• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সত্যিকারের হ্যাংলা : অনন্যা দাশ

    দাদুর সঙ্গে দাদুর বন্ধু হেমুদাদুর বাড়িতে এসেছে পুকু। তার বয়স পাঁচ। হেমুদাদুর বাড়িতে নতুন একজনকে দেখতে পেল পুকু। সে সোফার ওপর বসে বসেই ঘুমোচ্ছিল।

    হেমুদাদুকে সে জিগ্যেস করেছিল, “ওটা কে হেমুদাদু?”

    “ওমা ওটা তো সাগ্নিক। ও অনেক দূর থেকে আকাশযানে করে এসে পৌঁছেছে গতকাল রাতে। এখন ওর জেট ল্যাগ চলছে তাই বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ছে!”

    পুকু আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখছিল এমন সময় নতুন লোকটা নড়েচড়ে বসল।

    পুকু তক্ষুনি ছুটে তার কাছে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, তুমি কি এলিয়েন?”

    ওর কথা শুনে বাকিরা সবাই হেসে ফেলল। লোকটাও হেসে চোখে একটা কালো চশমা গলিয়ে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে জিগ্যেস করল, “কেন তুমি ওই কথা বলছ বলো তো? আমাকে দেখে কি এলিয়েন বলে মনে হচ্ছে?”

    “না এলিয়েন বলে মনে হচ্ছে না, ওদের তো কিম্ভূত দেখতে হয় কিন্তু হেমুদাদু যে বললেন তুমি অনেক দূর থেকে আকাশযানে করে এসেছ। তা এলিয়ানরা তো ওইভাবেই আসে আমি দেখেছি কার্টুনে!”

    এদিকে দাদুর আরেক বন্ধু ছবিদাদুও তাঁর নাতনিকে নিয়ে এসেছেন। তার নাম তিতলি আর সে খুব পাকা মেয়ে। সে পুকুর চেয়ে এক বছরের বড়ো আর পুকুকে প্রায়ই ‘তুই কী বোকা রে’ বলে খেপায় তাই পুকুর ওকে একদম পছন্দ নয়। আজকেও তিতলি ওর কথা শুনে বলল, “পুকুটা বোকাই রয়ে গেল! এলিয়েন…হা হা!”

    দিদা মিষ্টি দিয়েছিলেন প্লেটে করে আর এলিয়েন লোকটা একসঙ্গে অনেকগুলো তুলে নিয়ে টপাটপ খেতে লাগল। তাই দেখে তিতলি বলে উঠল, “ওমা তুমি কী হ্যাংলা!”

    হেমুদাদু হেসে বললেন, “ও যেখানে থাকে সেখানে তো ওসব পায় না তাই!”

    এলিয়েন-সাগ্নিক কালো চশমা খুলে ফেলেছে। তার চোখ ছোটো ছোটো হয়ে গেছে। সে তিতলি আর পুকুকে বলল, “চলো আমার সঙ্গে, আমি তোমাদের সত্যি এলিয়েনদের গল্প বলব। তোমরা গল্প শুনতে ভালোবাসো?”

    পুকুর যে একটু ভয়ভয় করছিল না তা নয়, কিন্তু গল্প শুনতে সে খুবই ভালোবাসে। দাদুকে সারাদিন বিরক্ত করে গল্প শোনার জন্যে। তিতলিও নাকি গল্প শুনতে ভালোবাসে তাই দাদুরা বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও, সাগ্নিক দারুণ গল্প বলতে পারে। ওর কাছে গল্প শুনে এসো, আমরা ততক্ষণ নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করি!”

    ওদের ছাদে নিয়ে গিয়ে এলিয়েন-সাগ্নিক বলতে শুরু করল, “এই গল্পটা তোমাদের মতন দুটো ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ের। ছেলেটার নাম রিও আর মেয়েটার নাম পিঙ্কি। ওরা অবশ্য ভাইবোন।“

    তিতলি তাই শুনে ফট করে বলল, “আমার মামাতো দিদির নাম পিঙ্কি!”

    এলিয়েন-সাগ্নিক বলল, “আচ্ছা, তা গল্পটা শুনবে কিনা বলো?”

    পুকু আর তিতলি দুজনেই “হ্যাঁ, হ্যাঁ” বলতে আবার শুরু করল সে।

    “তা গতবার যখন এসেছিলাম তখন তোমাদের মত রিও আর পিঙ্কি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমি সেবারেও হামড়ে পড়ে মিষ্টি খাচ্ছিলাম আর তাই দেখে রিও বলে উঠল, ‘উফ তুমি কী হ্যাংলা রে বাবা’। তখনই ঠিক করলাম যে পাথরটা ওদের দেব। ওরা বাড়ি যাওয়ার সময় রিওকে ডেকে পাথরটা ওর হাতে দিয়ে দিলাম। ও না নিলেও পারত কিন্তু পাথরটার এমন সুন্দর রঙ যে ও না করতে পারল না! বেশ গাঢ় একটা সবুজ রঙ।

    পিঙ্কি রিওকে বলল, ‘তুই নিলি কেন পাথরটা? তুই ওকে হ্যাংলা বললি আর তার বদলে ও তোকে গিফট দিল মানে কিছু একটা গন্ডগোল বুঝতে পারছিস না?’

    রিও বলল, ‘কী সুন্দর রঙ পাথরটার, আমি না বলতে পারলাম না! আর ও অতগুলো মিষ্টি খাচ্ছিল তাই হ্যাংলা বললাম!’

    ‘তোকে কতবার বলেছি ওই রকম মুখের ওপর কথা বলবি না, কারো নিন্দে করিস না, তা তুই শুনবি কেন। যাই হোক পাথরটা বাগানেই রেখে দে। বাড়িতে নিয়ে গেলে মা বকবে!’

    পিঙ্কির কথায় রিও সবুজ পাথরটাকে বাগানেই রেখে দিল।

    পরদিন মামার শরীর খারাপ বলে মা-বাবা পিঙ্কি আর রিওকে সুরেখামাসির কাছে রেখে মামাকে দেখতে গেলেন, পরের দিন ফিরবেন বলে গেলেন।

    ওদের খাওয়াদাওয়া সব হয়ে গেছে এমন সময় রাতেরবেলা কেউ এসে কলিং বেল বাজালো। মা অনেকবার বলেছেন যে কে এসেছে ঠিক মতন না দেখে দরজা খুলবে না কিন্তু রিও কিছু মনে না রেখে দুম করে দরজা খুলে ফেলল। অমনি হুড়মুড় করে দুজন বেঁটেখাটো অদ্ভুত দেখতে আর কিম্ভূত সবুজ পোশাক পরা লোক ঘরের ভেতর ঢুকে এল।

    সুরেখামাসি তো তাদের দেখেই হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘তোমরা কে গো? কী চাও?’

    লোক দুটো বলল, ‘আমাদের এখানে ডাকা হয়েছে তাই আমরা এসেছি!’

    মাসি শুনে বলল, ‘ও দাদা বুঝি তোমাদের ডেকেছেন। তা আমাকে তো কিছু বলেননি। আর দাদা তো বাড়ি নেই।‘

    লোকগুলো বলল, ‘সে-সব জানি না। এখন আমাদের খুব খিদে পেয়েছে, কিছু না খেয়ে কোন কথা বলা যাবে না।‘

    বাবার অফিস থেকে মাঝে মাঝেই লোকজন আসে তাই সেটা নতুন কিছু নয়।

    ওদের রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছিলল বলে মাসি গজ গজ করতে করতে খাবার আনতে গেল। পিঙ্কি আর রিওর অবশ্য প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল ওই লোক দুটো বাবার অফিসের লোক নয়। ওদের ভালো করে দেখতে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হল। কেমন একটা সবুজ সবুজ গায়ের রঙ ওদের। কানগুলো ছুঁচলো মতন।

    রিও বলল, ‘দিদি, মনে হচ্ছে ওরা এলিয়েন! বন্ধুদের বললে দারুণ মজা পাবে!’

    এদিকে লোকগুলো ওদের বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ফুলদানিতে রাখা ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল দেখে ওদের একজন ফুলগুলোতে হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতেই সেগুলো একেবারে টাটকা হয়ে গেল। মেঝের একটা টাইল ভাঙ্গা ছিল, সেটাতে ওরা হাত দিতেই সেটার ফাটল মিলিয়ে গেল।

    রিও বলল, “তোমরা বুঝি ম্যাজিক জানো?’

    লোকদুটো মাথা নেড়ে বলল, ‘না, না, আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে এইসব যে কেউ করতে পারে। ওখানে সব ভালো কিন্তু তোমাদের এখানকার মতন খাবার ওখানে পাওয়া যায় না। কেবল বড়ি আর ক্যাপসুল। সেইসব খেয়ে কোন মজা নেই। সেই জন্যেই আমাদের এখানে আসতে হয়। তা এত দেরি হচ্ছে কেন খাবার আসতে?’

    মাসি খাবার আনতেই ওরা দুজন খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে সব খাবার শেষ! তারপর ওরা টিভির সামনে সোফায় বসে পড়ল। ওদের একজন বলল, ‘তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার দেখা হবে।‘

    রিওর তো বেশ মজা লাগছিল কিন্তু পিঙ্কি বলল, ‘জানি না বাবা, আমার কেমন জানি ভয় ভয় করছে!’

    পরদিন সকালে মাসির চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল ওদের। মাসি হাঁউমাঁউ করে বলতে লাগল, ‘ওরা দুজনে মিলে বাড়িতে যা খাবার ছিল সব খেয়ে ফেলেছে। ফ্রিজে কিছু নেই। রান্না করা খাবার, কাঁচা সবজি সব হাওয়া। বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি ইত্যাদি যা ছিল সব শেষ। দাদা বউদি তো আমাকে টাকাও দিয়ে যায়নি বাজারের জন্যে! এবার কী হবে?’

    পিঙ্কি সব শুনে বলল, ‘ঠিক আছে আমার কাছে কিছু টাকা আছে সেটাই দিচ্ছি তোমায়। দিদা জামা কেনার জন্যে দিয়েছিলেন। বাজার থেকে সবজি কিনে নিয়ে এসো। কিছু তো খেতে হবে!’

    যাদের জন্যে এত কাণ্ড তারা ঘুমোচ্ছিল। একটু পরে উঠে বলল, ‘আজ তো রবিবার, তোমাদের বাড়িতে লুচিটুচি হয় না?”

    পিঙ্কি মুখ ব্যজার করে বলল, ‘লুচির সঙ্গে তরকারি যে হবে তার জন্যে তো কিছুই আস্ত রাখোনি তোমরা। শুধু লুচি খাওয়া যায় নাকি?’

    লোকগুলো লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ‘মাঝরাতে খুব খিদে পেয়ে গেল যে! আর খিদে পেলে আমরা আবার ঘুমোতে পারি না!’

    সুরেখামাসি বাজার করে ফিরে এসে লুচি ভাজল। রিও আর পিঙ্কি যতক্ষণে একটা করে লুচি খেতে পেরেছে ততক্ষণে ঐ দুজনে মিলে সব কটা লুচি আর সব তরকারি শেষ করে ফেলল!

    রিও এবার রেগে গিয়ে বলল, ‘কী হ্যাংলা রে বাবা!’

    পিঙ্কি গম্ভীর মুখে বলল, ‘তুই সাগ্নিকদাকে হ্যাংলা বলেছিলি তাই দাদা সত্যিকারের দুই হ্যাংলাকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে!’

    ‘কী হবে তাহলে?’

    ‘সাগ্নিকদার কাছে ক্ষমা চেয়ে ওই পাথরটা ফিরিয়ে দিতে হবে, আবার কী।‘

    দুজনে বাইরে বাগানে পাথরটার কাছে গেছে এমন সময় সুরেখামাসি এসে বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে! আমি দুপুরের রান্না সেরে স্নানে গিয়েছিলাম আর সেই ফাঁকে ওরা দুজন সব খেয়ে ফেলেছে। আমি আর পারছি না রান্না করতে।‘

    পিঙ্কি বলল, ‘তুমি ভেব না মাসি। এই পাথরটাই যত নষ্টের গোড়া। রিও সরি বলে এটা সাগ্নিকদাকে ফিরিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।‘”

    এতটা বলে থেমে গেল এলিয়েন-সাগ্নিক।

    পকেট থেকে একটা সবুজ পাথর বার করে বলল, “রিও সরি বলে এটা ফেরত দেওয়ার পর থেকে আমার কাছেই রয়েছে এটা। কী তিতলি নেবে নাকি সবুজ পাথরটাকে? তাহলেই বুঝতে পারবে হ্যাংলা কাকে বলে আর বোকা কাকে বলে!”

    তিতলি তো পাথরটাকে দেখে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে ছুটল। পুকু হাঁ করে ওর মুখের চেয়ে রয়েছে দেখে এলিয়েন-সাগ্নিক চোখ টিপে বলল, “ওকে একটু শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিল। এবার তুমি আর আমি নিশ্চিন্তে বসে চকোলেট খেতে খেতে গল্প করতে পারব।“



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments