• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • পাঁচমিশালী আফ্রিকা — পুস্তক পর্যালোচনা : পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়

    পাঁচমিশালি আফ্রিকা — ডাঃ সৌগত হালদার।; প্রচ্ছদ—নির্মলেন্দু মণ্ডল; প্রকাশক: আমপাতা জামপাতা, কলকাতা; এপ্রিল ২০২১; ISBN: 978-81-948202-2-2

    গত শতাব্দীর নব্বই দশকের পর থেকে ভারতীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণের পথ ধরে অবধারিতভাবে যে শ্রেণীটি তুলনায় অধিকভাবে একটু সচ্ছলতার মুখ দেখল, তা হল ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তারই ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির তহবিলে যখন কিছুটা বাড়তি জোগান দেখা দিল তখন পরম্পরাগতভাবে ভ্রমণপিপাসু বাঙালিকে আর পায় কে! ঘরের কাছে দীঘা, পুরী ছাড়িয়ে ভ্রমণবৃত্ত তখন রাজস্থান, কাশ্মীর, হিমাচল থেকে আরও বহুদূরের কোনো নির্জন দ্বীপ বা গুহাকন্দরে আছড়ে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একটা ঝোঁক বাধাহীনভাবে প্রশস্ত হল – বিদেশভ্রমণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উচ্ছ্বাসে ও উদ্যমে।

    প্রথমদিকে এই ঝোঁক গড়ে উঠল দঃ পূঃ এশিয়ার দেশগুলোকে কেন্দ্র করে পরে যা বিস্তৃতি লাভ করল ইউরোপের দিকে। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষেরা বেরিয়ে পড়লেন উন্নত দুনিয়ার চোখ ধাঁধানো বৈভব প্রত্যক্ষ করার তাগিদে। মূলত তাদের সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে উঠল হাজার রকমের দেশি-বিদেশি ভ্রমণ সংস্থা। তাদের রঙবেরঙের বিজ্ঞাপনের জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি মধ্য ও উচ্চবিত্তরা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপের আনাচে-কানাচে, এমনকি সুদূর আমেরিকাও বাদ গেল না।

    তবে এরই মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য নজরে এল যে ইউরোপ ভ্রমণে পর্যটকের যে ঢল ক্রমবর্ধমান সে তুলনায় আফ্রিকা মহাদেশের দিকে তার গতি যথেষ্ট সীমিত। কী তার কারণ? সে বিষয়ে আর্থ-সামাজিক বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আফ্রিকা ভ্রমণ করতে গেলে ইউরোপের তুলনায় যথেষ্ট আগাম প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে, এছাড়া ওই অঞ্চলের আবহাওয়া, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল হতে হয়। এই প্রাথমিক অনুশীলন ঠিকমতো করা থাকলে ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সহায়তা করে।

    সম্ভবত সেই কারণে আফ্রিকা ভ্রমণের ওপর অভিজ্ঞতালব্ধ বিবরণী, বিশেষ করে বাংলায় এত সহজলভ্য নয়। ক-জন বাঙালি ট্যুরিস্ট ইউরোপের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হাতছানিকে উপেক্ষা করে আফ্রিকার ওই গহীন জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেছেন, সম্ভবত হাতে গুনে তা বলে দেওয়া যায়।

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা। ইতিমধ্যে ওই শতাব্দীর ষাটের দশকে দু’টি হলিউডি চলচ্চিত্র বঙ্গজীবনে আলোড়ন তুলল, “হাটারি” (১৯৬২) এবং “বর্ন ফ্রী” (১৯৬৬)। একটি বই ও দুটি চলচ্চিত্র বাঙালির অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আফ্রিকার পটভূমিতে নির্মিত ওই শেষোক্ত চলচ্চিত্রটি কলকাতার এক কিশোরের মনকে যেভাবে আলোড়িত করেছিল এবং সেই সঙ্গে সেই কিশোরের মনোজগতে আফ্রিকার রহস্যময় আলো-আঁধারির পটভূমিতে স্বপ্নের যে মায়াজাল রচনা করেছিল, সেদিনের সেই কিশোর প্রাপ্তবয়স্ক যুবকে পরিণত হওয়ার পর সেই স্বপ্নকে সাকার করেছিলেন। তিনি আমাদের এই শহরের সহ-নাগরিক ডাঃ সৌগত হালদার।

    আফ্রিকার পাঁচটি দেশের রহস্যময় জঙ্গলকে বিদীর্ণ করে তিনি আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত – ‘পাঁচমিশালী আফ্রিকা’। যে দেশগুলিকে আবর্ত করে এই বইটি লিখেছেন সেগুলি হল – কেনিয়া, তানজানিয়া, ম্যাডাগাস্কার, জিম্বাবোয়ে ও বতসোয়ানা।

    বলা বাহুল্য সেই উদ্দেশ্যে, বেশ কয়েকমাস আগে থাকতেই যোগাযোগ স্থাপন করতে হয় আন্তর্জাতিক ভ্রমণ সংস্থাগুলোর সঙ্গে। জোগাড় করতে হয় বিভিন্ন অত্যাবশ্যক অনুমতিপত্র। পরিবহণ সময়সূচির সারণির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে পর্যটনের আগাম পরিকল্পনা করতে হয়। ঠিক কোন সময়, কোন দেশে পদার্পণ করলে কাঙ্ক্ষিত জন্তুজানোয়ারের দেখা মেলে, সে সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা গড়ে তুলতে হয় বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে। রাত্রিবাসের উপযুক্ত সুরক্ষিত বিশ্রামস্থল চিহ্নিত করতে হয় ভ্রমণকারী সংস্থার তত্ত্বাবধানে। মনে রাখা দরকার একটি সফল আফ্রিকা সফরের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রাখা দরকার নতুবা প্রতি পদক্ষেপে বাধার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

    বইটি পড়ার সময় পাঠক লক্ষ্য রাখবেন যে নিখুঁত পরিকল্পনা ব্যতীত আফ্রিকায় জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে জন্তুজানোয়ারের দেখা পাওয়া একটি দুরুহ প্রকল্প। পথপ্রদর্শক অথবা স্থানীয় গাইডদের নির্দেশ পালন করা একটি অতি আবশ্যিক শর্ত। ছক-বাঁধা সময়সারণির বাইরে মুহূর্তের শৈথিল্য পর্যটককে ফেলে দিতে পারে অদৃশ্য বিপদের সামনে যেকোনো মুহূর্তে।

    “Trespassers will be eaten” – এই সতর্কবার্তায় সন্ধান পাওয়া যায় ম্যাডাগাস্কারের বিস্তৃত কুমির খামারের। তানজানিয়ায় সেরেঙ্গেটির অনন্ত প্রান্তরে ১৮,০০০ বর্গ কি. মি. জুড়ে সাভানার ঘাসবনের আঙিনায় গুঁড়ি মেরে ঢোকার ব্যবস্থাযুক্ত তাঁবুতে রাত্রিবাস করতে গেলে আপনাকে মনে রাখতে হবে মধ্যরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে আপনার সঙ্গী হতে পারে জ্বলন্ত চোখযুক্ত হায়না অথবা গর্জনরত সিংহ যার ফোঁসফোঁসানি একটু আগেই আপনি আপনার তাঁবুর বাইরে শুনছিলেন!

    যে পাঁচটি দেশ লেখক তাঁর পরিবারসহ ভ্রমণ করেছিলেন তার প্রায় সমস্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ “World Heritage” তকমাযুক্ত। সুতরাং সেখানে রয়েছে নিয়মের কড়াকড়ি। কোনো ভ্রমণকারী, সে যে দেশ থেকেই আসুক না কেন, তাঁকে কতকগুলি নিয়মাবলী মেনে চলতে হয়। অন্যথার কোনো উপায় নেই। সুতরাং প্রায় প্রত্যেক ভ্রমণকারীকে নিশ্চিতভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ অনুশীলনে রপ্ত হতে হয়। এর থেকে সামান্য বিচ্যুতি ডেকে আনতে পারে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

    ঠিক যেমনটি ঘটেছিল বোতসোয়ানার চোবে নদীর সানসেট ক্রুজে। খাঁড়ির মধ্যে নৌকা ঢুকে পড়েছিল পড়ন্ত দিনের নিষ্প্রভ আলোকে সঙ্গী করে। আর ঠিক তখনই ওই অপরিসর খাঁড়ির উলটো দিক থেকে ধেয়ে আসছে প্রায় দু’হাজার কিলো ওজনের বিশাল পুরুষ হিপো, ‘তেড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে বা দাঁত গেঁথে উল্টে দিয়ে’ - অতীতে বিবরণ পড়ে আসা লেখকের অবস্থা তখন সহজেই অনুমেয়।

    ওঁর লেখনী ইত্যবসরে জানিয়ে দিয়েছে যে “আফ্রিকায় সবথেকে ভয়ঙ্কর নরহন্তা জানোয়ার হল এই জলহস্তী, বছরে শুধু এর হাতেই বা দাঁতে প্রাণ যায় প্রায় দু’হাজার আফ্রিকাবাসীর।” ৪৭০ বর্গ কি. মি. লেক মানিয়ারা ন্যাশানাল পার্ক লেখকের বর্ণনার জাদুতে পাঠকের মানসভ্রমণের এক আশ্চর্য উপাদানে পরিণত হয়। জলের কাছে ভিড় করে থাকা ফ্লেমিঙ্গো, পেলিক্যান, স্টর্ক, হেরন আর ডাঙায় ঘুরে বেড়ানো বুশবাক, জেব্রা, গ্রাটস সেজেল, টমসন্স গেজেল, বনমহিষ আর জেব্রার দল।

    পর্যটক হিসেবে আফ্রিকায় যেতে গেলে যে কটি বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়, তার অন্যতম হল ফটোগ্রাফি। আফ্রিকার পাঁচটি দেশের উপাখ্যান পড়ার সঙ্গে পাঠকের অতিরিক্ত পাওনা; এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ফটোগ্রাফির সারণি। প্রায় ৩২ পৃষ্ঠা জুড়ে আছে ‘পাঁচমিশালি আফ্রিকা’-র অতুলনীয় রঙিন ফটোগ্রাফি। কোনো অংশেই তা পেশাগত চিত্রগ্রাহকের থেকে গুণবিচারে নিম্নমুখী নয়। লেখকের প্রতিভা এখানে নিঃসন্দেহে পাঠকের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে।

    বিশেষ করে একটি ছবির কথা না উল্লেখ করলে এই পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে — তা’হল লেমার প্রজাতির একটি বিরল সদস্য ‘আয়ে আয়ে’। লেখকের বর্ণনায় “দাঁত ইঁদুরের মতো (যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাড়তে থাকে), কান বাদুড়ের মতো, লেজ শিয়ালের মতো, গায়ের লোম ভাল্লুকের মতো, আর হাত একেবারেই নিজের মতো।” কেন ‘আয়ে আয়ে’র হাত তার নিজের মতো? সেটা জানতে গেলে পাঠককে বইটি মন দিয়ে পড়তে হবে। তবেই জানা যাবে এই বিরল প্রজাতির প্রাণীটির আসল বৈশিষ্ট্য। ‘আয়ে আয়ে’র একটি অসাধারণ ফটো দিয়ে তৈরি হয়েছে এই বইয়ের প্রচ্ছদ।

    আন্তর্জাতিক ভ্রমণের অন্যতম শর্ত হল উদার মানসিকতা। না-জানা বহু বস্তু বা পরিস্থিতির সংস্পর্শে এসে তার বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং স্বাভাবিক চিত্তে তাকে আত্মস্থ করা। কোনোরকম কুসংস্কারের বেড়াজালে মনকে বেঁধে ফেললেই বেড়ানোর অর্ধেক আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হতে বাধ্য। প্রথমেই যে জিনিসের সংস্পর্শে এসে মানুষের যুগ যুগ ধরে লালিত সংস্কার ধাক্কা খায়, তা হল বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে আফ্রিকায় খাদ্যাভ্যাস। এই পরিস্থিতি পাঠককে অনেক কিছু ধারণা বা অভ্যেস ত্যাগ করতে বাধ্য করে। খাদ্যাভ্যাসের চিরকালীন নিয়মের বাইরে গিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে পরীক্ষার সুযোগ ঘটে।

    আফ্রিকার স্থানীয় মানুষের তৈরি খাদ্যসামগ্রী তখন দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে হয়। লেখকের বিবৃতি থেকে আমরা জানতে পারি। ম্যাডাগাস্কার শহরের অন্যতম আকর্ষণ হল সে দেশের খাদ্যবৈচিত্র। গ্রিল্ড ক্রকমিট অথবা ক্রোকোডাইল ব্রোশেটের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ কি বারবার আসে? নাকি অতি সহজেই সেই রসস্বাদন থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখা যায়? লেখক ও তার পরিবারের ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। এক অনাস্বাদিত খাদ্য বৈচিত্র্যের অভিজ্ঞতা তাঁদের ঝুলিতে অচিরেই স্থান করে নিল।

    আফ্রিকার পাঁচটি দেশের যে কাহিনী লেখক তাঁর বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এবং আফ্রিকার রহস্যময় প্রকৃতির সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তার তুলনা মেলা ভার।

    শুধুমাত্র একটি বিষয়ে আলোকপাত করলে গ্রন্থটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠত তা হল স্থানীয় মানুষের জীবনপ্রণালী। তাদের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের ছোটোখাটো কাহিনী বা এ বিষয়ে লেখকের নিজস্ব মতামত অন্তর্ভুক্ত হলে সাধারণ পাঠকের জ্ঞানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরও সহায়ক হত। আশা করি লেখক ভবিষ্যতে এই আঙ্গিকের ওপর বিশেষ দৃষ্টিপাত করবেন।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments