• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | রম্যরচনা
    Share
  • সারথি কথা : মৌসুমী ভট্টাচার্য্য

    (১)

    আমি বললাম সারথি, আপনি বলতে পারেন চালক, কিংবা সোজাসাপটা ড্রাইভার। এদিক-ওদিক যেতে আমাদের সবাইকেই কোনো না কোনো সময় সারথির ওপর ভরসা করতে হয়। আপনার পাকাপাকি সারথি থাকলে একরকম। আবার পথ চলতি ট্যাক্সি কিংবা আজকালকার অ্যাপ-ক্যাব হলে ব্যাপারটা অন্যরকম। কলকাতার রাস্তায় এতকাল একচ্ছত্রভাবে দাপিয়ে বেড়াত হলুদ ট্যাক্সি। যেন জিম করা পেটাই চেহারা! এখন তাকে টক্কর দিতে রাস্তায় নেমেছে অনেক সৌখিন প্রতিযোগী। তাদের সারথিরা আবার বেশ টেক-স্যাভি। ধোপদুরস্ত। বয়সও কম। তবে তারা তেমন গোপ্পে নয়। গল্প জমে হলুদ ট্যাক্সির সারথিদের সঙ্গে। এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা বেশ মজার। হলুদ ট্যাক্সিতে সপরিবারে চড়লে সারথির পাশে বসে আমার স্বামী প্রথম প্রশ্নটি করবেন, "আপনার গাড়ি কি সাউথের?" উত্তর 'নর্থ' হলেই পরের প্রশ্ন ধেয়ে আসবে। "নর্থ-এ কোথায়? আমি তো বাগবাজারে বড় হয়েছি।" তাতে সারথির কিছু যায় আসে না। তবে সওয়ারি তাকে যেন আপন জ্ঞাতি ভেবে পরের প্রশ্নে যায়, "অরিজিনাল বাড়ি কোথায়?" বেশিরভাগ সময়েই সারথিদের উত্তরটা হয় "বিহার"। আর তার পরেই আমি আর আমার ছেলে চোখে চোখে হাসি। কারণ পরের প্রশ্নটাই হবে, "বিহারে কোথায়, ছাপড়া?" যেন ছাপড়া ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই বিহারে। এরপর সবিস্তারে চলে তার গ্রামের খোঁজখবর। ওখানকার সামজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির হালচাল বোঝা। তবে বাবার হিন্দি কথোপকথন শুনে পিছনে বসে ছেলে খুব মজা পায়। এবং সেই ভয়ঙ্কর হিন্দি শুনে সারথিরা বাংলায় উত্তর দিতে শুরু করেন। ওই বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই, আরো অনেক গল্প জানা হয়ে যায়; সারথি কত বছর হল কলকাতায়, গাড়িটা নিজের কিনা, আজকাল হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশনে পুলিশের কেমন জুলুমবাজি, ইত্যাদি। বাড়ি ফেরার সময় হলে তো কোনো চায়ের দোকানে থামা এবং সারথিকে নিয়ে একসাথে ভাঁড়ে চা-খাওয়া বাঁধা। অ্যাপ-ক্যাবের কথা বিশেষ বলতে পারবো না, তবে কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চড়লে আপনার একজন আলাপী, হৃদয়বান এবং মানবিক সারথি পেয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। মাঝরাতে একা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফেরার সময়, কিছু না বলতেই লাগেজটি ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান বোধহয় শুধু কলকাতার সারথিরাই। অন্তত আমার এ অভিজ্ঞতা আছে। আছে কৃতজ্ঞতাও।

    (২)
    আমি নিজে যখন সারথি, তখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, ব্যাপারটার মধ্যে বেশ লিঙ্গবৈষম্য আছে। মহিলা ড্রাইভার বলে রাস্তায় যেমন কখনো কখনো অকারণ গালমন্দ শুনেছি, তেমনি আবার কোনো গ্রামের পথে চা খেতে থামলে ড্রাইভার-ম্যাডামের জন্যে বাড়তি খাতিরও দেখেছি। একবার তো ভাঙড়ের একজন চায়ের দোকানের দাদা গদগদ হয়ে বলেই বসলেন, "ম্যাডাম তো পাইলট!" বলেন কী! পাইলট! আর একবার ঝাড়গ্রাম গেছি। লোধাশুলির জঙ্গলের ধারে গাড়ি থামিয়ে ছোট্ট ঝুপড়ি এক চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে দোকান মালিকের সাথে দু-দণ্ড গল্পগাছা হল। চা শেষ করে গাড়িতে উঠতে যাব, তিনি আমায় বললেন, "বোন, ছাতু খাবে? নিয়ে যাও, দাম দিতে হবে না। এ ছাতু শুধু বর্ষাকালেই এই জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যায়।" বলে এত্তখানি এক প্যাকেট ভর্তি মাশরুম দিতে চাইলেন। আমি অপ্রস্তত। বুঝলাম বড় আবেগ থেকে উনি আমায় দিতে চাইছেন, নিলে খুশি হবেন। কিন্তু আমি তো হোটেলে থাকবো এখন ক-দিন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সে তো খারাপ হয়ে যাবে। তাই সবিনয়ে জানালাম, পরের বার এসে নিশ্চয়ই নেব, এবার থাক। পরে জানলাম ওই বিশেষ মাশরুমটি নাকি দুষ্প্রাপ্য এবং যেটুকু বাজারে আসে, সাংঘাতিক চড়া দামে বিকোয়। অতখানি মাশরুম বাজারে বিক্রি না করে আমায় দিয়ে দিতে চাইছিলেন গ্রামের ওই গরীব মানুষটি! পথের ধারে এমনভাবে ছড়িয়ে থাকে কত ভালবাসা! কুড়িয়ে নিতে পারলে ঝুলি উপচে পড়বে!

    একবার শান্তিনিকেতন যাচ্ছি। প্রায়ই যাই। সে-বার দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে সাংঘাতিক জ্যাম থাকায় ট্র্যাফিক পুলিশ বর্ধমান শহরের দিকে আমার এবং আমার পিছনের গাড়িগুলোকে ঘুরিয়ে দিলেন। স্বভাবতই সে পথ আমার অচেনা লাগছে। কিছুদূর গিয়ে একটা চৌমাথায় এসে কোনদিকে বাঁকতে হবে তা নিয়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে এক বাইক আরোহীকে জিজ্ঞেস করলাম "শান্তিনিকেতন যাব, নবাবহাটের মোড়টা কোনদিকে?" উনি বললেন, "আমাকে ফলো করুন।" ভাবলাম ফলো করার কী আছে! বলে দিলেই তো হয়! তারপর দেখলাম সেই নীল শার্ট পরা বাইক আরোহীটি আমার সামনে সামনে চলেছেন। চাইলে উনি কাটিয়ে-কুটিয়ে এগিয়ে যেতেই পারতেন। কিন্তু না, আমাকে পথ দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। তাই প্রত্যেক তেমাথা বা চৌমাথায় ধীরে চালাচ্ছেন বা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন, যাতে আমি ওঁকে হারিয়ে না ফেলি। আমি সেই নীল শার্টকে লক্ষ্য করে করে পৌঁছে গেলাম নবাবহাটে, আমার চেনা মোড়ে। কাঁচ নামিয়ে ধন্যবাদ দিলাম। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গতি বাড়িয়ে সোজা চলে গেলেন তিনি। আমি চললাম ডান দিকে, শান্তিনিকেতনের পথে। পথে বেরোলে এমন কতই না অবাক করা গল্প জমা হয়! এই শান্তিনিকেতনের পথেই আর একবার অন্য এক অভিজ্ঞতা। বোলপুরে ঢোকার আগে ভেদিয়া বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানে রেললাইনের তলা দিয়ে সরু একটা রাস্তা। একটি করে গাড়ি সেখান দিয়ে যেতে পারে। তাই যানবাহনের লম্বা লাইন পড়ে যায় ওইটুকু রাস্তা পার হতে। জায়গাটা সাধারণ রাস্তার থেকে বেশ অনেকটা নিচু। আর বর্ষাকালে অজয় নদের জল বাড়লে সে রাস্তা জলে ডুবে যায়। সে পথে তখন যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই দুর্ভোগ কাটাতে ওখানে একটা উড়ালপুল তৈরি হচ্ছে। হচ্ছে তো হচ্ছেই। সরকারি কাজের যেমন গতি আর কী! সে-বার শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময় দ্বিধায় ছিলাম। ভরা বর্ষা, ভেদিয়ায় জল জমে থাকলে কী করব! আগেই কি তবে অন্য রাস্তা ধরব? এসব ভাবতে ভাবতেই চলেছি। ভেদিয়ার বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার আগে রাস্তার চায়ের দোকানে চা খেতে থেমেছি। দেখলাম, রাস্তার উল্টোপারে একটা বাইক এসে থামল। বাইকের দুই আরোহী বাইক থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। মনে হল ওঁরা হয়ত ভেদিয়ার দিক থেকেই আসছেন, জানলেও জানতে পারেন, জল জমেছে কিনা। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে ওঁদের জিজ্ঞেস করলাম, "দাদা, আপনারা তো ওদিক থেকেই এলেন, ভেদিয়ায় জল জমেছে নাকি?" ওঁদের একজন সঙ্গে সঙ্গে জানলেন, "ভেদিয়ায় তো উড়ালপুল চালু হয়ে গেছে। আপনার চিন্তা নেই। বড় লরি এখনো যেতে দিচ্ছে না, তবে সব ছোট গাড়ি এখন উড়ালপুল দিয়েই যাচ্ছে।" বললাম, "মাস তিনেক আগেও যখন গেছি, পুলের কাজ অনেকটাই বাকি ছিল। কবে চালু হল?" বাইক আরোহী তৎক্ষণাৎ জানালেন, "এই তো তিন-চার দিন হলো।" আমি আনন্দে ডগোমগো হয়ে রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে ফিরে এলাম এবং সবাইকে সুখবরটি দিলাম। চা খেয়ে নিশ্চিন্তে চললাম এবার। ভেদিয়ায় এসে দেখলাম, তিন মাস আগে পুলের যতটুকু কাজ দেখেছিলাম, এখনো প্রায় ততটুকুই আছে। শূন্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে উড়ালপুলের কয়েকটা পিলার। কোথাও গর্ত খোঁড়া হয়েছে নতুন পিলারের জন্যে। আর অজয়ের জলে টইটুম্বুর রেললাইনের নিচের রাস্তা। বুঝলাম আমায় বোকা বানিয়েছেন বাইক আরোহীটি। রাগ হল খুব। আমি মহিলা-ড্রাইভার বলেই কি এমন রসিকতা? মানুষকে আতান্তরে ফেলে কী আনন্দ পেলেন উনি! আর প্রশ্ন করা মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে বানিয়ে বানিয়ে কেউ যে এমন অকারণ মিথ্যে কথা বলতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে! মাথা ঠান্ডা হলে ওই মানুষটির মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টা করছিলাম। অনেক আগে পড়া কাজুও সাকাই-এর 'দ্য আর্ট অফ লাইং' বইটার কথা মনে পড়ছিল। মিথ্যে কথার মধ্যেও নাকি এক শৈল্পিক সুষমা আছে। এবং 'লাইস মেক দ্য ওয়ার্ল্ড গো রাউন্ড'। মিথ্যেই পৃথিবীর চালিকা শক্তি! নাহ্! তা কী করে হবে! তাহলে তো নীল শার্ট দাদা মিথ্যে! মাশরুম দাদার মুগ্ধতাও মিথ্যে! অসম্ভব! এক্সেপশন প্রুভস্ দ্য রুল।

    (৩)

    একথা সবাই মানবেন, সারথি মিশুক না হলে বেড়ানোর মজাটাই মাটি। হিমাচলের ভিকিভাইয়া তো দশ বছর পরেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। কী আন্তরিক ব্যবহার! উত্তরবঙ্গ যাওয়ার কথা উঠলেই খোঁজ পড়ে নূর-দা ফাঁকা আছেন তো? এমন জমাটি মানুষ কম হয়। সেই সঙ্গে আবার ফোটোগ্রাফারও। কোন চা বাগানে ছবি তোলা হবে, কোন অ্যাঙ্গেলে ছবি হবে, সে-সবে নূরদা সিদ্ধহস্ত। ফেরার সময় প্রতিবার মূর্তি নদীর ধারে নিজের বাড়ি ঘুরিয়ে আনেন। উপহার দেন নিজের খেতের সুগন্ধী চাল। ব্যাঙ্গালোরের প্রসাদভাইয়াতো আমাদের নিয়ে প্রায় অ্যাডভেঞ্চারে বেরোন। আঙুর খেতের মধ্যে নামিয়ে আমাদের দেদার আঙুর তোলার অনুমতি দিয়ে দেন। প্রথমে বুঝতে পারি না খেতটা কার! নিশ্চয়ই ওঁর না। কন্নড় ভাষায় খেত মালিককে কী সব বললেন! দেখি, মালিক নিজেই আমাদের জন্যে হাসিমুখে ঝুলি এগিয়ে দিচ্ছেন! আবার ভূটানে গিয়ে আমাদের সারথির ব্যাজার মুখ আর নিরুৎসাহ আমাদের বেড়ানোর আনন্দটাই ফিকে করে দিয়েছিল। তবে উত্তরাখন্ডে যেবার 'ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস্' আর 'হেমকুন্ড সাহিব' ট্রেক করতে গেলাম সে-বার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কথা ছিল ঋষিকেশ থেকে ভোরে আমাদের তুলে নেবে এক গাড়ি। দিনের শেষে পৌঁছব যোশিমঠ। ভোর ভোর নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হলাম। কলকাতা থেকে আমি গেছি একলা। পরিচয় হল আমার ট্রেকের অন্য সহযাত্রীদের সঙ্গে। নানা রাজ্য থেকে এসেছে তারা। সময়মতো গাড়িও এসে হাজির হল। রিঙ্কুভাইয়া আমাদের সারথি। আমাদের লাগেজ গাড়ির ছাদে তুলে নিয়ে গাড়ি ছুটল বদ্রীনাথ হাইওয়ে ধরে। পথে পড়বে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ। আমি বসেছি সামনের সিটে। সারথির পাশে। পথের দু-পাশে, কাছে-দূরে যত দ্রষ্টব্য, রিঙ্কুভাইয়া তার ধারাবিবরণী দিতে থাকেন। উত্তরাখন্ডের জীবন, সংস্কৃতি, আচার সব কিছু নিয়েই তাঁর কী সাবলীল বর্ণনা। বেশ দার্শনিকতার ছোঁয়া তার কথাবার্তায়। এমন একজন সারথি না হলে কী আর অচেনা পথে বেরিয়ে মজা আছে! পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কত রহস্য, রিঙ্কু ভাইয়া যেন তার সব হদিশ জানেন। দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা আর ভাগীরথির দুই রঙের দুই আলাদা জলের ধারা পিছনে রেখে তুলে দিলেন আমাদের গ্রুপ ছবি। ততক্ষণে আমরা সবাই আমাদের সারথির ফ্যান হয়ে গেছি। আমাদের তারিফ পেয়ে রিঙ্কুভাইয়া আরো একটু দার্শনিক হয়ে গেলেন। "জিন্দেগী মে অউর কেয়া হ্যায়! রহেগা ভি কেয়া! ইয়ে পহচান হি রহ জায়েগা, ইনসানিয়ত সে বড়া কুছ নেহি!" পাশে বসে পাহাড়ের মোহে আচ্ছন্ন আমি অস্ফুটে বললাম, "জী, বিলকুল।" গাড়ি ছুটছে বেশ জোরে। শ্রীনগর নামের এক পাহাড়ি শহর পড়বে এবার। শ্রীনগর পৌঁছতেই হঠাৎ আমাদের চলন্ত গাড়িকে পুলিশ হাত দেখিয়ে থামাল। পাশেই শ্রীনগর থানা। রিঙ্কুভাইয়া গাড়ি রাস্তার ধারে পার্ক করে নেমে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাদের কাছ থেকে একহাজার টাকা চেয়ে নিয়ে গেলেন। আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ওঁদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। ভাবলাম, নিশ্চয়ই গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে গন্ডগোল। মিটে যাবে। কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ আমাদের গাড়ির কাছে এসে বললেন "আপনারা টের পাননি, আপনাদের ড্রাইভার মদ্যপান করে গাড়ি চালাচ্ছেন?" সামনের সিটে বসা আমাকেই তিনি বেশি দোষ দিলেন, "আপনি পাশে বসে গন্ধ পাননি? মেয়েরা তো বেশি গন্ধ পায়!" কী করে বলি, গন্ধ তো শুরুতেই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মাথায় আসেনি। আমার দু-চোখ জুড়ে তখন শুধুই পাহাড়, মন জুড়ে 'ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ারস্' দেখার উত্তেজনা। এরপর পুলিশ নিজে গাড়িটি চালিয়ে আমাদের নিয়ে থানায় ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, "এই গাড়ি আমরা ছাড়ব না। আপনারা থানার ভিতরে গিয়ে বসুন, রিল্যাক্স করুন আর অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করুন।" আমাদের ট্রেকিং সংস্থায় ফোন করতে তাঁরা অন্য গাড়ি ব্যবস্থা করে দিলেন ঘন্টাখানেকের মধ্যে। থানার ভিতরে পুলিশকর্মীরা আমাদের সঙ্গে ততক্ষণ টুকটাক গল্প করলেন। আমাদের সতর্ক করলেন, "পাহাড়ি পথে কখনো এ ভুল করবেন না। একটা ভুল মানে সোজা খাদে। শোধরানোর সুযোগ নেই।” নতুন গাড়ি এলে আমরা তাতে চড়ে বসলাম। তখনও থানার ভেতর মাথা নিচু করে বসে আছেন রিঙ্কুভাইয়া। আমাদের চলে যাওয়ার সময় একবার শুধু মুখ তুলে তাকালেন। অপরাধীর অভিব্যক্তি তাঁর মুখে। দু-চোখে তার লজ্জা, অসহায়তা। নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমাদের চোখে খুব ছোটো হয়ে গেলেন। হয়ত আসন্ন বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম আমরা সেদিন। কিংবা কিছুই হয়ত হত না। তবে বাকি পথটা যেন কেমন ছন্দহীন হয়ে গেল। নতুন সারথির সঙ্গে আর ভাব জমাতে ইচ্ছে করল না। পিছন থেকে আমাদের বন্ধু সমৃদ্ধি বলল, "মুঝে তো পহেলে হি কুছ গড়বড় লাগা থা, ওহ ইতনা ফিলোসফিকাল কিঁউ হ্যায়।" তাবিশ বলল, "রিঙ্কুভাইয়া ইয়ে বহত বুরা কিয়া হামারে সাথ।" আহা, তা বললে হয়! নেশার টানে মানুষ কী না করে! এই যে কাজকম্ম শিকেয় তুলে কোনো পাহাড়ের টানে বেরিয়ে পড়েছি, এটা বুঝি নেশা নয়! দু-দিন ছাড়া এই যে হাইওয়ের হাতছানি, নিশির ডাকের মতো লং-ড্রাইভে টেনে নিয়ে চলে, এটা বুঝি নেশা নয়! আসলে স্টিয়ারিং ধরে বসলেই এক গতির আনন্দ পেয়ে বসে। মনটা তখন ফুরফুরে হয়ে যায়! উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ছুটন্ত গাছপালার মতো পিছনের দিকে দৌড়য়। পথ যে কতকিছু শেখায়! ধৈর্য, বোঝাপড়া, মানবিকতা! জাপানীরা বলেন, 'লিভ লাইক ইউ ড্রাইভ'। সামনের দিকে তাকিয়ে, চোখ কান খোলা রেখে এগিয়ে চলো, খুব দরকার না পড়লে রিয়ার গ্লাসে চোখ রেখো না। এটাই তো জীবনের হক কথা! আর জীবনের লং-ড্রাইভে আমরা তো সবাই সারথি!



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments