সেখানে পাইন আর ধুপী গাছের সারির মাঝখান থেকে পথ উঠে গেছে কোন নাম না জানা বনবাংলোর দিকে, যেখানে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট চাষের জমি সবুজে সবুজ হয়ে রয়েছে। নিউজলপাইগুড়ি থেকে এরকমই তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার এক পথ পেরিয়ে, আমরা পৌঁছেছিলাম রামধুরায়—কালিম্পং-এর অখ্যাত, অথচ অপার সৌন্দর্যে ভরা এক পাহাড়ি গ্রামে।
১৮৬৫ সাল। ব্রিটিশদের সাথে ভুটানের রাজার যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত হলো 'সিনচুলা চুক্তি'। যার ফলস্বরূপ কালিম্পং ভারতে অন্তর্ভুক্ত হলো। আগে ছিল ভুটানের সাথে। স্থানীয় ভাষায় এই শহরের নাম ছিল কালিমপুং, যার অর্থ 'কৃষকদের সভাস্থল' বা 'রাজাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস'। ভারতে অন্তর্ভুক্ত হবার পর যেহেতু লাসা শহরের সঙ্গে কালিম্পং-এর সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে তাই ব্যবসাবাণিজ্য বেড়ে গেল বহুগুণ । সে সময় মূলত পশমি কাপড়, ওষধি গাছ ও অন্যান্য পাহাড়ি পণ্যের আদান-প্রদান চলত। ব্রিটিশ আমলে সুন্দর আবহাওয়ার জন্য কালিম্পং হয়ে উঠেছিল মিশনারিদের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯০০ সালে স্কটল্যান্ড-এর 'ইয়ং ম্যানস গিল্ডে'র প্রতিনিধি হিসেবে আসা ডক্টর গ্রাহাম 'পুওর হোয়াইট'দের জন্য (অর্থাৎ যারা ব্রিটিশ পিতা ও নেটিভ মাতার সন্তান) 'সেন্ট এন্ড্রুজ কলোনিয়াল স্কুলে'র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে 'ডঃ গ্রাহামস হোম' নামে এই স্কুলটি কালিম্পং-এর একটি ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান। রামধুরা যাবার পথে এই স্কুলটিও একটি অবশ্যদ্রষ্টব্য। এই কালিম্পং শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, ধূপখোলা ও ইচেখোলার সংলগ্ন এক পাহাড়ি গ্রাম রামধুরা। এটি প্রায় ৫০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
রামধুরার একদিকে পাহাড় উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়ার উদ্দীপনায়, আর অন্যদিকে খাদ, যেখান থেকে নিচে তিস্তা নদী দেখা যায়। বৃষ্টির পরে তার জল ঘোলা, যেন স্মৃতিবাহী কোনো প্রৌঢ়া নারী, যুগান্তরের ইতিহাস বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে। দূরে, ওপারের পাহাড় ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেনশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা—সাত বোনের মত, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে—নয়নাভিরাম এক অলৌকিকতা। মনে হয়, দূরের সেই সাতশিরা ধবল শিখর পাহাড়ের আত্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেন এই গ্রামকে ছায়া দিয়ে চিরকাল ঘিরে রাখবে বলেই।
রামধুরা নামটা যেন নিজেই এক কবিতা—“রাম” মানে শান্তি, “ধুরা” মানে ঢালু ভূমি। শান্তির ঢালে গড়ে উঠেছে এই পাহাড়ি জনপদ। রামধুরা নিজে তেমনভাবে কোনো ঐতিহাসিক যুদ্ধ বা রাজনীতির কেন্দ্র না হলেও, এর অবস্থান ছিল ব্রিটিশ আমলে কালিম্পং-ভিত্তিক ব্যবসা ও চলাচলের একটি অংশ হিসেবে। পাহাড়ি কৃষিজীবী সমাজের এক নির্জন গ্রাম হিসেবে এর পরিচিতি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে হোমস্টে এবং পর্যটন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিচিতি পেতে শুরু করে।
রামধুরায় মূলত নেপালি, লেপচা এবং কিছু ভুটিয়া পরিবার বসবাস করে। নেপালি ভাষা প্রধান, এর পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিও ব্যবহৃত হয়।এখানকার মানুষের মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিলিত প্রভাব দেখা যায়। এদের জীবনযাপন মূলত কৃষিনির্ভর। ধান, ভুট্টা, আদা, তেজপাতা ও কমলা চাষ হয়। সিঙ্কোনা গাছের প্ল্যান্টেশনও চোখে পড়ার মত, মংপু খুব দূর নয় বলেই হয়ত। সারাবছর দশৈঁ (দশেরা), তিহার (দীপাবলি), লোসার (তিব্বতি নববর্ষ), গুরুং প্রভৃতি নানা উৎসব পালিত হয়। সম্প্রতি স্থানীয় পর্যটনকে উৎসাহ দিতে প্রচুর হোমস্টে চালু হয়েছে। পর্যটকেরা ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং, বনভ্রমণ ও গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন রামধুরায়।
রামধুরার কাছাকাছি পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গাগুলো হল ডেলো পাহাড়, ইচ্ছেগাঁও, তিরি ভিউ পয়েন্ট, এবং কাছের সাইলেন্স ভ্যালি ফরেস্ট ট্রেল ইত্যাদি। আবার ছুটোছুটি না করে ছুটি কাটাতে চাইলেও রামধুরা আদর্শ জায়গা। সারাদিন নির্জনতায় মন ডুবিয়ে, শুধু সবুজ দেখে, পাখির গান শুনে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় দু তিনদিন।
রামধুরা একদিক থেকে যেন বাংলার পাহাড়ি গ্রামের এক প্রতীক— প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সরলতা ও অতিথিপরায়ণতা মিশে এক শান্ত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।
আমাদের হোমস্টের নাম ‘কসাংচা’। খাদ-ঘেঁষা, দু’তলার জানালা দিয়ে নিচে দেখা যায় সবুজের মেলা, চাষের জমি, গ্রীন হাউসের আধুনিকতা আর মেঘ, পাইনের রহস্যঘেরা পথ। দূরে, অনেক নীচে তিস্তা। হোমস্টের লাগোয়া ফুলের নার্সারি, যেখানে নাম না জানা অসংখ্য অর্কিড ও পাহাড়ি ফুল শোভা পায়। কালিম্পং তো এমনিতেই ভারতের অর্কিড রাজধানী। ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, সকালে আলো ফিনকি দিয়ে ঢুকে পড়ে, আর পাখিরা তীক্ষ্ণ শিসে জানিয়ে দেয় দিনের শুরু। রাতে পাহাড়ি ঝিঁঝিঁর রহস্যময় একটানা গুনগুন। হোমস্টেতে সুস্বাদু ঘরোয়া খাবার, চা, কফি, স্ন্যাকস সবই হাতের কাছে এসে যাচ্ছিল সময়মত। দুই লেপচা বোন এই হোমস্টের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ওরাই সারাদিন আমাদের খাওয়াদাওয়া আর ভালোমন্দের খেয়াল রাখছিলেন।
হোমস্টে থেকে একটু এগোলে পাওয়া যাবে জলসা বনবাংলো। কপাল ভালো থাকলে, মানে মেঘ না থাকলে বনবাংলোর ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে তিস্তা আর ওপারের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে মন ভরে যায়। বনবাংলোতে বেশ কয়েকটি ট্রি হাউজ আছে, আগে থেকে বুক করে সেগুলিতে থাকাও যায়। রামধুরা থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায় ইচ্ছে গাঁও—নামটা এমন কেন যে! সব ইচ্ছেপূরণের আশ্বাস দেয় যেন। কিন্তু না, সব ইচ্ছেপূরণ চাই না। কিছু অপূর্ণতা জীবনের লাবণ্যে নুন হয়ে থেকে যাওয়া ভালো।
সন্ধ্যে হলে দূরের পাহাড়ের গায়ে জ্বলে ওঠে ছোট্ট ছোট্ট আলো। যেন নাম না জানা গ্রামগুলোর তারাভরা আকাশে আলো ফোটা। পাইন বন, ঝিঁঝিঁর ডাক, রাতজাগা পাখির শিস—সব মিলে তৈরি হয় এক স্বপ্নমগ্ন স্তব্ধতা। গাছেদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এরা কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে। যেন আমারই অপেক্ষায় অতীতের শত শত গল্প শোনাবে বলে।
প্রায় ২৭ বছর পর আমি আবার এলাম কালিম্পং-এ। ১৯৯৮ সালের সেই প্রথম সফরের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট, কিন্তু প্রকৃতি যেন এখন কেমন বিষণ্ণ, মলিন। সবুজ কমেছে। কমেছে তার গ্রাম্যভাব, তার সারল্য। তবু যা আছে, সেটুকু যেন থাকে, হারিয়ে না যায়—এই প্রার্থনাটুকু রেখে এলাম।
আমরা ছিলাম চার বন্ধু—শৈশবের বন্ধুত্ব, ৪০ বছরের পুরোনো। প্রযুক্তিহীন সেই যুগের মানুষ আমরা, যখন আচার, আলুকাবলি, ঘাসে বসে গল্প আর বিছানার চাদর টাঙিয়ে নৃত্যনাট্যে ভরপুর ছিল জীবন। সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট, আজকের এই সেলফির যুগেও। তাই পেরেছি, শহুরের ক্লান্তি থেকে পালিয়ে পাহাড়ের কোলে অনাবিল আনন্দে কয়েকটা দিন কাটাতে।
রামধুরা আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে রয়ে গেল। ফেরার সময় তিস্তাকে ভালো করে দেখা হল না ঠিকই, কিন্তু মনটা যেভাবে ঝকঝকে সবুজ হয়ে উঠেছিল তাতে তিস্তার ছায়া পড়েছিল, সেটা নিয়েই ফিরেছি। আর তিস্তা? সে জানে, দেখা না হলেও অনুভব মুছে যায় না।