরপর বিরাট পুকুর ও তারপর বস্তি। লখা রামুকে বাংলা বলতে শেখাত, “এখানে লোকজন খুব ভালো রে, কোনো অসুবিধা হবে না, শুধু বাংলাটা বলতে শেখ।”
দুপুরের পর রামদাস একটু ফাঁকা পেত, সেসময় লখাও স্কুল সেরে এসে জুটত। বিকেলে এই মাঠে পাড়ার ভদ্রঘরের মেয়েরা খেলতে আসে। বিনিদিদি, রাখিদিদি, পরিদিদি, এমন দশ থেকে তেরোর একদল মেয়ে। লখা ও রামু তাদের নানা আবদার মেটায়।
বিনিদিদি বলে—রামু কাল একটু এক্কাদোক্কার ঘরটা কেটে রাখিস তো, দাগ মুছে গেছে।
তিন্নিদি বলে—পুতুলের বিয়ে দেব ফুল তুলে রাখিস তো।
প্রভাস-মাস্টারের মেয়ে পরিদিদি এক্কেবারে পরিটি-ই, তার পছন্দের এক্কাদোক্কা ঘুটি ইটের টুকরো থেকে তৈরি করে রাখে রামু।
কিন্তু লখার আফসোস পাড়ার ছেলেদের রোজ বিকেলে এই মাঠে খেলতে দেয় না মেয়েরা। তারা কেবল রোববারের সকালে এই মাঠে চান্স পায়। কে না জানে বাঙ্গালী মেয়েরা মা-দুগ্গার জাত, এত যে মিষ্টি চেহারা কোমর বেঁধে কী ঝগড়াটাই করবে ছেলেগুলোর সাথে।—-
—কেন পাঁচ মিনিট হেঁটে কোর্টের বড় মাঠে গিয়ে খেলতে তোদের কি পা খসে রে? মেয়েদের পাড়ার বাইরে গিয়ে খেলতে হবে নাকি?—বলবে দিদিরা।
ছেলেগুলো বলে—-কী আমার পদ্দানশীন বিবি এল রে।
—ভাগ বলছি।
লখা স্কুলের নামকরা স্পোর্টসম্যান, তাকে কদর করে ডেকে নিয়ে যায় ছেলেগুলো। কিন্তু রামু যেতে পারে না, উপিনঠাকুর হাঁক দেয় থেকে থেকে, সে ওই ফাঁকেই দিদিদের খেলা দেখে দুটো কথা কয়। লখা তাই দু-এক দিন এ মাঠেই থেকে যায় রামুর সাথে, সেদিন ওদের এক্কাদোক্কা খেলায় নেয় দিদিরা। লখা ভয়ে ভয়ে থাকে অন্য বন্ধুরা দেখে নিলে আচ্ছা খেপাবে।
গরমের সময়টাতে নুন কাঁচালঙ্কা বেটে কাঁচা আম মেখে আনে রামু, বিশাল দুটো আমগাছ অফুরন্ত কাঁচা আম জোগান দেয়। দিদিরা হুসহাস করে খায়, প্রসংশায় সবাই পঞ্চমুখ হয়, উপিনের সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়াও করে আসে রামুর বিকেলে ছুটির দাবিতে।
এইভাবে রামুর শীতের কুলমাখা বানানোর সময়ও আসে, শীতের ছুটির দুপুরগুলো লখা ও রামু আঁকশি দিয়ে কুল পাড়ে, আর পুকুরপাড়ে বস্তির লোকেদের খেজুর রস থেকে তাড়ি বানানো দেখে চুপি চুপি, লখা ও রামুর বন্ধুত্ব বছর পার হয়ে যায়। মেসের বাবুরা অফিস গেলে রামু লখাকে দেখায় এই এত্ত বই বাবুদের ঘরে, স্বল্পবাস অসভ্য ভঙ্গির মেয়েদের ছবি তাতে। রামু হাসে খিক খিক করে, লখা বলে—এসব অসব্য জিনিস দেখতে নেই রামু, রেখে দে। রামু বলে—পড়া শুনা করা বাবুরা দ্যাখে কাঁহে, বোল? উরা দ্যাখলে ভাল?
—আমি জানি খারাপ, সবার জন্যেই খারাপ, মা-দিদি আছে আমার।
রামুর বাবা এসে মাইনের টাকা নিয়ে যায়, রামুকে বলে ছটপুজোয় বাড়ি নিয়ে যাবে। রামুর কোনো হেলদোল নেই, মায়ের জন্যে একটু মন টাটায়, কিন্তু সে এখানে বেশ আছে, ঠেকুয়া লিট্টি খেয়ে সারা দিন খিদেয় পেট জ্বলা নেই। বাবা তো তার চকচকে চেহারা দেখে মহা খুশি, “আপলোগওকে মেহেরবানি” বলে বাবুদের গড় করে সে।
এমনই এক দুপুরে লখা স্কুল ফেরত সবে গুড়-চিঁড়ে খাচ্ছে এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে রামু এসে তাড়া দেয় “বাহার আ।”
লখা চটপট আমতলায় আসে।
রামু বলে—খেতে বস্ ছি এমোন সময় এক আদমি হুই কুলগাছের কাছে বাইক নিয়ে এল, বাইক ইধার এক্কেবারে আসে না, তো জানলা দিয়ে দেখনে গেলাম।
এখন রামু হিন্দিমিশ্রিত বাংলা বলে। রামুর বর্ণনার সারাংশ হল, একটা লোক বছর পাঁচেকের একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে আসে, বাচ্চাটা কাছেরই নার্সারি স্কুলের ড্রেসে ছিল। আশপাশের ফুলগাছ হাতড়ে বাচ্চাটাকে ফুল দিয়ে ভোলায়, তারপর অসভ্য কাণ্ড শুরু করে বাচ্চাটার সাথে।
এবয়সে অসভ্যতা সম্পর্কে স্কুলের বন্ধুদের রসাল আলোচনা থেকে ধারণা ভালোই হয়েছে লখার। আর বাবুদের ঘরের নিষিদ্ধ ম্যাগাজিনের ছবি লুকিয়ে দেখে রামুরও বিদ্যা হয়েছে ভালোই। দুজনেই বোঝে বাচ্চাটার মহা বিপদ।
লখা বলে—তুই কি করলি?
—বুদ্দি করি শিস দেলাম জোরে। কাম হল, বেটা বাচ্চাটাকে নিয়ে স্টার্ট দিয়ে ভাগলবা।
—আরে ভাগল তো কিন্তু বাচ্চাটা তো সাথেই থাকল, তার তো বিপদ।
—তা বটে, কিন্তু বাচ্চাঠোর চেনা আদমি, বাত করছিল, কাঁদেনি।
দুই বন্ধু ঠিক করল বড়দের কাউকে বলবে, মা-বাবাকে বলা যাবে না, দাদাকে বলা যেতে পারে।
রামু বলে—উপিনঠাকুর কো বলতে পারব।
লখা তো হাঁ, সে জানে ও ব্যাটা রামুর শত্তুর।
রামু বলে—উ আদমি খারাপ না আছে, ভাব হয়ে গেছে। মাথায় চাম্পি করি, পাক্কা চুল তুলে দি।
উপিনঠাকুর সব শুনে ওদের বার বার এই চক্করে পড়তে মানা করল, বাচ্চাটাকে স্কুল থেকে বাড়ি নিচ্ছিল যখন তখন নিজের বাড়ির লোক হতে পারে, অথবা পড়শি। সে জানে লখাদের কেউ বিশ্বাস করবে না। পরামর্শ রামু বা লখার মনে না ধরলেও উপিনঠাকুর যে তাদের ভালোর জন্যেই বলছে তা তারা বোঝে। এরপর দিনকতক কেটে যায়, লখা রামুকে কিচ্ছু জানাতেও চায় না, তার কেমন বিচ্ছিরি অনুভূতি হয়।
বিকেলের দিকে সেদিন জোর খেলা জমেছে, লখা ও রামু এক্কাদোক্কায় জুটি বেঁধেছে। “তোরা দুটো পাকা পার্টি একসাথে, তোদের কে হারাবে বল?” দিদিরা রেগে যাচ্ছে। এমন সময় একটা হইহই রব উঠল, অনেক লোক মাঠের পাশ দিয়ে বড় পুকুরের দিকে ছুটছে, ওরাও “কি হয়েছে, ও কাকু ও জ্যেঠু?” বলতে বলতে দৌড় দিল সেদিকে।
পুকুরের কচুরিপানার মাঝে একটা লাল রঙের কিছুর দিকে লোকে আঙ্গুল দেখাচ্ছে। সবার কথায় যা বোঝা গেল, ধোপাদের ছেলে হারু স্নান করতে গিয়ে দেখে একটা বাচ্চার দেহ দামে আটকে আছে। সবাই বলাবলি করে পুলিশ এসে ওঠাক। তবে বাচ্চা না হয়ে বড় সাইজের জামাপরা পুতুল হতেই পারে দু-একজন সন্দেহ জানালো। বড়রা দিদিদের বকে—“এই ছোট মেয়েরা সব বাড়ি যাও তো, আমরা দেখছি।”
ফেরত পথে সবাই একটু আড়াল হতে রামু ঘাসের ওপর বমি করে, লখা পিঠে হাত দিয়ে বলে—ও কিছু না, ভয় পাস না, পুতুল হবে কারও।
রামু বলে, “ঔর একদিন এসছিল। আমি বোলিনি তোকে। বাচ্চাটাকে যদি…”
অপরাধবোধে ঝিম মেরে বসে থাকে দুজনে, অন্ধকার আমগাছের তলায়।
রামু বলে “মা-কালীর দিব্যি, এবারে যদি বাচ্চাটা নিয়ে আসে হামি কিন্তু ছোড়ব না শালা হারামি কো।”
কিছুদিন পরেই লোকটা ধরা পড়ে তাদের হাতে, বাচ্চাটার সাথে অসভ্যতা করতে দেখেই রামু দৌড়ে লখাকে ডেকে আনে, দুজনের চেঁচানিতে লোকজন ছুটে আসে। কিন্ত লোকটার এত শক্তি, ওদের দুজনকে মেরে শুইয়ে দেয়। ভয়ে কাঁদতে থাকে বাচ্চাটা। পাড়ার লোকে জানতে চায় কি ঘটেছে?
লখারা গুছিয়ে বলার আগেই লোকটি জানায়, সে একটু পেচ্ছাপ করবে বলে বাইক দাঁড় করিয়ে ঝোপের দিকে গেছিল, এর মধ্যে এই দুই ছুঁচো বাচ্চাটার কাছে এসে মলেস্ট করবার চেষ্টা করে। মলেস্ট কি তা লখারা জানে না, দুজনে এতটাই হতবাক হয়ে যায় লোকটার মিথ্যা কথায় যে একটা শব্দও বেরোয় না মুখ থেকে।
কাত্তিকটির ফ্যাসানের পোশাক ও ইংরাজির বহরে কারও আর অবিশ্বাস করার জো থাকে না যে লখারাই দোষী। মেসের বাবুরাও বলে পুলিশে তাহলে খবর দেওয়া হোক, এত হিম্মত এই আশ্রিত হাভাতে ছোঁড়া ও ছোটজাত দারোয়ানের ব্যাটার, গালাগালি চড়-চাপড়ের বন্যা বয়ে যায়। বাংলাকে নিজের করে নেওয়া লখা জানতে পারে তারা খোট্টা, তাদের দেশ নাকি অন্য। শুধু উপেনঠাকুর দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মোছে।
পুলিশের কথায় লোকটার টনক নড়ে সে বলে—“আপনারা যা শাস্তি দেবার দিন, পুলিশ ডাকবেন না, এডোলেসেন্সে এসব ভুল হয়, বুঝিয়ে বলুন।”
সবাই বলাবলি করে কদিন আগে একটা কচি শিশুর দেহ ভেসে ওঠায় পুলিশ এল পাড়ায়, এখন আবার পুলিশ ডাকলে পাড়ার বদনাম, তার থেকে রামু আপাতত ঘরে বন্দী থাক কদিন, খাওয়া বন্ধ। আর লখার বাবাকে বলা হল লখাও যেন এখন ঘরে বন্দী থাকে; একপাও বাইরে দেখলে মার পড়বে আবার।
আপাতত এইমত শাস্তি বিধান শেষে পাড়ার সকলে ঘরে ফেরে।
পরদিন কাকভোরে লখার জানলায় টোকা পড়লে লখা দেখে রামু একটা বড় পোঁটলা নিয়ে দাঁড়িয়ে। ফিসফিসিয়ে বলে—“বাড়ি যাচ্চি, একদিন শির উঁচা করে ফিরব এখানেই, দেখে লিস।”
—কি ভাবে পালালি?
—উপেনঠাকুর খুলে দেল, রুপয়া ভি দেল রাস্তা মে খরচা করতে।
—প্রভাস-স্যর বাবাকে বলেছেন আমাকে একটা বোডিং স্কুলে পাঠাবে। স্পোর্ট কোটা আছে আমার, ওখানে খেলাধূলা ভালো হয়।
—পরিদিদির বাবা?
—হ্যাঁ, উনি আমাদের বিশ্বাস করেন, কিন্তু আর কেউ এখনো করে না, তাই যেতে হবে। তুই ভাগ রামু, দেশ ঘরে ভালো থাকবি।
অনেক অঘটন ঘটিয়ে লোকটার শয়তানি জানাজানি হয় একসময়, কোমরে দড়িও পড়ে। ভদ্রলোকেরা চুক চুক শব্দে আফসোস করেন। লখার মা-বাবা সঙ্কোচে লজ্জায় ততদিনে নানা অসুখ বাধিয়ে অকালেই অতিবৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল, এই কলঙ্কমোচনের খবর তার বাবা জেনে যেতে পেরেছিল, মা পারেননি। লখা শেষ এশহরে এসেছিল তার বাবার অন্ত্যেষ্টিতে। দাদা এরপর কলকাতায় কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিল, সেখানেই সংসার পাতে, দিদি বহু বছর অনেক দূরের শ্বশুরবাড়িতে নির্বাসিত। ফলে এই ছেলেবেলার মফস্বল হারিয়ে যায় লখার জীবন থেকে।
বহু বছর পর লছমন সিং স্পোর্ট টিচার হয়ে ফিরেছে এই শহরে। একটা কথা রাখার দায় ছিল তার। পুকুরপাড়ে খেজুরগাছের নীচে লখার দিবানিদ্রায় ছেদ পড়ে কচি গলার স্বরে, সে দেখে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে, গোলগাল ফর্সা কোঁকড়া চুল। চারপাশ ঘুরে ফিরে দেখে লখা, কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি, রামুকে তো স্বপ্নে দেখছিল, সে আবার সামনে দাঁড়িয়ে কিভাবে?
—আপনি কি ইস্কুলের নতুন গেম টিচার? প্রভাসস্যার খুঁজছেন, মোবাইল বাজছে না আপনার, আমাকে বললেন খুঁজে আনতে।
—তুমি কে?
—আমি ওই কোয়ার্টারে থাকি, আমার নাম কিশোরীলাল।
—বাবার নাম?
—রামদাস।
—আচ্ছা তুমি বুঝলে কী করে আমি কে?
—এমন জামাকাপড় পরে ব্যাগট্যাগ নিয়ে কেউ গাছে নীচে ঘুমোয়? তাই মনে হোলো।
—বাঃ বেশ বুদ্ধি তো তোমার। চলো তো দেখি, তোমার বাবার সঙ্গে একটু দেখা করি।
—বাবা না, প্রভাসস্যার ডাকছেন, হেডমাস্টার। বাবাকে কি বলবেন? আমার বাবা স্কুলের দারোয়ান।
—যাব তো হেডস্যারের কাছেই, আগে তোমার বাড়ি যাব কেমন?
লখা হতভম্ব বালকটিকে পরম স্নেহে একহাতে বেষ্টন করে হাঁটা লাগায়, তার কৈশোরের গন্ধমাখা দারোয়ান কোয়ার্টারের দিকে।
লখা ও রামু পরস্পরকে কথা দিয়েছিল—আবার দেখা হবে, এখানেই।