সায়ন্তনের ডাকনাম সান্তু। কোলকাতা থেকে একটু দূরে ওদের বাড়ি, সেখানে বাড়ির কাছের একটা ইস্কুলে পড়ে। তা পড়াশুনোয় খুব ভালো না হলেও মোটামুটি। টিউশন নেই, নিজে নিজে পড়েই পাশ করে যায়।
বাড়িতে তিনতলার ঘরে থাকেন সান্তুর জ্যাঠামশায়। একা মানুষ, ভীষণ রাশভারী। সান্তুর তো তিনতলার ঘরটায় ঢুকতেই ভয় করে। তবু বছরে দুবার আসতেই হয়। হাফ-ইয়ারলি আর বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোলে জ্যাঠামশায়কে সবকটা বিষয়ের নম্বর বলে আসা বাড়ির নিয়ম। যেমন এই ক্লাস এইটের হাফ-ইয়ারলির ফল বেরিয়েছে, সান্তু রেজাল্টের কাগজ হাতে নিয়ে এসেছে। জ্যাঠামশায় তখন আলবোলায় তামাক ভরে ভুরুক ভুরুক করে মৌতাত করছেন।
- বাংলা সাতচল্লিশ।
ভুরুক ভুরুক। তার মানে কিছু বলার নেই, পরেরটা বলো। জ্যাঠামশায় খুব কম কথা বলেন।
- ইংরেজি বিয়াল্লিশ।
ভুরুক ভুরুক।
- অঙ্ক বাষট্টি।
ভুরুক ভুরুক।
- ইতিহাস একান্ন।
ভুরুক ভুরুক।
- ভূগোল সাতানব্বই।
ভুরুক? শুধু জ্যাঠামশায় নন, সকলেই সান্তুর ভূগোলের নম্বর দেখে অবাক হয়ে যায়। এক-আধবার নয়, প্রত্যেকবার পঁচানব্বইএর ওপর নম্বর নিয়ে আসে। আসলে ভূগোল বিষয়টা সান্তুর ভীষণ ভালো লাগে। ক্লাস সিক্সে ভূগোল পড়াতে এলেন নবকিশোরবাবু। প্রথম দিন পড়াতে এসে বলেছিলেন, “অনেকে হয়তো তোমাদের বলবে যে ইংরেজি, বিজ্ঞান, অঙ্ক – এই বিষয়গুলো ভবিষ্যতে বেশি কাজে লাগবে, বাকি বিষয় ভালো করে না পড়লেও চলে। তা হয়তো সত্যি। কিন্তু কী জানো ভাই, এই পৃথিবীটা তো আমাদের বাড়ি। আর সে বাড়ি যে কত বিচিত্র কত অপরূপ তা আমাদের কল্পনার বাইরে! এই যে এত নদী, সমুদ্র, পাহাড়, মরুভূমি, শহর, বন্দর, রাজধানী – এসবের সঙ্গে একটা পরিচয় তো থাকতে হবে। এই পরিচয়টুকুই ভূগোল।”
নবকিশোরবাবু শান্ত প্রকৃতির মানুষ। বেশি জোরে কথা বলতেন না। তাঁর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল – যা পড়াতে যাচ্ছেন সে অঞ্চলের ম্যাপ কিছু না দেখেই বোর্ডে এঁকে ফেলতে পারতেন। তারপর বুঝিয়ে দিতেন কোথায় কোন দেশের সীমানা, কোন নদী কোন পথে সাগরে মিশেছে। ক্লাসের ছেলেরা কিছুই শুনত না, কেউ কাটাকুটি খেলত, কেউ গল্পের বই পড়ত। হ্যাঁ, হইচই করতে পারত না কারণ পাশেই ছিল হেডস্যারের ঘর।
সায়ন্তন কিন্তু একমনে শুনত। দেশ-বিদেশের কথা তার এত ভালো লাগত যে যা শুনত তাই মনে রয়ে যেত। বসফরাস প্রণালি কোন দুটো সমুদ্র জুড়েছে, সুয়েজ খাল যদি না কাটা হতো তাহলে জাহাজ কীরকম ঘুরপথে নিয়ে যেতে হতো অথবা কিলিমাঞ্জারো কোন দেশে এসবের জন্য সায়ন্তনের বই খোলার দরকারই পড়ত না।
ভূগোল ক্লাস এইট অবধি পড়ানো হতো। কিন্তু তার পরেও সান্তুর সঙ্গে ভূগোল স্যারের যোগাযোগ ছিল। নবকিশোরবাবু কখনো এরকম ভূগোলপ্রিয় ছাত্র পাননি, আর সান্তুরও কখনো কোনো বিষয় এত ভালো লাগেনি। নবকিশোর একা মানুষ, অতিসাধারণ জীবনযাত্রা। ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সে বাড়ি এক-কামরার বলে তাঁর অবশ্য কিছু আসে যায় না – মনের ভেতর যে গোটা পৃথিবীটা রয়েছে। আটলাস – মানে ম্যাপ বইটা সবসময় হাতের কাছে রাখেন। আঙ্গুল বুলিয়ে অনুভব করেন আলপস, রকি, আন্ডিজ, হিমালয়। কখনো চীন থেকে জাপান, জাপান থেকে আরো পুবদিকে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে মুচকি হেসে দেখেন পূর্ব কীরকম আমেরিকার তটে এসে পশ্চিম হয়ে যায়।
স্বল্প আয়ে দিন চলে নবকিশোরবাবুর। তবে ওনার মনে অভাব-অভিযোগের ব্যাপারটাই নেই। নিজের মনে থাকেন, কারুর সঙ্গে মেলামেশাও নেই তেমন।
দেখতে দেখতে সান্তুর ইস্কুলের দিন শেষ হলো, কলেজে ভর্তির পরীক্ষায় ভালো ফল করে ইনজিয়ারিং পড়তে গেল। তা ছুটিছাটায় বাড়ি এলে ভূগোল স্যারের সঙ্গে একবার অন্তত দেখা করতই।
ইনজিনিয়ারিং চার বছর পড়তে হয়। কিন্তু শেষের পরীক্ষা হবার আগেই কলেজে এক নামকরা কম্পিউটার কোম্পানি এসেছিল কিছু ছেলে-মেয়ে নিতে। জনা দশেকের ভেতরে সায়ন্তনকেও ওরা পাকা চাকরি দিয়ে দিল। পাশ করার পর চাকরিতে ঢুকে সায়ন্তন মাস ছয়েক কেবল এদেশে কাজ করেছিল। তারপর কোম্পানি ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিল। সেও আজ বছর পাঁচেক হয়ে গেল। দেশে আসা বছরে বড়জোর একবার। আর বিদেশে থাকলে পাঁচজনের বেলা যা হয় – বন্ধুবান্ধব, চেনাশোনাদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেকটাই কমে এল।
প্রতিবছর নবকিশোরবাবু আশা করে থাকতেন যদি সায়ন্তনের মতো আর দু-একটা ছাত্র পাওয়া যায়। নাঃ, তা কখনো হয়নি। এই করতে করতে নবকিশোরবাবুরও ইস্কুলের চাকরি শেষ হয়ে গেল। নবকিশোরবাবু অবসর নিয়েছেন গত বছর। পেনশনের আয় সামান্য বলে একটা বইএর দোকানে পার্ট-টাইম কাজ করেন।
ওই ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। বিশেষ কারো সঙ্গে আলাপসালাপ নেই। মাসের ভাড়াটা নিতে দোতলা থেকে বাড়ির মালিক মানে যাকে পাড়ার সকলে পিসীমা বলে, তিনি আসেন। পিসীমাই এসে যা দু-একটা কথা বলেন। সেবার বলেলন, “ওহে মাস্টার, তুমি এই চৌকোপানা পাতলা বইটা নিয়ে সারাদিন কী করো বলো তো? এটা কি ‘ছবিতে রামায়ণ’? রংচঙা ছবিছাবা রয়েছে তো মনে হচ্ছে।
নবকিশোরবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, “না পিসীমা না। ওটা আটলাস। মানে ম্যাপ বই। কোথায় কোন নদী-সাগর-পাহাড়, শহর-নগর আছে সব দেওয়া থাকে।”
--তা বাড়ি থেকে তো বেরোতে দেখি না। অত পাহাড়পর্বত নদীসাগরের খোঁজে তোমার কী কাজ?
--যাবার সামর্থ তো নেই, তাই বসে বসে দেখি। পিসীমা, এটাই আমার রামায়ণ, আমার মহাভারত …
পিসীমা হেসে বলেন, “তুমি বরং ভূতের রাজার খোঁজ করো। গুপিবাঘার মত একজোড়া নাগরাই-জুতো পেলে হুস করে যেখানে খুশি যেতে পারতে।” পিসীমার ঘরে সারাদিন টিভি চলে – গুপিবাঘার সিনেমাটা অনেকবার দেখা হয়ে গেছে।
তা কথাটা সত্যি। তিন-তিনটে বর নয় – ভূতের রাজার এই একটা বর পেলেই নবকিশোরবাবুকে আর দেখতে হতো না…।
ব্যাপারটা মাথায় ঢোকার পর থেকেই ভূতের রাজার গল্পটা আর তার সঙ্গে এদিক-ওদিক থেকে পড়া ভ্রমণ বৃত্তান্ত মিলেমিশে নানারকম রূপ নিয়ে তাঁর স্বপ্নে এসে হাজির হতো।
******
নবকিশোরবাবু শান্ত স্বভাবের মানুষ হলেও হঠাৎ ব্যস্ত পড়েছেন। পুরোনো পেতলের বাসন কিছু বিক্রি করে দিয়েছেন। খাটের তলায় লোহার বাক্সতে ওঁর মায়ের কটা সোনার গয়না ছিল। সেগুলো আর নিজের আংটিটা সোনার দোকানে গচ্ছিত রেখে টাকা ধার করেছেন। কাগজপত্র নিয়ে কোলকাতার আপিস-পাড়াতে কদিন যাতায়াত করছেন। ব্যাপারটা কী? ঘটিবাটি বিক্রি করে কলম্বাসের মতো অভিযান-টভিযানে বেরিয়ে পড়বেন নাকি!
কলম্বাসের মতো জাহাজ সাজিয়ে না হোক, তাপ্পি মারা একটা মাঝারি স্যুটকেস আর পিঠের ব্যাগ নিয়ে নবকিশোরবাবু বিকেলের দিকে স্টেশনে গেলেন হাওড়ার ট্রেন ধরতে।
হাওড়া পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। সন্ধেবেলাতেই রাত্তিরের খাওয়াটা একটা দোকানে সেরে নিয়ে চড়ে বসলেন একটা বাসে। হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা এয়ারপোর্ট যাবে।
এয়ারপোর্টে আগে কখনো আসেননি, তাই একটু ভয় ভয় করছিল। তবে সেরকম অসুবিধে কিছু হলো না। সবই তো লেখা রয়েছে। আর অন্য লোকেদের দেখেও তো বোঝা যায় কোনদিকে গিয়ে কী করতে হবে। রাত দুটোতে উড়ান মানে ফ্লাইট। যেতে হবে দুবাই।
উড়োজাহাজে এই প্রথম উঠলেন। কী সুন্দর! বাসের মতনই কিন্তু তার থেকে আরও অনেক বড় আর আরামের। প্লেন ছেড়ে দিল, জানালা দিয়ে নবকিশোর দেখলেন নিচে আলোর মালা পরা কোলকাতা শহর… কিছুক্ষণের মধ্যেই তা পেছনে রেখে অন্ধকারের রাজ্যে ঢুকে গেল উড়োজাহাজ। সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন তা মনেই নেই। ঝড়াংঝড়াং আওয়াজে সকালের দিকে ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলেন ছটা বাজে, কিন্তু বাইরে তো কালিঢালা অন্ধকার! কী ব্যাপার?
ও হো, নিজের বোকামিতে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল। প্লেন তো এখন ভারত পেরিয়ে আরব দেশের কাছাকছি। এখানে তো সকাল হবে দু-আড়াই ঘন্টা দেরি করে। দুবাই-সময় ভোর পাঁচটা নাগাদ উড়োজাহাজ দুবাইতে নামার কথা। এদিকে সামনে সকালের খাবার দিয়ে গেছে। কী সুন্দর দেখতে খাবারগুলো – খেয়ে কিন্তু বেশ নিরাশ হতে হলো। কীরকম যেন নুনকম, ঝালহীন, ফ্যাসফেসে ধরনের।
কোলকাতা-দুবাই যাত্রা বেশ ভালোই কাটল। প্লেন থেকে নেমে দুবাই এবারপোর্টের ভেতরে এসে তো নবকিশোরবাবু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। কী বড় আর কী সাজানো। এয়ারপোর্টের ভেতরে খেজুর গাছের সারি লাগিয়েছে, প্লাস্টিকের না কি? যাক গে। একটা বিরাট বড় বোর্ডে কোন বিমান কোন শহরে যাচ্ছে, কটায় ছাড়বে সব দেখা যায়। সেখানে ওপর থেকে নিচে দেখতে দেখতে একটা লাইনে খুঁজে পেলেন এবারের প্লেন কোথায় কখন ছাড়বে।
এইবারের উড়োজাহাজটা আরো বড়, আর আরো ভালো করে সাজানো। যাত্রীদের মধ্যে অনেক বিদেশী। তবে বেশ কিছু খালি জায়গা রয়েছে, সব আসন ভর্তি হয়নি। নটা নাগাদ ছাড়বে, প্রায় সতেরো ঘন্টা ওড়ার পর লস এঞ্জেলসে নামবে। তাহলে কটার সময় নামবে? শুধু ঘন্টা মিনিট যোগ করে দেখলে ডাহা ভুল হবে। কারণ অনেক দূরের শহর, সেখানকার ঘড়ি তো অন্য সময় ধরে চলে! পৌঁছোবে সেখানকার ঘড়িতে দুপুর দুটো নাগাদ। কী মজার ব্যাপার!
আর একটা অঙ্ক খুব কম লোকেই পারবে। যদি বলা হয়, আকাশপথে যেতে হলে সবচেয়ে কম সময় কী করে যাবে? বেশির ভাগ লোকেই একটা পৃথিবীর ম্যাপ পেতে নিয়ে দুবাই থেকে লস এঞ্জেলস অবধি স্কেল বসিয়ে পেনসিল দিয়ে দাগ কেটে বলবে – দুটি বিন্দুর মধ্যে সরলরেখাই সবথেকে ছোট রাস্তা। নবকিশোরবাবু মনে মনে একটু হাসলেন। সরলরেখাই শর্টকাট? দশে শূন্য।
এইজন্যই জানতে হবে ভূগোল। মানে ভূ গোল। মানে পৃথিবীটা তরমুজের মতো গোল। একটা গ্লোব – যাতে পৃথিবীর ম্যাপ আঁকা থাকে তার ওপর একটা সূতো ধরে ধরে দেখতে হবে কোন পথটা সব থেকে ছোট হচ্ছে। দেখা যাবে যে যাত্রাপথ সত্যিই ‘শর্টকাট’ তা ওই সরলরেখা থেকে একেবারে আলাদা। গোলকের ওপর সাধারণ জ্যামিতি কাজ করে না!
সব যাত্রীর জন্য একটা করে ছোট্ট টিভির বাক্স দেওয়া আছে … সেটাতে অনেক কিছু দেখা যায়। যেমন খবর, কারটুন, সিনেমা। তবে এক নম্বর চ্যানেলে যেটা দেখায়, নবকিশোরবাবু সেটা ছাড়া আর কিছু দেখতে চান না। উড়োজাহাজ কোন পথে চলেছে তা ম্যাপের ওপর দেখা যায়। আকাশে কোন রাস্তায় প্লেন যাবে তা দেখে তো নবকিশোরবাবু বলতে গেলে ‘রোমাঞ্চিত’ হয়ে পড়েছেন! যদিও মুখস্থ, তবু ম্যাপবইটাও হাতের কাছে রেখেছেন। আপাতত এখান থেকে উত্তরমুখো গিয়ে ইরান এবং তারপর রাশিয়ার পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে উড়বে। উচ্চতা অনেক, সে প্রায় তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট। তবু এখন তো টানা দিনের আলো পাওয়া যাবে। নবকিশোরবাবু পুজোআর্চার ধার ধারেন না তবে আজকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন – যেখান দিয়ে প্লেন যাবে সেখানকার আকাশে যেন আজ মেঘ না থাকে। উঁচু থেকে খানিকটা তো দেখা যাবে, বোঝাও নিশ্চয় যাবে।
পারস্য উপসাগরের এলাকা ছাড়িয়ে ইরানের ওপর দিয়ে চলছে উড়োজাহাজ। আকাশ কখনো পরিষ্কার কখনো মেঘলা … ম্যাপে একদিকে তেহেরান দেখাচ্ছে, জানালা দিয়ে চোখে পড়ছে পশ্চিম ইরানের পার্বত্য অঞ্চল। আহা, এবার ক্যাসপিয়ন সাগর আর কৃষ্ণ সাগরের মাঝখান দিয়ে রুশদেশের ওপর দিয়ে উড়ে যাবে প্লেন! কী দারুণ অভিজ্ঞতা!
টানা বসে থাকতে থাকতে গা-হাত-পা ধরে গিয়েছিল তাই সিট থেকে উঠে নবকিশোরবাবু দু-সারি সিটের মাঝের জায়গাটায় একটু হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন অনেকেই হয়তো তাঁর মতো আগ্রহ নিয়ে দেখছে আর ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু কোথায় কী! এ তো সেই ভূগোল ক্লাসেরই মতো। সেই ছেলেগুলোই যেন প্লেনে চড়ে বসে আছে! কেউ সিনেমা দেখছে, কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ গল্পের বই পড়ছে, কেউ ল্যাপটপে কাজ করছে।
নাঃ, পৃথিবীর মানুষের আর পৃথিবী নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই, জানার ইচ্ছেও নেই। সে যাকগে। তিনি এখন আর জানালা ছেড়ে উঠবেন না। খাবার এল, পানীয় এল। আরও কয়েক ঘন্টা কাটল।
উড়োজাহাজ এবার গ্রীনল্যান্ড পেছনে রেখে উত্তর মেরুর দিকে চলেছে। পাইলট এ নিয়ে কী যেন একটা বললেন। দু-একজন জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখছে। এখানে আকাশ খুব পরিষ্কার নয় তবে মাঝেসাঝে এক ঝলক নিচের সমুদ্র কিংবা ডাঙা দেখা যাচ্ছে। নবকিশোরবাবু মনে মনে চিৎকার করে বলে উঠলেন – উত্তর মেরু! উত্তর মেরুর ওপরে আমরা! মানে পৃথিবীর ঠিক মাথার ওপরে!! জীবন সার্থক হলো আজকে!
ম্যাপে দেখলেন বিমান এখন দক্ষিণ পানে ঘুরবে। কানাডা পেরিয়ে তারপর যাবে আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর। সেখানেই তো লস এঞ্জেলস।
নবকিশোরবাবুর মনের ভাবটা ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। অভিভূত বললে কমই বলা হয়। বর্ধমান কলেজে পড়েছেন আর কয়েকবার কোলকাতা গিয়েছেন। একবার ইস্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে বিষ্ণুপুর, আর সেই ছোটবেলায় বাড়ির সঙ্গে পুরী যাওয়া। ব্যস্। যদিও এতবছর ধরে এত ছেলেকে পৃথিবীর পাঠ দিয়েছেন, নিজের ঘোরা বলতে এইটুকুই। ইচ্ছে কি ছিল না? ইচ্ছে হয়তো ছিল কিন্তু সামর্থ কোথায়! আজ সেই মানুষ আকাশভ্রমণ করে যে ওপিঠের দেশ আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন, কী যে অদ্ভুত লাগছে…।
কানাডার ওপর দিয়ে বিমান চলেছে। নিচে ঘন মেঘ, কিছু দেখা যাচ্ছে না। চোখ বুঁজে ভাবছিলেন .. তা না যাক, পরে তো ঘোরা হবে। কানাডার নামকরা কতগুলো জায়গায় যাওয়ার কথা। দু-হপ্তার ছুটি। এদিকে ভ্যানকুভার ওদিকে নায়গারা। আর আমেরিকাও তো দেখা হবে। শিকাগোতে যাওয়ার আছে। কতবার উত্তর আমেরিকার পাঁচটা বড় হ্রদের কথা ভূগোল ক্লাসে পড়িয়েছেন। তার তিনটে দেখা হয়ে যাবে – নায়গারার দিকে গেলে ইরি আর অন্টারিও। এদিকে মিচিগান হ্রদের ধারেই তো শিকাগো শহর। বিমান নামবার সময় হয়ে এল … একটা ছোট্ট ঝটকা দিয়ে প্লেন আকাশ থেকে মাটিতে নামল। লস এঞ্জেলস।
এতো সুন্দর করে লিখে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে নেমে একটুও অসুবিধে হলো না। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখেন সায়ন্তন দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে এসে সে নবকিশোরবাবুকে প্রণাম করল আর উনি ছাত্রকে জড়িয়ে ধরলেন। দুজনেই খুশি। নবকিশোরবাবু ভাবছেন সারা জীবন যা পড়িয়ে এসেছেন সেই পৃথিবীর রূপ দেখার অবিশ্বাস্য সুযোগ করে দিয়েছে তাঁর প্রিয় ছাত্র। সে টিকিট করে না পাঠিয়ে দিলে তো কিছুই হতো না। পাসপোর্ট, দুদেশের ভিসা আর কটা ডলার কিনতেই তো ঘটিবাটি বিক্রি করতে হলো। সে যাক গে, আজ তাঁর মন ভরে গেছে কানায় কানায়। আর এদিকে সায়ন্তন ভাবছে – স্যার আমার ভেতর কত আগ্রহ কত কৌতূহল ভরে দিয়েছেন, কত কিছু শিখিয়েছেন! আজ স্যারকে সে যেটুকু দিতে পেরেছে তা স্যারের সত্যিই ভালো লেগেছে।
তবে লজ্জায় কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। কারণ দুজনেরই চোখে জল। মনপ্রাণ ছাপিয়ে আনন্দ হলে চোখে যে জল এসে যায়!