• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • কালবিন্দু : অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়

    ম্যাপ দেখে দেখে ভরত যেখানে এসে গাড়িটা দাঁড় করালো সেটা মেট্রোরেলের একটা কনস্ট্রাকশান সাইট। মেট্রো কলকাতা থেকে উত্তর দক্ষিণে ছড়াতে ছড়াতে হয়তো একদিন কল্যাণী কি নৈহাটি পৌঁছে যাবে। পিছু পিছু কলকাতা শহরটাও।

    আপাতত উত্তর শহরতলীর একটা পানাভর্তি দিঘির পাশে ইতস্তত পড়ে আছে সিমেন্ট মিক্সার। বালি, স্টোনচিপের স্তূপ...সিমেন্ট ব্লক। সাইটটা অবশ্য ফেনসিং দিয়ে ঘেরা। হেলমেট পরা লেবার, অফিসারদের আনাগোনা। জমি-বাড়ি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে মনে হয়,... খাঁ-খাঁ করছে খালি বাড়ির কঙ্কালগুলি। একটা বিজন শহরতলী অপেক্ষা করে আছে যেন।

    মোবাইলে মেসেজটা আরেকবার দেখল দুলাল। ঠিকই তো আছে। তাহলে কোথায় যেতে হবে? এলোমেলো চিন্তা এল মাথায়...নিজেও সে ব্যবসায়ী, এই জমি-বাড়ির লাইনেই...এটা কোনো ফাঁদ নয় তো! চোয়াল শক্ত হল, এতদূর এসে একটা ফয়সালা না করে যাবার কথা ভাবতেও পারে না, তখনই সাইটের পাশ দিয়ে গলিটার একদম মুখে, একটা ছোট হলুদ বোর্ডে মোবাইল নাম্বারটা লেখা দেখতে পেল। পাশে শুধু লেখা, এইদিকে আসুন।

    গাড়ির সামনের সীটের পেছনের পকেটে দৈনিক জনকন্ঠের কপিটা রাখা ছিল, দুলাল মিলিয়ে দেখল আবার। একটা ছোট্ট ইনসার্ট, ২০ বছর পরের কথা জানুন, সঙ্গে একই মোবাইল নাম্বার। সে নিজে গাড়ি থেকে নামল। রিঙ্কুও নামতে যাচ্ছিল, দুলাল মানা করল। পথি নারী বিবর্জিতা। দাদু নাকি বলত, অবশ্য রেগে গেলে। মুখে বলল, তুমি আর নেমো না, সোজা মলে চলে যাও, আমিও একটা কাজ চট করে সেরেই আসছি। রিঙ্কু আপত্তি করতে যাচ্ছিল, দুলালের মুখের ভাব দেখে আর কিছু বলল না।

    দুলাল ভরতকে বলল, যা, বৌদিকে সিটি মলে নিয়ে যা, ওখানেই পার্ক করবি। আমি অটো না পেলে তোকে ডাকব নাহয়।

    ভরত অবাক হয়ে তাকাল। সাধারণত সে ছায়ার মত সঙ্গে সঙ্গে থাকে সাহেবের। আজ নয়, বছর বারো তেরো হল। বৌদিও, সাহেবের সঙ্গে ভরত থাকলে নিশ্চিন্ত হয়। কিন্তু আজকাল সাহেবের মতিগতি সে বুঝতে পারছে না।

    সজলবাবা খুব ভুগছে ঠিকই। সাহেবের মাও শয্যাশায়ী। কিন্তু সেরকম ফিটের রোগ থেকে জ্বরজারি, বাতের ব্যথা থেকে বুড়ো বয়সের রোগ...কোন ঘরে নাই!

    তা বলে জ্যোতিষ? হাতে আঙটি? গত একবছরে সাহেবের সঙ্গে কত মঠ মন্দির দরগায় যে গিয়েছে...সাহেব এরকম ছিল না। সে একদম শূন্য থেকে ব্যবসাটা দাঁড় করিয়েছে এত বছর ধরে। বৌদি কেন যে কিছু বলে না!

    আজকেও বৌদি গম্ভীর হয়ে কালো চশমায় চোখ ঢেকে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।

    ভরত আর কী করবে। তবে সাহেবের কাছে একটা রিভলভার আছে। কাগজ করিয়ে নেওয়া, ক'বছর আগে একটা হুমকির পর এইসব বন্দোবস্ত।

    সে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

    কাগজের দ্বিতীয় পাতায় বিজ্ঞাপনটা দুলালের নিয়মিত ব্যস্ততার দিনে চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু আজকাল সে একটু ঢিল দিয়েছে। সজলের আকস্মিক অসুস্থতা তার জন্য খানিকটা দায়ী। আজকাল ঘন ঘন সজলের খিঁচুনি উঠছে, মুখে ফেনা, চোখ উল্টে যাচ্ছে। রিঙ্কু একা আর পেরে ওঠে না, পনেরো ষোলোর বাড়ন্ত কিশোরকে শারীরিক ভাবে আগলে রাখা ছোটখাটো চেহারার মা'র দ্বারা সম্ভবও নয়। সেকারণেই সজলের হাবভাবে বেগতিক দেখলেই, দুলাল আর আপিসে না গিয়ে ঝড়ের প্রতীক্ষায় থাকে।

    দুলালের মা একটা প্যারালিটিক এ্যাটাকের পর শয্যাশায়ী। দু-বেলা দুটি আয়ার ভরসায় তাঁর দেখাশোনা চলে। কাজেই অধিকাংশ দিনই সকালে কাগজটা দুলাল ধীরেসুস্থে পড়ে। জ্যোতিষের কলমগুলিও আজকাল নানা রকম যোগের কথা লেখে...গজকেশরী যোগ...অমৃতযোগ...ঠিক বিশ্বাস না, কিন্তু এক অমোঘ আকর্ষণের টানে সে পডে যেতে থাকে। ওই যে বলে, নিয়তি কেন বাধ্যতে, কী হবে আগাম জানতে পারলে বড় ভাল হত।

    রিঙ্কু ব্যপারটা লক্ষ্য করেছে, মানুষটা যে কী বিপুল চাপের মধ্যে আছে সে-ই জানে, তাই প্রথমদিকে গা করেনি। কিন্তু সজল ভালো নেই এই অছিলায় দুলাল যখন টানা পনেরোদিন আপিসে গেল না, তার টনক নড়ল।

    —কী ভেবেছো? ব্যবসাটা তুলে দেবে? সজলের কি রোজ ফিট হয়?

    —আরে না না, আপিসে প্রদীপ আছে, বাসুদেব আছে... ওরা সামলে নেবে।

    —সে এক-আধদিন না হয় সামলে নেবে। কিন্তু নিজের জিনিষ নিজে না দেখলে হয়?

    ধ্যাতানি খেয়ে দুলাল বের হয়। কিন্তু বেরিয়ে ভরতকে বলে ঠনঠনে কালীবাড়ির পাশের গলিতে চল। দেখা গেল, কোনো গণৎকারের সাইনবোর্ড। কিম্বা হয়তো বলল, বাঁশতলা লেন চিনিস? ওখানে নাকি সিংহনিয়া বলে এক মস্ত জ্যোতিষীর চেম্বার। এরকম আরো কত, অমুক মা, তমুক তন্ত্রাচার্য।

    ভরত মাথা হেলিয়ে হুকুম তামিল করে। আবার ফিরে এসে বৌদিদিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্টও করে। ধরা পড়ে দুলাল অপ্রতিভ হয়। কিন্তু লাভের লাভ পরের দিন রিঙ্কু আর তাকে কাজে যাওয়ার তাগাদা দেয় না।

    দুলাল নিশ্চিন্তে বাড়তি এক কাপ চা-সহ আবার খবরের কাগজ নিয়ে বসে, ধীরেসুস্থে দাদের মলমের বিজ্ঞাপন অব্দি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে, মাঝের পাতা, দ্বিতীয় পাতা... সেরকম একদিনই এই অদ্ভুত আহ্বান নজরে পড়েছিল। অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে মোবাইল নাম্বারটায় একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছিল, এবং গাড়ির সীট পকেটে কাগজটা রেখে বেমালুম ভুলেও গিয়েছিল। মোবাইল নাম্বারটা সেভ করেছিল ফিউচার বলে।

    সেদিন থেকেই সজলের আবার বাড়াবাড়ি শুরু হয়... যাকে এপিলেপটিক সিজ়ার ভাবা হচ্ছিল ততদিনে ডাক্তাররা তাকে অন্য কিছু বলে সন্দেহ করলেন... রিঙ্কুর একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন মত হল। দিন দশেকের মধ্যেই সজলকে রি-হ্যাব কেয়ারে দেওয়া ছাড়া উপায় রইল না।

    সজলকে রি-হ্যাবে রেখে ফেরার পথে, মোবাইলে একটা মেসেজ এল। একটা তারিখ, একটা ম্যাপ নির্দেশিকা। ব্যস। যেন এই তো সময়। চটজলদি মোবাইলেই দেখে নিল দিনটা একটা রবিবার। রিঙ্কুকে বোঝাল, মা'কে কয়েকঘন্টা শিবানীই সামলে নেবে, দক্ষ আয়া সে। চলো, আমরা একটু ঘুরে আসি...নতুন একটা মল হয়েছে কাগজে দেখলাম।

    রিঙ্কুর আপত্তি করার মত কোনো কারণ ছিল না।

    শিবানীও অভয় দিল, ঘন্টা চার-পাঁচ মা-জিকে দেখে রাখা কোনো ব্যপার না তার কাছে।

    পাড়াটা পরিত্যক্ত ফিল্ম সেটের মত নির্জন। অনেক বাড়ির কাঠের দরজা-জানালার পাল্লা পর্যন্ত খুলে নিয়েছে। ঠিক কোন বাড়িটা তার গন্তব্য জানার জন্য দুলাল মোবাইলের শরণাপন্ন হল, কিন্তু, আশ্চর্য, ঠিক তখনই ফোনের কৃত্রিম কন্ঠস্বর জানাচ্ছে, আপাতত এই নাম্বারে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

    জিজ্ঞাসা করার মতও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘোরার পর যখন সে ফিরে আসবে কি না ভাবছে তখনই একটা বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ ভেসে এল।

    বেশ পুরনো বাড়ি। লোহার গেট, বাগান, পোর্টিকো। যা থাকে কপালে ভেবে গেট খুলে ভেতরে ঢুকল। মোরামের রাস্তার দুপাশে এককালে বাগান ছিল হয়তো। আপাতত দুটো ঘুঘু পাখি, গু-র্-র্ গু-র্-র্ আওয়াজ করে কিছু গভীর বিষয়ে আলোচনা করছে, তাকে দেখে উড়ে পাঁচিলে গিয়ে বসল।

    দরজায় পুরনো আমলের কলিং বেল। দু-একবার বাজানোর পর ভেতর থেকে নড়াচড়ার শব্দ এল যেন। ভারী শরীর নিয়ে কষ্টকর নড়াচড়ার মত। দরজার খিল সরল, দরজা খুলে গেল, এক বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে, শাড়ী হিন্দুস্তানীদের মত, সামনে আঁচল ফেলে পরা, হাতে উল্কি, এক ঝলকে বোঝা গেল না কীসের।

    —আমার, হামকো আনা থা, মেসেজ মিলা থা।

    মহিলা গভীর অভিনিবেশে তাকে দেখছিলেন। দুলাল আবার বলে,

    —ঠিকানাটা, মানে পতা...

    —আপনি বসেন, দাদাবাবু আসছেন। হিন্দুস্তানী টানে, কিন্তু স্পষ্ট বাংলায় মহিলা বললেন।

    রেকর্ড ততক্ষণে বেজে থেমে গিয়েছে। বোঝা যায় গৃহকর্তা এখানেই ছিলেন, কিছুক্ষণ আগেও। তবু দরজাটা নিজে খুললেন না কেন!

    দুলাল সোফায় বসে ঘরের চারধারে চোখ বুলিয়ে চমকে উঠল...কেন জানি না, ঘরখানা তার যেন অতি-পরিচিত মনে হয়। এমনকি ওই রেকর্ড-প্লেয়ারের মডেলটাও। ইন ফ্যাক্ট, একই মডেলের দাদুর যন্ত্রটা তার কাছেই রাখা আছে সযত্নে। যদিও এই ডিজিটাল যুগে তাকে কদাচিৎ বের করা হয়, ঝেড়ে-পুঁছে আবার যথাস্থানে রেখে দেওয়ার জন্য।

    চটির আওয়াজে তাকে সচকিত করে গৃহকর্তা এলেন। সত্তর-পার বৃদ্ধ, সাদা টী-শার্ট, সাদা ধুতি লুঙ্গির মত করে পরা। দুলালকে নমস্কার জানিয়ে বসলেন তার উল্টোদিকে। দুলাল শশব্যস্তে মোবাইল বের করে মেসেজটা দেখাতে যাচ্ছিল, উনি হাত তুলে তাকে নিরস্ত করলেন, মুখে বললেন, জানি। বসুন, চা খাবেন তো? বলেই গলা তুলে বললেন, একটু চা দিও তো মাঈ।

    বৃদ্ধের মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, লোনা জল-হাওয়ায় বিধ্বস্ত নাবিকের মত ভাঙচুরের দাগ, নুয়ে পড়া কাঁধ, তবু দুলালের মন এক আশ্চর্য মায়ায় ভরে আসছিল। নিজের দাদুর কথা মনে পড়ছিল...কাছে গিয়ে দাঁড়ালে দাদু তার মাথার চুল একটু ঘেঁটে এলোমেলো করে দিত। সেই রকমের কিছু।

    বৃদ্ধ বললেন, কী জানতে চান? কেনই বা জানতে চান? আসলে অতীত বা ভবিষ্যৎ বলে কিছু কি আছে?

    —নেই? আমার ছেলেটার এ অবস্থা হল কী করে? আগে তো কোনো লক্ষণ ছিল না এসবের?

    —হয়তো জীনের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে এর রহস্য। আপনার, আপনার স্ত্রীর ...বা হয়তো দুজনেরই...বলা তো যায় না।

    —তাহলে আগে থেকে জানলে তো আটকানো যায়...

    —হয় তো নয়, হয় তো এর রহস্য লুকিয়ে আছে ওর শৈশবে, স্ট্রেস...কোনো ট্রমা...বা হয় তো এসব না হয়ে সম্পূর্ণ অন্য কোনো রোগ-জারি, সমস্যা দেখা দিত...কত জোড়া অতীত ভবিষ্যতের জের তুমি সামলাতে?

    দুলাল আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসাটা লক্ষ্য করে না। তার রোখ চেপে গেছে, এর একটা হেস্তনেস্ত আজ করতেই হবে। সে ঝাঁঝিয়ে ওঠে...

    —এক জোড়া মানুষের আবার কত জোড়া অতীত ভবিষ্যৎ হবে?

    —ভেবে দেখো। বৃদ্ধ প্রশ্রয়ের হাসি হাসছেন। পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতা পিতামহী, প্রপিতামহী... স্রেফ তিন প্রজন্মে কতজন মানুষের উত্তরপুরুষ তুমি হিসেব করেছো? তাও তো আমার মাতামহ, মাতামহী, প্রমাতামহ, প্রমাতামহীদের ধরতে ভুল হয়ে গেছে...তাহলে?

    ভবিষ্যৎ তো আরও গোলমেলে। তুমি জীন ছেঁটে ফেলতে গেলে, রোগ নিয়ন্ত্রণ হয়তো হল, কিন্তু ছেলে হয়ত বিশ্ববিখ্যাত দাবাড়ু কি বিজ্ঞানী হতে গিয়েও হল না। ভেবে দেখো, আমরা আসলে এক মুহূর্তের বর্তমান ছাড়া কিচ্ছু নই। গ্রাম থেকে এসে আসানসোলের দিকে যাও, গাড়ি বদল করে বোলপুর যাও, হাওড়া যাও...এক লহমার বর্ধমান স্টেশন।

    হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু দুলালের নিঃশেষিত লাগছিল। যেন সহ্যবিন্দুর শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে।

    মহিলা ঢুকলেন চা, বিস্কুট নিয়ে। হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক তখনি ভেতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ এল। দুলালের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বৃদ্ধ বললেন, আমার স্ত্রী। কয়েক বছর বিছানাবন্দী। আগে চা খাও, তারপর যাও, দেখে এসো, পাশেই ঘর...কাজের মেয়েটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল, যেন গেলে অসুবিধে নেই।

    বৃদ্ধ উঠে গিয়ে আবার রেকর্ডপ্লেয়ার চালিয়ে দিলেন...অতীত সুবাস ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে।

    কোনোরকমে চা-টা শেষ করে দুলাল অনুমতি চাইল, পাশের ঘরে যাবার। না গেলে যেন চলত না, যতই বাড়াবাড়ি মনে হোক। বৃদ্ধ নির্বিকার।

    শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে ঘরের কাঁচের আলমারীর পাল্লায়। সারা দেওয়ালে তার বিচ্ছুরিত আলো বিভ্রান্ত মৃগীর মত থমকে আছে।

    ঘরের মাঝখানে বিছানায় এক বৃদ্ধা শুয়ে। একটু আগে এঁর গোঙানির আওয়াজ শোনা গেলেও এখন কষ্টের কোনো ছাপ নেই। ঘুমোচ্ছেন। বিছানার নিচে বেডপ্যান ইত্যাদি রাখা। কিন্তু সব টিপটপ, পরিষ্কার।

    সে ফিরে আসে। বৃদ্ধ যেন তারই অপেক্ষায় ছিলেন, বললেন, কিছু বুঝলে?

    —কী বুঝব?

    —ছেলেটা ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। তাকে দুই হাতে আগলে রাখতে হয়েছে, অনেক মূল্য দিয়ে, তবে সে আজ...

    দুলাল বুঝতে পারে না এর থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা যায়।

    বৃদ্ধ নিজের মনে বলে চলেছেন, গত একবছর জেরবার হয়ে গেছিলাম, তাই এই ভুল হয়ে গিয়েছে। কোনো প্রয়োজন ছিল না এসবের। আমি তো জানি, ছেলেকে সামলে রাখতে গিয়ে খেয়াল করিনি, ছেলের মা এই চাপ আর নিতে পারছে না, তার মনে কালো ছায়ারা ফিরে ফিরে আসছে বারবার...

    তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হাতে ইশারা করলেন নিচু সাইডবোর্ডে রাখা একটা ছবির ফ্রেমের দিকে।

    —আমাদের ছেলে, জ়ুরিখে থাকে।

    দুলাল এগিয়ে গিয়ে ছবিটা তুলে দেখল। এক যুবক, এক যুবতী আর একটি ফুটফুটে মেয়ে। দুলালের বিশ্ব-সংসার দুলে উঠল, সে চিনতে পারল। সজল, কয়েক বছর পরের চেহারা। সঙ্গের যুবতী আর শিশুটি, তার মানে, সজলের স্ত্রী-কন্যা!

    বিছানায় শুয়ে উনি তাহলে কে?

    বৃদ্ধ বলে যাচ্ছিলেন, আমারও ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা কেউ স্থায়ী না, আসলে আমাদের মাঝে আছে এক বর্তমান যে পালটে পালটে যাচ্ছে...না বুঝে কাগজের বিজ্ঞাপনটায় সাড়া দিয়ে ফেলেছিলাম। বলতে বলতে বৃদ্ধ তার দিকে একটা দৈনিক জনকন্ঠের কপি বাড়িয়ে ধরলেন, দ্বিতীয় পাতাটা খোলা।

    চোখে অন্ধকার নেমে আসার আগে দুলাল একঝলক দেখল ইনসার্টটা, আপনি কি নিজের অতীতকে ফিরে পেতে চান একটিবার, যোগাযোগ করুন, তারপরে ওই একই মোবাইল নাম্বার, যেটায় ফোন করলে একটা যান্ত্রিক কন্ঠস্বর নিশ্চিত বলবে, এই নাম্বারের সঙ্গে আপাতত যোগাযোগ সম্ভব নয়।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments