গোপালদা মাস দুয়েক আগে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার কথা জানাতে আমার বাড়িতে হঠাৎ হাজির হয়েছিলেন। পর পর বেশ কয়েক সপ্তাহ কিছু বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখে যারপরনাই চিন্তিত হয়ে উনি এক রবিবার সকালে বাড়ি খুঁজে খুঁজে আমার বাসায় হাজির হন।
গোপালদা আমার ঠিক বন্ধু নন, তবে আমার এক ছোটবেলার বন্ধু শুভর দাদা। গত কুড়ি বছর দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাটে বৌদি আর ছেলে তুতুনকে নিয়ে থাকেন। এ খবরটাও আমি শুভর থেকেই জেনেছি। আমিও বহু বছর কলকাতা নিবাসী। কিন্তু কলকাতায় থেকেও গোপালদার সাথে প্রায় কুড়ি বছর পর আমার সেদিন দেখা হলো।
শুভর দাদা গোপালদার সাথে আমার পরিচয় জামশেদপুরে। শুভ আর আমি প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত একসাথেই পড়াশোনা করেছি। প্রায়দিনই ওদের বাড়ি বিকেলে যেতাম। ওদের বাড়ির মাসিমা মানে শুভর মা, দিদি আর গোপালদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। অবশ্য এই পছন্দ করার পিছনে কেবল শুভর বন্ধু বলে নয়,অন্যএকটা কারণও ছিল।
ক্লাস ফাইভের শেষের দিক থেকেই আমি স্বপ্নবিশারদ হিসেবে পাড়ায় বেশ নামডাক করে ফেলেছিলাম। এর কৃতিত্ব কিন্তু আমার ঠাকুমাকে দিতে হয়। উনি রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে একেক দিন একেক স্বপ্নের কথা বলতেন,“বাবু আজ ভোর রাত্রে গরুর স্বপ্ন দেখেছি। দেখ তো কী তার মানে?"
অমনি আমি শ্রীকৃষ্ণ গুপ্তের বিশাল পঞ্জিকার শেষের দিকে বিজ্ঞাপনের মাঝে লেখা স্বপ্নবিশ্লেষণের পাতা খুলে ঠাকুমার দেখা স্বপ্ন নিয়ে গবেষণায় নামতাম।
“ঠাকুমা, কালো না সাদা গরু?"
“অত সব মনে নেই বাপু। স্বপ্ন আবার বেশিক্ষণ মনে থাকে না। তুই দুটোই দেখ।” ঠাকুমা উত্তর দিতেন।
“কিন্তু দুটো তো সম্পূর্ণ উল্টো। সাদা গরু দেখলে দিন ভালো যাবে, কালো গরুতে ঝগড়া, বাছুর দেখলে মুদ্রালাভ।” আমি গড়গড় করে বইয়ের লাইন ধরে পড়ে যাই।
দিনের পর দিন ঠাকুমার দেখা স্বপ্নের বিচার করতে করতে পুরো দুপাতার ক্ষুদি ক্ষুদি করে লেখা 'স্বপ্নবিশ্লেষণ' আমার মুখস্ত হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই পাড়াতে; বিশেষত মেয়ে মহলে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। পাড়াতুতো পিসি-মাসি-দিদিদের আবদার আসা শুরু হলো। স্বপ্ন কে না দেখে?কিন্তু সেই দেখা স্বপ্নের বিচার করতে তো সবাই পারে না। ওখানেই আমি সবাইকে টেক্কা মেরে দিলাম। সবাই আমাকে দিয়ে নিজেদের স্বপ্ন বিচার করাতে দুপুরবেলা মায়ের সাথে গল্প করার অছিলায় আসে অথবা আমাকে আমসত্বের বা কামরাঙ্গা খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে বাড়ি ডেকে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। সেসব বিচিত্র স্বপ্নের হালহাকিকত খুঁজতে খুঁজতে আমি মাঝে মাঝে দিশাহারা হয়ে যেতাম। কিছু কিছু স্বপ্ন তো আমার মুখস্ত বিদ্যার ধারেকাছে আসত না। কিন্তু তাও গম্ভীর হয়ে,মন দিয়ে শুনে কাছাকাছি একটা মিল খুঁজে বিধান দিতাম। কাঁচা মুখের পাকা বুলি শুনে সবাই খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়তো।
মনে মনে একটা অহংবোধ দেখা দিল যে সবাই আমার স্বপ্নবিচার খুব মন দিয়ে শোনে এবং বিশ্বাসও করে। কত ছেলে তো পড়াশোনায় ভালো, কেউ-বা গানে, কেউ খেলায়, কিন্তু আমার মতো স্বপ্ন বিশ্লেষণী ক্ষমতা সেইসময় একটা ছেলেরও ছিল না। লোকের মুখে মুখে আমায় সেই ক্ষমতার কথা এপাড়া-সেপাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো।
স্কুলের মিলনস্যার আমাদের ক্লাস-টিচার ছিলেন। ইতিহাস পড়াতেন। বাবর,হুমায়ুন,আকবর-কে কার ছেলে বা বাবা বা ঠাকুরদা সেটা আমার প্রায়ই গুলিয়ে যেত বলে মিলনস্যার আমার ওপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন। সেই মিলনস্যার আমাকে একদিন টিফিনের সময় টিচার্স রুমে ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে সেখানে গেলাম। অনেকেই বসে ঢুলছেন, কেউ টিফিন খাচ্ছেন, কেউ নস্যি নিচ্ছেন আবার কেউ দেখি খাতা দেখছেন। মিলনস্যার মুখে এক খিলি পান পুরে চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুই নাকি আজকাল মেয়েদের স্বপ্ন বিচার করছিস?"
“না তো স্যার। ছেলেদেরও করি।” আমি স্মার্ট উত্তর দি।
“কী করে শিখলি?"
“ওটা স্যার আমার এমনি এমনিই আসে। মনে হয় গতজন্ম থেকেই শিখেছি।" আমি আমার সিক্রেট না ভাঙার কৌশল সবে শিখেছি।
“গুল মারছিস?"
“না স্যার।"
“আমি রোজ রাত্রে স্বপ্ন দেখি খুব উঁচুতে উড়ে যাচ্ছি। কী হতে পারে রে?” মিলনস্যার ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন যাতে অন্য স্যারেরা শুনতে না পায়।
“এতো দারুন স্বপ্ন স্যার। আর কিছুদিনের মধ্যেই আপনি হেডস্যার হয়ে যাবেন।"
মিলনস্যার মুখে পান নিয়েই হেঁচকি খেলেন। পাশে রাখা টিনের ড্রামে পুচ করে পানের পিক ফেলে আশপাশে অন্য স্যারদের আড়চোখে দেখে নিয়ে মনে মনে বেজায় খুশি হয়ে বললেন, “হারামজাদা, বজ্জাত ছেলে, ভাগ এখান থেকে।”
আমি ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতে শুরু করলাম।
একবার শুভর বাড়িতে রবিবার সকালে বারান্দায় বসে ক্যারম খেলছি, শুভর দিদি এসে আমাকে চুপি চুপি ডেকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। শুভ পিছন পিছন আসতেই ওর গালে ঠাস করে এক চড় পড়লো।
“সবসময় বড়দের কথা শোনায় তোর এত ঝোঁক কেন?”শুভর দিদির সেই কথা শুনে প্রথম অনুভব করলাম যে আমি বয়সের তুলনায় বড়ো হয়ে গেছি। যাকে বলে পেকে গেছি। বড় হবার গর্ব অনুভব করার সাথে শুভটার জন্য দুঃখও হলো। বেচারা সকাল সকাল দিদির কাছে চড় হজম করলো।
“শোন, কাল রাত্রে না আমি একটা ছেলেকে স্বপ্নে দেখেছি। বেশ অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলেটাকে ধরতে গেলেই ও মরীচিকার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। এটার কী ব্যাখ্যা তুই দিবি?” ফ্রক পরা শুভর দিদি চোখ বড় বড় করে চিবুকের তলায় হাত রেখে বললো।
আমার সিলেবাসে এমন ঘটনার উল্লেখ নেই। কিন্তু আমি সিলেবাসের বাইরেও মাঝে মাঝে মনগড়া জবাব দি। সেগুলোই লোকের বেশি পছন্দ হয়। আমিও চিন্তা করলাম কী জবাব দিলে দিদি খুশি হবে।
একটু গম্ভীর থেকে বললাম “চেনা ছেলে, না অচেনা?"
“আরে, চেনা চেনা। পাশের পাড়ার সঞ্জীব। এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। ওর বাবার কেনা নতুন সাইকেলটা নিয়ে রোজ আমাদের বাড়ির সামনে চক্কর কাটে। খুব ভালো ছেলে রে, বুঝলি।"
“কী করে বুঝলে ভালো ছেলে?” আমি মনে মনে হেসে বললাম।
“শোন, জ্যাঠাগিরি করিস না। যা জিজ্ঞাসা করছি শুধু সেটুকু বল।” দিদি বেশ রেগে গেল আমার ওপর। দিদিরা চিরকালই বেশ রাগী হয়।
“স্বপ্নে যদি লাল বা বেগুনি জামা পরা ছেলে হয়, তবে ছেলেটা ভালো নাও হতে পারে, যদি নীল বা আকাশি জামা পরে তবে বিনয়ী, ভদ্র আর জামা না থাকলে--"
“থাক থাক আর তোকে পাকামি করতে হবে না।” বলে শুভর দিদি গটগট করে বাড়ির ভিতরে চলে গেল আর আমি আবার ক্যারম খেলায় ফিরে এলাম।
গোপালদার সাথে শুভদের বাড়িতেই আমার নিয়মিত দেখা হলেও স্বপ্ন নিয়ে প্রথম কথা হলো রাস্তায়। তখন সবে কলেজে ঢুকে গোপালদা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন। উনি এক বিভেদহীন সমাজের চিন্তায় নাকি মশগুল থাকতেন। এসব আমি শুভর কাছেই শুনেছিলাম কিন্তু বিভেদহীন সমাজ কী বস্তু সে বিষয়ে কিছু জানা ছিল না।
এহেন গোপালদা আমাকে একদিন রাস্তায় পাকড়াও করলেন। আমি তখন ক্লাবে ফুটবল খেলতে যাচ্ছি।
“তুই নাকি খুব ভালো স্বপ্ন বিশ্লেষণ করিস। তোকে কে শেখালো রে?” সাইকেলটা থামিয়ে ডান পা-টা মাটিতে রেখে গোপালদা জিজ্ঞাসা করলেন।
“ঠাকুমা।"
“বলিস কীরে। আমি না একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। তা তোর ঠাকুমার কাছে আমাকে নিয়ে যেতে পারবি?ওনাকে স্বপ্নটা সম্বন্ধে একটু জিজ্ঞাসা করতাম।” কথাটা শুনেই বুঝলাম গোপালদা আমাকে বিশ্বাস করেন না তাই বাচ্ছা ছেলের কাছে না শুনে বড়দের মুখে শুনতে চান।
“ঠাকুমা আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেছে। কালীপুজোর পর ফিরবে।” সেই ভরা গ্রীষ্মে এই কথা বলায় গোপালদা যারপরনাই দুঃখ পেলেন। আর উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে বললেন,
“ইয়ে মানে ব্যাপারটা একটু কমপ্লিকেটেড। তুই ছোট ছেলে কি আমাকে হেল্প করতে পারবি?"
“চেষ্টা করবো দাদা।” আমি বলি।
“বেশ, তাহলে শোন।” বলে উনি সাইকেল থেকে নেমে ডান হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে আমার পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলা শুরু করলেন।
“তুই লেনিন, স্ট্যালিনের নাম শুনেছিস?"
“এনারা কি ইংরেজি ফিল্ম করেন?” সত্যিই এনাদের সম্বন্ধে আমি অজ্ঞ; সেটা সরল মনেই বললাম। তখন মায়ের সাথে হলে গিয়ে দু-একটা বাংলা সিনেমা দেখেছি। আর দেখেছি পাড়ার ঠাকুরকাকার জোগাড় করা রিলের ফিল্ম আমাদের কোয়ার্টারের পিছনের মাঠে; সন্ধ্যার অন্ধকারে। একেকটা রিল শেষ হলে পাঁচ মিনিট লাগতো পরেরটা লাগাতে। সব সাদাকালো হিন্দি সিনেমা। ফিল্মের হিরো হিরোইনদের খুব ভালো লাগতো আমার। বাবা আবার এসব দেখা পছন্দ করতো না। সুতরাং আমি আর মাই পাড়া-বেপাড়ার বিড়িখেকো, খৈনিটেপা লোকেদের সাথে মাটিতে বসে সেসব দেখতাম। সেই হিসেবেই আমি শিশুসুলভ সরলতায় গোপালদাকে প্রশ্ন করেছিলাম।
গোপালদা আমার ওপর ক্ষুন্ন হয়েছিলেন কিনা জানিনা; তবে আমার বালখিল্য প্রশ্নে হেসে বলেছিলেন,
“দূর বোকা। এরা দুনিয়া কাঁপানো নেতা। আমি রোজ রাত্রে স্বপ্ন দেখি এনাদের দুজনের মাঝখানে স্টেজে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুলে ইনক্লাব জিন্দাবাদ বলছি আর লক্ষ লক্ষ লোক আমার সুরে সুর মিলিয়ে ইনক্লাব জিন্দাবাদ বলছে। এই স্বপ্নটার মানে কী হতে পারে বলে তোর মনে হয়?"
ছোটবেলা থেকেই আমি ফিচেল। একটা দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় খেটে গেল।
“দাদা, সাদা কালো না রঙিন স্বপ্ন?"
দাদা থমকে দাঁড়ালেন। আমি যে দ্রুততার সাথে এই স্বপ্ন বিচার শুরু করে দিতে পারি সেটা ওনার ধারণার অতীত।
“দাঁড়া, সেটা তো খেয়াল করিনি। তুই দুটো পসিবিলিটিই বল।"
“মাঝ রাতে না ভোর রাতে দেখা স্বপ্ন?"
গোপালদা বিস্মিত হয়ে সাইকেল দাঁড় করিয়ে আমার পুঁচকে চেহারাটা মাপতে লাগলেন। মনে হলো ভিতর ভিতর ভীষণ রেগে যাচ্ছেন।
“তুই দুটো পসিবিলিটিই বল।"
“ডান দিকে লেনিন না বাঁ-দিকে?”প্রশ্ন শুনে ভাইয়ের বন্ধুর ওপর ওনার ঘোর সন্দেহ দেখা দিল। ওদিকে স্বপ্ন বিশ্লেষণ শুনতে মনটাও উতলা। তাই বাধ্য হয়ে আবার বললেন,
“তুই দুটো পসিবিলিটিই বল।"
“না, ডান দিকে হলে একরকম, বাঁ-দিকে হলে অন্য ব্যাখ্যা হবে।"
“শোন, তুই না ছোটবয়সে বড্ড বেশি পেকে গেছিস। ভাইয়ের বন্ধু না হলে তোকে ঠাস করে জোরে একটা চড় কষাতাম।” এই বলে গোপালদা রাগে গরগর করতে করতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন। আর কোনোদিন স্বপ্ন নিয়ে গোপালদার সাথে কোনো কথা হয়নি।
বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। মাঝে গঙ্গা ভলগা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আমি স্বপ্ন বিশ্লেষণের লাইন ছেড়ে একরাশ স্বপ্ন ফেরি করে বেড়াই। হাঁ, আমি কলকাতার এক বড় প্রমোটারের কাছে মার্কেটিং-এর কাজ করি। লোককে নিজের সুন্দর নিরিবিলি ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখাই। কথা বলাটা আমার ভালোই আসে। কাস্টমারস্যার, ম্যাডামরা আমার কথায় স্বপ্নের জগতে পৌঁছে যান। আমিও মন জুগিয়ে কথা বলে ফ্ল্যাট বেচি। গুজরাটি প্রমোটার আমার ওপর বেজায় খুশি। ওনার একের পর এক প্রজেক্ট বেড়েই চলেছে আর আমারও পদোন্নতি হয়ে চলেছে।
সেই গোপালদা দীর্ঘদিন পর স্বপ্ন বিচারের আশায় আমার কলকাতার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হওয়ায় আমি চিন্তিত হয়ে উঠলাম। কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়তো। ছেলেবেলায় দেখা গোপালদাকে চেনা দায়। ভীষণ বুড়িয়ে গেছে। সারা মাথা সাদা উস্কোখুস্ক চুল। শরীরটা সামনে একটু ঝুঁকে পড়েছে। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। বাইরে থেকে চোখের মনিগুলো বড় বড় লাগে। আমারও মাথায় কাঁচাপাকা চুল আর মুখে সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। গোপালদার বাঁ-গালে আঁচিলটা দেখেই চিনেছিলাম। বললাম,
“গোপালদা যে। কতদিন পর আপনার সাথে দেখা হলো। সব খবর ভালো তো?"
“তোর কাছে একটা খুব জরুরি পরামর্শ নিতে এসেছি। ছোটবেলায় তুই স্বপ্নের খুব ভালো ব্যাখ্যা করতিস। আজকাল কি তুই সেই চর্চাটা চালিয়ে যাচ্ছিস?"
“না দাদা। সেসব ছোটবেলায় লোকের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে উল্টোপাল্টা বলতাম। কোনোটাই ঠিক নয়। ফ্রয়েডসাহেব একটা বই লিখেছিলেন 'ইন্টারপ্রেটেশন অফ ড্রিমস'। উনি সব স্বপ্নকেই বাথরুমের জানালা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। সব স্বপ্নই নাকি কামুক মনের ভাব। বহু স্বপ্নের উনি কোনো ব্যাখ্যা করে যেতে পারেননি। সেসব দেখে নিরাশ হয়ে আমি স্বপ্ন বিচারে আগ্রহ হারালাম।"
“কিন্তু আমার কেসটা একটু আলাদা। আমি ইদানিং প্রতি সোমবার যে স্বপ্ন দেখছি, বুধবার তা ঘটে যাচ্ছে।” গোপালদা খুব চিন্তিত মুখে বললেন।
“এটাকে বলে প্রেকগনিসন ড্রিম। স্বপ্ন হলো সত্যির মতো। তবে সাধারণত এগুলো সব দুঃস্বপ্ন হয়।” আমি বুঝিয়ে বলি।
“ঠিক বলেছিস। স্বপ্ন দেখলাম মোবাইলটা হারিয়ে গেছে, বুধবার মাছের বাজারে সেটা পকেটমারি হলো। একদিন স্বপ্নে দেখি তোর বৌদি পড়ে গেছে, পরের বুধবার সত্যি সত্যি তোর বৌদি পড়ে কোমরের হাড় ভাঙলো যা অপারেশন করতে একগুচ্ছ টাকা খরচ হলো। এক সোমবার স্বপ্ন দেখলাম তুতুনের চাকরির ইন্টারভিউয়ে হয়নি। ব্যাস দুদিন পর রিজেকসন মেল এসে গেল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি। কী করা যায় বল তো?"
“সোমবার রাত্রে কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে যান।” আমি বিধান দিলাম। গোপালদার সেটা মনঃপুত হলো কিনা বুঝলাম না।
তারপর প্রায় দুমাস কেটে গেছে। আমিও গোপালদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। সোমবার মাঝরাত্রি পেরিয়ে হঠাৎ শুভর ফোন পেয়ে ভীষণ চমকে উঠলাম। রীতিমতো ভয়ও লাগলো। চারিদিকে চেনাশোনা লোকজন পটপট মরে যাচ্ছে। গোপালদার কিছু হলো নাতো? কী সব দুঃস্বপ্ন দেখছিল, যেগুলো আবার সত্যিকারের ঘটেও যাচ্ছিল।
“শোন না, ভীষণ একটা জরুরি ব্যাপারে তোকে ফোন করছি। আমি কিছুতেই তোকে এই অসময়ে ফোন করতে চাইছিলাম না। কিন্তু গোপালদা একটু আগে আমাকে ফোন করে তোকে বার বার জানাতে অনুরোধ করেছে। গোপালদা প্রায় দুমাস অসুস্থ থাকার পর আজ সোমবার রাত্রে এক ভীষণ বাজে স্বপ্ন দেখে কান্নাকাটি করছে। বয়েস হয়েছে। ইমোশনগুলো চাপতে পারে না। তোকে বার বার ফোন করতে বলছে।” শুভর গলাটা উৎকণ্ঠিত শোনালো।
“গোপালদাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে।” আমি উপদেশ দিলাম।
“সে নয় হবে এখন। গোপালদা তোকে এত রাত্রেই দুঃস্বপ্নটা জানাতে বলেছে। যত সব বুড়ো বয়সের পাগলামি।"
“কী স্বপ্ন বলতো?”এবার আমি গোপালদার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নিজেকে নিয়ে কিছু খারাপ স্বপ্ন দেখলো নাকি।
“স্বপ্নে দেখেছে তুই নাকি মারা গেছিস।"