ডাখাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, জার্মানি
আমেরিকায় একটা ট্র্যাডিশন আছে—হাইস্কুল শেষ করে কলেজ শুরু করার আগে ছেলেমেয়েরা দু'তিন মাস, ব্যাকপ্যাক পিঠে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ইয়োরোপে কাটিয়ে আসে। হাতে বেশি পয়সা না থাকলে পায়ে হেঁটে, সাইকেল বা বাসে যায়। রাতে ট্রেনে ঘুমিয়ে হোটেলের পয়সা বাঁচায়। এরকম একটু কষ্ট করাটা ওই বয়সে কিছুই নয়। অ্যাডভেঞ্চার বলেই মনে করে। এইভাবে অন্যান্য দেশের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও উদার হয়।
আইফেল টাওয়ার
আমাদের ছাত্রাবস্থায় তো আর সেরকম সুবিধা ছিল না। তাই বড়ো বয়সে ঠিক করলাম ওইরকম এলোমেলোভাবে ইয়োরোপে ঘুরব। ততদিনে (১৯৮৯) মেয়েরাও দশ-বারো বছরের হয়ে গেছে। তাই ওদেরও সঙ্গে নিলাম। কোনো ট্যুর কোম্পানি বা গাইডের সাহায্য না নিয়ে, নিজেরাই ঠিক করলাম কোথায় কোথায় যাব, কী কী দেখব। মেয়েদের ইতিহাসে খুব শখ, যত রক্তাক্ত ততই মজার। আর ইয়োরোপে তার কোনো কমতি নেই। বড়ো শহরে দ্রষ্টব্য অনেক কিন্তু হোটেলে থাকার খরচ প্রচুর, তাই শহরের বাইরে ছোট বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে (এখনকার এয়ার-বিএনবি-র মতোই) থাকার ব্যবস্থা করলাম। প্রথম দু-একটা জায়গায় তারিখ ধরে রিজার্ভ করতে পেরেছিলাম কিন্তু তারপর আমাদের তারিখের ঠিক ছিল না, তাই গাইডবই দেখে শহরে পৌঁছে খোঁজাখুঁজি করতে হত। যাতায়াতের জন্য একটা ভ্যান ভাড়া করেছিলাম। আর নানা দেশের ম্যাপ। তখন তো আর GPS ছিল না। নিজেরাই ড্রাইভার।
প্রথমে ইংল্যান্ডে মেয়েদের খুশি করতে কিছু 'রক্তাক্ত ইতিহাস' দেখা হল—লন্ডন টাওয়ার বেশ রক্তাক্ত। সঙ্গে যোগ দিলেন আমার দেওর, জা ও দুই সমবয়সী ছেলেমেয়ে। আট জনের গ্রুপ। একটা বড়সড় ভ্যান ভাড়া করলাম— শুধু মনে ছিল না যে ইংল্যান্ডের গাড়ির স্টিয়ারিং উলটোদিকে। তাই নিয়ে ইয়োরোপের অচেনা রাস্তায় চলাটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস! বিশেষ করে গোল চক্করে পড়লে।
আমাদের হাতে ছিল মাস খানেক সময় আর লিস্টে ছিল ফ্রান্স, জার্মানি, লিখটেনস্টাইন, লুক্সেমবুরগ, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও হল্যান্ড। ইচ্ছা ছিল সুইটজারল্যান্ড, ইটালি, গ্রীস ও স্পেন দেখারও—কিন্তু অত সময় ছিল না আর বাচ্চাদের নিয়ে অতদিন বেড়ানোও যায় না। তাই বাকি দেশগুলো রয়ে গেল, পরে একটু একটু করে সব কটাই দেখেছি।
নোতর দাম গির্জা
নিজেদের গাড়ির মস্ত সুবিধা যেখানে ইচ্ছে যতক্ষণ খুশি থামতে পারতাম। রাস্তার ধারে, পার্কে পিকনিক লাঞ্চ করতাম। আমার দেওরের ছোট মেয়ের আবার পোকামাকড়ে ভীষণ ভয়। একটা পিঁপড়ে, মাছি বা মৌমাছি কাছে এলেই সে কাঁদতে শুরু করে। তার ভাইবোনেরাও তাকে সর্বক্ষণ খ্যাপাত। এই ট্রিপের শেষে, দায়ে পড়েই, ওর পোকার ভয় অনেকটা কমে গেছিল।
এছাড়াও, আমার দেওরানির আবার কাঁটায় কাঁটায় বিকেল চারটেয় চা খাওয়ার ইংরেজি অভ্যেস। তাই, যে দেশেই থাকি না কেন, বিকেল চারটেয় গাড়ি থামিয়ে চা-পান আমাদেরও অভ্যেস হয়ে গেল। এসব তো আর কোনো গ্রুপ ট্যুরে করা যায় না।
এই বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়ানো বেশ উপভোগ্য। ওরা স্কুলে ইয়োরোপীয় ইতিহাস পড়েছে। রক্তাক্ত চ্যাপ্টারগুলো ওদের বিশেষ প্রিয়। রাজা হেনরির বউদের শিরশ্ছেদ, ফ্রান্সের বিপ্লব ও আরও মাথা কাটা, জার্মানির পাগল রাজা লুডভিগের দুর্গ, সারা মহাদেশে দুই বিশ্বযুদ্ধের ছড়ানো চিহ্ন, এইসব ছিল ওদের লিস্টে। এসবের তুলনায় আমেরিকার ইতিহাস তো নিতান্তই জোলো। মাত্র আড়াই শ' বছর বয়সের!
আমার তখনো পাখি দেখার শখ মাথায় চাপেনি, তাই মিউজিয়াম দেখা ও ফোটো তুলতেই ব্যস্ত ছিলাম। আমার জায়ের কিন্তু বিরাট শপিং লিস্ট। নিজের গাড়ি থাকায় যত খুশি কেনাকাটা করা যায়। দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি ভরে উঠল ব্ল্যাক ফরেস্টের কুকু ক্লক, ফ্রান্স ও জার্মানির ওয়াইনের বোতল, বেলজিয়ামের লেসের কাপড়, নানা দেশের সুভেনির, অন্যান্যদের জন্য উপহার, আরও কত কী। আমার অবশ্য আমেরিকায় ফিরতে হবে বলে শপিং লিস্টটা খাটো করতে হয়েছিল।
নোতর দামের ছাতে গারগয়েলের মূর্তি
এইভাবেই এলোমেলো ঘুরেছি আর অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরিয়েছি। কিছু তিক্ত, বেশিরভাগই মধুর, তারই কিছু বর্ণনা দিলাম। এতদিন পরে দিনক্ষণ আর রাস্তাঘাটের ডিটেল মনে নেই কিন্তু অনেক স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল।
পশ্চিম ইয়োরোপে আমাদের প্রথম পদার্পণ ফ্রান্সে। ডোভার থেকে ক্যালে এলাম গাড়িসুদ্ধু ফেরিতে তুলে। তখনো চানেল তৈরি হয়নি। ইংল্যান্ডের দোকানিরা আমাদের সাবধান করল, "ফ্রান্সে যাচ্ছ? ওখানে জল খুব নোংরা, কিছু বিয়ার নিয়ে যাও।" ফেরত আসার সময় ফ্রেঞ্চ দোকানিরা উপদেশ দিল, "ইংল্যান্ডের জল ভীষণ খারাপ, যতগুলো পারো ওয়াইনের বোতল নিয়ে যাও।" শুনে আমাদের খুব মজা লাগল। এরকম ইংল্যান্ড-ফ্রান্স রেষারেষি আমি পরেও অনেক জায়গায় দেখেছি।
প্যারিসে ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাতে গিয়ে, প্রথম দিনেই রাস্তা হারিয়ে এক আলজিরিয়ান পাড়ায় গিয়ে পড়েছিলাম। চারিদিকে ভয়াবহ মুশকো চেহারার লোকেরা আমাদের গাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। হঠাৎ দেখি ওরা মুচকি হাসছে। গাড়ির পিছনের জানলা খুলে আমার ছোট মেয়ে এদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছিল। বাচ্চাদের জন্যই আমরা বেকসুর ছাড়া পেয়ে গেছিলাম। একলা হলে ব্যাপার হয়তো অন্যরকম হতো।
অ্যান ফ্রাঙ্ক
ফ্রান্সে রাস্তা হারালে কোনো শ্বেতাঙ্গ ফরাসিকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ইংরেজি বললে তারা এমন মুখ করবে যেন কিছুই বোঝে না। আমাদের বাচ্চারা স্কুলে ফ্রেঞ্চ শিখেছে তবু তাদের কথা শুনে সবাই ব্যাজার মুখে তাকায় যেন সোয়াহিলি শুনছে। আমি আর রীতা হিন্দিতে গজগজ করছি শুনে জিজ্ঞেস করল আমরা কোথা থেকে আসছি। ইন্ডিয়া শুনে একেবারে গদগদ। হঠাৎ সবার ইংরেজি মনে পড়ে যায় আর আমাদের ঠিক রাস্তা দেখিয়ে দেয়। ভাষা নিয়ে এরকম স্নবারি শুধু ফ্রেঞ্চরাই পারে।
প্যারিসে দ্রষ্টব্যগুলো সব দেখলাম। আইফেল টাওয়ারে চড়লাম, নোতর দামের ছাতে গারগয়েল মূর্তিগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিল—নিচে তাকিয়ে যেন বলছে, ‘ইস, শহরটার কী অবস্থাই করেছ!' এসব কত গল্পে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি। চাক্ষুষ দেখে অভিভূত হতেই হয়। বিশাল ল্যুভ মিউজিয়াম তো দেখে শেষই করা যায় না। তবে মোনা লিসা দেখে সবার মতোই হতাশ হয়েছিলাম। এইটুকু ছবি, মোটা বুলেটপ্রুফ কাঁচ দিয়ে ঢাকা, আর তার সামনে কী প্রচণ্ড ভিড়! আরেকটা হতাশা, সেই গিলোটিনের জায়গাটা এখন আর দেখা যায় না। রাস্তা বানিয়ে ফেলেছে, যেন ওই স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়। আমার মেয়েরা হতাশ হল।
আমার মনে হয়েছিল ফ্রান্সের সবকিছুই ভালো শুধু ওই নাক-উঁচু ভাব ছাড়া। তাদের ভাষা, খাবার, ইতিহাস, আর্ট, সংগীত, ওয়াইন সবকিছুতেই স্নবারি আমায় ক্লান্ত করে তুলেছিল। ফ্রান্সের বাইরে, অন্য দেশেও আমি ফরাসিদের এইরকম আচরণ দেখেছি, ফ্রেঞ্চ ক্যানাডাতে —এমনকি সুদূর মাডাগাস্কারের বিখ্যাত পাস্তুর ইন্সটিটিউটেও, ফরাসি ডাক্তারদের দেশের লোকের প্রতি অদ্ভুত উদাসীনতা, আর আমাদের একটুও সাহায্য না-করা আমায় ক্ষুব্ধ করেছিল।
প্যারিসে শেষদিনে আমরা সবাই একটা নামী রেস্তরাঁতে খাব ঠিক করেছি। হাতে খুচরো ফ্রাঁ নেই। (তখনো ইউরো চালু হয়নি।) জিজ্ঞেস করতে বলল ক্রেডিট কার্ড চলবে। চর্ব্যচোষ্য খেয়ে বিল দিতে গিয়ে দেখি কার্ড নেবে না, নগদ চায়। এখন কী করি? আশপাশে কোনো ব্যাঙ্ক বা এটিএম-ও খোলা ছিল না। ভাবলাম আমাদের কপালে ডিশ-প্লেট ধুয়ে বিল মেটাতে হবে। তর্ক করেও কোনো লাভ হল না। ভয়ে, চিন্তায় বাচ্চাদের কাঁদোকাঁদো মুখ। শেষে এক ম্যানেজার এসে গোমড়ামুখে কার্ড নিতে রাজি হল। তাও ব্রিটিশ কার্ড চলবে না, অনেক গাঁইগুই করে আমেরিকান কার্ড নিল। ... সেই নিল ঠিকই শুধু মাঝখান থেকে আমাদের শেষ ফিষ্টটা মাটি করে দিল।
প্যারিস থেকে গাড়ি চালিয়ে পূর্বে জার্মানিমুখো হলাম। পথে পড়ল বিখ্যাত, পুরনো ফ্রেঞ্চ ওয়াইনারিগুলি, যাদের জন্য ফ্রান্সের এত নাম। মাটির নীচে গুহায় হাজার হাজার মদের পিপে, নানা সাইজের, নানা বয়সের। ভিতরে যাতায়াতের জন্য ট্রাম লাইন পাতা। এইখানেই বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি বিপ্লবীরা জার্মানদের চোখের আড়ালে ঘাঁটি তৈরি করেছিল। আমরাও কিছু ওয়াইন কিনলাম আর টেস্ট করলাম। ফ্রান্সে ছোটদের একটু মদ্যপানে আপত্তি করে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা একটু খেয়েই মাতালের মতো টলবার ভান শুরু করল আর আমরা তাদের মদ খাইয়েছি বলে ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে নালিশের ভয় দেখাল।
ল্যুভ মিউজিয়াম
ফ্রান্সের পর ইয়োরোপে আর কোথাও ভাষা নিয়ে কোনো গোলমাল হয়নি। জার্মানিতে সবাই আগ বাড়িয়ে ইংরেজিতে কথাবার্তা শুরু করে দেয়, তাই আমার দুর্বল জার্মান বলার সুযোগও পাইনি। জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টে কোনো হোটেলে জায়গা না পেয়ে ধরাধরি করে একজনের বাড়িতে একটা ঘর পেয়েছিলাম। মেঝেতে সবাই মিলে ঢালাও বিছানা। সঙ্গে বাচ্চাদের দেখে গৃহিণী সাহায্যে তৎপর হয়ে উঠলেন। গরম গরম স্টু, সঙ্গে মোটাসোটা জার্মান সসেজ। বিছানায় আইডার হাঁসের পালক ভরা বিরাট লেপ। সেই জার্মান আতিথেয়তা এখনো মনে আছে।
ফ্রান্সের বিখ্যাত ওয়াইনারি
ব্ল্যাক ফরেস্টে রীতার কুকু ঘড়ি কেনা হল। আর আমার প্রিয় জার্মান ওয়াইন, (ফরাসিদের থেকে অনেক ভালো, আমার মতে)। খুব কৌতূহল ছিল অটোবান হাইওয়েতে গাড়ি চালাবার। শুনেছিলাম কোন স্পীড লিমিট নেই, হু=হু করে যথেচ্ছ গতিতে গাড়ি চলে। কিন্তু কার্যকালে হতাশ হতে হল। মাত্র দুটো লেন, ডাইনে চালাবার আর বাঁয়ে পাশ কাটাবার। দুই লেনেই এত ভিড় যে স্পিড তোলাই যায় না। আমেরিকার পশ্চিম প্রদেশগুলির বিরাট, চওড়া খোলামেলা হাইওয়ের সঙ্গে তুলনাই হয় না।
আল্পস পর্বতমালা, অস্ট্রিয়া
জার্মানিতে মেয়েদের প্রিয় দ্রষ্টব্য ছিল 'পাগল রাজার দুর্গ'। রাজা লুডভিগের মাথার গোলমাল ছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু পাহাড়ের চূড়ায় দুর্গটি বানিয়েছিলেন খাসা। নয়শোয়ানস্টাইন নামক গম্বুজধারী দুর্গটির পরে কপি করা হয়েছে ডিজনীল্যান্ডের প্রতীক স্লিপিং বিউটির প্রাসাদে।
মিউনিখে দু'তিন দিন কাটিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ছেলেমেয়েদের ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটা দেখাব। (রক্তাক্ত ইতিহাসের পালা) এটাও এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক জায়গা। মিউনিখের খুব কাছেই। বইয়ে পড়া ও ছবিতে দেখার পর আমার কৌতূহল ছিল প্রথম ক্যাম্পটা দেখার জন্য। প্রথমেই দেখলাম গাইড বইয়ে বা ম্যাপে উল্লেখ নেই! কাউকে জিজ্ঞেস করলে আবছা উত্তর দিয়ে পাশ কাটায়। যেন আমাদের সেখানে যেতে দিতেই চায় না। শেষে অনেক ঘোরাঘুরির পর পৌঁছলাম কাঁটাতার ঘেরা গেটের সামনে। এটাই প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, আর এখানে বন্দীদের উপর সবথেকে বেশি ডাক্তারি এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ৪১,৫০০ ইহুদী বন্দীদের মারা হয়েছিল ওভেন চুল্লি আর গ্যাস চেম্বারে। সেই ওভেনগুলি এখনো আছে। ক্যাম্পের পাশেই রেল লাইন পাতা, যাতে করে হাজার হাজার স্ত্রী, পুরুষ, শিশুদের আনা হয়েছিল। ভিতরে ঘুপচি ঘরের মধ্যে থাকে থাকে বাঙ্ক বিছানা। সবথেকে আশ্চর্য লেগেছিল অফিস ঘরে সারি সারি লম্বা খাতায় নির্মম এক্সপেরিমেন্ট চালানোর বিবরণ! প্রত্যেকের নাম, ধাম, বয়স, কীভাবে টর্চার করা হয়েছিল, মরতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল সবকিছু খুঁটিনাটি লেখা। পড়তে পড়তে মন হিম হয়ে আসে। কীভাবে মানুষ প্ল্যান করে এরকম অমানুষিক অত্যাচার চালায় আর তা গর্বভরে খাতায় লিখে রাখে, ভাবাই যায় না। ক্যাম্প দেখে বাচ্চারাও বেশ গম্ভীর হয়ে গেছিল কিন্তু তাছাড়া কোনও বিশেষ কষ্ট দেখিনি। আমি কিন্তু পুরো দুদিন মনোকষ্টে ছিলাম। পরে ঘানায় ক্রীতদাস দুর্গ দেখেও ওই অবস্থা হয়েছিল। এতো কষ্ট আমার সয় না।
রাইন নদী, জার্মানি
নেক্সট দেশ অস্ট্রিয়া। ভিয়েনায় হফবার্গ রাজপ্রাসাদ দেখার পড় ক্লান্ত শরীরে রাস্তার পাশে ক্যাফেতে বসে বিখ্যাত কফি ও কেক খেতে খেতে মনে হচ্ছিল এ-ই ভ্রমণের সুখ। আমাদের সবার প্রিয় মোৎসার্টের জন্মভূমি সালজবার্গে যেতেই হল। মেয়েরা সবে পিয়ানোয় মোৎসার্ট শিখছে। তাদেরও খুব উৎসাহ। মোৎসার্টের ছোটবেলার বাড়িতে তাঁর দেড় হাত চওড়া পিয়ানোটা দেখে ভাবতে চেষ্টা করি কীভাবে ওই ছোট্ট পিয়ানো থেকে এমন কালজয়ী স্বর্গীয় সঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছিল! দু'সপ্তাহ পরেই সালজবার্গে বিখ্যাত বার্ষিক মোৎসার্ট ফেস্টিভাল। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পীরা এসেছেন। হোটেলগুলো সব ভর্তি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমরা পাশের বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে বেহালা বা পিয়ানোর টুং-টাং শুনতে পেতাম। ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার সঙ্গতি ছিল না তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছিলাম আর কি।
বীয়ার হল, মিউনিখ
দুটি ছোট ছোট দেশ, লুক্সেমবুরগ ও লিখটেনস্টাইন, বিশেষ কিছু মনে নেই। সবুজ ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা, মাঝেমধ্যে কোন দুর্গের উঁচু চূড়া, কিছু শপিং, রেস্তরাঁ। একদিনেই ড্রাইভ করে পার হওয়া যায়। সেসময় বেনেলাক্স বলে একটা ভিসা পাওয়া যেত— বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুকসেমবার্গ তিনটি দেশ একসঙ্গে। (ভারতীয় হওয়ার দরুন আমাদের প্রত্যেকটি দেশের ভিসা আলাদা আলাদা করে জোগাড় করতে হয়েছিল। সেও এক ঝামেলা।) লুক্সেমবার্গ দিয়ে বেলজিয়ামে ঢোকার সময় অফিসাররা আমাদের পাসপোর্টে ছাপ মারতে ভুলে গেছিল, আমরাও খেয়াল করিনি। বেলজিয়ামে প্রচুর লেস ও চকোলেট কিনে, হল্যান্ড হয়ে বেরুবার সময় ধরল— স্ট্যাম্প নেই মানে আমরা ঢুকিনি, তাহলে তো বেরবার প্রশ্নই ওঠে না! জটিল সমস্যা। অনেক মাথা ঘামিয়ে, মাথার চুল খামচিয়ে, শেষে বাচ্চাদের করুণ মুখ দেখে দয়া করে দেশ ছাড়বার অনুমতি দিল। বাচ্চাদের সঙ্গে ভ্রমণের কত সুবিধে!
অ্যামস্টারডাম আমার প্রিয় শহর। ছবির মতো সাজানো, পরিষ্কার, ক্যানাল ও সাইকেলে ভরা। আমেরিকার লোকেরা সাইকেলের বদলে গাড়ি চালিয়ে পেট্রলের অপচয় করে। কোপেনহাগেনেও দেখেছি গাড়ির বদলে সাইকেলের ভিড়। এখানে রাইকস মিউজিয়ামে আমার প্রিয় শিল্পী ভ্যান গখ আর রেমব্রার পেইন্টিং দেখে মুগ্ধ হলাম। তাঁর বিখ্যাত 'নাইটওয়াচ' তো হাঁ করে দেখবার মতো! রেমব্রান্ট আমার সবথেকে ভালো লাগে, দ্য ভিঞ্চি, বতিচেল্লি, এমনকি মিকেলেঞ্জেলোর থেকেও। তবে মিকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্যশিল্প সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর পিয়েতার তুলনা হয় না।
পাগল রাজার দুর্গ
আমস্টারডামে আরেকটি লক্ষণীয় মিউজিয়াম— অ্যান ফ্রাঙ্কের বাড়ি। সেই বিখ্যাত ডায়েরি লেখিকা। এটা আমার বড়ো মেয়ের মনে খুব ছাপ ফেলেছিল। সে তখন ১৩-১৪ বছর— ঠিক অ্যানেরই সমবয়সী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইহুদী অ্যান ও তার পরিবার পুরো দুবছর এই ছোট্ট চোরাকুঠুরির মধ্যে জার্মানদের হাত থেকে লুকিয়েছিল। তার লেখা দিনলিপি এখন ক্লাসিক ও সর্বপাঠ্য।
হল্যান্ডে টিউলিপ ফুল দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমরা গেছিলাম গরমের সময়। টিউলিপরা দুমাস আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবে একটা নতুন খাবার পেলাম— রিস্তাফেল। এটা ডাচ উপনিবেশ ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত। ঠিক ইংল্যান্ডে ভারতীয় কারির মতোই। মজার কথা, ইন্দোনেশিয়ার কোথাও আমি রিস্তাফেল দেখিনি, শুধুমাত্র হল্যান্ডেই। রিস্তাফেল এক বিরাট ব্যাপার—এর মানে রাইস ডিশ। এক প্লেট ভাতের চারপাশে প্রায় চল্লিশটি প্লেট ও বাটি-ভর্তি নানারকম খাবার—নারকোলের কারি, ঝাল-দেওয়া সবজি, লঙ্কা-পেষা আচার, বীফ ও মুরগির পদ, আরও কত কি। আমরা আট জনে মিলে একটা অর্ডার শেষ করতে পেরেছিলাম।
সাইকেল ও ক্যানাল -আমস্টারডাম
ইংল্যান্ডে ফেরার পথে ইংলিশ চ্যানেলে ঝড়ের দেখা পেলাম। এর সম্বন্ধে আমি আগেও পড়েছি। এতটুকু সমুদ্রেই এত হাওয়া, বৃষ্টি আর ঢেউ! কয়েক সেকেন্ডে আমি ভিজে চুপচুপে। আমার আত্মীয়রা সবাই সমুদ্রের দুলুনিতে কাতর হয়ে নীচের কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার সে রোগ নেই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে ঢেউয়ের দাপট দেখতে খুব ভালো লাগছিল। এটা আমার উপরি পাওনা, লিস্টে ছিল না।
ইয়োরোপের বেশ কিছু দেশ বাকি রয়ে গেছিল। তাই ফিরে গেছি বারবার—পারিবারিক কাজে, কনফারেন্সে, ভলানটিয়ার কাজে অথবা নিছক বেড়ানোর জন্য। ডেনমার্ক, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইটালি, গ্রীস, আইসল্যান্ড, স্পেন ও সুইটজারল্যান্ড। কী ভাগ্যি, রাশিয়ায় গেছি এইসব যুদ্ধের আগে। (এখন সেরকমই মনে হয় বার্মা, জেরুসালেম, চিন আর ইরান ভ্রমণ সম্বন্ধেও।) আবার কবে এরকম বেড়াতে পারব কে জানে।
মোৎসার্ট, সালসবার্গ
রাশিয়া ছাড়া সব জায়গাতেই শুধু ম্যাপ আর গাইডবইয়ের সাহায্যে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়িয়েছি। ইয়োরোপে এইটাই সুবিধের। তবে কিছু অন্য স্বাদের অভিজ্ঞতাও হয়েছে বইকি। রোমে সবাই বারবার পকেটমার থেকে সাবধান করেছিল, আমাদের রোমে কিছুই হয়নি, হল সভ্যভব্য কোপেনহাগেনে—প্রায় দুহাজার ডলার খোয়া গেল। পুলিশকে বলেও কিছু হল না। ওরা বলে ওখানে নাকি এখন বুলগেরিয়া থেকে আগত পকেটমার চোরদের ভীষণ উৎপাত। ছবির মতো সুইটজারল্যান্ড, নীল লেক ও সাদা পাহাড়ে ভরা— সেখানে দায়ে পড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে পেলাম তাচ্ছিল্য— বিদেশী, কালো রং এবং মেয়ে হবার দরুন। গ্রামীণ পোল্যান্ডে ভলানটিয়ার কাজ করার সময় বাচ্চারা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলোতো—রঙটা সত্যি কিনা দেখার জন্য, আমি বেশ উপভোগ করতাম। আর ফ্রান্সের কথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু বেশিরভাগ অভিজ্ঞতাই আনন্দের। নতুন অনেক কিছু দেখার ও শেখার। অনেক দেশের সম্বন্ধে আগেও লিখেছি 'পরবাসে'। ইটালি তো আমার সব থেকে প্রিয় দেশ। রোমে গিয়ে সত্যি মনে হয় দিল্লীতে ফিরে গেছি। সেই পরতে পরতে ইতিহাসের মোড়ক। অন্যান্য ইয়োরোপীয় দেশের তুলনায় একটু এলোমেলো, ঠিক এশিয়ার মতোই। আর আবহাওয়া, ইতিহাস, সঙ্গীত, আর্টস, খাবার সব কিছুই তুলনাহীন।
ইয়োরোপে এইরকম ঘুরে বেড়ানোটা খুব নিরাপদ ও আনন্দের। বেশিরভাগ দেশেই ইংরেজি চলে। প্রাকৃতিক আর ঐতিহাসিক ঐশ্বর্যে ভরা। আর সব জায়গার খুঁটিনাটি বিবরণ, ম্যাপ ইত্যাদি পাওয়া যায়। অবশ্য এখন তো অনলাইনে সব কিছুই নখদর্পণে।
ডানিউব নদীতে সফর
——- ভ্রমণ কাল—১৯৮৯ জুলাই-অগস্ট