• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • অশ্বারোহী : রিঙ্কি দাস

    মা-বাবাকে রাজস্থান ঘোরানোর প্ল্যানটা ঊর্মিই করেছিল। অবশ্য ভালো ট্রাভেল এজেন্ট ধরলে কাজটা ততটা কঠিন নয়, ঊর্মিকে বিশেষ ঝক্কি পোয়াতে হয়নি; বছরের পর বছর রান্নাঘর আর বাজারের মধ্যে আবদ্ধ জীবনে দশ দিনের এই অক্সিজেনটুকু পেয়ে মা গার্গী দেবী দারুণ খোশমেজাজে রয়েছেন, অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার দীপকবাবু তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও ঊর্মি বুঝতে পারে, বাবা এখানে এসে বেশ প্রসন্ন। সেনাবাহিনীর কাজে দীপকবাবু ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরলেও রাজস্থানে এই তাঁর প্রথম আসা।

    হ্যান্ডিক্রাফটস কেনার জন্য আদর্শ দোকানগুলোর একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিল ট্রাভেল এজেন্সির রুবিদি, সেটা মিলিয়েই দোকানবাজারে ঢুঁ মারছিল মা-মেয়ে; স্ত্রীর শপিং-এর চিরন্তন প্রথা মেনে দীপকবাবু তাদের পিছন পিছন হাঁটছিলেন কিছুটা দূরত্ব রেখে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতার প্রবল দরাদরির ক্রসফায়ারে তাঁকে ফেঁসে যেতে না হয়। ইচ্ছে করেই কোনো দোকানের ভিতরে ঢুকছিলেন না তিনি, অপ্রয়োজনীয় শো-পিস কেনাকাটায় তাঁর কোনোদিনই আগ্রহ নেই। ওদিকে মা-মেয়ে মিলে মীনাকারি দুল, হাতির দাঁতের বাক্স, বান্ধনি শাড়ি, কাঠের পুতুল, রংচঙে রজাই, পটারি নিয়ে পাগলের মত এ দোকান সে দোকান চষে বেড়াচ্ছে, এসব দেখে কিছুটা বিরক্তিই হচ্ছিল তাঁর। সেই সময়েই চোখে পড়ে গেল ছবিটা।

    রাস্তায় অন্যান্য দোকানের মত এসি, কাচের দরজা দেওয়া দোকান নয়, ডিসপ্লে কেসটার অবস্থাও তথৈবচ, ঘুপচি দোকানের বাইরে থেকে কম পাওয়ারের বাল্ব-এর ম্লান আলোয় ভিতরের পণ্যসামগ্রী সেভাবে চোখে পড়ার কথা নয়, তবুও পড়ল। পুরনো, সম্ভবত রঙ-জ্বলা সাবেকি ধাঁচের পেইন্টিংটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন দীপকবাবু।

    ছবিটা রাজারাজড়াদের যুদ্ধদৃশ্যের। ছবিতে অনেক চরিত্র, কেউ হাতির পিঠে, কেউ ঘোড়সওয়ার, পদাতিকও রয়েছে বেশ কজন। বেশিরভাগ সৈন্যই ঢাল তলোয়ার হাতে লড়াইয়ে ব্যস্ত। এই আঙ্গিকে রাজাদের যুদ্ধের ছবি তেমন বিরল নয়, তবু দীপকবাবু দোকানে অন্য কোনো কিছুর দিকে দৃকপাত না করে ছবিটা দেখিয়ে দোকানদারকে বললেন বিল করে দিতে। দরাদরি হবে ভেবে দামটা একটু চড়িয়েই বলল দোকানদার; দীপকবাবু একবাক্যে সেই দামটাই দিয়ে দিলেন।

    দোকানের বাইরে মা-মেয়ের মধ্যে তখন সাড়া পড়ে গেছে, বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দুজনকে আশ্বস্ত করে ছবিটা দেখালেন দীপকবাবু। ঠোঁট ওল্টালেন গার্গী দেবী। "কী এমন আহামরি দেখতে! তাছাড়া আমাদের ছোটো ফ্ল্যাটে এত বড় ছবি টাঙাবে কোথায়, বসার ঘরের দেওয়ালে কতটুকু আর জায়গা? আমি কিন্তু মধুবনী রাধাকৃষ্ণটা সরিয়ে এরকম ফ্যাকাসে ছবি ঝোলাতে পারব না...কত দাম নিল?"

    দাম শুনে গার্গীর মাথায় হাত! এই দামে একটা ভালো কার্পেট হয়ে যেত!

    "ছবিটা খুব মন টানল, কেন ঠিক বোঝাতে পারব না।" দীপকবাবুর গলায় অনুশোচনার লেশমাত্র নেই। "বিশেষ করে এই কালো ঘোড়াটা দেখো, সব হাতি ঘোড়ার পিঠে একটা মানুষ রয়েছে, কোণের এই ঘোড়াটা একদম একা। পুরো মাঠে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাই লড়াই করছে।"

    "ভীমরতি!" দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন গার্গী দেবী। ঊর্মির অবশ্য ভালই লাগল, বাবা কালেভদ্রে শখ করে নিজের জন্য কিছু কেনেন, সারাজীবন ভারতবর্ষের এত জায়গায় ঘুরেছেন, মায়ের জন্য শাড়ি, মেয়ের জন্য খেলনা, বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের জন্য ছোটোখাটো উপহার আনলেও কোনোদিন নিজের জন্য কিছু আনতেন না। বাবার জন্মদিন উপলক্ষে নতুন শার্ট বা পাঞ্জাবি, কখনো হেমন্ত বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক গানের ক্যাসেট পছন্দ করে মা-ই কিনতেন। এখন অবসর জীবনে হয়ত সেই শখ মেটানোর মত কিছু খুঁজে পেয়েছেন। ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথা না ঘামিয়ে গালার চুড়ির ছোটো দোকানটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঊর্মি, এর মধ্যে দীপকবাবু হঠাৎ উল্টোদিকে আরেকটা রাস্তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। প্রচুর ঝলমলে রঙচঙে ওড়নার দোকান। একটা গাঢ় লাল বাঁধনি ওড়না দেখিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেন, "এটা কত?"

    "এমন ক্যাটক্যাটে লাল ওড়না আবার কার জন্য?" এবার বেশ সন্দিহান মনে হয় গার্গী দেবীকে।

    সবাইকে অবাক করে ওড়নাটা ততক্ষণে মাথায় একদম পাগড়ির মত করে বেঁধে ফেলেছেন দীপকবাবু। দোকানদার বলে ওঠে, "একদম খাস রাজস্থানের মানুষের মতোই কষে পাগড়ি বেঁধেছেন স্যার, ট্যুরিস্টরা সাধারণত এত সুন্দর করে পাগড়ি বাঁধতে পারে না!"

    "বুড়ো বয়সে যত আদিখ্যেতা!" বললেও মায়ের গলায় প্রচ্ছন্ন মুগ্ধতা বুঝতে অসুবিধা হলো না ঊর্মির। আর্মির শরীরচর্চা, পরিমিত খাওয়াদাওয়া আর ভালোমত ডিসিপ্লিনে অভ্যস্ত দীপকবাবুর এখনো রীতিমত নির্মেদ দেহসৌষ্ঠব, চুলে সামান্য পাক ধরলেও গোঁফজোড়া একদম কুচকুচে কালো, ছ ফুট ছুঁই-ছুঁই ঋজু দেহে ধবধবে সাদা ফুল শার্ট অফ হোয়াইট ফর্মাল প্যান্টের সঙ্গে লাল পাগড়ি কিন্তু একটুও বেমানান লাগছে না, বরং তাঁর চেহারায় বেশ একটা রাজকীয় আবেদন যোগ করে দিয়েছে। ঊর্মি মুচকি হেসে সেলফোনে টুক করে একটা ছবি তুলে নিল। এবারও একটুও দরকষাকষি না করে দোকানদারকে তার পাওনা মিটিয়ে দিলেন দীপকবাবু।

    রাজস্থান ভ্রমণের দিনগুলো বেশ হইহই করে কাটিয়ে মা আর বাবাকে কলকাতার ফ্লাইটে তুলে দিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে এল ঊর্মি। আবার প্রতিদিনের অফিসের জাঁতাকল, মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে পাব রেস্টুরেন্ট বা বাড়িতে আড্ডা। ফেসবুক ইন্সটায় কিছুদিন রাজস্থান ভ্রমণ বিষয়ক ছবিতে সামাজিক মাধ্যমের অজস্র বন্ধুর প্রশংসাসূচক বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তারপর সব স্মৃতির পাতায়।

    দুর্গাপূজায় আলাদা ছুটি নেই, তবে উইকএন্ড বলে একটু দামি প্লেনের টিকিট কেটে কলকাতায় ঝটিকাসফর সেরে নিল ঊর্মি, প্যান্ডেল হপিং, কফি হাউস, ফুচকা মোগলাইয়ের ফাঁকে মা-বাবার সঙ্গে তেমন সময় না কাটালেও ফ্ল্যাটের বিভিন্ন কোণে সাজানো রাজস্থানের শিল্পকর্মগুলো চোখ এড়ালো না উর্মির। দরজার পাশে এরোপ্লেনে এক্সট্রা লাগেজ চার্জ দিয়ে সন্তর্পণে আনা নীল সাদা সিরামিক-এর বড়সড় ফুলদানি, বসার ঘরে পেলমেটের ওপর রঙচঙে কাঠের পুতুল, ডিভানের ওপর নতুন রজাই, দেখতে দেখতে মাকে সে প্রশ্ন করল, "বাবার ওই যুদ্ধের ছবিটা কই?"

    "ওটা স্টাডিতে আলমারির পিছনে রোল করে রেখে দিয়েছি। কোনো দেওয়ালে ফিট করছিল না অত বড় ছবি।" রান্নাঘর থেকে জবাব দিলেন গার্গী। "এমনিতে হয়তো কাউকে উপহার হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু ছবিটা এত ম্যাড়ম্যাড়ে দেখতে যে সেই উপায়ও নেই, লোকে ভাববে পুরনো জিনিস দিচ্ছি। পুরো পয়সাটাই জলে গেছে!"

    "ওটা কাউকে উপহার দেওয়ার জন্য কিনিনি।" খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই বললেন দীপকবাবু। "খুব দুর্মূল্য ছবি, রঙ তুলিতে কীভাবে একটা সম্পূর্ণ আখ্যান, ইতিহাসের একটা বাঙ্ময় মুহূর্ত ফুটিয়ে তোলা যায় সেটা এই প্রাচীন শিল্পীর কাছে শিক্ষণীয়।"

    "এগুলো তেমন প্রাচীন কিছু বোধহয় নয়, বাবা। বিশুদ্ধ অ্যান্টিক হলে আরও অনেক বেশি দাম দিতে হতো। এটা বড়জোর সেকেন্ড হ্যান্ড বা থার্ড হ্যান্ড, তাই এমন রঙচটা দেখতে। খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, শিল্পী হয়তো এখনও জীবিত।"

    "না রে মা, একেবারে ভুল। এমন অসামান্য যুদ্ধদৃশ্য কেউ ঘরে বসে আঁকতে পারে না, এমন কম্পোজিশন কারুর নিজের চোখে দেখা না হলে সম্ভব নয়। শিল্প ততটা না বুঝলেও যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝি।"

    "কত যেন ঘোড়ার পিঠে চেপে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছ!" ধূমায়িত লুচি-আলুর তরকারির প্লেট ডাইনিং টেবিলে ঠক করে নামিয়ে রেখে বক্রোক্তি করেন গার্গী দেবী।

    "তলোয়ার বা যুদ্ধাস্ত্রটা বড় কথা নয়। যারা অস্ত্র নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের আপাতদৃষ্টিতে যতই বীর মনে হোক না কেন, সবের পিছনে একটা ভয় কাজ করে। হেরে যাওয়ার ভয়, মৃত্যুভয়, কখনো মৃত্যুর চেয়ে অসহনীয় দৈহিক যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘায়ু হওয়ার ভয়! আপনজনকে হারানোর ভয়, বন্ধু বা সুহৃদের মৃতদেহ বহন করে আনার ভয়, পরিবারের কাছে ফিরতে না পারার ভয়, বহু কাজ অসমাপ্ত রেখে, বহু কর্তব্য অসম্পূর্ণ রেখে চলে যাওয়ার ভয়! ছবিটায় দেখো, প্রত্যেকটা যোদ্ধার মুখে সেই ভয়! আঁটোসাঁটো পাগড়ি বেঁধে, বর্ম পরে, ঢাল তরবারি নিয়ে যতই বীরদর্পে সেনাবাহিনীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ুক না কেন, সবের কেন্দ্রে শুধু ভয়! ছবিতে প্রত্যেকটা যোদ্ধার মুখের অভিব্যক্তির মধ্যে এই ভয়টা অসাধারণ তুলে ধরেছেন শিল্পী।"

    "আজকাল বাড়িতে বসে থেকে থেকে এইসব আজগুবি কথাবার্তা বড্ড বেড়ে গেছে।" ঊর্মির পাতে আরো দুটো লুচি দিতে দিতে মন্তব্য করেন গার্গী। "তুই দূরে থাকিস, দুশ্চিন্তা করবি বলে বলি না।‌”

    "আজগুবি কেন হতে যাবে, একজন যুদ্ধ অভিজ্ঞ মানুষের সুন্দর বিশ্লেষণ। একটা ছবি বাবাকে এইভাবে ছুঁয়ে গেছে দেখে আমার তো বেশ ভালো লাগছে। অবসর নেওয়ার আগে বাবার এই শিল্পরসিক সত্ত্বাটার সঙ্গে আমার অন্তত পরিচয় ছিল না।"

    ব্রেকফাস্টের পর নিজের ঘরের ড্রেসিং টেবিলের সামনে প্রসাধন সারছিল ঊর্মি, আজ সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখা, আড্ডা আর বাইরে খাওয়ার প্ল্যান, মা এসে নীচু গলায় বললেন, "দ্যাখ, আমার কিন্তু তোর বাবার ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না। মাঝেমধ্যে ছবিটা টেনে বার করে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর নিজের মনে বিড়বিড় করে। আমি চেপে ধরলে বলে, সব কিছু নাকি আমায় বুঝিয়ে বলা যায় না। তাছাড়া কদিন হলো দেখছি একটা বড়সড় বাঁধানো খাতায় কীসব লেখালেখি করছে। নিজের পড়ার টেবিলের তালা দেওয়া ড্রয়ারটায় খাতাটা ভরে রাখে, আমি চাইলে বলে, এখনও দেখার মত কিছু হয়নি। সময়মত দেখতে পাবে।"

    "ভালো তো, রিটায়ার করার পর একটা কোনো হবি নিয়ে থাকাটা মেন্টাল হেলথ-এর পক্ষে উপকারী, এ নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে?" পারফিউম-এর ঢাকনা লাগাতে লাগাতে মন্তব্য করে ঊর্মি। "বাবা ছবি দেখে বিশ্লেষণ করছে, লেখালেখি করছে, এর মধ্যে কোনোটাই তো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়।"

    "যে মানুষটা বিয়ের সময়ে একটাও রবীন্দ্রনাথের কবিতা পুরোপুরি বলতে পারত না, সে খাতা খুলে পাতার পর পাতা হাবিজাবি লিখছে দেখলে চিন্তা হওয়ারই কথা।"

    ঊর্মিকে নির্লিপ্ত দেখে গলার স্বর খাদে নামিয়ে গার্গী বলে চলেন, “আরো অদ্ভুত কথাবার্তাও বলে মাঝে মাঝে। সেদিন তোর সতুমাসীদের গৃহপ্রবেশে গিয়েছিলাম দুজনে। সবাই টুকটাক ঘর সাজানোর জিনিস দিচ্ছে, আমি ও একটা ভালো বেড কভার দিলাম… তা যাক গিয়ে, তোর মেসোর এক ভালো বন্ধুর অ্যান্টিক জিনিসের দোকান, উনি একটা ঢাল তলোয়ার নিয়ে এসেছিলেন। তোর বাবা সেটা দেখে কী মুগ্ধ, সারা দিন সেটা ঘুরিয়ে কত রকম পোজ দিল, তরবারির বৈশিষ্ট্য নিয়ে মেসোমশাইকে অনেক কিছু বলল, খাওয়ার সময়টা বাদ দিয়ে তলোয়ারটা একবারও হাতছাড়া করল না, বিকেল পর্যন্ত ওটা কোলে নিয়ে বসে রইল…আমার ওর সেদিনের ব্যবহারে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, জানিস? মনে হয় একটা ডাক্তার দেখানো দরকার। সতুও বলল, জামাইবাবুর ব্যবহার একটু অন্যরকম ঠেকছে, ভালো কোনো মনোরোগ ‌বিশেষজ্ঞকে…”

    ঊর্মি ব্যাপারটাকে তেমন আমল দিল না। কথাটা সেবারের মত চাপা পড়ে গেল। বন্ধুদের সঙ্গে হই হুল্লোড় করে পুজো কাটিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে এল ঊর্মি। তার মাস তিনেকের মাথায় কুরিয়ার মারফত একটা মাঝারি সাইজের প্যাকেজ হাতে পেল সে। একটা মোটা বাঁধানো খাতা, তার সঙ্গে বাবার লেখা চিঠি। খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্য-- "ঊর্মি মা, এই লেখাটা নিছক কল্পনা নয়। একদম চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তাই লিখছি। ঠিক ওই জয়পুরের পেইন্টিং-এর মত। ইতি বাবা।" সাদা রুলটানা রাইটিং প্যাডের কাগজে আর একটাও শব্দের অপচয় করেননি দীপকবাবু।

    ঊর্মি খাতাটা একটু উল্টে পাল্টে দেখল। তার কোনোদিনই গল্পের বই বা পত্রপত্রিকার প্রতি টান নেই, তাই খাতাটা দু পাতা শুরু করে একটা যুদ্ধের গল্পের ইঙ্গিত পেয়েও বেশিক্ষণ পড়ায় মন বসল না তার। কোনো এক ছুটির দুপুরে পড়বে ভেবে কাজের টেবিলের ওপর খাতাটা ফেলে রাখল ঊর্মি। আই টি কোম্পানির কাজ, তায় ঊর্মি একটু বাড়াবাড়ি রকমের কাজপাগল, অফিস থেকে ফিরে রাতের দিকে, অনেক সময় রবিবারেও ল্যাপটপ খুলে খুটখুট করার অভ্যাস। নানান কাজের চাপে বাবার খাতাটা খুলে দেখা হলো না বহুদিন। ক্রমশ ফাইল, প্রিন্টআউট, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ইলেকট্রিসিটি বিল এসবের নীচে তলিয়ে গেল নীলরঙা বাঁধানো খাতা।


    দুঃসংবাদটা এল হঠাৎ করেই। ঊর্মির মাসতুতো দিদির ছেলের অন্নপ্রাশন খেয়ে ফিরছিলেন দীপক আর গার্গী, বাড়ি পৌঁছে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পেয়েছিলেন দীপকবাবু। প্রথমে অগ্রাহ্য করলেও বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে অবস্থার অবনতি হয়। রান্নাঘরে সদ্য ডেলিভার হওয়া গ্যাস সিলিন্ডারের তদারকি করছিলেন গার্গী, বেডরুমে যখন এলেন, তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো, কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ।

    শনিবার সন্ধ্যা, ঘরেই ছিল ঊর্মি। মার ফোন পেয়ে পরবর্তী ফ্লাইটের টিকিট কেটে তড়িঘড়ি একটা ক্যারি অন সুটকেসে দু সেট জামাকাপড় ভরে রওনা দিয়েছিল সে। কী যেন একটা ভেবে ফ্ল্যাট থেকে বেরোনোর আগে টেবিল থেকে তুলে নিয়েছিল বাবার পাঠানো নীল খাতাটা। ক্যাবে বসে উদভ্রান্তের মত লাগছিল তার। এমন কিছু বয়স হয়নি বাবার, প্রেসার শুগার জাতীয় কোনো সমস্যা ছিল না, প্রতিদিন সকালে জগিং, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সরসাইজ করতেন, নিয়মিত যোগাভ্যাস করতেন, এভাবে কি করে একজন সুস্থ সবল মানুষ চলে যেতে পারেন?

    বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা অপেক্ষা, ফ্লাইটে প্রায় ঘন্টা তিনেক। এই দীর্ঘ সময়ে খুব মন দিয়ে খাতাটা পড়ে দেখল সে। কী অদ্ভুত সুন্দর কয়েকটা গল্প! গঙ্গাধর নামক এক ঘোড়সওয়ার সৈনিক আর তার সাহসী ঘোড়া মেঘবরণকে নিয়ে অনেকগুলো ছোটো গল্প। তারা একসঙ্গে যুদ্ধে লড়ে, শান্তির সময়ে স্থানীয় রাজার হয়ে দৌত্যবৃত্তি পালন করে। কখনো কখনো কাজ না থাকলে ঘোড়া আর তার মনিব নিশ্চিন্তে গ্রামেগঞ্জে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, অনেক অ্যাডভেঞ্চার তাদের দুজনের। বেশ সুন্দর ঝরঝরে লেখা, ঘোড়সওয়ার গঙ্গাধরের চোখ দিয়ে দেখা সব ঘটনা। শেষটা বড় কষ্টের, এক অসম যুদ্ধে সংখ্যালঘু সৈন্যবাহিনীর একজন অশ্বারোহী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে বিচ্ছেদ হয়ে যায় মেঘবরণ আর গঙ্গাধরের। চারদিকে তীরের বর্ষা, তরবারির ঝনঝনানির থেকে আত্মরক্ষা করতে করতে তার হারানো ঘোড়াকে পাগলের মত খুঁজে বেড়ায় গঙ্গাধর। খুঁজে পায় কি শেষ পর্যন্ত? পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায় ঊর্মির। বাবা এমন সুন্দর লিখতে পারতেন, তার খোঁজ পেতে এত দেরি হয়ে গেল?


    পরের কয়েক দিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। সবাই নিয়ম মেনে যা যা করতে বলে, মন্ত্রচালিতর মত করে যায় ঊর্মি। মা গার্গী একেবারে শোকস্তব্ধ, মাঝে মাঝেই শুধু বলতে থাকেন, "এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।"

    উপলক্ষ্য যতই যন্ত্রণাময় হোক, কাজের তাগিদে বেঙ্গালুরু ফেরার সময় এগিয়ে আসে ঊর্মির। তার এক দূর সম্পর্কের মাসী রাস্তার উল্টো দিকে অন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকেন, তিনি এসে রোজ দেখা করে যান গার্গীর সাথে। কথা দেন, ঊর্মি চলে যাওয়ার পরও তিনি দু বেলা খোঁজখবর রাখবেন।

    কলকাতা থেকে ফিরে যাওয়ার আগের দিন বিকেলে ল্যাপটপে ওয়েব চেক ইন করতে বসেছিল ঊর্মি, মা এসে বললেন, "এই ছবিটা তোর সঙ্গে নিয়ে যাবি? আগে একবার বলছিলি, তোর ফ্ল্যাটের বসার ঘরের দেয়ালটা ন্যাড়া, এটা ঝুলিয়ে রাখিস না হয়।"

    কম্পিউটার থেকে মুখ তোলে ঊর্মি। মা-র হাতে একটা রোল করা পেইন্টিং। গোটানো অবস্থায় থাকলেও ঊর্মির চিনতে ভুল হয় না। রাজস্থান ভ্রমণের সময়ে বাবার কেনা সেই যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি।

    "তোর বাবার স্ট্রোকটা হওয়ার সময়ে খাটের পাশে মাটিতে বসে পড়েছিল। আর কিছু হাতের কাছে না পেয়ে এই রোল করা পেইন্টিংটাই আঁকড়ে ধরেছিল। আমার এখন এটার দিকে তাকালে কেমন যেন লাগে, শেষের কদিন অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখত বাবা, চিরকেলে কাঠখোট্টা মানুষ, কোনোদিন আর্ট নিয়ে কোনো জ্ঞানগম্যি নেই, সে এই সাত পুরোনো ছবির মধ্যে কী খুঁজে পেয়েছিল কে জানে! আমি ঠাট্টাও করেছি সেটা নিয়ে…যাক সে কথা। আমাদের দেওয়ালে তো আর কোনোদিন ঝোলানো গেল না, দ্যাখ যদি তোর কাজে লেগে যায়!"

    একটু ইতস্তত করেন গার্গী দেবী। বলেন, “জানিস, শেষ মুহূর্তে রোল করা ছবিটা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মেঘ, মেঘ! কী বলতে চেয়েছিল, জানি না। জিভ জড়িয়ে গিয়েছিল, চোখের দৃষ্টি যেন কেমন বদলে গিয়েছিল! এই ছবিটা আমি আর ঘরে রাখতে চাই না। তুই না নিতে চাইলে ফেলে দেব।”

    "নিয়ে যাব। আমার দেওয়ালে ফিট হয়ে যাবে মনে হয়। তাছাড়া একটা মাত্র ক্যারিঅন ব্যাগ এনেছি, এই ছবিটা চেক-ইন করে দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।"

    একটু অন্যমনস্ক ভাবে গোটানো পেইন্টিংটা একবার খুলে দেখে ঊর্মি। একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে।

    রঙ জ্বলা ছবিটার কোণে সেই সওয়ারহীন একলা কালো ঘোড়ার পিঠে একদম টাটকা ঝকঝকে রঙে আঁকা এক অশ্বারোহী সৈন্য। হাতে তরবারি, মাথায় টকটকে লাল পাগড়ি। মুখটাও ঊর্মির চিরপরিচিত।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments