• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • কবি ও নৌকা অথবা ছলনাকথা : দিবাকর ভট্টাচার্য

    নৌকায় বসে কবিতা লিখেছিলেন এক কবি। নৌকা ভেসে যাচ্ছিল স্রোতের টানে। বাতাস ব‌ইছিলো খুব জোরে। হঠাৎ কবির হাত থেকে তাঁর লেখার খাতাটি উড়ে গিয়ে পড়লো নদীর জলে। তারপর সেটি ডুবে গেল ঢেউয়ের টানে। কবি তা দেখে হায় হায় করতে লাগলেন। তারপর নিশ্চুপ হয়ে বসে র‌ইলেন ওই জলের দিকে তাকিয়ে। তাঁর মনে হলো— ‘কেন যে নৌকায় বসে লিখতে গিয়েছিলাম!’

    ঠিক সেই সময়েই তিনি দেখতে পেলেন ওই জলের থেকে উঠে আসছেন এক দেবী। তাঁর ঠিক নৌকার সামনেই! তিনি অবাক হয়ে ওই দেবীর দিকে তাকালেন। সেই দেবী তাঁকেই উদ্দেশ্য করে বললেন— “আমি এই জলের দেবী। আর সমস্ত অক্ষরের। এই লেখাগুলি কি তোমার?” এই বলে কবির হাতে একটি খাতা এগিয়ে দিলেন। কবি সেটি হাতে নিয়ে খুব মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। তারপর বললেন — “হ্যাঁ দেবী এটা তো আমারই লেখা। একটু আগেই লিখেছি। হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে গিয়ে নদীর জলে পড়লো। আমি তো ভেবেছিলাম আর পাওয়াই যাবে না। তাই খুব মন খারাপ করে বসে ছিলাম।” দেবী স্মিত হেসে বললেন — “বেশ। তাহলে এটা এবার খুব যত্ন করে রেখে দাও। আশা করি এই লেখা যথাসময়ে উপযুক্ত সমাদর পাবে।” এই বলে দেবী ওই জলেই অন্তর্হিত হলেন।

    কবি এরপর ওই কবিতাগুলি প্রকাশ করে অপ্রত্যাশিত খ্যাতি পেলেন। হঠাৎ করেই তাঁর প্রভূত সুনাম হলো। কিন্তু ওই কবিতাগুলি একটাও তাঁর নিজের লেখা ছিলো না। অর্থাৎ সেই দেবী তাঁর হাতে যে খাতাটি দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে এটি তাঁর কিনা, সেটি আদৌ তাঁর ছিলো না। ওই খাতার কবিতাগুলিতে চোখ বুলিয়েই তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিলো কী অসাধারণ এই শব্দচয়ন! তখন তিনি আর লোভ সামলাতে পারেননি। তাই ওই দেবীকে ছলনা করেই বলেছিলেন যে এটি তাঁর লেখা — যে কথা জগতে কারো জানা ছিলো না।

    *

    সমস্ত ব্যাপারটাতে ওনার আর এক বন্ধু কবির খুব অবাক লেগেছিল। তিনি এনাকে দীর্ঘকাল ধরে জানতেন। এনার যাবতীয় লেখাপত্রের সঙ্গে আগাগোড়াই পরিচিত ছিলেন। তাঁর মনে হলো — ‘ওই নৌকায় বসে তাঁর বন্ধু যা কিছু লিখলেন তাই-ই এত বিখ্যাত হলো। নিশ্চয়ই নৌকায় বসে জলের সামনে লিখতে বসলে লেখায় অন্য মাত্রা আসে। তাহলে দেখাই যাক না। আমিও চেষ্টা করে দেখি।’ এই ভেবে তিনিও একটি নৌকায় চড়ে বসলেন। লিখতে শুরু করলেন বিরাট জলরাশির সামনে। কিন্তু একটা কবিতাও তাঁর মনের মতো হচ্ছিলো না। হঠাৎ একদিন খুব জোরে ঝড় উঠলো। নৌকা টলমল করে উঠলো। তাঁর হাত থেকে ওই কবিতার খাতাটি উড়ে গিয়ে পড়লো নদীর জলে। তারপর সেটি মিলিয়ে গেলো ওই নদীর উত্তাল ঢেউয়ের ভিতরে। উনি একটু ক্ষুণ্ন হয়ে ভাবলেন — ‘এ কদিন ধরে যাও বা দুচার লাইন লিখলাম তাও নষ্ট হয়ে গেল বরাবরের জন্য।’

    এই সময়েই ঠিক আগের মতো নদীর জল থেকে উঠে এলেন সেই দেবী। ওই কবিকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন — “আমি অক্ষর আর জলের দেবী। তোমার কি এই নদীর জলে কিছু হারিয়েছে?” ওই কবি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন — “হ্যাঁ দেবী। আমার এত নিষ্ঠার সঙ্গে লেখা কবিতার খাতাটা জলে পড়ে গেল একটু আগেই।” অক্ষর আর জলের দেবী ওনার দিকে একটি খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন — “এটি কি তোমার?” কবি খাতাটি নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন। আর মনে মনে ভাবতে থাকলেন — ‘এত অসাধারণ সব কবিতা! অপূর্ব ছন্দের কারুকাজ। আর তেমনই গভীর ভাবনা।’ উনি এবার দেবীকে বললেন — “হ্যাঁ হ্যাঁ। এটাই আমার হারিয়ে যাওয়া খাতাটা।” দেবী মৃদু হেসে বললেন — “তাহলে রাখো।” এই বলে তিনি যেমন ভাবে জল থেকে হঠাৎ উঠে এসেছিলেন তেমনভাবেই জলে অন্তর্লীন হলেন।

    এই কবিতাগুলি প্রকাশ পাওয়া মাত্রই পাঠকমহলে এক বিপুল আলোড়ন উঠলো। সবাই বিস্মিত হয়ে আলোচনা করতে লাগলো ভাব ও ভাষার এমন অসাধারণ সমন্বয় এর আগে কখনো দেখা যায়নি। কবির খ্যাতি হঠাৎই যেন গগনচুম্বী হয়ে গেল। যদিও তিনি নিজে ভালোভাবেই জানতেন যে এই লেখাগুলি একটিও তাঁর নিজের নয়। সব‌ই সেই অক্ষর আর জলের দেবীকে ছলনা করে পাওয়া। অবশ্য তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এই ছলনার কথা কারো কাছে কোনো দিন প্রকাশ পাবে না।

    *

    এর কিছুকাল পরেই দেখা গেল ওই নদীতেই আরো একজন একটি নৌকায় বসে কিছু লিখছেন। হঠাৎ একটা প্রবল ঝড় এলো। ওনার লেখা খাতাটি উড়ে গিয়ে পড়লো নদীর উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে। তারপর তলিয়ে গেল সেই ঢেউয়ের মধ্যে। উনি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখলেন সেদিকে। ওনার চোখে জল এসে গেল। উনি চোখের জল মুছে নিজেকেই বললেন — “আবার লিখতে হবে। নতুন করে।”

    ঠিক সেই মুহূর্তেই আগের মতই নদীর জল থেকে উঠে এলেন সেই দেবী। আগের মতোই নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন — “আমি অক্ষর আর জলের দেবী। তোমার কি কিছু হারিয়েছে?”

    উনি বললেন — “হ্যাঁ। আমার কবিতার খাতাটা ঝড়ে উড়ে জলে গিয়ে পড়লো। তারপর কোথায় ভেসে গেল কে জানে।”

    দেবী ঠিক আগের মতই একটি খাতা ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন — “এটি কি তোমার?”

    উনি দেবীর হাত থেকে খাতাটি নিয়ে পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে ওনার মনে হলো যে এই কবিতাগুলির ধরনটা একেবারেই অন্যরকম। এতে নানান ছন্দ আর শব্দের কারুকার্য। উনি বললেন — “নাহ্। এ আমার লেখা নয়।” এই বলে খাতাটি দেবীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন।

    দেবী মৃদু হেসে ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন — “ঠিক বলছো তো?”

    উনি বললেন — “নিশ্চয়ই।”

    এবার দেবী আরেকটি খাতা ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন — “তাহলে দ্যাখো তো এটা তোমার কিনা।”

    উনি দেবীর দেওয়া খাতাটি এবার খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। দেখলেন এ লেখাগুলিও একেবারে অন্যরকম। এখানে রয়েছে কঠিন কঠিন সব তত্ত্বকথা। অনেক অনেক পান্ডিত্য। কিন্তু সব‌ই যেন ধার করা। উনি বললেন — “নাহ্। এ খাতাটিও আমার নয়।”

    দেবী আগের মতোই মৃদু হেসে বললেন — “তুমি নিশ্চিত তো?”

    উনি এবার দেবীকে খুব নম্র স্বরে বললেন — “আপনি আমার জন্য এত কষ্ট করলেন। কিন্তু এগুলির কোনোটাই আমার নয়। আমি এভাবে লিখি না। আমি সহজ ভাবে লিখতে চেষ্টা করি। জোর করে কোনো ছন্দ কোনো ভাব বা কোনো তত্ত্ব এনে বসাই না।”

    তখন দেবী ওনাকে স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন — “তোমার কী মনে হয়? তোমার এইসব লেখা মানুষের মনে থাকবে?”

    উনি দেবীর চোখে চোখ রেখে খুব শান্ত গলায় বললেন — “যদি কোনো সুর এসে বসে ওইসব কথার উপর — তখন সেই সুর আর কথা মানুষের মনে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।” তারপর একটু থেমে বললেন — “যাক্। যা গেছে তা গেছে। আবার নতুন করে লিখতে হবে।”

    দেবী এবার বললেন — “যেসব লেখা তুমি এখন দেখলে সেগুলি লেখা তোমায় অনেক নামযশ এনে দিতে পারে তা জানো?”

    উনি বললেন — “জানি। কিন্তু আমি নামযশের জন্য লিখি না। আমি লিখি আমার প্রাণের দেবতার জন্য।”

    দেবী আবার মৃদু হেসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন — “তুমি সেই দেবতাকে দেখেছো কখনো?”

    উনি বললেন একটু চুপ করে থেকে বললেন — “অনুভব করেছি।”

    দেবী আগের মতই হাস্যমুখে বললেন — “বেশ বেশ। লেখো। খুব মন দিয়ে লেখো। আমি আবার আসবো।”

    উনি বললেন — “আসবেন? আবার আসবেন?” দেবী এর কোনো উত্তর না দিয়ে প্রসন্ন হেসে জলে অন্তর্হিত হলেন।

    ওনার তখন দূরের জলরাশির দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য মনে হলো — ‘যা ঘটলো তা কি সত্যিই? না সব‌ই আমার জীবনদেবতার কোনো ছলনা?’

    *

    এরপর থেকে উনি কেবল লিখেই চললেন আর লিখেই চললেন। এইভাবে ওই নৌকার উপরে জড়ো হলো তাঁর রাশি রাশি লেখা। মাঝেমাঝে উনি ভাবতেন সেই অক্ষর আর জলের দেবীর কথা। ভাবতেন দেবী যে বলেছিলেন আসবেন, ক‌ই এলেন না তো? তারপরেই তাঁর মনে হতো — বলেছেন যখন তাহলে নিশ্চয়ই আসবেন। কোনো না কোনো সময়ে। এরপর বহুকাল কেটে গেলো। ওই নদীতে ওই নৌকার উপরে কত ঝড়ঝাপটা এলো। আবার সেই নদী একসময়ে শান্ত‌ও হয়ে গেল। কিন্তু ওই দেবীর আর দেখা পাওয়া গেল না।

    ক্রমশ ওনার বয়সের ভার বেড়ে গেল। সেই ভার নিয়েও তিনি তাঁর জীবনদেবতাকে উদ্দেশ্য করে লিখে যাচ্ছিলেন অক্লান্তভাবে। এরপর একদিন উনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রোগশয্যায় ক্লান্ত শরীরে নৌকায় শুয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তখনো ভাবতেন হয়তো কোনো একদিন ওই দূরের জল থেকে উঠে আসবেন সেই অক্ষর আর জলের দেবী।

    *

    তারপর তিনি তাঁর অশক্ত শরীরটি নিয়ে কোনোক্রমে ওই ভেসে আসা ফাঁকা নৌকাটিতে উঠে এলেন। পিছনে পড়ে র‌ইলো তাঁর এতদিনের সঙ্গী পুরোনো নৌকাটি। আর সেই নৌকা ভর্তি তাঁর এতদিনের লেখাপত্র। উনি ওই নৌকার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলে উঠলেন — ‘তোমার কাছে আমার আর ঠাঁই নেই।’ তাঁর অতিপ্রিয় জীবনসর্বস্ব নৌকাটি দূরে আরো দূরে ভেসে চলে যেতে থাকলো। উনি একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে র‌ইলেন।

    তাঁর উপর নিঃশব্দে ঝরে পড়লো দিনশেষের ক্রমাগত অন্ধকার কিংবা শান্তির অক্ষয় অধিকার।



    অলংকরণ (Artwork) : রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments