"আরে বাবাজীবন, তুমি?" দরজা খুলে একগাল হাসি হাসেন বিশুবাবু। "এসো, এসো, কী সৌভাগ্য! তোমার তো এদিকে আসাই হয় না বিশেষ!"
"কী যে বলেন, বাবা! এই পথে তো যাওয়া-আসা রোজ লেগেই থাকে! হ্যাঁ, আপনার কড়া নাড়ার সময় তেমন পাই না সেটা অবশ্য ঠিক কথা। সে জন্যেই আজ এসে পড়লাম। তারিখটা মনে আছে নিশ্চয়ই!"
"তারিখ? ও, আচ্ছা, আজ তো জামাইষষ্ঠী! কী লজ্জার বিষয়, জামাইকে শ্বশুরের দরজায় এসে জামাইষষ্ঠীর কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে! এসো, বাবাজীবন, তুমি আরাম করে বসো। আসলে তোমার এত কাজের চাপ, কোনোদিন বেড়াতে আসার ছুটি পাও না, তাই লৌকিকতাগুলো আমিও ভুলতে বসেছি!"
"কাজের চাপ একটু আছে বইকি, বাবা!" সূর্যকুমার হাত-পা ছড়িয়ে সুদৃশ্য বৈঠকখানার গদিমোড়া অ্যান্টিক আরামকেদারায় বসে পড়েন। "তবে জানেন কি, করোনার পর থেকে সারা বিশ্বে যখন সবাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর পন্থা অনুসরণ করছে, তখন মাঝেমধ্যে আমারই বা করতে বাধা কোথায়! তাই ভাবলাম, আজ একটু কাজ ফাঁকি দিয়ে এত যুগের বকেয়া জামাইষষ্ঠীর খাওয়াটা খেয়ে যাই।"
"তা খুব ভালো করেছ, সুয্যি। আমার ঘেঁটুকে এখন গিয়ে বলি রান্না চাপাতে!"
“ঘেঁটু? ঘেঁটু কে? আপনি রান্নার লোক রেখেছেন বুঝি?”
“না হে সুয্যি, তুমি তো জানো, আমার রসুইঘরের এতসব অত্যাধুনিক গ্যাজেট কোনো ছাপোষা রান্নার লোকের হাতে ছাড়ার মানুষ নই আমি। তবে আমার ঘেঁটুর কথা আলাদা। যেমন রূপ তেমন বুদ্ধি, আর যন্ত্রপাতির ব্যাপারে খুব চালাক চতুর। এমনকি আমার লেটেস্ট মাইক্রোওয়েভ কুকটপ-টা তো ওরই ডিজাইন!”
"রান্নার লোক রাখেন না যখন, তখন এই ঘেঁটু দেবীটি কে একটু খুলে বলুন দেখি? আপনার নতুন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট? নাকি তারও বেশি কিছু?" সূর্যকুমার নড়েচড়ে বসেন। "চিরকাল জানতাম আমার সঞ্জু মাতৃহীনা, আপনিই একাধারে তার মা ও বাবা, সেই সূত্রে একাধারে আমার শ্বশুর ও শাশুড়ি ...এর মধ্যে ঘেঁটু নাম্নী মহিলাটিকে এত ‘আমার আমার’ করছেন কেন...আপনি কি তবে আমাদের না জানিয়ে আবার বিয়েটিয়ে..."
"আরে না না, বিয়েটিয়ে নয়। লিভ টুগেদার। ঘৃতাচি দেবীর টপ সিক্রেট অ্যাসাইনমেন্টে নাকি বিয়ে করার অনুমতি নেই। অগত্যা এই ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।"
সূর্য চুপ করে যান। তাঁর প্রচণ্ড টেক স্যাভি শ্বশুরটির ধ্যানধারণা চিরকালই একটু অন্যধরনের, তা ছাড়া শ্বশুরমশাইয়ের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর নাক গলানো সমীচীন নয়। রান্নাঘরে ঢুঁ মেরে দেখার নাম করে অন্দরমহলে গিয়ে একটা ট্রে-তে পানীয় সাজিয়ে বসার ঘরে ফিরে আসেন বিশুবাবু। জামাতার মুখোমুখি সোফায় গুছিয়ে বসেন।
"তা ঘেঁটুর কথা শুনে তুমি এমন আঁতকে উঠলে কেন, বাবাজীবন? তোমার স্ত্রী, মানে আমার মেয়ের তো কথাটা অজানা নয়। তাছাড়া আমার আর ঘেঁটুর এক সন্তান..."
"হ্যাঁ, সঞ্জু বলেছে। তবে নিজের সেই মর্কট সৎভাইয়ের সঙ্গে তার কোনোদিনই সদ্ভাব ছিল না, তাই তাকে নিয়ে সে তেমন কিছু আলোচনা করতে চায় না। ভাইবোনের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক নেই ভেবে আমিও এই প্রসঙ্গটা নিয়ে বেশি চাপাচাপি করি নি।" সূর্যকুমার একটু গম্ভীর হয়ে যান।
"সেটা স্বাভাবিক।" মুচকি হাসেন শ্বশুরমশাই। "আমাদের ওই ছেলেটির অনেক গুণ, আমি চিরকাল তার প্রচুর প্রশংসা করতাম, কত কম বাজেটে কি দুর্দান্ত একটা ব্রিজ বানিয়েছিল একবার, মনে আছে? তা বয়ঃকনিষ্ঠ সৎভাইয়ের প্রশংসা শুনে শুনে আমার মেয়ে বোধহয় একটা সিবলিং রাইভালরি গোছের কিছু ফিল করত। ও-মেয়েকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় নরমসরম স্বভাব, ভিতরে ভিতরে চিরকালই খুব কম্পিটিটিভ। তবে আজও আমার বিশ্বাস, নিজের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের চেয়ে তোমার সঞ্জু অনেক বেশি গিফটেড। একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ও একদিন যা করেছিল, আমি আজও তা বানানোর কথা ভাবতে পারি না।"
"জানি। আজকে মানবসভ্যতা নানা ধরনের রোবট বানাচ্ছে ঠিকই অথচ সঞ্জু এতবছর আগে যে যুগান্তকারী জিনিস আবিষ্কার করেছিল তার কাছে সব তুচ্ছ!"
"বললাম তো, অত্যন্ত প্রতিভাময়ী মেয়ে। অল্পবয়সে ওই বিয়ে বিয়ে করে না লাফিয়ে যদি ল্যাবে আমার সঙ্গে কাজ করত, তাহলে ইতিহাসে নাম উঠে যেত!" কন্যাগর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিশুবাবুর মুখ। "ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে কেমন করে যে বানিয়েছিল ওরকম তুখোড় একটা প্রোডাক্ট! আমার সাম্প্রতিকতম কোনো রোবট ওর ধারে-কাছে আসে না।"
"আপনারা বাপবেটি মিলে ভীষণ রকম বোকা বানিয়েছিলেন আমায়! কী লজ্জাজনক একটা পরিস্থিতি বলুন তো! শেষমেশ রেগেমেগে সঞ্জু নিজেই সব কিছু পাওয়ার অফ করে বাক্সে ভরে রেখে দিল।"
"সেটাই বিচক্ষণতার লক্ষণ। সব আবিষ্কারের গল্প পৃথিবীকে জানাতে নেই। তাছাড়া বাপ-বেটির চক্রান্ত ভেবে মনে ক্ষোভ পুষে রেখো না বাপু, তোমাকে বোকা বানানোর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব শুধু বেটির। বাপ মানে আমি অনেক দিন পর্যন্ত জানতেও পারিনি তলে তলে কী হচ্ছে!”
"ওর ওই বেখাপ্পা রোবটের জন্য আমাদের পরিবারে কত ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল সে খোঁজ রেখেছিলেন? নাকি আপনি তখন ঘেঁটু আন্টিকে লাইন মারতে ব্যস্ত ছিলেন?"
"নাহ্ ঘেঁটু আন্টির চ্যাপ্টার থেকে তোমাদের বিয়ের আগেই বিরতি নিয়ে নিয়েছিলাম।" বিশুবাবু পানীয়ের গেলাসে একটুকরো বরফ নেন। "এতদিন আগের কথা, তবু স্পষ্ট মনে আছে। ওইটুকু মেয়ে সঞ্জু, উঠল বাই, বিয়ে করা চাই! বলত, তোমায় ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। মেয়েটার মা নেই, কোনোদিন কোনো ব্যাপারে না বলতাম না, সেদিনও বলিনি। মিথ্যে বলব না, জামাই হিসেবে তোমায় আমার দারুণ পছন্দও হয়েছিল। অথচ বিয়ের বছর পাঁচেকের মাথায় একদিন হুট করে এসে মেয়ে বলল, আর পারছি না, বাবা। ওর সঙ্গে দিনের পর দিন ঘর করা অসম্ভব ব্যাপার। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। আমি দেখলাম, মেয়েটা একাই এসেছে, নিজের কচি ছেলেমেয়েদেরও আনেনি। আমি ভাবলাম, ছোটখাটো ঝগড়া, দুদিনে রাগ পড়ে যাবে। দিন গেল, মাস গেল, বছর ঘুরতে চলল, মেয়ে দেখি ফেরার মোটে নাম করে না। আমি ভাবতাম, এত কীসের অভিমান, নিজের সন্তানদের জন্যেও ফিরতে পারছে না! আমি দু-এক বার বোঝানোর চেষ্টা করলে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত, ঘোড়ায় চেপে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত, আবার রাগ পড়লে ফিরে আসত। তোমার বাড়ির দিকে ভুলেও পা বাড়াত না।"
"জানেন, বাবা, আমাদের মধ্যে কিন্ত কোনো ঝগড়াও হয়নি তখন। আমার কোনো ধারণাই ছিল না ও কোনো দিক দিয়ে অসুখী। এখনও ভাবলে বড় লজ্জিত বোধ করি।"
"লজ্জা পাওয়ার কারণ নেই, বাবাজীবন। ওর বানানো ওই বেবিসিটিং রোবট - ইট ওয়াজ পিওর জিনিয়াস! তাছাড়া আমার ধারণা তোমার স্ত্রী তাকে শুধু বেবিসিটার হিসেবে প্রোগ্রাম করেনি। নইলে এতদিন ধরে তোমার মতো সমঝদার ছেলে বুঝতেই পারল না, তোমার স্ত্রী বাড়ি নেই, গৃহিণীর মতো করে যে তোমার সংসার সামলাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের যত্ন করছে, সে হুবহু একরকম দেখতে এক যন্ত্রমানবী?"
"অনেক কিছুই বুঝিনি সেদিন, বাবা, ওর মুখ, ওর স্পর্শ, ওর কন্ঠস্বর...এমনকি ঘাড় ঘুরিয়ে অপাঙ্গে দেখার ভঙ্গি সব যেন অবিকল আপনার মেয়ে! এত সুন্দর, কোমল, কমনীয়... সব একটা নিষ্প্রাণ যন্ত্র?" লজ্জিত হয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন সূর্যকুমার। "আমি ওই রোবটকে দিনের পর দিন সঞ্জু ভেবেছি, স্বামী-স্ত্রীর মতোই জীবন যাপন করেছি তার সঙ্গে। বুঝবই বা কী করে? আচ্ছা, কোনোদিন শুনেছেন, যন্ত্রমানবীর প্রজনন ক্ষমতা থাকে? ন’মাস গর্ভে ধারণ করে সন্তানের জন্ম দিতে পারে?"
"তোমার স্ত্রীর তো তখনই টনক নড়ল। এতটাই উন্নত মানের রোবট, দেখা গেল সে আর প্রোগ্রামিং-এর তোয়াক্কা করছে না, নিজের সন্তানকে রক্ষা করতে একটা মাতৃসুলভ ইনস্টিংক্ট চলে এসেছে তার মধ্যে! আর তখন সে তোমার বড় ছেলেমেয়েদের প্রতি তার প্রাথমিক দায়িত্বও পালন করছে না!"
"অসম্ভব অশান্তি তখন বাড়িতে। আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না একজন মা তার সন্তানদের মধ্যে কেন এমন ভেদাভেদ করছে!" সূর্যকুমার শেষ চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখেন। "ধর্ম আর যমুনা মায়ের কাছে পাত্তা না পেয়ে আমার কাছে এসে নালিশ করত, কাঁদত, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকতাম। ভাগ্যিস সঞ্জু তখন ফিরে আসে! সে দিন বিকেলে সে এক দৃশ্য বটে! ঘরের এক দিকে সঞ্জু, রাগে ফুঁসছে, অন্যদিকে বাচ্চাকে কোলে আঁকড়ে ধরে সঞ্জুর কার্বন কপি রোবট তার স্রষ্টা এবং মালকিনের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে--দেখে আমার তো বাকরুদ্ধ অবস্থা! সঞ্জুই তখন খুলে বলল সব কিছু।”
“হুঁ। কী বলেছিল সে তোমায়?”
“কী আর বলবে? যত রাগ অভিমানের কথা!” সূর্য হেসে ফেলেন। “আমি নাকি পৃথিবী উদ্ধার করতে ব্যস্ত সারাদিন, বাইরের কাজ থেকে একমুহূর্ত ছুটি নিয়ে পরিবারকে টাইম দিই না, সামান্য যেটুকু সময় ঘরে থাকি শুধু তেজ দেখাই, এক হাতে সংসার আর ছেলেমেয়ে সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত সঞ্জু সাময়িক বিরতি চেয়েছিল। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি না হওয়ায় নিজের মতো দেখতে এই রোবট বানিয়ে তার হাতে সংসার সন্তান সব কিছুদিনের জন্য তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল একটা ভেকেশনের উদ্দেশ্যে। আপনার ল্যাবরেটরির উন্নত যন্ত্রপাতির সাহায্যে দূর থেকেই কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করত সে ওই রোবটটাকে। তবে একটা পর্যায়ের পর সেই রিমোট কন্ট্রোল বোধহয় আর তেমন কার্যকরী হচ্ছিল না, সঞ্জুও বোধহয় একটু গা ঢিলে দিয়েছিল। তখনই ঘটল যত অনাসৃষ্টি! জানেন বাবা, এত সব জল গড়ানোর পরও সঞ্জু ফিরে এসে এই রোবোটিক বেবিসিটারকে রিপ্রোগ্রাম করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সমাজসংসারের সব কম্যান্ড-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেই যন্ত্ররমণীর নিজের সন্তানকে ভালবাসার গ্লিচটা ফিক্স করা সেদিন ওর মত দুর্দান্ত ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। রোবটটাকে চিরকালের মত শাটডাউন করতে হয়েছিল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্তানকে আঁকড়ে ছিল সঞ্জুর রোবট, কী অদ্ভুত, কী অবিশ্বাস্য রকমের করুণ সে দৃশ্য!”
“ঠিক করে ভেবে বলো তো বাবাজীবন, সানির মাকে, মানে এই যন্ত্রটিকে কি তুমি ভালোবেসে ফেলেছিলে?” বিশুবাবু জামাইয়ের গেলাসে আরও একটু পানীয় ঢেলে দেন।
“এর উত্তর আমার জানা নেই, বাবা। আমি তো ওকে সঞ্জুই ভেবেছি চিরদিন। এমনকি সব জানার পর সঞ্জুর ওই মেধা, ওই ইন্টেলেক্ট-এর প্রেমে পড়েছি নতুন করে, ও যে আমার সঞ্জুরই প্রতিরূপ! সানির মা, ধর্মের মা, দুজনেই আমার কাছে এক, অভিন্ন।”
"বুঝলাম! যেমন জিনিয়াস আমার মেয়ে, তেমন সৃষ্টিছাড়া তার আবিষ্কার! জানো, এর পর থেকে চিরকালের মত এসব এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে দিয়েছে সে, তোমার সংসারেই ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে। আজও যদি ওই ল্যাব-এর কাজের সঙ্গে যোগাযোগ থাকত হয়তো আরো কোনো বড় আবিষ্কার...” গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে বিশুবাবুর। “মাঝখান থেকে বোধহয় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেলো তোমার সানির। যন্ত্রমানবীর সন্তান ওইটুকু বয়সে মাতৃহারা হলো চিরদিনের মত, আমার মেয়েটা পারল না তাকে সহানুভূতির সঙ্গে আপন করে নিতে, একবারও ভাবল না, পরোক্ষভাবে সানি ওরই মানসপুত্র। ছেলেটা বোধহয় ছোটবেলা থেকেই একটু অন্য ধরনের, ওর বয়সি আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত নয়, তাই না?"
"ঠিক জানি না, বাবা। ওর জ্ঞানবুদ্ধি যথেষ্ট ভালো, তবু কেমন যেন একগুঁয়ে, একরোখা। তার উপর দেখতে একটু অন্যধরনের, ওর বায়োলজিটাও তো আমাদের বোধের বাইরে! নিজের মনে চুপচাপ থাকে, কাক-শকুন পোষে, কেউ যদি ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তাদেরও অভিজ্ঞতা তেমন ভালো হয় না। কিছুদিন পর পরই কোনো না কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে সবাইকে দূরে সরিয়ে দেয় সানি, বলে ওদের এখনও জীবনে অনেক শিক্ষার বাকি আছে, বন্ধু হিসেবে আমি ওদের শিক্ষার পথ খুলে দিলাম। বেশ কবার এমন হওয়ার পর সানিকে আজকাল সবাই একটু এড়িয়েই চলে। ভয় পায় বোধহয়।"
"হুঁ। নিউরোডাইভার্জেন্স নিয়ে আমাদের ধারণাই বা কতদূর! কিংবা ওর প্রসূতি যন্ত্র ছিল বলেই হয়তো ওর চরিত্রে এমন এক যান্ত্রিক আবেগহীনতা! আমার তো মনে হয় সানিকে কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলে...তোমার যমজ ছেলেদুটো যখন এত প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, সানির সমস্যাগুলো তখন বোধহয় ওরাই ভালো বুঝতে পারত। অথচ দেখো, সঞ্জুর মত ওরাও সৎভাইকে তেমন পছন্দ করে না, ওকে বোঝার চেষ্টা তো দূর অস্ত! আচ্ছা সুয্যি, এই সানি, থুড়ি, শনি নামটা কি ওর মায়ের দেওয়া? তার কি নামকরণ করবার মত চিন্তাশক্তি ছিল?" একনাগাড়ে কথা বলার পর বিশুবাবু অন্যমনস্কভাবে নিজের পানপাত্রে একটা লম্বা চুমুক দেন। চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ।
নিশ্চুপে ইতিবাচক ভাবে ঘাড় নাড়েন সূর্য।
"যাক গে, অনেক গুরুগম্ভীর আলোচনা হলো এতক্ষণ। আমি বরং কিচেনে গিয়ে দেখি ঘেঁটুর রান্না কত দূর। অবশ্য আমার রান্নাঘরে যা সব অ্যাপ্লায়েন্স আর ডোমেস্টিক হেলপার রোবট রয়েছে, তাতে এক ঘণ্টায় পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন নামিয়ে দেওয়া ঘৃতাচির পক্ষে কোনো ব্যাপার নয়।"
রোবট শব্দটা শুনে নিজের অজান্তেই একটু চমকে ওঠেন সূর্যদেব। অস্বস্তিটা চোখ এড়ায় না শ্বশুর বিশ্বকর্মার।
"ভয় নেই, সূর্য। এরা অতি সাধারণ রোবট, সংজ্ঞার তৈরি ছায়া ভার্সন ওয়ান পয়েন্ট সিক্স-এর মত হাই-টেক নয়। তুমি বসো, আমি খাবারগুলো নিয়ে আসি।" বিশ্বকর্মা ট্রে নিয়ে উঠে দাঁড়ান। "আর তোমার ড্রাইভার, অরুণ না কী যেন নাম, ওকেও কিন্ত বলে দিও খেয়ে যেতে। সংজ্ঞা, ধর্মরাজ যম, যমী, শনি, অশ্বিন, রেবন্ত - সবার নেমট্যাগ লাগিয়ে তাদের পছন্দসই খাবার ঘৃতাচি টিফিন ক্যারিয়ারে গুছিয়ে দিয়েছে, ওগুলো নিয়ে যেতে ভুলো না যেন।"
—
পুনশ্চ: প্রচলিত কিছু পৌরাণিক নেপথ্যকাহিনী
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞা বা সঞ্জনা সূর্যদেবের প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাঁকে বিবাহ করেন। সুখী দাম্পত্য জীবনে আসে সন্তান - জ্যেষ্ঠপুত্র মনু, যমজ সন্তান ধর্মরাজ যম আর যমুনা বা যমী। অতঃপর সূর্যদেবের প্রখর তেজ সহ্য করতে না পেরে সংজ্ঞা সৃষ্টি করেন নিজের প্রতিবিম্ব স্বরূপা “ছায়া”কে। ছায়ার হাতে স্বামী, সন্তান, সংসারের ভার তুলে দিয়ে তিনি সূর্যের গৃহত্যাগ করেন। সূর্য ছায়াকে সংজ্ঞা ভেবে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন, জন্ম নেয় শনি। নিজের সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব জন্মায় ছায়ার, অচিরেই সংজ্ঞার সন্তানদের কপালে জোটে অবহেলা, অত্যাচার। যম বুঝতে পারেন, জন্মদাত্রী মা কখনও সন্তানদের সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করে না। অবশেষে ছায়া সূর্যের কাছে সব কথা স্বীকার করেন, সূর্য সংজ্ঞাকে সংসারে ফিরিয়ে আনেন। বিশ্বকর্মা কন্যা ও জামাতার দাম্পত্যজীবনে শান্তি ফেরানোর উদ্দেশ্যে সূর্যের তেজ খণ্ডিত করেন ও সেই উদ্বৃত্ত তেজঃপুঞ্জ দিয়ে বিবিধ দৈব অস্ত্র নির্মাণ করেন।
বিশ্বকর্মা ও অপ্সরা ঘৃতাচির সন্তান নল রামায়ণে রামচন্দ্রের বানরসেনার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাম রাবণের যুদ্ধের সময়ে নল দক্ষিণ ভারতের ধনুষ্কোটির সঙ্গে লঙ্কার সংযোগ স্থাপনার্থে রামসেতু নির্মাণ করেছিলেন।
সূর্যের সপ্তাশ্ব বিশিষ্ট রথের চালক অরুণ (গরুড়ের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)।
দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয় আর রেবন্তও সূর্য ও সংজ্ঞার সন্তান ।