গৌরহরির মায়ের বয়স বাহাত্তর। এমনিতেই তিনি বয়সজনিত নানা অসুখে ভুগছেন। সংসারের কাজ কিছুই করতে পারেন না, যা করার গৌরহরির স্ত্রী-ই করে। কিন্তু ইদানীং মায়ের শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছিল। গৌরহরির বাড়ির কাছেই এই ‘কমললতা নার্সিংহোম’। একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে গৌরহরি মাকে নিয়ে এসে এখানেই ভর্তি করে দেয়। অবন্তিকা এখানের নার্স।
অবন্তিকার সঙ্গে সেই প্রথম দেখা গৌরহরির। প্রথম চোখে চোখ রাখা। সেই প্রথম তার দেহের দিকে তাকানো। অবন্তিকা গৌরহরিকে সামনে বসিয়ে তার মায়ের বর্তমান কন্ডিশন, কতদিন থাকতে হতে পারে আইসিইউ-তে, কবে নাগাদ জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত করা হতে পারে; কিন্তু পেশেন্টের লাউফ রিক্স কতটা—এইসব বলে যাচ্ছিল মুখস্থ আওড়ানোর মতন। সে বলছিল, গৌরহরির কানে তার প্রথম দিকের কথাগুলির কিছু পৌঁছলেও বাকি কথা সে আর কিছু শুনছিল না বা শুনতে পাচ্ছিল না। সে কেবল অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছিল অবন্তিকাকে।
অবন্তিকা থামলে গৌরহরি প্রথম যে প্রশ্নটা অবন্তিকাকে করে, তা হল এইঃ আপনার বাড়ি কি এখানেই?
অবন্তিকা এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়েছিল। মুখ ফিরিয়ে চকিতে তাকিয়েছিল গৌরহরির দিকে। ভুরু বাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়েছিল, আমি আপনার মায়ের কথা বলছিলাম।
হ্যাঁ। তাই জানতে চাইছি আপনার বাড়ির অবস্থানটা।
মানে! কেন? আমার বাড়ি জেনে আপনি কী করবেন?
এমনিই জানতে চাইছি। সে খুব শান্তভাবে বলেছিল।
না। এখানে নয়। বলে ঘাড় নেড়েছিল অবন্তিকা। বলেছিল, অনেক দূরে।
মানে? কতদূর?
অবন্তিকা অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বন্ধ করেনি। এখানে সাধারণত পেশেন্টের কথা বাদ দিয়ে পারসোনাল প্রশ্ন কেউ করে না। কিন্তু গৌরহরি করছিল।
অবন্তিকা বলে, তারকেশ্বর থেকে যেতে হয় ট্রেকারে করে। একদম ভেতরে।
তারকেশ্বরের নাম শুনেছি। তবে কখনও যাইনি।
যাবেন। বাবার মাথায় জল ঢেলে আসবেন।
আপনার গ্রামে যাব।
আবার তার দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল অবন্তিকা। এবারে কিছু বলেনি। কিন্তু চোখ, মুখের কোঁচকানো ভাবটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে খুব একটা পছন্দ করছে না এইসব কথাগুলো। কিন্তু উত্তর দিয়েও যাচ্ছিল যাতে পেশেন্টপার্টি অখুশি না-হয়। এবার গৌরহরি তার নাম জানতে চাইল। সে এবার একটু নরম হল। বলল, কোন নাম বলব?
এবার থতমত খাবার পালা গৌরহরির। বলল, মানে!
অফিশিয়াল নাম না দীক্ষা নেবার পরের নাম।
আমি দুটিই শুনতে চাই।
তখন সে দুটি নামই বলে। দীক্ষা নেবার পরের নাম-রাধিকাদেবী দাসী। গৌরহরির খুব পছন্দ হয় নামটা। অবন্তিকার চেয়ে হাজারগুনে ভালো নাম। সে বলে, আজ থেকে আমি আপনাকে রাধিকা বলেই ডাকব। কথাটা শুনে অবন্তিকা তার দিকে প্রশ্রয়-মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
দেখা হবার ক্ষণ থেকেই সে কেবল রাধিকার নামই জপে গেল। রাধিকা রাধিকা রাধিকা—আহা। সর্বক্ষণ সে কেবল রাধিকার কথাই ভেবে গেল। ফেসবুকে তাকে খুঁজে বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। রাধিকা তা একসেপ্টও করল। সেখানে এক অভূতপূর্ব ছবি দেওয়া আছে রাধিকার। কমললতা থেকে বেরিয়ে এসে সে একান্ত অবসরে সেই ছবিটির দিকেই তাকিয়ে থাকত।
রাধিকার নাক যে খাড়া বা বাঁশির মত, তা নয়। বরং একটু চ্যাপ্টাই বলা যায়। দেহ যে খুব লম্বা-চওড়া—তা নয়। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মত তার দেহের গড়ন। ঠোঁট যে খুব পাতলা বা মোটা, তা নয়। মাঝামাঝি। তার ঠোঁটের রঙ গোলাপি। মুখখানা যেন সব সময় ফুল হয়ে ফুটে আছে। এমন মেয়ের প্রেমে না পড়ে থাকা যায়? তাই প্রথম দর্শনেই প্রেম!
গৌরহরির মা সাত দিন ভর্তি ছিল। পাঁচ দিন আইসিইউ-তে, দু’দিন জেনারেল বেডে। এই কদিন দুবেলা গিয়ে সে ঠায় বসে থেকেছে মায়ের কাছে থুড়ি রাধিকার কাছে। প্রথমদিকে যে চোখ কুঁচকানোর ব্যাপারটা ছিল রাধিকার মধ্যে, পরে পরে সেটা উধাও হয়েছে, সে স্বাভাবিক হয়েছে। গৌরহরিকে দেখলে আর সে ঘুরে বসে না বা রাগ করে না। বরং তার দিকে মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ চোখে তাকায়, হাসে। কথা বলে।
মায়ের ছুটি হয়ে গেল। তাই বলে গৌরহরির ছুটি হল না। নানা ছুতোনাতায় সে চলে আসতে লাগল কমললতায়। দেখা করতে লাগল রাধিকার সঙ্গে। এই ট্যাবলেট কখন দেব, ওই সিরাপ শেষ হলে কী করব—ইত্যাদি নানান অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে সে আসত আর বসে থাকত রাধিকার সামনে, দীর্ঘক্ষণ। অন্য নার্স বা অন্যান্য স্টাফরা মুখ চাওয়াচায়ি করত, আড়ালে হাসত। রাধিকা একদিন চুপিচুপি বলল, ফোন নম্বর দিচ্ছি, মায়ের কোনো অসুবিধা হলে ফোন করবেন। এখানে আর আসবেন না। হাত বাড়িয়ে গৌরহরি বলল, দিন। হাতে লিখে দিন।
ধ্যাৎ!
ফোন নম্বর মোবাইলে সেভ করে নিয়ে গৌরহরি বলে, এতে আপনার কন্ঠস্বর শুনতে পাব, কিন্তু আপনাকে দেখতে তো পাব না। তার কী হবে?
একগাল হেসে রাধিকা বলে, দেখে কী করবেন?
যদি ভিডিওকল করি?
না না। বলে রাধিকা হেসেছিল।
ভিডিওতে দেখাও বারণ?
কেন করবেন? প্রয়োজন হলে এমনিই ফোন করবেন।
আপনি খুব সুন্দর করে রসকলি পরেন। নিজেই পরেন? না কেউ পরিয়ে দেয়? রাধিকা হাসে। বলে, নিজেই পরি।
এখানেই না-থেমে গৌরহরি বলে চলে, রসকলির যে রঙ, ঘিয়ে কালার, আপনার গায়ের রঙের সঙ্গে কেমন করে যেন মানিয়ে যায়। গলায় তিনপাকের তুলসিমালা। সেটাও খুব সুন্দর করে আপনার গলায় জড়িয়ে আছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে, মালা আপনার কন্ঠলগ্ন হয়ে আছে, আপনাকে তারা উপভোগ করছে।
এবার রাধিকা লজ্জা পায়। এই প্রথম তার মুখে লজ্জার হাসি দেখা যায়। সেই হাসি সে আড়াল করে বাহুতে মুখ ঢেকে। মুখ তুলে বলে, আপনি দীক্ষা নিয়েছেন? গৌরহরি জানায়, আপনি বললে নেব।
নিরামিষ আহার করেন?
আপনি বললে করব।
সবই আমি বললে কেন? নিজে থেকে কিছু করতে পারেন না?
কেন করব? আপনি তবে আছেন কেন?
আপনার পরিবার আছে। আপনার আর চিন্তা কী?
আপনিই আমার সর্বক্ষণের চিন্তা।
উফ্! আপনাকে নিয়ে আমি আর পারি না।
আমি কি আপনার বাড়ি যেতে পারি?
পারেন।
আপনার ঘরে কে কে আছেন?
এখানে আমি একা থাকি। মাঝে মাঝে মাসিমা বা আমার মা অথবা আমার দিদুন এসে থাকে।
আমি যদি আজ যেতে চাই, অসুবিধা আছে?
না না, অসুবিধা কিসের?
আজ যাই?
কদিন পরে আসুন। যখন আমার দুপুর দুটোয় ছুটি হয়, তখন।
মাকে ছাড়িয়ে আনার দিন পনেরো পরে, রাধিকার ফ্ল্যাটবাড়ির এক কামরার ঘরে গৌরহরি গিয়েছিল। কমললতায় তাদের পোশাক হালকা গোলাপী চুড়িদার। সেই পোশাকেই তাকে দেখতে অভ্যস্ত গৌরহরি। এখন এই পোশাকে তাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল গৌরহরি। গাঢ় সবুজ চুড়িদারে কী অপূর্ব লাগছে মেয়েটিকে! গলায় জরির কাজ, চুড়িদারের ঝুলেও জরির পাড় বসানো। কানে সবুজ, ছোট্ট দুল। কপালেও জরি বসানো ছোট্ট সবুজ টিপ। মেয়েটা সাজতে জানে। নিজেকে সাজাতে জানে। আহা, সময় থাকতে থাকতে এই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হল না কেন?
তার ঘরে আছে কুঞ্জবিহারী। তাকে সেবা করতে গিয়ে রাধিকা আর কারও কথা ভাবার সময় পায় না। তার ঘরে টিভি নেই। রেডিয়ো নেই। ফোনে সে সময় কাটায় না। কাজ থেকে ফিরে সে ঠাকুরের ভোগ লাগায়, প্রসাদ চড়ায়, হরিনাম করে। সে কুঞ্জবিহারীকে প্রসাদ দেয়—সকালে- মাখন ও মিছরি। বেলায়- মুড়ি বা চাউ। দুপুরে- অন্নভোগ। বিকেলে- ফল ও চকোলেট। রাত্রে- রুটি ও তরকারি। আর এই প্রসাদ খেয়েই সে জীবনধারণ করে। সে একজন প্রসাদী ভক্ত।
রাধিকার বিধবা মাসিমার সঙ্গে তার আলাপ হল। সে বলে, রাধিকার মতন মেয়ে আমি আর দেখিনি মাসিমা। এমন অনেককেই দেখেছি, গলায় তুলসির মালা, সর্বক্ষণ নাম জপছে, এদিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এগরোল খাচ্ছে।
শুনে মাসিমা মৃদু হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ। এমন মানুষ আছে।
রাধিকাকে দেখে মনেই হবে না তার বাড়ি এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তার হাব-ভাব, কথা-বার্তা, চাল-চলন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও তার রূপের পরিচর্যা—কোথাও তার মধ্যে গ্রাম্যতা নেই, সবেতেই একটা শহুরে ছাপ স্পষ্ট। মুখখানা সব সময় ঝকঝক করছে। মুখের মধ্যে এক রসস্থ ভাব। কথা বলার সময় সে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুহাত পেছনে। ফলে নাতিউচ্চ বুকদুটি পুরোপুরি ঠেলে উঠে নিজেদের জানান দিচ্ছে। পরনে গভীর সবুজ রঙের চুড়িদার, হলুদ দেওয়াল—রঙ্গের এই মূর্চ্ছনায় তাকে খুব সুন্দর লাগছিল। অঙ্গের গোরা রূপ ফেটে পড়ছিল যেন আরও আরও বেশি করে। দেওয়ালে পিঠ চেপে কথা বলতে বলতে সে এমন মিষ্টি করে মুখ চেপে হাসছে যে তার বাঁ গালে টোল পড়ল। সেদিকে সব সময় তাকিয়ে থাকতে হয়। এই টোল আগে চোখে পড়েনি কেন গৌরহরির?
রাধিকা বলে, আমি নিরামিষ খাই। স্বপাক। আগে কুঞ্জবিহারীকে অর্পণ করি, তারপরে। কারও বাড়িতে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে খাই না।
আপনি কোনোদিন কুঞ্জবিহারীকে দেখেছেন রাধিকা?
মানে! রোজই তো দেখি।
ওই দেখা নয়। তিনি আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে ফিরছেন।
না। এমন দেখা, এমন অনুভব আমার এখনও হয়নি।
তিনি আপনাকে দেখা দেন না!
আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। গল্পে গল্পেই আমার সময় কেটে যায়।
আপনি কি মীরা?
না, আমি রাধিকা।
প্রথম দর্শনেই যে কাউকে দেখে ভালোবাসা যায়, রাধিকা হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গৌরহরির পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হল, কিন্তু এমনি করে কারও প্রেমে সে পড়েনি। প্রেম কেমন তা জানা ছিল না গৌরহরির। দেখাশোনা করে বিয়ে। তার স্ত্রী বিয়ের সময় থেকে পৃথুলা। এখন আরও হয়েছে। প্রথম থেকেই তার স্ত্রী রসকষহীন, আজও তাই। র্যোমান্টিকতার লেশমাত্র তার মধ্যে নেই। গৌরহরির দুই সন্তান। এক কন্যা এক পুত্র। সংসার এবং সন্তান নিয়েই গৌরহরির স্ত্রীর সময় কেটে যায়। তার দিকে তাকাবার ফুরসত কোথায়? বছর পনেরোর দাম্পত্যে প্রেমের চিহ্ন কোনদিন ছিল না, আজও নেই। এখন আর এই সম্পর্কটাকে দাম্পত্যজীবন বলা চলে না। বলা যায় একত্রবাস।
রাধিকা বলে, কৃষ্ণবর্ণ এক শিশু মুরলী বাজায়—এটি ছাড়া আমি আর কিছুই দেখি না।
সেদিন রাধিকার এক কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট থেকে চলে আসার পরে এক ঘোরের মধ্যে ছিল সে। সারারাত ঘুমোতে পারেনি। হোয়াটসয়াপ খুলে রাধিকার ছবিটি সে বার বার দেখেছে। পরনে লালপাড় শাড়ি। শাড়ির জমি ঘি রঙের। রাধিকার কপাল জুড়ে চন্দনের ছাপ, কন্ঠে তিন পাকে তুলসির মালা। খুব মন দিয়ে সে তাকিয়ে আছে কুঞ্জবিহারীর ছবিটির দিকে। অতি মনোমুগ্ধকর এক ছবি রাধিকার। আর রাধিকাকে দেখাচ্ছেও খুব সুন্দর। সে ছবি দেখে মন থেকে কাম চলে গিয়ে প্রেম জাগে।
ওর ফ্ল্যাট থেকে ফেরার দিন, সারারাত রাধিকার কথা ভেবে ভেবে গৌরহরি দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সেদিন ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর সেইসময় সে একটি স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন শেষ হবার পরেই ঘুমটা ভেঙে যায় তার। সে তখনও বিহ্বল হয়ে উঠে বসে। স্বপ্ন ছিল এইরকম—
সকালেই সে ফোন করে রাধিকাকে। স্বপ্নর কথা বলে। অন্যদের মত সেও গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটছে তা থেকে একটি ঠোঙা তুলে নেবে বলে। সে যেখান থেকে বেরুচ্ছে, গাড়িটি অনেকটাই এগিয়ে গেছে সেই পথ থেকে, সে ছুটছে গাড়িটির নাগাল পাবার জন্যে, প্রসাদ তুলে নেবার জন্যে, কিন্তু গাড়িটি দেখতে পেলেও তার কাছে সে পৌঁছতে পারছে না। অনেকেই তার আগে আগে দ্রুত পায়ে বা দৌড়ে চলেছে, গাড়িটির পেছনের ডালাটা উপর দিকে তোলা, ভেতরে রাশি রাশি প্রসাদ, অনেকেই তুলে নিচ্ছে সেখান থেকে, কিন্তু অন্যদের পাশ কাটিয়ে গৌরহরি কিছুতেই সেই অবদি পৌঁছতে পারিছে না। সে যত এগোতে চায় বাজারের ভিড়; কর্দমাক্ত, ইট ফেলা রাস্তা যেন তার গতিকে শ্লথ করে দেয়।
স্বপ্নের সে সবই বলে রাধিকাকে। কেবল বলে না, বাস থেকে নেমে, সেই রাস্তা ধরেই একদিন সে কাজে যেত। সেটা তার অতিচেনা এক রাস্তা। এইটুকু সে উহ্য রেখে দেয়।
স্বপ্ন শুনে রাধিকা বলে, গতকাল আপনি যখন আমার গৃহে এসেছিলেন, সেটি একটা ভালো দিন ছিল। সেদিন ছিল একাদশী। সেদিন আপনি প্রসাদ নিয়েছেন। এইসব নিয়ে অনেক কথা বলেছেন আমার সঙ্গে, আমার পিসিমার সঙ্গে। গোপাল তাই চেয়েছিলেন আপনি তাঁকে দর্শন করুন। তাই এরকম স্বপ্ন দেখেছেন।
আপনি কখনও নিজেকে একা বোধ করেন রাধিকা?
একা! কেন? কুঞ্জবিহারী রয়েছেন তো!
সারাদিন একটা ফ্ল্যাটে একা থাকা মুখের কথা নয়। সে দুপুরের পরেই হোক, বা সকালের দিকে পুরোটা সময়—একাই তো। এখানে কোনো প্রতিবেশী নেই। কথা বলার লোক নেই।
কুঞ্জবিহারীর সঙ্গেই কথা বলি। তাকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। একা কোথায়?
একাকীত্ব বোধ?
তাও না। আমি বই পড়ি।
গল্পের বই?
না। ভাগবত পড়ি। আপনি পড়েন?
না।
ভাগবত পড়ুন।
কেন পড়ব?
ভগবানকে জানার জন্যে।
গৌরহরি ঘরটাকে দেখে। দেওয়ালে একটা গিটার ঝোলানো। বলে, এই গিটারটা কার? বাড়িওয়ালার?
না। আমার। বলে স্মিত হাসে রাধিকা।
আপনি গিটার শেখেন বুঝি?
রাধিকা বলে, আগে শিখতাম। এখন আর শিখি না। তাই গিটারের কভার পরিয়ে রেখে দিয়েছি।
শিখলেন না কেন?
সে অনেক ব্যাপার।
শুনি না।
এর উত্তর দিলেন মাসিমা। বললেন, ও দু মাস শিখেছিল। তারপরে একদিন ওর গিটার মাস্টার ওকে বলে, তোমাকে আমার প্রাক্তন প্রেমিকার মতন দেখতে। এই কথা শুনে ও শেখা ছেড়ে দেয়।
গৌরহরি ফিরে আসে। পরের দিন ফোন করে রাধিকাকে। বলে, আমি গিটার মাস্টার হতে চাই না।
রাধিকা শব্দ করে হাসে।
আমি আপনাকে কিছু শেখাতে চাই না।
তবে?
শিখতে চাই।
আবার রাধিকার হাসার মিষ্টি শব্দ শোনা যায়।
আপনি তো একজন প্রসাদী ভক্ত।
হ্যাঁ।
আমিও প্রসাদী হব।
এই ত্যাগবোধ কোথা থেকে এল?
রাধিকা-রঙের বাতাস লেগে জীবনে ত্যাগ এল।
কী বলেন! কে আপনি?
আমি কৃষ্ণদাস।
কোন কৃষ্ণদাস?
দুঃখী কৃষ্ণদাস।
কতটা দুঃখী?
আমি বঞ্চিত কৃষ্ণদাস।
ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর—এ-কী সারাজীবনে মুখস্থ করতে পারবেন?
হয়ত পারব, অথবা পারব না।
তাহলে হল না।
হয়ত এইমাত্র মুখস্থ করলাম, পরমুহূর্তে ভুলে গেলাম।
বাদ।
তবে আপনার নাম আমি ঠিক জপ করতে পারব।
আপনি কে বলুন দিকি?
আমি আপনার দাস।
ছি ছি, এভাবে বলবেন না।
আমি এমনি বলি।
কৃষ্ণদাস অভিমান যখন পরিপক্ক হয় তখনই জীব যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তিনি সন্ন্যাস নেন।
সন্ন্যাস! অনেকবার ভেবেছিলাম জানেন, কিন্তু যেতে পারিনি।
এ সন্ন্যাস বনের সন্ন্যাস নয়, মনের সন্ন্যাস। আমার মন যোগী হয়ে দশ ইন্দ্রিয় শিষ্য নিয়ে সংসার করে। বলে রাধিকা ফোন কেটে দেয়।
সে আবার ফোন করে। রাধিকা ফোন তোলে না। সে টেক্সট মেসেজ করে, রাধিকা কোনো উত্তর দেয় না। রাধিকা কী একেবারে গুটিয়ে নিল নিজেকে? তাকে ত্যাগ দিল জীবনের কেন্দ্র থেকে? গৌরহরি জানে, রাধিকার জীবনকেন্দ্রে রয়েছেন শ্রীহরি। গৌরহরি সেখানে ব্রাত্য। তাঁকে সরিয়ে নয়, তাঁরই পাশেই সে একটু জায়গা চেয়েছিল। রাধিকা তাতে নাচার।
তারপরে কেবল এক ঝলক রাধিকাকে দেখার জন্যে সে কতদিন ঘুরে গেছে এখানে, এই পাড়ায়, গলির মধ্যে সে দাঁড়িয়ে থাকল ঘন্টার পর ঘন্টা। যদি তাকে এক ঝলক দেখা যায়।
এইভাবে ঋতু পরিবর্তন হল। ফাল্গুনের গন্ধ। এখন শীত নেই, তবুও ভোরের দিকে ঠান্ডা বাতাস এসে এই কৃষ্ণময় পৃথিবীকে ঘিরে ধরে। ওদিকের কদম গাছের একটা পাতা নড়ছে, মনে হচ্ছে ওই বুঝি রাধিকা যায়; তার পদশব্দ শোনা যায়। চকিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে দেখে, না, কেউ নেই, কিছু নেই, কেবল রোদ পড়ে আছে। রাধিকা চলে গেছে। সে ফোন করল। বেজে বেজে কেটে গেল। গৌরহরি ভাবল, এমনি করে সে চলে গেল, বলে গেল না? কেন গেল?
আবার সেই ফাঁকা, শূন্য ফ্ল্যাটবাড়িতে ঢোকার সরু, গলি রাস্তার দিকে তাকাল সে। দুপুরের রোদ বেশ চড়া, তবু এখনও গরম নেই। এখন দুপুর, পাড়ার মধ্যে লোকজন নেই। রাস্তায়, উঁচু বাড়ির মাথায়, দেওয়ালে দেওয়ালে, ছাদের কার্নিসে—কত রোদ পড়ে আছে। আর বাতাসে ভাসছে ফুলের গন্ধ।
রাধিকা নেই!
মনে হল, কেউই যদি না-থাকবে তাহলে কেন এত কামনার তরঙ্গ জাগল তার বুকে? কে জাগাল এই প্রেম? সে যে ওই রাধিকা, রাধাপ্রেম; যার জন্যে তার এত আকুলি-বিকুলি। আশ্চর্য হয়ে সে ভাবে, সে এতটা একাকী বোধ করে কেন? এই গোটা পৃথিবীতে সে একা, যেন তার কেউ নেই। তার সংসার আছে। বয়সেও সে অনেকটাই বড় রাধিকার চেয়ে। তবুও সে রাধিকাকে চেয়ে এসেছে দেখার প্রথমদিন থেকেই।
কদিন পর সে আবার ফোন করল। না, এবারেও রাধিকা নিরুত্তর। তবে কি আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাবে না তার সাথে? রাধিকা বিপথে ফেলে চলে গেল তাকে?
রাধিকা কুঞ্জবিহারীকে নিজের স্বামী বলে মানে। সে আর কাউকে বিয়ে করবে না। কিন্তু তাকে ভালোবাসায় দোষ কোথায়?
গৌরহরি বলে, রাধিকা, আপনাকে ঠিক বুঝতে পারি না!
বোঝার দরকার কী?
মন খুলে কথা বলেন না।
আমার কুঞ্জবিহারী আছেন তো।
সেটাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমিও আছি, এটা ভুলবেন না।
শুনে রাধিকা হাসে।
তার হাসি বড় মিষ্টি। বড় নির্মল। সে যে নিজেকে চেপে রাখে সেটা এতদিনে বুঝে গেছে গৌরহরি। কিন্তু তাকে ভালোবাসায় কি আটকায় তাতে?
বলা হয়, যাকে যে ভালোবাসে তার সব কিছুই সুন্দর লাগে। এ বিষয়ে রাধিকাই বা কম কী? তার তাকানো, হাসি, রাঙা গালে টোল, তার লালচে অধর, কন্ঠস্বরের উত্তাপ, সুন্দর সাদা দাঁত—সবই মনোমুগ্ধকর। যেমন তার ব্যবহার, তেমনি তার শব্দ চয়ন, আর তার কথার থ্রোয়িং। ওর গলার মিষ্টিস্বর, খুব নীচু দিয়ে গোটা পৃথিবীমণ্ডলে ভেসে যায়। গৌরহরি চোখ বুজে সেই শ্রুতিমধুর শব্দের আস্বাদন করে। রাধিকা, যে জন্ম-জন্মান্তরের প্রেমিকা, তার কন্ঠস্বর হয়ত চিরকালই এমন নরম, এমন মিষ্টি, এত শ্রুতিমধুর।
একদিন সে ফ্ল্যাটবাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করল। বলল, রাধিকা এখানে আর থাকে না?
রাধিকা কে? তিনি অবাক।
অবন্তিকা হাজরা।
আচ্ছা! নার্স দিদি? ওনার নাম কি রাধিকা?
আসলে এটা ওনার দীক্ষা নেবার পরের নাম।
কিন্তু তাঁকে খুঁজছেন কেন?
উনি কি ঘর ছেড়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। আচমকাই ছেড়ে দিলেন।
কিছু বলে গেছেন কোথায় গেছেন না গেছেন?
না। তবে বলেছিলেন, সরকারি হাসপাতালে সুযোগ পেয়েছেন, তাই এটা ছেড়ে দিচ্ছেন। তা, আপনি ওঁর কে হন?
ফট করে মিথ্যেটা বলে দিল সে। বলল, আমি ওনার কাছে দীক্ষা নিয়েছি।
উনি দীক্ষাও দেন? ওনার বয়স তো খুব কম!
পঁচিশ।
এই বয়সে উনি এত বড় ভক্ত হয়ে গেছেন!
চলে আসার সময় সে দেখে, ফ্ল্যাটের মালিক তার দিকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিরে এসে সে আবার ফোন করে রাধিকাকে। সে এবার ফোন ধরে। হয়ত কিছুটা বিরক্ত হয়েই। আপ্লুত গৌরহরি বলে, আপনি ঘর ছেড়ে দিলেন কেন?
ছাড়লাম।
একবার বলে গেলে কী হত?
কী বলব?
এই যে...চলে যাচ্ছি।
কেন বলব?
ভালোবাসি বলে।
তখন আপনি ছাড়তেন আমাকে?
এখনই বা ছাড়তে পারছি কই?
সবকিছু ত্যাগ না দিলে কৃষ্ণভজন হয় না।
ত্যাগ করছি তো।
কেবল নাম করুন, নাম। কৃষ্ণনাম।
রাধানাম কেন নয়, রাধিকা?
এই অভিমান ছেড়ে দিন।
তাহলে কী করব?
বিষয়ভোগ ত্যাগ করুন।
তারপর?
গোবিন্দে আস্থা রাখুন।
আমার আস্থা আপনার উপরে।
তিনি হলেন মধুরাতিময় আনন্দঘন মূর্তি। তাই তাঁর প্রেম এত উদার।
আপনার প্রেম পেলে তো সবই পাওয়া হল, রাধিকা।
আপনি চুপ করুন!
এতদিন তাই তো ছিলাম।
নিষ্কাম প্রেমই জানিয়ে দেয় যে কিসে সুখ হবে আর কিসে দুঃখ।
দুঃখ তুমিই দিচ্ছ, রাধিকা।
গৌরহরিও আর আপনি আপনি করে কথা চালাতে পারে না। সে বলে, তুমি শুধু কৃষ্ণকে বুঝলে রাধিকা, আমায় বুঝলে না! তোমার হৃদয় যেমন কৃষ্ণবিরহে দ্বগ্ধ হচ্ছে, তেমনি আমার হচ্ছে রাধিকাঅনলে। আমার দেহ তোমার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! রাধিকাও যেন তুমিতে নেমে এসে স্বস্তি পেল। বলল, তুমি আমার পিছনে আর ঘুরো না গৌর।
কেন?
আমি তোমায় কিছুই দিতে পারিনি!
তো দাও।
পারব না।
ইচ্ছে করলেই পারো।
কী করে দেব?
যেমন করে প্রেমিকা প্রেমিককে দেয়।
আমার যে কিছুই নেই!
তোমার তুমি আছ।
একপত্র তুলসী আর একগণ্ডূষ জলের কাছে ভগবান বিক্রি হয়ে যান—সেখানে আমি কে?
তুমিই তো সব রাধিকা।
খালি বাজে কথা!
যে ব্যথা পেয়েছে প্রেমে, সে আর কৃষ্ণনাম শুনবে না।
তবে সে কী করবে?
সে জানবে রাধাকে—রাধিকাকে।
কোন রাধিকা?
তুমি।
এসব বাজে কথা।
তাই আমি তোমার চরণদর্শন প্রত্যাশা করি।
ছি ছি! এ কী বলছ!
খারাপ কী বলেছি?
এমন বলো না গৌর।
অনেক কষ্টে বলছি।
কৃষ্ণনামে ফাঁকি রেখো না।
আমার কাছে তা রাধানাম।
ফাঁকি থাকলে বনও গৃহ। আর যদি ফাঁকি না থাকে তাহলে গৃহ-ই বন।
আজ কী পড়লে, রাধিকা?
গৌর, আজ কেবল পড়লাম কৃষ্ণনাম।
তার মানে তুমি আমাকে পড়লে।
সে তুমি যাই ভাবো।
আজ আমি দীক্ষা নেব রাধিকা।
ভালো তো। নাও।
তোমার কাছে নেব।
আমি!
হ্যাঁ। দেবে না?
আমি এই তিন বছর কুঞ্জবিহারীর সেবা করছি। আমি কীকরে দীক্ষা দেব!
তুমি ছাড়া আর কারো কাছে আমি দীক্ষা নেব না।
নিরামিষ খেতে হবে।
পারব রাধিকা।
স্বপাক।
তাই হবে।
মিথ্যা বলা যাবে না।
বলছিও না।
আচ্ছা, গুরুমহারাজকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।
বলে রাধিকা অনেকদিন পর হাসে।
গ্রামের এক জায়গায় ম্যারাপ বেঁধে হরিনাম হচ্ছে। একদিকে কয়েকটি তেঁতুলগাছ পর পর, ওদিকে চাষজমি। আর এদিকে পর পর গভীর জলের দুটি পুকুর। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ উপস্থিত। মহিলার সংখ্যাই বেশি। আছে কুচোকাঁচাও। পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই কম। কিছু পুরুষ তেঁতুলগাছের নীচে দাঁড়িয়ে নামগান শুনছে আবার মৃদুস্বরে নানান কথাও আলোচনা করছে। কিন্তু মহিলারা অনেকে আবেগ চেপে রাখতে না পেরে কৃষ্ণভাবাবেগে ঘন ঘন চোখের জল মুছছে। তাদের সবার পিছনে বসে আছে রাধিকা। গৌরহরি করল কী, চুপ করে তার পিছনে বসল, একটু দুরত্ব রেখে।
রাধিকা খেয়াল করেছে তাকে। চাপা গলায় বলে, তুমি পথ খুঁজে এখানেও চলে এসেছ!
এলাম।
কেন?
ইচ্ছে হল।
এ পথ তোমার নয়।
পথ আর খুঁজে পেলাম কই!
এখুনি এখান থেকে চলে যাও।
তাড়িয়ে দিচ্ছ?
তাড়াচ্ছি না, চলে যেতে বলছি।
তাই বা কেন বলবে?
আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি এখানেও চলে আসতে পারো।
তুমি যেখানে আমিও সেখানে।
ও! কী কুক্ষণেই না ঠিকানাটা বলেছিলাম!
সেটাই বা বলবে না কেন?
তুমি এসো।
এসেছি তো।
একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমাকে।
আমাতেই তোমার শান্তি।
একদম যা-তা লোক তুমি।
রাধিকা তোমাকে ঘিরেই এত লোকজন, এত বাজনা—
ওভাবে বলবে না, পাপ লাগবে।
কেমন করে ভালোবাসলে তুমি সবচেয়ে সুখী হবে রাধিকা?
এই কথাটা শোনার পরে রাধিকা উঠে পড়ে। সে গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক হেঁটে এক বাড়িতে ঢুকে পড়ে। পিছু পিছু গৌরহরিও ঢোকে। দেখে সেখানে পিসিমা উপস্থিত। তিনি খুব অবাক হয়ে বললেন, আপনি এখানেও!
হ্যাঁ। এলাম। রাধিকাই টেনে আনল।
বসুন। অতিথি নারায়ণ। জল-বাতাসা খান। দুপুরের প্রসাদ পাবেন।
ঘরে একটা সাধারণ খাট আর সামান্য কিছু আসবাব। সেখানেই একটা স্থানে রাখা আছে কুঞ্জবিহারীর সেই আবক্ষ মূর্তি ও ভাগবত। একপাশে একটি বড় আয়না ঝুলছে। রাধিকা কোথায় গেল?
আয়নায় নিজেকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। তার চুলে পাক ধরেছে সে জানত। কিন্তু এতগুলো চুল পেকে গেছে তার! কবে পাকল? ভেতরে ভেতরে এত চুল এমনি করে সাদা হয়ে গেছে, এতটা বয়স হয়ে গেছে; বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। এতদিন সে নিজেকে দেখার, চেনার, জানার সুযোগ পায়নি। আজ, এখানে এসে, রাধিকার ঘরে, এত বড় আয়নায়, নিজের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার সময় হল তার! গৌরহরি খুব অবাক হয়ে গেল। এমন বুড়িয়ে গেছে সে!
মাসিমা ফিরে এলেন একটি রেকাবে কয়েকটি বাতাসা আর জল নিয়ে। বললেন, আয়নায় কী দেখছেন এত?
আয়নার কাছ থেকে সরে গৌরহরি বলে, রাধিকা?
রাধাবিনোদ মন্দিরে গেছে সে।
কেন?
সেখানে গতকাল সে তার পায়ের একটি নূপুর হারিয়েছে; তাই খুঁজতে গেছে।
ফিরবে কখন?
সেটা সে-ই জানে।
রাধিকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ।
কেন?
কুঞ্জবিহারীকে পাবে বলে।
রাধিকা তার অন্তরে এমন প্রেম-পিপাসা জাগিয়েছে যে তা বলার নয়। এক তীব্র অনুরোধ, অনুভব; এই দেখলাম তো পরক্ষণেই মনে হল, কই দেখলাম, কিছু দেখিনি তো! মনটা তার সর্বক্ষণ রাধিকা রাধিকা করে বেজে ওঠে। পিপাসা পিপাসা পিপাসা—এত তীব্র প্রেম-পিপাসা যে বলার নয়! এই তীব্র প্রেম-পিপাসায় দেহ, মন, বুক সবই শুকিয়ে শুষ্ক মরুভূমি হয়ে ওঠে।
মন্দিরটি কোথায়?
গ্রামের উত্তরে, বনের মাঝে।
কী হবে দুপুরের আহারে, যেখানে রাধিকাই নেই! এই ভেবে গৌরহরি বেরিয়ে পড়ল। সে মন্দিরে যাবে। রাস্তায় অনেককেই জিজ্ঞাসা করল, রাধাবিনোদ মন্দিরটি কোথায়? কেউ বলে উত্তরে, কেউ বলে দক্ষিণে আবার কেউ জানায় এমন নামে কোনো মন্দির নেই। সে এই পাড়া সেই পাড়া, এই গ্রাম সেই গ্রাম, এই বন সেই বন ঘুরে বেড়াতে লাগল। এক সময়ে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে সে বসল। চৈত্রের বিকেলের মধুর বাতাসে, অরণ্যের শীতলতায় সে ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্তিতে, খিদেতে।
যখন ঘুম ভাঙল দেখে অন্ধকার নেমে এসেছে; দূর আকাশে ভেসে উঠছে চৈত্রের চাঁদ। বাতাসে শীতলতা। তাতে মিশে আছে অপূর্ব সুগন্ধ। কে জানে এই সন্ধের আলোয় বনমধ্যে কোন ফুল ফুটেছে। সে প্রথমে বুঝতে পারল না, এই বনের মাঝে সে কেন।
গৌরহরি উঠে বসল। দেখল তার সামনেই এক বৃদ্ধ বসে আছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি। মাথায় পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। পাশে রাখা একটি ঢোল। লোকটির মাথার পিছনে চাঁদ। বনের পদপ্রান্তে লুটিয়ে আছে নক্ষত্ররা। হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবী। এদিক-ওদিক পাখিরা উঠছে। নানান পতঙ্গ ডাকছে। অদ্ভুত একটা আমেজে ডুবে আছে গোটা বন।
গৌরহরি বলল, কে গো তুমি?
আমি নিমাই আদক। একজন ঢোলবাদক।
এই বনের মাঝে কী করছ?
হরিনাম শেষ, বাজিয়ে ঘরে ফিরছি। দেখছি তুমি গাছতলায় শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছ। তোমায় দেখে মায়া লাগল। তাই এট্টু বসে গেলাম। তোমাকে হরিনামতলায় দেখেছি।
অনেকেই হরিনাম শোনে। কিন্তু আমাকে আলাদা করে চিনলে কি করে?
বা, তোমায় চিনব না? তুমি যে সবার চেয়ে আলাদা।
কীরকম?
আমরা লোক দেখলেই বুঝি কে ভক্ত আর কে নয়। দেহ দেখে বলে দিই কে সাধক বা ভোগী।
তা কী বুঝলে?
তুমি একজন সংসার উদাসীন সাধক মানুষ। কিন্তু এখানে কী করছ?
এসেছি রাধাবিনোদ মন্দিরের খোঁজে। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না!
পাচ্ছ না!
না।
কিন্তু মন্দির খুঁজছ কেন?
মন্দির-প্রাঙ্গণে রাধিকার পায়ের নূপুর হারিয়েছে, তাই।
আহা, কি ভক্তি তোমার! হারানো নূপুর শ্রীরাধিকা একা খুঁজে বের করতে পারছেন না—আহা, মধু মধু! কী ভাব! ঈশ্বর তোমার সাহায্য চাইছেন। তুমি আসল ভক্ত না তো ভক্ত কে!
তুমি জানো সেই মন্দিরের খোঁজ?
না-গো। আমি তো বাইরের লোক; আমি কেমনে জানব? শ্রীরাধিকার হারানো নূপুর খোঁজার ডাক যখন তুমি পেয়েছ তখন এটা মনে রেখো; তিনিই তোমায় সেই মন্দিরের খোঁজ দেবেন।
ততদিন আমি কী করব?
আজ থেকে তুমি আর গৃহী নও; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—কিছুই নও—
তবে আমি কে?
তুমি ঈশ্বরের দাস।
রাধিকাদাস।
আহা! কী বললে, পরান জুড়িয়ে গেল! তুমি তো বড় ভক্ত, পারবে না সেই অনন্য মনমন্দির খুঁজে বের করতে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌর বলে, পারব।
তোমার খোঁজ সফল হোক।
আর নূপুর?
শ্রীরাধিকার শ্রীনূপুরের ধ্বনি তোমার দেহকে কৃষ্ণনাম-মঞ্জরিত করে তুলুক।
গৌরহরি কিছু বলে না। তাকায় কেবল।
তুমি পারবে রাধিকাদাস, পারবে। তোমায় হরিনামতলায় দেখেই আমি বুঝেছি, তোমার মধ্যে এক প্রবল ঈশ্বর-প্রেম আছে। ঈশ্বরপথের পথিক তুমি।
গৌরহরি ফ্যালফেলিয়ে দেখে। তার শরীরের মধ্যে কেমন একটা ঢেউ জাগছে। গুলিয়ে উঠছে শরীর। তারপরে শরীর স্থির। বুকের দপদপানি উধাও। গা ঠান্ডা হয়ে এল। চন্দন গন্ধের বাতাস ছুটে এল। গৌরহরি শীতল হল। চারপাশ ক্রমে শূন্য হয়ে কেবল আলো জেগে আছে।
শ্রীরাধিকা স্বয়ং তোমার ডেকেছেন; তুমিও তাঁর স্মরণ নাও।
কিভাবে?
তাঁর নূপুরের ধ্বনি বুকে নাও, রাধিকাদাস।
আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে গৌরহরির শরীর। যে লোক তার সামনে তারই মতন থেবড়ে বসে আছে যেন সে আছে কতদূরে! তাকে দেখাচ্ছে এই এতটুকু!
তুমি চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
এত দূরে কেন?
দূরেই তো।
একবার বাজাবে তোমার বাজনা?
শুনবে?
শোনাও।
ঢোলবাদক বাজাতে শুরু করে। আহা, কী অপূর্ব সুর তার বাজনায়! সারা চরাচর সেই শব্দের আনন্দে হয়ে ওঠে কৃষ্ণময়। চাঁদের গায়ের রঙ রাধিকার মত। গাছের পাতা থেকে, ঘাসের শিস থেকে নূপুরধবনি যেন বেজে ওঠে তালে তালে; সঙ্গতে। তার বাজনার বোল এটাই বলে দেয়; এই অতি সাধারণ, কৃষিজীবী, অশিক্ষিত বাদক বহু আগেই ঈশ্বরকে পেয়েছে; কেবল দেরি হয়ে গেল গৌরহরির।
বাদক বাজাতে বাজাতেই চলতে লাগল। আলো-অন্ধকার মেশানো পথে বাজাতে বাজাতেই হারিয়ে গেল।
ঢোলবাদকের ওই চলে যাওয়া বনপথে চন্দ্রের উজ্জ্বল আলোকে রাধিকার চরণচিহ্ন ক্রমে প্রস্ফুটিত হল। গৌরহরি বুঝল পথেই, ধুলোতেই ঈশ্বরের বাস। এই পথই সে খুঁজছিল এতগুলি দিন ধরে! সেই আলোকিত ধুলোর সঙ্গে নিজ অঙ্গ মিশিয়ে, মাটিতে কান পেতে গৌরহরি শুনতে লাগল হারিয়ে যাওয়া এক নূপুরের অপূর্ব সুর।