• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • বাথরুম সিঙ্গার : পরন্তপ বসু

    —অসাধারণ!

    —কী?

    —তোর বাবার গানের গলা।

    —বাবা প্রতিদিনই তো বাথরুমে গিয়েই ওই একই গান গায়, পুরানো সেই দিনের কথা।

    —সে যাই বল গলাটি কিন্তু খাসা! উনি কি গান শিখেছেন? একেবারে ব্যারিটোন ভয়েস। তোর গলাটা কিন্তু এরকম নয়।

    শুভজিতের শুনে একটু খারাপই লাগল। গানটা সে অনেক বেশি মন দিয়ে করে লেখাপড়ার থেকে। পন্ডিত আনন্দ গোস্বামীর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। স্বপ্ন দেখে একদিন নামকরা গায়ক হবে।

    শুভজিতের বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন। চম্পক উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, মেসোমশাই আমি ইম্প্রেসড!

    পরিতোষবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

    —আপনার তো দারুণ গলা!

    পরিতোষবাবু হকচকিয়ে গেলেন, তারপর লজ্জা পেলেন।

    —যাহ! কী যে বল চম্পক! আমি কোনোদিন গান শিখেছি না কি? আমি তো বাথরুম সিঙ্গার। সিরিয়াসলি গান করে শুভজিৎ। দেখো, ও একদিন খুব নাম করবে।

    পরিতোষবাবু চলে গেলেন অন্দরমহলে।

    চম্পক টিভিতে সরগম অনুষ্ঠানটি মন দিয়ে দেখছে। আজকাল নবীন প্রতিভা যে কী পর্যায়ে গেছে তা এই অনুষ্ঠানটি দেখলে বোঝা যায়। ছেলে-মেয়েগুলি কী সুন্দর গান গায়! অবশ্যই এদের ট্যালেন্ট আছে। তবে একটু মন দিয়ে দেখলে মনে হয়, এদের গানের সঙ্গে যে সব বাদ্যযন্ত্র আর অনুষঙ্গ থাকে, অনেক গানই মোটামুটি সুরে গাইলে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর লাগে। খালি গলায় গাইলে কি এতটা ভালো লাগত?

    এসব কথাই ভাবছিল চম্পক টিভির দিকে তাকিয়ে। চম্পক একটি রেডিও স্টেশনের টক্ শো হোস্ট। সেখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। টক্ শোটির নাম শব্দচুম্বক। অনেক সময় নাম করা ব্যক্তিত্বদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হয়। এইতো কিছুদিন আগে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের একটি শো ছিল। আবার অনেকসময় নাম না জানা আমজনতাকেও। গতমাসে একজন অটোচালকের ইন্টারভিউ নিল চম্পক। তিনি উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির বিখ্যাত ঠুমরি, ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গানটি নিখুঁতভাবে খালি গলায় নামালেন। শব্দচুম্বক দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে শ্রোতাদের কাছে।

    চম্পক গভীর চিন্তা করছিল। পরিতোষবাবুর ব্যারিটোন গলায় কিছু একটা আছে যা তাকে ভীষণভাবে ভাবে আকৃষ্ট করছে।

    —এই শুভজিৎ, মেসোমশায়কে বলবি আমার টক শোতে এসে দু-এক কলি গাইতে।

    —তোর কি মাথাটা গেছে? বাবা কখনও রাজি হবে? এরকম প্রোপোজাল দিলে নির্ঘাত হার্ট এটাক হবে।

    —তুই মেসোমশাইকে আরেকবার একটু ডাক তো!

    শুভজিৎ দোনোমোনো করে অন্দরমহলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে পরিতোষবাবু ঘরে ঢুকলেন।

    —মেশোমশায় আপনার কাছে একটি অনুরোধ আছে। না বলবেন না কিন্তু।

    —কী?

    —আপনি আমার টকশোতে একদিন একটু আসুন না।

    —সেখানে গিয়ে কী করব?

    —দু-এক কলি গান গাইবেন।

    —কী যা তা বলছ! আমি বাথরুম সিঙ্গার। শুভজিতকে বলছ না কেন?

    —ওকে তো বলবই। প্রথমে আপনাকে দিয়েই শুরু হোক না?

    —আমি তোমার টক শোতে কী গাইব?

    —যা আপনার মন চায়। আমি সাজেস্ট করব হেমন্তর একটা গান গাইতে।

    —কোন গান?

    —‘এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু’। …গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা! আহা! আপনার গলায় দারুণ আসবে।

    পরিতোষবাবু হাঁ-হাঁ করে বললেন, পাগল না কি? ওটা আমার বিশাল প্রিয় গান। ভুলভাল গাইলে ম্যাসাকার। হেমন্তবাবু উপর থেকে নেমে এসে এক চড় মারবেন।

    —ভুল আপনি গাইবেন না। ট্রাস্ট মি মেসোমশাই।

    —কিন্তু বাথরুমে তো আমি শাওয়ারের সঙ্গে গাই। শাওয়ারের জলের তোড়ে আমি সুর খুঁজে পাই। তোমার টক শোতে সেটা কীভাবে হবে?

    এতক্ষণ শুভজিৎ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলল, কেন শাওয়ারের জলের শব্দ গানের সঙ্গে মিক্স করা যায় না? রাহুলদেব বর্মণ তো গানে নানা রকম শব্দের প্রয়োগ করেছেন।

    চম্পক একটু চিন্তা করে বলল, ব্যবস্থা হয়ে যাবে মেসোমশাই।

    —কীভাবে?

    —আপনাকে আমার স্টুডিওতে আসতে হবে না। আমি আমার স্টুডিও আপনার বাথরুমে নিয়ে আসব।

    —যাহ! তা হয় না কি? তুমি আমার স্নান করার সময় বাথরুমে এসে ঢুকবে না কি? কী সব উদ্ভট কথা?

    —না না মেসোমশাই। আমি আপনার বাথরুমে একটি মাইক্রোফোন বসিয়ে দেব। আপনাকে দু-একটি প্রশ্ন করব এখানে। তারপর আপনি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিতে নিতে গান গাইতে শুরু করবেন।

    শুভজিৎ এই কথোপকথনে একটি এক্সপেরিমেন্টের গন্ধ পাচ্ছিল। এবার বলল, বাবা ট্রাই করো না! যদি উতরে যায় তবেই তো ব্রডকাস্ট হবে তোমার অনুমতি নিয়ে।

    ।।২।।

    —শুভসন্ধ্যা! চম্পকের শব্দচুম্বক থেকে স্বাগতম! আজকের অনুষ্ঠানে আপনাদের কাছে একজন অজানা কিন্তু বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী এসেছেন। তাঁর নাম পরিতোষ চক্রবর্তী। পরিতোষবাবু আমার কলেজের বন্ধু শুভজিতের বাবা। আর চার-পাঁচ জন বাবাদের মতোই মেসোমশাই সকল সন্ধে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন একটি মধ্যবিত্ত পরিবারকে সচল রাখতে। মানে, জুতোসেলাই থেকে চন্ডীপাঠ। তবে মেসোমশাইয়ের একটি অসামান্য প্রতিভা আছে। সেটি হলো তাঁর ব্যারিটোন সঙ্গীতকণ্ঠ।

    ইথারে চম্পকের গমগমে গলা ছড়িয়ে পড়ছে। অনুষ্ঠানটি প্রি-রেকর্ডেড। শুভজিতের বাড়িতে উপস্থিত আছে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, শুধু চম্পক ছাড়া। চম্পক বলে চলেছে, মেসোমশাইয়ের গানের একটি স্বাতন্ত্র্য আছে। উনি কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান করেন বাথরুমে শাওয়ার নিতে নিতে। জলের স্রোতের একটি সুর আছে। সেই সুরের সঙ্গে পরিতোষবাবুর গলা মিললে এক আশ্চর্য মেলোডি তৈরি হয়। শুনুন আপনাদের পছন্দের এই গানখানি।

    খানিকক্ষণ পিনপতন স্তব্ধতা। তারপর জলের স্টেরিওফোনিক শব্দ। সঙ্গে পরিতোষবাবুর কণ্ঠ, এই বালুকাবেলায় আমি লিখেছিনু, একটি সে নাম আমি লিখেছিনু, আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে যেন মুছিয়া দিলাম।

    শুনলে মনে হবে কেউ দীঘার সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে গান গাইছে। জলের শব্দ যেন সমুদ্রের ঢেউ। অসাধারণ শুনতে লাগছে।

    পরিতোষবাবুর স্ত্রী রমলা বললেন, এটা তোমার গলা! কখনও তো মন দিয়ে শুনিনি।

    পরিতোষবাবু মৃদু হেসে বললেন, তা আর কী করা যাবে? গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।

    শুভজিৎ গেরামভারি ভাবে বল, যাক উতরে গেছে। কংগ্রাচুলেশনস বাবা!

    * * * *

    ঠিক সাতদিন বাদে চম্পকের ফোন এল।

    —এই শুভ, মেসোমশাই আছেন?

    —বাবা বাজারে গেছে, কী ব্যাপার?

    —দারুণ খবর! তোকে বলার আগে মেসোমশায়কে বলি। আচ্ছা পরে ফোন করব। একঘন্টা বাদে আবার চম্পকের ফোন।

    —মেসোমশাই, আপনার শো-এর পর একটি সাবানের এডভার্টাইজমেন্ট এজেন্সি আমাকে ফোন করেছিল। দু-তিন কলি ওদের জন্য গাইতে হবে।

    —চম্পক তুমি কিন্তু আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছ! একবার গেয়েছি তোমার অনুরোধে।

    —মেসোমশাই কোনো চাপ নেই। আমি আবার আমার সাউন্ডসিটেম নিয়ে আসব। ঠিক দু-লাইন আপনাকে গাইতে হবে শাওয়ার নিতে নিতে। লাইন দুটি আপনাকে হোয়াটস্যাপ করে দেব। একটু শুভর সঙ্গে কথা বলতে দিন।

    শুভজিৎ ফোন ধরলে এক নিশ্বাসে চম্পক বলল--

    —শুভ, প্লিজ মেসোমশাইকে রাজি করা। আমি কিন্তু এবার ফ্রিতে ওনাকে গাওয়াব না। এই গানের জন্য পঁচিশ হাজার দেব। টাকাপয়সার কথা তো ওনাকে বলা যায় না।

    শুভজিৎ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে দেখি কী করা যায়।

    দু-কলি বাথরুমে গাইবেন তার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা! এ তো আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ! শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। দু-দিন বাদে চম্পক এল সাউন্ডসিস্টেম নিয়ে। গানটির চলন পরিতোষবাবুর জানা। পুরোনো দিনের লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপনের মতো। শুধু সাবানের নামটি আলাদা।

    স্বাস্থ্যরক্ষা করে এই কবিরাজি সাবান,
    কবিরাজি যেখানে স্বাস্থ্য সেখানে।

    এরপর পরিতোষবাবু সোজাসাপটা জানিয়ে দিলেন চম্পককে আর বিরক্ত না করতে। এসব তার ধাতে পোষায় না। বললেন এরপর শুভকে ডাকতে। ও গান জানে। ভালো করবে।

    ।।৩।।

    দু-সপ্তাহ বাদে শুভজিতের স্মার্টফোনে একটি অচেনা ফোনকল এল। শুভজিৎ যথারীতি অগ্রাহ্য করল স্প্যাম ভেবে। তারপর ফোনের পর্দায় একটি মেসেজ ভেসে এল।

    —শুভজিৎবাবু আমার নাম আলোক চ্যাটার্জী, রূপায়ণ রেকর্ডিংয়ের মিউজিক বিভাগের ম্যানেজার। চম্পকবাবুর কাছে আপনার মোবাইল নম্বর পেয়েছি। আপনার বাবা পরিতোষ চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক।

    সম্ভব হবে কি?

    পরিতোষবাবুকে মেসেজটি পড়ানোর পর উনি শুভজিতকে জিজ্ঞেস করলেন, কী চান এই ভদ্রলোক?

    —আরে বুঝছ না, তোমার গান রেকর্ড করতে চাইছে।

    —কী ব্যাপার বলতো? এটা কোন স্ক্যাম নয় তো?

    —আমিও বুঝছি না। চম্পককে ফোন করছি।

    চম্পক বলল, আলোক চ্যাটার্জী শব্দচুম্বকের অনুষ্ঠানটি শুনেছেন। বলছিলেন, পরিতোষ চক্রবর্তীর গলার জোয়ারি যে-কোন শ্রোতাকে মুগ্ধ করবে। ওনার একটি অ্যালবাম করতে রূপায়ণ ভীষণভাবে আগ্রহী।

    পরিতোষবাবু একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন,

    —কিন্তু শুভ গান শিখিনি, তাল লয় বুঝি না। যে কটি গান জানি সেগুলো তো রেডিও, টিভিতে শুনে শেখা।

    —ও সব নিয়ে ভেবো না। রূপায়ণের মিউজিক টিম নিশ্চয়ই সব ব্যবস্থা করবে। ওরা নিশ্চয় গান কম্পোজ করবে তোমার জন্য।

    রমলা বললেন, আরে গাও না। এত সাধাসাধি করছে। দারুণ হবে!

    ।।৪।।

    সোমবার সকাল নটায় পরিতোষবাবুকে নিয়ে শুভজিৎ হাজির হল অক্রুর দত্ত লেনের রূপায়ণ রেকর্ডিং স্টুডিওতে। আলোক চ্যাটার্জিকে ভিজিটিং কার্ড পাঠানোর পর আলোকবাবু এসে দুজনকে অফিসে নিয়ে বসালেন।

    —নমস্কার পরিতোষবাবু। খুব খুশি হয়েছি আমার আমন্ত্রণটি গ্রহণ করার জন্য। আলোকবাবু পরিশীলিত বাংলা বলেন। বছর চল্লিশ বয়স। অভিজাত হাবভাব। পরনে জহরকোট। রিমলেস চশমা।

    —একটু চা দিই?

    পরিতোষবাবু সম্মতিজনক মাথা নাড়ার পর, বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে চা আনতে পাঠালেন আলোকবাবু।

    —পরিতোষবাবু, আমাদের স্টুডিওতে কতকগুলি নিয়মকানুন আছে। আশা করি আপনি তাতে রাজি হবেন। আজ আপনার একটি অডিশন নেওয়া হবে আমাদের মিউজিক হ্যান্ডসদের সাথে। আপনার পছন্দের একটি গান পুরো গাইবেন। ঠিক আছে?

    পরিতোষবাবু ভ্যাবলা চোখে শুভজিতের দিকে তাকালেন। শুভজিৎ তাড়াতাড়ি বলল, কিন্তু বাবা তো কোনোদিন কোনো হ্যান্ডসের সঙ্গে গাননি!

    আলোক চ্যাটার্জি বললেন, কোনো অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। আমাদের টিম ওনাকে শিখিয়ে বুঝিয়ে দেবে। দে আর রিয়েল প্রফেশনালস। পরিতোষবাবু, আপনি একটু ভাবুন কী গান গাইবেন। আমাদের হাতে সময় কিন্তু খুব কম। আজ তিনটে রেকর্ডিং হওয়ার কথা।

    আলোক চ্যাটার্জী ওদের দুজনকে একটি অন্য ঘরে বসে গান নির্বাচনের জন্য আধঘন্টা সময় দিলেন।

    —কী গান গাইব রে শুভ? মাথা কাজ করছে না যে।

    আকুলভাবে পরিতোষবাবু বললেন।

    —আমার সাজেশন হলো পুরোনো দিনের কোন ছন্দওলা গান গাও। মৃণাল চক্রবর্তীর ওই গানটা গাও না?

    —কোন গান?

    —আরে শ্যামল গুপ্তর কথা, মৃণালের সুর!

    —ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে থৈ থৈ বন্যা নাচে রে?

    —হ্যাঁ হ্যাঁ জমবে!

    —পারব?

    —কেন পারবে না? তুমি তো অনেকবার গেয়েছ!

    পরিতোষবাবু একটু ভাবলেন। তারপর বললেন,

    —বেশ।

    ।।৫।।

    রূপায়ণ রেকর্ডিং স্টুডিওটি ছোট। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে একজন একটি ঢাউস সিন্থেসাইজার নিয়ে বসে আছেন। নাম সুজিত। আরেকজন কুণাল, গিটার হাতে। ড্রাম আর বাঁয়া তবলা নিয়ে সুরজিত। ঘরের অন্যদিকে একটি কাঁচের দেওয়ালের পেছনে কানে হেডফোনে লাগিয়ে একজন গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তিনি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। স্টুডিওতে শুধু গায়ক আর কলাকুশলী ছাড়া আর কারো প্রবেশ নিষেধ। যে গানটি পরিতোষবাবু গাইবেন সেটির প্রথম দুটি লাইন লিখে একটু আগেই টিমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং টিমের লোকেরা ইউটুব শুনে বুঝে নিয়েছেন গানটির চলন।

    মিউজিক ডিরেক্টর শ্রাবন্তী দত্ত স্টুডিও থেকে বেরিয়ে পরিতোষবাবুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।

    —আসুন পরিতোষবাবু।

    শুভজিৎ একটি থাম্বস আপ দিল! পরিতোষবাবু জড়োসড়ো হয়ে স্টুডিওতে ঢুকলেন।

    শ্রাবন্তী দত্ত বললেন,

    —নমস্কার মেসোমশাই! আপনি একটি দারুণ গান নির্বাচন করেছেন। এ গান কি আজকের গান? আমরা প্র্যাকটিস করছিলাম। মেজাজে গাইবেন। শুধু আমার হাত দুটির দিকে নজর রাখবেন। হাত তুললেই গান শুরু করবেন। হাত নামালে পজ। তখন মিউজিক পিক আপ করবে। আবার হাত তুললে আপনার গান শুরু। কেমন? শ্রাবন্তী ব্যস্ত ব্যবসায়িক ধাঁচে কথা বলেন। পরিতোষবাবু নার্ভাসভাবে মাথা নাড়লেন।

    —ও কে গাইস। রেডি? ওয়ান টু থ্রী।

    সিন্থেসাইজারে ছেলেটি নানা রকম কেতা করে প্রথম লাইনটি বাজাল। শ্রাবন্তী পরিতোষবাবুর দিকে তাকিয়ে হাত তুললেন। পরিতোষবাবু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রথম লাইনটি মিস করলেন।

    —কী হলো মেসোমশাই গাইলেন না?

    —ও হ্যাঁ! তাই তো! সরি!

    —নো প্রব্লেম।

    —ও কে গাইস। টেক টু। ওয়ান টু থ্রী। শ্রাবন্তী আবার হাত তুললেন।

    পরিতোষবাবু কাঁপাকাঁপা গলায় শুরু করলেন, ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে …

    ড্রাম বাজতে শুরু করল, সঙ্গে গিটার আর সিন্থেসাইজার। কিন্তু তাল কেটে গেল। সব কী রকম ঘেঁটে যাচ্ছে।

    —কী হলো মেসোমশাই। আরে রিলাক্স। বি ইওরসেলফ। ভালো হবে। শ্রাবন্তীর গলায় অসহিষ্ণুতা।

    —ও কে গাইস, টেক থ্রী। পরিতোষবাবু এবার একটু সাবলীভাবে প্রথম দুটি লাইন গাইলেন। তারপর অন্তরাতে গিয়ে একটু বেসুরো হয়ে গেল। এতো ঠান্ডা ঘরে গলাটাও বিট্রে করছে। কিছু একটা রেকর্ড হল।

    * * * *

    আলোক চ্যাটার্জিকে হতোদ্যম দেখাচ্ছিল। অডিশনের রেকর্ডটি শুনতে শুনতে পরিতোষবাবু আর শুভজিতের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

    —সরি! সেই এফেক্টটা তো আসছে না। চম্পকের টক শোতে কী সুন্দর গেয়েছিলেন!

    পরিতোষবাবু ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু ওখানে তো আমি কোনো যন্ত্রের সঙ্গে গাইনি। বলতে গিয়েও বললেন না যে রেকর্ডিংটা চম্পক বাড়ির বাথরুমে করেছিল। আলোক চ্যাটার্জী একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ওহ ওয়েল। কী আর বলব। ধন্যবাদ আসার জন্য। দু মাস পর আরেক বার প্র্যাক্টিস করে আসতে পারেন।

    ঘরে কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর পরিতোষবাবু ছেলেকে মৃদুস্বরে বললেন, শুভ তুই একটু বাইরে যা। শুভজিৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।

    পরিতোষবাবু এবার আলোক চ্যাটার্জীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিযে বললেন, স্যার একটা কথা বলি।

    —হ্যাঁ বলুন।

    —আমার ছেলে শুভজিৎ খুব ভালো গায়। তৈরি গলা। পাঁচ বছর ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিচ্ছে। আমার মতন আনাড়ি নয়। ওকে একটা চান্স দেবেন? আপনাকে হতাশ করবে না।

    —তাই? আচ্ছা আপনার ছেলেকে আমাকে একটি গানের ক্লিপ পাঠাতে বলুন।

    পরিতোষবাবু উদ্ভাসিত মুখে বললেন, থ্যাংক ইউ আলোকবাবু।

    ।।৬।।

    দুজনে চুপচাপ হাঁটছে বাড়ি ফেরার পথে। কিছুক্ষণ বাদে পরিতোষবাবু হাত রাখলেন শুভজিতের কাঁধে।

    —খুব হতাশ হলি না?

    —না না আমি কিন্তু এরকমই ঘটবে এক্সপেক্ট করেছিলাম।

    —তাই?

    —বাবা, গান তো শুধু গাইলেই হয় না। অনুশীলন করতে হয়। তালিম নিতে হয়।

    —জানি তো! তোরাই তো জোর করলি।

    দুজনে আবার চুপচাপ হাঁটতে থাকল বৌবাজারের দিকে। আকাশে মেঘ জমছে। পরিতোষবাবু এবার ব্যারিটোন গলায় গাইতে শুরু করলেন,

    শাওন এল মন বলে, সে কেন এল না
    মরমে মরমিয়া গুমরিয়া কাঁদে
    নয়নেরই ধারা মেশে বাদলেরই মাঝে রে
    জলতরঙ্গ বাজে রে
    রিমঝিম রিমঝিম বরষাতে জলতরঙ্গ বাজে রে বাজে রে!
    এই ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে …
    মুখেই মিউজিক দিচ্ছেন, আর নেচে নেচে গাইছেন হাতে তালি দিয়ে।

    রাস্তায় লোকজন তারিফের চোখে তাকাচ্ছে পরিতোষবাবুর দিকে। দু-একজন বলল, দারুণ হচ্ছে দাদা!

    শুভজিৎ থমকে ঘুরে তাকালো বাবার দিকে।

    —এইতো খাসা গাইছ! সুর তাল সব ঠিকই তো আছে, স্টুডিওতে ছড়ালে কেন?

    পরিতোষবাবুকে এত খুশি কখনও শুভজিৎ দেখেনি। দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, ওসব আমার পোষায় না কি? তুই গাইবি ওসব যন্ত্রের সঙ্গে। আমি তো বাথরুম সিঙ্গার।

    আবার দুজনে পথ চলতে শুরু করল। বৃষ্টি এল বলে।

    ……………

    (উডি এলেনের, "টু রোম উইথ লাভ' ছবির একটি উপাখ্যানের ছায়াবলম্বনে।

    কবিবন্ধু মহুয়া সেনগুপ্তকে পুরোনো খসড়ার উপর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। পাঠকের ভালো লাগা না লাগার দায়িত্ব সম্পূর্ণ লেখকের।)



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments