“বৌদি, কিছু পুড়ছে।” ঘরে ঢুকেই বলল অসীম।
সুলেখা বাথরুমে কাচাকুচি করছিল। ভুরু কুঁচকে বলল, “নাক বটে তোমার!” পরক্ষণেই কী সন্দেহ হওয়ায় দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি গ্যাসটা বন্ধ করে জিভ কেটে বলল, “এই যাঃ, বাঁধাকপিটা—”
“গেছে তো?”
“ন্-না, একটু তলা ধরে গেছে। ম্যানেজ করে দেব।” তারপর সপ্রশংস দৃষ্টিতে অসীমের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যিই, তোমার নাকটা—”
“হাইপার সেনসিটিভ। এক এক সময় বোধহয় পোড়া লাগার আগেই টের পেয়ে যায়।”
অসীম ফ্যানটা ফুলস্পীড করে দিল। সুলেখা তার মুখের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তোমার ইন্টারভিউটা?”
এতক্ষণ চেপে রাখা হাসিটাকে আকর্ণবিস্তৃত করে অসীম বলল, “ক্লিয়ার্ড! এখন শুধু লেটারটা পাওয়ার অপেক্ষায়।”
“উঃ, এতক্ষণ বলেনি!”
“ফুরসত পেলাম কই! তবে চাকরি পেলে কলকাতার মৌরসিপাট্টা ছাড়তে হবে, পোস্টিং তো ঐ বেঙ্গালুরু বা চেন্নাইয়ে।”
“হ্যাঁ, তোমার মতো ছেলেদের বাংলায় চাকরি কোথায়!” সুলেখা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর হঠাৎ চনমনিয়ে উঠে বলল, “তাহলে এবার ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটগুলোয় অ্যাড দিতে শুরু করি।”
“বৌদি, আজকাল আর ওভাবে হয় না।”
“তো কী? কতবার জিগ্যেস করেছি, তুমিই তো বলেছ তোমার তেমন কেউ নেই। তাহলে কি ইতিমধ্যে—”
“আরে, তাও নয়। বোসো, ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরো আমার এই কলকাতায় এক বঙ্গললনার সঙ্গে যাকে প্রেম বলা হয়, তাই হল। অথবা, তোমরা ঐসব সাইট-ফাইট দেখে কাউকে আমার সামনে এনে দিলে। তা, কোনো নব্যা মহিলা কি স্রেফ আমার পোঁটলা হয়ে ভিনরাজ্যে যেতে চাইবেন? তাঁরও তো একটা ক্যারিয়ার প্ল্যান থাকতে পারে। দুটো পথ নাও মিলতে পারে।”
“ও মা, তাহলে কি আধুনিক ছেলেমেয়েদের বিয়েফিয়ে উঠে যাবে?”
“অতটা নয়। বিয়ের ব্যক্তিগত, সামাজিক প্রয়োজনীয়তাটাকে তো এক্ষুনি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে মূলভূমি থেকে দূরে ছেলেমেয়েরা যখন সীমিত রোজগারে পায়ের তলায় একখণ্ড মাটি খোঁজে, তার ভাড়া বলো বা ইএমআই, টানার জন্য দুটো ইঞ্জিন লাগে। তাই তাদের অনেকেই আজকাল চাকরি পাওয়ার পর নিজের বা আশপাশের কোম্পানিতে দেখেশুনে নিজেরাই ম্যাচ ফিক্স করে নিচ্ছে।”
“তাহলে বলছ ভাব-ভালোবাসা, মনের টান ওসব কিছু নয়? স্রেফ একত্রে থাকার সুবিধের জন্যই—”
“বৌদি, অ্যারেঞ্জড ম্যারেজই বলো বা লাভ ম্যারেজ, ঐ বুক টনটন, মন উড়ুউড়ু কিছুদিনের। যারা লম্বা ইনিংস টানে, সেটা এই পারস্পরিক সুবিধেরই ওপর।”
“তাহলে আর কী!” হতাশ সুলেখা বলল, “যাও, বেঙ্গালুরু না চেন্নাই গিয়ে তোমার ‘পারস্পরিক সুবিধে'কে আবিষ্কার করো। বুঝতে পারছি, দেওরানিটির বাঙালি হবার চান্স কম। তবে তিনি শাকাহারি না হলেই ভালো। তুমি তো আবার আঁশ ছাড়া ভাত মুখে তুলতে পারো না।”
“আরে, ওসব তো কথাবার্তা বলে আগেই ঠিক করে নিতে হবে। ফুড হ্যাবিট, মিউজিক-মুভি চয়েস, পেট—”
“অ্যাঁ, গাছে না উঠতেই এক কাঁদি— বিয়ে না হতেই পেট!”
“ইয়ার্কি মেরো না!” অসীম হেসে ফেলল, “ওটা সেই পেট নয়— পি-ই-টি পেট, মানে পোষ্য। ধরো কারো পছন্দ কুত্তা, কারো বিল্লি, কারো কোনোটাই নয়। সেসব বোঝাপড়া করে নিতে হবে না?”
“হুম, বুঝলাম ব্যাপারটা নিয়ে তুমি খুব সিরিয়াসলি রিসার্চ করেছ।”
“দূর, এসব তো বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শোনা।”
“বান্ধব, না বান্ধবীও আছে?”
“বান্ধবী আছে। তবে তারা ফ্রেন্ডলি গার্ল, গার্লফ্রেন্ড নয়।”
“বা-ব্বাঃ! কিন্তু এত করে দুজনে মিলে ঘর বাঁধার প্ল্যান নয় করলে। ওদিকে তোমাদের তো তোমার দাদার মতো স্থায়ী সরকারি চাকরি নয়। তোমরা তো এক চাকরিতে, এক জায়গায় থিতু হও না।”
“ঠিক। আমরা লে অফ হতে পারি আবার বেটার অপশন পেলে কম্পানিকে কাঁচকলা দেখাতেও পারি। তখন একজন কিছুদিন কষ্ট করে ধরো শেয়ারে থাকে, উইক-এন্ডে আসে, পারলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে। এভাবে ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করে।”
“হয় ম্যানেজ?”
হয় আবার হয়ও না। অসীম অনেক রকম গল্প শুনেছে। কিন্তু সেসব বলে বৌদির চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কী? তাই একটা ফেকলু হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল, “ঐ, একরকম।”
আবার বাতাসে একটা পোড়া গন্ধ। বৌদি বোধহয় কড়াইয়ে জলের ছিটে দিয়ে তরকারির অক্ষত অংশটুকু চেঁছে তুলছে।
অসীমের এই বিশেষ ঘ্রাণশক্তির পরিচয় প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ওর স্কুলবেলায়। ও আর দাদা অজয় তখন এক ঘরে শুত। একদিন মাঝরাতে অসীম দাদাকে ঠেলে বলেছিল, “দাদা, কিছু পুড়ছে।”
অজয় ঘুমজড়ানো চোখে বলেছিল, “কোথায়, আমি তো বুঝছি না। দ্যাখ, হয়তো বস্তিতে কেউ খড় পুড়িয়ে শীত তাড়াচ্ছে।”
“না রে, কাছে।”
অগত্যা অজয় উঠল আর জানালা দিয়ে উঁকি মেরেই আঁতকে উঠল। তাদের মূল বাড়িটা বাবা অনেক কষ্টের টাকায় পাকা করেছিলেন। কিন্তু লাগোয়া রান্নাঘরটার তিন দিক ছিল দর্মার আর ছাদটা টিন ও টালির। সেই রান্নাঘরেই কীভাবে যেন আগুন লেগে গেছে।
তবে সবে লেগেছে। তাই হৈ-হল্লা, লোকজন, জল ইত্যাদির পর নামমাত্র আহুতি নিয়েই অগ্নিদেব পিছু হঠলেন। সব শুনে বাবা অসীমকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, “তোর জন্যই আমরা এক বিরাট সর্বনাশ থেকে বাঁচলাম।”
আর অসীমের এক সর্বনাশের সূত্রপাত হল। তারপর বহু রাতে সে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নাক টানত— কিছু কি পুড়ছে? তখন দাদাই আবার ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, “কিছু হয়নি, ঘুমো।”
সেই ট্রমার থেকে বেরিয়ে আসার পর অসীম এক সময় বুঝতে পারল, আশপাশে কোথাও কিছু পুড়লে সে চট করে টের পায়। তখন কী পুড়ছে আবিষ্কার না করা অবধি তার স্বস্তি নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য সে জ্বলন্ত বস্তুটি খুঁজে পায় না। কিন্তু সে নিশ্চিত কিছু পুড়ছে, যা তার চোখকে এড়িয়ে গেলেও নাককে ফাঁকি দিতে পারেনি।
তারপর বালক থেকে জোয়ান হওয়ার পথে অসীম বুঝেছে, সংসারে অনেক কিছু পুড়লেও দেখা যায় না। তবু সে পোড়া গন্ধেই ব্যাপারটা টের পায়, এমনকি কখনো জিনিসটা পুড়তে শুরু করার আগেই। হয়তো একে ‘কন্ডিশনড রিফ্লেক্স’ বলে। যেমন ওর বাল্যবন্ধু সুব্রত সানাই শুনলেই লুচির গন্ধ পেত।
অসীমের বাবার কথাই ধরা যাক। চিতায় ওঠার অনেক আগের থেকেই সে তিলে তিলে পুড়ছিল, টার্মিনাল ক্যান্সারে। তখন বাবার ঘরে গেলে, তার ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকালে অসীম একটা পোড়া গন্ধ পেত। মা অবশ্য বেশি কষ্ট দেয়নি বা পায়নি, একেবারেই চিতায় উঠেছিল। দাহকার্য শেষ হলে দাদা অসীমকে বুকে টেনে বলেছিল, “আমরা অনাথ হলাম। তবে তোর ওপরে আমি রইলাম।”
“আর তোর ওপরে?”
তার সদ্য সাবালক দাদা ক্লিষ্ট হেসে বলেছিল, “আকাশ।”
দাদা কথা রেখেছিল। বটগাছের ছায়া দিয়ে ভাইকে সংসারের ঝড়ঝাপটা থেকে আগলে রেখে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে বৌদি এসে দেওরটির মায়ের অভাব অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছিল।
ওদের ঋণ অসীম কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। ওরা তা চায়ও না। ওদের শুধু আকাঙ্ক্ষা, ভাইটি জীবনে বড় হোক। যে খ্যাতি, স্বাচ্ছন্দ্য তাদের বাইপাস করে গেছে তার থেকে যেন তাদের স্নেহের ধনটি বঞ্চিত না হয়।
গাছে না উঠতেই এক কাঁদি?
সবে তিন মাসের ট্রেনিং সেরে বেঙ্গালুরুতে প্লেসমেন্ট পেয়েছে, অসীমের সঙ্গে আলাপ হল কলিগ রেশমি চ্যাটার্জির। কলকাতার এক নামী প্রতিষ্ঠানের ঝকঝকে স্টুডেন্ট, সচ্ছলতায় বেড়ে ওঠা মেয়ে, চোখে হাজার স্বপ্ন। তার সঙ্গে অভাবের বিরুদ্ধে লড়ে স্রেফ প্রতিভার জোরে ভেসে থাকা অন্তর্মুখী ছেলে অসীমের কীভাবে যেন চট করে নিবিড় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর আরো একটু কিছু।
“আমি অনেক টাকা করতে চাই। যাতে প্রতি মুহূর্তে ইচ্ছেগুলিকে হিসেব কষে কাটছাঁট না করতে হয়। আর পারলে দাদা-বৌদিকে একটু ভালোভাবে রাখতে চাই।” বলত অসীম।
“আমি অ-নেক বড় হতে চাই। টাকাটা দরকার, কিন্তু শুধু টাকাতেই সব হয় না। আমি অনেক বড় কাজ করতে চাই। এমন জায়গায় পৌঁছোতে চাই যেখানে পৃথিবীর সেরা কাজ হয়। এখানে এই কম্পানিগুলির অনেক নামডাক, কিন্তু তারা স্রেফ ব্যাক-এন্ড জব করে। আমার তাতে আটকে থাকলে চলবে না।” রেশমির চোখে স্বপ্ন জ্বলজ্বল করত।
“তাহলে তুই জিআরই-টোফেল দিয়ে মাস্টার্স করার চেষ্টা না করে এখানে এলি কেন?”
“অনেক খরচ। ড্যাডি-মাম্মি অনেক করেছে, আর তাদের বোঝা হতে চাই না। এখন যা করব, নিজের চেষ্টায়। এই চাকরিটা আমার জাস্ট একটা স্টেপিং স্টোন।”
“বেস্ট অফ লাক।”
“কিন্তু তখন তুই আমার পাশে থাকবি তো? বল, থাকবি তো?” রেশমি হঠাৎ আকুল হয়ে উঠেছিল।
এক মুহূর্তের জন্য অসীমেরও বুক মুচড়ে উঠেছিল। বলেছিল, “হ্যাঁ রে পাগলি, তুই যত দূরেই যাস আমি তোর পাশে থাকব।” হঠাৎ তার মনে হয়েছিল পারস্পরিক সুবিধে আর যৌনতার বাইরেও নারী-পুরুষের মধ্যে কিছু একটা আঠা আছে৷ সম্ভবত উভয়ের প্রকৃতিগত কিছু খামতি, যা পূর্ণ করতে তারা অসহায় মুহূর্তে একে অপরের মধ্যে ভরসার বন্দর খোঁজে।
মাসের পিঠে মাস গড়িয়ে কেটে গেল দু-দুটি বছর। কিন্তু পরিণতির দিক থেকে অসীমের দেহেমনে এই সময়টায় অন্তত পাঁচটি বছর যোগ হয়েছে। সে ‘প্রসেস'এর জোয়ালে অবিরাম ঘুরতে শিখেছে। সীমাহীন স্বপ্নগুলির ডানা ছাঁটতে শিখেছে। ভিনদেশি ক্লায়েন্টের হ্যাপা সামলাতে দিনরাত এক করতে শিখেছে। তার পাখির চোখ শুধু দুই ‘ডি’— ডেলিভারি আর ডেডলাইন।
আর আছে একটি খুড়োর কল, অফশোর। অর্থাৎ দেশ ছেড়ে বিদেশি ক্লায়েন্টের সাইটে গিয়ে কাজ করার সুযোগ। ইদানিং এহেন সুযোগ কমে আসছে। কোভিডের সময় দেশে-বিদেশে অনেক আই-টি কম্পানিরই রমরমা হয়েছিল। সেই জোয়ার সরে গিয়ে এখন উপকূলের এবড়ো খেবড়ো পাথর উঁকি মারছে। ক্লায়েন্টদের টাকা কম। বলছে, রিসোর্সদের যদ্দুর পারো ইন্ডিয়ায় রেখে কাজ করাও। কোভিডের সময় পেরেছিলে, এখন নয় কেন?
যে ক'জনের ভাগ্যে অফশোরের শিকে ছেঁড়ে তাদের জীবনও দুধ আর মধুর নয়। যা অ্যালাওয়েন্স, তাতে ক’জনে মিলে একটা অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করতে হয়। কঠিন আবহাওয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যাতায়াত করতে হয়। এত কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্দেশ্য শুধু কিছু ডলার জমিয়ে ‘দেশে’ পাঠানো আর এই আশা বুকে নিয়ে ঝুলে থাকা যে এই যুদ্ধের শেষে উন্নত দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ মিলবে।
ক্লায়েন্ট কখনো আমেরিকায় কখনো ইউরোপে। তাদের থেকে মাইক্রো লেভেলে স্পেসিফিকেশন নেওয়া, অনবরত ফীডব্যাকের মাধ্যমে হাজার বায়নাক্কা মেটানো, এসব মিটিং হয় তাদের টাইমে। আর কোডিং সহ সমস্ত কাজ ও বিভিন্ন স্তরের ম্যানেজারের কাছে হিসেব দেওয়ার কাজ হয় ভারতীয় টাইমে। কখনো টিমের সঙ্গে কথা হয় জুমে, কখনো অফিসে মুখোমুখি। ফলে স্থান, কাল ঘেঁটে লাবড়া।
এসব শিডিউলের ফাঁকেও দুর্ভাগ্যবশত স্নান, খাওয়া, টয়লেট, যাতায়াত, সোশ্যাল মিডিয়া, প্রেম ইত্যাদি ব্যক্তিগত কাজকে গুঁজতে হয়। আই-টি বাজিগররা তাই দু'হাতে তিন-চারটে বল সামলাবার দুরূহ চেষ্টায় দিন কাটায়, ‘কাল থেকে সব বদলে যাবে'র দুরাশায় বুক বেঁধে।
অসীম তিনজন ছেলের সঙ্গে শেয়ারে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। রুমমেটরা বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছে। একজন অসীমের কলিগ, বাকি দু'জন অন্য কম্পানিতে। ওরা চারজন পরস্পরের ভালো বন্ধু। কিন্তু অসীম বোঝে, ঐ হ্যাপি-গো-লাকি ছেলেগুলোর সঙ্গে তার ডিএনএ'র কিছু একটু ফারাক আছে।
কিচেন একটা আছে। তবে সেটার ব্যবহার কমই হয়। খাওয়া দাওয়ার জন্য তারা মূলত নির্ভর করে ক্যান্টিন অথবা অন লাইন অর্ডারের ওপর।
তবু অসীম প্রায়ই পোড়া গন্ধ পায়, সব সময় কিচেন থেকেও নয়। অনুমান করতে পারে কী পুড়ছে। কিন্তু সেটা তার মনেই থেকে যায়।
রেশমিও দুটি মেয়ের সঙ্গে শেয়ারে থাকে। বেঙ্গালুরুর রাস্তায় বীভৎস ট্রাফিক জ্যাম, তাই অফিসের কাছেপিঠে থাকলে সুবিধে। কিন্তু তেমন জায়গায় ভাড়াও আকাশছোঁয়া, অগত্যা মধ্যপন্থা।
এই বাস্তবতা বুঝে অবশ্য কম্পানিও কর্মীদের রোজ অফিসে আসতে বাধ্য করে না। রাতের কাজ তো ঘরে বসেই।
অসীম ও রেশমি পরস্পরের ফ্ল্যাটে আসে তবে রাতে থাকে না। দুজনের ফ্ল্যাটেই অবশ্য অন্যান্য রুমমেটদের বি-এফ, জি-এফরা আসে। কখনো সখনো কেউ কেউ নাইট স্টে-ও করে। কিন্তু বারো ভূতের বাজারে, ওদের কেমন রুচিতে বাধে।
“চল, আমরা দুজন মিলে একটা ফ্ল্যাট নিই।” হঠাৎ রেশমিই একদিন কথাটা তুলল। অসীম চমকে উঠল, “এ-খন? মানে, বিয়েটিয়ে ছাড়, আমরা তো এখনো ফর্মালি প্রোপোজই করে উঠতে পারিনি।”
“ওসব সময়মতো হবে, আগে এক ছাদের তলায় তো আসি। ক-ত্ত সুবিধে বল দেখি! ছুটির দিন ডেটিংয়ের জন্য ট্র্যাফিকের ধোঁয়া খেতে হবে না। তারপর আমি তো পাইথনে একটু উইক, তুই বুঝিয়ে দিবি। তারপর কনসেপ্টে তুই গাড্ডু, আমার থেকে আইডিয়া নিতে পারবি। তারপর —”
“তোর ‘তারপর'গুলো থামা। আগে প্রথম স্টেপটার কথা ভাব, অর্থাৎ দুজন আনম্যারেড ছেলেমেয়েকে ফ্ল্যাট কে ভাড়া দেবে? এটা তো ইউরোপ-আমেরিকা নয়।”
“দেবে, দেবে। বেঙ্গালুরুতে আজকাল হয়। আমি খোঁজ রাখছি, তুইও রাখ।”
জুটেও গেল। ওদের কলিগ ভবানীশঙ্করের এক আমেরিকাবাসী কাজিন বেঙ্গালুরুতে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন। সেটা তিনি আপাতত ভাড়া দিতে চান। ভবানীকে বলেছেন, যদি ওর অফিস কলিগরা শেয়ারে নেয় তবে ভাড়ার ব্যাপারে তিনি নমনীয় হতে পারেন। ভব্যসভ্য ভাড়াটে পেলেই হল, যারা ফ্ল্যাটকে ভালো কন্ডিশনে রাখবে আর ক'বছর পর নির্ঝঞ্ঝাটে ছেড়ে দেবে। ভাড়াটেরা ছেলে না মেয়ে তা তিনি জিগ্যেসও করেননি।
“আর আমিও বলতে যাচ্ছি না।” চোখ মেরে বলেছিল ভবানী।
এক আনাড়ি আর এক বোহেমিয়ান ফ্ল্যাটটাকে যতটা পারে গুছিয়ে নিয়েছে। দুজনের দুটো বেডরুম। যেটায় বাথ অ্যাটাচড সেটা রেশমির আর অসীম বাইরের বাথরুম ব্যবহার করে।
রান্নায় দুজনই সমান ‘দড়’। উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে রেশমি কোনোদিন কিচেনে ঢোকেনি। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে অসীম মা আর বৌদির কড়া স্নেহের দাপটে রান্নাঘরের ছায়া মাড়াতে পারেনি।
তা'বলে এখন শিখে নিতে তো বাধা নেই! “দ্যাখ, বাইরে আমরা একদিন যাবই।” রেশমি বলেছিল, “তখন সারভাইভাল কুকিং নিজেদেরই করে নিতে হবে। তার ট্রায়ালের সুযোগ এটাই। এখানে আমরাই সায়েন্টিস্ট, আমরাই গিনিপিগ।”
আর ইউ টিউব, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর, বাড়ির হটলাইন— এসবের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটো গেলও শিখে ঐ সারভাইভাল কুকিং। পরস্পরের রান্নার ব্যাপারে তারা খুব উদার, যা দাঁড়ায় খেয়ে নেয়। লাঞ্চ, ডিনার অনিশ্চিত হলেও ব্রেকফাস্টটা ঘরেই— যে আগে ওঠে সে বানায়।
তারা দুজন ফ্ল্যাট শেয়ার করায় তাদের বাড়িতে যে আলোড়ন ওঠেনি, তা নয়। তবে অনুমান, রেশমির বাবা তার মা'কে আর অসীমের বৌদি ওর দাদাকে ভোগাভাগা দিয়ে কিছুটা বশ মানিয়েছে। তাছাড়া সবাইকে এটা ফলাও করে বলে রাখা হয়েছে, বিদেশে গেলে শেয়ারড অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডর্ম, সব জায়গায় ছেলে ও মেয়েরা মিলেমিশে থাকে। এ ব্যাপারে স্পর্শকাতর হলে বাইরে যাওয়া সমস্যার।
সব মিলিয়ে, দুই বাড়ি ব্যাপারটা মেনে নিলেও দুই তরফ থেকেই চাপ আসছে— তোরা বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে নে। ওরা সরাসরি না করে না, তবে কাজের অজুহাত দিয়ে ক্রমে ব্যাপারটা পেছনে ঠেলতে থাকে।
এসবের পরও তাদের নিজেদের বোঝাপড়াটা থেকে যায়। সেটারও একদিন নিষ্পত্তি হয়ে গেল। সেদিন দুজনেরই নাইট অফ। ডিনারের পর অসীম নাইট ড্রেস পরে বিছানায় যাবার উদ্যোগ করছে, রেশমি এসে ক্যাজুয়ালি বলল, “তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল।”
“কী?” অসীম অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল।
“করবি?”
“অ্যাঁ— এখন?”
“নয় তো কি চল্লিশ বছর পর, যদ্দিনে সব তেল ফুরিয়ে যাবে? হি-হি!”
অসীমও হেসে ফেলল। তারপর বলল, “তদ্দিন কি টানতে পারব? যেভাবে রগড়োফায়েড হচ্ছি, পঞ্চাশের আগেই আমাদের বার্ন-আউট হয়ে যাবে। এক্কেবারে পুড়ে ঝামা।”
“তাহলে তো বুঝছিস সমাজ, সংস্কার, বিয়ে ওসব ফালতু প্রেজুডিসে জীবনের সেরা ক'টা বছর নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।”
“বুঝেছি, বাবা। চল।”
এই পর্দাটা খসে যাওয়ার পর তাদের সম্পর্ক যেন আরো অনেক সহজ হয়ে গেল। তবে রেশমি একদিন অসীমের বুকে মাথা রেখে বলছিল, “দ্যাখ, আমি কিন্তু প্রিকশন নিচ্ছি আর নেব। এখন বা ঐ বিয়েফিয়ের পরও বেবিফেবির আশা রাখিস না।”
“কেন রে?” অসীম একটু আশাহত হয়েছিল।
“মেয়েরা প্রফেশনালি কেন পেছিয়ে পড়ে, জানিস? বিয়ে করার জন্য নয়, মা হবার জন্য। জাপান, কোরিয়া, চিন, জার্মানির ক্যারিয়ার গার্লরা পেছিয়ে পড়তে রাজি নয়, তাই বেবি নিচ্ছে না। শত লোভ আর ভয় দেখিয়েও সরকার কিছু করতে পারছে না।”
“তুইও ক্যারিয়ারে পেছিয়ে পড়তে চাস না, সুতরাং—”, দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসীম বলেছিল, “বেশ, যা ভালো বুঝিস। তবে তুই আমার হাত ছাড়িস না।”
উত্তরে রেশমি শুধু অসীমের দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিয়েছিল।
এভাবে ছেলেমেয়ে দুজনের দিন গড়িয়ে চলল। মাঝেমধ্যে তারা কলকাতা যায়, তবে আলাদা আলাদা। অফিসে দুজনে এক প্রজেক্টে আছে বলে একসঙ্গে ছুটি মেলে না। অসীম রেশমির বাড়ি গিয়ে ওর বাবা-মা'র সঙ্গে পরিচয় করে এসেছে। স্পষ্ট না বললেও তাঁদের চোখেমুখে ঐ অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা— বিয়েটা কবে করছ?
বৌদির শরীর তত ভালো যাচ্ছে না। অসীম মাঝে মাঝে টাকা পাঠায়। দাদা আপত্তি করে, “কী দরকার ছিল? তুই খরচের শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকিস। তাছাড়া তোর ভবিষ্যতও তো আছে।” অসীম উত্তর দেয় না। সে বোঝে, বেশি দরকার ছিল সময় দেওয়ার। দাদা অফিস, হাসপাতাল ওপিডি, টেস্ট ইত্যাদি একা করে উঠতে হিমসিম খায়। কিন্তু এ ব্যাপারে অসীমের হাত-পা বাঁধা, যখন খুশি যেতে পারে না। ইতিমধ্যে এক ডিউটিরত মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠল। তার ঢেউ ভারত তথা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন ডিউটি থেকে ফিরে রেশমি উত্তেজিতভাবে বলল, “জানিস, আজ পশ্চিমবঙ্গের মতো বেঙ্গালুরুতেও বাঙালি মেয়েরা রাত দখলে নামবে। একজন মন্ত্রীর কী দুঃসাহস— বলে, ঐ মহিলা ডাক্তার রাতে ঘরে একা কেন ছিলেন? আমরা আজ রাত দখল করে দেখাব, রাতটা শুধু পুরুষদের নয়।”
ব্যাপারটা অসীম জানত। ওর বন্ধু সুব্রত ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ আন্দোলনের একজন অ্যাকটিভিস্ট। তার ফেসবুক পোস্টিং থেকেই অসীম আপডেটগুলি পায়।
“কিন্তু তুই মাঝরাতে, বেঙ্গালুরুর রাস্তায় —”
“না রে, এখানে বাঙালি আর ক’জন? আমরা এগারোটা থেকে বারোটা একটা মলে জড়ো হব।” বলে একটু ইতস্তত করে রেশমি যোগ করল, “তবে যাব কী করে? অত রাতে উবরে —”
অসীম হেসে বলল, “আমি তোকে স্কুটারে পৌঁছে দেব। আর— মানে, তোদের মেয়েদের ব্যাপার তো— আমি নয় এক ঘণ্টা মলের অন্যদিকে ঘুরঘুর করব। তোকে আবার নিয়ে আসতে হবে তো।”
“দরকার হবে না।” রেশমি নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “তুই আমাদের সঙ্গেই থাকবি। অনেক মেয়ের ভাই, হাজব্যান্ডরাও থাকবে, আরো কেউ কেউ থাকবে যারা আমাদের এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। তুইও তো তাই, বল, তাই না রে?”
“অবশ্যই।” তেমন কিছু না ভেবেই অসীম সায় দিয়েছিল।
সেদিন রেশমি প্রতিবাদ জমায়েতের বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। অসীম তার কয়েকটা ফেসবুকে লটকে দিল। সুব্রত দেখে খুশি হয়ে লিখল, “দেখে ভালো লাগছে, সারা ভারত তথা সারা বিশ্বের থেকে আমরা এই আন্দোলনের সহমর্মিতা পাচ্ছি।”
এদিকে কম্পানিতে ক'মাস ধরেই আশঙ্কার ছায়া। বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির অনিশ্চয়তা, তার সঙ্গে এ-আই নামক নতুন প্রাণীটির আবির্ভাবে আই-টি কর্মীদের মাথার ওপর লে-আউটের খাঁড়া। কম্পানি এখনো অব্দি মুখ খোলেনি তবে তলে তলে ফিসফিস আলোচনা চলছে।
অসীম ভেবেছিল এবার পুজোয় কলকাতা যাবে। কিন্তু রেশমির মা-বাবারও খুব ইচ্ছে মেয়ে পুজোয় বাড়ি আসে, তাই একটু স্বার্থত্যাগ করে অসীম ঠিক করল পরে কখনো যাবে। রেশমি অবশ্য তাড়াতাড়িই ফিরে এল। কিন্তু অসীম তদ্দিনে একটা কাজে জড়িয়ে গেছে।
কিছুদিন পর রেশমি বিষণ্ণ মুখে বলল, “জানিস, ঐ ডাক্তার মেয়েটি বোধহয় সুবিচার পাবে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে।”
অসীম জানে। সে কলকাতার খবর নিউজ পোর্টালে দেখে, সুব্রতর পোস্টিং মারফতও খবর পায়। আইন আইনের পথে এগোচ্ছে, যদিও কোন দিকে তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। অন্যদিকে, আন্দোলনের জোর কমছে। যে বিরাট সংখ্যক মানুষ এগিয়ে এসেছিল তাদের অনেকেই হতাশ হয়ে বা সংশয়ে পড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে, পড়ে থাকছে শুধু কোর গ্রুপগুলি। অসীমেরও এক এক সময় সন্দেহ হচ্ছে— এতগুলি এজেন্সি, সবাই কি ভুল বা মিথ্যে বলছে? নাকি আন্দোলনকারীদেরই বুঝতে কিছু ভুল হয়েছে— ঘটনাটি স্রেফ সাধারণ একটি ক্রাইম?
এই সময়ে সে সুব্রতর কাছ থেকে মেসেজ পেল, “তুই একবার আয়। সুলেখা বৌদির একটা অপারেশন হয়েছে। বৌদি মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল অপারেশন না হওয়া পর্যন্ত তোকে না জানাতে, তাই অ্যাদ্দিন বলতে পারিনি। সব ঠিক আছে, তবু ক'দিনের জন্য হলেও ঘুরে যা।”
মেসেজ পেয়েই অসীম চটজলদি বসের সঙ্গে কথা বলে রেশমিকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেশি রাতের ফ্লাইট ধরে কলকাতা পৌঁছে ভোররাতে কড়া নাড়ল।
দাদা তো অবাক, “কী রে, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ—”
“বলবে তো তুমি! বৌদি এত অসুস্থ, একটা খবর দিলে না?”
“তেমন কিছু নয়।” স্মিত হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল দাদা, “একটা মাইনর অপারেশন, কালই বাড়ি নিয়ে এসেছি। ভালো আছে। এই সামান্য ব্যাপারে আর তোকে বিরক্ত করতে চাইনি। তুই কত বড় কম্পানিতে কাজ করিস, কত দায়িত্ব। আমাদের পরিবারের তুই গৌরব।”
“বৌদি শোয়া, তোমাদের রান্না-খাওয়া চলছে কীভাবে?”
“ঐ, কোনোমতে ভাতে-ভাত করে নিচ্ছি। আর দরকার হলে বুধুর হোম ডেলিভারি তো আছেই।”
“আমি যে ক'দিন আছি, ওসব করতে হবে না। আমি রান্না শিখে গেছি। হেসো না, খেয়ে দেখো।”
“কিন্তু তুই— জানলি কীভাবে? ও, নিশ্চয়ই সুব্রত বলেছে। সত্যি, ও আর ওর বন্ধুরা এ ক'দিন যা করেছে! তা, তুই ছুটি পেলি?”
“ঐ, কোনোমতে। দিন সাতেক আছি। তার মধ্যে দুদিন ছুটি আর বাকি দিনগুলোয় ঘরে বসে কিছু কাজ করব। ও নিয়ে ভেবো না, ঠিক ম্যানেজ করে নেব। তুমি শুধু দেখিয়ে দাও কী কী করতে হবে।”
“যা, আগে সুলেখার সঙ্গে দেখা করে আয়। খুব খুশি হবে।”
দাদার আপত্তি উপেক্ষা করেই অসীম বাজারে এসেছে। দেখা হয়ে গেল সুব্রতর সঙ্গে।
“বাঃ, তুই এসে গেছিস!” সুব্রত পিঠ চাপড়ে বলল, “হয়তো তোর কাজের একটু ব্যাঘাত হল। তবে আমার মনে হয়েছিল, কোনো কাজের জন্য নয়, শুধু মানসিক বলভরসা দেবার জন্য তোর একবার আসা দরকার। অজয়দা বৌদির ওপর খুব নির্ভর করে, একটু ভেঙে পড়েছে।”
“হ্যাঁ, আমি আসায় দাদা অনেকটা জোর পেয়েছে। আমি তো দিন সাতেক আছি।”
“দিন সাতেক?” সুব্রতর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “তুই তো জাস্টিস ফর অভয়া ইস্যুতে পথে নেমেছিলি। কাল গোলপার্ক থেকে ঐ ব্যাপারে একটা মিছিল বেরোবে, চলে আয় না?”
মিছিল! এক মুহূর্তে অসীমের মনে ভেসে উঠল— পুলিশ, লাঠি, জেল। নিদেনপক্ষে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে চিহ্নিত করে পরে ডেকে হয়রানি। চাকরি এমনিতেই টলমল, দিন কয়েক ক্রিমিনাল কেসে ফেঁসে গেলে তো হল! একটু ভেবে সে বলল, “দ্যাখ, তখন তো মানুষ আন্দোলনের সঙ্গে ছিল। আর এখন, সত্যি করে বল তো, আন্দোলনের কঙ্কাল ছাড়া কিছু পড়ে আছে?”
“সেই জন্যেই তো এখন আগুন নিভতে না দেওয়ার চেষ্টাটা এত জরুরি। তখন মানুষ নিজের থেকেই এসেছে। এখন জনে জনে বলতে হচ্ছে, তবু তো অনেকে আসছে।”
“ইচ্ছে রইল।” অসীম একটু কিন্তু-কিন্তু করে বলল, “কিন্তু পারব কি? আসলে জানিস, আমি কলকাতা এলেও ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমে আছি। কাল ঐ সময় বোধহয় অন কল থাকব। তুই বরং— তোদের তো দরকারে লাগে—” বলে কিছু টাকা সুব্রতর দিকে এগিয়ে ধরল।
“ওটা রাখ।” সুব্রত মিষ্টি হেসে অসীমকে জড়িয়ে ধরল, “টাকাটা, হয়ে যায়। আমাদের কিছু মানুষ দরকার ছিল। তুই জুয়েল ছেলে, আমাদের গর্ব। যা, ভালোভাবে কাজ করে এলাকার মুখ উজ্জ্বল কর।”
লম্বা লম্বা পা ফেলে সুব্রত ভিড়ে মিশে গেল, বোধহয় ঐ মানুষ খুঁজতে।
আর তখনই অসীম সেই পরিচিত গন্ধটা পেল— কিছু পুড়ছে। আশপাশে তাকিয়ে অবশ্য কিছু চোখে পড়ল না। পাঁচিলের ওপাশে কেউ টায়ার পোড়াচ্ছে?
আশঙ্কাটা ছিলই। কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তবায়িত হবে, ভাবা যায়নি। শোনা গেল, তাদের গ্রুপ রি-অর্গানাইজড আর রি-সাইজড হবে। সংক্ষেপে, লে-অফ শুরু হবে। ম্যানেজার ভেঙ্কটেশ জনে জনে ডেকে কথা বলছেন। কেউ মুখ কালো করে ফিরছে, কেউ গম্ভীর হয়ে।
যথারীতি একদিন অসীমেরও ডাক পড়ল। ভেঙ্কটেশ মৃদু হেসে বললেন, “বোসো। শুনেছ নিশ্চয়ই, এ-আইয়ের প্রেক্ষিতে আমাদের সামনে নানা নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে আবার অজস্র নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে। এখন এ-আই ক্লাউডের নতুন বাস্তবতাকে মেনে সব বিজনেস সলিউশনকে রি-ওরিয়েন্ট করতে হবে।”
“স্যার, খুলেই বলুন না— আমার চাকরি আছে কি নেই?”
“আহা, অত অধৈর্য হচ্ছ কেন? বলছি না, এটা একটা নতুন অপর্চুনিটি। আমরা একটা জেন-এ-আই টিম তৈরি করছি। তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছি। তাই নাম বাছছিলাম। তবে বুঝতেই পারছ, ছোট এ-আই বোটে তো সবার জায়গা হবে না। যাদের হবে না, তাদের হয়তো কিছুদিনের জন্য বেঞ্চে বসতে হবে।”
কিছুদিন! অসীমের হাসি পেল, চার বা পাঁচ সপ্তাহ বেঞ্চের পর সোজা লে-অফ। তাই সে দুরু দুরু বুকে বলল, “স্যার, আমি—”
“বলছি। আচ্ছা, তুমি আর রেশমি, মানে চ্যাটার্জি, তো লিভ-ইনে আছ?”
অসীম গম্ভীর হয়ে বলল, “সেটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, স্যার।”
“অবশ্যই। কিন্তু এইজন্য প্রসঙ্গটা তুললাম যে তুমি আর মিস চ্যাটার্জি খুব ইন্টিমেট আর তোমরা দুজনে মোটামুটি একই কাজ করছ। তাই তোমরা যদি আপসে ঠিক করে নাও কে থাকবে আর কে আপাতত বসবে, তাহলে ব্যাপারটা সহজে মিটে যায়। অবশ্য আমি রেশমিকেও ডাকতে পারি আর নিতান্ত দরকার হলে নিজেরাও ডিসিশন নিতে পারি।”
ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে অসীমের সামান্যই সময় লাগল। আবার তার মনশ্চক্ষে দ্রুত ছায়াছবি— মাথা নিচু করে দাদার ‘পরিবারের গর্ব’, সুব্রতর ‘জুয়েল ছেলে’ কলকাতা ফিরে বলছে “আমার চাকরিটা আর নেই।’’ অন্যদিকে রেশমি খুশিতে উচ্ছল, “জানিস, আমার স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। শেষ অবধি আমি কাটিং এজে কাজ করব, বিদেশ যাব।” সেই উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভেসে যাবে তার অসীমের হাত না ছাড়ার আকুলতা, শারীরিক উষ্ণতার স্মৃতি। এমন অনেক দৃষ্টান্ত তার চেনাজানাদের মধ্যে রয়েছে। আর হ্যাঁ, সে নিশ্চিত যে যদি সিলেকশনটা ম্যানেজমেন্টের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে ইনোভেটিভ, অ্যাকাডেমিকালি ব্রাইট, স্মার্ট রেশমিই জেন-এ-আই বোটে জায়গা পাবে।
যদি না— যদি না সে এই মুহূর্তটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে!
তাই একটু ভেবে অসীম বলল, “আপনি অবশ্যই রেশমিকে নিতে পারেন। ও ইন্টেলিজেন্ট, স্কলারলি, ইনোভেটিভ— যদিও ও আইডিয়ায় যত দড়, হ্যান্ডস-অন কাজে ততটা নয়। ধরুন, পাইথনটা তো নাকি এ-আইর কাজে খুব উপযুক্ত। কিন্তু এ ব্যাপারে ও সবসময় আমার হেল্প নিয়ে থাকে। আর একটা কথা আপনাকেই বলছি, প্লিজ দেখবেন যেন পাঁচকান না হয়—”
“না না, হবে না, বলো।” উৎসুক ভেঙ্কটেশ মুখটা একটু এগিয়ে আনলেন।
মুচকি হেসে অসীম বলল, “শি হ্যাজ মিসড এ পিরিয়ড। এটা অবশ্যই ও ডিসক্লোজ করবে না। ও চাইবে না এই সামান্য ব্যাপারে ওর এত বড় একটা ড্রিম আপসেট হয়ে যাক। আচ্ছা, তাহলে চলি। জানাবেন। আর ঐ যে বললাম, কথাটা যেন পাঁচকান না হয়।”
বেরিয়ে আসার আগে ভেঙ্কটেশের গম্ভীর মুখ দেখে অসীম বুঝতে পারল, সে ওদের প্রায় পাকা ঘুঁটিটা একরকম কাঁচিয়ে দিয়ে এসেছে।
কিন্তু একটা পোড়া গন্ধ কোত্থেকে আসছে? নাক টানতে টানতে অসীম অনেক খুঁজল, কোনো ধোঁয়া দেখতে পেল না।
অসীম আজ একটু আগে বাড়ি ফিরেছে। টেবিলে ল্যাপটপ খুলে চটুল গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে শিস দিচ্ছে, রেশমি ফ্ল্যাটে ঢুকল। তার মুখ থমথমে।
তবে কি ও এর মধ্যেই ব্যাড নিউজটা পেয়ে গেছে? অসীম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, “কী রে, কী ব্যাপার?”
“শয়তান, ইতর, লায়ার!” রেশমির চোখে আগুন জ্বলে উঠল। তারপর ধরা গলায় “তুই চাইলে কি আর আমি—” বলে প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
সর্বনাশ, ভেঙ্কটেশ ওকে বলে দিয়েছে! তারপর মনে পড়ল— বেরিয়ে আসার সময় ম্যানেজারের রুমের বাইরে ভার্গবকে ঘুরঘুর করতে দেখেছিল। ব্যাটা এক নম্বরের চুকলিবাজ। নিশ্চয়ই সব শুনেছে আর রেশমিকে বলে দিয়েছে। তারপর রেশমি গিয়ে ভেঙ্কটেশকে চ্যালেঞ্জ করতেই সে আর অস্বীকার করতে পারেনি।
অসীম রেশমির দরজার কাছে গিয়ে বলল, “রেশমি খোল। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। আমাকে একটা চান্স দে, তোকে বুঝিয়ে বলছি।” ওদিক থেকে সাড়া নেই।
অসীমের মনের চাপা খুশি মুহূর্তে উধাও। তার মনে ভেসে উঠল, মেয়েটা খুব আদুরে আর অভিমানী। দেরি করে অফিস থেকে না খেয়ে এলে ঢুকেই বলে, “খিদে পেয়েছে। কী বানিয়েছিস রে?”
“রেশমি, খেতে আয়।” সে ডাকাডাকি করতে লাগল। কোনো সাড়া নেই।
এ কী করলাম!
নিজের ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল অসীম। তারপর রেশমিকে একের পর এক মেসেজ পাঠাতে লাগল— প্লিজ, একটিবার বাইরে আয়। আমাকে মাফ করতে পারিস বা না পারিস, একবার বলার সুযোগ দে। ওদিক থেকে কোনো সাড়া নেই।
নিশ্চুপ অসীম বিছানায় শুয়ে রইল। আধো তন্দ্রায় আধো জাগরণে সময় এগিয়ে চলল, মোবাইলে শুধু একটি বিশেষ ‘টুং’ শব্দের ব্যর্থ প্রতীক্ষায়। তারপর এক সময় সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল— চারদিকে পোড়ার উৎকট দুর্গন্ধ।
কী পুড়ছে বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মনুষ্যত্ব। নাকি মনুষ্যত্ব বলে কোনোকালেই কিছু ছিল না— ওটা স্রেফ কিছু দুরারোগ্য আশাবাদীর শবের ওপর স্প্রে করে দেওয়া খানিকটা সুগন্ধী?
কিন্তু তারপরই অসীমের খেয়াল হল বিমূর্ত কিছু নয়, পুড়ছে কোনো পার্থিব বস্তু আর কাছেই। বড় বড় করে নাক টানল— রেশমির ঘরে!
কী সর্বনেশে কাণ্ড করছে পাগলিটা? অসীম দৌড়ে গিয়ে দরজায় নক করল তারপর পাগলের মতো ধাক্কাতে থাকল। দরকার ছিল না, দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে রেশমি নিজেকে নয়, ওর সার্টিফিকেটগুলি পোড়াচ্ছে।
“পুড়িয়ে দেব, সব পুড়িয়ে দিয়ে যাব। এই জঘন্য জায়গায়, জঘন্য লোকেদের সঙ্গে থাকব না। ফিরে গিয়ে ইউ-টিউব করব।” হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার করতে করতে বলছিল রেশমি।
অসীম প্রথমে দৌড়ঝাঁপ করে আগুন নেভাল। তারপর রেশমিকে জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিল। রেশমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল।
“প্লীজ, প্লীজ, এই জঘন্য লোকটাকে একটিবার মাফ করে দে।” সজল চোখে বলল অসীম, “আমিই ফিরে যাব। তুই এভাবে পচে মরার জন্য জন্মাসনি— তুই এগিয়ে যা, অনেক দূর যা। কিন্তু যেখানেই যাস, আমাকে ছেড়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।”
রেশমি বিবশ স্বরে বলল, “চল, আমরা এই নরক ছেড়ে পালিয়ে যাই। দুজনে মিলে ঠিক কিছু একটা হয়ে যাবে। এখানে থাকলে আমরা অমানুষ হয়ে যাব।”
“সেসব কাল সকালে ভাবা যাবে। এখন একটু রেস্ট নে।”
অসীম রেশমিকে শিশুর মতো পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। তার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে কপাল থেকে থেকে সরিয়ে দিল এলোমেলো কয়েক গোছা চুল।
“আমাকে ডাকিস না। ব্রেকফাস্টটা ঢাকা দিয়ে রেখে তুই বেরিয়ে যাস।” বলেই রেশমি তলিয়ে গেল অপরিসীম ক্লান্তির ঘুমে।
আর অসীম ঘরে এসে শুয়ে শুয়ে আধা ঘুমের ডিলিউশনে দেখছে, সে কাল রেশমি ওঠার আগেই বসের কাছে গিয়ে রেজিগনেশনটা জমা দিয়ে বলছে, “আমি যা বলেছিলাম সব মিথ্যে, স্রেফ প্রফেশনাল জেলাসি। রেশমি চ্যাটার্জি আপনার টিমের সেরা অ্যাসেট, জেন-এ-আইয়ের কাজে সবচেয়ে উপযুক্ত।”
তারপর বাড়ি ফিরে বুক ফুলিয়ে বলছে, “আমার চাকরিটা নেই। কিন্তু হাত-পা, মাথা তো আছে, ঠিক কিছু একটা জুটিয়ে নেব। নাহলে বাড়ির ফাঁকা জায়গায় মুর্গির চাষ করব।”
আর সবশেষে সুব্রতর কাছে গিয়ে বলছে, “তোরা মানুষ খুঁজছিলি, দ্যাখ তো আমাকে মেজেঘষে নিলে চলবে কিনা?”
পরক্ষণেই আবার ঝটকায় উঠে বসে ভাবছে, কাল ভোরের প্রখর আলোয় পারবে তো এই সাহসের চিলতেটুকু ধরে রাখতে? পারবে শেষ অবধি এই উৎকট পোড়ার দুর্গন্ধটাকে ম্যানেজ দিতে?
কে জানে! বৌদিকে খুব মিস করছে।