ডা. হৈমবতী সেন-এর জীবনকথা-- প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায়; সাহিত্য সংসদ, কলকাতা- ৯; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৯; ISBN 978-81-938062-1-0
মেডিক্যাল কলেজে পড়তে চেয়ে এক দরখাস্ত এসেছে।
সে তো অমন অনেক আসে, এতে আর আশ্চর্য কী?
না, আশ্চর্য আছে, কারণ এই আবেদনকারী এক নারী, এবং সময়টা ১৮৪০-এর দশক। এবং ঐ ডাক্তারিস্কুলটি নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।
এবং আরো আশ্চর্য এই যে, ঐ কলেজ সম্মতি দিয়েছিল মেয়েটির আবেদনে।
এতেই বা আশ্চর্য কী?
আশ্চর্য নয়? কারণ ঐ প্রথম এক নারী ডাক্তারি-ডিগ্রি পড়তে ঢুকলো, এবং পাঁচ বছর পরে পৃথিবীর প্রথম পাশ করা নারী-ডাক্তার হয়ে বেরোল!
এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েল (১৮২১-১৯১০ খ্রি.), যিনি এর আগে একাধিক মেডিক্যাল স্কুলে পড়ার আবেদন করে প্রত্যাখ্যানই মাত্র পেয়েছিলেন।
তাহলে কি নিউ ইয়র্কের ঐ ‘জেনেভা মেডিক্যাল কলেজ’ মস্ত উদারতার পরিচয় দিয়েছিল প্রথম নারী-ছাত্রীকে স্বাগত জানিয়ে?
না, ব্ল্যাকওয়েলের জীবনীকার লিখছেন, ঐ ডাক্তারিস্কুলের ছাত্ররা বেশ একটা ‘মজা দেখার জন্যে’ মেয়েটিকে ক্লাসে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল, এবং পুরো পাঁচ-পাঁচটা বছর ধরে নানাভাবে তাকে উত্যক্ত করে গিয়েছিল।
পরে এলিজাবেথ যখন ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছেন এক নামি জার্নালে টাইফয়েড নিয়ে লিখলেন এক প্রবন্ধ, তাতে রোগক্লিষ্টতার সাথে সাথে সামাজিক অনাচারের প্রসঙ্গও এসে গিয়েছিল বলে পুং-ডাক্তারগণ সেটিকে ‘মেয়েলি লেখা’ বলে তুচ্ছ করেছিল।
ভারতে আসা যাক্:
খুলনা থেকে কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে ডাক্তারি পড়তে এসেছে এক বালবিধবা। ব্রাহ্ম। বাঘা বাঘা দেশী-বিদেশী ডাক্তারদের সামনে ভাইভা ও প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা দিয়ে ফাইনালে ফার্স্ট হল সে! গোল্ড মেডাল সে-ই পাবে। গর্জে উঠল ক্লাসের ছাত্রদল! একটা মেয়েকে সোনা দেওয়া হলে ধর্ণায় বসব আমরা। বসলো-ও। চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করল কলেজে। কাগজে খবর ছেপে বেরোল। পুলিশ ডাকে ডাকে এমন অবস্থা। মনে রাখবেন পাঠক, সময়কালটা কোনো নকশাল আন্দোলনের নয়। ১৮৯৫ খ্রি.। ঘোর ব্রিটিশ আমল।
ইনি ডাঃ হৈমবতী সেন (১৮৬৬-১৯৩৩ খ্রি.); ভারতের প্রথম কোয়ালিফায়েড প্রাক্টিসিং মহিলা-ডাক্তার প্রবাদপ্রতিম কাদম্বিনী গাঙ্গুলী (১৮৬১-১৯২৩ খ্রি.)-র চাইতে বয়সে মাত্র পাঁচ বছরের কনিষ্ঠা।
এর পরে ডাঃ হৈমবতী যখন কলকাতার কাছেই চুঁচুড়াতে জমিয়ে প্রাকটিস করছেন, তাঁর সহকর্মী পুং-ডাক্তার নানাভাবে নিপীড়ন করেছেন তাঁকে, যৌন হেনস্থা পর্যন্ত! তাকে, অবিশ্যি, আদালতে টেনে এনে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন হৈম। হেরে যেতেন কেবল তাঁর (দ্বিতীয়) স্বামীর কাছে। ব্রাহ্মধর্মের এক প্রচারক কুঞ্জবিহারী সেন, যাঁর একটি আধলা উপার্জনের মুরোদ না থাকলেও তম্বি করতেন স্ত্রীর উপরে, তাঁর রোজগারের সব টাকা কেড়ে নিতেন। কাজের মধ্যে, আটবার গর্ভবতী করেন স্ত্রী হৈমবতীকে।
সংগ্রাম কোন্ স্তরের হতে পারে, শিক্ষার প্রতি কায়মনোবাক্যতার উচ্চতম উদাহরণ কী--এ’সব জানতে পড়তে হবে এ’বই। হৈমবতীর এই জীবনীগ্রন্থ পড়তে পড়তে তাই মনে হয়ে যেন এক ধর্মগ্রন্থ পড়ছি, কারণ, মনে করি, যেকোনো ধর্মগ্রন্থের প্রধান লক্ষ্য মানুষের মনে বল জোগানো, প্রতিবন্ধকতার সামনে ভেঙে না পড়তে শেখানো।
এ’বইটি, অবশ্য, আদতে লেখা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায়ঃ ‘The memoirs of Dr Haimabati Sen’, যেখানির একটি অতি-সুখপাঠ্য ভাবানুবাদ করে আম-বাঙালির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন শ্রী প্রবীর গঙ্গোপাধ্যায় (হ্যাঁ, ভাবানুবাদ। ওঁর নামটিও ‘অনুবাদক’ নয়, ‘লেখক’-এর ঢঙে ছাপা হয়েছে এখানে)। অতি খেটে করেছেন কাজটি, অতি যত্নে। হৈমবতী ছাড়াও সমকালীন আরও আরও মহিলা-ডাক্তার এসেছেন কথাপ্রসঙ্গেঃ হেমাঙ্গিনী মজুমদার, নিস্তারিণী চক্রবর্তী, প্রিয়বালা গুহ, সুরমা দাশগুপ্ত, স্বর্ণলতা মিত্র, ইদিন্নেসা মুসাম্মত বিবি, কাদম্বিনী ব্যানার্জি, সুশীলা দেবী।
ত্রিশ বছর আগে পড়া এই গোত্রের এক বাংলাগ্রন্থকে আজও মাথায় করে রাখিঃ মহিলা ডাক্তারঃ ভিন গ্রহের বাসিন্দা (চিত্রা দেব)।
তার পাশে স্থায়ী আসন লাভ করল এই বইটি।
আমার আনন্দ কথা-- দীপংকর চক্রবর্তী; লা স্ত্রাদা, কলকাতা ৯২; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৫; ISBN 978-81-981823-0-2
‘চৌধুরী’ বানানটা ঠিক, না ‘চৌধুরি’?
আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এক কবি বাংলা বানানের যে নিদান দিয়েছিলেন তাতে দ্বিতীয়টি ঠিক।
কে বললে, ঠিক?
ফুঁসে উঠলেন ততোধিক বড় এক ঔপন্যাসিক, কারণ তিনি নিজনামে প্রথম বানানটি লেখেন।
ঢোঁক গিলে কবি নতুন নিদান দিলেন যে ঐ বিখ্যাত উপন্যাসকার চাইলে ‘চৌধুরী’ লিখতে পারবেন।
তাতে সংস্থার অন্য চৌধুরীরা গোঁসা করলেন। আমরা কি তবে বানের জলে ভেসে এয়েচি?
তখন নিদান এল, বাঙালি চৌধুরীরা দীর্ঘ-ঈ লিখতে পারবেন, কিন্তু অবাঙালিদের ক্ষেত্রে ‘চৌধুরি’ লিখতে হবে।
অর্থাৎ, ‘চৌধুরি চরণ সিংহ্’ লিখতে হবে, কিন্তু ‘অমিতাভ চৌধুরী’!
জানতেন এই গল্পটা?
আমি তো জানতাম না।
করোনাকালে গৃহে আবদ্ধ সাংবাদিক আনন্দবাজার হাউজের ভিতরের গল্প লিখতে বসেছিলেন ফেসবুকে। এবং তখনই তা যথেষ্ট জনপ্রিয় হচ্ছিল। এখন বই হয়ে বেরোতে গরম পিঠার মত বিকোচ্ছে!
কে এই সাংবাদিক?
ঐ হাউজে একই সময় নাগাদ দুইজন দীপঙ্কর চক্রবর্তী ছিলেন যে, একজন নাম লেখেন ঙ-য়ে ক-য়ে (যিনি ছিলেন স্বল্পজীবী), অপরজন প-এর পরে ং । বর্তমান বইটি এই দ্বিতীয়জনের লেখা। দীর্ঘ চার দশক আবাপ হাউজে চাকুরি করেছিলেন এই দীপংকর চক্রবর্তী মশায় (মাঝে জার্মানি ও মার্কিনদেশও ঘুরে এসেছেন), তাই তাঁর কলম থেকে এমন এমন ইন-হাউজী ছুট্কাহানী (anecdote) পড়তে পাওয়া গেল, যার পাঠ যথেষ্ট উপভোগ্য।
যেমন ধরুন, ক্রীড়া-পত্রিকা ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’ এডিট করতে বড়বাড়িতে মনসুর আলি খান পতৌদির পদার্পণ ও এক উন্নাসিক কর্মীর তাঁকে ন্যাজে খেলানো! অপমানিত পতৌদির পত্রপাঠ বিদায়।
বা, বুদ্ধদেব বসুকে চিনতে না পেরে কড়া ‘রিসেপশনিস্ট’ (বা, ‘রিপালশনিস্ট’) শান্তি সেন দ্বারা তাঁকে প্রায় অর্ধচন্দ্রদান… ইত্যাদি ইত্যাদি।
আনন্দবাজার তথা আনন্দবাজারীদের উন্নাসিকতা তাহলে মজ্জাগত!
শুধু কি এই?
না, না, পরম মমতায় দীপংকর শুনিয়েছেন প্রত্যন্ত জেলা-সংবাদদাতা পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়/দীনেন চক্রবর্তী বা হাজারিবাগের নেপালবাবুর কথা। শেষোক্তজন চমৎকার কবিতা লিখতেন, কিন্তু স্বীকৃতি পেলেন না কভু!
আচ্ছা, শুধুই কি এ’হেন ‘অভাজন’-দের কথা আছে?
কেন, লন্ডন স্কুল অব্ ইকনোমিক্সের গ্রাজুয়েট ব্রায়ার-পাইপফোঁকা রাজন বালা সাহেব কি নেই, ক্রীড়া-সাংবাদিকতাকে যিনি এক অত্যুচ্চ মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিলেন? ফাইভ ফিফটি ফাইভের জায়গায় ফোর-স্কোয়ার সিগারেট টানিয়ে যাঁকে ঠকিয়ে দিয়েছিলেন দীপংকর! সাধে কি আর শীর্ষেন্দু ওঁকে ‘মহাবিচ্ছু’ বলে ডাকতেন?
এমন মজলিশি ঢঙে লেখা হলেও বেশ কিছু গভীর বোধের কথাও বলেছেন লেখক এই বইতে। গৌরকিশোর ঘোষের কাছে শিখেছিলেন যেকোন সাধারণ খবরকেও নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখে অ-সাধারণ করে তুলতে। স্বনামখ্যাত জি বিক্রমন নায়ারের ভার্সিটিলিটির কথা বলতে নালেঝোলে হয়েছেন দীপংকর। আর স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তো এ’বইয়ের ভূমিকা লিখতে বসে ‘শতমুখে সাধুবাদ’ জানিয়েছেন।
গত সংখ্যাতেই আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত গ্রন্থখানি সম্বন্ধে পড়েছিলাম আমরা। বর্তমান গ্রন্থখানি সে-সুরের নয় যদিও, যদিও এটি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতামালিকা, তবু বাঙালির এক প্রধান প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে জানতে দীপংকর চক্রবর্তীর এই বইখানির পাতা ওল্টাতে হবে। তাছাড়াও, নিজের ‘প্যাংলাপুত্তর চেহারা’, বা একটা ‘ফঙফঙে’ খেলনা বা, ‘তুইয়ে-বুইয়ে’ কাজ করানোর কথা কোথায় পড়া যেত (চালুশব্দের ব্যবহার অসাধারণ করেছেন লেখক)? কিন্তু, আনন্দবাজারের গল্পে গৌরকিশোর ঘোষ এসেছেন অমিতাভ চৌধুরীও, কিন্তু সন্তোষকুমার ঘোষ এলেন না বরুণ সেনগুপ্তও না--এটা যেন কেমন কেমন লাগল!
নূতন প্রকাশনালয়ের কাজটি ভালো। চারটির বেশি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি।
শাংগ্রিলার খোঁজেঃ হিমালয়ে গুপ্তচারণার তিন শতক -- পরিমল ভট্টাচার্য; অবভাস, কলকাতা-৩৬; প্রথম প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ২০১৪; ISBN: 978-93-80732-32-9
আগে এমন হয়নি কখনও।
প্রিয় এক লেখকের সদ্য-প্রকাশিত উপন্যাসখানি পড়তে বসতে গিয়ে মনে হল, আরে, দশ বছর আগের মুগ্ধপাঠ এঁর প্রথম বইটির কথা তো বলা হয়নি কখনও! হাতে ধরা পৃথুলা উপন্যাসটি পড়ে শেষ করতে তো সময় লাগবে, তার আগে কেন না সেই সব পাওয়ার দেশ-এর গপ্পোটা একবার করি!
ডন কিহোতে থেকে শার্লক হোমস--বিশ্বসাহিত্যে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা ব্যক্তির তো অভাব নেই। কিন্ত স্থান? এ’প্রসঙ্গে তিব্বতের ‘শাংগ্রিলা’-র তুলনা আর পাই কোথা? হয় সেই এলিস-বালিকার ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড, বা নারায়ণ সাহেবের ‘মালগুড়ি’! তবু ধারে-ভারে শাংগ্রিলা অনেক এগিয়ে, কারণ তার নামে হোটেল থেকে মেমেন্টো থেকে সত্যি সত্যি স্থাননাম করে দেওয়া--এমন তো আর বেশি হয়নি।
যেমন বেশি হয়নি পরিমলের এই লেখার মানের আরেকটি বাংলা উপন্যাস-তথা-স্মৃতিচারণ-তথা-ভ্রমণকাহিনী-তথা-ইতিহাসগ্রন্থ! কোন্ গোত্রে এই দু’শো পৃষ্ঠার বইটিকে ফেলা যায়, বলুন তো? কী এর উপজীব্য?
‘দ্য গ্রেট গেম’!
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মধ্য-এশিয়ার উপরে খবর্দারী নিয়ে ব্রিটিশ ও রুশ দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে টানাপোড়েনকে নোবেলজয়ী রুডিয়ার্ড কিপলিং সাহেব তাঁর ‘কিম’ উপন্যাসে ঐ ‘গ্রেট গেম’ নাম দিয়ে অমর করে গেলেন। তিব্বত ছিল এই রেষারেষির মধ্যমণি। নৈন সিংহ কিষাণ সিংহের মতো ‘পণ্ডিত’-দের (আসলে, স্পাই!) গোপনে তিব্বতে পাঠিয়েছে সার্ভে অব্ ইণ্ডিয়া! গেছেন প্রেসিডেন্সিয়ান বঙ্গসন্তান শরৎ চন্দ্র দাস-ও! আর গিয়েছিল দার্জিলিঙের এক নিরক্ষর দর্জি লেপচা কিন্টুপ, ভূগোলচর্চায় যার অবদান ইতিহাস লিখে রাখেনি কিন্তু পরিমলের এই উপন্যাসে যাঁর নিবেদিতপ্রাণতার কথা পড়ে অশ্রু সম্বরণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই তো ‘নীরস’ ভূগোলবিদ্যার শেষ যেখানে এক সাহিত্যিকের কলম সেখান থেকেই চলতে শুরু করে।
শাংগ্রিলার স্রষ্টা জেমস হিলটন না তাঁর অতি-বিখ্যাত ‘লস্ট হরাইজন’ উপন্যাসে, না আর কোনো সাক্ষাৎকারে কখনও ‘শাম্ভালা’-র কথা স্বীকার করেছেন, যদিও এ’দুইয়ে স্পষ্টতঃ রয়েছে ধ্বনিগত মিল। প্রাচীন হিন্দু/বৌদ্ধশাস্ত্রে তিব্বতের উপরে স্বপ্নভূমি ‘জ্ঞানগঞ্জ’-এর কথা বলা আছে, যেখানে অবস্থান ‘সম্বল’ (বা, শাম্ভালা) রাজত্বের, যা চিরসবুজ চিরআনন্দের দেশ, যেখানে গেলে মানুষের বয়স আর বাড়ে না, থেমে থাকে। চির অমরত্বের দেশ সে! কেহ কেহ বলেন সময়ের অপর পিঠে রয়েছে সেই স্থানঃ শাম্ভালা!
মানং তস্যাপি কিমপি বিদ্যতে নৈব শাম্ভবি
এই দেশ, তাকে শাংগ্রিলা বা শম্ভালা যে নামেই ডাকো--খুঁজতে বেরিয়েছেন লেখক পরিমল ভট্টাচার্য। পেয়েছেন কিনা লেখেননি। পাঠক কিন্তু পেয়ে গেছে।
কারণ, অনায়াসে বিচরণ করেছেন এই অধ্যাপক-লেখক কখনও দার্জিলিং কলেজে তাঁর প্রথম কর্মস্থল থেকে যেন ইয়ার্লুং-সাংপো (ব্রহ্মপুত্র) নদীপথ বেয়ে তিব্বতী মালভূমিতে, কখনও বা ইতিহাসের পথে পথে ওয়ারেন হেস্টিংসের বন্ধু জর্জ বোগলের হাত ধরে শিগাৎসে, যেখানে স্বয়ং তাসি লামার ভগিনীকে বিবাহ করেন জর্জ (এবং তাঁর যমজ দুই কন্যা জন্মায়)! আবার, পেনাল্টিমেট অধ্যায়ে (‘পৃথিবীর শেষ দশ মাইল’) পরিমল যখন লেখেন, ‘সীমান্ত শব্দটির মধ্যে যে ছেদের ধারণা আছে, ফ্রন্টিয়ার শব্দে তার বদলে রয়েছে সম্মুখের হাতছানি!’--তখন মনে হয়, না, এ’ বইয়ের ফ্রন্টিয়ার দু’শো পৃষ্ঠায় তো শেষ হয়ে যাবার নয়, কারণ দিতে গেলে দশে বারো দিতে হয় এই বইকে!
তার চেয়ে হোক, মন্ত্রাবৃত্তিঃ
…ওঁ, মণিপদ্মে হুম্….!!
…ওঁ, মণিপদ্মে হুম্….!!
…ওঁ, মণিপদ্মে হুম্….!!
প্রত্নতথ্যঃ ভারতবর্ষের প্রত্নক্ষেত্র সন্ধানের আশ্চর্য কাহিনি -- প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত; খড়ি প্রকাশনী, হাওড়া- ৭১১১০৯; প্রথম প্রকাশঃ জানুয়ারি ২০১৯; বর্তমান মুদ্রণ চতুর্থ, অগাস্ট ২০২৩; ISBN: 978-81-934351-9-9
যতই আমরা সাহেবদের নিন্দা করি না কেন, তাঁরা না এলে কিন্তু ভারতবর্ষে প্রত্নতত্ত্বের চর্চাই হতো না।
জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার না করে দিলে মহামতি অশোকের নাম কেউ জানত না। ১৮১৯-খ্রিস্টাব্দে বাঘ শিকারে বেরিয়ে ব্রিটিশ আর্মির ক্যাপ্টেন জন স্মিথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ খুঁজে পেলেন অজন্তার অপরূপ গুহা! জার্মান পণ্ডিত আর্থার শোপেনহাউয়ারের মতো পণ্ডিত না এলে বিশ্বব্যাপী বৌদ্ধতত্ত্বের চর্চাও হতো কিনা সন্দেহ।
কিন্তু তবু প্রত্নতত্ত্বের গল্প কেউ করে না, চালু নয় ব্যাপক।
কে বলল, নয়?
এই তো তরুণ ব্যবহারজীবী প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত বর্তমান বইটিতে অজন্তা-ইলোরা থেকে বুদ্ধগয়া-ভারাওদ-জেতবন থেকে হরপ্পার গল্প শুনিয়েছেন---আর কী মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে! ওঁর এই নিবন্ধগুলি কলকাতার এক প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের রবিবারের সংখ্যায় নিয়মিত বেরোত, গোগ্রাসে গিলত পাঠক। এখন এই নূতন প্রকাশনালয়টিও চমৎকার উপস্থাপন করেছে বর্তমান সংকলনটি।
পঞ্চাশখানি রচনা রয়েছে সংকলনটিতে। ইচ্ছে করছে পুরো লিস্টিটা দিই। কিন্তু ততটা দরকার না হলেও কয়েকটি শিরোনাম তো পড়াই যেতে পারেঃ
• ব্রিংকালাট্টি [ভীম-কা-লাঠি]
• ধরিত্রী মাতার আঁচিল
• হাতির পেটে বর্ণমালা
• কোথায় কপিলাবস্তু
• রাখালদাসের দোষ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি
একটা থেকে পড়িঃ
১৯০৯-এ অজন্তা দেখতে গিয়েছেন সস্ত্রীক জগদীশ বোস, ভগিনী নিবেদিতা প্রমুখ। নন্দলাল বসু-অসিত হালদার তখন ছিলেন সেখানে ছবি কপি করার কাজে নিয়োজিত। খাওয়াদাওয়ার বড্ড কষ্ট হতো সেখানে শিল্পীদের। কলকাতায় ফিরে তাই লেডি অবলা বসু ডাক-পার্সেলে আলু পাঠাতেন ওঁদের। প্রায় চল্লিশ মাইল দূরের জলগাঁও পোষ্টাপিস থেকে, অবিশ্যি, সে সব ছাড়িয়ে আনাতে হতো তাঁদের।আরেকটি নিবন্ধ শুরু হচ্ছে এইভাবেঃ
গৌতম বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় একবার কিছুদিনের জন্য স্বর্গে গিয়েছিলেন…তাঁর স্বর্গগতা মা মায়াদেবীকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করতে। সেখান থেকে এক অনুপম সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন এই ধরাধামের সংকাশ্য নগরীতে, যার কথা ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং দুজনেই লিখে গেছেন।কোথায় এই নগরী?
পড়তে হবে যে, বাবু, বইখানি।
সব কিছু বলে দিলে যে গ্র-সমালোচকের ফাইন হয়ে যাবে!
তবে বড় সুখপাঠ্য স্টাইলখানি লেখকের। আর ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বচর্চার এমন এমন স্থান ও বিষয়গুলির উত্থাপন করেছেন যে পাঠক ধরলে ছাড়তে পারছে না লেখাগুলি।
যেমন ধরুন না কেন ‘তিব্বতী সূত্র’ নিবন্ধখানি, যেখানে পৃষ্ঠা-চারেকের মধ্যে বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ হাঙ্গেরীয় আলেক্সান্দার শোমা ও ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ব্রায়ান হজসনের গল্প করেছেন। শোমা-কে জাপান ‘দ্বিতীয় বোধিসত্ত্ব’-এর মর্যাদা দিয়ে থাকে, আর হজসন-কে ফ্রান্স দিয়েছিল তার সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিয়ন অব অনার’!
প্রত্নতত্ত্বের কাহিনি পড়তে বসে প্রাসঙ্গিক ইতিহাসটুকুও পড়তে পাওয়া চমৎকার উপরি পাওনা বটে, যদিও এখানে শোমা-র ‘গুরু’ ভেটারিনারিয়ান উইলিয়ম মুরক্রফটকে আদতে একজন ‘স্পাই’ কেন বলা হলো সেটা বুঝিনি।
আরেকটা প্রসঙ্গ ঃ ‘দ্বীপভূমির মহাবংশ’ নিবন্ধে সম্রাট অশোককে বারবার ‘দেবনামপিয়’ বলা হয়েছে। ওটি ‘দেবানাংপিয়’ হবে। এখানে দেবতাদের প্রিয়, অর্থাৎ বহুবচন ব্যবহৃত ।
গ্রন্থ-শীর্ষনামে ‘আশ্চর্য কাহিনি’ লেখা হয়েছে! আশ্চর্যই বটে, ঘুমিয়ে থাকা ভাষাহীন পাথর যে এত এত কথা বলতে পারে তা প্রত্নতত্ত্বের জ্ঞানসাগরে ডুব না দিলে কি বোঝা যায়?
মন ভরে গেছে বইটি পড়ে।