আমার সোনামণি, শোনো, সেই খুব খুব পুরোনো সময়ে হাতিদের কিন্তু লম্বা শুঁড় ছিল না। তার একটা কালোমতন মোটকা নাক ছিল, একটা বুট জুতোর মত বড়, সেটা সে একদিক থেকে অন্যদিকে নড়াতে পারত, কিন্তু কোনো জিনিস তুলতে পারত না। কিন্তু সেই সময়ে একটা নতুন হাতি ছিল, মানে হাতির বাচ্চা, যার মনে সব ব্যাপারে এত কৌতূহল ছিল যে সে সারাক্ষণ প্রশ্ন করত, করতেই থাকত, কিন্তু সন্তুষ্ট হত না। সে আফ্রিকায় থাকত, আর সারা আফ্রিকা তার প্রশ্নের জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে যেত। সে তার লম্বা অস্ট্রিচ মাসিকে জিজ্ঞেস করত তার ল্যাজের পালকগুলো ওরকম হয়েছে কেন, আর তার লম্বা অস্ট্রিচ মাসি শক্ত শক্ত নখওলা থাবা দিয়ে তার পাছায় চাপড় মারত। সে তার লম্বা মামু জিরাফকে জিজ্ঞেস করেছিল তার চামড়ায় এত ছোপ ছোপ কেন, আর তার লম্বা জিরাফ মামু তার শক্ত খুর দিয়ে পাছায় চাপড় মারল! তবুও সেই বাচ্চা হাতির অনবরত প্রশ্ন করার অভ্যেস যায়নি। সে তার মুটকি পিসি হিপোপটেমাসকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল তার চোখগুলো লাল কেন, আর মুটকি পিসি নিজের চওড়া খুর দিয়ে তার পাছায় চাপড় মারল। সে তার লোমওলা কাকু বেবুনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তরমুজগুলো খেতে ওরকম কেন, আর তার লোমওলা কাকু বেবুন লোমওলা থাবা দিয়ে তার পাছায় চাপড় মারল। সবার কাছ থেকে পাছায় চাপড় খেয়েও তার কৌতূহল যায়নি, সে যা দেখত, যা শুনত, বা অনুভব করত, গন্ধ পেত, বা ছুঁত, সব কিছুর ব্যাপারেই প্রশ্ন করতে থাকত, আর তার মাসি পিসি কাকু মামু সববাই তাকে পাছায় মারত। তবুও তার মাথা ছিল কৌতূহলে ঠাসা! এক সুন্দর সকালে যখন শরতকাল শেষ হব হব করছে, এই অদম্য কৌতূহলী হাতির বাচ্চা একটা প্রশ্ন করল যা সে আগে কখনো জিজ্ঞেস করেনি। সে জিজ্ঞেস করল, “কুমির তার ডিনারে কী খায়?” শুনেই সবাই ভয়ানক বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল, “চুপ।” আর তারা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে কিছুক্ষণ ধরে না থেমে পাছায় চাপড় মারল। যাই হোক, এইসব যখন শেষ হল, সে বেরিয়ে একটা কোলোকোলো পাখিকে একটা কাঁটাঝোপের মাথায় বসে থাকতে দেখে বলল, “আমার বাবা আমাকে পাছায় চাপড় মেরেছে। আমার সব মাসি পিসি কাকু মামু আর যত যত আছে আমি বেশি জিজ্ঞেস করি বলে আমাকে পাছায় চাপড় মেরেছে। তবুও আমি জানতে চাই কুমির ডিনার কী দিয়ে করে।” সব শুনে কোলোকোলো পাখি খুব দুঃখের স্বরে বলল, “তুমি ধূসর সবুজ, বিশাল, তেলতেলে দেখতে লিম্পোপো নদী, যার আশপাশে চারদিকে জ্বরের গাছ আছে, তার কাছে যাও, আর গিয়ে নিজেই দেখে নাও।” পরের দিন যখন শরতকাল এক্কেবারেই চলে গেছে, কারণ আগে যেমনি করে যেত তেমনিভাবে এখনো যায়, এই অদম্য কৌতূহলে ঠাসা মাথা হাতির বাচ্চা, একশ পাউণ্ড কলা যেগুলো ছোট ছোট ও লাল রঙের, আর একশ পাউণ্ড আখ, যেগুলো লম্বা বেগুনি রঙের, আর সতেরোটা খরবুজা যেগুলো সবুজমতো আর ফাটা ফাটা ধরনের, নিয়ে তার প্রিয় পরিবারের সবাইকে বলল, “গুড বাই, আমি এখন ধূসর সবুজ, তেলতেলে দেখতে মস্ত নদী লিম্পোপো, যার পারে ও আশেপাশে জ্বর গাছ আছে, সেখানেই যাচ্ছি, আর সেখানে গিয়ে দেখে আসব যে কুমির ডিনারে কী খায়।” আর তারা সবাই তাকে গুডলাক জানাতে আবার তার পাছায় চাপড় মারতে থাকল, যদিও শেষপর্যন্ত সে তাদের বিনীতভাবেই বলেছিল আর না চাপড়াতে। তারপর সে বেরিয়ে পড়ল, গরম লাগছিল, কিন্তু এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, সে খরবুজা খেয়ে খেয়ে আর খোসা ছড়িয়ে ফেলে যাচ্ছিল, কারণ সে তখন কিছুই তুলতে পারত না। সে গ্রাহামের শহর, কিম্বার্লি পেরোলো, কিম্বার্লি থেকে খমা’র গ্রাম, তারপর খমা’র গ্রাম থেকে উত্তর ধরে পুবমুখে গেল, পুরো সময় খরবুজা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সে পৌঁছল ধূসর সবুজ তেলতেলে লিম্পোপো নদীর কাছে যার আশেপাশে শুধুই জ্বর গাছ, ঠিক যেমনটা কোলোকোলো পাখি বলেছিল। এখন, সোনামণি, তোমাকে জানতে ও বুঝতে হবে যে সেই সপ্তাহ, সেই দিন, সেই ঘণ্টা, আর সেই মিনিট পর্যন্ত এই অদম্য কৌতূহলী হাতির বাচ্চা কোনোদিন কুমির দেখেনি, এবং জানতও না কুমির দেখতে কেমন হয়। তাই তার এত কৌতূহল ছিল। প্রথম জিনিস যা সে সেখানে দেখল, তা হল একটা পাথরে-থাকা-দু’রঙা-পাইথন, যা একটা বড় পাথরের চারদিকে জড়িয়ে বসেছিল। “মাফ করবেন,” হাতির বাচ্চা বিনম্রভাবে বলল, “আপনি কি কুমির বলে কোনো জিনিসকে এই চালচুলো-না-থাকা জায়গাতে দেখেছেন?” দু’রঙের পাইথন পাথরে জড়ানো নিজের শরীরটাকে তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে তার বড়বড় আঁশওলা চ্যাপটা আর মুগুরের মত ল্যাজ দিয়ে হাতির বাচ্চার পাছায় চাপড় মারল। হাতির বাচ্চা বলল, “এ তো বড় আজব ব্যাপার হল, আমার বাবা, আমার মা, আমার মাসি অস্ট্রিচ, আমার মামা জিরাফ, আর পিসি জলহস্তী, কাকা বেবুন সব্বাই আমার এই কৌতূহলের জন্য আমাকে পাছায় মেরেছে, আর আমার মনে হচ্ছে আপনারটা মারটাও তেমনি ব্যাপার।” তাই সে পাথরের মাঝে-থাকা-দু-রঙা পাইথন সাপকে নম্রভাবে গুডবাই বলে তাকে আবার পাথরের সঙ্গে জড়াতে সাহায্য করল, এবং তারপর চলতে শুরু করল; তার বেশ গরম লাগছে, কিন্তু আশ্চর্য লাগছে না, যেতে যেতে খরবুজা খেয়ে খেয়ে এবং খোসাগুলো পথে ছড়িয়ে যাচ্ছে, কারণ সে তখন কিছু তুলতে পারত না; যখন সে ধূসর-সবুজ, তেলতেলে দেখতে বিশাল নদী লিম্পোপোর কাছে এসে পৌছোল, যার আশেপাশে শুধুই জ্বর গাছ, নদীর একেবারে ধারে একটা কাঠের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখল। কিন্তু, জানো, সোনামণি, ওই কাঠের গুঁড়িটা আসলে ছিল কুমির, আর কুমিরটা তার একচোখ পিটপিট করল, ঠিক এই আমি যেমন করছি, দ্যাখো। “আময় মাফ করবেন,” হাতির বাচ্চা বলল, “আপনি কি কোনো কুমিরকে এই এলোমেলো জায়গাতে কখনো দেখতে পেয়েছেন?” তখন কুমির তার অন্য চোখটা পিটপিট করল, আর তার ল্যাজ কাদা থেকে ওঠাল, আর হাতির বাচ্চা তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গেল, কারণ তার আর পাছায় চাপড় খাবার ইচ্ছে করছিল না। “এখানে এসো, ছোট্ট খোকা,” কুমির বলল, “তুমি কেন একথা জিজ্ঞেস করছ?” “মাফ করবেন,” হাতির ছানা খুব নম্রভাবে বলল, “কিন্তু আমার বাবা আমায় পাছায় চাপড় মেরেছে, আমার মা-ও পাছায় মেরেছে, আর আমার লম্বা মাসি অস্ট্রিচ আর লম্বা মামু জিরাফ, যে খুব জোরে কিক মারতে পারে, আর মোটা পিসি হিপোপটেমাস,ও আমার লম্বা চুলো কাকু বেবুনের তো কথাই নেই, এমন কি নদীর পাড়ের উপরে পাথরে থাকা দুরঙা-পাইথন-পাথরসাপ তার বড়বড় আঁশওলা চ্যাপ্টা মুগুরের মত ল্যাজ দিয়ে এদের সব্বার চাইতে জোরে মেরেছে। আর সেইজন্য আপনিও নিশ্চয় ওরকম করবেন, তাই আমি আর পাছায় চাপড় খেতে চাই না।” কুমির বলল, “ছোট্ট খোকা, তুমি এদিকে এস, কারণ আমিই কুমির”, আর সে তার কথা ঠিক বোঝাতে তার চোখ দিয়ে একফোঁটা কুমিরের চোখের জল ফেলল। তখন হাতির বাচ্চা এসব দেখেশুনে একেবারে খুসিতে বড় বড় শ্বাস ফেলে নদীর তীরে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তোমার মত লোকই আমি এত্ত দি-ন ধরে খুঁজছি। তুমি কি বলবে তুমি কী দিয়ে ডিনার কর?” “কাছে এস, ছোট বাচ্চা,” কুমির বলল, “আমি তোমার কানে কানে বলব।” তখন হাতির বাচ্চা কুমিরের মুখোশের মত শক্ত, বড় বড় দাঁতে ভর্তি মুখের কাছে তার মাথাটা নিচু করতেই কুমির তার ছোট নাকে ধরল, যা এই হপ্তা, এই দিন এই ঘণ্টা, এই মিনিট পর্যন্ত একটা বুটজুতোর চাইতে বড় ছিল না, যদিও বুটজুতোর চাইতে অনেক বেশি কাজের ছিল। কুমির বলল, আর সে কথা বলল তার দু’পাটি দাঁতের ফাঁক দিয়ে, “আমার মনে হয় আজকে আমি শুরু করব একটা হাতির বাচ্চা দিয়ে।” একথা শুনে হাতির বাচ্চা খুব চিন্তায় পড়ল, আর সে তার নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এরকম নাকি সুরে বলতে পারল, “আঁবাকে যেঁতে দাঁও। আঁবার লাঁকছে।” তখন দুরঙা-পাইথন-পাথরসাপ কোনোরকমে নদীর পাড়ের উপর থেকে বলল, “আমার ছোট বন্ধু, তুমি যদি যত জোরে পার তত জোরে টানতে না পার, আমার মনে হচ্ছে এই বড় বড় খাঁজ কাটা চামড়ার ডাব্ল আলস্টার ওভারকোট”— আল্স্টার ওভারকোট বলতে সে কুমিরকে বুঝিয়েছিল— “তোমাকে হ্যাঁচকা টানে জ্যাক রবিন্সন বলার আগেই ওই টলটলে জলে নিয়ে যাবে।” সব দু’রঙা-পাইথন-পাথর-সাপ এরকম কঠিন করেই কথা বলত। তখন হাতির বাচ্চা তার ছোট দুটো পাছার উপর বসে টানতে থাকল, টানতে থাকল, টানতে থাকল, তার নাক ছাড়তে থাকল। কুমির জলে ঝাপটা মারতে থাকল, জল তার ল্যাজ আছড়ানোর ফলে ঘোলা হতে থাকল, তবুও সে টানতে থাকল, টানতে থাকল, টানতেই থাকল। আর হাতির বাচ্চার নাক ছাড়তেই থাকল; হাতির বাচ্চা তার চার পা ছড়িয়ে টানতেই থাকল, টানতেই থাকল, টানতেই থাকল, তার নাক ছাড়তেই থাকল; কুমির তার ল্যাজটা দাঁড়ের মত জলে আছড়াতে থাকল, আর প্রত্যেকটা টানে হাতির বাচ্চার নাক লম্বা হতেই থাকল, আর তার বেশ ব্যথা লাগছিল। তারপর হাতির বাচ্চার মনে হল তার পাগুলো হড়কে যাচ্ছে, আর তার নাক, যা এখন প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা হয়ে গিয়েছিল, সেই নাকেই সে নাকিসুরে বলল, “আঁবার জঁড্য এঁটা বড্ড বেঁশি হঁয়ে যাঁচ্ছে।” তখন দু’রঙা পাইথন পাথর-সাপ নেমে নদীর ধারে এল, আর হাতির বাচ্চার পেছনের পা দুটোকে দুটো লংদানা সেলাইয়ের মত প্যাঁচ দিয়ে জড়িয়ে ধরল, আর বলল, “অসাবধান অনভিজ্ঞ পথিক, এখন খুব সাবধানে আমাদের এই টানাটানি করতে হবে। যদি না করি, তাহলে আমার মনে হয় ওই নিজে-থেকে- চলতে-থাকা-যুদ্ধজাহাজ যার উপর বর্মের ঢাকনা আছে তা চিরতরে তোমার ভবিষ্যতের কাজকর্মকে নষ্ট করে দেবে।” বুঝলে সোনামণি, যুদ্ধ জাহাজ বলতে সে কুমিরকে বুঝিয়েছিল। আসলে, দুরঙা পাইথন পাথর-সাপ এরকম কঠিন কঠিন কথা বলত সব সময়। তাই সে হাতির বাচ্চাকে টানল, আর হাতির বাচ্চাও টানল, আর কুমির ও টানতে থাকল। তবে এখন হাতির বাচ্চা আর দুরঙা-পাইথন-পাথরসাপ খুব জোরে টানল, আর শেষপর্যন্ত সারা লিম্পোপো নদীর উজান ও ভাটি দুদিকের জলেই ছড়িয়ে যাওয়া একটা জোর প্প্ল্ শব্দ করে কুমির হাতির বাচ্চার নাক ছেড়ে দিল। তখন হাতির বাচ্চা ধুপ করে হঠাৎ বসে পড়ল; কিন্তু সে প্রথমটা দুরঙা-পাইথন-পাথরসাপকে ধন্যবাদ বলতেও সাবধান ছিল; তারপর বেচারা টেনে-লম্বা-করা নাকটাকে দেখে তার খুব কষ্ট হল, ঠাণ্ডা কলাপাতায় পুরো নাকটাকে পেঁচিয়ে বিশাল ধূসরসবুজ লিম্পোপো নদীতে ঠান্ডা হবার জন্য ঝুলিয়ে রাখল। “এরকম করছ কীসের জন্য?” দুরঙা-পাইথন-পাথরসাপ তাকে জিজ্ঞেস করল। “মাফ করবেন,” হাতির বাচ্চা বলল, “আমার নাকটা একদম বেখাপ্পা হয়ে গেছে, তাই আমি এটা যাতে কুঁচকে গিয়ে আগের মত ছোট হয়ে যায়, সেই অপেক্ষা করছি।” হাতির বাচ্চা নাকটা কুঁচকে ছোট হবার জন্য তিন দিন সেখানে অপেক্ষা করল। কিন্তু সেটা আর ছোট হল না। তা ছাড়া, নাক লম্বা হওয়ার কারণে তার চোখও তেরচা হয়ে গেল। কারণ, সোনামণি, তুমি যদি দেখ, বুঝতে পারবে যে কুমির নাকটাকে টেনে লম্বা করে একটা আসল শুঁড় বানিয়ে দিয়েছিল, যা হাতিদের এখনো একই রকম আছে। তিন দিনের শেষে একটা মাছি এসে তার কাঁধে কামড়ে দিল। আর কিছু ভাল করে বুঝে ওঠার আগেই সে তার শুঁড় তুলে তার ডগা দিয়ে মাছিটাকে মেরে ফেলল। “এই তো, একনম্বর সুবিধে,” দু-রঙা-পাইথন-পাথরসাপ বলল, “তোমার সেই শুধু দেখানোর জন্য নাকটা দিয়ে এটা করতে পারতে না।” হাতির বাচ্চা নিজেই বুঝতে পারবার আগেই তার শুঁড় এক বড় ঘাসের আঁটি উপড়ে সামনের পায়ে মেরে ঘাসগুলোকে ঝেড়ে নিয়ে পরিষ্কার করল আর মুখে ঢুকিয়ে দিল। “দুনম্বর সুবিধে!” দুরঙা-পাইথন-পাথর-সাপ বলল। “তোমার ওই দেখানোর জন্য নাকটা দিয়ে এই কাজটাও করতে পারতে না। তোমার কি মনে হচ্ছে না এখন খুব গরম?” “হ্যাঁ, খুব গরম লাগছে,” বলে সে বুঝতে না বুঝতেই তার শুঁড় বিশাল ধূসর সবুজ তেলতেলে লিম্পোপোর পার থেকে কাদা তুলে মাথায় থেপে দিল আর মাথার উপর থেকে কান পর্যন্ত নরম কাদার প্রলেপের টুপি মাথাটাকে ঠাণ্ডা করে দিল। “তিন নম্বর সুবিধে!” দুরঙা-পাইথন-পাথর-সাপ বলল, “তোমার ওই দেখানো নাকটা দিয়ে এই কাজটা ও হত না। তাহলে বল, আবার কী পাছায় চাপড় খেতে চাও?” “মাফ করবেন,” হাতির বাচ্চা বলল, “আমার তা মোটেই ভাল লাগবে না।” “তাহলে তুমি কি কারো পাছায় চাপড় মারতে চাও?” দুরঙা-পাইথন-পাথর-সাপ বলল। “আর কাউকে পাছায় মারতে আমার বেশ ভালই লাগবে, সত্যি,” হাতির বাচ্চা বলল। “ভাল,” দুরঙা-পাইথন-পাথর-সাপ বলল, “তোমার এই লম্বা নাক অন্যদের পাছায় চাপড় মারার জন্য খুব কাজে আসবে।” “ধন্যবাদ,” হাতির বাচ্চা বলল, “আমি কথাটা মনে রাখব; আর মনে হচ্ছে এখন আমি বাড়িতে আমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবার চেষ্টা করলে ভাল।” তো হাতির বাচ্চা আফ্রিকার একদিক থেকে অন্যদিকে তার শুঁড় দিয়ে কখনো এটা ওটা পরখ করে, কখনো বা শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে চলল। যখন তার মনে হত ফল খাবে, সে আগে যেমন পাকা ফল কখন গাছ থেকে পড়বে তার অপেক্ষায় থাকত, এখন তা না করে থেকে গাছ থেকে ফল টেনে নামিয়ে খেত। যখন তার মনে হত ঘাস খাবে, সে মাটি থেকে ঘাস শুঁড় দিয়ে ছিড়ে নিয়ে খেতে পারত, আগের মতন মাটিতে হাঁটুর উপরে ভর করে মুখ দিয়ে টেনে ছিঁড়ে খেতে হত না। আর যখন মাছিরা কামড়াত, সে একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে সেটা দিয়ে মাছি তাড়ানোর হাতিয়ার বানিয়েছিল। আর রোদে গরম বেশি লাগলে সে শুঁড় দিয়ে নদীর ধারের নতুন, নরম কাদা তুলে মাথায় মেখে টুপির মত ঢেকে দিত। আর যখন তার নিজেকে একা মনে হত, সে শুঁড় নিচু করে নিজে নিজেই গান গাইত, আর তার গলার আওয়াজ পেতলের ব্যাণ্ডের চাইতেও উঁচু ছিল। সে তার রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় একটা হিপোপটেমাসকে দেখতে গিয়েছিল, সেই হিপো অবশ্য তার কোনো আত্মীয় ছিল না। দুরঙা-পাইথন-পাথর-সাপ তাকে যা বলেছিল, তার সত্যতা পরীক্ষা করবার জন্য সেই হিপোকে সে নিজের নতুন শুঁড় দিয়ে জোরে পাছায় মেরেছিল। বাকি সময়টা সে লিম্পোপো যাবার পথে যে খরবুজার খোসা ফেলে ফেলে গিয়েছিল, সেগুলো এখন কুড়োতে কুড়োতে গিয়েছিল, কারণ সে ছিল একজন পরিচ্ছন্ন ঐরাবত। এক অন্ধকার সন্ধেয় সে তার পরিবারের সবার দেখা পেল, এবং তার শুঁড় গুটিয়ে রেখে তাদের জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ?” তারা তাকে দেখে খুব খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বলল, “আয়, আয়, তোর অতিরিক্ত কৌতূহলের জন্য পাছায় চাপড় মারি।” “পুঃ,” হাতির বাচ্চা বলল, “আমার মনে হয় না যে তোমরা সবাই পাছায় চাপড়ানোর ব্যাপারে কিছু জানো; কিন্তু আমি জানি, এবং আমি তোমাদের দেখাব।” তারপর সে তার গোটানো শুঁড় খুলে তার দুই ভাইকে মাথা থেকে পা অবধি চাপড় মারল। তারা বলল, “পাকা কলার দিব্যি, তুই কোত্থেকে এই চালাকি শিখল? আর তোর নাকটাকে তুই কী করেছিস?” “আমি নতুন নাকটা ধূসর-সবুজ, তেলতেলে দেখতে বড় নদী লিম্পোপোর পাড়ে থাকা একটা কুমিরের থেকে পেয়েছি”, হাতির বাচ্চা বলল। “আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও ডিনারে কী খাবে, আর তখন সে আমাকে এই নাক দিয়েছে।” বড়বড় লোমওলা বেবুন কাকু বলল, “এটা কিন্তু দেখতে খুব বাজে লাগছে।” “তা ঠিক,” হাতির বাচ্চা বলল, “কিন্তু এটা খুব কাজের।” সে তার বড় বড় লোমওলা কাকু বেবুনকে একটা লোমশ পা ধরে উঠাল, আর তাকে ভিমরুলের চাকের উপর ঠেলে দিল। তারপর দুষ্টু হাতির বাচ্চা তার যত পরিবারের লোকজনকে পেল, সবাইকে ধরে পাছায় চাপড় মারল, যতক্ষণ না তাদের গরম লাগে ও তারা আশ্চর্য হয়ে যায়। সে তার অস্ট্রিচ মাসির ল্যাজের পালক টেনে তুলল, তার লম্বা মামু জিরাফের পেছনের পা ধরে কাঁটাঝোপে টেনে নিল, তার মুটকি পিসি হিপোপোটেমাস যখন দুপুরে খাবার পর জলে ঘুমোচ্ছিল, তার কাছে গিয়ে চিৎকার করল, আর কানে বুড়বুড় করে বুদবুদ ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু কেউ কোলোকোলো পাখিকে যেন না ধরে-- এই বলে সবাইকে নিষেধ করে দিল। শেষটায় ব্যাপারটাতে সবাই এত উৎসাহ পেয়েছিল যে তার পরিবারের সবাই একজন একজন করে তাড়াতাড়ি দুপারে ও আশেপাশে জ্বর গাছ থাকা ধূসর-সবুজ তেলতেলে দেখতে লিম্পোপো নদীর কাছে যেতে থাকল, যাতে কুমির তাদেরো লম্বা নাক দেয়। যখন তারা ফিরে এল, তাদের আর কেউ পাছায় চাপড়াত না; আর সেই সময় থেকে, বুঝলে সোনামণি, সব হাতি যাদের তুমি দেখতে পাও, আর যাদের তুমি দেখতে পাচ্ছ না, বা যাদের তুমি দেখতে পাবে না, তাদের সবারই এই অদম্য কৌতূহলী হাতির বাচ্চার মত লম্বা শুঁড় হয়ে গেছে। টীকাঃ
লিম্পোপো— দক্ষিণ আফ্রিকার একটা বড় নদী।
জ্বর গাছ— সিঙ্কোনা গাছ, যার ছাল থেকে কুইনিন হয়।
জ্যাক রবিনসন— before you could say Jack Robinson ১৮ শতকে ব্যবহৃত ইংরাজি বাগ্ধারা, হঠাৎ করে, আচমকা বোঝাতে ব্যবহার হত। বলা হয় যে জ্যাক রবিন্সন নামে ব্যক্তি খুব তাড়াতাড়ি তার মত পাল্টাত।