“চাল আজ চাট্টি বেশি নিও তপু বুঝলে। আজ একেবারে শ্যামার খাসি।” বাজারের ব্যাগটা তপুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সুধাময় বলে উঠল।
“সে তো অনেক দাম গো।”
“তা ওর দোকানে দাম একটু বেশিই। ন’শো টাকা কেজি নিল। কিন্তু গতকাল আড্ডায় শ্যামাকান্তর খাসির যা গুণগান চলছিল যে বাজারে গিয়ে আর মনটাকে বাগে রাখতে পারলাম না।”
সুধাময়ের গলা থেকে খুশি চলকে উঠল। তপতী ব্যাগটা হাত থেকে নিয়ে আনাজপাতি সরিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে শালপাতায় মোড়া মাংস খুব যত্ন করে স্টীলের জামবাটিতে ঢালল। নরম আর অল্প গরম মাংসের স্পর্শ তারও বেশ ভালো লাগল। মাংস ধুতে ধুতে সে হিসেব করল প্রায় দু’মাস পরে এ বাড়িতে খাসির মাংস রান্না হচ্ছে। যা দাম! সুধাময়ের একার রোজগারে বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া খাসি কেনা সম্ভব নয়।
“বৌমা আজ নাকি মাংস হচ্ছে,” শ্বশুরমশাইয়ের গলার আওয়াজে ভাবনার সুতো ছেঁড়ে।
“হ্যাঁ বাবা।” তপতীর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“তাহলে গুঁড়ো মশলায় না রেঁধে মশলাটা একটু শিলে বেটে নিও। স্বাদটা ভালো হয় তাতে। আমার মা একদম গুঁড়ো মশলা ব্যবহার করতেন না। মায়ের হাতের মাংস যে একবার খেয়েছে সেই জানে কী তার স্বাদ।”
কড়াইতে মাংস কষা হচ্ছে। অল্প টকদই আর মশলাপাতি দিয়ে ঘন্টা খানেক মেখে রেখেছিল। এখন পেঁয়াজ-রসুন-আদা-গরমমশলা আর মাখানো মাংসের মেলবন্ধনে যে গন্ধটা বেরোচ্ছে তা রান্নাঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে গোটা বাড়িটাকে উচাটন করে তুলেছে। এ বাড়িতে মহানবমী, ভাইফোঁটা আর পয়লা বৈশাখ ছাড়া খাসির মাংস ঢোকে না। কেনার সাধ্য নেই সুধাময়ের। কতটা কষেছে তা হাত দিয়ে টিপে দেখে আবার খুন্তি চালালো কড়াইতে। নেড়ে চেড়ে সব মশলা মাংসের গায়ে লাগানোর চেষ্টা করছে তপু। জল শুকিয়ে মাংসটা কমে এসেছে। আন্দাজ সাড়ে সাতশো আছে। মনে হচ্ছে কষা হয়েছে – হাতায় তুলে টিপে দেখতে গিয়ে ছ্যাঁকা লাগল আঙ্গুলে। প্রতিবর্তক্রিয়াতে আঙ্গুল মুখে। চমৎকার এক স্বাদ তার জিভ হয়ে মস্তিস্ককে আচ্ছন্ন করল, সে টুকরোটা মুখে ভরে ফেলল।
“কী খাচ্ছ মা, মাংস খেলে?”
অপ্রস্তুত তপু সবেগে মাথা নাড়ে। কিন্তু মেয়ে তীক্ষ্ণ, নির্মম, “বললেই হল? হাঁ করো তো, হাঁ করো দেখি …”
গোলমালে শাশুড়ি-শ্বশুর দুজনেই বেরিয়ে আসেন। শাশুড়ি বিজবিজ করে ওঠেন, “কী লোভ! সোয়ামী শ্বশুরের আগে খাওয়া! আমরা তো বাপু ভাবতেও পারতাম না।” বিব্রত তপুর মাথা নীচু। নিজের ওপর রাগ আর মেয়ের ওপর অভিমানে চোখে জল এল।
হেনকালে সুধাময় ঢুকল, আর সবাই একসাথে ঘটনাটা বলতে লাগল। সুধাময় বাঁকাভাবে বলে উঠল, “সেই জন্যই তো ঠিকঠাক কুলোয় না।”
বলতে পারল সুধাময়? পারল বলতে? কীভাবে চালিয়ে নেয় তপু জানে না তার স্বামী? সবার মুখে হাসি ফোটাতে কীভাবে বঞ্চিত করে নিজের স্বাদকোরক? একদিন নয় - দিনের পর দিন। ছ’জনের সংসারে সাড়ে সাত’শ মাংস কত কুলোবে? তপু কোনদিন একটুকরোর বেশি পেয়েছে? সবাইকে দিয়ে ভালো একটা টুকরো জুটেছে তার। তার বুক জ্বালা করছে। ঝালটা কি বেশি হয়ে গেছে? তার জিভে আর মাংসের স্বাদ নেই, অন্য এক কটু স্বাদ। রান্নাঘর থেকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে।
গোপাল রেডি। ললিতা, বিদিতা আর বুবলাইও তৈরি। গোপালের সাজগোজ চোখে পড়ার মত। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম জামাইষষ্ঠী। শাশুড়িমা মেয়ের হাতে টাকা ধরে দিয়েছেন সবার জন্য জিনিষ কিনতে, মায় গোপালের মা-বাবা, দাদা-বৌদি, মিষ্টু কেউ বাকি নেই। গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে এসে তিনি ললিতাকে বললেন, “শোন গোপালের জামার ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করবি না কিন্তু, গোপালই আমার সব।” গোপাল ওরফে অনিরুদ্ধ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চোখ ফেরাল।
“জানি মা, আমি ঠিক আনব – অপছন্দ হবে না।” ললিতার বড় গুণ সে মিষ্টভাষী, বৌয়ের এই স্বভাবটি গোপালের ভারী পছন্দ।
গোপালের বেশ লাগছে শ্বশুরবাড়িতে এত গুরুত্ব আর মনোযোগ পেতে। সে বাড়ির ছোটছেলে, বাড়িতে তাকে কেউ বড় একটা পাত্তা দেয় না। আসলে তার দাদা তার থেকে আট বছরের বড়ো, দিদিও প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের বড়। দু’জনেই বরাবর নিজেদেরকে গোপালের গার্জেন ভেবে এসেছে। মায়ের কোলপোঁছা ছেলে, তাই তার আস্কারা বেশি। আদরে-গোবরে বড় হয়েছে। কোন সিরিয়াস ব্যাপারে তার মতামত গুরুত্ব পায় না। কিছু এদিক-ওদিক হলেই সবাই তাকে নাড়ুগোপাল বলে ক্ষ্যাপায়। সে শান্তশিষ্ট প্রকৃতির কিন্তু আজকাল ললিতাও যখন আড়ালে তাকে নাড়ুগোপাল বলে তখন তার ভীষণ রাগ হয়।
তা সেই গোপালের জন্য এ বাড়িতে সবাই খুব যত্নবান। শাশুড়িমা তো তাকে কীভাবে যত্ন করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। দ্বিরাগমনের পরে এবারই তার বেশিদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি আসা। বিদিতাও তাকে বেশ পছন্দ করেছে, আর বুবলাই তো তার ফ্যান হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে গোপালের আর তার পছন্দ একেবারে খাপে খাপ। সে নাকি বিরিয়ানির থেকে বাসন্তী পোলাও বেশি ভালোবাসে, বিরাট কোহলির থেকে রোহিত শর্মার ব্যাটিং তার বেশি ভালো লাগে। সৃজিতের থেকে শিবপ্রসাদের সিনেমা তাকে বেশি টানে। সত্যি-মিথ্যে গোপাল জানে না তবে ললিতার মুচকি মুচকি হাসি দেখে মনে হচ্ছে বুবলাইয়ের ভালোলাগাগুলো তাকে ইমপ্রেস করার জন্য। সত্যি বলতে কি সেটা গোপালের আরও ভালো লেগেছে। তার প্রিয় হবার জন্য এত আগ্রহ আগে কেউ দেখায়নি।
জামাইষষ্ঠীর বাজার, রাসবিহারীতে পা ফেলার জায়গা নেই। গাড়ি রেখে বেশ খানিকটা হেঁটেই দোকানে পৌঁছতে হল। তারপর জিনিষ কেনা। বৌয়ের পছন্দ হয় তো বিদিতার হয় না, বিদিতা মুগ্ধ তো ললিতা খুশি নয়। বুবলাইয়ের সতেরো বছরের পক্ষে এসব বোরিং। সে জিজুর সাথে ইংলিশ সিরিজ নিয়ে বকে চলেছে। গোপালেরও শাড়ি-ফাড়ি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই। তার জিনিষ সে ভেবে নিয়েছে- কুর্তা পাজামা জ্যাকেট। তার জামাকাপড়টা কেনার সময় ললিতা নিশ্চয়ই ডাকবে।
ডাক একসময় এল। তার দাদার জিনিষ পছন্দের জন্য। সে সাধ্যমতো চেষ্টা করল দাদার ড্রেস পছন্দ করতে। এরপর নিশ্চয়ই তারটা। গোপাল নিজেই সেলসম্যানকে ডেকে কুর্তা-পাজামা পছন্দ করে চলেছে। ললিতা ঘেঁষে এল, ভাইবোনের কান বাঁচিয়ে বলল, “বুবলাই কিন্তু এসব পরবে না। আর এত দামি!”
গোপাল থমকাল। তারও তো এবাড়ির সবার জন্য উপহার কেনার কথা। মা আড়ালে বলেও দিয়েছিল। ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে ললিতাকে কিছু বুঝতে দিল না, “বুবলাই? আরে না। সে সব তোমার ব্যাপার। যার জন্য যা ইচ্ছে নাও, দাম নিয়ে ভেবো না। আমি পে করে দেব।”
ললিতার মুখটা আলো-আলো হয়ে গেল। সব মেয়েই চায় উদারচেতা স্বামী। আর বাপের বাড়ির জন্য হাত খুলে খরচ করার আনন্দই আলাদা। তার কানে এল গোপাল বলে চলেছে, “এটা আমি আমার জন্য দেখছি।” তার হাত তখনও কুর্তা সেটের ওপর নড়াচড়া করছে।
“দামটা একটু বেশি কিন্তু মা তো বললেন আমার জিনিষের দামের কোন লিমিট নেই,” সহাস্য গলা।
ললিতার চোখে অপার বিস্ময়। তারপর সে চোখ কৌতুকে ঝলসে ওঠে, হাসতে হাসতে সে বলে, “সেই গোপাল শুধু আমার গোপাল নয় গো, সে সবার গোপাল, যশোদাদুলাল।”