• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • রক্ষক : দেবাশিস দাস

    বিকেলের চা খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে গেছে আজকাল। অথচ সামনের বাগানে বসে বিকেলে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেওয়াটাই সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল তার। এভাবেই বোধ হয় ইচ্ছেগুলো মরে যায়। ক্রমে ফ্যাকাসে হতে হতে অভিমানী বিকেলটা ধূসর সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে যায়। অবসরের পরও গ্রামের বাড়িতে নানা কাজকর্মের মধ্যে থাকতেন তিনি। সেখানে বন্ধু-বান্ধব ছিল কিছু। স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন। তাই গ্রামের একার সংসার ছেড়ে চলে এসেছেন শহরের এই আস্তানায় ছেলের সংসারে। এখানে এসে তিনি প্রায় বন্ধুহীন। শুরুতে মাঝে মাঝে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। ইচ্ছে হলেও এখন তো তাও হয় না। এই ইচ্ছেটাও মরে যাবে একদিন। ছেলে বা বৌমা কেউই দরকার ছাড়া এ ঘরে আসে না। কাজের মেয়েটাও এসে ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যায় দিনে একবার। গ্রামের সেই পৈত্রিক বাড়ি এখন স্মৃতি। মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেই ঘরদোর, মা-বাবা, নতুন বউ সবিতা, ছেলের জন্ম। সবিতার সুন্দর সাজান সংসার। কে জানে শিবু এখন কেমন করে রেখেছে সে সব! বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কোনদিন কি তার যাওয়া হবে আর? এই সব স্মৃতিও কি মরে যাবে একদিন? হয়তো বা। স্মৃতির মৃত্যুই বোধ হয় আসল মৃত্যু। এই ঘরের মধ্যে বসে তিনি শুধু সাত পাঁচ ভাবতে থাকেন। হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল। কে যেন অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজাচ্ছে। কেউ কি নেই বাড়িতে দরজা খোলার?

    **********

    স্টেশনে নামার পরেই চারদিকে একটা ছমছমে ভাব অনুভব করল অজিন। এখানে আসার ব্যাপারে আগে থেকে বিশেষ প্রস্তুতি ছিল না তার। কদিন আগেই অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে একটা ফোন পেয়েছিল গ্রাম থেকে। আপাতত কিছুদিন তার গাড়ি চালানো বারণ, তাই তাকে বাসেই যাতায়াত করতে হয় আজকাল। গ্রামের স্কুলের একটা নতুন ভবন উদ্বোধন হবে আগামী রবিবার। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হেডমাস্টারমশাই নিজেই ফোনে তাদেরকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। সে অবশ্য একাই এসেছে এখেনে। অনেকদিন পর দেশে ফেরাতে মনটা বেশ খুশি খুশি ছিল এতক্ষণ। কিন্তু এই ছমছমে অনুভূতিটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলল। স্টেশন চত্বরের পাঁচিলে বসা কতগুলো কুচকুচে কালো কাকের কর্কশ ডাক তার শিরশিরে অনুভূতিটাকে বাড়িয়ে তুলছিল। এতগুলো এইরকম কাক একসঙ্গে দেখা যায় না সচরাচর। তাদেরই মধ্যে একটা কাক আবার হলুদ চোখ নিয়ে তার দিকে চেয়েছিল। এরকম অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই তার শরীর কাঁপতে থাকে। একবার মনে হল, এখানে না আসলেই ভাল হত বোধহয়। পরক্ষণেই মনকে শক্ত করে তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠল সে।

    সকালের অনুষ্ঠান বেশ ভালোই লেগেছে অজিনের। স্কুলের লাইব্রেরী আর ল্যাবের জন্য একটা নতুন ভবন উদ্বোধন করা হল। এতদিন এগুলি স্কুলের দুটো বড় ক্লাসরুম জুড়ে ছিল। ভীষণ আসুবিধে হচ্ছিল ছাত্রদের, ক্লাসরুমের অভাবে। ফান্ডেরও অভাব ছিল তখন। এখন আলাদা ভবনে লাইব্রেরী আর ল্যাব চলে যাওয়াতে ছাত্ররাও দুটো ক্লাসরুম বেশি পেল। উদ্বোধনের বক্তৃতায় হেডমাস্টারমশাই এই স্কুলেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিরেনবাবু অর্থাৎ অজিনের বাবার কথা উল্লেখ করছিলেন বার বার। অবসরের সময় পাওয়া টাকার বেশ কিছুটা অংশ হিরেনবাবু দান করেছিলেন এই ভবন বানাবার জন্য। উনি যেহেতু নিজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন, ল্যাব-এর জন্য আলাদা একটা বিল্ডিং-এর ভাবনা ছিল তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এখন যিনি স্কুলে পদার্থবিদ্যা পড়ান, সেই সুমন-স্যারও একসময় এই স্কুলে অজিনের বাবার ছাত্র ছিলেন। অজিনের থেকে অবশ্য বছর তিনেকের সিনিয়র ছিলেন তিনি। উনিও এই স্কুলে হিরেন-স্যারের অবদানের কথা উল্লেখ করছিলেন। বলছিলেন হিরেন-স্যার আজ এখানে উপস্থিত থাকলে খুব ভালো লাগত সকলের। অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার সময় সুমন-স্যার অজিনকে বললেন--‘কালই তো চলে যাবে। বিকেলে গ্রামটা একটু ঘুরে যেও। বাঁওড়ের জলে নৌকো করে ঘুরতে পারো। ভালো লাগবে। চাইলে আমিও থাকতে পারি। অনেকদিন গল্পও হয়নি তোমার সঙ্গে।’

    বাড়ির পুরনো দেখভাল করার লোক শিবুকাকার হাতের রান্না টাটকা মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে শুতেই চোখটা লেগে এসেছিল। জেগে উঠে দেখল বেলা প্রায় শেষ হয়ে আসছে।

    জলের উপর থেকে সূর্যের শেষ আলো খানিক আগেই মিলিয়ে গেছে। এই অশ্বখুরাকৃতি জলাশয়টি একসময় মূল নদীর অংশ ছিল। স্থানীয় মানুষজন একে বাঁওড় বলে। এখন মূল নদীটি অনেক দূরে সরে গেছে এই জলাশয়টিকে ছেড়ে। এ যেন জন্ম দিয়ে ছেড়ে চলে গেছে মা। সন্তান পড়ে আছে একাকী অযত্নে। হ্রদটি বেষ্টন করে রেখেছে মাঝখানের একটি ছোট অরণ্যভূমিকে। কিছু মানুষের বসত সেখানে। তাদের বেশিরভাগই জেলে এবং মাঝিমাল্লা। অজিন আর সুমন-স্যার দেখলেন কয়েকটা নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। মাঝিরা কেউ নেই। দিনের বেলা সেগুলোতে চড়ে দুপারের লোকজন মাছ ধরে, পারাপার করে।

    নদীর ঘাটে এসে উৎসাহী সুমন-স্যার একটা নৌকো দেখিয়ে বললেন ‘চলো অজিন আমরা নিজেরাই নোঙর খুলে এই নৌকোটা নিয়ে ঘুরে আসি। এখন তো আর কোন মাঝিকে পাব না। এই নৌকোর মাঝিকে আমি চিনি। ওর ছেলে আমাদের স্কুলের ছাত্র। আমি পরে ওদের জানিয়ে দেব।’ এই বৃহৎ জলাশয় আর তার চারদিকের সুনসান গ্রামদেশে অন্ধকার নামছে। গত দুদিন বৃষ্টি হওয়াতে জল এখন অনেকটা বেড়েছে বাঁওড়ের।

    ‘আপনি কি নৌকো বাইতে পারেন স্যার?’ প্রশ্নের সঙ্গে অবিশ্বাসী চোখে স্যারের দিকে তাকাল অজিন।

    ‘আরে চিন্তা করো না, ছোটবেলায় এখানে আমি অনেকবার নৌকো বেয়েছি। তুমি শুধু হাল ধরে বসে থাকবে আর আমি যখন যেভাবে বলবো সেভাবে হালটা ঘোরাবে তাহলেই হবে। আমি চালিয়ে নেব। বেশি দূরে তো আর যাব না। অন্ধকার ঘন হবার আগেই ফিরে আসব। একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে কিন্তু।’

    মনের আনন্দে অনেকটা নৌকো বাইবার পর হঠাৎ খেয়াল হল চারিদিকে কখন যেন অন্ধকার নেমে গেছে। এপার থেকে গ্রাম অনেকটা দূরে বলে কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। আর ওদিকে হ্রদের মাঝের জঙ্গল তো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা।

    ‘এবারে ফেরা যাক স্যার, অন্ধকারে আর না এগোনোই ভালো।’ অজিনের কথায় সচকিত হলেন সুমন-স্যার।

    ‘ঠিক বলেছ। এখনই নৌকো ঘোরাতে হবে। আমি যেভাবে বলছি সেভাবে হালটা ঘোরাতে থাকো।’

    স্যারের নির্দেশমতো হাল ধরে ঘোরাতে গিয়েই হল বিপত্তি। একটুখানি ঘুরে নৌকোটা আটকে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে হাল ঘোরালেও নৌকো ঘুরছে না, আবার সামনেও এগোচ্ছে না। দুদিকেরই অস্পষ্ট পার দেখা যাচ্ছে যদিও। গ্রামের দিকের পার অবশ্য কাছেই। জলও বিশেষ গভীর নয়। জলের ওপরে নৌকোর দুদিকেই মাথা তুলে রয়েছে প্রচুর লম্বা লম্বা ঘাস আর অন্যান্য জংলা গাছ। নৌকো আটকে গেছে এই ঘাস আর জংলার মধ্যে। বোধহয় জলের নিচে কোন মাটির ঢিবিতে অথবা কোন আগাছার জঙ্গলে। কাউকে ডাকাও যাবে না। মোবাইলের কোন নেটওয়ার্ক এদিকে একেবারেই নেই।

    নৌকো ঘাস-জংলার জটলা থেকে বের করার জন্য খানিকক্ষণ কসরত করাতে দুজনেরই ঘাম ঝরছিল। হঠাৎ কী মনে হতে ওপারের জঙ্গলের দিকে আঙ্গুল তুলে সুমন-স্যার বলে উঠলেন--‘বাঁওড়ের পারের ওই জায়গাটা চিনতে পারছ অজিন? ওখানেই অনেকদিন আগে ঘটেছিল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।’ সেদিকে তাকাতেই দম প্রায় আটকে এল অজিনের। হৃদ্‌স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে মনে হল। হ্যাঁ ওই তো সেই জঙ্গলের দিকের ভাঙ্গা পাড়। বাঁওড় অনেকটা ঢুকে গেছে ভেতরে। এখানেই তো পাড় ভেঙ্গে বর্ষার বাঁওড় গ্রাস করেছিল মনীশকে।

    **********

    আজকাল হিজিবিজি চিন্তাতেই সময় কেটে যায়। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। স্মৃতিগুলো আর কতদিন তার সঙ্গে থাকবে কে জানে। অজিন তার বেশিবয়সের একমাত্র সন্তান। ছোট থেকেই ছেলেটা বেশ ভীতু প্রকৃতির। মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি রকমের নার্ভাস হয়ে যেত সে। ছোট থাকতেই ওর মাও একদিন চলে গেল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। সবসময় তিনিই ছেলেকে আগলে আগলে রাখতেন। ভেবেছিলেন বড় হয়ে ঠিক হয়ে যাবে। কত বুঝিয়েছেন ছেলেকে, ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিছুটা ভালো হয়ে উঠেছিল অজিন। তিনি ভাবতেন পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই অজিনের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অজিন স্কুলে ফার্স্ট হত। আত্মবিশ্বাসও বেড়েছিল তার। মনে হল অজিন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু ক্লাস এইটে ওঠার পরেই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা।

    গ্রামের বিডিও সাহেবের ছেলে মনীশ অজিনের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। ভালো ছেলে হলেও বেশ ডাকাবুকো ছিল ছেলেটি। মনীশের সঙ্গে যেখানে সেখানে যেতে ছেলেকে বারণ করতেন তিনি। তবে তিনি জানতেন, অজিন তাঁকে লুকিয়ে মাঝে মাঝে মনীশের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াত। এভাবেই একদিন বাঁওড়ে গিয়ে অজিনের চোখের সামনেই পাড় ভেঙ্গে জলে তলিয়ে গিয়েছিল বিডিও সাহেবের ছেলেটি। ব্যাপারটা একেবারেই নিতে পারেনি দুর্বল মনের অজিন। আর তারপর থেকেই ওর প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয়। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ত সে। এর পর থেকে ছেলেকে এই মানসিক আতঙ্কের অভিঘাত থেকে রক্ষা করাটাই তাঁর প্রাথমিক কাজ হয়ে দাঁড়াল।

    **********

    নৌকোর মধ্যে অজিনের মনে বার বার একই ভাবনা ভেসে উঠছিল - মনীশ এখন কোথায়? বাঁওড়ের নিচে কি শুয়ে আছে সে? আজ এই অন্ধকারে সে কি এই নৌকোয় উঠে আসবে? জিজ্ঞেস করবে, কেন তাকে সেদিন বাঁচায়নি অজিন?

    কেউ জানে না যে বাঁওড়ের ধারে মনীশের জায়গায় সেদিন অজিনই দাঁড়িয়েছিল। মনীশ ছিল কিছুটা দূরে। পাড় ভাঙ্গার আওয়াজ ও-ই পেয়েছিল প্রথম। মুহূর্তের মধ্যে দৌড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে অজিনকে সরিয়ে দেয় সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নিজে আর সরে যেতে পারেনি। অজিন শুধু দেখেছিল মনীশের আর্তি-ভরা দুটো চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। ভাঙনের মাটি আর বাঁওড়ের জল মুহূর্তে গ্রাস করে নিয়েছিল সেই চোখদুটোকে। থর থর করে কাঁপছিল অজিন। বোধহয় চিৎকারও করে উঠেছিল। নিশ্চিত মৃত্যু তাকে ছেড়ে মনীশকে টেনে নিয়ে গেল। মনীশই যেন বদলাবদলি করে নিল মৃত্যুটাকে। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন এসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েও খুঁজে পায়নি মনীশকে। সে কি বাঁচাতে পারত মনীশকে? পরের দিন বেশ কিছুটা দূরে নাকি ভেসে উঠেছিল শরীরটা। অজিন তখন হাসপাতালে ভর্তি। সেবারই প্রথম প্যানিক অ্যাটাকে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে এই মৃত্যুদৃশ্য বারে বারেই হানা দেয় তার জীবনে। বিশেষ করে কোন অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই মনে পড়ে মনীশের সেই অদ্ভুত আর্তিপূর্ণ দৃষ্টি।

    এই তো সেদিনও সন্ধ্যার দিকে একা গাড়ি চালাতে চালাতে সামনে এসে পড়েছিল একটা কালো রাস্তার কুকুর। অজিন শুধু দেখেছিল কুকুরটার ভয়ার্ত চোখদুটো। আপাতভাবে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু অজিনের শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছিল। ব্রেক লাগেনি। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল সে। কুকুরটাকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি ছুটেছিল রাস্তার ধারের দিকে। ভাগ্যিস রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না তখন। গাড়ি তীর বেগে ছুটে রাস্তার পাশের একটা গভীর খালে পড়ে যাবার মাত্র কয়েক ইঞ্চি আগে হঠাৎ একেবারে স্থির দাঁড়িয়ে গেল। লোকজন চিৎকার করে ছুটে এল। গাড়ি থেকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হল অজিনকে। তবে একটা আঁচড়ও লাগেনি তার শরীরে। গাড়িরও কোন ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ হয়নি। অদ্ভুতভাবে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেল সে। অনেকে বলেছিল আতঙ্কের বশে ব্রেক করতে গিয়ে ভুল করে অ্যাক্সিলেরেটর দাবিয়ে দিয়েছিল সে। তবে শেষ মুহূর্তে কোনভাবে ইমারজেন্সি ব্রেক লাগেছিল। কিন্তু সে তো প্রায় সংজ্ঞাহীন তখন। তার মন জুড়ে ছিল উইন্ডস্ক্রীনে দেখা কুকুরটির ভয়ার্ত চোখদুটো। তবে ব্রেক লাগল কী করে? ওই দুরন্ত গতিতে চলা গাড়ি কে থামাল তবে? আশ্চর্য!

    **********

    এ কোথায় এসে নৌকো আটকাল? গতকালের সেই শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে আসছে। প্রাণপণে মন শক্ত করার চেষ্টা করল সে। একটা ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। জলে একটু একটু করে ঢেউ হচ্ছে। হয়তো এগুলো আসন্ন ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস।

    স্যার বললেন, ‘এখন শুধু ভালো দিকগুলো ভাবো অজিন। আমরা বিপদের মধ্যে আছি বটে, তবে পার কাছেই আছে, আর জলও অগভীর। হয়তো কোথাও কোথাও গলা অব্দি হবে। আর আমরা দুজনেই সাঁতার জানি।’ স্যারের কথাতে ভরসা ফিরল কি অজিনের?

    স্যার আবার বললেন--‘এখানে জলে নেমে নৌকোটাকে একটু ধাক্কা দিতে পারলে এটা হয়তো চলতে শুরু করবে। দিনের আলো থাকলে হয়তো সেই চেষ্টা করা যেত।’

    কিন্তু দুজনেই জানে নৌকোর চারদিকে বড় বড় ঘাস আর আগাছার জঙ্গল হওয়াতে এখানে জলজ জীবজন্তু যেমন সাপখোপ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এর মধ্যে তাদের জলে নামার চেষ্টা না করাই ভালো। আর এই মাথা-তোলা জলজ উদ্ভিদের মধ্যে সাঁতার কেটে পারে যাওয়া তো প্রায় দুঃসাধ্য কাজ। তাই আপাতত এখানে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

    স্যার বললেন, ‘একটু বিশ্রাম নিয়ে কিছুক্ষণ পরে আবার চেষ্টা করব দাঁড় টানার। কিন্তু একেবারেই যদি না হয় তবে হয়তো জলে নেমে চেষ্টা করতে হবে। প্যানিক করো না অজিন। তবে খেয়াল করো, সাপখোপ যেন নৌকোতে না উঠে আসে।’

    কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল ছিল না। তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মাঝে মাঝে অবশ্য সাহায্যের জন্য চিৎকার করে বা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে পারের কোন সম্ভাব্য অথচ অদৃশ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের বিফল চেষ্টা করছিল তারা। রাতে তাদের না দেখতে পেয়ে বাড়ির লোকজন যে এখানে এসে তাদের খোঁজ নেবে এরকম আশাও ক্ষীণ। কেননা তাদের নৌকো বাইবার কথা কেউ ভাবতেও পারবে না। চিন্তিত দুজন মানুষ পারের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

    **********

    প্লে-স্টোর থেকে একটা অ্যাপ ডাউনলোড করেছিল উনা। অ্যাপের নাম ‘হুইল।’ পুরনো গাড়ি কেনাবেচার অ্যাপ। নিজেদের গাড়িটা মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকলেও সেটা বিক্রি করার কথা ভাবতে হচ্ছিল তাদের। বিশেষ করে একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট থেকে অজিন বেঁচে যাবার পর। আজ রবিবার হলেও অজিন বাড়িতে নেই। ও গেছে গ্রামের বাড়িতে নিজের স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে। নিমন্ত্রণ আসলে ছিল ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক হিরেনবাবুর মানে ওর বাবার। ওনার যাওয়া সম্ভব নয় বলে ছেলেই গেছে। থাকবে গ্রামের বাড়িতে। শনিবার গেছে সোমবার ফিরে আসবে সকালে। ‘উনা’রও যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নিজের শরীর খারাপ ও গাড়ি বিক্রির চক্করে যেতে পারেনি সে। অ্যাপের অফিস থেকে বলা হয়েছিল যে সপ্তাহান্তে যে-কোনদিন তাদের লোক এসে গাড়িটা একবার পরিদর্শন করে যাবে।

    অ্যাপের তরফ থেকে এমন একজন মানুষ আসবে সেটা ভাবতে পারেনি উনা। ভদ্রলোকের পরনে একটা আধ-ময়লা ধুতি আর তার উপরে একটা পাঞ্জাবির মতো কলারওয়ালা জামা। কাঁধে একটা ঝোলা। সঙ্গের ছাতাটাও সেই পুরনো আমলের বাঁশের বাঁটওয়ালা বড় ছাতা। কলিং বেল বাজিয়ে খুব কুন্ঠিতভাবে দরজার একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রৌঢ় মানুষটি। একটু আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে মনে হল তার। ভদ্রলোক জানালেন যে তিনি অ্যাপের অফিস থেকে গাড়ি দেখতে এসেছেন। ভেতরে আসতে বলাতে দ্বিধাগ্রস্তভাবে ঘরে ঢুকে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বসতে বলাতে বললেন তাড়াতাড়ি গাড়িটা তাকে দেখিয়ে দিতে, কারণ এরপরেও তাকে আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে।

    এসব ক্ষেত্রে অ্যাপের থেকে সাধারণত বলিয়ে কইয়ে ঝকমকে লোকই আসে। এনাকে দেখে বোঝা গেল না গাড়ির ব্যাপারে উনি বিশেষ কিছু জানেন কিনা। তাই দ্বিধাগ্রস্ত উনা বলেছিল, ‘আমার হাসব্যান্ড একটা কাজে আজ আউট অফ স্টেশন, তাই যদি আপনি অন্য কোনদিন আসেন তাহলে ভালো হয়।’

    ‘না না, ওনাকে দরকার নেই, শুধু গাড়িটা দেখাতে পারলেই হবে। অ্যাপের অনেক গাড়ি লাইনে আছে, কাজেই আরেকদিন আসতে অনেকটা সময় লেগে যাবে। আজ আমি প্রাথমিক সার্ভেটা করে অফিসে গিয়ে রিপোর্ট দিলেই ওনারা একটা মূল্য নির্ধারণ করে আপনাদের জানাবেন। তারপরেই বাকি কাজ এগোবে।’

    গাড়িটা যখন উনি পরিদর্শন করছিলেন তখনই উনা বুঝল যে ভদ্রলোক মোটেই আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন না। গাড়ির বডিটা বিভিন্ন জায়গায় ঠুকে দেখলেন। টায়ার, ব্যাটারি সবই পরীক্ষা করলেন। ঝোলা থেকে নানা যন্ত্রপাতি বের করে ইঞ্জিন, ইলেকট্রিকাল লাইন পরীক্ষা করলেন আর নিজের নোটবইতে লিখে নিলেন। সব শেষ করে গিয়ার হ্যান্ডেলে একটা হলুদ ফ্লোরেসেন্ট রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে দিলেন।

    কাজের মাঝে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাড়িটা কি কোন বড় অ্যাক্সিডেন্টের থেকে বেঁচেছে সাম্প্রতিক কালে। টায়ারে ঘষ্টানির দাগ রয়েছে। ‘ব্রেকশু’-তেও কিছুটা ইস্যু আছে। ইমারজেন্সি ব্রেক লেগেছে।’ উনা অবাক হয়ে গেল ওনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে।

    ভদ্রলোক যাবার সময় বললেন, ‘গাড়িটা খুব ভাল কন্ডিশনে আছে। সেইমতো দাম কিন্তু পাবেন না। তাই গাড়িটা বিক্রি করা এখন মনে হয় ঠিক হবে না। তবে সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমাদের অফিস থেকে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দামের কথা দিন-দুয়েকের মধ্যে জানাবে। তবে গাড়ি বিক্রির সময় আমার সাজেশনটা অবশ্যই ভাববেন।’

    ভদ্রলোক চলে যাবার সময় আবার সেই কুণ্ঠিত ভঙ্গি দেখতে পেল উনা। যেটা গাড়িটার সঙ্গে যখন ছিলেন তখন একদম দেখা যায়নি। বরং মনে হচ্ছিল উনি যেন গাড়িটার সঙ্গে কথা বলছিলেন ফিসফিস করে। বাড়ির বাইরের রাস্তায় গিয়ে ছাতাটা খুলে ঝোলাটা কাঁধে ঠিকঠাক লাগিয়ে হাঁটা দিলেন উনি। অবাক উনা তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে।

    **********

    ‘সর’ ‘সর’ শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই আসছিল। অন্ধকারে জলের শব্দ বলে ভুল হয়েছিল হয়তো। এবার একদম পেছনে শব্দটা হওয়াতে খটকা লাগলো। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে নৌকোর ধারের দিকে আলো ফেলাতে হাড় হিম হয়ে গেল অজিনের। নৌকোর ধার থেকে জলের দিকে ঝুলে রয়েছে একটা কালো প্রায় চার পাঁচ হাত লম্বা সাপ। মোবাইলের আলোতে স্যারেরও নজর পড়ল এই ঝুলে থাকা জীবের ওপর। হয়তো জলের জংলাগাছ বেয়ে নৌকোয় উঠে এসেছে এই কালান্তক সরীসৃপ। চারদিকে থৈ-থৈ জলের মাঝে একটু শুকনো জায়গা পেয়ে হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছে সে। স্যার ফিসফিস করে নৌকোর আরও মাঝখানে সরে আসতে বললেন অজিনকে, সাপের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে। এই পরাবাস্তব পরিবেশে প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতোই লাগছিল সরীসৃপটিকে। এই ঘাসবনে নিশ্চয়ই আরও সখা সখি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে এই সরীসৃপটির। এভাবে থাকলে হয়ত আরও কিছু এরকম রাতের অতিথির আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে নৌকোটি। নৌকোর মাঝামাঝি জড়সড় হয়ে ব্যালেন্স করে বসে রইল তারা। স্যার টের পেলেন অজিন কাঁপছে। ‘মনীশ কি তবে এখন সাপ হয়ে গেছে? কাকে কাটবে? ওকি এখন নিজের জীবন ফেরত চাইবে?’ ভীষণ আতঙ্কিত হল অজিন। এতদিন প্রত্যেক বিপদেই কোন-না-কোনভাবে বেঁচে গেছে সে। আজও বুকের ভিতর থেকে উঠে আসছে একটা ভয়। ভীষণভাবে কাঁপছে শরীর। কে বাঁচাবে তাকে এখন? নৌকোর ধারে ঝুলে থাকা জীবটির শরীর থেকে টুপটুপ করে ঝরা জলবিন্দুর মতো ঝরে পড়ছিল সময়।

    এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানা নেই। হঠাৎই যেন কিছু একটা শুনে অজিন ফিস ফিস করে বলে উঠলো, ‘একটা ছপ ছপ আওয়াজ পাচ্ছি স্যার, মনে হচ্ছে জঙ্গলের দিক থেকে কোন নৌকো আসছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন? ... ওই তো একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে ...। দেখুন তো স্যার।!..’

    ‘স্যার বুঝলেন অজিন নিজের মধ্যে নেই। ও ভীষণভাবে আতঙ্কিত। তিনি ওকে সামলাবার জন্য বললেন, ‘এসব কিছু নয় অজিন। তুমি একটু শান্ত হও, মন শক্ত করো। আমরা দুজনেই শুধু এখানে আছি।’

    ‘না স্যার, ছপ ছপ আওয়াজটা কাছে এসে গেছে...এই তো ... এই তো নৌকোটা আমাদের পাশে এসে গেল একেবারে।’ চোখ বুজে বলে যাচ্ছে অজিন। ওর গলার উত্তেজনা ওলটপালট করে দিচ্ছিল স্যারের মনের ভাবনাগুলো। তিনি তো কোন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন না। অজিনের এখন কিছু হলে সামলাবেন কী করে?

    তখনই হঠাৎ কিসের একটা ধাক্কা লেগে নৌকোটা অন্ধকারে দুলে উঠল। বিদ্যুত চমকে উঠল। সেই আলোতে দেখা গেল নৌকোর ধারে যে জায়গায় সরীসৃপটি জলের মধ্যে আধা ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। সেই জায়গাটা খালি। সে কি তবে এই ধাক্কায় জলে পড়ে গেছে? নৌকোটা আবার দুলে উঠল একটু। ঘুরেও গেল। স্যার তাড়াতাড়ি দাঁড় টেনে জলের মধ্যে আঘাত করাতে নৌকো এগিয়ে গেল। জলের নিচে জংলায় আটকে থাকা নৌকোটা কীভাবে যেন খুলে গেছে। স্যার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অজিন ভয় পেয়ো না, শক্ত হও। নৌকো খুলে গেছে। আমরা মুক্ত।’ বলতে বলতে আবছা অন্ধকারেই সুমন-স্যার দেখলেন অজিন নেতিয়ে পড়েছে নৌকোর মধ্যে।

    **********

    বিকেল হলেই স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে যায় তার। কত কী যে মনে পড়ে। কতভাবে অজিনকে আগলেছেন তিনি। এখনও সেই চেষ্টা করে যান। অজিন কি জানতে পারে? তাকে তো রক্ষা করতেই হবে অজিনকে। যতদিন পারা যায়।

    ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে ঢোকার কয়েক বছরের মধ্যেই একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছিল অজিন। তিনি ততদিনে গ্রাম থেকে ছেলের বাড়িতে এসে গেছেন। রোজ সকালে উঠে গাড়ি চালানো শেখা শুরু হল। তিনি বসে থাকতেন পেছনের সিটে। দেখতেন ইন্সট্রাক্টর কীভাবে শেখাচ্ছেন অজিনকে। তিনিও শিখে নিয়েছিলেন গাড়ি চালানো। যখন অজিন নিজে গাড়ি চালাত, প্রায়ই তিনি পাশের সিটে বসতেন আর ওকে নানাভাবে সাহস যোগাতেন। অজিন একটু নার্ভাস থাকত। পাশের সিট থেকে পা বাড়িয়ে ব্রেক করে দুয়েকবার ছোটখাটো দুর্ঘটনা থেকেও বাঁচিয়েছেন তিনি। অজিন একাই গাড়ি চালায় এখন। ভালোই চালায়। তবে কিছুদিন আগে অজিনের আবার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল গাড়ি চালাবার সময়। একটা বড় অ্যাকসিডেন্ট থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে। ছেলে আর বউমা এখন গাড়িটাকেই খারাপ এবং অপয়া বলে মনে করে। শীগগিরই এটা বিক্রি করে নতুন গাড়ি কিনতে চায় চায় তারা। কিন্তু তাঁর একেবারেই মত নেই। তাছাড়া এই গাড়িটার ব্যাপারে তিনি নিজে অনেক কিছু জানেন। কিন্তু এখনকার নতুন গাড়িগুলো তো নতুন টেকনোলজির, তিনি তো প্রায় কিছুই জানেন না সেগুলোর। আর এখন সেই গাড়ির খুঁটিনাটি শিখবেনই বা কী করে? নতুন গাড়িতে তাহলে তিনি অজিনকে বিপদে রক্ষা করবেন কী করে। এই গাড়ি বিক্রি করতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই।

    **********

    অ্যাপের ভদ্রলোক গিয়ার হ্যান্ডেলে একটা হলুদ রঙের ফ্লোরোসেন্ট ব্যান্ড লাগিয়ে দিয়ে গেছেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন ‘এটাকে গাড়ির সুরক্ষা কবচ বলতে পারেন। ব্যান্ডটা যেন খুলবেন না, হা-হা।’ তারপর আবার গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন ‘আসলে এই ব্যান্ড হল একটা চিহ্ন যে আমদের কোম্পানি গাড়িটা ইন্সপেকশন করে ফেলেছে।’

    একটা খটকা কিন্তু বিরক্ত করছিল উনাকে। গাড়ি যে দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে তা উনি জানলেন কী করে? যদিও উনি বলেছেন যে টায়ারে দাগ আর ব্রেক-শু দেখে বুঝেছেন। আরও বলেছেন অ্যাকসিডেন্টের মুখে কোনভাবে ইমারজেন্সি ব্রেক এনগেজ হয়ে গিয়েছিল। তবে উনি নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছেন ব্যাপারগুলো। এতটা আন্দাজ করা যায় নাকি গাড়ির ব্যাপারে? নাকি গাড়িটাই সেকথা বলেছে ওনাকে? ওনার পর্যবেক্ষণের সময় মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল উনি গাড়ির সঙ্গে কথা বলছেন। তাছাড়া অ্যাপের লোক হিসেবে তিনি কেন গাড়িটা বিক্রি না করার পরামর্শ দেবেন। বড় আদ্ভুত ব্যাপারটা।

    সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই ফোন বেজে উঠল উনার। ওপাশ থেকে কেউ বলল-- ‘অজিন গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উনা যেন কালই চলে আসে গ্রামে। খুব জরুরি।’ ভীষণ ভয় পেল উনা। কী যে হচ্ছে ? এই শরীর নিয়ে কষ্ট করে হলেও তাকে যেতে হবে।

    গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উনা দেখল অজিন প্যানিক অ্যাটাকে ভুগছে। তবে এখন সে অনেকটা সুস্থ। অ্যাটাকটা হবার পর তার সমস্ত শক্তি কেউ যেন শুষে নিয়ে গেছে শরীর থেকে। কিছুটা মানসিক ভারসাম্যের অভাবও হয়েছিল তার। ডাক্তার বলেছে অজিন এখন অনেক ভালো আছে। দুয়েকদিনের মধ্যেই পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে।

    পুরো ঘটনা শুনেছিল উনা। সেদিন সুমন-স্যার একা একাই কোনরকমে দাঁড় বেয়ে নৌকোটাকে পারে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরহীন থেকে গিয়েছিল। নৌকোয় ধাক্কা লাগল কীভাবে? সরীসৃপটি নৌকোয় উঠল কী করে? নৌকোতে হঠাৎ ধাক্কাই কি তার আবার জলে পড়ে যাবার কারণ? অজিন একটা ‘ছপ ছপ’ আওয়াজ শুনেছিল বটে। তবে কি কোন অদৃশ্য নৌকো করে কেউ এসে ধাক্কা দিয়েছিল তাদের নৌকোতে? তাতেই মুক্ত হয়েছে নৌকো? কিন্তু এ তো অলৌকিক ব্যাপার। অজিনের ওরকম ভয়ানক প্যানিক অ্যাটাকই বা হল কেন? ও কি কিছু দেখেছিল? এ সবের কোন উত্তর পাওয়া যাবে না। যদিও অজিন অনেকটা সুস্থ এখন, কিন্তু সরীসৃপ বা অন্য কিছুর কথা তার মনেই নেই। সেই স্মৃতিগুলো একেবারে মুছে গেছে তার।

    **********

    গ্রাম থেকে বাড়ি ফিরেই উনা অজিনকে বলল হুইল অ্যাপের প্রতিনিধি এসে পরিদর্শন করে গেছে গাড়িটাকে। যদিও মাঝে অজীনের জন্য গ্রামে যেতে হয়েছিল বলে হুইলের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করা যায়নি। হুইলের তরফ থেকেও আর কেউ ফোন করেনি তাদের। হয়তো করেছিল কিন্তু গ্রামে নেটওয়ার্ক পাওয়া খুব মুশকিল। সেইজন্য মিস হয়ে থাকবে। তবে হুইলের ভদ্রলোক বার বার বলেছিলেন গাড়িটা খুব ভালো কন্ডিশনে আছে এটা বিক্রি না করাই ভালো।

    পরদিন ভোরবেলা উঠে গ্যারেজে গিয়ে গাড়িটাতে স্টার্ট দিয়ে চমকে গেল অজিন। পুরনো গাড়িতে এত সুন্দর ইঞ্জিনের আওয়াজ? উনা বলেছিল ভদ্রলোক নাকি পরিদর্শন করার সময় গাড়িটা হাল্কা টিউনিং করেছেন। দু-চারটে যন্ত্রাংশ টাইট করে দিয়েছেন। অয়েলিংও করেছেন। কিন্তু অ্যাপের লোকজন এসব করে বলে তো জানা ছিল না অজিনের। তবে যাই হোক গাড়িতে এখন আর কোন সমস্যা নেই।

    গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে রাস্তাতে এল সে। অনেকটা চলার পরে মনে হল গাড়ি তো নয় যেন মাখনের মধ্যে ছুরি চলছে। এত মসৃণ। নিজের আত্মবিশ্বাসটাও যেন পুরোমাত্রায় ফিরে এসেছে তার। হঠাৎ এই গিয়ার হ্যান্ডেলে ব্যান্ডটা নজর করল সে। উনা বলছিল বটে ভদ্রলোক এটা লাগিয়ে দিয়ে গেছেন কোম্পানির তরফ থেকে। হ্যাঁ রক্ষাকবচই বটে। একবার ফোন করতে হবে অ্যাপের অফিসে।

    আজ শনিবারে অফিস ছুটি থাকায় সকালে বিছানা ছাড়তে একটু গড়িমসি করছিল অজিন। তখনই কেউ দরজায় কলিং বেলটা বাজাল। উনা নিশ্চয়ই রান্নাঘরে। অজিন নিজে দরজা খুলেই দেখল একজন মধ্যবয়সি মানুষ একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অজিনের প্রশ্নবোধক চাহনির উত্তরে তিনি বললেন অ্যাপের অফিস থেকে এসেছেন অজিনদের গাড়িটা দেখতে চান।

    পেছনে ততক্ষণে উনা এসে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোককে দেখে অবাক বিস্ময়ে সে বলল-- ‘আরে আপনি তো গত রবিবারে গাড়িটা দেখে গেলেন। আবার কী ব্যাপার বলুন তো? সেদিন অবশ্য ধুতি শার্ট পরে এসেছিলেন।’

    ‘আমি এসেছিলাম?’ ভদ্রলোক আশ্চর্য হলেন। ‘হতেই পারে না। আর আমি তো ধুতি কখনও পরিই না। তবে আমরা তো সবাই কন্ট্রাক্ট এ কাজ করি তাই বলতে পারব না কে এসেছিল।’

    একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘তবে একটা ব্যাপার ঠিক যে গত রবিবার আমি আসার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু একেবারে কাছাকাছি এসেও রাস্তা একেবারে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। দুপুরবেলা রাস্তায় কেউ ছিল না। এই গলির মুখেই হঠাৎ এক বয়স্ক ভদ্রলোক এসে কী সব ডিরেকশন দিয়ে বাড়ির রাস্তা ভীষণভাবে গুলিয়ে দিয়েছিলেন। একেবারে অন্য রাস্তায় অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, বাড়ি খুঁজে না পেয়ে, বিফল হয়ে ফিরে গিয়েছিলাম। তাই আজ একটু সকাল সকাল এসেছি যাতে রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে পারি।’

    উনা লক্ষ্য করল, ইনি প্রায় একইরকম দেখতে হলেও আগের ভদ্রলোকের থেকে কমবয়সি। সে নিজের ভুল শুধরে নিয়ে বলল, ‘তবে নিশ্চয়ই অ্যাপের অফিস থেকে অন্য কেউ এসেছিল সেদিন। যাই হোক এসেছেন যখন আপনিও দেখে যান গাড়িটা।’ ভদ্রলোক গাড়িতে ঢুকেই গিয়ার স্টীকে লাগানো হলুদ ব্যান্ডটা খোলার চেষ্টা করলেন। অজিন বলল- ‘আরে ওটা খুলবেন না। ওটা তো আপনাদের লোকই লাগিয়ে দিয়েছে। ওটা লাগানোই থাক।’ ভদ্রলোক কিছুটা আশ্চর্য হলেও আর কিছু বললেন না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গাড়ি পরিদর্শন করলেন তিনি। তারপর প্রথমেই ওদের দুজনকে বললেন, ‘এখনই বিক্রি করলে এই গাড়ির খুব ভালো দাম পাওয়া যাবে।’ অজিন ভাবছিল, গত সপ্তাহে কে এসেছিলেন তবে? তিনি তো গাড়ি বিক্রি করতে বারণ করেছিলেন।

    ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকতেই একটা ফোন এল অজিনের। গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের ফোন। উনি জানালেন যে ওখানকার স্থানীয় খবরের কাগজে স্কুলের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে। সেখানে অজিনের বাবার কথা বিশেষ করে অর্থদানের কথা লেখা হয়েছে। পরে উনি ডাকে কাগজটা পাঠিয়ে দেবেন।

    **********

    অনেকদিন পর আজ বাগানে এসেছেন তিনি। আমগাছের নিচের এই বাঁধানো বেদীটাই তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। গত রাতের বৃষ্টিতে মাটি এখনও ভেজা। ছেলে ও বউমা বাড়িতে নেই। শেষ বিকেলের মন কেমন করা আলো আমগাছটার মাথা থেকে মিলিয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। তাঁর মন কিন্তু আজ বেশ খুশি। আজ সকালে তিনি শুনেছেন অজিন কাউকে বলছিল- ‘কিছু মনে করবেন না। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা স্থির করেছি গাড়িটা এখন আমরা বিক্রি করব না। পরে যদি আমাদের সিদ্ধান্তের বদল হয় তবে আপনাদের নিশ্চয়ই জানাব।’ তিনি মনে করেন অজিনের এখন একা গাড়ি না চালানোই ভালো। কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িতে নতুন অতিথি আসবে। ততদিন তাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। তিনি জানেন সেই অতিথি আসার পর অজিনকে আর রক্ষা করা বা আগলে রাখার দরকার হবে না তার। কারণ বাবা হিসেবে অজিনই তখন রক্ষক হবে সেই নতুন মানুষটির।

    **********

    গাড়ি গ্যারেজে রেখে উনাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মনে পড়ল কাল হেডমাস্টারমশাই ফোন রাখার আগে আরেকটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই অজিন স্ত্রীকে বলল- ‘মনে আছে তো উনা, আর ঠিক দু মাস বাদেই বাবার প্রথম বছরের মৃত্যুবার্ষিকী। হেড-স্যার বলেছেন সেই অনুষ্ঠান যেন আমরা গ্রামের বাড়িতেই পালন করি। স্কুলের তরফ থেকে সেদিন ছাত্র ও শিক্ষকরা বাবাকে একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে চান।’



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments