জীবন আর প্রকৃতি পরিবেশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রত্যক্ষ পরোক্ষ দু ভাবেই জীবনে প্রকৃতির, পরিবেশের প্রভাব অমোঘ। জীবন সর্দারের সঙ্গে সন্দেশ-এর সম্পর্ক প্রায় গোড়া থেকেই এই সূত্রেই। উনি বলতেন, বড় হয়ে আমরা অনেকেই এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করি; ছোটবেলা থেকেই এই সত্যিটা যদি মনে বুনে দেওয়া যায়, ছোটদের বুকে যদি প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা যায়, তাহলে পৃথিবী অনেক বেশি সুন্দর, নির্মল, বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেশ পত্রিকার তৃতীয় পর্যায়ের শুরুতেই (১৯৬১) ছোটদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করার কথা ভাবেন দুই সম্পাদক সত্যজিৎ রায় আর সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যেমন ভাবনা, তেমনই তার জন্য উদ্যোগ। প্রকৃতি সম্পর্কিত বিভাগের পরিকল্পনা করলেন। বিভাগের রূপরেখার খসড়া তৈরিতে বেশ কিছুদিন গেল। ওঁরা প্রকৃতি সম্পর্কিত লেখা আহ্বান করলেন। ১৯৬২-তে, পত্রিকার ২য় বর্ষেই এক তরুণের জমা দেওয়া প্রজাপতি নিয়ে সহজ ভাষায় দারুণ সাহিত্যগুণসম্পন্ন লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হলেন সম্পাদকদ্বয়। ডেকে পাঠান সেই তরুণ সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তার প্রকৃতির প্রতিটি দিককে সহজভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা দেখে সিদ্ধান্ত নেন, প্রকৃতি সম্পর্কিত বিভাগের দায়িত্ব সুনীলের হাতে দেওয়ার। আরম্ভ হয় 'প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর'। বিভাগের লোগো এঁকে দেন অমল (চক্রবর্তী)। সুনীলের বন্ধু কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে সুনীলের জন্য নাম চয়ন করেন — 'জীবন সর্দার'।
এই প্রকৃতিনিবেদিতপ্রাণ মানুষটার জন্ম ঢাকা বিক্রমপুরে ১৯৩৫ (মতান্তরে ১৯৩৩) সালে। প্রাথমিক শিক্ষা সেখানে হলেও পরবর্তীতে শিক্ষাজীবন কলকাতার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যার গোড়াপত্তন শিয়ালদহের মিত্র ইন্সটিটিউটে। প্রথম থেকেই পোকামাকড়, ফুলপাতা, প্রজাপতি পাখি, গাছপালার বৈচিত্র্যময় জগতের প্রতি আকর্ষণ ছিল তাঁর।
১৯৪৮-এ বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কিংবদন্তী প্রকৃতিবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের সান্নিধ্যে এসে প্রকৃতি ওঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরশিক্ষায় নিজের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন।
সন্দেশ ছাড়াও জ্ঞান বিজ্ঞান, কিশোর বিজ্ঞানী পত্রিকার সঙ্গেও আজীবন জড়িত ছিলেন। জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম ছিলেন; কিশোর বিজ্ঞানী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন শেষদিন পর্যন্ত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের আজীবন সদস্য ছিলেন। বঙ্গীয় বিজ্ঞান মঞ্চও ওঁর সক্রিয় উপস্থিতির সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
কিশোর বয়সে খগেন্দ্রনাথ মিত্র সম্পাদিত 'কিশোর' পত্রিকায় ওঁর লেখালিখি শুরু। উনি এবং অন্যান্য বিজ্ঞানবেত্তারা অনুভব করছিলেন মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের বই না থাকায় বাঙালিদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। বিজ্ঞানের, বিশেষত পরিবেশ বিজ্ঞানের সঙ্গে সাধারণ বাঙালিকে যুক্ত করতে গেলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালিখি প্রয়োজন। সেই অভাব পুরণ করতেই ১৯৯১ সালে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরামর্শে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে ব্রতী হন উনি। তাঁর এই নিরলস প্রয়াসের জন্য জীবন সর্দার (সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে 'গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার' ও বঙ্গীয় বিজ্ঞানপরিষদের তরফে 'রামেন্দ্রসুন্দর স্মৃতি পুরস্কার'-এ ভূষিত হয়েছেন। আজীবন বিজ্ঞান বিজ্ঞানের সেবা করার জন্য সরকার তাঁকে দিয়েছেন মানপত্র। এসব কথা সুনীলদা কখনোই বলতেন না; অন্যদের মুখ থেকেই জেনেছি আমরা; আর খানিকটা বৌদির মুখ থেকে।
সন্দেশের শতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসেবে 'সন্দেশ ১০০' তথ্যচিত্র তৈরি করেছিল কয়েকজন সন্দেশী তরুণ। সেই উপলক্ষ্যে নেওয়া সাক্ষাৎকারে সন্দেশে আসার আর তার পরে প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর পরিচালনার কিছু কথা বলেছিলেন। তার অধিকাংশটা জুড়েই ছিল প্রকৃতি আর তার গুরুত্বের কথা, তাকে রক্ষা করায় আমাদের ভূমিকার কথা।
কখনও অন্য সন্দেশীদের সঙ্গে, কখনও একা ওঁর বাড়ি গিয়েছি, কখনও বসার ঘরে, কখনও শোবার ঘরে, আবার কখনও ব্যালকনিতে বসত আমাদের আড্ডা, যার মূল বিষয় হতো সন্দেশ আর প্রকৃতি। আমাদের হাজারো প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতেন গল্প করে, উদাহরণ দিয়ে। বার কয়েক হাসপাতাল, নার্সিংহোম ঘুরে আসার পর ব্যালকনিটাই ছিল ওঁর প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ করার জায়গা।
শেষদিকে ৯০ বছর বয়সে একসময় যখন বিছানা ছেড়ে উঠতে অন্যের সাহায্য লাগত, তখনও সুযোগ পেলেই এসে বসতেন ব্যালকনির আরামকেদারায়। মাসখানেক আগেই যখন গিয়েছিলাম, আরামকেদারায় বসে বললেন, 'দেখ, নিজে নিজেই হেঁটে এসেছি।' চাইছিলেন আবার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। আবার পড়ে গেলেন, চোট লাগল মাথায়, পাঁজরায়, আবার যেতে হলো হাসপাতালে। বাড়ি ফিরে পত্রপত্রিকা, বিশেষ করে সন্দেশ আর বইগুলোকেই সঙ্গী করে নিলেন। কিছুদিন পর ওঁর মতো সজীব মানুষকে এমন নির্জীব হয়ে পড়ে থাকতে দেখে খুব কষ্ট হলো। বৌদি জানালেন — আগের থেকে একটু ভালো বোধ করছেন সুনীলদা। এরপর আর যাওয়া হলো না ওঁর সঙ্গে গল্প করতে। ওঁর স্মৃতি আর ওঁর বইগুলোর মধ্যেই এখন ওঁকে খুঁজে নিতে হবে আমার দ্রোণাচার্য জীবন সর্দারকে।
সংসার সম্পর্কিত বিষয় পুরোটাই ছিল বৌদির জিম্মায়। নিঃসন্তান দাদার সংসারে বাড়ির বাইরের কাজে বৌদির সহায় ছিলেন ওঁর অবিবাহিত ছোট দেওর। ওঁদের ভরসাতেই সুনীলদা মনপ্রাণ সঁপে দিতে পেরেছিলেন প্রকৃতিচর্চায়।
শারীরিক কারণে যখন প্রত্যক্ষভাবে ওঁর অগণিত গুণমুগ্ধ শিষ্যশিষ্যার কাছে পৌঁছনো আর সম্ভব হচ্ছিল না, ফোন ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর শিক্ষা বিতরণ চালিয়ে গিয়েছেন, বিভিন্ন বিজ্ঞানমঞ্চের, বিজ্ঞানপত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছেন ওঁর সুচিন্তিত লেখা দিয়ে। শারীরিক কষ্টও লেখালিখির থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। আমৃত্যু তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞান চর্চার প্রসারে ব্রতী ছিলেন। মৃত্যুর দু দিন আগে ওঁর হাতে পৌঁছেছিল সন্দেশ-এর মে ২০২৫ সংখ্যাটি, যাতে ছাপা হয়েছিল ওঁর শেষ রচনা 'ঘাসের পিঠে হাত বুলিয়ে'। ওঁর এই নিরলস বিজ্ঞানসেবার পিছনে ওঁর স্ত্রীর নীরব সমর্থনের বিশাল অবদান রয়েছে, এটা তো সবাই জানে।
এমন এক প্রকৃতিগতপ্রাণ মানুষের প্রয়াণে প্রকৃতিপ্রেমী জগতে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তবে, আশার কথা, ওঁর শিষ্যরা ওঁর বিজ্ঞান, বিশেষত পরিবেশ বিজ্ঞানের প্রসারের ধ্বজা বয়ে নিয়ে যেতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা এইটুকু আশা করতেই পারি, ওঁর অবর্তমানে প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে নীরব আন্দোলন ভবিষ্যতেও জারি থাকবে। চলে গিয়েও আছেন জীবন সর্দার।