• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | বিবিধ
    Share
  • প্রফুল্ল রায় : অনেক কথা বলার ছিল : শুভঙ্কর গুহ

    স্মরণে: প্রফুল্ল রায় (১৯৩৪-২০২৫)

    প্রফুল্ল রায় (১৯৩৪-২০২৫) ছিলেন মূলত ভারতীয় কথা সাহিত্যের প্রান্তিক জীবনের কথক। সাব অলটার্ন মানুষের জীবন ও জীবিকা নিয়ে তাঁর সাহিত্যসাধনা বাংলাসাহিত্যে অবশ্যই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। মুন্সি প্রেমচন্দ, কৃষনচন্দর, ফণীশ্বরনাথ রেণু ও সতীনাথ ভাদুরী যে পথের সন্ধান করেছিলেন তিনি মূলত সেই পথের পথিক ছিলেন। লেখার সন্ধানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি অনেকসময় পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন। অবিভক্ত বিহারপ্রদেশ ছিল তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তিনি যখন বিহারপ্রদেশ ভ্রমণ করেছেন তখন সেকালের বিহারভূমি ছিল সম্পূর্ণ অনুন্নত। ভুঁইফোড় ও জমিদারদের লেঠেলদের স্বর্গরাজ্য। বিহারপ্রদেশের ক্ষেতমজুরদের তিনি দেখেছেন পঙ্গপালের মতো এই মাঠ থেকে সেই মাঠে ছুটে যেতে সামান্য দিনমজুরির সন্ধানে। হাঁটু ভর্তি মাটি, খরখরে শরীর, যাদের জায়গীরদার ও জমিদার সম্প্রদায় মনে করত জেগে থাকা ভূত। এই সব মানুষদের দেখতে দেখতে প্রফুল্ল রায় হয়ে উঠলেন এদের জীবনের ভাষ্যকার। যাদের কথা তিনি রচনা করলেন তাদের চিনতে না পারলে ভারতবর্ষ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর মুখ থেকেই শোনা, বিহারের একটি গ্রামীণ হাট থেকে তিনি ফেরার পথে প্রত্যন্ত গ্রামের কাচ্চি সড়কের ওপরে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন, কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, বিকেল ফুরিয়ে আসছে, রেল স্টেশনের সন্ধান তিনি জানেন না, বাসের রাস্তা ধরতে হলে রাত ফুরিয়ে যাবে। এই সময়ে দেখতে পেলেন একজন বন্দুক কাঁধে নিয়ে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছেন। প্রফুল্ল রায়কে দেখে সেই বন্দুকধারী অবাক হয়ে বলল, “আপনাকে আমি হাটে দেখেছিলাম, কোথায় যাবেন? কেঊ আপনাকে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে?”

    প্রফুল্ল রায় বললেন, “আমি এখানে কাউকে চিনি না। কেউ আসবে না।” বেশ কিছু কথাবার্তার মাধ্যমে পরস্পরের পরিচয় জানার পরে প্রফুল্ল রায় জানতে পারলেন এই বন্দুকধারী আসলে একজন পাখিশিকারি। আর পাখিশিকারি জানতে পারল যার সঙ্গে এখন সে কথা বলছে তিনি আসলে একজন বাঙ্গালি বাবু। সেই পাখিশিকারি আসলে ছিল স্থানীয় জমিদার স্টেটের সদস্য। পাখি শিকারি বুঝতে পেরেছিল তাঁর ফেরার পথ নেই। তাই তাঁকে নিয়ে চলল জমিদার বাড়ির দিকে। প্রফুল্ল রায় নিজেই আমাকে বলেছিলেন বিহারি ঠাকুর জমিদারদের বাড়ি সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা তাঁকে পরবর্তীকালে লেখার রসদ জুগিয়েছিল। ভারতীয় সাহিত্যে চিরস্মরণীয় গল্প ‘সাতঘরিয়া’ লেখার এই ছিল পটভূমি। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও কথা বলেছিলেন, সে সব কথা ‘আকাশের নিচে মানুষ’ রচনা সংগ্রহে খুঁজে পাই।

    বড়ই স্নেহে তিনি কাছে ডেকে নিতেন। অনুজ লেখকদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও অনুরাগ আমাদের লেখকমহলে উদাহরণ হয়ে থাকল। অনুজ লেখকদের প্রতি অগ্রজ লেখকদের স্নেহ ও আগ্রহ বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশক পর্যন্ত চল ছিল। তারপরে অগ্রজ লেখকদের এই ধারাটি ক্ষীণ হয়ে আসে। প্রফুল্ল রায় নিজের মুখে অনেককেই প্রায়ই বলতেন অনুজ ও তরুণ লেখকদের কীভাবে কাছে টেনে নিতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলতেন, “এঁদের কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি।”

    এক বিকেলের দিকে, সম্ভবত ২০০৭ সালে, কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। সেই সময় ‘নন্দন’ সাহিত্য পত্রিকায় আমি ‘বিয়োর’ উপন্যাসের প্রথম পর্ব লিখি। শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শচিন দাস প্রফুল্ল রায়ের হাতে ‘নন্দন’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি দিয়েছিলেন। প্রফুল্ল রায় লেখাটি পড়েছিলেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন, “আমি তোমার লেখাটি পড়েছি। তুমি আর কোনো দিকে তাকাবে না। লেখাটি শেষ করে আমাকে জানাবে।” ‘বিয়োর’ উপন্যাসটি লিখতে আমার সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন বছর। এর মধ্যে তিনি যে কতবার খোঁজ নিয়েছিলেন। উপন্যাস শেষ করার পরে তিনি করুণা প্রকাশনীর কর্ণধার বামবাবুকে (বামাচরণ মুখোপাধ্যায়) নিজে বলেছিলেন, “এই বইটি আপনাকে ছাপতে হবে।” বামবাবু আমাকে বলেছিলেন, “আপনি কত বড় সৌভাগ্যবান, প্রফুল্ল রায় নিজে বলছেন আপনার বই ছাপতে।” সত্যিই সেদিন আমি নিজেও ভাবতে পারিনি, একজন পরম শ্রদ্ধেয় লেখক আমাকে এইভাবে আশীর্বাদ করবেন। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন পর্যায়ে ছিল যে কত মনের কথা তিনি আমায় বলতেন। তিনি যেখানে বসে কথা বলতেন সামনেই কাঁচের আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন আলেক্স হেলি-র ‘দি রুটস্’ উপন্যাসটি। আমি তাঁকে একদিন বলেছিলাম, “এই উপন্যাসটি আপনি নিশ্চয়ই বারে বারে পড়েন।” তিনি বলেছিলেন, “এই ধরণের উপন্যাস না পড়লে লিখবে কি? এটি শুধু একটি উপন্যাস নয় একটি মহাগ্রন্থ। দাস প্রথার ওপরে এটি একটি প্রামাণ্য দলিল।”

    তিনি বারে বারে আক্ষেপ করতেন, শুধুমাত্র কলকাতা শহর নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো দীর্ঘ উপন্যাস লেখা হল না, যে উপন্যাসটির মূল চরিত্রই হবে কলকাতা শহর এবং সাধারণ মানুষ। কলকাতা ভারতবর্ষে বামপন্থী আন্দোলনের পীঠস্থান শুধু নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনে এই শহরের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তিনি কথায় কাথায় বলতেন, “মস্কো প্যারিস লন্ডন ইস্তাম্বুল সেই দেশের সাহিত্য রচনায় যে ভাবে উঠে এসেছে, সেই ভাবে কলকাতা শহরের উঠে আসা উচিত ছিল। দেখা যাক শুধুমাত্র কলকাতা শহর নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ হয়তো লিখবেন।”

    তিনি আমাকে বারে বারে বলতেন, “লক্ষ করলে দেখতে পাবে কলকাতার প্রতিটি বাজারের ভিন্নরকমের গন্ধ। বৈঠকখানা বাজারের একরকম, বড়বাজারের অন্য রকম, সখেরবাজার, মানিকতলা বাজার, শ্যামবাজার প্রতিটি বাজার যদি লক্ষ করো অনেক ভিন্নতা পাবে। একটা শহরের ঠিক মধ্যেখানে এত বড় মাঠ, নদী, কত ভাষার মানুষ।” তাঁর কথা শুনে মনে হত তিনি কলকাতা নিয়ে বড় কাজ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না।

    আমাকে তিনি প্রায়ই বলতেন, “লেখকের লিখতে লিখতে খ্যাতি আসে কিন্তু লেখক খ্যাতির জন্য লেখেন না। লেখকের কাজই হল একমাত্র তাঁর পরিচয়। কোনো দিকে না তাকিয়ে শুধু লিখে যাও নিজের দেশ ও মানুষের জন্য। আমাদের দেশে এখনও অনেক প্রান্তিক, দলিত শ্রেণি ও সমাজ আছে যাদের নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি।”

    প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস গল্প নিয়ে অনেক আলোচক ও গবেষক লিখেছেন। বছর তিন আগে তিনি একটি উপন্যাস লিখেছিলেন. নাম “একটা দেশ চাই”। উপন্যাসটির বিষয় অধুনা বাংলাদেশের বাসিন্দা বিহারপ্রদেশের মানুষ মানে বিহারিসম্প্রদায়, যারা নিজেদের দেশের শিকড় ছিন্ন করে, জীবিকার সন্ধানে এসে আর নিজেদের প্রদেশে ফিরতে পারেননি, তাদেরই জীবন সংগ্রামের কাহিনি। একদিন বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসে আছি, তিনি আমার হাতে উপন্যাসটি দিয়ে বললেন, “বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছি।” এত বড় মাপের একজন ভারতীয় লেখক আমার মতো একজনকে ভেবেছেন! আবেগ ও শ্রদ্ধায় চোখে সেদিন শ্রাবণ এসেছিল।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments