• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • আনলকড : শৌনক দত্ত



    আবার বৃষ্টিপাত আরম্ভ হয়েছে। দেবদারু গাছটা ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়িয়ে ভিজছে। সকাল থেকে বৃষ্টি। সারারাত বৃষ্টি গেছে। রাস্তায় জল জমছে। লোকজন হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, মেয়েরা শাড়ি তুলে, ছেলেরা প্যান্ট ভিজিয়ে জল ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট এবং সব সবুজ মাঠ যদি কোথাও থাকে প্রায় খালবিলের মতো। উত্তর থেকে হাওয়া এলে জানালা দরজা খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু দক্ষিণ থেকে হাওয়া এলে দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। বৃষ্টিপাতের সময় দক্ষিণের হাওয়া প্রবল। গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রাক ভিজতে ভিজতে চলে যায়। কখনও সার সার থেমে থাকে। বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশ চুরমার করে দিয়ে বজ্রপাতের শব্দ নেমে আসে। তখন কেউ হুইসকি গলায় ঢেলে বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনতে ভালোবাসে। সবাই যখন যার যার মতন করে বৃষ্টি উপভোগ করছে তখন ফ্ল্যাটবাড়ির জানালায় একটা দুঃখী মুখ দেখা গেল।

    বাঁ-দিকে সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে সুখলয় দাঁড়িয়ে। সুখলয় বিশ্বাস ভালো আড়বাঁশি বাজাতে পারত বলে যাত্রাদলে, সিনেমায় ও টিভিতে বহু কাজ করেছে। কিন্তু চাইতে জানত না বলে বেশিরভাগ কাজই করেছে বিনা পারিশ্রমিকে আর কখনো কখনো কেউ পঞ্চাশ বা একশ টাকা হাতে দিয়ে বলত ‘শিল্পীর শিল্পের তো দাম পরিমাপ করা যায় না। আপনার বাঁশির পারিশ্রমিক দেব সেই সামর্থ্য আমার নেই, এই টাকাটা রাখুন-- বাস বা রিক্সায় চলে যান!’ সুখলয় তাতেই বিনাবাক্যে ফিরে আসত। বয়স হবার পরে যখন বুঝেছিল আর কিছু করার নেই তখন থেকে এইখানে চুপ করে সকাল থেকে মধ্যরাত দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস করে নিয়ে ছিল। এত সময় কী দেখত, কাকে দেখত কে জানে! সচারাচর কথা বলত না সুখলয়। ভাইদের সংসারে অনাদরের ভাত জুটে যেত, সুমনের দোকান থেকে দয়ার চা। পাঁচ দশটাকা হাতখরচও জুটত। সেই ছিল তার অঢেল। রিক্সা বা বাসে চড়তে কেউ কখনো দেখেনি। বিড়ি টানত। দাঁড়িয়ে থাকত। কখনো এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত পশ্চিমের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে। কখনো পুব দিকের বড় রাস্তার দিকে। অমন নির্বিকার মানুষ, অমন অহং ও আমিশূন্য মানুষ কেউ কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।

    দুপুরে ঘুমোলে আজকাল আর পারভেজ সাহেব রাতে ঘুমোতে পারেন না। তাই দুপুরটা প্রাণপণে বই নিয়ে, পত্র-পত্রিকা নিয়ে জেগে থাকেন। যদিও ভাত খাবার পর একটা ঢুলুঢুলু ভাব আসে। যাই হোক, দুপুরে জেগে থাকার জন্যেই বলা যায়, রাতের ঘুমটা নিশ্ছিদ্র হয়। ঠিক দশটা থেকে পাঁচটা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। পারভেজ সাহেব বাথরুম গেলেন, জল খেলেন, তারপর চটিটি পাপোশের ওপর খুলে চিত হয়ে শুলেন। পুবে মাথা পশ্চিমে পা। চোখ তুলতেই পারভেজ সাহেব ভিরমি গেলেন। পশ্চিমের দেয়ালে এক ভয়ঙ্কর পুরুষ, ইয়া গোঁফ, ইয়া বুকের পাটা, ঝাঁকড়া চুল, তার শেষ কোথায় দেখা যায় না। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে ভীষণ রুষ্ট চোখে আর ঠোঁট দুটো ধরে সেলাই করছে। ভয়ে পারভেজ সাহেব চোখ বুজলেন। কিন্তু বুজলে কী হবে? সেই মুখ সারাক্ষণ ভাসছে চোখের মধ্যে। পারভেজ সাহেব উঠছেন, জল খাচ্ছেন, শুচ্ছেন, বসছেন, স্বস্তি পাচ্ছেন না। বারান্দার দিকের দরজা খুলতে সাহস হচ্ছে না। যদি ওইরকম রাক্ষসের মতো কোনো চোর বা ডাকাত …। হঠাৎ মনে পড়ল, বারান্দা তো গ্রীল দিয়ে ঘেরা। পারভেজ সাহেব তড়াক করে উঠে বারান্দায় চলে গেলেন, ঘরের দরজাটিতে শেকল দিলেন। আরাম চেয়ারটা পাতলেন। বাকি রাত সেখানেই আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিলেন।

    খুব ভোরবেলায় পারভেজ সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। বেশ ঝরঝরে তরতরে লাগছে শরীরটা। সূর্য এখনও ওঠেনি। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। পারভেজ সাহেব উঠে পড়ে মুখটুখ ধুয়ে ফেললেন। জামাকাপড় পরে বেরিয়ে পড়লেন। এত ভোরে পার্কে কেউ কেউ বেড়াচ্ছে বটে, কিন্তু আড্ডা দেবার মেজাজে কেউ নেই। হনহন করে হাঁটছে সব। প্রাণের দায়ে। পারভেজ সাহেবও হাঁটতে লাগলেন, ধীরে সুস্থে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে, ভোরের হাওয়া খেতে খেতে, গাছের পাতার আড়ালে সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে। রোদ একটু চড়া হতেই তিনি পকেটঘড়ি বার করে দেখলেন সাড়ে ছটা, রোদ ঝড় বৃষ্টিতে ঠিক এইসময় হরিপদবাবু পার্কে আসে, আজ এখনো আসার নাম নেই দেখে বেশ অবাক হলেন পারভেজ সাহেব। পার্কের প্রবেশপথে চোখ রাখতেই দেখলেন সুখলয় দাঁড়িয়ে আছে সুমনের দোকানের সামনের ফুটপাথে। সুমন এখনো দোকান খোলেনি। হরিপদবাবুর জন্য সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে পারভেজ সাহেব বাড়ি ফিরে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। বাড়ির কেউ জাগলেও এখন সব যে যার বাথরুমে। কারুর নজর পড়েনি, বাইরের দরজা খোলা ছিল। পারভেজ সাহেবের মনে হল পরদিন তিনি তালা দিয়ে বেরোবেন।

    খানিকক্ষণ পরে চায়ের জন্য হাঁক দিতে গিয়ে পারভেজ সাহেব খেয়াল করলেন গলা থেকে কোন স্বর বের হচ্ছে না। প্রথমে ভাবলেন গত রাতের ভয়টা বোধ হয় কাটেনি তাই গলার স্বর বসে আছে, ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলেন কাজের মেয়ে ফাতিহা কথা বলতে পারছে না তাই ভয়ে কান্না জুড়েছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল শহরের সবাই বোবা হয়ে গেছে। সারা শহর নীরব হয়ে গেল। সমস্ত এলাকা নিশ্ছিদ্র নীরবতায় হারিয়ে গিয়ে নীরবতাতেই জেগে উঠল আবার। প্রত্যেকটি বাড়ির, পার্কের, রাস্তার, যানবাহনের প্রেত তাদের দ্বিতীয় অস্তিত্বের জানান দিয়ে আবার দ্বিতীয় অস্তিত্বকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। ভয় কি? বেরিয়ে আয়। কতকাল আর বোবা হয়ে নীরবতায় চাপা থাকবি? কেউ কেউ লিখে বা আকার ইংগিতে বলল গতকালকের বৃষ্টিটা প্রতিবেশী শত্রুদেশের কারসাজি। বৃষ্টির মধ্যে এমন রাসায়নিক ছিল যা সবাইকে বোবা করে দিয়েছে, কেউ কেউ বলল এটা মানুষের পাপের ফল। সুমনের চায়ের দোকানে ভিড় কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। নীরব চলচ্চিত্র যুগ যারা দেখেনি টিভি চ্যানেলগুলো আজ তাদের সেই নীরব চলচ্চিত্র যুগে নিয়ে গেল। সারা শহর সকাল থেকেই কেমন নীরব হয়ে গেল। প্রাথমিক ধাক্কা সয়ে ওঠার পরে শহরের লোকজন দেখল কেউ কথা বলতে না পারলেও সুখলয়ের গলার স্বর বেঁচে আছে, সে বোবা হয়নি বাকি সবার মতন! কে একজন সাদা কাগজে বড় বড় করে লিখল আমাদের নেতারা কি কথা বলতে পারছে?

    সুখময় মাথা নেড়ে বলল যতদূর জানি জনগণ থেকে সরকার সবাই নির্বাক। অন্যসব সময়ের চেয়ে আজ রাত তাড়াতাড়ি এল শহরে। আকার ইংগিতে বা লিখে লিখে কতক্ষণ কথা বলা যায়? তাই সারাদিন এইভাবে কথা বলে ক্লান্ত নগরবাসী সন্ধ্যা রাতেই শুয়ে পড়েছে। সারা শহর অন্ধকার। সুখলয় আজ রাতে বাড়ি ফেরেনি, সবাই চলে গেলেও সে ঠায় দাঁড়িয়ে সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে। রাত বাড়তে বাড়তে যখন মধ্যরাত সে দেখল কথাগুলো লেগে পড়ল নিজেদের কাজে, তাদের দিনের কাজ শুরু করার জন্য দোকানের ঝাঁপ খোলে নয়ত নিজেদের ডেস্কে বসে পড়ে। অচিরেই, আরও কথা এল শহরে, অন্যদের মত সেতু পেরিয়ে। জিনিস কেনার জন্য দোকানে ঢোকে তারা কিংবা প্রশাসনিক বিষয় সামলাতে টাউন হলে যায় কিংবা হোটেলের রেস্তোরাঁয় খাবার খায় কিংবা পানশালায় বিয়র পান করে এবং প্রাণবন্ত কথা গান গায়। যেহেতু কথাদের রাত দিন বলে কিছু নেই, তাদের একরকম কোন আলোই দরকার হয় না, কিন্তু সে-রাতে জ্যোৎস্না শহরটিকে প্লাবিত করায়, সুখলয় সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথ থেকে খুঁটিনাটি সবকিছু দেখতে পাচ্ছিল। যখন ঘনিয়ে এল ভোর, নিজেদের কাজ শেষ করল কথারা, দোকান বন্ধ করে, ঝাঁক বেঁধে ফিরে গেল সেতুর ওপারে।

    সূর্য উঠতে উঠতে, কথারা চলে গেল, এবং আবার বিরান হয়ে গেল শহর। সুখলয় বাড়ি ফিরে নিজের বিছানায় ঘুমোতে গেল। যখন খিদে পেল তার, রান্নাঘরে রাখা জলভাত আর সঙ্গে পেঁয়াজ খেল। পরেরদিন রাতে, আবার সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথে গা ঢাকা দিল সে, ভোর অবধি কথাগুলোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করল। মধ্যরাতের ট্রেন থেকে কোন যাত্রী নামল না; কেউ উঠলও না। তবু, ঠিক এক মিনিটের জন্য ট্রেনটা থামল স্টেশনে, তারপর আবার ছেড়ে গেল। এই অদ্ভুত ঘটনা সে আরও দেখতে চাইল। যদি সম্ভব হয়, সে আবিষ্কার করবে এই শহরটা কেন বোবা হয়ে গেল আর কখন এবং কীভাবে কথাগুলো শহরকে গ্রাস করল।

    গোধূলি গিয়ে সাঁঝ। সাঁঝ পেরিয়ে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। শহরতলি কাঁপিয়ে ঝিঝির তানকর্তব শুরু হয়ে গেল। মুক্তাঙ্গনে লক্ষ নর্তকীর নূপুরশিঞ্জিনী। বেগবান হাওয়ার সমৰ্থ সঙ্গত। আকাশে চাঁদ নেই। শুধু তারার আলোয় জেগে আছে অলৌকিক জাহাজ বাড়ি, তারার আলোয় দাঁড়িয়ে আছে ত্রিকাল-সাক্ষী অশ্বত্থ। তারার জ্যোৎস্নায় সুখলয় শুনতে পেল কয়েকটি কথা একে অপরের সাথে কথা বলছে, “অ্যাই, তোমরা কেউ কথা কথা গন্ধ পাচ্ছ?” বলল একটা কথা। “তুমি যখন বললে এটা, আমার মনে হয় গত কয়েক দিন যাবত একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছি,” সুর মেলাল আরেকজন, বাতাসে নাক টেনে। “আমিও,” বলল আরও একটা কথা। “আশ্চর্য। এখানে কোন মানুষের কন্ঠে জবান থাকার কথা না,” যোগ করল কেউ-একজন। “না, অবশ্যই না। কোনভাবেই মিথ্যুক মানুষের এই শহরে কারো মুখে কথা থাকার কথা নয়।” “কিন্তু ওই গন্ধটা এখানে ঠিকই আছে।”

    দল গঠন করে তল্লাশি শুরু করল কথাগুলো। গন্ধের উৎস সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাথ এটা আবিষ্কার করতে তাদের খুব কম সময় লাগল। ফুটপাথ জুড়ে ওদের নরম পায়ের আওয়াজ পেল সুখলয়। সর্বনাশ, ওরা ধরে ফেলেছে আমাকে! ভাবল সে। ওর গায়ের গন্ধ যেন ক্রুদ্ধ করে তুলেছে কথার দলকে। বোবা মানুষ ছাড়া শহরে কথা বলা মানুষ থাকার কথা না। কথাগুলোর নখর এবং শাদা দাঁত বিরাট এবং তীক্ষ্ণ। সুখলয় অনুমান করতে পারে না কী ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে তার জন্য। যদি তাকে খুঁজে পায় ওরা, তবে সে নিশ্চিত যে ওগুলো তাকে প্রাণে মারবে না কেননা শহরের মানুষের মতন সে কখনো মিথ্যা কথা বলেনি কিংবা মিথ্যা বলে সেই মিথ্যাকে ঢাকতে আরো মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন তার হয়নি। তিনটা কথা হাঁটতে হাঁটতে সুমনের চায়ের দোকানের সামনের ফুটপাতে এল, বাতাসে গন্ধ শুঁকল। “আশ্চর্য,” বলল একটা কথা, গোঁফ নাচিয়ে। “আমি কথার গন্ধ পাচ্ছি, অথচ এখানে কেউ নেই যার কন্ঠে কথা থাকতে পারে।”

    ”আসলেই অদ্ভুত, বলল দ্বিতীয় কথাটা।” কিন্তু সত্যিই এখানে এখান কেউ নেই। চল, অন্য কোথাও খুঁজি গিয়ে। ঘাড় বাঁকাল কথাগুলো, হতভম্ব, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। সুখলয় শুনতে পায় ওদের পায়ের আওয়াজ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে, কিন্তু এইমাত্র যা ঘটল তার কিছুই বুঝে উঠল না। ওরা তাকে খুঁজে না পাবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক ওরা তাকে দেখতে পায়নি। সুখলয়ের পরক্ষণেই মনে হল তার ধরা দেয়া উচিত ছিল এই শহরের মানুষদের কথা ফিরিয়ে দেবার জন্য হলেও। তৃতীয় রাতের অপেক্ষায় রইল সুখলয়…



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments